কালি ও কলম তরুণ কবি ও লেখক পুরস্কার ২০১৪

নতুনেরে বাসিয়াছি ভালো

আবসার জামিল

 

সপ্তমবারের মতো ঘোষণা করা হয়েছে ‘কালি ও কলম তরুণ কবি ও লেখক পুরস্কার ২০১৪’। গত ৩০ মে শনিবার রাজধানীর বেঙ্গল শিল্পালয়ে সন্ধ্যা সাড়ে ছটায় এক অনাড়ম্বরপূর্ণ অনুষ্ঠানে বিজয়ীদের হাতে এ-পুরস্কার তুলে দেওয়া হয়। এবার তিনটি বিভাগে কালি ও কলম এ-পুরস্কার প্রদান করেছে। বিভাগগুলো হলো – ১। কবিতা, ২। ছোটগল্প ও উপন্যাস এবং ৩। প্রবন্ধ, গবেষণা ও নাটক। কবিতা বিভাগে পুরস্কার অর্জন করেছেন বৃষ্টির মাতলামি গ্রন্থের জন্য সাকিরা পারভীন, ছোটগল্প ও উপন্যাসে আমি অনিন্দিতা গ্রন্থের জন্য ফাতিমা রুমি এবং প্রবন্ধ, গবেষণা ও নাটক বিভাগে পাবনায় ভাষা আন্দোলন গ্রন্থের জন্য এম আবদুল আলীম।

জ্যৈষ্ঠের উষ্ণ সন্ধ্যায় এ-আয়োজনে প্রধান অতিথি ছিলেন বাংলা ভাষার প্রখ্যাত কথাসাহিত্যিক সমরেশ মজুমদার। বিশেষ অতিথির আসন অলংকৃত করেন বিশিষ্ট কথাসাহিত্যিক ইমদাদুল হক মিলন। অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন কালি ও কলমের সম্পাদকমন্ডলীর সভাপতি আনিসুজ্জামান। অনুষ্ঠানটির সঞ্চালক ছিলেন বেঙ্গল ফাউন্ডেশনের মহাপরিচালক এবং কালি ও কলমের সম্পাদকমন্ডলীর সদস্য লুভা নাহিদ চৌধুরী। এছাড়া অনুষ্ঠানমঞ্চে ছিলেন কালি ও কলমের প্রকাশক আবুল খায়ের ও কালি ও কলম সম্পাদক আবুল হাসনাত।

২০০৮ সাল থেকে তরুণ কবি ও লেখকদের সাহিত্যচর্চায় উৎসাহ প্রদানের লক্ষ্যে এ পুরস্কার প্রদান করে আসছে কালি ও কলম। সে-সময় থেকে ২০১৩ সাল পর্যন্ত এ-যাত্রায় কালি ও কলমের সঙ্গী ছিল বিশ্বের স্থানীয় ব্যাংক এইচএসবিসি। তবে এবারে কালি ও কলম এককভাবে এ-পুরস্কার প্রদান করেছে। ২০০৮ সালে দুটি বিভাগে এ-পুরস্কার প্রদান করা হয়েছিল। ২০০৯ সালে বিভাগ বেড়ে দাঁড়ায় তিনটি। ২০১০ সালে যোগ করা হয় আরো দুটি বিভাগ। ফলে ২০১০ থেকে ২০১৩ সাল পর্যন্ত পাঁচটি বিভাগেই বই চাওয়া হয়। তবে ২০১৪ সালে চাওয়া হয় তিনটি বিভাগে। এ-বিষয়ে পুরস্কার প্রদান অনুষ্ঠানে কালি ও কলমের প্রকাশক আবুল খায়ের বলেন, ‘এবার থেকে কালি ও কলম এককভাবে এ-পুরস্কার প্রদান করবে।’ তিনি আরো বলেন, ‘এবার তিনটি বিভাগে পুরস্কার প্রদান করা হলো। আগামীতে পাঁচটি বিভাগেই পুরস্কার প্রদান করা হবে।’

অনুষ্ঠানের শুরুতেই স্বাগত বক্তব্য রাখেন বেঙ্গল ফাউন্ডেশনের মহাপরিচালক লুভা নাহিদ চৌধুরী। তাঁর বক্তব্য শেষে ২০০৮ থেকে ২০১৩ সাল পর্যন্ত দেওয়া এ-পুরস্কার নিয়ে নির্মিত চলচ্চিত্র প্রদর্শন করা হয়। চলচ্চিত্র প্রদর্শন শেষে প্রজেক্টরের মাধ্যমে দেখানো হয় কিভাবে কালি ও কলম সহজেই ইন্টারনেটের মাধ্যমে যে-কোনো অ্যান্ড্রয়েড মোবাইল ফোনে দেখা ও পড়া যাবে।

