স্মরণ
-
কয়েকটি সাক্ষাতের স্মৃতি
হাসনাতভাইয়ের সঙ্গে আমার প্রথম দেখা হয় মস্কোয় ১৯৮৬ সালে। বোধ করি ফেব্রুয়ারি মাসের শেষ সপ্তাহে – শীতের ঠান্ডা তখনো পুরোমাত্রায়। গণসাহিত্যের সম্পাদক হিসেবে তাঁর নামের সঙ্গে আমি পরিচিত ছিলাম, কিন্তু সরাসরি সাক্ষাৎ সেই প্রথম। মস্কোয় তখন বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত হয়ে এসেছেন সৈয়দ নাজমুদ্দীন হাশেম। তাঁরই বাসভবনে এক সন্ধ্যায় ডাক পড়ল। সেখানে এর আগেও বারকয়েক গিয়েছি। তিনি…
-
হাসনাতদা
বিশ্বব্যাপী অতিমারীর কারণে দীর্ঘকাল ধরে বাড়িতে বন্দি। এই অবসরে নিজের অসমাপ্ত কাজগুলো গুছিয়ে নেবার চেষ্টা করছি। তারপর প্রায় মাস আষ্টেক বাদে হঠাৎ একটা জরুরি কাজে শান্তিনিকেতন থেকে কলকাতায় চলেছি ভাড়া-করা বাহনে। বহুদিন পরে বিস্তীর্ণ খোলা আকাশের নিচে। চারদিকে ঝলমলে রোদ্দুর, দিগন্তবিস্তৃত সবুজ ধানক্ষেত্রের পরে তাল-খেজুরের সারি, কিছুটা দূষণমুক্ত বলে আকাশের রং ঘন নীল – অনেকদিন…
-
‘অনেক মাইল ব্যেপে পৃথিবীর রাঙা দীর্ঘশ্বাস’
নিকটজনের মৃত্যু ভিন্ন এক বেদনাদায়ক অভিজ্ঞতা। যেসব মানুষের স্নেহ-মমতা আমরা একটু বেশি মাত্রায় পাই, তাঁদের মৃত্যু বেশি আঘাত দেয়। আর সেই আঘাত এতটা গভীর হতে পারে যা আগে থেকে কিছুই অনুভব করা সম্ভব নয়। অনেক গুণী মানুষ থাকেন সমাজে যাঁদের হারালে ক্ষতি হয় সমাজদেহের, কিন্তু কিছু কিছু গুণী মানুষ থাকেন যাঁদের বিদায় শুধু যে ক্ষতিই…
-
প্রিয় হাসনাতভাই
সাতমসজিদ রোডে ছায়ানটের অপরিসর আঙিনায় জনাপনেরো নারী-পুরুষ। সকাল থেকে ঝিরিঝিরি বৃষ্টি। মাস্ক-মোড়া মুখে কয়েকজনকে চেনা-চেনা লাগলেও আমার দৃষ্টি অদূরে লাশবাহী ফ্রিজিং ভ্যানের দিকে। কিন্তু ততক্ষণে ওটার ডালা আটকানো সারা, মৃদু শব্দে ভ্যানটা পিছিয়ে মূল রাস্তায় গড়িয়ে নামতে বাকি। কে যেন এগিয়ে এসে বললেন, দেখবেন? আমি ভ্যাবাচেকা খেয়ে ঘড়ি দেখছি, এখানে তো আরো আধঘণ্টার মতো থাকার…
-
হাসনাতভাই
নবাবপুরের মাঝামাঝি পশ্চিম দিককার এক রাস্তায় মানসী সিনেমা হল। মানসী হলের নাম তখন ছিল ‘নিশাত’। এই হলের ঠিক উলটোদিকে লোহার বিশাল একটা গেট, টিনশেডের দৈনিক সংবাদ অফিস। যতদূর মনে পড়ে তখন বিল্ডিং কনস্ট্রাকশনের কাজ কিছুটা শুরু হয়েছে। ১৯৭৫-৭৬ সালের কথা। তখন দুটো দৈনিক পত্রিকার সাহিত্যপাতা অত্যন্ত জমজমাট। একটি দৈনিক বাংলার সাহিত্যপাতা, আরেকটি দৈনিক সংবাদের সাহিত্য…
-
সাহিত্য সম্পাদক আবুল হাসনাত
প্রারম্ভে কিছুটা ভণিতা। নেত্রকোনার কুমড়ি পল্লিতে আমার জন্ম হয়েছিল আমার নানাবাড়িতে। সেই বাড়িতে একটি বিশাল কোঠা ছিল। তখন প্রায় পরিত্যক্ত এই কোঠায় কাঠের একটি আলমিরা ছিল। একেবারে শৈশবে লুকোচুরি খেলতে খেলতে একদিন সেখানে লুকোতে গিয়ে আলমিরাটা খুলে ফেলেছিলাম। তখন সহসা সেখানে আমি অনেক পত্র-পত্রিকা দেখতে পাই। দেখে বেশ অবাক হই। আমার শিশুমন কিছুটা ভয়ও পায়।…
