মধ্যরাতের কোকিল

আফরোজা পারভীন

 

মাঝরাতে ধড়ফড় করে উঠে বসে মালতী। তার ঘুম বরাবরই পাতলা। গাঢ় ঘুমের সঙ্গে তার চিরকালের আড়ি। জীবনে তার সন্ধান পায়নি। ছেলেবেলায়, কৈশোর আর যৌবনেই গাঢ় ঘুম হয়নি, এই বয়সে তো হওয়ারই কথা নয়। খুট করে শব্দ হলেই ঘুম ভেঙে যায়। আবার একচিলতে আলো ঢুকলেই ঘুমের দফারফা। কল চুইয়েপড়া পানিবিন্দুও তার কানে বোমার মতো বাজে। তাই ঘুম বরাবরই সাধনার ব্যাপার তার। চারদিক নিসন্তব্ধ হবে, কোথাও একবিন্দু আলো থাকবে না, নিঃশ্বাস পতনের শব্দও পাওয়া যাবে না – এমন হলে যদি তার ঘুমের কিছুটা সম্ভাবনা তৈরি হয়। দরজা আটকে পৃথিবী থেকে নিজেকে বিচ্ছিন্ন করে ঘুমাতে যায় মালতী। এ নিয়ে ছেলের বউ কথা শোনাতে ছাড়ে না। অবশ্য সরাসরি নয়, আবার আড়ালেও নয়। এমনভাবে শোনায় যেন মালতীকে শোনানোর জন্য বলছে না। সরলভাবে ছেলেকে বলছে যেন, ‘আম্মার ব্যাপারটা বুঝি না, তিনি দরজা আটকে ঘর অন্ধকার করে ঘুমান কেন বলত? এটা কি ঠিক?’

: বেঠিকের কী দেখলে? মা সারাজীবন এভাবেই ঘুমান। এক-একজন এক-একভাবে ঘুমাতে ভালোবাসে।

: না না, ওভাবে নিও না। ওনার বয়স হয়েছে। বন্ধ ঘরে খারাপ কিছু তো ঘটে যেতে পারে। তখন আমরা জানতেও পারব না।

: সেটা অবশ্য একটা চিন্তার কথা।

সামান্য সায় পেয়ে বউ কৌশলে এগোয়।

: তারপর ধরো, শুধু রাতেই তো না, দিনের বেলাতেও তিনি কয়েক ঘণ্টা দরজা লক করে রাখেন। বাচ্চারা ওই ঘরটায় একদমই ঢুকতে পারে না। ওরা চায় দাদির সঙ্গে একটু সময় কাটাতে। আবার দেখো, বারান্দাটাও তো ওনার ঘরের সঙ্গে। কাপড় মেলতেও সমস্যা হয়।

: দেখো, মায়ের সাফিশিয়েন্ট ঘুম দরকার।

স্বামীর কথা শুনে ভেতরে ভেতরে রাগে গা জ্বলে যায় সুরমার। মায়ের সাফিশিয়েন্ট ঘুম দরকার! কেন মা কি পঁচাত্তর বছরের বুড়ি! বয়স তো সবে পঞ্চান্ন। আঠারো বছর বয়সে বিয়ে হয়েছিল আর উনিশ বছরে ছেলে। দেখলে চলিস্নশ মনে হয়। – শরীরের আঁটোসাঁটো গাঁথুনি। ত্বক নিভাঁজ। দু-চারবার শাশুড়ির সঙ্গে   এদিক-ওদিক গিয়ে ভালো শিক্ষা হয়েছে নাফিসার। বান্ধবীরা চোখে মুগ্ধতা এনে বলেছে –

: কে বলবে তোর শাশুড়ি, দেখলে মনে হয় বোন! তা আবার কে বড় কে ছোট বোঝা শক্ত।

এখন তাই পারতপক্ষে বাইরে বের হয় না শাশুড়ির সঙ্গে। আর তার নাকি সাফিশিয়েন্ট ঘুম দরকার! আদিখ্যেতা আর কাকে বলে! কিন্তু মনের কথা মুখে আনে না সুরমা। নির্দোষ গলায় বলে-

