ছোট গল্প

  • চিহ্নহীন

    মণিকা চক্রবর্তী সূর্যটা তখন সমস্ত আকাশ পারাপার করে পশ্চিমে ঢলে পড়েছে। কোথা থেকে একটা প্রবল বাতাস এসে দুলিয়ে দিলো তার ঘাড়ের কাছে ঘামে লেপ্টে থাকা উদ্দাম চুলগুলোকে। চল্লিশ ফুট উঁচু বাঁশের ঝোলার ওপর দাঁড়িয়ে ঝুলতে ঝুলতে শাজাহান ভাবে, আইজকার লাইগ্যা কাম শেষ হইল। ঝুলতে ঝুলতেই সে তার শার্টের পকেটে রাখা বিড়িটি ঠোঁটে চেপে রেখে অতি…

  • মন-সংক্রান্তি

    মনি হায়দার নাহার এমনিতেই সুন্দরী। অফিসে যাওয়ার সময় হালকা সাজলে চোখ ফেরানো কঠিন। সকালে অফিসে যাওয়ার জন্য প্রস্তুত হয়ে ড্রয়িংরুমে ঢোকে। ড্রয়িংরুমে নিবিড়মনে পত্রিকা পড়ছে খালেদ। হাতে সিগারেট। মুখে আর নাকে ধোঁয়ার কুণ্ডলি। নাহারকে দেখে পত্রিকা থেকে চোখ তোলে – অফিসে যাচ্ছো? হ্যাঁ। তুমি কখন যাবে? যাবো একটু পর। খালেদের কথায় হাসে নাহার। তুমি হাসছো…

  • ইও নলো সো

    মাহবুব রেজা কয়েকদিন ধরে ব্যাপারটা হয়ে আসছিল। ও আমাকে সহ্য করতে পারত না। আমার জায়গায় ওর দেশের এক ছেলেকে ঢোকানোর জন্য শেফ নাশা আমার ওপর বেপরোয়া হয়ে উঠেছিল। আমার কাজে-কর্মে সামান্য ভুল হলে ওটাই বড় করে মালিকের সামনে তুলে ধরত আর যাচ্ছেতাই ভাষায় আমাকে গালাগাল করত। ইতালিয়ান মালিক অ্যান্তোনিও তখন শেফের কথাকে গুরুত্ব দিয়ে আমাকে…

  • প্রয়াত জনকের সঙ্গে ইহজনম

    হুমায়ূন মালিক সহসাই তার মনে হয়, একজন নয় তাকে তাড়া করছে অনেকে। প্রথমে তো শাবান মণ্ডলের পোলা মবিন চেয়ারম্যান তার দিকে পিস্তল তাক করেছিল, আর ও দৌড়াতে শুরু করে। এখন তাকে ছাপিয়ে অনেক মানুষের পায়ের, গলার আওয়াজ – দৌড়ের মধ্যেই মমতাজ একবার মাথা ঘুরিয়ে দেখার চেষ্টা নেয় – এরা কারা! দেখে কুরুক্ষেত্রের অর্জুনের মতো সে…

  • বদহজম

    শাহনাজ মুন্নী খুব আশা ছিল, এবার হবেই। যারা অফিসের বড় কর্তাদের সঙ্গে উঠবোস করে, তারাও ইঙ্গিত দিয়েছিল এবার আর কিছুতেই সোনার হরিণ হাত থেকে ফসকাবে না, এতদিন ধরে আটকে থাকা প্রমোশনটা পেয়ে আরেকটু উচ্চপদে এ-বছর নিশ্চয়ই যাবে সে। উন্মুখ অপেক্ষা আর অপেক্ষা। কিন্তু হলুদ খামে ‘অতি জরুরি’ ছাপ দেওয়া সেই কাক্সিক্ষত চিঠিটি আর এলো না।…

  • পাতার পাহাড়, রক্তবর্ণ হিম আর উষ্ণবয়সী ব্ল্যাকবোর্ড

    পাপড়ি রহমান পাতার পাহাড় টিলার ওপর থেকে রাবার বাগানটাকে একেবারে পাতার পাহাড়ের মতো দেখায়। রাবার প্ল্যান্টগুলোর পাতাই কেবল দৃশ্যমান হয় বলে প্রাথমিকভাবে আমাকে এই বিভ্রমের ভেতর পড়তে হয়েছিল। অবশ্য এই বিভ্রমের ভেতর নাস্তানাবুদ হওয়ার আগে আমি ঝুক্কুর ঝুক্কুরের দুর্দান্ত স্বাদ পেয়েছিলাম। আদতে ওটাই ছিল আমার জীবনের প্রথম স্বাধীনতা। স্বাধীনতা মানে যেনতেন প্রকারের স্বাধীনতা নয়, দীর্ঘকাল…

