শতবর্ষী গগন শিরিষ গাছের তলে রোদ ঢাকা ছাতির নিচে উবু দৃষ্টিতে নিথর পাথরের মতো চলন্ত দুটো হাত লোকাল বাসের ন্যায় থেমে থমে বিশ্রামের মাঝে লুঙ্গিতে নাক ডলে ফের সুতায় উঁচিয়ে মনোনিবেশ করলো খাদেম আলী। দুহাতের নখে বিস্তর ময়লা জমে কুঁচকে আসা চামড়ায় সঙ্গে মিল যতখানি একহাতে ধরে রাখায় জুতোয় মনোযোগের সঙ্গে মমতা ততোখানি। সর্দিটা বাঁধিয়েছে গতকাল ঘরে ফেরার সময় আচমকা ঘোর বর্ষণে। রাত করে ঘরে ফেরার সময় ছাতি অবশ্য ছিলো সঙ্গে কিন্তু সে ছাতির ঝাঁঝরির ফুটোর মতো দেহ এই মৌসুমি বৃষ্টির সঙ্গে পাল্লা দেয়ার শক্তি খুঁজে পায়নি। তাই বগলে পুরে বাকিটা পথ একাধারে পথ চলে তবেই উঠোনে পা পড়েছে। সাত জনমের ভাগ্য যে তবু জ্বর লাগেনি, তবে আর বেরোতে না পারার সঙ্গে দু বেলা আধপেটা পেটে পাথর বাঁধার উপক্রম হতো। শেষ রাতে যখন হাসিনার মাকে বহুদিন বাদে স্বপ্নে দেখলো খাদেম আলী। ঘন কাপড়ে আচ্ছাদনে ঢাকা। শেষবার যখন রিলিফের সাদা কাপড়ে দাফন হলো সখিনার, তেমনই অনেকখানি, তবে কাফন তো আর জামা নয়, স্বপ্নে যা ছিলো তাও উঁচু কামিজের কোর্তা। সাহেবি হালে যার নাম কামিজ। শুভ্র দেহে যেন চমকে উঠছে ক্ষণে ক্ষণে। ফাটা নাক আর কানের ছিদ্রটুকু নেই, গলায় নেই সে ক্ষেতপীরের মাজারের তাবিজ। চোখের দৃষ্টিটা ভীষণ কমে এসেছে খাদেম আলীর। তার বয়সের বিশ বছর আগেই বাপদাদারা কবরে শুয়েছে তো ঠিকই আরও দেড় দশক আগে খুইয়েছে দুচোখের দৃষ্টি। অথচ এই নব্বই ছুঁইছুঁই বয়সে এখনো মুচির কাম নিস্তরঙ্গ চলছে তার।
এককানা তাড়াতাড়ি করেন। বাজার করন লাইগবো। পাশে দাঁড়ানো লম্বা যুবাটার গলা চওড়া হয়।
বারবার ঘোলাটে চশমাটা নাকের উপর তুলে ধরে খাদেম আলী। আজ এগারো বছর চলছে চশমার বয়স। এক ডাঁট ভেঙ্গেছে দেড় বছর আগে, ভাঙ্গা ডাঁটে সুতলি ফুটিয়ে কায়দা করে বাঁধা চশমাটা ঢের নিচে নেমে যায়। চোখের সামনের সবকিছুই ভীষণ ঘোলায়, অনেকখানি অদৃশ্যমান হয়ে উঠে। সেলাইয়ের শেষ ফুটোটায় সুতা পেঁচিয়ে ব্লেড দিয়ে সুতলি ছিঁড়ে ছেলেটার পায়ের কাছে রাখে সে। ছেলেটা পকেট থেকে আট আনার কয়েন তুলে খাদেম আলীর হাতে দিলে কালির বাক্সের এককোণের ঘুপচি থেকে চার আনার সিকিটা হাতে ধরায় খাদেম আলী। পাশে মেলানো জুতা ছেড়ে নিজের জুতা পরে নেয় ছেলেটি। সঙ্গে রাখা সাইকেলটা টেনে দৌড়িয়ে উঠে ছুটে। বা হাতের দুই আঙ্গুলে