বৃশ্চিক বীজ

এসব খাপছাড়া ঘুমের বিশৃঙ্খল অসুখ তাকে বিপর্যস্ত করে প্রায় প্রতিরাতে। অজাগতিক সেই অচেতনার জগতেও তার মগজে টনটন করে বাজে, ‘জেগে ওঠো ফ্লোরা, জেগে ওঠো।’ সে জানে না কেন তাকে হুড়মুড় করে জেগে উঠতে হবে, কেন ঘুমের আরাম-সুখ তার জন্য প্রযোজ্য নয় – তবু সে জেগে ওঠে। এক তীব্র ভয়ংকর শোঁ শোঁ শব্দসহযোগ হল্কা আগুন তার কান গরম করে রাখে অযথাই, সে শুধু অনুভব করে অদৃশ্য কারো গায়ের ঘাম তার শরীরের বাষ্পীয় নদীতে লেপ্টে যাচ্ছে অতলে। এগুলো ঠিক দুঃস্বপ্ন নয়, আবার জৈবিক সুখস্বপ্নও নয়, কী যেন নাম এর! পুরোপুরি ধাতস্থ না হয়ে ঝিম ধরে পড়ে থাকে ফ্লোরা; একা নিঃসঙ্গ বিছানায়। এরপর ফোন হাতে নেয়, আলো জ্বেলে দেখে ফোনের স্ক্রিন, কতশত বিকারগ্রস্ত পুরুষের প্রণয়কথন, স্তুতি। কখনো কখনো অনাবৃত পুরুষের মাংসল সাহসী ভঙ্গি। হায় চারপাশ জুড়ে এত সেক্সুয়াল ফেটিসিজম! হাতাকটা টপসের উদলা হাত আর হাফপ্যান্টের স্থূল ঠ্যাংওয়ালা সমুদ্রস্নানের ছবি তাকে সমুদ্রপরী থেকে জঙ্গলে ছুটে বেড়ানো উন্মত্ত ঘাই হরিণী বানিয়ে ছাড়ে, কত সুবোধ সামাজিক ভালোমানুষ চেহারার মানুষগুলোর চোখ ছাপিয়ে ঠিকরে বাইরে বেরিয়ে আসে তার ভেতরের চর্বচুষ্য মুখ, অদৃশ্য ঝাঁ-চকচকে লোভী জিভ ফ্লোরা ঠিক দেখতে পায়, দেখেও না দেখা চেতনায় ফোনটা ছুড়ে মারে দূরে। থুঁতনির নিচে গালের হনুতে ব্রণের গজানো ব্যথায় হাত ঘষে ঘষে এভাবেই ফ্লোরা সকাল আনে তার দরজায়। 

বয়সের তুলনায় ব্যক্তির সামর্থ্যরে এফোর্ট যদি বেশি নিতে হয় তাহলে পেছনের ব্যাকপ্যাকও পৌনঃপুনিকভাবে মোটা আর ভারি হয়ে দাঁড়ায়। টানতে কষ্ট হয় সেসব, কিন্তু শুধু এই মোটা ব্যাগ বহন করার জন্য দু-চারটা টাইমপাসিং বয়ফ্রেন্ড বানানোটাও কাজের কিছু নয়, অযৌক্তিক; ফ্লোরা জানে সেসব। প্রোডাক্ট ডেলিভারি শেষ হতে ঘণ্টা-দুই লাগে – এ-সময়টা বোরিং তার কাছে। অতটা সময় নিজেকে দিতে পারলে কত কী হতো। কাউন্সিলর লাগত না, ইদানীং মাসের অর্ধেক চলতেই হাত খালি হয়। হ্যানের বার্থডে, ত্যানের আপকামিং রিলেশনশিপ সেলিব্রেশন, ট্রিট-ফ্রিট আও-ফাও বাল-ছালে পকেটের হয় দফারফা, মাস-দুয়েকের মধ্যে সেমিস্টার ফাইনাল, মুখে জোয়ারের মতো স্ল্যাং জমছে তার। ‘শালার মাটাও কেমন ক্ষেত, ব্যাকডেটেড, একটা বাপ গেছে তো তো কী হয়েছে সে কি পারত না তাকে আরেকটা বাপ জুটিয়ে দিতে! বছর বছর এইসব হোস্টেল-খরচা, সেমিস্টার ফির প্যারা আর কত ভাল্লাগে; বাপের তো এখনো ছেলেপুলে হয়, তো তোমার সব ঝুলে গেল ক্যান বাল!’ – মা অথবা অদৃশ্য কাউকে উদ্দেশ করে মনের খেদ ঝেড়ে শান্ত হয় ফ্লোরা, রোজই। এরপর সানগ্লাসের পজিশন আর কর্মস্থলের দূরত্ব ঠিক অ্যাঙ্গেলে রেখে পথে হাঁটে দ্রুত।