-
নীরব-সরব মানুষটি
ঢাকার বাইরে থাকি। ঢাকায় এলেই সুবীরকে (বেঙ্গল শিল্পালয়ের প্রয়াত পরিচালক সুবীর চৌধুরী) ফোন দিই : সুবীর, ঢাকায় এসেছি, একদিন আড্ডার আয়োজন করো। সাধারণত সেদিনই আয়োজনটি হয়ে যেত, কারণ সুবীরের আগ্রহ আমার চেয়ে কম নয়। আড্ডায় সস্ত্রীক আমি ছাড়া অবশ্য-সদস্য কাইয়ুম স্যার (আমার শিক্ষক হলেও পরবর্তীকালে বন্ধুসম), তাহেরা ভাবি (কাইয়ুম চৌধুরীর স্ত্রী) আর হাসনাতভাই। অনিয়মিত হলেও…
-
তিনি সম্পাদকদের সম্পাদক
আমার একটি বইয়ের উৎসর্গ-পাতায় আবুল হাসনাতের পরিচিতি এভাবে তুলে ধরেছিলাম : ‘সম্পাদকদের সম্পাদক’। বইটির পেছনে তাঁর অবদান ছিল সবচেয়ে বেশি। তবে তাঁরই আগ্রহে আমার যে আরেকটি বই বেঙ্গল পাবলিকেশন্স থেকে বেরিয়েছিল, যার বিষয়বস্তু ছিল শিল্পকলা, তার পেছনেও তো তিনিই ছিলেন অনুপ্রেরণা। সেই ১৯৭৫ সালে গণসাহিত্য পত্রিকায় কামরুল হাসানের ওপর একটা লেখা আমাকে দিয়ে না লিখিয়ে…
-
এক বিদগ্ধ রুচিমান ভদ্রলোক আবুল হাসনাত
কয়েকদিন আগে কালি ও কলম পত্রিকার সহকারী সম্পাদক আশফাক খান সাহেবের কাছ থেকে একটি ই-মেইল বার্তা পাই যে কালি ও কলম সম্পাদক আবুল হাসনাতকে স্মরণ করে একটি বিশেষ সংখ্যার পরিকল্পনা করা হয়েছে, তাতে যদি আমি ওঁর সম্পর্কে একটি ছোট লেখা লিখি – এই অনুরোধ। সঙ্গে লুভা নাহিদ চৌধুরী স্বাক্ষরিত একটি চিঠি, যা পড়ে জানতে পারলাম…
-
মিত্রমশায়, অন্য কিছু লিখুন
গত নভেম্বরের ১ তারিখে কালি ও কলম সম্পাদক, কবি, প্রাবন্ধিক আবুল হাসনাত প্রয়াত হয়েছেন নিউমোনিয়া হয়ে; শুনছি করোনা, আবার করোনা নয়। তিনি ঢাকার মানুষ। ঢাকা বিদেশ তো সত্য। ভিসা না হলে যাওয়া যায় না। আর করোনাকালে তো সেই শহর আমার এই কলকাতা শহর থেকে দূর-দূর লক্ষ আলোকবর্ষ দূরের হয়ে গেছে। বাংলাদেশ ভারত আলাদা দেশ। কিন্তু…
-
আবুল হাসনাত : দূরের ও কাছের মানুষ
‘আবুল হাসনাতভাই নেই। অবিশ্বাস্য মনে হচ্ছে। এই তো দেখা হলো গত ডিসেম্বর বাংলা একাডেমির সাধারণ সভায়। আমাদের সাহিত্যচর্চার পথে একজন অভিভাবক বিদায় নিলেন। দেখা হলেই বলতেন, লেখা দিয়েন। তিনি ছিলেন লেখক তৈরির কারিগর। সংবাদ সাময়িকীতে তিনি আমার প্রচুর প্রবন্ধ ছেপেছেন। রাজশাহী থেকে ঢাকায় গেলেই লেখক সম্মানী দ্রুত পরিশোধ করার ব্যবস্থা করতেন। কালি ও কলমের দক্ষ…
-
একদিন
একদিন দিকচিহ্নহীন বিষণ্নতায় দেখেছি নৈরাশ্য কথা বলছে ভাঙা শরীরের সঙ্গে অলীক বিশ্বাস দোল খায় তুলসীমঞ্চ ও ধ্বংসস্তূপে ঘাতকের হাতের থাবায় পূর্ণিপুকুর, দলিল দস্তাবেজ, ঘরদোর, পাঁজিপুথি উধাও হলো আর্তনাদ আর বর্বরতায় বুনো পশু ছিন্ন করলো মালতী আর মিনতির দেহের সুষমা জীর্ণ ও শীর্ণ হয়ে যন্ত্রণায় স্মৃতির পথরেখা হয়ে সীমান্তের দিকে হারিয়ে গেল ডাবল-ডেকার বাসে যে তরুণী…