নানা ধরনের বিচ্ছিন্নতা সত্ত্বেও মানুষের দ্রোহী ও সংগ্রামী চেতনা, স্বাধীনতা ও স্বাধিকার চেতনা, মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় দেশপ্রেমিক মানুষকে একই সুতোয় বেঁধে ফেলেছেন হেলাল হাফিজ। কালচক্রে প্রোথিত মানব জীবনলীলার নিত্যতা, মানবীয় সারাৎসারের অভিশ্রুতি কবিতার পরিচর্যায় নানা কৌণিক দূরত্ব নিয়ে হাজির হয়েছে তাঁর কবিতায়। নিঃসন্দেহে হেলাল হাফিজ রোমান্টিক স্বপ্ননির্ঝরের কবি। প্রেম ও রোমান্সের একটা প্যাটার্ন তাঁর কবিতা-বাস্তবকে গড়ার প্রয়াস পেয়েছেন। জীবন-মৃত্তিকা, স্বদেশ-মৃত্তিকা আর প্রণয়-মৃত্তিকার মিশেল ভূমিতে হেলাল হাফিজের আত্মআবিষ্কার-স্পৃহা হার্দিক ও
বাসনা-মদির। মানুষকে তিনি আলোকতীর্থের পথিক হিসেবেই বিবেচনা করেন। অন্ধকার ও আলো তাই তাঁর চেতনায় বিচিত্র দ্যোতনায় স্পন্দিত।
হেলাল হাফিজের হৃদয়পৃথিবীর উজ্জ্বলতম হীরকখণ্ডটি হচ্ছে প্রেম। এই প্রেম তাঁর প্রধান কাব্যপ্রেরণার কাব্যপ্রণোদনাও বটে। জীবনের রোদঢালা পথে তাঁর প্রেমকে যেমন প্রত্যাশা করা যায়, তেমনি প্রত্যক্ষ করা যায়, বৃষ্টিচঞ্চল জীবনের প্রত্যয়ে। এই প্রেম যেমন অমূল্য, তেমনি অতুল্য। এই প্রেমে যেমন অমৃত আছে, তেমনি আছে কূটবিষ। প্রেমের কবিতায় কখনো হৃদয়াগ্নি ও প্রেমাগ্নি একাত্ম হয়ে যায়। কবি লেখেন :
হলো না, হলো না।
শৈশব হলো না, কৈশোর হলো না
না দিয়ে যৌবন শুরু, কার যেন
বিনা দোষে শুরুটা হলো না।
হলো না, হলো না
দিবস হলো না, রজনীও না
সংসার হলো না, সন্ন্যাস হলো না, কার যেন
এসবও হলো না, ওসব আরও না।
হলো না, হলো না।
সুন্দর হলো না, অসুন্দরও না
জীবন হলো না, জীবনেরও না, তার যেন
কিছুই হলো না, কিচ্ছু হলো না।
হলো না, না হোক,
আমি কী এমন লোক।
আমার হলো না তাতে কি হয়েছে?
তোমাদের হোক।
(‘সুন্দরের গান’, যে জলে আগুন জ্বলে)
হেলাল হাফিজের অনেক কবিতা আত্মচরিতমূলক। এসব কবিতা কবির লালিত স্বপ্নের উপর দৃঢ়ভাবে দাঁড়াতে চেয়েছে। জীবনের গূঢ় অর্থ আত্মচরিতমূলক কবিতার লালিত স্বপ্নের ওপর নিশ্চিন্তে দাঁড়িয়ে গেছে। আত্মরতি থেকে আবেগঘন স্বপ্নচিত্র হেলাল হাফিজের কবিতায় বহুমাত্রিক বিন্যাসে বিন্যস্ত হয়েছে –
কোনোদিন, আচমকা একদিন
ভালোবাসা এসে যদি হুট করে বলে বসে –
‘চলো যেদিক দু’চোখ যায় চলে যাই’
যাবে?