: আমিও তো বাচ্চাদের তাই বলি। তোমাদের দাদির শরীর খারাপ, ঘুম দরকার। কিন্তু ওরা তো বাচ্চা। ওরা বলে, সবুজের দাদির বয়স আমার দাদির থেকে কত বেশি। তিনি তো দুপুরে ঘুমান না, সবুজের সঙ্গে খেলেন। আমি ওদের বোঝাতে পারি না।

ছেলে চুপ করে থাকে। তার বেকায়দা অবস্থাটা মালতী বুঝতে পারে। সুরমার কৌশলী কথাবার্তাও বোঝে; কিন্তু তার কিছু করার নেই। রাতে ঘুম হয় না, দিনে তাই ঘুমানোর প্রাণান্ত চেষ্টা। অধিকাংশ সময়েই সে-চেষ্টা ব্যর্থ হয়। তারপরও সে-চেষ্টা চালিয়ে যায়। আর নাতিরা তার ঘরে আসে না। ওরা বড় ভালো, খুব বিবেচক। ওরা জানে, দাদি এ-সময় ঘুমায়। আর রাতে পড়াশোনা শেষ হওয়ার পর মালতী অনেকটা সময় ওদের সঙ্গে গল্প বলে কাটায়। দাদির ব্যাপারে ওদের কোনো কমপেস্নইন নেই। আর কাপড় মেলা! বেশ বড়সড় বারান্দা আরো একটা আছে। সে-বারান্দার তারের অনেকটাই খালি পড়ে থাকে। এখন তো এ-বাড়িতে শিশু নেই যে তার কাঁথা মেলতেই তিন-চারটে বারান্দা লাগবে! আসলে সুরমার ছেলের কাছে কিছু একটা লাগাতে হবে – তাই এ-কথোপকথন। এমন আরো অনেক কথা সুরমা বলে, জানে মালতী। তার বিরুদ্ধে সুরমার অনেক অভিযোগ।

এই ফ্ল্যাটটা মালতীর নামে। এ-ফ্ল্যাট ছাড়াও তাদের একটা ছয়তলা বাড়ি আছে। সেটাও মালতীর নামে। সেখান থেকে মোটা টাকা ভাড়া আসে। টাকাটা মালতীই নেয়। ছেলে একটা বড় চাকরি করলেও আর তার বেতন বেশ বড় অঙ্কের হলেও মালতীর সম্পদ বেশি। ছেলের নামে কোনো সম্পত্তি নেই। এটা সুরমার বড় জ্বালা!

মালতীকে যখন কেউ প্রশ্ন করে, আপনি কি ছেলের কাছে থাকেন,  মালতী বলে, আমি না, ছেলে আমার সঙ্গে থাকে। ছেলেরাই তো মায়ের সঙ্গে থাকবে। মা গার্জিয়ান, অভিভাবক, তাই না?

সংসারের কর্তৃত্বও তিনি হাতে রেখেছেন। তাকে নিজের ইচ্ছায় চালাতে পারে না সুরমা। দুহাতে সংসারে খরচ করেন, ছেলের টাকার বড় অংশই ব্যাংকে জমা পড়ে, তারপরও বাড়ি ভাড়ার টাকাটা কেন সুরমা বা সৌরভের হাতে তুলে দেন না বা বাড়িঘরগুলো সৌরভের নামে কেন লিখে দেন না-এটা মালতীর বড় দোষ। এ নিয়ে দু-চারবার সুরমার অভ্যাস অনুযায়ী প্রকাশ্য-গোপনে কথা শোনানোর পর মালতী একদিন সাফ জানিয়ে দিয়েছেন-

: আমি মারা গেলে সৌরভ তো সবই পাবে। এ-সম্পত্তি তো আমি অর্জন করিনি। কিছুটা ওর বাবা করেছে, কিছুটা আমার শ্বশুরবাড়ির। ও-ই পাবে। কিন্তু আমার মৃত্যু পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে। শুধু কি তাই। সুরমা একমাত্র ছেলের বউ তারপর নিজের গয়নার পুরোটা মালতী তাকে দেননি। অনেকগুলো এখনো আগলে রেখেছেন।

এতসব দোষ যার, তার ওপরে সুরমার রাগ থাকবে না কেন?