এ বছর পুরস্কার বিজয়ীদের নাম ঘোষণা করেন ‘কালি ও কলম তরুণ কবি ও লেখক পুরস্কার ২০১৪’-এর বিচারকমন্ডলীর সদস্য অধ্যাপক বিশ্বজিৎ ঘোষ। এরপর তিন বিজয়ীর উদ্দেশে রচিত শংসাবচন পাঠ করেন তিনি। বিশ্বজিৎ ঘোষের পাঠ শেষে বিজয়ীদের প্রত্যেককে একটি ক্রেস্ট, এক লাখ টাকার চেক ও শংসাবচন প্রদান করা হয়। এ প্রতিযোগিতায় পাঁচ সদস্যের বিচারকমন্ডলীর অন্য সদস্যরা হলেন – লেখক সুব্রত বড়ুয়া, অধ্যাপক ও কবি দিলারা হাফিজ, কবি ও অধ্যাপক মাহবুব সাদিক এবং অধ্যাপক ও কবি খালেদ হোসাইন।

পুরস্কার গ্রহণের পর প্রত্যেক বিজয়ীকে নিজের অনুভূতি প্রকাশের জন্য আহবান জানানো হয়। প্রথমেই নিজের অনুভূতি প্রকাশ করেন সাকিরা পারভীন। তিনি বলেন, এ-অর্জনের পেছনে সবচেয়ে বেশি অবদান তাঁর পরিবারের। সহকর্মীদের প্রতিনিয়ত অনুপ্রেরণাও তাঁর পাথেয় হয়েছে এ-সাফল্য অর্জনে। এ-পুরস্কার সাহিত্যের প্রতি তাঁর দায়বদ্ধতা আরো বাড়িয়ে দিয়েছে বলে উল্লেখ করেন তিনি। এম আবদুল আলীম বলেন, এ-অর্জনের পেছনে সবচেয়ে বড় ভূমিকা ছিল তাঁর পিতার। তাঁর অনুপ্রেরণাই তাঁকে আজকের এ-অবস্থানে নিয়ে এসেছে। একই সঙ্গে তিনি তাঁর পরিবারের অন্যান্য সদস্য এবং সহকর্মীদের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন। ফাতিমা রুমি বলেন, আমি অনিন্দিতা তাঁর প্রকাশিত প্রথম বই। তিনি ভাবতেই পারেননি এ-বইটি পুরস্কৃত হবে। তবে এ-পুরস্কার তাঁর সাহিত্যের পথচলাকে আরো বেগবান ও মসৃণ করবে বলে আশাবাদ ব্যক্ত করেন তিনি।

বক্তব্যপ্রদানকালে অনুষ্ঠানের বিশেষ অতিথি ইমদাদুল হক মিলন বলেন, তরুণদের উৎসাহী করার লক্ষ্যে এ-ধরনের পদক্ষেপ অত্যন্ত প্রশংসনীয়। তিনি বলেন, আমরা যখন সাহিত্যচর্চা করেছি তখন এ- পথটি এতটা সহজ ছিল না। তিনি এ-সাহিত্য পুরস্কার সবার জন্য উন্মুক্ত করার আহবান।

প্রধান অতিথির বক্তব্যে সমরেশ মজুমদার বলেন, পুরস্কারপ্রাপ্ত নবীনদের লেখা সম্পর্কে পড়ে তিনি অভিভূত। প্রত্যেকের লেখার ধরন ও শব্দচয়নে যথেষ্ট মুন্শিয়ানার ছাপ রয়েছে বলে তাঁর ধারণা হয়েছে। কালি ও কলমের এ-প্রয়াসকে ধন্যবাদ জানিয়ে ও অব্যাহত থাকার আশাবাদ ব্যক্ত করে তিনি তাঁর বক্তব্য শেষ করেন।

অনুষ্ঠানের সভাপতির বক্তব্যে অধ্যাপক আনিসুজ্জামান বলেন, কালি ও কলমের এ-প্রয়াসে  ছ-বছর এইচএসবিসি থাকলেও এ-বছর থেকে এককভাবে এ-পুরস্কার দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে কালি ও কলম। তিনি আরো বলেন, এ-পুরস্কার আগামীতেও অব্যাহত থাকবে ও নতুনদের সাহিত্যচর্চায় অনুপ্রেরণা জোগাবে।