মুক্তিযুদ্ধের আগুন ও অশ্রুকে কবিতায় ধারণ করেছেন হেলাল হাফিজ। স্বাধীনতা একটি জাতির জন্যে স্বর্ণদুয়ার খুলে দেয়, যে-দুয়ার দিয়ে প্রবেশ করে যুগসঞ্চিত জঞ্জাল দূর করা যায়। মুক্তিযুদ্ধের সময় আমাদের স্বপ্ন ছিল – একটি শোষণমুক্ত সমাজ প্রতিষ্ঠা করা। স্বাধীনতার সুফল সাধারণ মানুষের কাছে পৌঁছে দেওয়া। দেশের সকল নাগরিক যেন মৌলিক চাহিদা পূরণ করতে পারে, মানবিক মর্যাদা দিয়ে বাঁচতে পারে। মুক্তিযুদ্ধের সময় মানুষের স্বপ্ন ছিল, মানুষের চোখের তারার স্বপ্ন পূরণ হবে। কবি তাই লেখেন :
কথা ছিলো একটি পতাকা পেলে
আমি আর লিখবো না বেদনার অঙ্কুরিত কষ্টের কবিতা
কথা ছিলো একটি পতাকা পেলে
ভজন গায়িকা সেই সন্ন্যাসিনী সবিতা মিস্ট্রেস
ব্যর্থ চল্লিশে বসে বলবেন, ‘পেয়েছি, পেয়েছি’
কথা ছিলো একটি পতাকা পেলে
পাতা কুড়োনির মেয়ে শীতের সকালে
ওম নেবে জাতীয় সঙ্গীত শুনে পাতার মর্মরে।
কথা ছিলো একটি পতাকা পেলে
ভূমিহীন মনু মিয়া গাইবে তৃপ্তির গান জ্যৈষ্ঠে-বোশেখে,
বাঁচবে যুদ্ধের শিশু সসম্মানে সাদা দুধে-ভাতে।
কথা ছিলো একটি পতাকা পেলে
আমাদের সব দুঃখ জমা দেবো যৌথ-খামারে,
সম্মিলিত বৈজ্ঞানিক চাষাবাদে সমান সুখের ভাগ
সকলেই নিয়ে যাবো নিয়ে যাবো নিজের সংসারে।
(‘একটি পতাকা পেলে’, যে জলে আগুন জ্বলে)
হেলাল হাফিজের কবিতায় এক ধরনের অন্তর্গত রোমান্টিকতা লক্ষ করা যায়। প্রত্ন-স্মৃতির জন্যে আত্মিক আকাক্সক্ষার কারণেই এমনটি ঘটে তাঁর কবিতায়। সেই প্রত্ন-স্মৃতিকে পাঠকের মনে তিনি স্থিত ও প্রোথিত করেন। এক্ষেত্রে হার্দিক সুরের সরল সিম্ফনি তাঁর শব্দের প্রার্থনাকে অর্থবহ করে তোলে। মৃদু অথচ গাঢ় উচ্চারণে স্মৃতি ও বিচ্ছেদের ভার বহন করে তাঁর কবিতা। তাঁর কবিতা তাই জীবনের বৈরী আঘাতে, প্রবল অভিঘাতে জেগে ওঠে। কবি লেখেন :
এখন তুমি কোথায় আছো কেমন আছো, পত্র দিয়ো।
এক বিকেলে মেলায় কেনা খামখেয়ালী তালপাখাটা
খুব নিশীথে তোমার হাতে কেমন আছে, পত্র দিয়ো।
ক্যালেন্ডারের কোন পাতাটা আমার মতো খুব ব্যথিত
ডাগর চোখে তাকিয়ে থাকে, তোমার দিকে, পত্র দিয়ো।
কোন কথাটা অষ্টপ্রহর কেবল বাজে মনের কানে
কোন স্মৃতিটা উস্কানি দেয় ভাসতে বলে প্রেমের বানে
পত্র দিয়ো, পত্র দিয়ো।
আর না হলে যত্ন করে ভুলেই যেয়ো, আপত্তি নেই।
(‘প্রস্থান’, যে জলে আগুন জ্বলে)