এসব মালতীর জানা। এ নিয়ে তেমন ভাবেও না। তবে মাঝরাতে ঘুম ভাঙার ব্যাপারটা তাকে ভাবাচ্ছে। মধ্যরাতে কোথা  থেকে যেন কোকিলের ডাক ভেসে আসে। প্রথম দিন এ-ডাক শুনে মালতী ভেবেছিল সত্যিই বুঝি কোকিল ডাকছে। এটা কোন সময়, এ-সময় কোকিল ডাকে কিনা, তার মাথায় আসেনি। পরপর কয়েকদিন এ-ডাক শোনার পর মালতীর একদিন মনে হলো, এটা বসন্তকাল না। আর রাতে কি কখনো কোকিল ডাকে? মালতী মনে করতে পারল না। তারপর একদিন তার মনে হলো, এটা কোকিলের ডাক নয়, অন্য কিছু। আর একসময় এ-ডাকটা তার অবচেতনে ঢুকে গেল। অ্যালার্মের মতো সেট হয়ে গেল মসিন্তষ্কের কোষে কোষে। এখন কোকিলের এক ডাকের সঙ্গে সঙ্গেই তার ঘুম ভেঙে যায়। আর বিছানা থেকে উঠে একবার জানালা, একবার বারান্দায় গিয়ে বুঝতে চেষ্টা করে কোকিলটা কোথায় আর কোকিল যদি মানুষও হয় সে-ই বা কোথায়? খুঁজে পায় না। এই অতলস্পর্শী দালানকোঠার রাজ্যে ও পাবে কোথায় কোকিলকে? এ কি তার কৈশোরের সেই গ্রাম, যে-গ্রামের চওড়া গাছের আড়ালে দাঁড়িয়ে কোকিল ডাকত। আর কোকিলা সে-ডাকে গোপিনীর মতো ছুটে যেত। এখানে কোথায় গাছ, কোথায় মাঠ, কোথায় বন!

এ-ডাক ভাসিয়ে নিয়ে যায় মালতীকে। এ যেন সেই ব্রজের বাঁশি, যে-বাঁশি কদমতলী গায়ে লতিয়ে ওঠা সদ্য কলেজপড়ুয়া  মেয়েটির কানে প্রতিরাতে ভেসে আসত। পরপর তিনবার। ডাক দিত ঢাকায় বুয়েটেপড়ুয়া চাচাত ভাইয়ের শালা, যে বেড়াতে এসেছে এ-গাঁয়ে। আত্মীয়তার সূত্রে দেখা আর কথা হয়েছে। সবার চোখ বাঁচিয়ে দু-চারটি কথাও হয়েছে। আর সে-কথার ফাঁকে হয়েছে এই ডাকাডাকির তরিকা। তিনবারের ব্যাপারটা একটা সিনেমা থেকে শেখা। কোকিল তাকে বলেছে। আর সে-ডাক শুনে সন্তর্পণে সমসন্ত শব্দ বাঁচিয়ে নিঃশব্দে বেরিয়ে যেত মেয়েটি। একটা বলিষ্ঠ হাত তাকে টেনে নিত নিজের কাছে। দুজনে বসত পুকুরপাড়ে। ছেলেটির কাঁধে মেয়েটির মাথা। চার চোখ নির্নিমেষ। কথা হতো না, ছোঁয়াছুঁয়ি হতো। তার বেশিতে যেন ছিল না বলা বারণ।

