পিতৃত্ব

রাজীব নূর

মা¬লতিপাড়া মসজিদের মুয়াজ্জিন হাফেজ আবদুল মোতালেব আলী হাজতে। নিজের মেয়েকে খুনের অভিযোগে গ্রেফতার করা হয়েছে তাকে। হাজতে আনার একদিন পরই তাকে আদালতে হাজির করিয়ে ১০ দিনের রিমান্ড চাওয়া হয়েছিল। আদালত সাতদিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেছেন। আজ তার হাজতবাসের ষষ্ঠদিন, রিমান্ডের পঞ্চমদিন।
এর মধ্যে ওর নিজের পরিবার ও আত্মীয়স্বজনের কেউ তাকে দেখতে আসেনি। আজ প্রথমবারের মতো যে দেখতে এসেছে, সে তার কেউ নয়, হওয়ার কথাও নয়। কান্দাপাড়ার রমলা মাসি কারো কিছু হয় না। অথচ সবাই তাকে চেনে। যারা ওই পাড়ায় যায়, তারা এবং যারা ভুলেও ওমুখো হয় না, তারাও। সবাই জানে রমলা মাসির নাম।
রমলা মাসিকে থানায় দেখে ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেছে পুলিশের লোকজনও। অবশ্য রমলা মাসির হাত যে অনেক লম্বা জানা আছে তাদের। তাই দায়িত্বরত সাব-ইন্সপেক্টর হাজতখানা থেকে মোতালেবকে বের করে পাশের রুমে এনে মাসির সঙ্গে দেখা করিয়ে দেওয়ার নির্দেশ দেয় কনস্টেবলকে।
হাজতখানাটি আয়তাকার। সামনে তেরো শিকের লোহার দরজা। এরপর আরো একটি লোহার দরজা রয়েছে। দরজার ফাঁক দিয়ে সামান্য বাতাস আসে, যা মোতালেবের মতো আরো হাজতবাসীর সহায় হয়েছে। একমাত্র টয়লেটের ছাদ দেয়াল পর্যন্ত ঠেকানো হয়নি, অর্ধেক তোলা। তার ওপর দিয়ে দুর্গন্ধ হাজতখানার ভেতরে আসতে থাকে। টয়লেটের ময়লা যাওয়ার নালাটাও খোলা।
আজান দেওয়া মোতালেবের পেশা হলেও মসজিদ কমিটির দেওয়া মাসিক তিন হাজার টাকাই তার একমাত্র ভরসা নয়। তার বাবা ছিলেন সম্পন্ন গেরস্ত এবং তাকে একমাত্র উত্তরাধিকারী হিসেবে রেখেই তিনি পরলোকগমন করেছেন। ফলে তাকে হাজতের মতো এত খারাপ অবস্থায় কখনো দিনাতিপাত করতে হয়নি। এর মধ্যে খাবার-দাবারের কষ্ট করতে হচ্ছে তার। কয়েকদিন ধরে বারবার ডাক পাঠিয়েও জিনদের কাউকে উপস্থিত করতে না পারায় ওরাই খুনটা করেছে, এমন ধারণাটা আরো পোক্ত হয়েছে তার মনে। খুন না করলে তার ডাকে সাড়া না দেওয়ার আর কী কারণ থাকতে পারে? মোতালেব নিজেই অন্য একটি কারণ খুঁজে পায়, তার মনে হয়, বাথরুমের দুর্গন্ধ জিনদের আসতে নিরুৎসাহিত করছে।
যেদিন তাকে পুলিশ ধরে আনল, সেদিনও দু-দুবার জিনেরা এসেছিল তার কাছে। বিকেলে জিনদের একজন পিরালি এসেছিল তাকে সাবধান করার জন্য। অন্যজন শেরালি এসেছিল মাগরিবের নামাজের পর, তখন সে পুলিশের হাতে আটক হয়ে গেছে। শেরালি এলো তাকে অভয় দেওয়ার জন্য।
বিকেলে পিরালি মোতালেবকে বিপদ আসন্ন জানালেও বিপদের স্বরূপ সম্পর্কে কোনো ধারণা দিতে পারেনি। তবু মোতালেব বুঝতে পারে, ঝামেলাটা করবে পুলিশ। তাই প্রথমে ঠিক করে ইমাম সাহেব ফিরে এলেই সে পালাবে। ইমাম সাহেব প্রায়ই তার ওপর আজান দেওয়া থেকে জামাতে ইমামতি করার দায়দায়িত্ব দিয়ে পাশের গ্রামে অবস্থিত নিজের বাড়িতে ঘুরে আসতে যান। ওইদিনও ইমাম সাহেব বললেন, ‘মোতালেব, আমি বাড়ি থিকা একটা ঘুরান দিয়া আহি। তুমি আসর আর মাগরিবের নামাজটা চালাইয়া দিও।’
পুলিশ আসবে তাকে ধরতে, এটা বুঝতে পারলেও তখনই পালানোর প্রয়োজন বোধ করেনি মোতালেব। কারণ, সে পুুলিশকে কখনই মাঝরাতের আগে আসামি ধরার জন্য আসতে দেখেনি। তবু মাগরিবের পর পালানোর প্রস্তুতি হিসেবে ব্যাগ গোছাতে শুরু করে। তাকে ব্যাগ গোছাতে দেখে মেয়েদের একজন এসে জানতে চায়, ‘আব্বা, কই যাবেন?’
মেয়ের প্রশ্নের উত্তর দেওয়া তো দূরের কথা, ফিরে তাকানোরও প্রয়োজন বোধ করেনি মোতালেব। অনুপস্থিত ইমামের রুমের বারান্দায় নিজের কাপড়চোপড়-ভরা ব্যাগটা রেখে প্রথমে অজু করে নিল সে। অজু করতে না করতেই অন্য এক মসজিদে মাগরিবের আজান শুরু হয়ে গেল। তাই তাড়াতাড়ি অজু শেষ করে আজান দিতে দাঁড়াল সে। মোতালেব অন্যদিনের চেয়ে বেশি সময় নিয়ে আজান দিলো আজ। আজান শেষ হতে না হতেই মসজিদ ভরে গেল মুসল্লির উপস্থিতিতে। মুসল্লিদের মধ্যে পুলিশের পোশাক পরা দুই ব্যক্তিকে দেখে মোতালেব বুঝে গেল, তার আর পালানোর সুযোগ নেই। এ-অবস্থায় সে জীবনে প্রথমবারের মতো প্রচণ্ড ভয় পায়। হঠাৎই কে একজন কানের কাছে মুখ এনে বলল, ‘ডরাইয়েন না?’
জিনের আশ্বাসে ভয়ডর কেটে যাওয়ায় মনপ্রাণ উজাড় করে ইমামতি করল মোতালেব।
সেই থেকে এই থানাহাজতেই আছে মোতালেব। মাঝে একবার কোর্টে ঘুরিয়ে আনা হলো তাকে। তার পক্ষে কোনো উকিলই দাঁড়ায়নি। উকিল দাঁড় করানোর মতো মোতালেবের যে আত্মীয়স্বজন একেবারে নেই তা নয়; কিন্তু নিজের আত্মজাকে হত্যা করার অপরাধে যাকে গ্রেফতার করে আনা হয়েছে, তার পক্ষে উকিল নিযুক্ত করবে কে? হাজতেও তাকে দেখতে আসার কেউ থাকবে না, এটাই স্বাভাবিক।
মোতালেব আশা করেছিল, আর কেউ না এলেও তার বড় মেয়েটা আসবে। থানাহাজত থেকে হাঁটাপথে মিনিট দশেকের দূরত্বে বড় মেয়ে খাদিজার বাসা। খাদিজার স্বামী মোহাম্মদ আবু তাহেরকে মোটামুটি অবস্থাপন্ন ব্যবসায়ী বলা চলে। মাদ্রাসায় পড়াশোনা করলেও তাহের মোল্লাগিরি না করে ব্যবসাকেই পেশা হিসেবে বেছে নিয়েছে। কন্ট্রাক্টরি করে সে। তা ছাড়া শহরের ব্যস্ততম এলাকা, সদর হাসপাতালের সামনেই তার বিরাট ওষুধের দোকান। দুই সন্তানের মা-বাবা ওরা।
খাদিজা তার মা-বাপের একের পর এক সন্তান জন্ম দেওয়াটাকে কোনোভাবেই মেনে নিতে পারছিল না। বাবার সামনেই সে একবার তার মা হোসনা বেগমকে বলে বসল, ‘আম্মা, আপনেরা কি শরম-লজ্জার মাথা খাইছেন। নাতি-নাতনিগোর নগে নিজেগো পোলাহান মানুষ করতে কি ইটটুও শরম লাগে না।’
খাদিজারা সাত বোন। খাদিজার বয়স ২৫, আয়শার বয়স ২১। সাত সন্তানের এই দুজনের নাম মোতালেবের পছন্দে রাখা হয়েছিল। এরপর মোতালেব একটি ছেলের আশায় আরো পাঁচটি মেয়ের জন্ম দিয়ে গেল এবং প্রতিটি মেয়ের জন্মমাত্রই এতটা হতাশ হলো যে, তাদের নাম রাখারও প্রয়োজন বোধ করেনি। ফলে কোরানের হাফেজ মুয়াজ্জিনের মেয়েদের নাম রাখা হলো অলি, কলি, জুলি, মলি ও পলি।
মুয়াজ্জিন মোতালেব আলীর একটা ছেলে চাই-ই চাই। তাই তার স্ত্রী হোসনা বেগম যখন অষ্টম সন্তানের জন্ম দিতে চলেছে, তখন তার দ্বিতীয় মেয়ে আয়শা দ্বিতীয়বারের মতো সন্তানসম্ভবা হয়েছে আর বড় মেয়ে খাদিজার ছেলেমেয়ে দুটির বড়টি পা দিয়েছে স্কুলের বারান্দায়।
খাদিজা এসেছে মাকে দেখতে। অন্য মেয়েরা মোতালেবের সামনে কথা বলতে ভয় পেলেও খাদিজা কখনো বাবাকে তেমন তোয়াক্কা করে না। তাই বাপের সামনেই মাকে ভর্ৎসনা করার ছলে বাপকে কিছু কথা শুনিয়ে দিয়ে বলল, ‘আরো একটা মেয়া হইব আপনেগো।’
মোতালেব অনেকক্ষণ চুপচাপ মেয়ের কথা শুনে যাচ্ছিল, এবার আর সহ্য করতে না পেরে একপর্যায়ে বলল, ‘এইবার মেয়া অইলে তোর মায়রে তালাক দিয়া আরেকটা বিয়া করুম আমি।’
‘আব্বা এইসব কী কইতাছে, হুনছেন?’