অক্সফোর্ড ডিকশনারি একেকটা পিস একেকটা থানইট। পিঠের ব্যাকপ্যাকের ভারে ঘাড় টনটনায়। বড় রাস্তায় এলে তবু একটু সুখ, পিচের এই রাস্তাটা প্রশস্ত। ঘোরানো গোলকধাঁধার মতো অনেকটা পথ প্যাঁচানো। দুপাশে বড় বড় শালবৃক্ষ। দুপুর হলে এ-রাস্তায় প্রায়ই ঘুঘু ডাকে। হবে হয়তো ‘অক্টোবর ইন নভেম্বর রেইন’ গায়। মাঝে মাঝেই ছেলে ঘুঘুটাকে একা লাগে ওর। সিঙ্গেল স্বরে ডাকে ঘুউগ ঘুউগ ঘুউগ। সেসব দুপুরে হুটহাট তার নিনাদকে মনে পড়ে। ফ্লোরা নামটা নিনাদের পছন্দ নয়। ও ডাকে পুষ্পিতা অথবা পুষ্প। কখনো ডাকে ফুল। ছোট ছোট করে কানের কাছে সুর করে বলে –

পুষ্পিতাকে বৃষ্টি 

পুষ্পিতাকে জল

পুষ্পিতাকে দিলাম অশ্রু টলমল –

নিনাদ যেন দেখতে কার মতো, ওর বাবার মতো দীর্ঘ নয় মোটেও। চোখের ভেতর কী যেন বেশি ওর। ভোঁতা একমুখীন আবেগ। ফ্লোরার হাঁসফাঁস লাগে। নাহ্, আজ আর ডেলিভারি চলবে না, চাকরি যায় তো যাক। অনলাইনেই আজকাল আউটসোর্স ইনকাম কত!

একটা হিংস্র বাঘের গর্জনে সাদা বাড়ির নিস্তব্ধতা ভাঙে। মন্দিরা আন্টি দরজা খুলে সামনে হাসিমুখে দাঁড়ায়। জংলি হালুম-হুলুমে সে ভুলে গিয়েছিল ওটা কলিংবেলের শব্দ। এটা নিশ্চয়ই আংকেলের কাজ। দরজা খুলতেই কার্নিশে ঝুলে থাকা একটা বিচ্ছিরি দেখতে টিকটিকি গায়ের ওপর পড়ে যায় আচমকা। কিলবিল করে বুকের ভাঁজে। সে একবার ভাবে চেঁচিয়ে উঠবে জোরে, কিন্তু এটার অদ্ভুত ছটফটানি পুরুষালি অবাধ্যতায় ওর কেমন যেন লাগে। অল্প সময়েই জলজ্যান্ত টিকটিকি জীবন নিয়ে পালায়, তার চোখ এখন উদ্বিগ্ন নিনাদ বা ছুটন্ত টিকটিকি রেখে খোঁজে একটা বাজখাই চোখের মুখ।

 সকাল সকাল নিনাদকে দেখতে বিচ্ছিরি লাগছে। পরে আছে মেরুন শার্ট, ও কি আয়নায় নিজেকে দেখে না। নিনাদ তাকিয়ে আছে একদৃষ্টিতে ওর চোখের পরে, সে চোখ নামায়, ভয়ও হয়, যদি পড়ে ফেলে কিছু। আজো আতঙ্কিত বোধ করছে কিঞ্চিৎ। 

– তুই এসময়?

– হু।

– কোনো কাজ আছে?

– উহু।

– শপিংয়ে যাবি?

– নাহ্।

– তো আসছিস কেন?

– এমনি, শরীর ভাল্লাগছে না।

– ওহ্, আয়, ভেতরে আয়।

– একটা ব্যাপার খেয়াল করেছিস নিনাদ? 

– কী?

– পেছন থেকে আন্টিকে দেখলে কিন্তু মা ভাবটা আসে না একদম। মন্দিরা নামটাতেও কেমন একটা অ্যাডিকশনাল ব্যাপার আছে, লক্ষ করেছিস। 

– সকাল সকাল এসব কী? ড্যাম ইউ টক অ্যাজ লাইক অ্যা নুইনসেন্স।

– ওহ্ নো, কুল বেইবি!

– লিসেন, ট্রাই টু কনসেনট্রেট, শি ইজ মাই মম। 

– হা হা হা, জানি তো নিনাদ, উথড্রো করছি, এত ওভার রিঅ্যাক্ট ভাল্লাগছে না! শোন এগুলো আমার দোষ নয়।

– আচ্ছা! তোর না কার?