মেয়েটার বিয়ের সম্বন্ধ আসছিল চারদিক থেকে। বড় বেশি সুন্দর মেয়ে, বনেদি ঘর, অর্থবিত্ত কিছুরই কমতি নেই।

বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ুয়া বড়ভাই মোহিত সেদিন শহর থেকে এসেছে বোনের একটা ভালো সম্বন্ধ নিয়ে। ছেলে দারোগা, বনেদি ঘর। এ-বাড়ির কোনো এক পূর্বপুরুষ ব্রিটিশ আমলে দারোগা ছিলেন। তখন থেকেই দারোগা বলতে এরা অজ্ঞান। দারোগার চাকরির ওপরে কি কোনো চাকরি আছে! মা-বাবা আহ্লাদে আটখানা। এতদিনে তাদের মেয়ের উপযুক্ত পাত্র জুটেছে। অনেক রাত অবধি ভালো-মন্দ আর পান-তামাক খেয়ে, বাবা হুঁকোয় হুড়ুম হুড়ুম করে গল্পগুজব শেষে শুয়ে পড়েছে। ঘুমও জাঁকিয়ে বসেছে ভরা পেটের টানে। তবে ভাই তখনো ঘুমায়নি।

শহরের রাত আর গাঁয়ের রাত এক নয়। রাত আটটা বাজলেই নিশুতি হয়ে পড়ে গাঁ। তেলের খরচ বাঁচানোর জন্য অনেকে আগেই রাত নামিয়ে দেয়। আর সারাদিনের পরিশ্রান্ত খেটেখুটে খাওয়া মানুষ বিছানায় এলিয়ে পড়েই ঘুমে তলিয়ে যায়। তাদের শরীর শহুরেদের মতো আয়েশি নয় যে। ভাইও ঘুমানোর তোড়জোড় করছে। এর মাঝেই ওই কুউ-উ। ডাকটা ভাইয়ের কানে গেল। ব্যাপার কী? ভাই উৎকর্ণ। ততদিনে সে অনেক গল্প-উপন্যাস পড়ে ফেলেছে। সিনেমাও দেখেছে বিসন্তর। এই ডাকরহস্য তার জানা। ভাই ঘাপটি মেরে থেকে বুঝতে চেষ্টা করে। কান সজাগ। দৃষ্টি প্রখর। একসময় আধো অন্ধকারে খুলে যায় বোনের ঘরের দরজা। তারপর নিঃশব্দে পদচারণায় গাছের পশ্চাদদেশ এবং পুকুরঘাট।

মোহিত একমুহূর্ত দেরি করে না। ঘরের কোণে রাখা তেল-মাখানো চকচকে লাঠি একটা তুলে নেয় হাতে। এসব লাঠি গ্রামের বনেদি বাড়িতে মজুদ থাকে। জমিজমার হাঙ্গামা মেটাতে মাঝে মাঝে দরকার হয়। লাঠি হাতে সে সন্তর্পণে যায় পুকুরঘাটে। তারপর একবারে যুবকের পিঠ বরাবর। ইচ্ছা করেই মাথায় মারেনি। খুনখারাবি করতে চায়নি। লোক-জানাজানিও না। বোনের চরিত্রে দাগ পড়বে, বিয়েতে সমস্যা হবে। মালতী চেঁচিয়ে উঠেছিল। সে-শব্দ বেশিদূর যাওয়ার আগেই বোনের মুখ চেপে ধরে হিড়হিড় করে টানতে টানতে নিয়ে এসেছিল ঘরে। তবু শব্দ ঠেকানো যায়নি। যেটুকু আওয়াজ তুলেছিল, তাতেই আশপাশের দু-চারজন চলে এসেছিল পুকুরঘাটে। আর যুবককে পড়ে থাকতে দেখে বলাবলি করছিল, ‘আহা রে, কে যেন মেরে ফেলে রেখে গেছে ছেলেটাকে।’

