বুলবন ওসমান
-
সেগুনবাগিচার সারমেয়
ফ্ল্যাট থেকে বেরিয়ে গাড়িটা ডানে মোড় নেয়। ফজল খেয়াল করে, একটা সাদা-কালো ছোপ কুকুর তার গাড়ির পেছনে ভেক ভেক করে তেড়ে আসছে। বেশ অনেকটা দৌড়ে রণে-ভঙ্গ। ফজল চালককে বলে : হারুন, কুকুরটা গাড়ির পেছনে কেন দৌড় দিলো বলো তো? স্যার, গতকালও পেছনে এসেছিল, আপনি খেয়াল করেননি। কিন্তু কেন? ঠিক আছে স্যার, আমি জানার চেষ্টা করব।…
-
চৈত্রপালা
জন্মের ঠিকুজি জানার সবচেয়ে প্রাথমিক উৎস মা। বাবা নন। মা জন্ম দিয়েছেন। বাবা পাশে থাকতেও পারেন, না-ও পারেন। থাকলে দিনক্ষণ বলতে পারবেন। নচেৎ শোনা কথা। বা নোটবুকে টুকে রাখা। কোনো মানুষই তার জন্মক্ষণ সম্বন্ধে বলতে পারে না। কারণ তার স্মৃতিকাণ্ড শুরু হয় ধীরে। এবং কয়েক বছর কেটে যায়। আমার সূত্র মা। তাই দ্বিধার কোনো বালাই…
-
বাঙালি সংস্কৃতির রূপান্তর
মহাভারতেও আমরা বাঙালি জাতির উল্লেখ পাই। তাই সহজেই সিদ্ধান্তে আসা যায় যে, বাঙালির জাতিসত্তা কম করে হলেও পাঁচ হাজার বছরের। আজকে যুক্ত-বাংলায় আমরা যেসব ক্ষুদ্র-নৃগোষ্ঠী দেখি যেমন, সাঁওতাল, ওঁরাও, মুণ্ডা, গারো, হাজং, কোচ, রাজবংশী এবং দক্ষিণ-পূর্বের চাকমা, মগ, মুরং, বম ইত্যাদি এরা এই অঞ্চলের বাসিন্দা। তবে দক্ষিণের নৃগোষ্ঠীসমূহের স্থানান্তর তত প্রাচীন নয়। প্রাচীন বাংলায় যে-কটি…
-
জগৎ জুড়ে প্রাণের মেলা
হাতেখড়ির পালা একবারে তো আর শেষ হয় না। পড়ে থাকে দ্বিতীয় অধ্যায়। সেটি গণিতের জগৎ। আমরা সবাই দুটি মাত্রায় সীমাবদ্ধ। এক, ভাষা – দুই, গণিত। অ আ শেখার পর আসে রাশি শিক্ষার পালা। তো বর্ণপরিচয় শেখার পর শুরু হলো গণিত পাঠ। এক থেকে দশ পর্যন্ত লেখা চলল। এই প্রথম সিঁড়ি ভাঙার পর এগারো থেকে কুড়ি।…
-
তালগাছ
তালজ্ঞান না থাকলে সংগীতজগতে জায়গা পাওয়া মুশকিল। সুর-লয়-তাল সংগীতের কাঠামো। গান-বাজনা পরে। অনেকে জন্মলগ্ন থেকে এগুলো পেয়ে থাকে। এমন ভাগ্যবান না হলে শিখতে হয়। গুরু ধরে। হতে পারে মা-বাবা বা পরিবারের কেউ। তাছাড়া গুরুমশাই। সংগীতেরও আছে হাতেখড়ি। এখানে হাতেখড়ি কণ্ঠ ও যন্ত্রসহযোগে। আর পেছনে থাকে তাল-যন্ত্রটি। যাকে আমরা বাঁয়া-তবলা, মৃদঙ্গ, খঞ্জনি, করতাল, ঢোল ইত্যাদি বলে…
-
হারিয়ে ফেলেছি পরশপাথর
ছোটবেলায় রবীন্দ্রনাথের ‘পরশপাথর’ কবিতা পড়ে ক্ষ্যাপা লোকটির জন্যে বড় কষ্ট হয়েছিল। শুধু মনে হয়, আহা যদি একটু খেয়াল করত! ফেলে যাওয়া রাস্তায় আবার পরিক্রম করতে হতো না। পৃথিবীতে এরকম অনেক ধরনের ক্ষ্যাপা আছে। কেউ শিল্পচর্চা করে, কেউ করে রাজনীতি … এমনি হাজার ধারা। এই বাংলায় তেমন ক্ষ্যপার অভাব নেই। রাজা রামমোহন থেকে শুরু করে ঈশ্বরচন্দ্র…
-
নিভে গেল সাঁঝবাতি