– তুই তো জানিস নিনাদ আমার

মাথায় ছিট আছে, আর তাছাড়া প্যারাফিলিয়া না যেন কী নাম, ওই যে তোর ডাক্তার বলে, ওটাও তো আমার আছে। আমার কি দোষ! যাকে দেখি তাকেই যেন কেমন কেমন ঠেকে!

– ওকে কাট দিস আনহাইজেনিক গসিপিং। সকাল সকাল সুন্দর কিছু ভালো লাগে। আমার ফুল এনেছিস?

– হু।

ফ্লোরা সাদা তিনটে গ্লাডিওলাসের স্টিক নিয়ে রেখেছিল গতরাতে। ও প্রতিদিনই ফুল কেনে, সাদাফুল। ডগা ছিঁড়ে সেগুলো -কেই পেঁচিয়ে নিয়ে এসেছে দুটো। একটা রেখে এসেছে টেবিলে।

– তোর কাঁঠালচাঁপায় ফুল ফোটেনি? 

– হু, অনেক।

– আনিসনি কেন?

– আনবো নিনাদ, আর কটা দিন যাক, খোকা ঘুমাক, পাড়া জুড়াক, বর্গিরা আসুক, রসুন পাকুক তারপর?

 হাউ স্ট্রেঞ্জ! তুই যেন কেমন। অসহ্য। তোকে সহ্য করা ইম্পসিবল! অ্যাবসার্ড! ড্যাম আগলি!

ফ্লোরা কথা বাড়ায় না, চুপসে থাকে, ক্লান্ত লাগে তার – নিনাদের ন্যাকা ন্যাকা রোমান্টিসিজম বা টিনেজ প্রেমিকসুলভ রাগ কোনোটাই ভালো লাগছে না এই মুহূর্তে। নাহ্ কাজবাজ রেখে এ-বাসায় ছুটে আসাটা ঠিক হয়নি। ফ্লোরা সোফায় নেতিয়ে পড়ে, ঝিমুতে থাকে। নিনাদ রেগে যাচ্ছে। যাক। ফ্লোরার খুব ইচ্ছে করছে একটা সিগারেট ধরাতে, নিনাদের কোলে শুয়ে শুয়ে সুখটান দেওয়া, আহা! নাহ্, মুখভর্তি ব্রণ নিয়ে হবু শ্বশুরঘরে সেটা মনে হয় ঠিক দেখাবে না এই মুহূর্তে, ফ্লোরা জানে নিনাদ ছাড়া এ-বাড়ির কেউ তাকে পছন্দ করে না, তবু সে আসে, তাকে আসতেই হয় এখানে। ফ্লোরা ভেবে অবাক হয় নিনাদ কেমন করে এখনো এত চাইল্ডিশ, ইম্ম্যাচিউরড। কিছুই কি বোঝে না!

ফ্লোরার বিষণ্নতায় নিনাদ একটু নরম হয়।

– ফ্লোরা তোকে কিছু রং কিনে দিই? একটা পুরো ক্যানভাস জুড়ে আকাশ আঁকবি?

ফ্লোরা নিরুত্তর।

– আঁকবি বল, কতদিন রং ছুঁয়ে দেখিস না। তোর গায়ের মিষ্টি গন্ধটাও আঁকিস। আজ কি মেখেছিস গায়ে, কোন ব্র্যান্ড?

 ব্র্যান্ড-ফ্র্যান্ড না চাঁপাফুল পুড়িয়ে ছাই মেখেছি, কাছে আয় গন্ধ নিয়ে যা।

– সত্যি আসব।

– হু আয়। কিন্তু একটা প্রশ্নের উত্তর কিন্তু দিতে হবে তোকে?

– বল।

– ধর একটা ধেঁড়ে বেড়াল আর একটা ছুঁচো ইঁদুর সঙ্গম করছে, ঠিক সেই মুহূর্তে তাদের গায়ে কেমন গন্ধ হতে পারে বল তো? হ্যাভ অ্যানি আইডিয়া?

নিনাদ ঠাস করে উঠে দাঁড়ায়, বিশ্রী শব্দে নিজের ঘরে গিয়ে দরজা আটকে দেয়, ছিটকিনি তোলার আওয়াজও শোনা যায়। রাগ না পড়া পর্যন্ত নিনাদ আর দরজা খুলবে না। না খুলুক। নিনাদের মা এসবের ঊর্ধ্বে। নিনাদ-ফ্লোরার পার্সোনাল ইস্যুতে নাক গলানোর মতো আনস্মার্ট নিজেকে ভাবেন না তিনি। একফাঁকে ফ্লোরাকে কফি দিয়ে যান, ব্যস এটুকুই। ফ্লোরা সময় নিয়ে তেতো কফি  খায়, পা নাচায় কিছুক্ষণ, রাগ পড়ে গেলে নিনাদ নিশ্চয়ই আসবে, না এলেও সমস্যা নেই। ফ্লোরা পা নাচায় আবারো।