খাদিজা পাশের ঘর থেকে তার স্বামী তাহেরকে ডেকে আনে, ‘আপনে আব্বারে বুঝাইয়া কন তো পোলা না মাইয়া হইব তা মাইয়ালোকের না, পুরুষমাইনষের ব্যাপার।’
মাদ্রাসাশিক্ষায় শিক্ষিত হলেও ওষুধের দোকান চালানোর কারণে ডাক্তারিবিদ্যার অনেক কিছুই জানা হয়ে গেছে আবু তাহেরের। মেয়েজামাইয়ের কথাবার্তা শুনতে শুনতে মোতালেবের মনে হয়, তার মেয়ে ও মেয়েজামাই Ñ দুইটাই বড় নির্লজ্জ হয়ে গেছে। রাগ সামলাতে না পেরে বলে, ‘যদি এবারও আরেকটা মাইয়ার জন্ম হয়, ওইটারে আমি নুন খাওয়াইয়া মাইরা ফালামু।’
সাত চড়ে রা করে না যে-মানুষটি, সেই হোসনা বেগম কিনা হঠাৎ ক্ষেপে গিয়ে হাতে বঁটিদা তুলে নিয়ে বলে, ‘ঘর থেকে বাইর অন। নাইলে আমি আপনেরে কোপাইয়া মারুম।’
খাদিজা মাকে আঁকড়ে ধরে নিরস্ত করে এবং তাহের শ্বশুরকে নিয়ে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে যায়। উত্তেজনায় অসুস্থ হয়ে পড়ে হোসনা বেগম। মেয়ে ও জামাই মিলে হাসপাতালে নিয়ে যায় তাকে।
হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার পর শুরু হয় প্রসববেদনা এবং যথারীতি আরো একটি মেয়ের জন্ম দেয় হোসনা বেগম। অকালে প্রসব হলেও মেয়েটি বেশ সুস্থ-সবল অবস্থাতেই পৃথিবীতে আসে।
স্ত্রী-সন্তান মাত্র ১০ কিলোমিটার দূরে অবস্থান করলেও এ-খবর পেতে পুরো দুটি দিন লেগে যায় মোতালেবের। তাও আবার খবর নিয়ে আসে প্রতিবেশীদের একজন। আজান দিতে যাওয়ার পথে দেখা হয় তবারক আলীর সঙ্গে। তবারক বলে, ‘মুয়াজ্জিন, আছ কিবা?’ মোতালেবের উত্তরের অপেক্ষায় না থেকে সে জানায়, ‘গ্যাসটিকের ব্যাদনাডা বাইরা যাওয়ায় হাসপাতালে গেছিলাম।’ মোতালেব চুপচাপ শুনে যাচ্ছিল। তবারক আলী এবার বোমা ফাটায়, ‘তোমার মেয়া দেইখা আইলাম। একদম তোমার মতো অইছে।’
মোতালেব বিস্মিত হয়। বিস্ময়ের ঘোর না কাটতেই তবারক বলে, ‘তুমি কিন্তুক আবার আমার কাছ থিকা খবর পাইছ, এইডা কেউরে কইও না। খাদিজা আমারে বারবার অনুরোধ কইরা কইছে তোমারে জানি খবরডা না জানাই। আমি তো জানি, আমি খবর গোপন রাখলেও জিনেরা তোমারে খবর জানাইয়া দিব। তাই কইয়া দিলাম আর কী?’
এতদিন ধরে দুই-দুইটা জিন পোষার গল্প করে এসেছে যাদের কাছে তাদের একজন তবারক আজ জানল, আসলে জিনের গল্পটা সত্য নয়। সত্য হলে এই অতি সাধারণ খবরটা মোতালেবের অজানা থাকত না।
মোতালেব ভাবে, শেরালি ও পিরালি তার সঙ্গে এই প্রতারণা করল কেমনে? এ-কথা ভেবে নামাজের পরও মসজিদে বসে থাকল মোতালেব। মনে মনে সে জিনদের ডাকতে লাগল। ডাকতে ডাকতে যখন হতাশায় নিমজ্জিত হতে চলেছে মোতালেব, ঠিক তখন তাকে আশ্চর্য করে দিয়ে জিনদের দুজনই এসে হাজির হলো, ‘তবারক মিয়া ঠিকই কইছেন, আপনের মেয়েটা এক্কেবারে আপনের মতন হইছে।’
‘তোমরা আমারে আগে জানাইলা না কেন?’
কোনো উত্তর নেই জিনদের।
হঠাৎ মোতালেবের মনে হয় তার স্ত্রী মিথ্যা বলে না, আসলে জিনটিন কিছুই নেই। সবই তার মনের কল্পনা। একই কথা অবশ্য ইমাম সাহেবও বলেন। তাই বলে গ্রামের মানুষ মোতালেবের পোষা জিনের ওপর একটুও সংশয় রাখে না। শুধু কি তার নিজের গ্রাম, আশপাশের ১০ গ্রামের মানুষ আসে শেরালি ও পিরালির কাছ থেকে পাওয়া পানিপড়া নিতে। প্রথম প্রথম লোকজন মোতালেবের কাছে পানিপড়া নিতে আসার সময় এটা-ওটা উপহার নিয়ে আসত। অবস্থাপন্নরা চাইত নগদ টাকা দিতে। মোতালেব কঠোরভাবে এসব উপহার-উপঢৌকন ফিরিয়ে দেওয়ায় মানুষের আস্থা বেড়ে দ্বিগুণ হয়ে যায়। ক্রমে ভিড় বাড়তে থাকে তার বাড়ির আঙিনায়। মোতালেব আবার কড়া নিয়ম মেনে চলে, সে কোনোক্রমেই দিনে ১১ জনের অতিরিক্ত একজনকেও পানিপড়া দেয় না। তার এই পানিপড়া খেয়ে কতজনের কত ইচ্ছা পূরণ হয়েছে, কিন্তু নিজের পুত্রসন্তান পাওয়ার ইচ্ছাটা অপূর্ণই থেকে গেল। হোসনা বেগম কতবার কতভাবেই না তার কাছে মন্ত্রপূত পানিপড়া চেয়েছে। মোতালেবের এক জবাব, ‘এই পানিপড়া আমার নিজের লাইগ্যা ব্যবহার করন যাইব না।’
‘যদি আপনের নিজেরই কামে না লাগল তাইলে জিন পাইল্যা লাভ কী?’