হেলাল হাফিজের মানস-চিত্র যেন হৃদয়ের সবুজ নিসর্গের ঠিকানা, যা প্রেমের মোহরযুক্ত মানচিত্র। প্রেমের হাত ধরেই শব্দের তুমুল উত্থান ঘটে তাঁর কবিতায়। কখনো কখনো ব্যক্তিগত বাচনভঙ্গির আন্তরিক দরদ তাঁর কবিতাকে দেয় জবানের অন্তরঙ্গ শব্দপুঞ্জ। ফলে হেলাল হাফিজের কবিতায় রূপায়িত হতে দেখা যায় ড্রামাটিক মনোলগ। হেলাল হাফিজ কবিতায় একই সঙ্গে অন্তরবাসী ও বহির্বাসী। কবিতাযাপন ছিল তাঁর জীবনযাপনেরই অংশ। এ-কারণে তাঁর কবিতায় আত্মজিজ্ঞাসা প্রবল। কালের প্রলয়ঝড়েই উড়ে উড়ে কবিতা হয়ে যায় তাঁর নির্বাচিত শব্দপুঞ্জ। তীব্র আত্মসমীক্ষা ও আত্মজিজ্ঞাসা হেলাল হাফিজের কবিতায় এসেছে এভাবে :
কষ্ট নেবে কষ্ট
হরেক রকম কষ্ট।
লাল কষ্ট নীল কষ্ট কাঁচা হলুদ রঙের কষ্ট
পাথরচাপা সবুজ ঘাসের সাদা কষ্ট
আলোর মাসে কালোর কষ্ট
‘মালটি কালার’ কষ্ট আছে
কষ্ট নেবে কষ্ট।
ঘরের কষ্ট পরের কষ্ট পাখি এবং পাতার কষ্ট
দাড়ির কষ্ট
চোখের বুকের নখের কষ্ট,
একটি মানুষ খুব নীরবে নষ্ট হবার কষ্ট আছে
কষ্ট নেবে কষ্ট।
(‘ফেরিঅলা’, যে জলে আগুন জ্বলে)
হেলাল হাফিজের আত্মসমীক্ষা ও আত্মজিজ্ঞাসার সঙ্গে দেশাত্মবোধ ও চৈতন্যের আলোড়ন একাত্ম। হেলাল হাফিজের কবিতায় বিষাদ ও বিভ্রমের জ্বালা রয়েছে এবং সেই জ্বালা তুলে নিয়েছেন তিনি মনের মন্দিরায়। হেলাল হাফিজের কবিতায় এসেছে জীবন-পিপাসা এবং এর মাধ্যমে তিনি বাংলা কবিতায় যুক্ত করেছেন নতুন ঝুলবারান্দা। তাঁর কবিতায় আছে মনস্তত্ত্বের ক্ষীণ ইঙ্গিত। ব্যক্তির বিচ্ছুরিত দাহ ও দ্রোহ গড়ে তুলেছে তাঁর কবিত্ব। কবি লেখেন :
এমন যৌবন যার মিছিলে যাবার তার শ্রেষ্ঠ সময়
এখন যৌবন যার যুদ্ধে যাবার তার শ্রেষ্ঠ সময়।
মিছিলের সব হাত
পা
কণ্ঠ
এক নয়
সেখানে সংসারী থাকে, সংসার বিবাগী থাকে।
কেউ আসে রাজপথে সাজাতে সংসার।
শাশ্বত শান্তির যারা তারাও যুদ্ধে আসে
অবশ্য আসতে হয় মাঝেমধ্যে
অস্তিত্বের প্রগাঢ় আহ্বানে,
কেউ আবার যুদ্ধবাজ হয়ে যায় মোহরের
প্রিয় প্রলোভনে।
কোনো কোনো প্রেম আছে প্রেমিককে খুনি
হতে হয়।
যদি কেউ ভালোবেসে খুনি হতে চান
তাই হয়ে যান
উৎকৃষ্ট সময় কিন্তু আজ বয়ে যায়
এখন যৌবন যার মিছিলে যাবার তার শ্রেষ্ঠ সময়।
এখন যৌবন যার যুদ্ধে যাবার তার শ্রেষ্ঠ সময়।
(‘নিষিদ্ধ সম্পাদকীয়’, যে জলে আগুন জ্বলে)