গত সপ্তাহে নিনাদ ওকে নিয়ে গিয়েছিল এক অদ্ভুত মানুষের কাছে। সাইকিয়াট্রিস্ট। সে নাকি যে কোনো ফ্রাসটেটেড রোগীর ব্লকড সারাতে পারে, ফ্লোরার ব্লকড কোথায় ফ্লোরা নিজেই তো জানে না। লোকটাকে উন্মাদ মনে হয়েছিল ওর। একটানা ঘড়ঘড়ে আওয়াজে বলতে থাকেন বেগুনি, নীল, আসমানি, সবুজ, হলুদ, কমলা, লাল। লাল লাল লাল – তাকান এইদিকে দেখুন, লাল দেখুন প্লিজ। বেছে নিন একটা লাল! গাঢ় লাল, ফিকে লাল, কমলা লাল, খয়েরি লাল। লোকটা বলে যায় ক্রমাগত, দ্রুতই। ফ্লোরার এসব রঙের ক্যাচালে মাথা ধরে যায়। তবুও লোকটা অনেকগুলো বাক্স নিয়ে বসেন। কোনোটায় ত্রিভুজ, কোনোটায় চতুর্ভুজ, কোনোটায় বৃত্ত! বৃত্তের মাঝে নীল, বৃত্তের মাঝে সবুজ, বৃত্তের মাঝেই লাল। চোখের সামনে ঘোরায় সেসব! এক ঘণ্টা দু-ঘণ্টা তিন ঘণ্টা। সে ছটফট করে, লোকটা বাক্সগুলো ঘোরায়, ঘোরাতে ঘোরাতে একসময় সেগুলো চোখের ভেতর দিয়ে মগজে ঢুকে যায় তার, ব্যথা হয় পিনপিন – এরপরই সে ওই অদ্ভুত লোকটার দোজখখানা ওলটপালট করে বেরিয়ে আসে বাইরে। লোকটা কি তাকে কালারব্লাইন্ড পেশেন্ট ভেবেছে? না হয় এত জোর করে রং চেনাচ্ছে কেন? অদ্ভুত।

 বসার ঘর থেকে নিনাদের আব্বুর ঘরটা দেখা যাচ্ছে, ও ঘরে অনেক বই। কিছুদিন আগেও এই মানুষটা অন্যরকম ছিল, কী-সব মুখোশ এনে লুকিয়ে রাখত বইয়ের ভাঁজে, এমন একটা ভাব দেখাত যেন সেগুলো ফ্লোরার জন্য নয়। ফ্লোরা তার ব্যাকপ্যাক ভর্তি করে নিয়ে যেত মুখোশ আর বই। প্রতিবার একটা মুখোশ কমন, এক প্রতাপশালী রাজার মুখ। সেটা দেখতে অনেকটা তার নিজের বাবার মতো; হু, বাবা। বাবার মুখটা একসময় তার কাছে খুব রঙিন মনে হতো। সে যখন ক্লাস ফাইভে বৃত্তি পেয়েছিল বাবা তখন তাকে মেলায় নিয়ে গিয়েছিল ঘুরতে, হাত ভর্তি করে দিয়েছিল গরম গরম জিলাপি। ফুঁ দিয়ে দু-ঠোঁট মাখিয়ে যখন সে জিলাপির মিষ্টতায় দুনিয়া ভুলছিল তখনই উন্মোচিত হয় নতুন পৃষ্ঠা – ‘এ ফ্লোরা, আমার মেয়ে, খুব শান্ত চুপচাপ, ভালো ছবি আঁকে।’ বাবার পেছনের ছিপছিপে সেই তরুণীর চোখের দ্যুতির আলোয় ঠান্ডা হয়ে গিয়েছিল তার জিলাপি, এমনকি বিস্বাদও লাগছিল একটু। তরুণীর বগলদাবা হয়ে বাবা হাওয়া হয়ে যাওয়ার পর ফ্লোরা জেনেছিল মেয়েটি তার হবু দ্বিতীয় মা। বাবার নবাগত প্রণয়ী।