‘তুমি এহন যাও। এই জিনিস বুঝন মাইয়া মাইনসের কাম না।’
হোসনা বেগম উত্তেজিত হয়ে বলে, ‘আসলে তো জিন নাই। আপনে নিজেই একটা জিন হইয়া বইয়া রইছেন।’
উত্তেজনার বশে হোসনা বেগম যে-কথা বলেছিল, তা যে ষোলো আনা মিথ্যা, এমন দাবি মোতালেবও করতে পারে না। তার প্রায়ই মনে হয়, জিন দুইটা আসলে সে নিজেই। নিজেই সে নিজের সঙ্গে কথা বলে। গ্রাম-গ্রামান্তর থেকে আসা মানুষদের মন্ত্রপূত পানিপড়াও দেয়। কিন্তু তার কাছে তাজ্জব লাগে যখন সে হঠাৎ দেখা কোনো মানুষের অতীত-বর্তমান বলতে শুরু করে এবং তা নির্ভুলভাবেই বলতে পারে।
মেজাজ খারাপ করে মসজিদ থেকে বের হয়ে হনহন করে বাড়ির দিকে হাঁটা দেয় মোতালেব। শেরালি ও পিরালি তার সঙ্গ ছেড়ে যায়নি বলে সে ঘরে না গিয়ে ঘরের দাওয়ায় তুলে রাখা বাইসাইকেলটা নামিয়ে আনে এবং মেয়েদের কাউকে কিছু না জানিয়ে শহরের পথে রওনা দেয়।
হাসপাতালে কি মোতালেব গিয়েছিল? মোতালেবের স্ত্রী হোসনা বেগম মামলা করার সঙ্গে সঙ্গে পুলিশ এলো, যে-ওয়ার্ডে সে ছিল, সেটা সরেজমিন পরিদর্শন করতে। পুলিশের কাছে হোসনা বেগম জানিয়েছে, ‘বাচ্চাটা ঘুমাইয়া ছিল। ওরে রাইখ্যা আমি বাইরে গেছিলাম।’
পাশের সিটের মহিলা হোসনা বেগমের মুখের কথা কেড়ে নিয়ে বলতে শুরু করে, ‘হঠাৎ কইর‌্যা খুটখাট শব্দ শুইনা ঘুম ভাইঙা গেল আমার। তাকাইয়া দেহি দাড়িআলা এক বেডা ওয়ার্ডে খাড়াইয়া রইছে। আমি জিগাইলাম, আপনে কার কাছে আইছেন। হে কইল, হোসনা বেগম কোনে? আমি কইলাম, বাথরুমে। হে কইল, অ তাইলে এইডা আমার মাইয়া। কইয়া সে মাইয়ারে কোলে নিল। আমি তারে নিষেধ করলাম। আমার কথা কানেই নিল না। আমার দিক পিছ ফিইরা খাড়াইয়া থাকায় মাইয়াডারে গলা টিইপ্যা মারছে কিনা জানি না।’
হোসনা বেগম বলে, ‘আমি বাথরুম থিকা বাইর অইয়া দেখলাম খাদিজার বাপ চইল্যা যাইতাছে। আমি তারে ডাক দিয়া কইলাম, আপনে চইল্যা যাইতাছেন ক্যা, খাড়ান। কথা কইয়া যান। সে উত্তর না দিয়া কান্ধের গামছা দিয়া মুখ ডাইক্যা বাইর হইয়া গেল।’
মামলার তদন্ত কর্মকর্তা কবির আহমেদ তদন্তের অগ্রগতিতে খুশি হয়ে চলে যায় এবং পরের দিন আদালতে আবেদন করে মোতালেবকে রিমান্ডে নিয়ে আসে। রিমান্ডে আনার পর জিজ্ঞাসাবাদের শুরুতেই মোতালেব স্বীকার করে নেয় যে, সে নিজেই তার মেয়েকে খুন করেছে। সহজ-সরল স্বীকারোক্তিতে রেহাই পায় না সে। বরং এ-স্বীকারোক্তির মধ্যে একজন পিতার  যে-নিষ্ঠুরতা প্রমাণিত হয়, তা তদন্ত কর্মকর্তাকে উত্তেজিত করে তোলে এবং সে সিপাইদের দুজনকে মোতালেবকে দলাই-মলাই দেওয়ার নির্দেশ দেয়।
পুলিশের এক কনস্টেবল যখন তাকে ঘুম থেকে জাগায় তখন সারাশরীরে তার ব্যথা। কনস্টেবল যখন জানায়, ‘চল বেটা মুয়াজ্জিনের বাইচ্চা, তর লগে দেখা করতে কান্দাপাড়ার রমলা মাসি আইছে।’ তখনো সে কিছু বুঝতে পারে না। কনস্টেবল মুখ খারাপ করে বলে, ‘রমলা মাসির নাম শুইন্যা ধোন খাড়া কইরো না, বাপজান। মাসির যৌবন গেছে বহুদিন। তোমার লগে দেখা করতে আসছে সত্তর বছরের এক মাগি। সে এখন পাড়ার মাসি, মাগির দালালি করাই তার কাম।’
কান্দাপাড়া যে শহরের একমাত্র পতিতাপল্লি, তা মুয়াজ্জিন হলেও মোতালেবের অজানা নেই। ওই পাড়ার এক মাসি দেখা করতে এসেছে শোনার পরও তার মনটা নেচে ওঠে। কেউ একজন তো এসেছে দেখা করতে।
পুলিশের সঙ্গে কান্দাপাড়ার রমলা মাসির যে গভীর সম্পর্ক রয়েছে, তা ওদের দেখা করিয়ে দেওয়ার বিশেষ ব্যবস্থা থেকেই বুঝতে পারে মোতালেব। মাসি ঘরের একমাত্র খালি চেয়ারটি দেখিয়ে মোতালেবকে বসতে ইশারা করে। তারপর বলে, ‘মুয়াজ্জিন সাব, আমি আপনারে ছাড়ানোর ব্যবস্থা করব।’
কেন করবেন? মোতালেবের মনে এ-প্রশ্ন এলেও সে প্রশ্ন করে না। বরং রমলা মাসি হাসিতে মুখ উদ্ভাসিত করে বলে, ‘কেন করুম জানতে চাইলেন না যে?’
‘আপনেই কইন’ বলে চেয়ারের হাতল ধরে দাঁড়ায় মোতালেব।
‘করুম, কারণ আমার অনেক মেয়ে বাইচ্চা দরকার।’
মোতালেব তার মুক্তির সঙ্গে রমলা মাসির মেয়ে বাচ্চা দরকারের সম্পর্কটা বুঝতে পেরেছে বলে মনে হয় না, বরং সে অকূল সাগরে খড়কুটো আঁকড়ে ধরার মতো বলে, ‘আগে আমারে বাইর করনের ব্যবস্থা করেন।’
‘করনের জন্যই তো আসছি, বাইর করনের পর আপনে প্রথমে আপনের বউরে তালাক দিবেন।’
সে আর বলার অপেক্ষা রাখে, মোতালেব তো মনে মনে অনেক আগেই এটা ঠিক করে রেখেছে, যে স্ত্রী স্বামীর বিরুদ্ধে মামলা করে তাকে তালাক না দেওয়ার কোনো কারণ নেই, তাই জোর গলায় বলে, ‘অবশ্যই তালাক দিমু।’
‘শর্তের হেরফের করলে কিন্তু আমি কাউরে ক্ষমা করি না।’
‘হেরফের অইব না। আপনে আমার মা-বাপ, যেমনে পারেন আমারে বাইর করেন আগে।’
‘ঠিক আছে। এইবার পুলিশ আর রিমান্ড চাইব না। ডাক্তার রিপোর্ট দিব যে, আপনের বাচ্চারে কেউ খুন করে নাই, সে নিউমোনিয়ায় মারা গেছে।’
‘বিশ্বাস করেন মাসি, আমি খুন করি নাই’, মোতালেব এই প্রথমবারের মতো নিজের সন্তানকে খুন করার অভিযোগ মেনে নিতে অস্বীকৃতি জানাল।
‘খুন করছেন কি করছেন না, সেইটা আপনে জানেন আর পোষা জিনেরা জানে।’
‘আপনে আমার জিনের কথা জানেন? আসলে জিন বলে কিছু নাই, থাকলে আমার কপালের এই অবস্থা অইত না’, বলল মোতালেব। তারপর টুপি খুলে কপালের ফোসকাগুলো দেখিয়ে বলে, ‘না, জিন বইল্যা কিছু নাই, সবই আমার কল্পনা।’

দুদিন পরের ঘটনা। আদালতের বারান্দায় কান্দাপাড়ার রমলা মাসিও উপস্থিত। মোতালেবকে পুলিশ বারান্দা দিয়ে কোর্টে নিয়ে যাওয়ার সময় তার দিকে তাকিয়ে অভয়ের হাসি হাসল মাসি। মাসি যে যথেষ্ট প্রভাবশালী তা মোতালেবের পক্ষে জেলার সবচেয়ে দামি উকিল উঠে দাঁড়ালে আবার টের পেল সে। রিমান্ডে মোতালেব বারবার আত্মজাকে খুন করার কথা স্বীকার করলেও কোর্ট ইন্সপেক্টর জানাল, ‘মোতালেব বলেছে, সে হাসপাতালে গিয়েছিল মেয়েকে দেখতে এবং স্ত্রীর সঙ্গে ঝগড়াঝাটি থাকার কারণে হোসনা বেগমের ডাকে সাড়া না দিয়ে পালিয়ে চলে এসেছিল।’ শুধু তা-ই নয়, ইন্সপেক্টর আরো জানাল, ‘হাসপাতালের ডাক্তাররা ছোট্ট মেয়েটির মৃত্যুর কারণ নিউমোনিয়া বলে শনাক্ত করেছেন।’
মামলা চলাকালে বাদী-বিবাদী উভয়পক্ষকে আদালতে হাজির হতে হয়। কাজেই হোসনা বেগম উপস্থিত রয়েছে, রয়েছে তাদের বড় মেয়ে খাদিজা ও খাদিজার জামাই। দুর্বল সাক্ষ্যপ্রমাণের পর আসামিকে জামিন না দেওয়ার উপায় থাকে না বিচারকের। জামিন পেয়ে কোর্টের বারান্দায় ভিড় জমানো লোকজনের উপস্থিতিতে মোতালেব মামলার বাদী তার স্ত্রী হোসনা বেগমকে উদ্দেশ করে বলল, ‘তোমারে আমি তালাক দিলাম। এক তালাক, দুই তালাক, তিন তালাক, বাইন তালাক।’
মুয়াজ্জিন মোতালেব জানে এভাবে তালাক শরিয়তসিদ্ধ হয় না। তবু তালাকের ঘোষণায় তার স্ত্রী ও মেয়ে যখন হাউমাউ করে কাঁদতে শুরু করল, তখন তালাক দেওয়ার কঠিন কাজটি এত সহজে সেরে ফেলতে পারায় মোতালেব মনে মনে স্বস্তিবোধ করে। তার স্বস্তির রেশ না কাটতেই টিংটিংয়ে প্রায় ছয় ফুটি এক যুবক, যার নাম দেওয়া যায় তালপাতার সেপাই, সে ভিড় ঠেলে এগিয়ে আসে মোতালেবের কাছে এবং তাকে টেনে নিয়ে যেতে থাকে। সে জানতে চায়, ‘টানাটানি করতাছুইন কির লাইগ্যা।’