সর্দি ফেলে গামছায় মোছে খাদেম আলী। শতবর্ষী শিরিষ গাছটার ছোট্ট ডাল এসে পড়ে রাস্তার ধারে। পিঁড়িতে বসা দেহে কোনো চৈতন্য নেই তার। বাজার এখনো অনেকখানি খালি। বেশ সকালে ঝাপি উঠে বলে কেবল বাজার করতে আসা লোকের দেখা মিলে। আর চাঙ্গা হতে সময় লাগে বেলা উঠলে। পাশ থেকে দুটো রিকশা এসে দাঁড়ায় বটগাছের তলে । ওপাশে মেকার বসে। খানিক বাদে আসবে। রিকশাওয়ালা বসে থাকে পাশে বসানো বেঞ্চিতে। ওপাশে তালের শাঁস বিক্রি হয় বেলা উঠলে। আপন মনেই আগের জমানো জুতাগুলো ধরে খাদেম আলী। কাল রাতের স্বপ্নটা চাঙ্গড় দিয়ে উঠছে। সে ভাবার কাজ নেই এখন। বিকেল বেলা পাঁচ জোড়া জুতো দিয়ে গিয়েছিল সরদার। ঐ নামেই সরদার, কাজ করে মিলে, অবশ্য হিসাবদার, কেরানীর উপরে এই যা। এই জুতা আর ঠিক করা চলে না। প্রতিবারই ঐ করে দেয়, তবে এক জুতায় যদি আট-দশবার সেলাই হয় তাহলে ঐ জুতার ছালচামড়া থাকার কথাই নয়। কিন্তু বেপরোয়া সরদার। বেতন এলেই কিনবে নতুন জুতো। কিন্তু সেই বেতন ফুরিয়ে অপেক্ষা পরবর্তী মাসের।
খাদেম আলী জুতা সেলাইয়ের মাঝে উবু মাথা ধরে এলে মাথা উঠায়। আশপাশে নজর বুলায়। রাস্তার পাশে মানুষের গতিপথ পেরোয়। বাজার ক্রমে চাঙ্গা হয়। দুচারটে ভবঘুরে রাস্তায় চলে, ভিখারির নানা সুর ভেসে বেড়ায়, আর পথচারীর জুতার খস খস আওয়াজ কানে লাগে। উপরের ঝাপিটা অর্ধেক খুলে দেয় খাদেম আলী। উপরটা পাতায় ডেকে গেছে। একরাতের শিরিষের পাতায় আর পথের ধূলায় জমে যায় উপরটা। ছাতাটা সামনে রাখা, যেন রোদ এসে না ঢুকে। কিন্তু দুপুরের তপ্ত রোদে বিকার না করলে হিমশিম খেতে হয় ছাতা নিয়ে। মাঝেমাঝে বিড়বিড় করে খাদেম আলী, মনে মনে তসবি জপে। চান্দির নেংটা ঘামে টুপিটা ভিজে যায়। কখনো টুপিটা পড়ে থাকে কালির বাক্সের উপরে। ও কাগু, জুতা ছিড়ি গেছে। ইয়ান ঠিক করি দিবেন বুইজ্জেন নি। আরও দুই জোয়া আছে। এই রেনেন। খাদেম আলী মাথা উঠিয়ে তাকায়। তাকায় বাজারের চটের ব্যাগের উপড়ে রাখা তিন জোড়া জুতায়। ঠিক হবে চারটি। তাই নিয়ে এসেছে আবদুল। বিড়িতে ফুঁক দেয় মাঝেমাঝে। খাদেম আলী নড়েচড়ে দেখে। কতদুরা সেলামু। ইয়ানদি তো আরো কদ্দুর ছিড়ি গেছে। খাদেম আলীর প্রশ্নে জবাবে মুখ খুলে আবদুল। ঠিক আছে, সিলাই দিয়েন। অন কন কতো লাইগবো।
ফের নড়ে চড়ে দেখে খাদেম আলী। দুই টেয়া চাইর আনা দিস। কতোক্ষণে লইবি?