নিনাদ দরজা খুলে আবার এসে পাশে বসেছে, চুপচাপ, শব্দহীন। দুজনের দুপুরগুলো আগে এমন ছিল না, সময় সময় ঘোরগ্রস্ত না হলে ফ্লোরা খুব হইচই করা মেয়ে। বন্ধুদের মধ্যে একমাত্র সে-ই যখন-তখন হুটহাট নিনাদের বাসায় ছুটে আসে। নিনাদের আব্বুর বইয়ের তাকে ওর অনেক লোভ! আর নিনাদ? হ্যাঁ ফ্লোরার কাছে নিনাদের সেই পুরুষ হওয়ার কথা ছিল যার জন্য একটা মেয়ে ধীরে ধীরে অ্যাডাল্ট হয়, যার কাছে এইটিন পাশ শব্দটা বলতে পারাও গর্বের। সেই কলেজ থেকে ভার্সিটি পর্যন্ত তারা অতি সঙ্গোপনে বিছিয়ে এসেছে প্রণয়পথের রাস্তা, উঠোন থেকে বারান্দায় যাওয়ার গৃহস্থ পথ, অথচ কোন দিকে গেল সেই পথ, সেই রাস্তা; দুজনের কেউই জানে না। তাদের যে কী সমস্যা! সমস্যা হয়তো কিছুই না, সমস্যা শুধু তার বাবা আর তার সাদা রং। ফ্লোরা প্রতিটি মানুষের অপজিটে একটা করে রং কল্পনা করে, যেমন নিনাদ হলুদ, আন্টি গাঢ় লাল। আঙ্কেল ডার্ক ব্লু। মেয়েটাকে নিয়ে বাবা চলে যাওয়ার পর থেকেই ফ্লোরার পথে হেঁটে রং খোঁজার রোগ হয়েছে। ফ্লোরার মনে হতো এ-শহরের যে-কয়টা সাদা বাড়ি সব কয়টায় ওর বাবা থাকে। কারণ ওর বাবার খুব সাদাপ্রীতি ছিল। সমুদ্র, কাশফুল আর পশ্চিমের মেঘ বাবার পছন্দ ছিল খুব। ফ্লোরা জানে ওই তরুণীর অপজিটেও সাদা। 

একেকটা সাদা বাড়ি খুঁজে সেখানে যাওয়া মানেই কাঁধে করে হরেকরকম অসুখ নিয়ে আসা। ফ্লোরা তাই করত, কখনো মনে হতো এটা সেই বাড়ি এখানেই হয়তো আছে কেউ। অথচ না সেখানে তার পুরনো কেউ থাকে না। একবার দেখা হলো কাঁচাপাকা চুলের এক আধবুড়ো মানুষের সঙ্গে। চশমার ফাঁক দিয়ে গম্ভীর হয়ে লোকটা দেখল সদ্য শৈশব ছাড়ানো এক বিষাদগ্রস্ত কিশোরীকে। 

– কী চাই?

– কিছু না, এমনি আসি। 

– ও আচ্ছা, এসো।

সেই প্রথম, এরপর কতবার! বাবার মতো সহজ সাদা মৃত্যু।

আরেক সাদা বাড়িতে ঢুকে দেখে সেটা একটা গোপন গুহার মতো উপাসনা ঘর। যে লোকটা বেদিতে বসা তার চোখ লাল, ফ্লোরার তো লাল চাই না, তার প্যাস্টেলে স্ফটিকের শুভ্রতা প্রয়োজন। ফ্লোরা তাকায় বারবার, লোকটার ভুলে-যাওয়া-চোখে বিগত জনমের শোক তাপ সুখ অথবা তন্ত্রমন্ত্রের মাঝে কোথাও নেই স্নেহময় অবয়ব। ধূসর অস্বচ্ছ কোটরে তার চোখের মনি ঘুরেফিরে পালটে যেত রক্তজবায়। নামাবলি মন্ত্র অথবা রুদ্রজটার নামাঙ্কিত ত্রিশূল দেখেও ভয় পায়নি ফ্লোরা। লোকজনও তাকে বাবা ডাকে শুনেছে সে। হয়তো সময় গেলেই সাদা হবে সব। লোকটা কী যেন ওড়াত ধোঁয়ার মতো, বৃষ্টি হলে বলত ‘এসো মা’, রোদ হলেও। 

– তোর কী হয়েছে বলবি?

– হু বলব, আগে বলত আমি দেখতে কেমন হয়েছি।

– জানি না, কেন জানি মনে হয় তুই আর সহজ-সরল তুইতে নেই, ঝুমবৃষ্টিতে ভিজতে ভিজতে কৃষ্ণচূড়া এনে দেওয়ার বায়না ধরা কিশোরী প্রেমিকা তুই নেই, এলভিস প্রিসলি নিয়ে মাতামাতি করা পুষ্পরমণী আর নেই তুই। তোর চারপাশ ঘিরে এখন শুধু ফণীমনসার ঝোপ, হিসহিস শব্দও শুনি, শুধু খালি চোখে অন্ধকারে সাপটাকেই দেখতে পাই না। এখনকার তুই বড় অদ্ভুত জটিল অন্ধকার কালো তুই।

 এত এত বিশেষণে হাসি পায় ওর।

 –    বাব্বাহ! নিনাদ, তুইও এভাবে বলতে পারলি। বাহ! খুব বুঝি কবিতা পড়িস আজকাল?