সবশেষে সবাইকে ধন্যবাদ জ্ঞাপন ও পুরস্কৃতদের অভিনন্দন জানিয়ে বক্তব্য রাখেন কালি ও কলমের সম্পাদক আবুল হাসনাত। এবার দুটি বিভাগে দুজন নারীর পুরস্কার অর্জন করার বিষয়টি উল্লেখ করে তিনি বলেন, বাংলাদেশের অগ্রযাত্রায় ও সৃজনে এই অর্জন নিশ্চিতই প্রভাবসঞ্চারী হয়ে উঠবে। তিনি আরো বলেন, বিগত ১ ফাগুনে কালি ও কলম দ্বাদশ বর্ষে পদার্পণ করেছে। এই পথচলার মধ্য দিয়ে আমরা এদেশের সাহিত্যের গতিধারাকে নানা ভঙ্গিতে তুলে ধরার চেষ্টা করেছি। কালি ও কলমের প্রকাশক আবুল খায়েরের আনুকূল্য ছাড়া এ-পথচলা ও প্রকাশনা অব্যাহত রাখা সম্ভব ছিল না।

পরিশেষে অনুষ্ঠানের সমাপ্তি ঘোষণা করে সঞ্চালক লুভা নাহিদ চৌধুরী যখন সবাইকে সামান্য জলযোগের আমন্ত্রণ জানালেন তখন ঘড়ির কাঁটা ৮-এর ঘর পেরিয়ে গেছে। জলযোগের উছিলায় বেশ জমে উঠল লখক-পাঠক ও অনুষ্ঠানে অভ্যাগতদের আড্ডা। বেঙ্গল ক্যাফেতে বারবার ঝলসে উঠল ক্যামেরার ফ্ল্যাশ। আগামী বছর আবারো এমন একটি সুন্দর আয়োজনের আকাঙ্ক্ষা বুকে নিয়ে একসময় অনুষ্ঠানস্থল ত্যাগ করতে শুরু করলেন অভ্যাগতরা। q

 

 

বৃষ্টির মাতলামি

সাকিরা পারভীন

 

কবিতা শাখায় বৃষ্টির মাতলামি গ্রন্থের জন্য ‘কালি ও কলম তরুণ কবি ও লেখক পুরস্কার ২০১৪’ অর্জন করেছেন তরুণ কবি সাকিরা পারভীন। বৃষ্টির মাতলামি সাকিরার অন্তরঙ্গ জীবনের নিপুণ শিল্পভাষ্য। জীবনের নানামাত্রিক সংকট ও সংঘর্ষ, স্বপ্নভঙ্গ আর রিক্ত আশা, বেদনা আর বিষণ্ণতার স্নিগ্ধ নিনাদ বৃষ্টির মাতলামি। সাকিরার কবিতায় থাকে অন্তরমথিত এক বেদনার সুর, থাকে মর্মকোষ থেকে উঠে আসা ভালো লাগা আর ভালোবাসার কিছু সোনালি-রুপোলি যন্ত্রণাকথা। টানা গদ্যে কি ছন্দোময় পঙ্ক্তিতে নিজের কথা বুনতে সমান স্বচ্ছন্দ সাকিরা। যন্ত্রণা-বেদনা আর শূন্যতাকে কীভাবে শিল্প করে তুলতে হয়, তার প্রাথমিক প্রতিশ্রুতিতে উজ্জ্বল বৃষ্টির মাতলামি। আমরা আশা করব, ভবিষ্যতে এই প্রতিশ্রুতি পূর্ণতা পাবে সাকিরার সৃষ্টিতে।

কবিতা শাখায় ‘কালি ও কলম তরুণ কবি ও লেখক পুরস্কার ২০১৪’ লাভ করায় কবি সাকিরা পারভীনকে কালি ও কলমের পক্ষ থেকে অবারিত শুভেচ্ছা ও অশেষ অভিনন্দন।

 

আমি অনিন্দিতা

ফাতিমা রুমি

 