আরে এগান কিয়া কন। দেড় টেয়ার কাম আমনে কন দুই টেয়া চাইর আনা। আইচ্ছা এক টেয়া বারো আনা দিমু। আই বাজার করি আইয়ের। লই যামু গই।
না অইতো ন। বেশি কি চাইছিনি। আই কাম করিয়ের না, আই জানিনা। আইচ্ছা সোজা দুই টেয়া দিস। কতক্ষণ লাইগবো তোর। আগের জুতা ফের ধরে খাদেম আলী।
এবার দাম নিয়ে আপত্তি করে না আবদুল। ঠিক আছে। এই ধরেন আধ ঘণ্টা লাইগবো। আবার কাশেইম্মার দোয়ানে যাওন লাইগবো। বেকে মিলে এই এক ঘণ্টা।
ওমা তাইলে তো ঐতো ন এতক্ষণে। অনো হাতের কাম আছে। তুই দুপুরের আগে দি আইছ। বাজারে থাইকবি নি? ভাঙ্গা গলায় বলে খাদেম আলী। রোদটা বেশ চেগিয়ে উঠেছে চারধারে। খানিক আগের আধো কোলাহল মুক্ত মফস্বল জেগে উঠেছে। রিকশার বেলের সঙ্গে বাস, ট্রাকের হর্ন বেজে উঠে কাঁপুনির ন্যায়।
আইচ্ছা বিয়ালে লই যামু। সিগারেট শেষ ফুঁকটা দিয়ে আবদুল বলে। সাথে থাকা চার বছর বয়সী ছেলেটাকে সাইকেলের পিছনে উঠিয়ে টান দেয় মুহূর্তেই। তিন রাস্তার মোড়ের জগৎ শেঠ ফার্মেসি খোলার প্রস্তুতি নিচ্ছে। নামের সঙ্গে ডাক্তার জুটালেও ও আদৌ ডাক্তার নয়। ডাক্তারি পড়া তো দূরে থাক মেডিকেলের ত্রিসীমানায় পা পড়েনি সেকালে। রাস্তার ওপাশ দিয়ে ভ্যানের পিছুপিছু পাশে বসা একটা কুকুর তাড়া করে। ভ্যানের প্যাডেলের জোর বাড়িয়ে দেয় রিকশাওয়ালা। খাদেম আলী সামনের অবশিষ্ট দুদাঁতের ফাঁক দিয়ে থুথু ভিজিয়ে দেয় কষা মাটিতে। জুতার ছেঁড়া অংশটুকু চামড়ায় সুতোয় সেলাই করে। হাত ধরে আসে, কপালে ঘামের স্রোত জমে যায়, পিঠটা টান হয়ে থাকলেও হাত থামেনা। দুপায়ের মাঝখানে বসানো জুতার রাবারের ফিতা বরাবর একটানা চলে ভিতর বাহির সেলাই। শেষ ফোঁড়ে গেরো পেঁচিয়ে তবেই শ্রান্তি দেয় খাদেম আলী। পাশের তালগাছের উপরে ঝুপঝাপ বাতাসের শব্দ শোনা যায়। ক্ষণিক আগের নীলাকাশ ক্রমেই ধূসর হয়ে আঁধারের রূপ ধারন করে। পাতায় পাতায় লেগে যায় সঙ্গম। ঝুপঝাড় দুপাশে ধুলো উড়তে থাকে। সে ধূলায় শামিল হয় যত্রতত্র কাগজের বান, আঁখের ছোবড়া, ছেঁড়া পলিথিন, সিগারেটের শেষাংশ, ঝরা পাতার কিয়দাংশ, দোকানের সামনে রোদের আড়াল থেকে বাঁচার কয়েক তালি মারা পর্দা।
