অনুবাদ : আলম খোরশেদ

সলোমন বলেছেন : পৃথিবীতে নতুন কোনো কিছু নেই। যেমনটি প্লেটো কল্পনা করেছিলেন, সকল জ্ঞানই বস্তুত স্মৃতিমাত্র, তেমনি সলোমনও এই সিদ্ধান্ত দেন যে, নতুন সমস্তকিছুই আসলে বিস্মরণ।

– ফ্রান্সিস বেকন, রচনাবলী, ৪৭

লন্ডনে, ১৯২৯ সালের জুনের গোড়ার দিকে, দুর্লভ গ্রন্থের বিক্রেতা, স্মার্না শহরের জোসেফ কার্তাফিলাস রাজকুমারী দ্য লুস্যাঞ্জকে পোপ-বিরচিত ইলিয়াড-এর ছয় খণ্ডের সংস্করণটি সাধে। রাজকুমারী সেগুলো কিনে নেন; তিনি সেগুলো বুঝে নেওয়ার পর বিক্রেতার সঙ্গে সামান্য বাক্যবিনিময় করেন। তাঁর কথা অনুসারে সে ছিল ছাইরঙা চোখ ও দাড়িঅলা, একেবারেই বৈশিষ্ট্যহীন গড়নের এক শীর্ণকায়, ধূর্ত মানুষ। সে একপ্রকার অপরিশীলিত ও অশুদ্ধ স্বাচ্ছন্দ্যের সঙ্গে বেশ কয়েকটি ভাষায় নিজেকে প্রকাশ করতে পারত; মুহূর্তের মধ্যে ফরাসি থেকে ইংরেজিতে, এবং ইংরেজি থেকে সালোনিকার স্প্যানিশ ও ম্যাকাউয়ের পর্তুগিজের মিশেলে তৈরি এক অদ্ভুত রহস্যময় ভাষায় কথা বলতে পারত। অক্টোবরে জিউস জাহাজের এক যাত্রীর কাছ থেকে রাজকুমারী জানতে পারেন, স্মার্নায় ফেরার পথে কার্তাফিলাস সমুদ্রে ডুবে মারা যায় এবং তাকে আইয়স দ্বীপে সমাহিত করা হয়। ওই ইলিয়াডের শেষ খণ্ডে তিনি এই পাণ্ডুলিপিটি পেয়েছিলেন। সেটি এমন এক ইংরেজিতে লিখিত হয়েছিল যেখানে ছিল লাতিনের ছড়াছড়ি; এটি সেই পাণ্ডুলিপিরই হুবহু পুনর্লিখন।

এক

আমি মনে করতে পারি, আমার সংগ্রাম শুরু হয়েছিল সম্রাট দিওক্লেটিয়ানের সময়কার শত-তোরণ থিবিসের একটি বাগানে। আমি (কোনো গৌরব ছাড়াই) সাম্প্রতিক মিশরীয় যুদ্ধগুলোতে লড়াই করেছিলাম এবং লোহিত সাগরের তীরে বেরেনিসে মোতায়েন করা একটি বাহিনীর অধিকর্তা ছিলাম; সেখানে, জ্বর ও জাদু বহু পুরুষকে গ্রাস করেছিল, যারা আকুলভাবে ধাতব ব্লেড অর্থাৎ তরবারির বাসনা করেছিল। মৌরিতানীয়দের পরাজয় ঘটেছিল; যে-সকল ভূমি একদা বিদ্রোহী নগরীসমূহের অধিকারে ছিল সেগুলোকে অনন্তকালের জন্য প্লুটোনীয় ঈশ্বরদের উৎসর্গ করা হয়েছিল; দমিত আলেক্সান্দ্রিয়া বৃথাই সিজারের করুণা প্রার্থনা করেছিল; এক বছরের মধ্যে তার বাহিনীর বিজয়ের কথা ঘোষণা করার কথা ছিল, কিন্তু আমি যুদ্ধের দেবতা মার্সের দর্শন পেয়েছিলাম সামান্যই। সেই কষ্ট আমাকে শোকার্ত করেছিল, এবং সম্ভবত সেই কারণেই আমি নিজেকে ভবঘুরে জীবনে ও ভয়ংকর মরুভূমির ভেতরে অমরজাতির গোপন নগরের অনুসন্ধানে ন্যস্ত করেছিলাম।

আমার সংগ্রাম, আমি বলেছি, থিবির এক বাগানে শুরু হয়েছিল। সেদিন সারারাত আমি ঘুমাইনি, কেননা আমার হৃদয়ে তখন যুদ্ধ চলছিল। শেষ পর্যন্ত ভোরের সামান্য আগে আমি বিছানা ছেড়ে উঠি। আমার দাসেরা ঘুমাচ্ছিল, চাঁদের রং ছিল সেই অনিঃশেষ বালির মতো। এক রক্তাক্ত অশ্বারোহী পুব দিক  থেকে এগিয়ে আসছিল, ক্লান্তিতে অবসন্ন। আমার কাছ থেকে কয়েক পা দূরে সে ঘোড়া থেকে নেমে মৃদু ও সতৃষ্ণ কণ্ঠে, লাতিনে, জানতে চায় সেই নদীটির নাম, যার জলে আমাদের শহরের সীমানাপ্রাচীর স্নাত হতো। আমি তাকে বলি, তার নাম ইজিপ্ট, বৃষ্টির জল যাকে পুষ্ট রাখে। ‘এটা নয়, আমি অন্য এক নদীর খোঁজ করছি’, সে বিষণ্ন গলায় জবাব দেয়, ‘সেই গোপন নদীর, যা মৃত্যুপথযাত্রী মানুষদের শুদ্ধ করে।’ তার বুক থেকে কালোরঙা রক্ত উথলে পড়ছিল। সে আমাকে বলে, তার জন্ম সেই দেশে যার অবস্থান গঙ্গা থেকে দূরে পার্বত্যভূমিতে; সেই পর্বতে এমন গুজব ছিল, সে আমাকে বলে, যদি কেউ পশ্চিম দিকে পৃথিবীর শেষ পর্যন্ত ভ্রমণ করে, সে সেই নদীর দেখা পাবে যার জল মানুষকে অমরত্ব দেয়। সে আরো যোগ করে, তারই দূরবর্তী তীরে অমরাবতীর ঠিকানা, যেখানে মন্দির, মুক্তমঞ্চ ও সুরক্ষাপ্রাকার রয়েছে। ভোরের আগেই সে মারা যায়, কিন্তু আমি সেই নগর ও নদীর সন্ধানে যাওয়ার প্রতিজ্ঞা করি। নির্যাতনকারীর জিজ্ঞাসার মুখে মৌরিতানিয়ার কোনো কোনো বন্দি সেই ভ্রামণিকের গল্পের সত্যতা সমর্থন করে : তাদের একজন ইলিসিয়ান সমতলের কথা বলে, দূরে, পৃথিবীর শেষপ্রান্তে যেখানে মানুষের জীবন অনন্ত; আরেকজন সেই পর্বতের চূড়ার কথা বলে যেখান থেকে পাক্তলোস নদীর উৎপত্তি, যেখানে মানুষেরা শত শত বছর বাঁচে। রোমে আমি এমন দার্শনিকদের সঙ্গে কথা বলি, যাদের বিশ্বাস, মানুষের জীবনের দৈর্ঘ্যকে টেনে বড় করার অর্থ তার মৃত্যুর যন্ত্রণাকে দীর্ঘায়িত করা, এমনকি তার মৃত্যুকে বহুবার হতে দেওয়া। আমি নিশ্চিত নই আমি কখনো এই অমরাবতীর অস্তিত্বে বিশ্বাস করেছি কি না; আমি মনে করি সেটা খুঁজে বের করাই আমার জন্য যথেষ্ট। গেতুলিয়ান প্র-কন্সাল ফ্লাভিয়াস এই অভিযানের জন্য আমাকে দুশো সৈন্য বরাদ্দ দেন, আমি নিজেও কিছু ভাড়াটে সৈন্যকে নিয়োগ দিই, যারা দাবি করেছিল তারা পথঘাট ভালো চেনে, এবং যারা সবার আগেই আমাকে ছেড়ে চলে গিয়েছিল।