মোতালেবকে আশ্চর্য করে তালপাতার সেপাই বলে, ‘আমি রমলা মাসির লোক, মাসি আপনেরে নিয়া যাইতে কইয়া গেছে।’
‘আত ছাড়েন, আমি তো যাইতাছি।’
তালপাতার সেপাইয়ের সঙ্গে এক রিকশায় করে মুয়াজ্জিন মোতালেব যখন কান্দাপাড়ায় হাজির হয় ততক্ষণে দুপুর গড়িয়ে বিকেল হচ্ছে। আসার পথে জানতে পায়, সে যাকে মনে মনে তালপাতার সেপাই ডাকছে, লোকটি সত্যি পুলিশের একজন সিপাই ছিল এবং পাড়ার সবাই তাকে সিপাই নামে ডাকে। কান্দাপাড়ার নাম জানা থাকলেও মোতালেব এর আগে কোনো দিন এ-পাড়ার পাশ মাড়ায়নি। তাই রংচঙে মুখ ঢেকে দাঁড়িয়ে থাকা মেয়েদের দেখে ভয় পেয়ে যায়। মেয়েদের একজন, চিল যেমন মুরগির ছানাকে ছোবল দিয়ে উড়াল দেয়, ঠিক সেরকম উড়াল দেওয়ার মতো তাকে টেনে নিয়ে যেতে শুরু করলে মোতালেবের ভয় আরও বাড়ে। ভয়ে সে সিপাইকে ডাকতে পর্যন্ত ভুলে যায়। রিকশা ভাড়া মিটিয়ে ফিরে তাকাতেই ঘটনাটা প্রত্যক্ষ করে তালপাতার সিপাই, ‘আরে জুঁই, করতাছস কী? রমলা মাসি এই বেডারে জেলহাজত থেইক্যা ছাড়াইয়া আনছে। আগে অরে মাসির ঘরে নিয়া যা।’
মেয়েটি এবার হাত ছেড়ে বলে, ‘আসেন, মাফ কইরা দিয়েন, আমি বুঝতাম পারি নাই যে আপনে মাসির স্পেশাল গেস্ট। অবশ্য স্পেশাল গেস্টদের খেদমত করার জন্য মাসি বেশির ভাগ সময় আমারেই দায়িত্ব দেয়।’
মাসি দরজায় দাঁড়িয়ে যেন মোতালেবের আসার অপেক্ষা করছিল, ‘আসেন, আসেন, মুয়াজ্জিন সাহেব।’
মোতালেবের সঙ্গে জুঁই আর সিপাইও আসে রমলা মাসির ঘরে। মোতালেব দেখতে পায়, এতক্ষণ যেসব খুপরি ঘর দেখে এসেছে, সেগুলোর তুলনায় মাসির ঘরটা বেশ বড়। পুরনো আমলের খাটে পরিচ্ছন্ন চাদর বিছানো। মাথার ওপর ফলস সিলিং দেওয়ায় টিনের চাল দেখা যাচ্ছে না এবং গরমও কম লাগছে। ফলস সিলিং ছিদ্র করে একটা লোহার ডান্ডা নামিয়ে আনা হয়েছে নিচের দিকে, ওই লোহার মাথায় ঘুরছে ফ্যান। ফ্যানের স্পিড বাড়িয়ে দিয়ে মাসি বলে, ‘মুয়াজ্জিন সাব, জুঁইরে পছন্দ হইছেনি আপনের?’
মোতালেব একটু লজ্জা পেলেও জুঁই হেসে গড়িয়ে পড়ে, ‘ও মাসি, তুমি কি এই লোকের কথা কইছিলা আমারে। আমি যদি তার লগে থাকি তাইলে আমার তালপাতার সিপাইয়ের কী অইব?’
‘সিপাই আজকা থেইক্যা কঙ্কনের লগে থাকব। ওরে দিয়া তো বাচ্চা ফুটাইয়া লাভ নাই। ও খালি পোলাপানেরই জন্ম দিতে জানে।’
‘মাসি, কামডা কিন্তু ভালো অইল না’, বলে ঘর থেকে বেরিয়ে যাওয়ার সময় সশব্দে পা ফেলে মাটিতে, যেন পিটি-প্যারেড করছে পুলিশের সাবেক এই সিপাই।
রমলা মাসি জুঁইকে বেরিয়ে যাওয়ার জন্য ইশারা করে বলে, ‘তর আজকা কোনো কাস্টমার ডাকনের দরকার নাই। মুয়াজ্জিন থাকব তর লগে।’
মোতালেব এতক্ষণে মুখ খোলে, ‘মাসি, এইগুনা কী কইতাছেন। আমি আপনের পাড়ার মাইয়া লোকের লগে থাকতে যাইমু কোন দুঃখে?’
‘আমি থানায় গিয়া কথাবার্তা পাকা কইরা আসি নাই? আপনেরে আমি কই নাই, আমার অনেক মাইয়া বাচ্চা লাগব। আমার হিসাবমতন জুঁই যদি আজকা সহবাস করে তার পেটে বাচ্চা আসনের আশা আছে। আপনে আজকা জুঁইয়ের সঙ্গে রাত কাটাইবেন।’
‘এইডা তো বেশরিয়তি কাম’, বলে একটু থামে মোতালেব, আবার বলে ‘মাসি, আপনে আমারে এত বড় শাস্তি দিয়েন না।’
‘দেখেন মুয়াজ্জিন সাব, শরিয়ত আমারে শিখাইয়েন না। আপনেরে কি শরিয়ত শেখানোর লাইগ্যা আমি বার কইর‌্যা আনছি।’
‘আমি তো বেগানা নারীর সঙ্গে সহবাস করবার পারুম না।’
‘এইটা তো আগে ভাবি নাই।’ বলে কী যেন ভাবে রমলা মাসি, তারপর বলে, ‘ঠিক আছে, বেগানা নারীর সঙ্গে আপনের সহবাস করা লাগব না। আজকাই আমি আপনের লগে জুঁইয়ের বিয়া দিমু।’
‘আমি আপনের পাড়ার মেয়ে, জেনা করা যার জীবিকা, তারে বিয়া করতে যামু কোন দুঃখে?’
রমলা মাসি এবার রেগে যায়, ‘করবেন। আমি আপনেরে এই শর্ত দিয়া মৃত্যুদণ্ডের হাত থেইকা বাঁচাইয়া আনছি। আমি আজকা আপনের লগে জুঁইয়ের বিয়া দিমু। কদিন পর রেশমারে, তারপর আপনের লগে বিয়া দিমু চশমা আর মৌরিরে। শরিয়তে চাইর বিয়া করন যায়। আপনের চার বউয়ের যে আগে গর্ভবতী হইব, তারেই আপনে তালাক দিবেন। তখন আবার নতুন আরেকটা মাইয়ারে বিয়া দিমু আপনের লগে। কোনো সময় চারজনের বেশি বউ থাকবে না আপনের।’
মোতালেব এবার ভয় পেয়ে যায়। সে রমলা মাসির পা জড়িয়ে ধরে বলে, ‘মাসি, আমারে ছাড়ানের লাইগ্যা আপনার যত টাকা গেছে, আমি জমিজমা বিক্রি কইরা তা শোধ কইরা দিমু। তবু আপনে আমারে ছাইড়া দেন।’
‘টাকা শোধ কইরা তো পার পাইবেন না। আপনের মামলা আবার কোর্টে উঠব। ডাক্তাররা কইব, আপনের বাচ্চাটারে গলা টিইপা মারনের প্রমাণ পাওয়া গেছে। আগের রিপোর্ট ভুল আছিল।’
উপায়হীন মোতালেব গুমরে কাঁদতে শুরু করলেও ঘিঞ্জি এ-পল্লির অনেকেই তা শুনতে পায়। কাজেই রমলা মাসির ঘরের সামনে মেয়েদের ভিড় জমে যায়। ভিড়ের মধ্য থেকে জুঁইকে ডেকে এনে মাসি বলে, ‘মুয়াজ্জিন সাবরে তর ঘরে লইয়া যা। খাওনদাওন করাইয়া ওনারে রেস্ট নেওনের ব্যবস্থা কইরা দে।’
ক্ষিধে ছিল প্রবল, ঘুমও। তাই খাওয়া-দাওয়া শেষে লম্বা একটা ঘুম দেয় মোতালেব। জুঁই অবশ্য এর মধ্যে তার সঙ্গে কথাবার্তা বলার চেষ্টা করেছে। মোতালেবের সাড়া না পেয়ে একসময় তার পাশে শুয়ে ঘুমিয়ে পড়ে। নারীদেহের স্পর্শে ঘুম ভেঙে গেলে নিজের মধ্যে কেমন যেন সাড়া টের পায় সে। তবু নিজেকে হয়তো নিবৃত্ত করতে পারত, কিন্তু জুঁইয়ের প্ররোচনায় নিষেধের বাঁধ ভেঙে যায়। অসামান্য সুন্দরী এক নারীর দেহ তাকে মোহমুগ্ধ করে রাখে। কাজেই সন্ধ্যায় যখন তার জন্য নতুন পায়জামা-পাঞ্জাবি নিয়ে আসা হলো, বিনা ওজরে সে দুলহা সেজে চলল বিয়ে করতে। কাজি অফিসে যাওয়ার পর জানল জুঁইয়ের আরো একটি নাম আছে এবং সেই নামই কাবিননামায় লেখা হলো।
কান্দাপাড়া ছাড়িয়ে তাদের রিকশাটি যখন হাসপাতালের সামনে দিয়ে যাওয়া-আসা করছিল, তখন কেমন যেন একটু ভয় ভয় লাগছিল, মনে হচ্ছিল পরিচিত কেউ তাকে দেখে ফেললে কী হবে? তাই নবপরিণীতা জুঁইয়ের আঁচল টেনে নিয়ে নিজের মুখ ঢেকে রাখে। মোতালেবের মুখ ঢাকার এ-চেষ্টায় হাসিতে ভেঙে পড়ে জুঁই, ‘আরে হুজুর, আপনে শরম পাইতাছেন কী জন্য। এ-বিয়াটা আসলে ছোটবেলার বিয়া বিয়া খেলার মতন একটা ঘটনামাত্র। আমার পেটে বাইচ্চা আসলে মাসি আপনেরে কইব, এইবার জুঁইরে তালাক দেন।’
লজ্জা কাটানোর চেষ্টায় বলা জুঁইয়ের কথা যেন মোতালেবকে আরো লজ্জায় ফেলে দেয়। জুঁই সেটা বুঝতে পেরে মোতালেবকে আরো লজ্জা দেওয়ার জন্য বলে, ‘আমার মনে হয় বিকালে যে শট লাগাইছেন, তাতেই কাম হইয়া গেছে। আমি পেটের ভিতরে একটা বাইচ্চার কান্দন শুনতাছি।’
মোতালেব নিচুস্বরে বলে, ‘লজ্জা-শরমের মাথা খাইছেন আপনে। রিকশাআলা হুনতাছে না?’