খাদেম আলী বাঁশের খুঁটিতে ভর দিয়ে দাঁড়ায়। উপরের পলিথিনের বাড়তি অংশটুকু সামনে চড়ায়, বাম ডানে কঞ্চিতে আটকায়। ছাতাটা ঝুলতে থাকে পাশের ক্ষুদ্র দড়িতে টাঙ্গানো সীমানায়। এ সীমানায় বৃষ্টি অবাঞ্চিত, এ সীমানায় জগতের সকল অনিষ্ট অবাঞ্চিত। নখে জমানো ময়লা সাফ করে নারিকেলের শলায়। ঘাম শুকোলেও পিঠ ভিজে যায়, ফতুয়া লেপ্টে থাকে পিঠে। ধুমধাম কিলের মতো বাজ পড়ে উত্তরের দিকে। টিফিনকারীরা বের করে। মগের পানিতে হাত ধোয়। দু আঁজলা নিক্ষিপ্ত পানিতে ভিজে মুখ সমগ্র, থুঁতনিতে জমানো এক ঝরা দাঁড়ি। ফের গামছায় মুছে যায়। চো চো করে ভিতরের অচিন গহব্বর। কাল রাত থেকে এবেলা অব্দি উপোষ। এমন উপোষ নিত্য, কিন্তু সেলাইয়ের ফাঁকে সুযোগ হয়, ডলে খাওয়ার।আজ তাড়া বেশ বলে দেরী হয়। চারটে বাটির প্রথম দুটো শূন্য। খাঁ খাঁ করে চরের মতো। ভাগ্য যে এই খাওয়া আসে পাশের ঘর থেকে, দিনের শেষে টাকা যায় যাক। কিন্তু এই তৈরির পিছনে ছুটতে গেলে বিস্তর ফ্যাঁকড়া। আটটার ঘড়ি থামে সাতটায়। সেই যে বেরোয় এই সকালে ছুটতে গেলে যে দশটা পেরোবে। হোক সে সাত সকালে উঠে চড়ালে হয় কিন্তু সেই শরীরের ও কি নয় দশকেও সায় মিলে। কেবল দেখতে পায়, এক গণ্ডা যৌবনের সঞ্চয়। মেয়ে মরেছে অকালে, বড়টা কেটেছে ট্রেনে, বাকি দুইয়ের এক বড্ড মাতাল, মদ খেয়ে গড়াগড়ি খায় বিছানায়। দিনের শুরুতে তাস আর বাকিদিন রিকশায় প্যাডেল ঘুরিয়ে যে আয় বেবাক চলে জুয়াতালে। বাকি রইলো হারাধনের শেষ যক্ষ। সেই ধন ফুরিয়েছে বাড়ি পালিয়ে। কবেকার বয়স ঠেকেছে কই, সত্তরের বিবি ডুবেছে বানে, খাদেম আলী চায় গগন পানে। তার আর শেষ নেই, শেষ নেই ফুরানোর। নয় দশকের ক্লান্ত রথ ফুরাবার নয়।

বৃষ্টির মাঝে হাই তুলে আকাশ। ঘুম মাড়ানো চোখে তন্দ্রা ভর করে। হাত দুটো একটু বিশ্রাম খোঁজে। তা নয় সেই বিশ্রামের সাধ্য নেই। ও ইসমাইল্লা, ঐ ইসমাইল্লা। এমুই আয়। ওডা। খাদেম আলী ভাঙ্গা গলায় হাত উঁচিয়ে ডাকে অদূরে দাঁড়ানো গোয়ালা ইসমাইলকে। এসেছে সে দুধ দিতে নন্দের দোকানে। এই দুধ চড়বে খানিক পরে মস্ত কড়াইয়ে। টাকাটা লুঙ্গির খাঁজে আটকিয়ে সাইকেলেটা হাতে চালিয়ে সামনে এগোয়।
কিয়া গো দাদা। কিয়া কইবেন নি। দুধের কলসিটা সামনে থেকে নামিয়ে পিছনে ঝুলায় সে।
তুই কাইল বিকালে চলি গেলি কিললে। এতবার ডাইকলাম হুইনলি না। ইয়াসিন যদি হুনে তুই এগান কইরলি তোরে কি কইরবো জানোস নি।
এগান কিয়া কন। অ্যাঁই আবার কি কইরছি। অ্যাঁর কি দোষ কন আমনে। হেতে অ্যাঁরে বোলাইলো। কইলো অ্যাঁই বলে হেতের দুধে হানি মিশাই। আই কসম করি কইয়ের জিন্দেগিত যদি হানি মিয়াই তয় আল্লার যেন ঠাডা হড়ে অ্যাঁর মাথার উচে।
হে কথা ন। তার লগে আরও কিয়া বলে কইরলি। হেতে মেম্বারের কাছে নালিশ দিছে। তুই বলে কারে বলে কইছিলি হেতে বলে চুরি কইরছে, অ্যাঁর হেতে বলে কোব্বাতের মাইয়ার লগে লটরফডর কইরছে। আর তুই বলে হেগান কোব্বাতেরে কই দিছোস।