– কী হয়েছে তোর উত্তর দে?

– আগে বল সঙ্গমকালে পুরুষ যখন প্যাঁচিয়ে ধরে রমণীর নগ্নবুক তখনকার শিৎকার কী তৃপ্তির উষ্মা, নাকি ওটাও হিসহিস? তাদের নিঃসরণে কি রং থাকে বলত?

– পুষ্পিতা প্লিজ স্টপ। চল তোকে আরো ভালো ডাক্তার দেখাই, তুই অসুস্থ, তোর চোখ দিনকে দিন ভয়ংকর হয়ে উঠছে। তোর মুখের ভাষা অসহনীয় পর্যায়ের কুৎসিত! তোমার মগজ পচে যাচ্ছে, ওইসব পাতি সাইকিয়াট্রিস্টে তোর হবে না; আরো উন্নত চিকিৎসা জরুরি।

– ঠিক বলেছিস তুই। গ্রেগর সামসার মতো আমিও মনে হয় কিছু একটা হয়ে যাচ্ছি। গভীর এক ঘুম থেকে জেগে উঠে দেখছি আমি আর আমি নেই, সর্পগন্ধা ফুল হয়ে গেছি, কালনাগও মনে হয়। ওহ-হো, আমি তো আমাজনের দৈত্যাকার অ্যানাকোন্ডা, জানিস না তুই। আয়, কাছে আয়, তোকে গিলে খাই কপ কপ! … 

নিনাদ আবার রাগ করে উঠে যায়।

ওর ফেলে যাওয়া জায়গাটায় নাক ডুবিয়ে বসে থাকে সে চুপচাপ কিছুক্ষণ। লাইব্রেরি ঘরটায় চোখ যায় ওর। ওই বিশেষ দরজাটায় গাঢ় করে লেখা আছে প্রবেশ নিষেধ। তবু সে জানে ও-ঘরের দক্ষিণে একটা নীল বাতি জ্বলে, নিয়ন। সন্ধের পর ও-ঘরে চমৎকার গন্ধ থাকে, আলো ও গন্ধের চমৎকার কম্বিনেশন! সে সেঁধিয়ে যায় কোথাও ওই ঘর আর ওই লোকটাকে ভেবে। দৃশ্যপটে সে আর শুধু নিনাদের বাবা। 

– একটু আসি এ-ঘরে?

– ওহ ফ্লোরা, নিনাদের বন্ধু, এসো।

– আপনার ঘরের দেয়ালটা কী সুন্দর সাজানো, সাদা।

– প্রতিবার এক কথাই বলো মাই সান। বসো, বাট লিসেন, ডোন্ট ট্রাই টু ইন্টারাপ্ট মাই সাইলেন্সি, আই ডোন্ট লাইক বদারিং। একটা জটিল ফিচার পড়ছি। এরপর লোকটা পড়ায় ডুবে যেত রঙিন পাতায়, ফ্লোরা দেখত মুগ্ধচোখে।

না, সে বদার করিনি একদম। তবু কোনো এক অচেনা টানে ছুটে ছুটে গেছে সে। তার কণ্ঠ, তার চোখ? উহু, উহু কিছুই নয় তবু তার খুব ইচ্ছে হতো ও-ঘরের জানালা হাট করে খুলে দিতে। অন্ধকার ঘরে সূর্যের আলো এনে দিতে ইচ্ছে হতো খুব। সে ভেবে রেখেছে এ-ঘরের বউ হয়ে এলে ও-ঘরটার পাশে একটা কাঁঠালচাঁপা পুঁতে দেবে। সর্পগন্ধাও হতে পারে। নিনাদ চাইলে ফণীমনসার ঝোপও লাগাবে কিছু। 

ফ্লোরার অস্থির লাগে এসব ভেবে। শোনা যায় না এমন আস্তে করে দুবার ডাকে নিনাদকে –

নিনাদ

নিনাদ

অভিমান ভেঙে নিনাদ আবার ছুটে আসে। নাহ্ ছেলেটা আসলেই বোকা, বেহায়া। মৃদু একটু ডাকতেই কেমন সুড়সুড় করে চলে আসে। মানুষ এত ইনোসেন্ট হয়! ওর তো এখন রেগে থাকা উচিত। এসব উপযুক্ত প্রণয়ের দিনেও তার প্রেমিকা মগজে অসুখ নিয়ে ঘুরছে, শরীরে অবসাদ নিয়ে ঘুরছে এটাও কি মেনে নেওয়া যায়! তার মনে হতে থাকে নিনাদ হয়তো সেই কাঠমানুষ যার ভেতরের অস্থির অধৈর্যের বিষ হয়তো কোনোদিনই গলিত লাভার মতো ফিনকি উপচে পড়বে না কোথাও। হয়তো কোনোদিনই না। ফ্লোরা ভাবে, নিনাদ যদি সব জানে শেষটার অনিবার্য পরিণতি তাকে কতটা পালটে দিতে পারে, কতটা!