পরবর্তী ঘটনাগুলো আমাদের শুরুর সময়ের স্মৃতিগুলিকে এমন বিকৃত করে দিয়েছে যে, এখন সেগুলোকে সুবিন্যস্ত করা রীতিমতো অসম্ভব। আমি আর্সিনো থেকে যাত্রা শুরু করে উত্তপ্ত  মরুভূমিতে প্রবেশ করি। আমরা ট্রগ্লোডাইটদের দেশ অতিক্রম করি যারা সাপ ভক্ষণ করে এবং যাদের মৌখিক যোগাযোগের কোনো ক্ষমতা নেই; গারামান্তাসদের ভূমিও পেরিয়ে যাই, যাদের নারীরা যৌথসম্পত্তি এবং যাদের খাদ্য সিংহ; পাড়ি দিই অজাইলদের দেশ, যারা কেবল তারতারাস্কে পূজা করে। আমরা অপরাপর মরুভূমিও দৈর্ঘ্যে প্রস্থে চষে ফেলি … কালো বালির মরুভূমি, যেখানে পর্যটকদের রাত্রির প্রহরগুলোকে দখল করে নিতে হয়, যেহেতু দিনের উত্তাপ সেখানে অসহনীয়। দূর থেকে আমি পর্বতটাকে দেখতে পাই যার নামে এই মহাসমুদ্রের নামকরণ হয়েছে; তার ঢালুতে বিষের প্রতিষেধক ইউফোর্বিয়া গজিয়ে থাকে, আর তার চূড়ায় বাস করে সেটাররা; বুনো, বর্বর ও কামসর্বস্ব এক জাতি। সেইসব বর্বর ভূমির কোলে, যেখানে পৃথিবী হচ্ছে দানবদের জননী, সেখানে একটি বিখ্যাত নগরের সংস্থান হতে পারে … সেটা আমাদের সবার কাছেই অচিন্তনীয় মনে হচ্ছিল। তবে আমরা আমাদের চলা অব্যাহত রাখি, যেহেতু পিছিয়ে পড়া মানে আমাদের নিজেদেরই অসম্মানিত করা। কয়েকজন, যারা কিছুটা ভীতু প্রকৃতির, চাঁদের দিকে মুখ করে ঘুমিয়েছিল; দ্রুতই তারা জ্বরে পুড়ে যাচ্ছিল। কুয়োর শয়তানি জল পান করার সঙ্গে অন্যেরা উন্মাদনা ও মৃত্যুকেও পান করছিল। তারপর শুরু হলো পলায়ন; এর অল্প কিছু পরে বিদ্রোহ। তাদের দমনে আমি কঠোরতা অবলম্বনে দ্বিধা করিনি। সেদিক থেকে আমি যথাযথ কাজই করেছি, কিন্তু একজন শতবর্ষী আমাকে সাবধান করে দিয়েছিলেন এই বলে যে, বিদ্রোহীরা (তাদের কোনো এক সদস্যের ক্রুশবিদ্ধ হওয়ার বদলা নিতে) আমাকে হত্যার ষড়যন্ত্র বুনছে। যে অল্প কজন সৈন্য তখনো আমার অনুগত ছিল আমি তাদের নিয়ে শিবির থেকে পালিয়ে যাই মরুভূমিতে, বালু ও বিশাল রাত্রির ঘূর্ণাবর্তে, আমরা বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ি। একটি ক্রিটীয় তির আমার মাংস খুবলে নেয়। বেশ কিছুদিন – অথবা রৌদ্র, তৃষ্ণা ও তৃষ্ণার ভয়ে বহুগুণ বড় হয়ে যাওয়া কোনো এক দীর্ঘ দিবসজুড়ে আমি পানি না পেয়ে ঘুরে বেড়াই। আমার যাত্রাপথের হদিস ঘোড়ার ইচ্ছের ওপর ছেড়ে দিই। ভোরবেলা দূরের দৃশ্যাবলি পিরামিড ও সুউচ্চ স্তম্ভের উপস্থিতিতে ঝকমক করে। আমি স্বপ্ন দেখি, অসহনীয়ভাবে, একটি ক্ষুদ্র ও সুশৃঙ্খল গোলকধাঁধার, যার কেন্দ্রে আছে একটি কুয়ো; আমার হাত সেটি প্রায় স্পর্শ করতে পারে, আমার চোখ দেখতেও পারছে, কিন্তু তার বাঁকগুলো এতটাই প্যাঁচালো ও বিভ্রমভরা ছিল যে, আমি বুঝতে পারছিলাম সেখানে পৌঁছানোর আগেই আমি মারা যাব।

দুই

আমি যখন শেষমেশ সেই দুঃস্বপ্ন থেকে নিজেকে মুক্ত করতে সক্ষম হই তখন দেখতে পাই পেছনে হাতবাঁধা অবস্থায় একটি কবরের সমান তির্যক পাথুরে গর্তে শুয়ে আছি, যা চুনা-পর্বতের ঢাল ঘষে বানানো। গর্তটির পাশগুলো ভেজা, এবং সময় ও মানুষের হাতের মসৃণপ্রায়। আমি আমার বুকে এক যন্ত্রণাদায়ক কাঁপুনি অনুভব করি, এবং তৃষ্ণায় পুড়ে যেতে থাকি। আমি মাথা তুলি এবং দুর্বলভাবে চিৎকার করে উঠি। পর্বতের পাদদেশে একটি নিঃশব্দ, দূষিত ঝরনা বয়ে যাচ্ছিল, বালি ও বর্জ্যে বুজে আসা; দূরবর্তী তীরে সেই অদ্বিতীয় অমরাবতী সূর্যের শেষ (কিংবা প্রথম) রশ্মিতে ঝলমল করে। আমি দুর্গের প্রাকারবেষ্টনী, খিলান, ভবনপ্রচ্ছদ, সভাচত্বর ইত্যাদি দেখতে পাই; এদের সবই একটি পাথুরে মালভূমির উপর দাঁড়িয়ে। আমার কবরটির মতোই আরো শত-শত এলোমেলো পরিখায় পুরো পর্বত ও উপত্যকাভূমি আকীর্ণ হয়ে ছিল। বালিতে অগভীর গর্ত খোঁড়া হয়েছিল; সেইসব বিচ্ছিরি গর্ত থেকে, কবরগুলো থেকে, ধূসর চামড়ার অচর্চিত দাড়িশোভিত নগ্ন পুরুষেরা উঠে দাঁড়াচ্ছিল। আমার মনে হয় আমি তাদের চিনতে পারছিলাম : তারা ট্রগ্লোডাইটদের সেই পশুবংশের সদস্য, যারা পারস্য উপসাগরের তীরভূমি ও ইথিওপিয়ার পার্বত্য কন্দরগুলোতে পতঙ্গের মতো বসবাস করে; তদেরকে কথা বলতে না দেখে কিংবা সাপ গিলে খেতে দেখেও আমি মোটেও বিস্মিত হইনি।