তো অ্যাঁই কি মিছা কথা কইছি নি। জেগান কইছি হাচা কথা। হেতে অ্যাঁর নামে উল্টা কথা কইলে অ্যাঁই কিয়ারলে হেতের নামে কইতে পাইরতার ন। হেতের কয় অ্যাঁই বলে দুধে হানি মিশাই। অ্যাঁই যদি দুধে হানি মিশাই মাইনসে তো অ্যাঁরে কইতো। এগান বেক অইছে হেতের বিটলামি। হেতে মানুষ বোলাই বোলাই কইছে। হেতের কারনে বান্ধা যেগুনে কিনে এইচ্ছা চাইরজন ছুডি গেছে। হেতে যে মাইর খায় নো হেতের তো এই কপাল। অন্য কেউ অইলে যে মাইর খাইতো ইজ্ঞাও মাডিত পড়তো না। গরগরিয়ে বলে ইসমাইল।
অইছে অইছে, অন মিটমাট ঐ যাইস। ভেজাল করি লাভ আছেনি। মিলিঝুলি থাইকবি এই ভালা। হেতে অ্যাঁর কাছে অ্যাঁই কয়। মেম্বারের কাছে যাই বলে কইছে। অন তো কোব্বাতে হেতেরে খালী খুঁজের। হাইলে বলে পিঠের চামবা তুলি হালাইবো। এমন সময় ঘেটু এসে হাজির হয়। ওগো জেঠা অইছে নি জুতা, অন আবার সদরে যাওন লাইগবো। এরে ইসমাইল এনা। তুই কোন মুই থুন আইলি? তোরে দেখিনা যে অন। তোরে বাত্তি জ্বালাই খুঁজিয়ের। রঘুরে আইজ কাইলের মইদ্ধে কমু মনে কইরলাম যে আংগো বাড়ির দুধ যানি হেতে দি যায়। অন তো তোরে পাইলাম। বেয়ান বেলা দুধ দি যাইতে পাইরবি নি?
মেঘ না চাইতেই জলের মতো অবাক হয় ঘেটু। আনন্দটা সামলে নিয়ে বলে, কখন থুন দিমু।
কাইল থুন দেয়। অন তো বাজারের থুন কিনা লাগে। তুই সের কতো করি রাখোস?
এই দুই টেয়া। বাজারে আরও কমে হাইবেন। হেতেরা কেমনে বেচে জানিনা, অ্যাঁর গরু তিনগা সেগুনের দুধ দিই। এই যে নন্দ কাকু লয়, যদি জিগাইবার লে মনে চায় জিগান দুধ কেইচ্ছা। বাজারে এক টেয়া চৌদ্দ আনা অ্যাঁই চাইর আনা বেশী রাখি।
অইছে অ্যাঁর বেশী কথা কইছছা। কাইললা থুন দেওন শুরু কর। দেড় সের করি দিবি। কই জেঠা জুতা অইছে নি।
জুতা অনেক আগেই হয়েছিলো। পাশে জুতা রেখেছিলো খাদেম আলী। ঐতো জুতা, জুতার দিকে ইশারা করতেই খাদেম আলী দেখে জুতা নেই। দিকে কিন্তু সে জুতা গেলো কই। চশমাটা নাকের নিচে নেমে যেতেই ফের নাকের উপর উঠালেন তিনি। এই বাউ জুতা ইগা তো ইয়ানদি রাইখলাম কোন মুই গেলো। তৎক্ষণাৎের মধ্যেই ব্যতিব্যস্ত হয়ে উঠে ঘেটু। চারদিকে একবার নজর বুলায় কোথাও দেখতে পায়না। আরে জুতা যাইবো কোনমুই হতাশ গলায় বলে।
কোন কুত্তা টান দিছেনি। কুত্তা ওগল অখন যে বিটলা, মুখে করি লই দূরে হালাইদে। ইসমাইল বলতেই কুত্তা যা করে। তোর ঠ্যাঙয়ের সামনে জুতা রাইখলাম সবে, যাইবো কোনমুই। খাদেম আলী বলতেই বসে ঘেটু। পরক্ষনেই উল্লাসিত গলায় বলে উঠে ‘হাইছি, হাইছি। এইততো জুতা। অবা আমনের খাটের লগে। খেয়াল ও করিনো’।