‘শমসের শুনতাছ নি?’ এবার জুঁই রিকশাঅলাকে ডাকে এবং উত্তরে রিকশাঅলা হেসে বলে, ‘কান ত অহনও নষ্ট হয় নাই।’
‘হুজুর শরমাইয়েন না, শমসের মিয়া আমরার পাড়ার বান্ধা কাস্টমার। আমার লগেও বহুবার শুইছে সে। আজকাও দুপুরে আপনে যখন ঘুমাইতেছিলেন, তখন একবার দরজা ধাক্কাইয়া গেছে। আমি তারে কইছি, আমি এখন আমার স্বামীর লগে আছি, তুমি আরো কয়দিন পরে আইও।’
‘আপনে চুপ করেন। নাইলে আমি কিন্তু রিকশা থেইক্কা নাইমা আডা দিমু।’
রিকশা থেকে নেমে হাঁটা দেওয়ার শক্তি যে মোতালেবের নেই, তা জুঁইও জেনে গেছে। পেছনের রিকশায় সিপাইসহ স্বয়ং রমলা মাসি আছে। তবু মোতালেবকে আশ্বস্ত করে বলে, ‘হুজুর, আপনে অইলেন আমার বিবাহ করা স্বামী। আপনে চুপ করতে কইলে চুপ না কইরা উপায় আছে? এই যে আমি মুখে তালা দিলাম। আপনে না কওন পর্যন্ত এই তালা আর খুলতাম না।’
জুঁইয়ের যে-ঘর থেকে মাত্র ঘণ্টাখানেক আগে তারা বেরিয়ে গিয়েছিল, সে-ঘরই বেশ সাজানো হয়েছে। দরজায় রঙিন নিশান কেটে ঝালর লাগানো হয়েছে। ঘরের ভেতরেও ঝালর টানানো হয়েছে। বেলি, রজনীগন্ধা ও গোলাপ দিয়ে বানানো মালা দিয়ে ঘিরে দেওয়া হয়েছে বিছানার চারদিক। রেশমা, মৌরি ও চশমা ধান-দূর্বা দিয়ে তাদের ঘরে তুলে আনলে হঠাৎ মোতালেবের মনে পড়ে বহু বছর আগে হোসনা বেগমকে বিয়ে করে নিয়ে আসার পর তাদের বরণ করে ঘরে তুলবে বলে মঙ্গলকুলো নিয়ে এভাবেই দাঁড়িয়েছিল মাতৃকুলের নারীরা। একই সঙ্গে গ্লানি এসে গ্রাস করে তাকে, মনে পড়ে হোসনা বেগমকে সে যেভাবে তালাক দিয়ে এসেছে, তা শরিয়ত মোতাবেক হয়নি এবং এক স্ত্রীকে তালাক দিয়ে ইদ্দতকাল অতিক্রান্ত হওয়ার আগেই সে এমন একজনকে বিয়ে করেছে, জেনা করাই যার কর্ম। শুধু তা-ই নয়, আজ বিকেলে সে নিজে জেনার মতো গুরুতর পাপ করেছে। ফলে রমলা মাসির নিজের হাতে বহু যক্ষ করে রান্না করা পোলাও-কোর্মা খেতে গিয়ে বমি হয়ে যায় তার এবং রাতে জুঁইয়ের ঐকান্তিক চেষ্টা সত্ত্বেও সে সহবাসে লিপ্ত হতে পারে না।
দিনকয়েক পর জুঁইয়ের কাছ থেকে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে সব শোনার পর মাসি ডেকে আনে মোতালেবকে, ‘আপনে মিয়া কেমন মরদ। আমার মাইয়াগুলানের মধ্যে সবচেয়ে সুন্দরী ও যুবতী মাইয়াটার লগে বিচিকাটা খাসির মতন পইড়া পইড়া ঘুমান।’
‘আমার ডর লাগে।’
‘কিয়ের ডর?’
‘রোজ হাশরের ময়দানে জেনা করনের কী জওয়াব দিমু।’
‘আল্লাহর কাছে আমার নামে বিচার দিয়া কইবেন, কান্দাপাড়ার রমলা মাসি আপনেরে বন্দি কইরা জেনা করতে বাধ্য করছে। গুনাগাতা সব আমার নামে লেখাইয়া দিবেন।’
জুঁই হাসতে হাসতে বলে, ‘মাসি গো, তোমারে কী কমু, পয়লা দিন তুমি আমার ঘরে হুজুররে খাওইয়া-দাওয়াইয়া রেস্ট করাইতে পাঠাইলা না। তিনি খাইলেন, খাইয়া নাক ডাকাইয়া ঘুম দিলেন। আমি আর কী করুম হুজুরের পাশে শুইয়া ঘুম দিলাম। কতখান ধইরা ঘুমাইছি কইতে পারি না। হুজুরের চুমাচাপটির চোটে ঘুম ভাইঙ্গা গেল আমার। বাধা দিয়া থামাইতে পারি নাই।’
রমলা মাসি কৌতুকের হাসি দিয়ে বলে, ‘কী মিয়া, বিয়ার আগে যে-কামটা জোর কইরা করলা, বিয়ার পর সেইটা পারো না কী জন্য?’