প্রাণঘাতী তৃষ্ণা আমাকে ভীত করে তোলে। আমি অনুমান করি বালি থেকে ত্রিশ কদম দূরে আমার অবস্থান; আমি চোখ বন্ধ করি এবং পর্বত থেকে নিজেকে নিচে ছুড়ে দিই, আমার হাত পেছনে বাঁধা। আমি আমার রক্তাক্ত মুখ নিয়ে কালো পানিতে গিয়ে পড়ি এবং তার মধ্যে পশুর মতো ঝাপটাতে থাকি। আরো একবার ঘুমে ও অজ্ঞানতায় ডুবে যাওয়ার আগে আমি অব্যাখ্যেয়ভাবে কয়েকটি গ্রিক শব্দ আওড়াই : জেলিয়া থেকে আগত, বিত্তশালী ট্রয়বাসী যারা কৃষ্ণ আইসেপসের জল পান করে …

আমি বলতে পারব না আমার ওপর দিয়ে কত দিন কত রাত পার হয়ে গেছে। যন্ত্রণার্ত, গুহার আশ্রয়ে ফিরে যেতে অসমর্থ, অচেনা বালিতে পড়ে থাকা নগ্ন আমি, চাঁদ ও সূর্যকে আমার অন্ধকার ভবিষ্যৎ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে দিই। তাদের বর্বরতায় প্রায় শিশুপ্রতিম, ট্রগ্লোডাইটরা আমাকে বাঁচতে কিংবা মরতে সাহায্য করে না। বৃথাই আমি তাদের কাছে আমাকে মেরে ফেলার জন্য অনুনয় করি। একদিন, একটি পাথরের টুকরোর ধারালো প্রান্ত দিয়ে আমি আমার বাঁধন ছিঁড়ে ফেলি। এরপর আমি উঠে দাঁড়াই এবং চেয়ে নিতে কিংবা চুরি করতে সক্ষম হই – আমি, মার্কাস ফ্লামিনিয়াস রুফাস, রোমের এক সামরিক বাহিনীর কর্মকর্তা – আমার মুখভরা বমনোদ্রেককারী সাপের মাংস।

সেই অমরদের দেখার ব্যগ্রতায়, সেই অতিমানবিক নগরটি দেখার বাসনায়, আমি মোটেও ঘুমুতে পারিনি। ট্রগ্লোডাইটরাও, যেনবা তারা আমার গন্তব্য কোনো দৈবক্ষমতায় বুঝে নিতে পেরে, ঘুমাচ্ছিল না। প্রথমে আমি ভেবেছিলাম তারা বুঝি আমার ওপর নজরদারি করছে, পরে কল্পনা করি আমার এই অস্বস্তি তাদের মধ্যেও সঞ্চারিত হয়েছিল, যেমনটি কুকুরদের ক্ষেত্রে হয়ে থাকে। সেই বর্বর গ্রাম থেকে বেরিয়ে যাওয়ার জন্য আমি সবচেয়ে প্রকাশ্য সময়টাকেই বেছে নিই, সূর্যাস্তের সময়কে, যখন প্রায় সকল মানুষ পৃথিবীর ফাঁকফোকর ও গর্তগুলি থেকে বের হয়ে আসে, এবং  না দেখার চোখে পশ্চিমে চেয়ে থাকে। আমি জোরে প্রার্থনা করতে থাকি, যত না তাদের কাছ থেকে দৈব ক্ষমতা পাওয়ার প্রত্যাশায়, তার চেয়ে বেশি আমার উচ্চারিত শব্দের আওয়াজে তাদের ভীত করে তোলার জন্য। আমি বালির চাঙরে বুজে যাওয়া জলস্রোত পার হয়ে সেই নগরের দিকে পা ফেলি। বিভ্রান্তের মতো দুটো কি তিনটে মানুষ আমাকে অনুসরণ করে, তারা দেখতে ছোটখাটো (তাদের প্রজাতির অপর সদস্যদের মতোই) এবং ভয়ের চাইতে বিকর্ষণের জন্ম দেয় বেশি। আমি বেশক’টি অসমান খোঁড়ল এড়িয়ে চলি, আমি যাদেরকে প্রাচীন খনি ভেবেছিলাম, নগরের বিশাল আকারে বিভ্রান্ত আমি তাকে আরো অনেক নিকটবর্তী ভেবেছিলাম। মাঝরাতের দিকে আমি নগর-প্রাচীরের ছায়ার ওপর পা ফেলি … হলুদ বালির ওপর মূর্তিপূজারীসদৃশ্য কিছু আকারের উপস্থিতিতে উজ্জ্বল … । আমার পদক্ষেপগুলো একধরনের পবিত্র ভীতিতে থেমে গিয়েছিল। মানবজাতির এতো ঘৃণার পাত্র সেই নতুন দৃশ্য আর মরুভূমি যে আমি এক ধরনের উৎসাহ অনুভব করলাম এবং দেখলাম একজন ট্রগ্লোডাইট আমাকে শেষ পর্যন্ত সঙ্গ দিয়েছিল। আমি চোখ বন্ধ করে, না ঘুমিয়ে, ভোরের জন্য অপেক্ষা করি।