মোহিত মালতীকে ঘরে ঢুকিয়ে ডেকে তুলেছিল বাবা-মাকে। মালতীকে কঠোর প্রহরায় রাখতে বলে হাজির হয়েছিল পুকুরঘাটে। আহা-উহু করেছিল প্রয়োজন অনুযায়ী। সবাই ধরাধরি করে ওকে নিয়ে গিয়েছিল চাচাত ভাইয়ের বাড়িতে। তারপর হাসপাতালে। সেই মাঝরাতে চাচাত ভাইয়ের বউয়ের কান্নায় থম ধরে দাঁড়িয়ে গিয়েছিল বাতাস।

সাতদিনের মধ্যেই দারোগা ফজলের সঙ্গে বিয়ে হয়ে গিয়েছিল মালতীর। এ কদিন তাকে একরকম গৃহবন্দি করে রাখা হয়েছিল। আর বিয়ের আসরেই নানান কথার মাঝে সে জানতে পেরেছিল, মুসা পুকুরঘাটে অজ্ঞান হয়ে পড়েছিল। ওখান থেকে তাকে তুলে নিয়ে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। অবস্থা ভালো না।

অল্পদিনেই ফজলের গভীর প্রেমে মুসা বিস্মৃতির পাতায় চলে গিয়েছিল প্রায়। মাঝে মাঝে কখনো সুদূরের রংধনুর মতো একচিলতে উদয় হতো মনের কোণে। আবার মিলিয়ে যেত। ফজল মানুষটা নামেই দারোগা, বড় নরম স্বভাবের, বড় হাসিখুশি আর দিলখোলা। এমন মানুষ যে কি করে দারোগাগিরি করে! আর বছর ঘুরতে না ঘুরতে সৌরভ এসেছে কোলজুড়ে। ওকে পেয়ে এক কুউ-উ ডাকা কোকিলের কথা স্মৃতির অতলে ডুবে গেছে বলে ভেবেছিল মালতী। আজ বুঝল স্মৃতি কখনো ডোবে না, ফোকর পেলেই মাথা তোলে।

বিয়ের তিন বছরের মাথায় ডাকাত ধরতে গিয়ে ডাকাতের গুলিতে মারা গেছে ফজল। মা বুক চাপড়াতে চাপড়াতে বললেন, ‘কী ভুল করলাম, কেন এ-বিয়ে দিলাম। কত ভালো ভালো সম্বন্ধ ছিল।’ ভাই একদিন আক্ষেপ করে বলেছিল, ‘মুসাকে সেদিন কি মারটাই মারলাম। ওর সঙ্গে বিয়ে হলেই তো ভালো ছিল। ও এখন বড় ইঞ্জিনিয়ার। একটু ছোট ঘর, তাতে কী, বেঁচে তো থাকত।  হায় রে, বোনটা এত অল্প বয়সে বিধবা হয়ে গেল।’

মালতীকে বাপের বাড়িতে ফিরিয়ে নিয়ে আবার বিয়ে দেওয়ার চেষ্টাও হয়েছিল। মালতী ছিল অনড়, আজো আছে। আর সে-সময় পাশে ছিল ফজলের ছোটভাই ফরিদ আর তার বউ। ফরিদ বলেছিল, ‘ভাবি, তোমাকে আমার কিছু বলার নেই। ভাইয়া অকালে চলে গেলেন। এ-সমাজে এভাবে তোমার বেঁচে থাকা কঠিন। কিন্তু যদি তুমি আমাদের সংসারে থাকো তোমাকে মাথায় করে রাখব।’

ফরিদকে ছোটভাইয়ের মতোই স্নেহ করত মালতী। ওর মধ্যে ফজলের প্রতিচ্ছবি দেখত। ফজল যে বড় ভালো ছিল। তাকে যে খুব বেশি ভালোবাসত। কখন যে নিজেও তাকে এতটা ভালোবেসেছে জানে না মালতী। ও কেন যাবে, ওর আছে ফরিদ, সৌরভ আছে, আছে ফরিদের ফুটফুটে মেয়ে জিনিয়া। যে ওকে বড়মা ডাকে। যাকে কখনোই মনে হয় না ও নিজের মেয়ে না।