‘মাসি, আমার হুজুররে আর বকাবকি দিও না। সব ঠিক অইয়া যাইব।’
‘কী ঠিক অইব। তুই মাগি তোর জোয়ানকি দিয়া কী করছ? একটা মরদের মধ্যে মর্দানি জাগাইতে পারছ না। নে, বড়িটা ল, ঘুমাইতে যাওয়ার ঘণ্টাখানিক আগে তর হুজুররে এইটা খাইতে দিবি।’
বড়ির গুণে হোক আর জুঁইয়ের জোয়ানকির জোরে হোক মোতালেব সে-রাতে আবার নারীর স্পর্শে শিহরিত হয়।
পরের দিন জুঁইয়ের কাছ থেকে এ-তথ্য জানার পর রমলা মাসি এবার রেশমার সঙ্গে মোতালেবের দ্বিতীয় বিয়ের আয়োজন করে। শুধু তা-ই নয়, মাসির পূর্বসিদ্ধান্ত অনুযায়ী একে একে চশমা ও মৌরিকে বিয়ে করতে বাধ্য হয় মোতালেব।
মোতালেব প্রথম প্রথম কয়েকদিন তার পোষা দুই জিন শেরালি ও পিরালিকে ডাকাডাকি করছিল। একসময় তার মনে হয়, এই পাপপুরীতে ওরা আসতে নারাজ, অন্য সময় মনে হয় তার স্ত্রী হোসনা বেগম ঠিকই বলত, জিনটিন কিচ্ছু নেই, এগুলো তার কল্পনা। শেরালি ও পিরালির সাড়া না পেয়ে রিকশাঅলা শমসের মিয়াকে দিয়ে খবর পাঠায় খাদিজার জামাই তাহেরের কাছে। শমসের খবর নিয়ে এসে বলে, ‘তাহের মিয়া আপনের লাইগ্যা কিছু করত পারব না। হে আপনেরে জানাইতে কইছে আপনের বউ মইরা গেছে। আপনের দ্বিতীয় মেয়ে আয়শারে তার জামাই তালাক দিয়া কইছে, যার বাপ মুয়াজ্জিন অইয়া বেশ্যাপাড়ায় আশ্রয় নিছে, তার লগে ঘর করন যায় না। বাচ্চা দুইটারে রাইখা দিয়া আপনের মেয়েরে আপনের বাড়িত পাঠাইয়া দিছে।’
মোতালেব এ-খবর পেয়ে অস্থির বোধ করে, তার আরো পাঁচটি মেয়ে অলি, কলি, জুলি, মলি ও পলির কথা মনে পড়ে, যাদের নাম সে রাখেনি, রেখেছিল ওদের মা। মোতালেব ঠিকই ওদের চিনত; কিন্তু সবসময় না চেনার ভান করত, অলিকে হয়তো কলি ডাকত আবার পলিকে ডাকত অলি। এখন মনে হয়, মেয়েগুলোরে আরেকটু ভালোবাসা দিয়ে বড় করা উচিত ছিল তার।
মেয়েদের খবর এনে দিতে শমসের মিয়াকে ধরে মোতালেব। খবর যা পায়, তা তাকে পাগল করে তুলে এবং সে এক রাতে পালানোর চেষ্টা করে। পারে না, ধরা পড়ে যায় তালপাতার  সেপাই এবং অন্য পাহারাদার জাম্বো ও গাম্বোর কাছে। শাস্তি হিসেবে রমলা মাসি নিজে দাঁড়িয়ে থেকে মোতালেবকে মুগুরপেটা করায়। পরে আবার ডাক্তার ডেকে এনে চিকিৎসার ব্যবস্থাও করে। মোতালেবের চার বউয়ের দুজন রেশমা ও চশমা মারধরের এ-ঘটনা দেখে পাড়ার আর সব মেয়ের সঙ্গে হাসি-তামাশা করলেও জুঁই ও মৌরি এ নিয়ে মাসির সঙ্গে ঝগড়াঝাটি পর্যন্ত করতে শুরু করে।
দিনের বেলা তার বউদের সবাই কাস্টমার নিয়ে ব্যস্ত থাকে। কখনো কখনো রাতেও তার চার স্ত্রীর সবাই স্পেশাল ডিউটিতে নিযুক্ত হয়। তখন সে তালপাতার সেপাইয়ের সঙ্গে পাড়া পাহারা দিয়ে বেড়ায়, পাহারা দেওয়ার এক ফাঁকে পালানোর মতলবে সিপাইকে ফাঁকি দিয়ে পাড়া ছেড়ে বেরিয়ে যায়। বেরোতে গিয়ে ধরা পড়ে। মোতালেবকে মারধর করার পর জুঁই তাকে নিয়ে নিজের ঘরে তোলে এবং মাসির চোখ রাঙানি উপেক্ষা করে পুরো এক সপ্তাহ জুঁই তার ঘরে কোনো খদ্দের ঢুকতে দেয় না।
সে রাতদিন সেবা করে মোতালেবের, মাঝেমধ্যে মৌরিও আসে। রিমান্ডে গরম পানি ঢালায় তার কপালে যে দাগ পড়েছিল প্রতিদিন তিনবেলা মলম লাগিয়ে তাও প্রায় সারিয়ে ফেলে জুঁই। এ ঘটনায় অভিভূত হয়ে পড়ে মোতালেব। টুপি তো পল্লিতে ঢোকার দিন মাথা থেকে ফেলে দিয়েছিল, এবার জুঁইয়ের ইচ্ছায় দাড়িও উধাও করে দিলো। অবশ্য তার নিজেরও মনে হচ্ছিল এত পাপাচারের মধ্যে দিন গুজরান করে দাড়ি রাখার কোনো অর্থ হয় না।
পুরো এক সপ্তাহ পর মোতালেব তখন বেশ সুস্থ হয়ে উঠেছে, জুঁই রাতে তার এক বান্ধা বাবুর সঙ্গে থাকতে রাজি হয়। বাবুকে ঘরে রেখে বাইরে এসে মোতালেবকে ডাকে, ‘হুজুর, একটা কথা আছে।’
জুঁই প্রথম দিন থেকেই মোতালেবকে ‘হুজুর’ ও ‘আপনি’ সম্বোধন করে আসছে, মোতালেবও তাকে ‘আপনি’ বলেই ডাকে। জুঁইয়ের ডাকে পাড়ার একপ্রান্তে এসে দাঁড়ায় মোতালেব। আসার পথে মেয়েদের কেউ কেউ তাকে ‘বেরেশ’ মানে ‘ষাঁড়’ বলে যে রসিকতা করছে তাও বুঝতে পারে। প্রথম প্রথম এরকম ডাক শুনে তার রাগ হতো। এখন মেনে নিয়েছে। আজ আবার ‘বেরেশ’ ডাক শোনার পর তার ছোটবেলার একটা ঘটনা মনে পড়ে, তাদের গ্রামে একমাত্র শুক্কুর আলীরই একটা ষাঁড় ছিল। গাই গরুর যখন প্রজননের সময় হয়, তখন সে ডাকাডাকি শুরু করে, যাকে মোতালেবদের যমুনা চরের গ্রামগুলোতে গাইয়ের ডাক ওঠা বলে। ডাক উঠলে সবাই গরু নিয়ে যেত শুক্কুর আলীর বাড়িতে। মোতালেবের মনের মধ্যে যে-ঝড় বয়ে চলছে তা তো জুঁইয়ের জানা নেই, তাই সে উৎফুল্ল কণ্ঠে বলে, ‘হুজুর, শুনেন, আমার বাইচ্চা অইব। আমি কিন্তু অহনও মাসিরে কিছু জানাই নাই। আপনে কিছু কইয়েন না।’
‘আসমানে চান উঠলে সেইডা আপনে গোপন রাখবেন কেমনে?’
মোতালেবের প্রশ্নের উত্তরে জুঁই বলে, ‘সময় অইলে জানানো যাবে। কিন্তু একটা কথা আপনেরে জানাইয়া রাখি, আমি চাই না, আমার মাইয়া এই বেশ্যাপল্লিতে বড় হোক।’
‘মাইয়া হইব নিশ্চিত হইছেন কেমনে?’
‘আপনেরে তো মাসি আনছে মাইয়া জন্ম দেওয়ানোর লাইগ্যা।’
এরপর আর কথা চলে না। মোতালেবের মনে পড়ে, একবার তাদের গাই গরুটার ডাক উঠলে সে নিজেও তার আব্বার সঙ্গে নিজেদের গাই গরু নিয়ে গিয়েছিল। তাদের গাই গরুর সঙ্গে বেরেশের মিলন ঘটিয়ে দেওয়ার বিনিময়ে পাঁচ টাকা দিতে হয়েছিল শুক্কুর আলীকে। জুঁই যখন তাকে জানাল সে গর্ভবতী হয়েছে, নিজেকে তার শুক্কুর আলীর ষাঁড়ের মতো মনে হলো। তবু জুঁইয়ের আনন্দ ম্লান করে দেওয়া হবে বলে নীরবতা অবলম্বন করে।  অবশ্য সিপাই চলে আসায় চাইলেও মোতালেব আর কিছু বলতে পারত না। সিপাই বলে, ‘জুঁই, তর বান্ধা বাবু বইয়া বইয়া বিরক্ত অইতাছে। তাড়াতাড়ি যা।’
জুঁই চলে যাওয়ার পর সিপাই বলে, ‘লও মুয়াজ্জিন, চা-বিড়ি খাইয়া আসি।’
গত কয়েক মাসের মধ্যে মুয়াজ্জিন মোতালেবের জীবনে আরো একটা বড় পরিবর্তন হলো। এখন সে চা-সিগারেটে আসক্ত হয়ে পড়েছে। সিপাই জোর করে মাঝে কয়েকদিন মদও খাইয়ে দিয়েছে তাকে। মদ্যপানে এখন আর আপত্তি নেই তার। তবে মদ গলা দিয়ে নামার সময় যে জ্বলুনি শুরু করে, তা সে সহ্য করতে পারে না বলেই এড়িয়ে চলে। সিপাই বলে, ‘পয়সা থাকলে কান্দাপাড়ায় বাঘের চোখও কিনতে পারবা। কিন্তু পলাইতে চাইলে পারবা না।’
মোতালেব বলে, ‘যদি আমার শেরালি আর পিরালিরে আনতে পারতাম?’
একসময় এই পল্লির অনেকের জন্য মোতালেব মুয়াজ্জিনের দেওয়া জিনের পানিপড়া আনতে গিয়েছে। সে-কথা সে এখন স্বীকার করতে নারাজ। তাই হেসে উড়িয়ে দিয়ে বলে, ‘ধুর মিয়া, জিনটিন বইল্যা কিছু নাই।’
‘হেইডা বুঝনের মতো ঘিলু তোমার আছেনি? আমি কোরানের হাফেজ, আমি জানি, জিন আর ইনসানের মাজেজা।’
‘হ, সবজান্তা শমসের অইছ?’
সিপাইয়ের সঙ্গে আলাপ চালিয়ে গেলেও মোতালেব পালানোর তক্কে তক্কে আছে, তাই বলে, ‘লও, তোমারে মাল খাওয়ামু। আমার চাইর বউ পাঁচশো কইরা মোট দুই হাজার টাকা দিছে।’
পরিকল্পনা ছিল সিপাইকে মদ খাইয়ে মাতাল করে পালানোর চেষ্টা করবে। প্রকৃতপক্ষে ঘটে উলটোটা। নিজেই মদ খেয়ে এত মাতাল হয় যে বমি করে ভাসায় মদের দোকান এবং একসময় অচেতন হয়ে দোকানের চাটাইয়ে ঘুমিয়ে পড়ে।
সকালে রমলা মাসি এসে ভাঙায় তাদের ঘুম, ‘বলি মুয়াজ্জিন, আজকা যে তোমার কোর্টে হাজিরার দিন, এইটা মনে নাই?’