আমি বলেছি যে-নগরটি একটি পাথুরে মালভূমির ওপর নির্মিত হয়েছিল। সেই মালভূমি, তার খাড়া কিনারগুলোর কারণে, কোনো দেয়ালের মতো আরোহণ করা কঠিন ছিল। বৃথাই তার চারপাশে হেঁটে বেড়ায় আমার ক্লান্ত পদযুগল, কালো ভিত্তিটুকু এক চিলতে অমসৃণতাও প্রকাশ করে না, এবং দেয়ালগুলোর বৈচিত্র্যহীনতা একটি দরজার সম্ভাবনাকেও রহিত করে। দিনের রৌদ্রের শক্তি আমাকে গুহার ভেতরে আশ্রয় নিতে বাধ্য করে; যার পেছনের দিকে একটি গর্ত ছিল, এবং সেই গর্ত থেকে, তার নিচের অন্ধকার থেকে, একটি মই উঠে গিয়েছিল। আমি মই বেয়ে নিচে নেমে যাই, এবং একগাদা গুমোট ঘরের জটলা পেরিয়ে একটি বিশাল বৈশিষ্ট্যহীন বৃত্তাকার প্রকোষ্ঠে প্রবেশ করি। নয়টি দরজা সেই পাতাল প্রকোষ্ঠের মতো ঘরের ভেতর খুলে গিয়েছিল, যার আটটি এমন এক গোলকধাঁধায় নিয়ে যায়, যা লোক ঠকানোর মতো করে সেই একই ঘরেই ফিরিয়ে নিয়ে যায়। আর নবমটি আরেক গোলকধাঁধার ভেতর দিয়ে প্রথম প্রকোষ্ঠের মতো দেখতে আরেকটি গোলাকার ঘরে গিয়ে মিলেছিল। আমি ঠিক নিশ্চিত নই কয়টি প্রকোষ্ঠ ছিল সেখানে, আমার কষ্ট ও উদ্বেগ সেই সংখ্যাটাকে বাড়িয়ে তুলেছিল। নীরবতাটা ছিল শত্রুর মতো, এবং কার্যত নিখুঁত, ফল্গুধারার মতো এক বায়ুস্রোত ছাড়া, যার উৎসটা আমি ঠিক বার করতে পারিনি, সেই পাথুরে গভীর জালিকাজুড়ে আর কোনো শব্দ ছিল না, এমন কি লোহাবর্ণ জলের যে সরু রেখাগুলো গর্তগুলোর ফাঁক দিয়ে বয়ে যাচ্ছিল, সেগুলোও ছিল নিঃশব্দ। ভয়ার্তভাবে আমি সেই সন্দেহজনক পৃথিবীতে অভ্যস্ত হয়ে উঠি, আমার কাছে এটা অবিশ^াস্য মনে হতে থাকে যে, সেই নয়টি দরজাবিশিষ্ট পাতাল প্রকোষ্ঠ আর মাটির নিচেকার দীর্ঘ, আঁকাবাঁকা অলিন্দ ছাড়া আর কোনোকিছুর অস্তিত্ব থাকতে পারে। আমি জানি না কতক্ষণ আমি সেই মাটির তলায় অবস্থান করেছিলাম, আমি এটুকু জানি যে, মাঝে মাঝে, বাড়ির জন্য এক বিভ্রান্ত বাসনার মধ্যে আমি বর্বরদের সেই ভয়ংকর গ্রাম ও গুচ্ছ গুচ্ছ আঙুরের মাঝখানে অবস্থিত আমার জন্মশহরকে গুলিয়ে ফেলেছিলাম।

বারান্দার শেষে, ততটা অপ্রত্যাশিত নয় এমন এক দেয়াল আমার পথ রোধ করে … এবং এক দূরবর্তী আলো আমার ওপর এসে পড়ে। আমি আমার ঘোরলাগা চোখ তুলে ওপরে তাকাই, খাড়া অনেক ওপরে, এবং আমি একটি বৃত্তাকার আকাশ দেখি, এতটাই নীল যে তাকে বেগুনির মতো দেখায়। একটি সিঁড়ির কিছু ধাতব পাদানি দেয়াল ধরে ওপরে উঠে যায়। ক্লান্তিতে আমার পেশি শিথিল হয়ে আসে, আমি তবু সিঁড়ি বেয়ে ওপরে উঠি, শুধু মাঝেমধ্যে একটু বিরতি নিই, অগোছালোভাবে আনন্দের কান্নাটুকু কাঁদবার জন্য। ধীরে ধীরে আমি ত্রিকোণ খিলান, গম্বুজাকৃতি প্রলম্বিত ছাদ, স্তম্ভের ওপরের অংশ ও অলংকৃত দেয়াল দেখতে পাই, গ্রানিট আর মার্বেলে খোদাই করা বিভ্রান্ত গৌরব। আর এভাবেই আমাকে পরস্পরযুক্ত গোলকধাঁধা ও অন্ধকারের কালো জগৎ থেকে একটি উজ্জ্বল নগরের দিকে তুলে দেওয়া হয়।

আমি একটা  ছোটখাটো চত্বরে গিয়ে নিষ্ক্রান্ত হই … উঠোন শব্দটা বরং এর একটা ভালো বর্ণনা। এটা একটা অসমান এবং অনুচ্চ দালান দ্বারা পরিবেষ্টিত ছিল। এই অসম দালানটির ছিল অনেকগুলো ক্ষুদ্রাকৃতি গম্বুজ ও স্তম্ভ, সেই অবিশ্বাস্য দালানটির অন্য যে-কোনো বৈশিষ্ট্যের চেয়ে, আমি তার নির্মিতির প্রাচীনত্ব দ্বারা বেশি আবিষ্ট ছিলাম। আমার মনে হয়েছিল, এটি বোধহয় মানবসভ্যতার আগে থেকেই ছিল, খোদ পৃথিবীরও আগে থেকে। এর নিজস্ব প্রাচীনতা (যদিও চোখের জন্য তা কিঞ্চিৎ ভীতিকর) তার অমর নির্মাতাদের শ্রমের সঙ্গে সংগতিপূর্ণ ছিল। প্রথমে সতর্কভাবে, সময়ের সঙ্গে সঙ্গে কিছুটা উদাসীনতায়, এবং শেষের দিকে মরিয়াভাবে আমি সেই গোলকধাঁধাময় প্রাসাদের সিঁড়ি ও কারুকার্যখচিত মেঝেতে ঘুরতে থাকি। (আমি পরে আবিষ্কার করি যে, সিঁড়ির ধাপগুলোর উচ্চতা ও প্রস্থ এক ছিল না; এটাই আমার সেই অস্বাভাবিক ক্লান্তির কারণ বলে মনে হয়।) এই প্রাসাদটি দেবতাদের কাজ, এটি ছিল আমার প্রথম চিন্তা। আমি লোকমানবহীন পরিসরটি ঘুরে দেখি, এবং আমি নিজেকে সংশোধন করি : যে-দেবতারা এই প্রাসাদটি বানিয়েছেন তাঁরা মৃত। এরপর আমি তার উদ্ভটত্ব নিয়ে ভাবি এবং নিজেকে বলি : যে-দেবতারা এই প্রাসাদটি বানিয়েছেন তাঁরা উন্মাদ। আমি জানি, আমি এ-কথাটা বলি একধরনের দুর্বোধ্য তিরস্কারের স্বরে, যা ছিল পরিতাপের প্রায় কাছাকাছি … ইন্দ্রিয়জ ভীতির চেয়েও বৌদ্ধিক ত্রাসসহকারে।