তোর সামনে রাইখছি আর তুই অহন ও খুঁজোস। খাদেম আলী মুখ ভর্তি হাসিতে বলে।
এক টাকার নোটটা এগিয়ে দেয়। জুতার দুপাশে পুরো সেলাই করা। খাদেম আলী টাকাটা পকেটে পুরে। পুরা খাওয়াটা এখনো হয়নি। ঘেটু আর ইসমাইল চলে যেতেই ফের খেতে বসে খাদেম আলী। অবশ্যি ক্ষিধেটা বিদেয় নিয়েছে, কিন্তু খানিক বাদেই তা ফিরে আসবে জানে খাদেম আলী। থেমে থাকা বৃষ্টিটাও শুরু হয় আবার, তবে আগের মতো এখন বাতাস নেই। টিফিনকারীর প্রথম দুটো বাটি খুলে পাশে রাখে খাদেম আলী। তৃতীয় বাটিতে ডালের সঙ্গে কই মাছের তরকারী। এই খাবার এখন অর্ধেক বাকিটা ভর দুপুরে তখন অবশ্য ঘণ্টাখানেক বিশ্রাম মিলবে। বাক্স পেটারা উপরে উঠিয়ে ঝাঁপি নামিয়ে পা টান করে শুয়ে থাকবে খানিকক্ষণ। তারপর উঠে গিয়ে ফের সাতটা অব্দি চলবে ঠুনঠুনি। দুটো কইমাছের অপেক্ষাকৃত ছোটটি পাতে তুলে। বিশিলরা পুকুর সেঁচেছে বলে সস্তায় মিলেছে কইমাছ। রুই কাতলার দাম যেন হারাম, মুখ তোলাও অপরাধ বলে গণ্য। খাবারের ভুল ধরার স্বভাব মানুষের যৌবনে থাকে। সেই যৌবনে কোনরূপ পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া না করেই উঠে যেতো খাদেম আলী। কই মাছের সঙ্গে পুঁইয়ের লতায় বুটের ডাল। মসুর ডালের বাজার গরম বলে সস্তায় মিলে বুট। আজীবন সস্তায় কাটলো, সাধে আর রইলোনা।
একনাগাড়ে ঝড় শুরু হয়। ফের সামনের ঝাঁপিটা নামায় খাদেম আলী। গলায় কাঁটা বিঁধেছে তার। কাঁটা ফেলার আগে ছাতিটা উঠিয়ে টাঙ্গায়, খুলে আসা লুঙ্গিতে গিঁট দেয়। পলিথিনের ছিদ্র দিয়ে ঢোকা পানির দিকটা শুইয়ে দেয় বাকি পলিথিন সমেত। ভীষণ শব্দে ঘন আঁধারে ঢাকা পড়ে সব। হাতুড়ির বাড়ির মতো এসে পড়ে শরীরে। চোখ ফেটে সব আঁধার দেখায়। লোকের কোলাহলে ভেসে যায় বাকি সব। ঘো ঘো শব্দহুঁশবৈদয়এহ………ধুজ্জজ্জদ্দস্ললসগগগস। নাক মুখ ভেদ করা ক্ষীণ শব্দস্বর। ধীরে ধীরে চোখ বুজে আসে, আর নেই নেই। শেষবারের মতো কেঁপে উঠে গোটা দেহ।

আশপাশে জমে উঠা ভিড় ঘিরে খাদেম আলির ছাপড়াটার উপর। সটান হয়ে পড়ে থাক দেহে বেঁকে যাওয়া টিফিন বাটি আর গালে মুখে বাদলা ভেজা রক্তের বান। মগজ উপড়ানো খুলি ফেটে মিশেছে কই মাছের তরকারী। সেদ্ধ কইমাছ চোখ বিহীন খোলসানো দেহে আর খাদেম আলীর বাঁকানো ফাটা কপালের পানে চেয়ে রয়। গগন শিরিষ গাছটা পড়ে থাকে বুক বরাবর ভেদ হয় কানের পাশ দিয়ে রেল লাইনের মতো সমান হয়ে। আশ্বিনের ক্লান্ত বর্ষণে শতাব্দী প্রাচীন দুই বুড়োর মিলন ঘটে অভিন্ন বিন্দুতে।