বছরদশেক পর এক সড়ক দুর্ঘটনায় একসঙ্গে মারা গিয়েছিল ফরিদ আর ওর বউ। শেষ সময়ে হাসপাতালে মালতীর হাত ধরে ফরিদ বলেছিল, ‘ভাবি, মেয়েটাকে রেখে গেলাম। ওকে দেখো। ওকে বাবা-মায়ের অভাব বুঝতে দিও না।’ মালতী কথা দিয়েছিল।

মালতী চোখ মোছে। খুব ইচ্ছা ছিল জিনিয়াকে নিজের কাছে রাখার। রেখেও ছিল। কিন্তু সুরমা আসার পর ওর হুল-ফোটানো কথায় নিঃশব্দে চলে গেছে নানাবাড়ি। ওখানেই আছে। লেখাপড়া শেষ করেছে। নানা দিকে বিয়ের সম্বন্ধ আসছে ওর। গয়নাগুলো ওর জন্যই রেখেছে মালতী।

ডাকটা আবার শোনা যায়। ডাকটা আসছে কোথা থেকে। মালতী বিছানা থেকে ওঠে, বাতি জ্বালায়। খুব সন্তর্পণে দরজা খোলে। পা টিপেটিপে সামনের দরজা খোলে। তারপর করিডরে যায়। কড়া আলোয় ভাসছে পুরো করিডর। এ-মাথা থেকে ও-মাথা দেখা যায়। কেউ কোথাও নেই। মালতী এগিয়ে ঝুঁকে সিঁড়ির নিচটা দেখতে চেষ্টা করে। এটা বহুতল ভবন। এ-ভবনের নিচে বেশিদূর দেখা যায় নয়। দেখতে হলে প্রতিটা ফ্লোরে গিয়ে গিয়ে দেখতে হয়। তা সম্ভ^ব না। যতদূর চোখ যায় কিছুই চোখে পড়ে না। তা হলে? অন্য কোনো বিল্ডিং থেকে আসছে নাকি ডাকটা। কিন্তু না, মনে হচ্ছে খুব কাছ থেকেই আসছে। কে কাকে ডাকছে? তাহলে কি ছাদে? কিন্তু সেটা তো সম্ভব নয়। মালতীর গাছ লাগানোর নেশা। গাছ লাগাবে বলে সে বেশ কয়েকবার ছাদের চাবি চেয়েছিল অফিসে। অফিস থেকে সাফ জানিয়ে দেওয়া হয়েছে, চাবি দেওয়া সম্ভব নয়। ছাদের চাবি দিলে ওখানে নানারকম অপকর্ম হবে। বিশেষ করে উঠতি বয়সের ছেলেমেয়েরা ওখানে গিয়ে ডেটিং করবে। ঠিক এ-ভাষায় ওরা বলেনি। তবে যা বলেছে তার মানে এটাই। তাছাড়া খুনখারাবি করে লাশ ফেলে যেতে পারে পানির ট্যাংকে। পুলিশের কোনো একটা অফিসের ছাদে এ-ঘটনা ঘটেছিল ঢাকাতেই। ওদের কথায় যুক্তি আছে। তার মানে এ-বিল্ডিংয়ের ছাদের চাবি কারো কাছে নেই। তা হলে কোকিল-কোকিলা নিজেরা রিস্ক নিয়ে মিলিত হবে কোথায়? সেই জায়গা কোনটা?