প্রাচীনতার অনুভূতির সঙ্গে আরো কিছু অনুভব যুক্ত হয় : অনিশ্বেষতার বোধ, পীড়ন ও সন্ত্রাসের অনুভব, জটিল অযৌক্তিকতার অনুভূতি। আমি একটি অন্ধকার গোলকধাঁধার ভেতর দিয়ে এগিয়েছি, কিন্তু আমাকে যা ভয়ার্ত ও বিকর্ষিত করে সেটা সেই উজ্জ্বল অমরাবতী। গোলকধাঁধা হচ্ছে মানুষকে বিভ্রান্ত করার জন্য সচেতনভাবে তৈরি করা একটি ঘর; এর স্থাপত্য, সুষমতার পরাকাষ্ঠা সেই উদ্দেশ্য সাধন করে। আমি যে প্রাসাদটি অসম্পূর্ণভাবে আবিষ্কার করি সেখানে স্থাপত্যের কোনো উদ্দেশ্য ছিল না। তাতে কিছু বারান্দা ছিল যা কোথাও পৌঁছায় না, নাগাল পাওয়া যায় না এমন উঁচু জানালা, বিশাল নাটকীয় দরজা যা খুলে যেত সন্ন্যাসকুঠুরি অথবা শূন্য গহ্বরে, অবিশ্বাস্য হেঁটমুণ্ড সিঁড়ির হেঁটমুণ্ড ধাপ ও হাতল। অন্য সিঁড়িগুলি বিশালাকার এক দেয়ালের পাশে বায়বীয়ভাবে লেগে থাকা, দুই-তিনটা বিরতিভূমির পরেই ধীরে ধীরে ফুরিয়ে এসেছিল গম্বুজের সুউচ্চ অন্ধকারে, কোথাও না পৌঁছেই। আমি জানি না সেগুলো আমার দেওয়া আক্ষরিক দৃষ্টান্ত কি না; তবে আমি জানি তারা দীর্ঘদিন আমার সমস্যাসংকুল স্বপ্নদের মধ্যে অধিবাস করেছিল, আমি আর জানতে পারব না এর কোনো একটা বৈশিষ্ট্য বাস্তবের  সঠিক অনুবাদ কি না অথবা তারা আমার স্বপ্ন থেকে ছাড়া পাওয়া কোনো আকৃতি মাত্র। আমি তার বর্ণনা দিতে চাই না, অসমসত্ত্ব শব্দের নৈরাজ্য বাঘ কিংবা ষাঁড়ের শরীর, দাঁত, অঙ্গপ্রত্যঙ্গাদি একসঙ্গে আটকানো মাথায় উদ্ভাসিত অথচ পরস্পরকে ঘৃণারত … এটাই সম্ভবত এর নিকটবর্তী প্রতিরূপ হতে পারে।

আমি সেই পর্বগুলোর কথা মনে করতে পারি না যেগুলোর ভেতর দিয়ে আমি ফিরে এসেছি, এমনকি সেই ধূলিধূসরিত, স্যাঁতসেঁতে সমাধিসমূহের ভেতর দিয়ে চলা পথের কথাও নয়। আমি কেবল জানি যে, আমার সঙ্গী ছিল এক সার্বক্ষণিক ভীতি, যে, আমি যখন শেষ গোলকধাঁধা থেকে নিষ্ক্রান্ত হবো তখন আবারো এই বমনোদ্রেককারী অমরাবতী দ্বারা পরিবেষ্টিত হয়ে পড়ব। এছাড়া আমি আর কিছু মনে করতে পারি না। এই স্মৃতির অবসান, এখন প্রায় অনতিক্রম্য, হয়তোবা ইচ্ছাকৃতই ছিল, এটা সম্ভবপর যে আমার পলায়নের পরিস্থিতি এতটাই অস্বস্তিকর ছিল যে, কোনো কোনো দিন স্মৃতির কাছে পরাজিত না হয়েও আমি সেসব আমার মন থেকে বহিষ্কার করে দিতে চাইতাম।

তিন

যাঁরা আমার এই কষ্টকর অভিজ্ঞতার গল্প মন দিয়ে পড়েছেন তাঁরা মনে করতে পারবেন, ট্রগ্লোডাইট জাতির এক লোক আমাকে অনুসরণ করেছিল, একটি কুকুর যেভাবে করতো, দেয়ালের আঁকাবাঁকা ছায়ার শেষ পর্যন্ত। আমি শেষ প্রকোষ্ঠ থেকে নিষ্ক্রান্ত হলে তাকে গুহার মুখে দেখতে পাই। সে বালিতে শুয়ে ছিল, এলোমেলোভাবে কিছু প্রতীক এঁকে মুছে দিচ্ছিল, যে প্রতীকগুলোকে সাধারণত স্বপ্নে দেখা যায়, যা ঠিক বুঝে ওঠার মুহূর্তেই মুছে যায় কিংবা ঝাপসা হয়ে অদৃশ্য হয়ে যায়। প্রথমে আমি ভেবেছিলাম সেগুলো বুঝি কোনো বর্বরদের লেখালেখি; তারপর আমি উপলব্ধি করি, এটা অবাস্তব, যে কি-না কথাই বলতে শেখেনি সে কীভাবে লেখা আবিস্কার করবে। এমনকি একটি প্রতীকের সঙ্গে আর একটি প্রতীকের কোনো মিলও ছিল না যা এই সম্ভাবনাকে নাকচ করে (অন্ততপক্ষে অসম্ভব করে তোলে) যে, তারা আদৌ কোনো প্রতীক। লোকটা কিছু একটা আঁকতো, তারপর তার দিকে তাকাতো এবং সংশোধন করতো। তারপর হঠাৎ, যেনবা তার এই খেলা তাকে বিরক্ত করছে এই বোধে, সে সেসব তার হাত এবং হাতের তালু দিয়ে মুছে দিত। সে আমার দিকে তাকায়, যদিও মনে হয় না সে আমাকে চিনতে পেরেছে। তবু এই যে পরিত্রাণের অনুভূতি (অথবা আমার নিঃসঙ্গতা এতটাই বিশাল ও ভয়াবহ ছিল যে) আমি বোধ করি, তাতে মনে হয় এই আদিম ট্রগ্লোডাইট গুহার মেঝে থেকে যে আমার দিকে চেয়ে আছে, সে বুঝি আমার জন্য অপেক্ষাই করছিল। সূর্য সমতলভূমিকে উষ্ণ করে তুলছিল, আমরা গ্রামে ফিরতে শুরু করি, সন্ধ্যার প্রথম তারাদের নিচ দিয়ে, বালি আমাদের পদতল পুড়িয়ে দিচ্ছিল। ট্রগ্লোডাইটটি আমার আগে আগে হাঁটছিল, সে-রাতে আমি সিদ্ধান্ত নিই তাকে কয়েকটা শব্দ এবং সেগুলোকে পুনরাবৃত্তি করতে শেখাব। কুকুর ও ঘোড়ারা, আমি ভাবি, প্রথমটা করতে সক্ষম; কিছু কিছু পাখি, যেমন সিজারের ময়না, দ্বিতীয়টাও পারত।