কান্দাপাড়ায় বন্দি হওয়ার পর অনেকবারই মোতালেবের মনে হয়েছে, কোনটা ভালো ছিল, জেলখানা, না পতিতাপল্লি? শেষ পর্যন্ত অবশ্য সিদ্ধান্তে আসতে পারে না সে। কারণ, তার মনে হয়, মেয়েটাকে বোধহয় সে নিজেই খুন করেছে আর খুনের শাস্তি মৃত্যুদণ্ড।
জুঁই ও মৌরি তার কাছে বারবার জানতে চেয়েছে, ‘হুজুর, সত্য কইরা কন, আপনে কি সত্যই নিজের মাইয়ারে খুন করছেন?’
‘না। আমি খুন করি নাই। বাচ্চাটা মনে হয় আমি কোলে নেওয়ার আগেই মারা গেছিলো।’
রিমান্ডে যেমন বারবার নিজের মেয়েকে খুন করার কথা স্বীকার করেছে, তেমনি জুঁইয়ের প্রশ্নে বারবারই অস্বীকৃতি জানিয়ে যাচ্ছে। তবু জুঁই জানতে চায়, ‘মাসি যে কয় সে পয়সাপাতি দিয়া খুনের ঘটনাটা চাপা দিছে। ডাক্তাররে মেলা টাকা দিয়া নিউমোনিয়ার কথা লিখাইয়া আনছে?’
জুঁইকে বোঝাতে গিয়ে মোতালেব যেন নিজেকেই বোঝায় যে, সে তার মেয়েকে খুন করেনি। এখন কোর্টে হাজিরা দিতে যাওয়ার জন্য তৈরি হতে গিয়ে সে ওই ঘটনাটা আরও একবার ভেবে দেখার চেষ্টা করে। মোতালেব তো হাসপাতালে আসার আগে ঠিক করে এসেছিল স্ত্রীর কাছে মাফ চেয়ে নেবে, অথচ তাকে বাথরুম থেকে বেরোতে দেখে মুখ ঢেকে পালাল।
পালাল কেন? একবার মনে হয় লজ্জা পেয়ে পালিয়েছিল সে। এত বছরের দাম্পত্য জীবনে হোসনা বেগম তো সাত চড়ে রা করেনি, অথচ অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে আসার দিন সে স্বামীকে মারার জন্য বঁটি নিয়ে তাড়া করেছিল, ওই ঘটনা মনে পড়ে যাওয়ায় পালিয়েছিল সে? কিছুই ঠিকমতো মনে করতে পারে না। তার আবার মনে হয় কোলে নিতে গিয়ে বাচ্চাটার গলা টিপে ধরেনি তো? তার মাথা কি তখন থেকে খারাপ হয়ে গেছে, বাড়তি কিছু ভর করেছে যার প্ররোচনায় সে নিজের মেয়েকে খুন করেছে?
মামলার বাদী হোসনা বেগম মারা যাওয়ার পর আদালতে তার পক্ষে কোনো আইনজীবীও উপস্থিত থাকে না এবং সাক্ষ্য-প্রমাণে বিবাদী যে নিরপরাধ, তা প্রমাণিত হওয়ায় বিচারক মামলার একমাত্র আসামি মুয়াজ্জিন ও হাফেজ আবদুল মোতালেব আলীকে বেকসুর খালাস প্রদান করেন। পাড়ায় ফেরার পথে মোতালেবের একবার মনে হয়, যত পাহারা থাকুক, সে পালাতে চাইলে জনগণ তাকেই সহযোগিতা করবে। শেষ পর্যন্ত সে তা করে না, তার মনে হয়, এই মুখ নিয়ে আয়শার সামনে গিয়ে দাঁড়াবে কী করে। খবর পেয়েছে, খাদিজা ও আয়শার ছোট পাঁচ বোনের মধ্যে সবচেয়ে ছোটটি, যার নাম পলি, সে তাঁতিদের এক ছেলের সঙ্গে পালিয়ে গিয়ে বিয়ে করেছে। বাকি চারজনকে নিয়ে গ্রামের বাড়ি আগলে রেখেছে আয়শা। খাদিজা ও তার জামাই আবু তাহের যেমন পারে সহযোগিতা করছে ওদের।
বেকসুর খালাস হয়ে ফিরে আসার পর মোতালেব কান্দাপাড়ার পরিবেশ-পরিস্থিতির সঙ্গে নিজেকে আরো খাপ খাইয়ে নেয়। নিজের চার স্ত্রী জুঁই, রেশমা, চশমা ও মৌরির সঙ্গে সারাক্ষণ রঙ্গরসিকতা করে বেড়াচ্ছে। আজ এর কাছ থেকে টাকা নেয় তো কাল ওর কাছ থেকে। চাইলে মাসিও টাকা-পয়সা দেয় তাকে। সেই টাকা সে ওড়ায় তালপাতার সেপাইয়ের সঙ্গে মদ-সিগারেট খেয়ে।
দিন-মাস কাটে। সন্তান প্রসবের সময় এগিয়ে আসছে জুঁইয়ের। রমলা মাসি চাপ দিচ্ছে, ‘মুয়াজ্জিন সাব, অহন তুমি জুঁইরে তালাক দেও।’
মোতালেবের এখন আর কোনো কথা বলতেই বাধে না, মাসির মুখের ওপর বলে দেয়, ‘আপনে তো নিয়মনীতি কিছুই জানেন না, পোয়াতি স্ত্রীরে শরিয়ত মোতাবেক তালাক দেওয়া যায় না। আগে বাইচ্চাডা হোক, তারপর ভাইবা দেখবেন নে।’
‘তো তোমার এই কথাডা না হয় মাইনা লইলাম। কিন্তু তোমার বাকি তিন বউয়ের পেটে বাইচ্চা আসতাছে না কেন?’
‘আমি তো আর আল্লাহ না। জীবন তাইনে দেন।’
‘কথায় কথায় এত আল্লাহবিল্লাহ কইরো না তো? আমার তো মনে অইতাছে তোমার লগে মিইল্যা গিয়া আমার মাইয়াগুলান বাচ্চা না অওনের কোনো ব্যবস্থা নিছে।’
মোতালেবের চার বউয়ের মধ্যে একমাত্র মৌরি এ-সময় উপস্থিত ছিল। বয়সে সে সবার ছোট হলেও সে সবার তুলনায় ঠোঁটকাটা, মাসির মুখের ওপর আঙুল তুলে বলে, ‘আমি তো মুয়াজ্জিনরে আমার সঙ্গে থাকার সময় জোর কইরা পায়জামা পরাইয়া লই?’
‘কেন? এই কাজ করছ কেন? আমি তরারে কই নাই আমার অনেক মেয়ে বাচ্চা লাগব।’ রাগে যেন কাঁপে রমলা মাসি। সে মোতালেবকে বলে, ‘তুমি কনডম পরাইতে দেও কেন?’
মোতালেবের উত্তর দিতে হয় না, মৌরি বলে, ‘হ, বাইচ্চা বিয়াই আর তুমি তারারে দিয়া ব্যবসা করো?’
‘চুপা করিস না, মৌরি। আগামী দুই মাসের মধ্যে পেট বাঁধাইতে না পারলে তরে আমি দৌলতিয়ায় বেইচ্যা দিমু।’
‘তোমার কেনা মাল, তুমি যেখানে ইচ্ছা বেচবা’ বলে চলে যায় মৌরি।
ওইদিন রাতে মরিয়ম ওরফে মৌরির সঙ্গে থাকতে গিয়ে মোতালেব জানতে চায়, ‘কেনা মাল বলতে মাসিরে কী বুঝাইছিলা?’
মৌরি জানায়, সে প্রেমিকের হাত ধরে ঘরবাড়ি ছেড়ে পালিয়ে এসেছিল বিয়ে করে ঘরসংসার পাতবে বলে। সে জানত না, তার প্রেমিক কত বড় নষ্ট মানুষ। ওই প্রেমিক তারে কুমিল্লা থেকে নিয়ে আসে টাঙ্গাইলে। দুই রাত হোটেলে কাটানোর পর নিজেদের জন্য বাড়ি দেখার নাম করে কান্দাপাড়ায় রেখে পালায়। সে একে একে বলে রেশমা ও চশমার কথা। ওরা দুজন চাচাতো বোন। রমলা মাসির এক মহিলা দালাল গার্মেন্টসে চাকরি দেবে বলে রংপুর থেকে এখানে নিয়ে আসে তাদের।
মোতালেবের আগ্রহ জুঁইয়ের কথা জানার, যা সে জুঁইয়ের কাছ থেকে জানার চেষ্টা করেও জানতে পারেনি। তাই জানতে চায়, ‘জুঁইয়ের কথা কিছু কইলা না?’
‘ও আল্লাহ, জুঁই আপা তোমারে কিছু জানায় নাই? তার লগে না তোমার গলায় গলায় পিরিত।’
‘না, জানায় নাই, আমি কত জিগাইলাম, হে উত্তর দেয় না।’
‘জুঁই আপা নিজের ইচ্ছায় আইছে এই পাড়ায়।’
মোতালেব আশ্চর্য হয়, ‘এইডা কী কইলা?’