কলেজ স্কোয়ার। কলকাতা। গোত্রহীন এক পান্থনিবাস। আহার-ব্যবস্থাবিহীন। অনুজ-কবি মানিকের তবু এই ঠাঁই পছন্দের। কারণটা ধরে ফজল খুশি। কর্মীদের আহারে শামিল হলে ঘরোয়া খাবার মেলে। থালি সত্তর টাকা। খুব একটা বেশি কী? খাবারে আমিষ ও সবজির অনুপাত প্রায় হাসপাতাল-ব্যবস্থাপনার মতো। সবচেয়ে ভালো ডিমের ব্যঞ্জন। একজোড়া ডিম। এ কি রাজকীয় থেকে কিছু কম হলো! অনেকদিন ফজল একটা…
-
অনুজ হাসনাতকে
২রা অগ্রহায়ণ ১৪২৭ ১৭ই নভেম্বর ২০২০ সেগুনবাগিচা, ঢাকা প্রিয় হাসনাত চিঠিটা তো খোলাই থাকবে। ভদ্রতার মোড়ক ব্যবহার করতে হবে না। কালি ও কলমের মেরুদণ্ড ছিলে তুমি। কয়েক মাস আগে গেল পত্রিকার প্রধান মস্তিষ্ক অধ্যাপক আনিসুজ্জামান। আমার তো এখন ভয় হচ্ছে সিরিয়ালি সার দিয়ে নামছে। প্রার্থনা – এবার যেন বাকিরা রেহাই পায়। এত বড় উৎসর্গের পর…
-
বন্ধু জিন ও অভ্যর্থনা
বুলবন ওসমান ফজলের খেয়াল, বয়স যত বাড়ছে, কারণে-অকারণে জন্মভূমি চোখে ভাসে। মনে পড়ে হাওড়া জেলার ঝামটিয়া গ্রামের সেই তিনতলা ভবনটির কথা। তখন গ্রামেগঞ্জে যে-ভাবে আঁতুড়ঘরকে গোয়ালঘরে রূপান্তরিত করা হতো তাদের বেলা তেমনটি হয়নি। একেবারে উঠোনের পর বারান্দা, তারপর যে-দুটি পাকা কক্ষ এর পুবদিকের কামরায় তার জন্ম। মায়ের মুখে শোনা প্রথম সন্তান হিসেবে সে মাকে খুব…
-
আনিসভাই
১৯৬১ সাল। ঢাকায় তখন রবীন্দ্রবার্ষিকী পালনের জোর তোড়জোড়। দুটো কারণ। এক. শতবার্ষিকী। দুই. পাকিস্তানি সরকারের রবীন্দ্রচর্চার ওপর নিষেধাজ্ঞা। সুতরাং আমাদের জিদ ষোলো আনা ছাড়িয়ে। মানব না এ-বন্ধনে, মানব না এ-শৃঙ্খলে – তরুণসমাজ, মাঝবয়সী ও বয়সী সবাই একাট্টা। আমাদের দাবি প্রাণের। সংস্কৃতির। অধিকারের। পাকিস্তানের বয়স তখন তেরো-চৌদ্দো। আমাদের মূল সাংস্কৃতিক বন্ধনটি হাজার বছরের বাঙালি ও বৃহত্তর…
-
পোট্রেটটা তোমার কাছে থাক
অপূর্ব, কেমন আছ? ফোনে কথাটা শুনে সে চমকে ওঠে। এই টোনে এই ঢংয়ে তাকে মাত্র দুজন ডাকত। এক. সাহিত্যিক আতিউর, দুই. মানসী। আতিউর সাহেবের বাড়ি কুষ্টিয়া। চোস্ত বাংলা বলতেন। তার মধ্যেও একটা শান্তিপুরি টান ছিল। তিনি মারা গেছেন তিন-চার বছর। তাহলে বাকি থাকে মানসী। কিন্তু কণ্ঠটা মেয়েলি নয়। পুরুষঘেঁষা। এটাই অপূর্বর সামনে দ্বিধা তৈরি করে।…
-
অন্ধ্রের অপ্সরা
ভাদ্রের আকাশ। ভিক্টোরিয়ার মাথায় মেঘের ছায়া। আকাশ ঘোলাটে। শরৎ নির্বাসনে। পাঁচজনের দলে ফজল টিকিট কাউন্টার থেকে অনেকটা পেছনে। পথনির্দেশক মানিক সর্বাগ্রে। প্রহরায় পুরুষকর্মীর মধ্যে একজন যুবতী। একহারা চেহারা। হালকা খয়েরি ইউনিফর্মে বেশ সপ্রতিভ। টেপাপুতুলের অবয়ব। যৌবনের শ্রীশোভিত। ফজলের কানে আসছে … টিকিটমূল্যের দস্তুর। সঙ্গে চারজন বাংলাদেশি … একশ টাকা … পার হেড … ফজল মেয়েটির…