মানুষের যুক্তি যত সামান্যই হোক সেটা অযৌক্তিক পশুদের চেয়ে অবশ্যই বেশি হতে বাধ্য।

ট্রগ্লোডাইটের নিচুজন্ম এবং জীবনযাপন আমার স্মৃতিতে র্আগোসের ছবিকে জাগিয়ে তোলে, ওডিসির সেই মৃত্যুমুখী বৃদ্ধ কুকুরটির ছবি, ফলে আমি তাকে র্আগোস নাম দিই এবং তাকে কিছু শেখাতে চেষ্টা করি। বারবার চেষ্টা করেও আমি ব্যর্থ হই। আমি যত চেষ্টাই করি না কেন, যত পদ্ধতি, যত গোঁয়ার্তুমি ও যত কঠোরতা – কোনোটাই কাজ দেয় না। গতিহীন, তার চোখ মৃতপ্রায়, আমি যে-শব্দগুলোকে তার চেতনায় গেঁথে দিতে চাইছিলাম সেগুলো সে আদৌ অনুভব করতে পারছিল না। আমার কাছ থেকে মাত্র কয়েক গজ দূরে, কিন্তু তাকে মনে হচ্ছিল অনেক দূরবর্তী। বালিতে শুয়ে থাকা, লাভা থেকে তৈরি ক্ষুদ্র কিন্তু আহত স্ফিংকসের মতো, সে তার মাথার ওপর স্বর্গকে আবর্তন করতে দেয় সকালের প্রথম ঘোলাটে আলো থেকে রাতের শেষ ঘোলাটে আলো পর্যন্ত। এটা আমার কাছে স্রেফ অসম্ভব বলে মনে হয় যে, সে আমার উদ্দেশ্যটা বুঝতে পারছিল না। আমার মনে পড়ে, ইথিওপিয়ানরা সাধারণভাবে বিশ্বাস করে বানরেরা ইচ্ছা করেই কথা বলে না, যেন তাদেরকে কাজ করতে বাধ্য করা না যায়; আমি র্আগোসের এই নীরবতাকেও ভীতি কিংবা অবিশ্বাসপ্রসূত বলে ধারণা করি। সেই জীবন্ত ছবি থেকে আমি আরো অনেক দৃশ্য কল্পনা করি, এর চেয়েও অনেক বেশি জমকালো। আমি ভাবি যে, আমি ও র্আগোস দুই ভিন্ন বিশ্বে বসবাস করি; আমি এও ভাবি আমাদের ধারণাগুলো একই, কিন্তু সেগুলোকে র্আগোস আমার চাইতে ভিন্নভাবে জড়ো করে, সেগুলো থেকে সে ভিন্ন বস্তুদের তৈরি করে; আমি ভাবি যে, হয়তো তার কাছে বস্তু বলে কোনো জিনিসই নেই, আছে শুধু নিরন্তর মাথা-ঘোরানো গতিময় ধারণাসমূহের খেলা। আমি সময় ও স্মৃতিরহিত এক পৃথিবীর কল্পনা করি; আমি একটি ভাষার সম্ভাবনা নিয়ে খেলা করি যার কোনো বিশেষ্য নেই, যাতে আছে শুধু নৈর্ব্যক্তিক ক্রিয়াপদ এবং অপ্রত্যাখ্যানযোগ্য বিশেষণসমূহ। এইসব ভাবনায় বহুদিন চলে যায়, এবং বহুদিনের সঙ্গে যায় বহু বছর। তারপর এক সকালে অনেকটা আনন্দের অনুভূতির মতো কিছু একটা ঘটে … আকাশ থেকে ধীর কিন্তু শক্তিশালী বৃষ্টির ধারা নামে।

মরুভূমিতে রাতগুলো খুব শীতল হতে পারে, কিন্তু সে-রাতটি ছিল পাত্রের মতো উত্তপ্ত। আমি স্বপ্ন দেখি, থেসালির একটি নদী (যে-নদীতে আমি একটি সোনালি মাছ ধরে আবার ছেড়ে দিয়েছিলাম) আমাকে বাঁচাতে আসছে; লাল বালি ও কালো শিলার ওপর দিয়ে তার অগ্রসর হওয়ার শব্দ আমি শুনতে পাচ্ছিলাম; বাতাসে শীতল অনুভূতি ও বৃষ্টির ছুটে চলার শব্দ আমাকে জাগিয়ে দেয়। আমি নগ্ন শরীরে তাকে আবাহন জানানোর জন্য ছুটে যাই। রাত শেষ হয়ে আসছিল; হলুদ মেঘেদের নিচে, সেই গোষ্ঠী, আমারই মতো আনন্দিত, জীবন্ত বৃষ্টির ধারার কাছে নিজেদের সমর্পণ করছিল একধরনের উল্লাস থেকে … তারা আমাকে দেবতায় পাওয়া করিবান্তেস নর্তকদের কথা মনে করিয়ে দেয়। র্আগোস, তার চোখ আকাশের ওপর নিবদ্ধ, গোঁ গোঁ শব্দ করছিল, জলের ধারা গড়িয়ে পড়ছিল তার মুখ বেয়ে … শুধু বৃষ্টি নয়, (আমি পরে জেনেছিলাম) কান্নার জলও। আমি চিৎকার করে বলি, র্আগোস, আর্গোস!

তারপর মৃদু বিস্ময়ে, যেন বা বহুদিন ধরে হারিয়ে যাওয়া বিস্মৃত কিছুকে আবিষ্কার করার আনন্দে আর্গোস তোতলানোর মতো করে বলে : র্আগোস, ইউলিসিসের কুকুর। এবং তারপর আমার দিকে না তাকিয়ে আরো বলে, কুকুরটি বিষ্ঠার স্তূপে শুয়ে আছে।

আমরা বাস্তবতাকে এত দ্রুত গ্রহণ করে ফেলি … সম্ভবত এ-কারণে যে আমরা বুঝতে পারি, বাস্তব বলে কিছুই নেই। আমি র্আগোসকে জিজ্ঞাসা করি সে ওডিসির কতটুকু জানে। গ্রিক বুঝতে তার কষ্ট হচ্ছিল, আমি তাই প্রশ্নটির পুনরাবৃত্তি করি।

খুব কম, সে উত্তর দেয়। দুর্বলতম আবৃত্তিকারটির চেয়েও কম। আমি এটা লেখা শেষ করার পর এগারোশো বছর কেটে গেছে।

চার

সেইদিন আমার কাছে সব উদ্ঘাটিত হলো। ট্রগ্লোডাইটরাই আসলে সেই অমর মানুষেরা; বালিভরা জলের ধারাটিই, অশ্বারোহী কর্তৃক খুঁজে ফেরা সেই নদীটি। আর সেই নগর যার সুখ্যাতি ছড়িয়ে পড়েছিল গঙ্গা অবধি, নয়শো বছর আগে এই অমরজাতি তা ধূলিস্যাৎ করে দিয়েছিল। নগরের বিক্ষিপ্ত ধ্বংসাবশেষ থেকে একই জায়গায় তারা সেই অসমঞ্জস শহরটি গড়ে তুলেছিল আমি যার ভেতর দিয়ে হেঁটে বেড়িয়েছি, যা নগরের সাক্ষাৎ বিপরীত প্যারোডি, যে-শহর ছিল সেইসব যুক্তিহীন দেবতার মন্দির যারা পৃথিবী শাসন করতো এবং যাদের সম্পর্কে আমরা কিছুই জানি না শুধু এইটুকু ছাড়া যে, তারা মানুষের মতো দেখতে নয়। এই নগরের প্রতিষ্ঠা ছিল শেষতম প্রতীক যে পর্যন্ত অমরেরা নেমেছিল, যখন তারা সমস্ত পরিশ্রমকে বৃথা মনে করে চিন্তায় ও বিশুদ্ধ কল্পনায় বাঁচার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল। তারা সেই আত্মরক্ষামূলক আশ্রয়ঘরটি নির্মাণ করেছিল, তারপর তা পরিত্যাগ করে তারা গুহায় বাস করতে চলে গিয়েছিল। তাদের আত্মমগ্নতায় তারা বাস্তব পৃথিবীর কথা খুব কমই ভেবেছিল।