‘আগে শুইন্যা লও, জুঁই আপা কিন্তু এসব কথা আমারে ছাড়া আর কাউরে কয় নাই। তুমিও কাউরে কইবা না কিন্তু। জুঁই আপা আছিল হিন্দু। তার আগের নাম ছিল জয়শ্রী। আচ্ছা, তুমি কি আমার আসল নামটা জানো?’
‘জানি, তোমার আসল নাম মরিয়ম। হজরত ঈসা নবীর মায়ের নামে নাম। আচ্ছা, জুঁইয়ের কথা কও।’
‘জুঁই আপা কলেজে পড়ত। একদিন কলেজ থেকে ফেরার পথে চাইর মুসলমান বেডা তারে ধইরা নিয়া পাটক্ষেতের ভিতর ফালাইয়া র‌্যাপ করল। র‌্যাপ করার দৃশ্য ভিডিও করল তারা। তারপর ওই ভিডিও আবার ছড়াইয়া দিলো আশপাশের সব জাগায়।’
‘কী আশ্চর্য, র‌্যাপ করল আবার ভিডিও করল? ভিডিওতে ওই চারজনরে দেখা যায় নাই?’
‘না, ওই বেডাদের একজন ছিল ভিডিও দোকানের মালিক, সে জুঁই আপার সঙ্গে প্রেম করতে চাইছিল। আপা রাজি না হওয়ায় তিন বন্ধুরে লইয়া এই কাজ করছে।’
‘হের পর?’
‘আর কী, ঘটনা জানাজানি হইয়া যাওয়ায় আপারে তার বাড়ির মানুষ শেল্টার না দিয়া দিলো বাড়ির বার কইরা। আপা আইস্যা ধরল ওই ভিডিঅলারে। কইল, তুমি আমারে বিয়া করবা, নাইলে আমি গলায় ফাঁস দিমু আর সবকিছু লেইখ্যা রাইখ্যা যামু। বেডা ডরাইয়া গিয়া রাজি অইল। জুঁই আপাও মুসলমান হইয়া তারে বিয়া করল, নতুন নাম রাখল সালেহা।’
‘তারপর?’
‘তারপর আর কী? বন্ধুবান্ধব লইয়া যে-মেয়েরে গ্যাং র‌্যাপ করছে, তারে কি আর বউ হিসেবে মানতে পারে পুরুষ মানুষ। বেডা আপারে ছোঁইয়াও দেখে না আর। বাইরে বাইরে পলাইয়া বেড়ায়। এর মধ্যে আরেকটা বিয়া কইরা বউ আইন্যা ঘরে তুলল। নতুন বউ খাটে পা তুইল্যা খায় আর আপা খাইট্টা মরে। তাইলে সইত, কিন্তু বেডা আবার দিন-রাইত যখন ইচ্ছা আপারে ধইরা মাইরধর করে। না পাইরা আপা পলাইয়া আইস্যা নিজেই এই কান্দাপাড়ায় উঠল।’
মৌরি যখন জুঁইয়ের জীবনের করুণ কাহিনি মোতালেবকে শোনাচ্ছিল, তখনই জুঁইয়ের প্রসববেদনা শুরু হয়। মাসি তাকে নিয়ে হাসপাতালে রওনা দেয়। সঙ্গে নিয়ে যায় সিপাইকেও।
পরদিন সকালে দরজা খুলে মোতালেব দেখে খুশির বান ডেকেছে রমলা মাসির পট্টিতে। এ-ওকে মিষ্টি খাওয়াচ্ছে। রমলা মাসি বলে, ‘মুয়াজ্জিন, তাড়াতাড়ি হাতমুখ খুইয়া আসো। পরীর মতন একটা মাইয়া হইছে তোমার।’
হাত-মুখ ধুয়ে মাসির কাছ থেকে এক বাটি মিষ্টি নিয়ে মৌরির ঘরে যায় মোতালেব। ততক্ষণে মৌরির ঘুম ভেঙে গেছে এবং মাসির চিৎকার করে দেওয়া খবর তার কানেও এসে গেছে। মোতালেবকে মিষ্টি খেতে দেখে ফুঁসে ওঠে মৌরি, ছোবল দেওয়ার আগে সাপ ফণা তুলে যেমন শব্দ করে, তেমন হিসহিস শব্দ করে বলে, ‘মিষ্টি না খাইয়া তুমি বিষ খাইতে পারো না?’
‘কী অইছে, ক্ষেপছ কিয়ের নিগা।’
‘তোমার এখন জুঁই আপারে ডিভোর্স দেওয়া লাগব। মাসি একটা নতুন মেয়ে কিনছে, তোমার লগে তার বিয়া দিব। তবে মাইয়াডা কুনোভাবে পোষ মানতাছে না। মাইরধর চলতাছে। কিন্তুক মাইয়ার এক কতা। বিষ খাইব, তবু পরপুরুষের লগে জিনা কইরব না।’
‘বালাই কয় মাইয়া। না, আমিও আর বিয়াসাদিত নাই। আমি আমার বাচ্চাডারে তো নিমুই, লগে জুঁইরে লইয়া পলামু। তুমি খালি আমারে এই পাড়া থিকা বাইর অওনের ব্যবস্থা কইরা দিও।’
‘সত্যই আপনে জুঁই আপারেও লইয়া যাইবেন?’
‘হ, সত্যই নিয়া যামু।’
‘ঠিক আছে, তাইলে আমি ব্যবস্থা কইরা দিমু।’
হাসপাতালে এক সপ্তাহ কাটিয়ে ফিরেছে জুঁই। মোতালেব ঘুরেফিরে জুঁইয়ের ঘরে আসে। মৌরি তো সারাক্ষণের জন্য আসন পেতে বসেছে এ-ঘরে, ‘কী হুজুর, তুমি না জুঁই আপা আর তার বাচ্চারে নিয়া পলাইবা?’
‘পলামু, কটা দিন যাক।’
‘হুজুর, আমি তো আপনের লগে যামু না। আমরা তো জানি, আপনে নিজের মাইয়ারে খুন কইরা জেলে গেছিলেন।’ জুঁই স্পষ্ট আপত্তি জানিয়ে বলে, ‘পারলে আমি নিজেই মাইয়াটারে লইয়া পলামু।’
‘আপনেরারে আমি কতবার কইছি, আমি আমার মাইয়াডারে খুন করি নাই। মাইয়ার মা সন্দেহ কইরা মামলা দিছিল।’
হঠাৎ ‘আগুন, আগুন’ চিৎকার শুনে দৌড়ে বেরিয়ে যায় মৌরি ও মোতালেব। ঘটনাস্থলে পৌঁছার আগেই জানতে পায়, নতুন আনা মেয়েটা গায়ে কেরোসিন ঢেলে আগুন লাগিয়ে আত্মহত্যা করেছে। মৌরির কাছে মোতালেব নতুন মেয়েটার নাম জানতে চায়।
‘নাম জাইনা কী অইব?’
‘কও না, জাইনা রাখি।’
‘পলি।’
আচমকা যেন পাগলামি ভর করে মোতালেবের গায়ে। ‘কী কইলা? পলি…’ বলতে বলতে ছুটতে থাকে সে। সবাইকে ঠেলে এগিয়ে যায়। তারপর মেয়েটি যেখানে মরে পড়ে আছে, সেখানে গিয়ে থামে সে। পলি!  এ যে তার ছোট মেয়েটা।
হঠাৎ মাথা চক্কর দিয়ে ওঠে মোতালে১বের। আগুনে পোড়া এই ঝলসানো শরীরের মেয়েটা তার আত্মজা! আর এর সঙ্গেই কিনা তার বিয়ে দিতে চেয়েছিল রমলা মাসি।
একটু সুস্থির হওয়ার পর ভিড়ের মধ্যে জুঁইকে দেখতে পায় এবং এটাই সুযোগ বুঝতে পেরে দ্রুত ফিরে যায় জুঁইয়ের ঘরে।
বাচ্চা মেয়েটি ঘুমাচ্ছে। তার মনে হয়, ওর সঙ্গে পলির কোথায় যেন একটা মিল আছে। এমন সময় বহুদিন পর শেরালি ও পিরালির কথা শুনতে পায় সে। ওরা বলে, ‘মাইয়াডারে কোলে লন, কেউ দেখতে পাইব না।’
‘এমুন মাসুম বাইচ্চারে আমি মানুষ করুম কেমনে?’
এবার আর জিনেরা কথা বলে না, কথা বলে মৌরি, ‘লইয়া যান, নিয়া আপনের মেয়েদের হাতে তুইল্যা দেন। তারাই এরে বড় করতে পারব।’
মোতালেবকে দ্বিধা করতে দেখে মৌরি নিজেই বাচ্চাটাকে কোলে তুলে নেয়, ‘আপনে শর্টকাট মাইরা মেইন রোডে গিয়া খাড়ান, আমি ঘুরাপথে অরে লইয়া আয়তাছি।’
মৌরি বেরিয়ে যেতে জিনদের দুজনও তাড়া লাগায় এবং সেও ভাবে, এক মেয়েকে হারিয়ে আরেক মেয়ে পেয়েছে। এখন কেবল বাচ্চাটারে নিয়ে মালতিপাড়ায় পৌঁছতে পারলেই হয়।