  • বেলোর্মি

    রবিউল হুসাইন সামান্য এই পরিসরে কতটুকু সময়ই বা ধরে। আকাশ বিষণœ হলে আজকাল বৃষ্টি হয় না। মেঘগুলো বাতাসের সঙ্গে পরকীয়া প্রেমে মত্ত হয়ে শুধু সরে সরে যায়। দানা বাঁধে না। তাই বৃষ্টি হয়ে ওঠে না। বাতিঘর নিভে গেছে। জাহাজটি অকূল সমুদ্রে জলের ওপর দোল খায়। জলের ভেতরে জলমগ্ন অন্য পৃথিবী আর মাছ এবং মাছ-পরীদের জলজ…

  • ইঁদুর-বিড়ালের দিন

    রাশেদ রহমান এটা ছিল সেই সময়, যখন মৃতেরাই কেবল সুখে হাসতে পারতো শেষ পর্যন্ত নিষ্কৃতি মিলেছে Ñ এই বোধে Ñ আন্না আখমাতভা তখনো আমরা হাফপ্যান্ট পরি। আমি পরি ইংলিশ প্যান্ট। ইংলিশ প্যান্টের তখন অনেক দাম, দশ-বারো টাকা Ñ সব বাড়ির ছেলেরা পরতে পারে না। আবিদ, মিজান, সন্তোষ Ñ আমার বন্ধুরা তাজু খলিফার কাছে বানানো লংক্লথের…

  • সময় যখন কান্দনের

    কামরুজ্জামান জাহাঙ্গীর পাহাড়তলীর মেইন রাস্তার পাশ দিয়ে যে-রাস্তাটা বয়ে যায়, সে-রাস্তার পাশে যে একটা ভাঙা ব্রিজ আছে, সেই ব্রিজের উত্তর সাইডে যে-সরকারি চাকরিজীবীদের জন্য নির্মিত তিনতলা দালান আছে, সেখানে যে-রাত নামে, তা থেকেই একটা মাইয়ালোকের কান্দন শোনা যায়। এই কান্দন বয়ে নেওয়া নিয়ে যেমন নানান কিচ্ছা জমা হয়, অনেক কথা চালাচালি হয়। কান্দন-সৃষ্টি-করা নারী নিয়ে…

  • জ্যোৎস্নার ছোঁয়ায় যে-মানুষটি প্রতিবাদ করেছিল

    জাকির তালুকদার কয়েকটা বাবলাকাঁটা আর খয়েরগাছ ছাড়া এই মাঠে থাকার মধ্যে আছে শুধু ঘাস। কথা ছিল এখানে গ্রামের গোরস্তান হবে। কিন্তু সবটুকু জমির মালিকানা না পাওয়ায় কাজটা করা হয়ে ওঠেনি। সাত শরিকের মধ্যে তিনজন জমি লিখে দিয়েছে গোরস্তানের জন্য। চারজন দেয়নি। সে-কারণে বারো বছর ধরে পড়ে আছে পুরো জমি। কেউ আসে না ফসল ফলাতে। ফলে…

  • কৃতঘ্ন

    হরিশংকর জলদাস অর্জুনের কথা ‘আপনার স্ত্রী তো সুন্দরী?’ ‘হ্যাঁ স্যার, লোকে বলে।’ ‘আপনি বলেন না?’ ‘এ্যাঁ হ্যাঁ, তিষা দেখতে খারাপ নয়।’ ‘আমি জানি, আপনার স্ত্রী দুর্দান্ত সুন্দরী। আপনি বলছেন দেখতে খারাপ নয়!’ ‘একসময় আমার চোখে ও দুর্দান্ত সুন্দরী ছিল স্যার। এখন আর তেমন সুন্দরী মনে হয় না তাকে।’ ‘কেন, কেন মনে হয় না?’ ‘নিত্যদিন দেখার…

  • সেদিন আকাশে পূর্ণিমা ছিল না

    নুরুল করিম নাসিম সাবের রাতে আর বাড়ি ফিরলো না। আমরা সবাই খুব উদ্বিগ্ন। বাবা চিন্তিত। মা ডুকরে কাঁদতে লাগলেন। আমি সবার বড়। ঢাকা মেডিক্যাল কলেজে সেকেন্ড ইয়ারে পড়ি। মন শক্ত ও কঠিন না হলে ডাক্তার হওয়া যায় না। মন শক্ত করে অনড় হয়ে রইলাম। ভাবলাম, সাবের রাতে এই তুমুল ঝঞ্ঝাটের ভেতর বাড়ি না ফিরে ভালোই…