এই বিষয়গুলো হোমার আমার কাছে ব্যাখ্যা করেছিলেন যেভাবে শিশুর কাছে তা ব্যাখ্যা করা হয়। তিনি আমাকে তাঁর বৃদ্ধ বয়স এবং তাঁর সেই সর্বশেষ যাত্রার কথা বলেছিলেন … ইউলিসিসের মতো সেই জাতিগোষ্ঠীর কাছে পৌঁছানোর তাড়নায়, যারা সমুদ্র কাকে বলে জানে না, যারা লবণাক্ত মাংস খায় না, তারা জানে না একটি আকরিক আসলে কী। তিনি এক শতাব্দী সেই অমরাবতীতে বাস করেছিলেন, এবং যখন তা ধ্বংস করে দেওয়া হয়েছিল তখন তিনিই এই অন্য নগরীটি নির্মাণের পরামর্শ দিয়েছিলেন। আমাদের এতে বিস্মিত হওয়া উচিত নয়, গুজব আছে যে ইলিয়নের যুদ্ধগীতি গাওয়ার পর তিনি ব্যাঙ ও ইঁদুরের মধ্যেকার যুদ্ধের গানও গেয়েছিলেন। তিনি এমন এক দেবতার মতো ছিলেন যিনি মহাজগৎ তৈরি করার পর তার নৈরাজ্যটুকুও সৃষ্টি করেছিলেন।

অমর হওয়াতে তেমন অসাধারণ কিছু নেই; মানবজাতি ছাড়া, আর সব সৃষ্টিই তো অমর, কেননা তারা মৃত্যু কাকে বলে তার কিছুই জানে না। যেটা স্বর্গীয়, সাংঘাতিক ও দুর্বোধ্য সেটা হচ্ছে নিজেকে অমর হিসেবে জানা। আমি লক্ষ করেছি যে, ধর্ম থাকা সত্ত্বেও নিজের অমরতা বিষয়ে বিশ্বাস খুবই দুর্লভ। ইহুদি, খ্রিষ্টান ও মুসলিম সবাই অমরত্বের বিশ্বাস প্রচার করে, তবে জীবনের প্রথম শতাব্দীটির প্রতি শ্রদ্ধাবোধ এটাই প্রমাণ করে যে, তারা সেই একশ বছরকেই বিশ্বাস করে বেশি, বাকি বছরগুলোকে, শাশ্বতকাল ধরে জীবৎকালের কাজের শাস্তি কিংবা পুরস্কার হিসেবে দেখে। আমার মতে, হিন্দুস্তানের কয়েকটি ধর্মের চর্চিত চক্র প্রতীকটি বরং যৌক্তিক, সেই চাকা যার কোনো শুরু কিংবা শেষ নেই, প্রতিটি জীবনই তার আগের জীবনের ফল এবং ভবিষ্যৎ জীবনের নিয়ামক, তবু কোনো একটি জীবন পুরোটিকে নির্ধারণ করে না …। অনেক শতাব্দীর জীবনযাপনের শিক্ষায়, অমর মানুষের প্রজাতন্ত্র এমন এক সহিষ্ণুতা অর্জন করে যা প্রায় অবজ্ঞাতুল্য। তারা জানতো যে, দীর্ঘ সময়ের এক জীবনে, সব মানুষের জীবনেই সবকিছু ঘটে। তার অতীতের ও বর্তমানের গুণাবলির পুরস্কার স্বরূপ, প্রতিটি মানুষের প্রতিটি দয়াই প্রাপ্য হয়, আবার তার অতীতের ও ভবিষ্যতের প্রতিটি অসততার পুরস্কার স্বরূপ প্রতারণাও জোটে। ভাগ্যের খেলায় যেমন, মাথা ও লেজ প্রায় সমানভাবেই পড়ে, সেভাবেই চতুরতা ও নিষ্প্রাণতা একে অপরকে বাতিল ও সংশোধন করে। এল সিদের অভব্য কবিতাটিই সম্ভবত হেরাক্লিটাসের কোনো প্রবাদ কিংবা এক্লগসমূহের একটি স্তবকের দাবি করা প্রতিসাম্য। সবচেয়ে অস্থায়ী চিন্তাদেরও একটি অদৃশ্য পরিকল্পনা থাকে, যা একটি গোপন নকশার উদ্বোধন অথবা তাকে মুকুট-শোভিত করে। আমি এমন মানুষদের জানি যারা শয়তানি করেছে যেন ভবিষ্যৎ শতাব্দীতে ভালো কিছু ঘটে তা থেকে, বা হয়তোবা তা অতীতের শতাব্দীতে ঘটে গেছে ইতোমধ্যে …। এভাবে দেখলে আমাদের প্রতিটি কাজই ন্যায্য, যদিও গুরুত্বহীনও বটে। সেখানে কোনো আত্মিক কিংবা বৌদ্ধিক মূল্য নেই। হোমার ওডিসি রচনা করেছিলেন; অনন্ত সময়, অসংখ্য ঘটনা ও প্রচুর পরিবর্তনের সাপেক্ষে, এটা অসম্ভব যে ওডিসির কমপক্ষে একবারই রচিত হওয়া উচিত হয়নি। কেউই কেউ নয়, একজন একক অমর মানুষ সকল মানুষ। কর্নেলিয়াস আগ্রিপ্পার মতো আমিই ঈশ্বর, নায়ক, দার্শনিক, দৈত্য, এবং পৃথিবী … যা মূলত এই কথা বলারই একটি দীর্ঘ সর্পিল পথ যে, আমি নই।

পৃথিবীকে একটি নিখুঁত প্রতিদানের ব্যবস্থা হিসেবে দেখার ধারণাটুকু অমরদের ওপর প্রচণ্ড প্রভাব ফেলেছিল। প্রথমত এটি তাদের করুণা বিষয়ে প্রতিরোধী করে তুলেছিল। আমি উল্লেখ করেছি, সেই প্রাচীন পাথরখনির কথা যেগুলি জলধারার দূরবর্তী তীরগুলোতে ভিড় করেছিল; একটি মানুষ সেরকমই একটি গভীর গর্তে পড়ে গিয়েছিল; তার আহত হওয়ার, মরে যাওয়ার উপায় ছিল না; তবু সে তৃষ্ণায় পুড়ে যাচ্ছিল, সত্তর বছর লেগেছিল তার দিকে একটি দড়ি ছুড়ে দিতে। সে তার নিজের ভাগ্য বিষয়েও খুব একটা আগ্রহী ছিল না। তার শরীর ছিল একটি সমর্পিত গৃহপালিত পশু, সারা মাসে তার যেটুকু দাক্ষিণ্যের প্রয়োজন হতো তা কেবল কয়েক ঘণ্টার ঘুম, সামান্য পানি এবং এক টুকরো মাংস। কিন্তু কেউ যেন না ভাবে যে আমরা সাধু-সন্ন্যাসীদের মতো ছিলাম। চিন্তার মতো জটিল সুখানুভূতি আর কিছু নেই, এবং আমরা সেই চিন্তার কাছে নিজেদের সমর্পণ করে দিয়েছিলাম। মাঝেমধ্যে কিছু অসাধারণ প্রণোদনা আমাদের মর্ত্যের পৃথিবীতে ফিরিয়ে আনত … যেমন ধরুন সেদিন সকালের সেই প্রাচীন মৌলিক বৃষ্টির আনন্দ। তবে সেই শৈথিল্যগুলো ছিল খুবই দুর্লভ; সকল অমরই ছিল নিখুঁত নৈঃশব্দ্যে সক্ষম। আমি একজনের কথা মনে করতে পারি যাকে কোনোদিন আমি দাঁড়ানো অবস্থায় দেখিনি … তার বুকে একটি পাখি বাসা বেঁধেছিল।