চেতনার অন্তর্গূঢ় তাৎপর্য বহনে সক্ষম হেলাল হাফিজের কবিতা। নিঃসঙ্গ এই কবির কবিতা ব্যঞ্জনাপুষ্ট। মানবিক প্রেরণায় প্রাণময় এই কবির কবিতা তাঁর সত্তায় আলোকরশ্মির মতো কম্পমান। প্রগাঢ়তম উপলব্ধিকে হেলাল হাফিজ তাঁর পাঠকের বোধের আয়ত্তে যখন আনেন, তখন পাঠক অনুধাবন করতে সক্ষম হন যে, তাঁদের অনুভূতি নতুন চেহারায় জারিত হয়েছে। তাঁর কবিতা শব্দ এবং চিত্রকল্প, রূপকল্প একে অন্যকে অভিষিক্ত করে। পাঠক সহজেই লক্ষ করেন তাঁর কবিতার ঐশ্বর্যের বৈচিত্র্য।
হেলাল হাফিজ জানেন যে, বোধের সামগ্রিকতা একটি পূর্ণ উপলব্ধিকে নির্মাণ করে। বোধের করতলে মজ্জাগত স্বয়ংসম্পূর্ণতায়, পূর্ণতায় কবিতায় যা প্রকাশ পায়, তা সমষ্টিগত চৈতন্যকে শাণিত করলেও এর স্বাতন্ত্র্য আবিষ্কারও স্বাভাবিকভাবে সম্ভব। কবি লেখেন :
তোমাকে শুধু তোমাকে চাই, পাবো
পাই বা না পাই এক জীবনে তোমার কাছেই যাবো।
ইচ্ছে হলে দেখতে দিয়ো, দেখো
হাত বাড়িয়ে হাত চেয়েছি রাখতে দিয়ো, রেখো।
অপূর্ণতায় নষ্টে কষ্টে গেলো
এতোটা কাল, আজকে যদি মাতাল জোয়ার এলো
এসো দু’জন প্লাবিত হই প্রেমে
নিরাভরণ সখ্য হবে যুগল স্নানে
থাকবো ব্যাকুল শর্তবিহীন নত
পরস্পরের বুকের কাছে মুগ্ধ অভিভূত।
(‘অমিংমাসিত সন্ধি’, যে জলে আগুন জ্বলে)
হেলাল হাফিজের ব্যক্তিস্বরূপের অনুধাবনকে আমরা তাঁর কবিতার বন্ধ ঘরের দুয়ার খোলার চাবি হিসেবে অভিহিত করতে পারি। অবিভাজ্য ব্যক্তিসত্তাই তাঁর কবিতার নিউক্লিয়াস শব্দের দেহ ও আত্মার মধ্যে যে বিচ্ছেদ প্রক্রিয়া চলে – এ-প্রক্রিয়ায় তিনি শব্দকে কবিতাময় করে তুলেছেন। কবি লেখেন :
১.
আমি তো গিয়েছি জেনে প্রণয়ের দারুণ আকালে
নীল নীল বনভূমি ভেতরে জন্মালে
কেউ চলে যায়, চলে যেতে হয়
অবলীলাক্রমে কেউ বেছে নেয় পৃথক প্লাবন,
কেউ কেউ এইভাবে চলে যায় বুকে নিয়ে
ব্যাকুল আগুন।
২.
নারী তুমি এক শৈল্পিক তাবিজ
দুঃখের আরেক নাম হেলাল হাফিজ
(‘দুঃখের আরেক নাম’, যে জলে আগুন জ্বলে)
৩.
আজ দেখি রাজ্য আছে
রাজা আছে
ইচ্ছে আছে
শুধু তুমি অন্য ঘরে।
প্রেম দূরবর্তী মনে হলেও হেলাল হাফিজের কবিতার ক্ষেত্রে এটি সত্য নয়। প্রেমের ক্ষেত্রে তাঁর কবিতায় লক্ষ করা যায় আসঙ্গনিবিড় নির্ঘুমতা। কিন্তু তাঁর প্রেমের কবিতায় কোনোভাবেই বাচকি গোঁয়ার্তুমি লক্ষ করা যায় না। তাঁর প্রেমিকসত্তা ভণ্ডামি ও উপর-চালাকি থেকে মুক্ত। বৈচিত্র্যময় রূপায়ণ হেলাল হাফিজের কবিতায় নতুন রক্ত সঞ্চালন করেছে। অনুভূতির সংশ্লেষণ আর চিন্তার বিশ্লেষণ হেলাল হাফিজের কবিতায় মহার্ঘ হয়ে উঠেছে। প্রেম এবং দ্রোহ তাঁর কবিতায় হাত ধরাধরি করে চলে।
Leave a Reply
You must be logged in to post a comment.