– আচ্ছা নিনাদ আমার একটা সুন্দর মেয়ে বাবু হলে কেমন হয়? 

– হোয়াট ডু ইউ মিন পুষ্প?

– কী নাম রাখবো তার – কাঁঠালচাঁপা, বৃশ্চিক বীজ, নাকি সান্তা ক্লজ?

– পুষ্পিতা প্লিজ নো মোর। আই কান্ট, ইউ উড বি অ্যা সাইকো, স্টপ ইট প্লিজ।

– ডোন্ট টেক ইট সিরিয়াস, আই অ্যাম জাস্ট জোকিং, আই থিংক এই মাসে তোর আর আমার কোনো ইন্টারকোর্স হয়নি। সো ডোন্ট বি সিরিয়াস – আমি এখন বমি করে তোদের বসার ঘরটা নোংরা করে দেব, নাথিং মোর। ডোন্ট মাইন্ড ডিয়ার, ডোন্ট বি সো, ডোন্ট বি। বলতে বলতেই ফ্লোরা উগড়ে দেয় তার পাকস্থলীর সমস্ত জারক রস। জানো তো নিনাদ আমার রাশি কী? বৃশ্চিক। আমার বাবা আমার মায়ের পেটে এই বীজ রেখেই পালিয়েছিল জানো? এখন আমিও পালাবো, এই ঘরে রেখেই পালাবো। আমার বাবাকে পেলে বেশ হতো আমার, পুরুষজাতির ওপর পেচ্ছাপ করাটা ওখান থেকেই শুরু করা যেত; ওহ্ সরি, পেচ্ছাপ না বমি, মানে পাকস্থলীর বিচূর্ণ, গলিত খাদ্যপদার্থ, করা যেত না বল – পুরো প্রলাপ শেষ করতে পারে না সে, নেতিয়ে পড়ে সোফার ওপর। 

সকালে কিছু খায়নি, তেতো কালো কফি সবুজ হয়ে লেপ্টে যাচ্ছে নিনাদের বসার ঘরে। নিনাদের আম্মু ছুটে আসেন! ফ্লোরার এই আকস্মিক শরীর খারাপের কারণ খুঁজে পান না তিনি। সন্দেহের চোখে তাকান দুজনের দিকে, নিনাদ কুঁচকে যায়, অপ্রস্তুত মুখে কথা সরে না ওর।

– এই মেয়ে কী হয়েছে তোমার?

– অ্যাসিডিটি আন্টি।

– সকালে কিছু খাওনি।

– না, একটু পাউরুটি আর জেলি দেবে। না থাক, ডিমের অমলেট হলেও চলবে। খেয়ে নিই, ঠিক হয়ে যাবে।

– মন্দিরা, আন্টি হাফ ছেড়ে বাঁচেন, দৌড়ে ছোটেন ওষুধ আনতে। ফ্লোরা নিনাদের হাত জড়িয়ে ধরে।

– নিনাদ অ্যাসিডিটির ওষুধে হবে না আমার, তুই যা আন্টির ফাস্ট এইডের পুরো বাক্সোটা নিয়ে আয় আমার কাছে –

– কী লাগবে বল, বাইরে থেকে এনে দিই। 

– দুটো ইমার্জেন্সি কন্ট্রাসেপটিভ পিল, একটায় যদি কাজ না হয়!

– পুষ্পিতা প্লিজ!

এবার আর নিনাদ ফ্লোরার হাত ছাড়ে না, আরো শক্ত করে আঁকড়ে ধরে মুঠোয়, ফ্লোরার প্রতিরোধ ভাঙে না তাতে একটুও, কান্না পায় না, সে জানে সে কাঁদবে না, সে শক্ত হয় আরো কিছু শক্ত মুহূর্তের অপেক্ষায়। ফ্লোরার মনে হয় মানুষ স্বভাবতই পাপাভিমুখী, তো সেখানে এই ফ্লোরা কোন ছাড়। সে জানে তার জন্ম হয়েছে প্রতিরাতে দুঃস্বপ্ন দেখার জন্য। তার জীবনের দায় তার একার, তার ব্যর্থতা তার একার, তার আবেগ, তার ফ্যান্টাসি, তার ভুল, সব তার একার। এখন এসব কিছু ভাবলে হবে না, এখন শুধু টিকে থাকাটাই জরুরি। আচ্ছা নিনাদকে আগেভাগে মেরে ফেললে কেমন হয়। নিনাদের সঙ্গে তার ফার্স্ট ডেট হয়েছিল কবে? মনে পড়ে না তার! প্রেম হওয়ার আগে কি, না পড়ে? স্বেচ্ছায়, না ভুলে? ভুল! মানুষ তো ভুল করবেই। জেগে থাকা মানুষও করে, ঘুমিয়ে থাকা মানুষও করে, নিনাদ করে, নিনাদের বাবাও করে, এমনকি তার বাবাও। নিনাদ করে ভালোবেসে, আর নিনাদের বাবা? হা হা হা তিনি হয়তো মন্দ বেসেই করেন। 