মালতীর মনে অপার কৌতূহল। কিন্তু কতক্ষণ আর এভাবে এই মাঝরাতে বারান্দায় ঘোরাঘুরি করা যায়। মালতী ফিরে যাবে ভাবছে, তখনই যেন খুট করে শব্দ হয়। ও ঘুরে দাঁড়ায়। সদর দরজাটা সামান্য ফাঁক হয়ে আবার বন্ধ হয়ে গেল কী? কেউ কি উঁকি মেরে তাকে দেখছিল। নাকি তার মনের ভুল! চিমিন্তত মালতী ধীরে ধীরে, শব্দ না করে দরজা আটকায়। তারপর বিছানায় শুয়ে নির্ঘুম রাত কাটায়।

দিনকয়েক পরের কথা। সুরমা একটা বিয়েতে যাবে। তিনদিন ধরে মালতীর আশপাশে ঘুরঘুর করছে আর বারবার বলছে –

: খালাত বোনের বিয়েতে যাব মা। আমার কোনো ভালো জড়োয়া নেই। কী পরে যাই বলেন তো আম্মা?

: কেন মা, বিয়ের সময় তো তোমাকে বেশ ভারী একটা নতুন জড়োয়া দিয়েছিলাম। তাছাড়া আমার গয়নার থেকেও তো তোমাকে দিয়েছিলাম একটা। আর তোমার বাবা-মাও তো ভালো জড়োয়া দিয়েছেন। তার একটা পরো।

: ওসব ব্যাকডেটেড আম্মা।

: তা ব্যাকডেটেড যখন দু-একটা ভেঙে বানালেই তো পারো?

: কী যে বলেন আম্মা, বিয়ের গয়না কেউ ভাঙে নাকি?

: তাহলে ওর একটাই পরো। দেখো, ঠিক মানিয়ে যাবে। পুরনো ডিজাইনই তো ঘুরে ঘুরে আসে।

এ-কথার পর সুরমা মুখ ভার করে চলে গেছে। তিনদিন আগের কথা সেটা। সে-ভার এখনো একই রকম আছে।

শুক্রবার দুপুর। ছেলের ছুটির দিন, বাড়িতে আছে। কাজের বুয়ার রান্নার তদারকি করছিল মালতী। ছেলে তার ভালোমন্দ খেতে ভালোবাসে। ভালোবাসে সুরমাও। ওদের খাবারটা এদিন নিজে তদারক করে রান্না করেন। তাছাড়া নাতিদের রান্নাও ভালো হওয়া চাই। বউমার খাওয়া-দাওয়ার দিকেও মালতীর তীক্ষ্ণ নজর। এদিন তাই দু-চারটে পদ নিজেও রাঁধেন।

সুরমা এসে পাশে দাঁড়াল। ওর মুখে হাসি। মালতী অবাক হলো। এ-কদিন সুরমা তার কাছে আসেনি, কথাও বলেনি।

: আম্মা একটা কথা বলতাম।

: বলো?

: একটু এদিক আসেন বলি।

সুরমা তাকে টেনে নিয়ে আসে মালতীর ঘরে।

: এখানে বসেন আম্মা। বলছি।

: বলো।

: আম্মা আমি একটা জিনিস চাইব দেবেন?

: দেওয়ার মতো হলে নিশ্চয়ই দেব।

: আম্মা আমি আপনার একমাত্র ছেলের বউ, আমাকে অদেয় আপনার কী থাকতে পারে?

: কী বলবে বলো?

: আপনার ওই তিন প্যাঁচের জড়োয়া সেটটা আমাকে একটু আজ পরতে দেন। একেবারে চাইছি না। বিয়েবাড়ি থেকে ফিরে আবার দিয়ে দেব।

মালতী জানে এ-হার একবার বউমার গলায় উঠলে আর কোনোদিন তার কাছে ফিরে আসবে না। এমন অনেক গয়না নিয়ে আর সে ফেরত দেয়নি। মালতী কিছু বলে না। নিঃশব্দে ফিরে আসে রান্নাঘরে। আগের মতোই রান্নার তদারকি করতে থাকে। বউমা কিছুক্ষণ হতবুদ্ধি হয়ে বসে থেকে নিজের ঘরে যায়। তার মুখে আগুন জ্বলতে থাকে। দড়াম করে বন্ধ করে দরজা। সে-রাতে বিয়েবাড়িতে যায় না।