ছোটগল্প ও উপন্যাস শাখায় আমি অনিন্দিতা গ্রন্থের জন্য ‘কালি ও কলম তরুণ কবি ও লেখক পুরস্কার  ২০১৪’ অর্জন করেছেন তরুণ কথাকার ফাতিমা রুমি। আমি অনিন্দিতা একটি মেয়ের গল্প, এ-প্রজন্মের মেয়েদের বেড়ে ওঠা, প্রেম-ভালোবাসা, সংসার-জীবনের নিটোল কাহিনি। একই সঙ্গে এ-উপন্যাস নারীর অতলান্ত যন্ত্রণা ও অপরিসীম বেদনার অসামান্য এক শিল্পকথা। স্বপ্নের সংসারে ধীরে ধীরে বঞ্চনার বেসাতিতে নারীর মধ্যে গুমরে মরে অন্তর্গত কান্না ও হাহাকার। সমাজে প্রতিষ্ঠা পাওয়ার, ঐশ্বর্যলাভের এক দুর্বিনীত মোহে একান্ত আপনজনও কখনো কখনো অপরিচিত হয়ে যায়। কিন্তু প্রেমময় নারী অট্টালিকা নয়, ভালোবাসার ছোট্ট একটা বাসারই স্বপ্ন দেখে সবসময়। সময়ের স্রোত এক সময় দূরে ঠেলে দুই আত্মাকে। বারবার নিগ্রহের শিকার নারী একসময় ছেড়ে যায়, ছেড়ে যেতে বাধ্য হয় একান্ত প্রিয়জনকে। চলমান সমাজের আটপৌরে এ-গল্প অত্যন্ত সহজ ও সাবলীল ভাষায় আমি অনিন্দিতায় তুলে ধরেছেন ফাতিমা রুমি। তিনি সব কথাকেই ঐন্দ্রজালিক ভাষা দিয়ে করে তুলেছেন শিল্প। কথাকার হিসেবে এ-বই ফাতিমা রুমির দীপ্র প্রতিভাকে যেমন প্রকাশ করে, তেমনি প্রকাশ করে দ্যুতিময় এক ভাষাশিল্পীর আগমন-বার্তা।

ছোটগল্প ও উপন্যাস শাখায় ‘কালি ও কলম তরুণ কবি ও লেখক পুরস্কার ২০১৪’ লাভ করায় কথাকার ফাতিমা রুমিকে কালি ও কলমের পক্ষ থেকে অবারিত শুভেচ্ছা ও অশেষ অভিনন্দন।

 

 

পাবনায় ভাষা আন্দোলন

এম আবদুল আলীম

 

প্রবন্ধ, গবেষণা ও নাটক শাখায় পাবনায় ভাষা আন্দোলন গ্রন্থের জন্য ‘কালি ও কলম তরুণ কবি ও লেখক পুরস্কার, ২০১৪’ অর্জন করেছেন তরুণ গবেষক এম আবদুল আলীম। উনিশশো বায়ান্ন সালের ভাষা-আন্দোলন হাজার বছরের বাঙালি জাতির ইতিহাসে গৌরবোজ্জবল এক অধ্যায়। ঢাকায় সংঘটিত এই আন্দোলন অতিদ্রুত সমগ্র দেশে প্রবল আলোড়ন তোলে। ভাষা-আন্দোলনের আঞ্চলিক ইতিহাস রচনায় আমাদের দেশে দীর্ঘ নীরবতা লক্ষ করা গেছে। তবে এ-ধারায় কয়েকজন তরুণ গবেষক সম্প্রতি গুরুত্বপূর্ণ গবেষণা করেছেন। ড. এম আবদুল আলীম-রচিত পাবনায় ভাষা আন্দোলন এ-ধারায় উল্লেখযোগ্য এক সংযোজন। এ-গ্রন্থে বৃহত্তর পাবনা জেলার বিভিন্ন এলাকায় সংঘটিত ভাষা-আন্দোলনের ঘটনাবলি বিশদভাষ্যে উপস্থাপিত হয়েছে। পাবনা জেলার বিশিষ্ট ভাষা-সংগ্রামীদের সংক্ষিপ্ত বিবরণ গ্রন্থটির গ্রহণযোগ্যতা বহুগুণ বৃদ্ধি করেছে। নিরাসক্ত দৃষ্টি দিয়ে পাবনা জেলারভাষা-আন্দোলনের যে-বিবরণ আলীম তুলে ধরেছেন তা  তরুণদের গবেষণাকর্মে অনুপ্রাণনা সঞ্চার করবে বলে আমাদের বিশ্বাস।

প্রবন্ধ ও গবেষণা শাখায় ‘কালি ও কলম তরুণ কবি ওলেখক পুরস্কার ২০১৪’ লাভ করায় এম আবদুল আলীমকে কালি ও কলমের পক্ষ থেকে অবারিত শুভেচ্ছা ও অশেষ অভিনন্দন।