 দরজায় মৃদু শব্দ হয়ে, ধীরে ধীরে তা আবার শূন্যে মিলিয়ে যায়, ফ্লোরা জানে মন্দিরা নামে মেয়েরা অনেক আধুনিক, তারা অন্যের পারসোনাল ব্যাপারে কখনো নাক গলায় না, অথচ তার এত কুড়ি বছর পর জন্মেও কেউ কেউ ঢুকে যায় তার পার্সোনাল ম্যাটারে। নিনাদ এখন আলতো করে হাত বুলিয়ে যাচ্ছে ফ্লোরার মাথায়। তার ফুলের অসুখ হয়েছে, বড় হওয়ার অসুখ। পরিচর্যায় প্রয়োজন, নিনাদ তো জানে না কীসের ব্যথা তার, তবু চায় ঘা শুকাক, ব্যথা কমুক মেয়েটার। ফ্লোরার চোখে স্বপ্নদৃশ্যের মতো এখনো অনেক মুখ। কিছু মুখ মুখোশের। বাঘ, সিংহ, হরিণ আর মানুষ। অর্ধরাতে জেগে ওঠা যে-বাসি ঘুমটা আজ ভেঙেছিল তার নিনাদের আদরে আবার তা জাঁকিয়ে বসতে চাইছে চোখে। অপরাধবোধে ফ্লোরা গা ঝাড়া দেয়। ঘুম তাড়ায়।

– আঙ্কেল কোথায় নিনাদ?

অফিসের কাজে শিলং গেছে। সপ্তাহখানেকের আগে ফিরবে না মনে হয়। চুপ করে শুয়ে থাক, কথা বলিস না। মা চুলোয় ভাত দিয়েছে, লাঞ্চ করে বের হবো, তোকে নিয়ে ডক্টরের কাছে যাবো, এখন চুপ।

চুপই তো থাকে ফ্লোরা, কারো অনুপস্থিতির সংবাদ তার ভেতরে কতটা তোলপাড় করে তা কি ওপর থেকে বুঝবে কেউ! নিশ্চয়ই না, ফ্লোরা তো ভালো মেয়ে। নিনাদ ওর কপালে ঠোঁট ছোঁয়ায়, ফ্লোরা কুঁচকে যায়। কেমন লাগে। এইসব প্রেম-অপ্রেমের সময়ে তার ভেতরে কী যেন ঘটে যায়। চোখের কোনায় গলে গলে পড়ে আছড়ে ওঠা আবেগজল। আহা শিলং, আস্ত পাহাড়, সমুদ্র নয়। লোকটা যদি সান্তিয়াগোর মতো হতো ফ্লোরা ঠিক তার সঙ্গে সমুদ্রে যেত। দ্য ওল্ড ম্যান অ্যান্ড দ্য সি – হায় লোকটা নিজেই কি একটা সমুদ্র নয়! 

বুড়ো যদি যুদ্ধে যেত, যদি পুড়িয়ে দিত ট্রয়, যদি হতো ফারাও রাজা, তবুও কি বাবা হতে পারত? পূজারির পূজার ফুল পায়ে দলিয়ে আত্মপর হয়ে ওঠে যে সম্রাট, সে যোগী নয় ভোগী। তার আত্মা চায় শুধু নর্তকী, মাই সান অথবা কন্যা সে শুধু অর্থহীন সম্বোধন। ফ্লোরার ঠোঁটে হাসি ফোটে তুচ্ছতার হাসি। ওহে বুড়ো সান্তিয়াগো সাদা সমুদ্রে তুমিও ডুবে গেলে! যুদ্ধশেষে ফিরতে পারোনি তীরে, পালাতে হয় সেই শিলং! ফ্লোরার পিপাসা পায়, পানি অথবা বাবা কোনটার তৃষ্ণা বুঝতে পারে না সে। ফ্লোরা বিড়বিড় করে কোলরিজ –    ‘ওয়াটার ওয়াটার এভরি হয়ার, বাট নট অ্যা ড্রপ টু ড্রিংক!’  সে টের পাচ্ছে তার গর্ভের তলদেশে ফুঁসে উঠছে সমুদ্র! উঠুক, ফ্লোরা শুয়ে থাকবে এখানেই। কতদূর বৃদ্ধ সান্তিয়াগো! কতদূর শিলং!