আর সে-রাতেই আবার কুউ-উ ডাক ভেসে আসে। আজো সন্তর্পণে ওঠে মালতী। আগের মতোই দরজা খোলে। কাউকেই দেখে না। তারপর সে আগের মতোই ধীরে ধীরে এগিয়ে সিঁড়ির রেলিংয়ে ঝুঁকে নিচে তাকায়। কিছুই দেখতে পায় না। ও ধীরে ধীরে নেমে যায় একেবারে সিঁড়ির নিচ অবধি। দাঁড়ায় রেলিংয়ের আড়ালে। তখনই ওর চোখে পড়ে নিচের সিঁড়ি থেকে ওপরে উঠে আসছে একটা মেয়ে। সে দ্রুত এদিক-ওদিক তাকিয়ে লিফটে ঢুকে পড়ে। আর প্রায় একই সময়ে পাশের একটা দরজা খুলে একটা  ছেলে দ্রুত এগিয়ে গিয়ে ঢুকে পড়ে লিফটে। এ-বিল্ডিংয়ে দুটো সিঁড়ি, দুটো লিফট। ও এককোণের সিঁড়ির রেলিংয়ের আড়ালে ছিল বলে ওরা মালতীকে দেখতে পায় না।

মালতী আসেন্ত আসেন্ত এগিয়ে এসে লিফটের সামনে দাঁড়ায়। ও খেয়াল করে, লিফটটা এক থেকে চোদ্দো পর্যন্ত উঠছে আর নামছে, নামছে আর উঠছে। ওর মুখে স্মিত হাসি ফুটে ওঠে। মনে মনে কামনা করে, ওই ছেলেমেয়ের ঘরে যেন কোনো বড়ভাই না থাকে।

খুশিমনে সদর দরজা ধাক্কা দেয় মালতী। আর ধাক্কা দেওয়ামাত্র আলোর ঝটকায় চোখ ধাঁধিয়ে যায় যেন। ওর স্পষ্ট মনে আছে এ-জায়গা অন্ধকার ছিল। দরজার ও-পাশে দাঁড়িয়ে আছে ছেলে আর বউমা। ছেলের রণদেহী মূর্তি।

: মা এত রাতে তুমি কোথায় গিয়েছিলে? তোমার বউমা কদিন ধরে বলছে, রাতে তোমাকে কেউ কুউ-উ করে ডাকে আর তুমি বের হয়ে যাও। আমি বিশ্বাস করিনি। কিন্তু আজ…

বউমা থামিয়ে দেয় তাকে।

: আমার কোনো কথা তো তুমি বিশ্বাস করো না। বলিনি তোমাকে বারবার। এজন্যই তো গয়নাগাটি, বিষয়সম্পত্তি সব কুক্ষিগত করে রেখেছে। একদিন সব নিয়ে চম্পট দেবে।

মালতী ওদের ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে সামনে এগোয়। ছেলে বলতেই থাকে, মা, মা বললে না, সিঁড়ি দিয়ে নেমে কার সঙ্গে দেখা করতে গেছিলে? মা…

মালতীর মন আজ খুব ভালো। সে ভালোলাগাটা নষ্ট করতে চায় না কিছুতেই। তাই শুধু একবার করুণা আর বেদনার চোখে ছেলের দিকে তাকায়। ছেলেটাকে সত্যিই সে মানুষ করতে পারেনি! নইলে বউয়ের কথায় মাকে…। যাকগে যাক…। মালতী আয়েশে বিছানায় এলিয়ে পড়ে আর ভাবে, হে বিধাতা, কেউ যেন লিফটে কল না দেয়। আর কিছুক্ষণের মধ্যেই ও তলিয়ে যায় অপার শামিন্তর ঘুমে। r