এমন কোনো জিনিস নেই যা অপর একটি বস্তু কর্তৃক তার ভারসাম্য রক্ষা করছে না, এই মতবাদের অনুসিদ্ধান্তসমূহের মধ্যে একটি আছে যার তাত্ত্বিক গুরুত্ব তেমন না হলেও, যা আমাদেরকে দশম শতাব্দীর শুরু কিংবা শেষের দিকে পৃথিবীর বুকে ছড়িয়ে পড়তে বাধ্য করে। এটির সারমর্ম এই শব্দগুলো দ্বারা প্রকাশ করা যেতে পারে: একটি নদী রয়েছে যার জল অমরত্ব প্রদান করে; অন্যত্র কোথাও নিশ্চয়ই এমন একটি নদী রয়েছে যা অমরত্বকে কেড়ে নেয়। নদীদের সংখ্যা অসীম নয়; একজন অমর পর্যটক পৃথিবী ভ্রমণরত অবস্থায় একদিন না একদিন সেই সবগুলো থেকেই জলপান করে। আমরা সেই নদীটি খুঁজে বের করার প্রতিজ্ঞা করি।

মৃত্যু (অথবা মৃত্যুর উল্লেখ) মানুষকে মূল্যবান ও শোচনীয় করে তোলে; তাদের ভৌতিকতা আমাদেরকে স্পর্শ করে; যে-কাজই তারা করে সেটি তার সর্বশেষ কাজ হতে পারে; এমন কোনো মুখ নেই যা স্বপ্নের মুখগুলোর মতো মুহূর্তের মধ্যে মিলিয়ে কিংবা মুছে যেতে সক্ষম নয়। মরণশীলদের পৃথিবীতে প্রত্যেকটি জিনিসই পুনরুদ্ধার-অযোগ্য ও নৈমিত্তিকতার গুণসম্পন্ন।

অন্যদিকে, অমরদের মধ্যে প্রতিটি কাজ (প্রতিটি চিন্তা) অতীতে ঘটে যাওয়া জিনিসগুলোর প্রতিধ্বনি, কোনো দৃশ্যমান আরম্ভ ছাড়া, এবং ভবিষ্যতেও যা অসীমকাল ধরে ঘটতে থাকবে তারই নিশ্চিত পূর্বাভাস। এমন কিছুই নেই যা অক্লান্ত আয়নাসমূহের মধ্যে হারিয়ে যায়নি। একবারের বেশি ঘটতে পারে না কিছুই, মূল্যবান কোনোকিছুই হারিয়ে যাওয়ার ভয় থেকে মুক্ত নয়। প্রশস্তিবাচক, ভাবগম্ভীর, আনুষ্ঠানিকতার মতো ধারণাগুলোকে অমরেরা শ্রদ্ধার চোখে দেখে না। তাঞ্জিয়ারের তোরণগুলো থেকে আমি ও হোমার আলাদা পথে যাত্রা করি; আমার মনে হয় না আমরা পরস্পরকে বিদায় বলেছিলাম।

পাঁচ

আমি নতুন নতুন অঞ্চল ও রাজ্যে ঘুরে বেড়াচ্ছিলাম। ১০৬৬ সালের শরৎকালে আমি স্ট্যামফোর্ড ব্রিজে যুদ্ধ করি, যদিও আমার মনে নেই আমি হ্যারল্ডের সৈন্যদের মধ্যে ছিলাম কি না, দ্রুতই যার সাক্ষাৎ হয়েছিল নিয়তির সঙ্গে; না কি সেই দুর্ভাগা হ্যারাল্ড হার্ড্রাডার দলে, যে কি না ছয় ফুট অথবা সামান্য বেশি ইংরেজদের জমি দখল করতে পেরেছিল। হিজরি সপ্তম শতাব্দীতে, বুলাকের নগরপ্রান্তে, খুব সুচিন্তিত লিপিতে আমি সিন্দবাদের সাত সফর ও ব্রাস নগরের গল্প লিখেছিলাম এমন এক ভাষায় যা আমি ভুলে গিয়েছি, এমন এক বর্ণমালায় যা আমি জানি না। সমরকন্দের এক কারাগারের উঠোনে আমি প্রায়ই দাবা খেলতাম। বিকানিরে আমি হস্তরেখাবিদ্যা শিখিয়েছিলাম, যেমনটি করেছিলাম বোহেমিয়াতেও। ১৬৩৮ সালে আমি কল্জ্ভারে ছিলাম এবং পরে লাইপজিগে। অ্যাবারডিনে, ১৭১৪ সালে, আমি পোপের ছয় খণ্ডের ইলিয়াড-এর গ্রাহক হই; আমি জানি আমি প্রায়শই সেগুলো আনন্দের সঙ্গে পাঠ করতাম। ১৭২৯ কি তেমন সময়ে আমি সেই কবিতার উৎস নিয়ে আলাপ করেছিলাম অলংকারশাস্ত্রের এক অধ্যাপকের সঙ্গে, যার নাম আমার মনে হয় গিয়ামবাতিস্তা, যার যুক্তিগুলো আমার কাছে অখণ্ডনীয় মনে হয়েছিল। ১৯২১ সালের ৪ঠা অক্টোবর, পাটনা জাহাজটি যা আমাকে বোম্বাই নিয়ে যাচ্ছিল, ইরিত্রিয়ার উপকূলের এক বন্দরে আটকে যায়। 

আমি তখন নেমে পড়ি, সেখানে আমার মনে আসে দূর অতীতের অন্য কিছু সকালের কথা, যখন আমি রেড সি’র দিকে তাকিয়ে থাকতাম … যখন আমি রোমান সৈন্যদলের অংশ ছিলাম, এবং জ্বর, জাদু ও নিষ্ক্রিয়তা সৈন্যদের গ্রাস করেছিল। শহরের বাইরে আমি একটি ঝরনা দেখি, অভ্যাসের অনুবর্তী হয়ে আমি তার স্বচ্ছ জল পান করি। আমি তার পার্শ্ববর্তী খাড়া তীর বেয়ে ওঠার সময় আমার হাতের উল্টো দিক ছড়ে গিয়েছিল একটি কাঁটাঅলা গাছের ঘষায়। অপরিচিত ব্যথাকে মনে হচ্ছিল অতিরিক্ত যন্ত্রণাদায়ক। অবিশ্বাসপ্রবণ, বাকরুদ্ধ, এবং আনন্দিত আমি একটি মূল্যবান রক্তবিন্দুর ধীর বিকাশকে অবলোকন করি। আবারো মরণশীল আমি, আমি নিজেকে বারবার করে বলি, আবারো আমি অন্যসব মানুষের মতো।
সে-রাতে আমি ভোর পর্যন্ত ঘুমাই।

… এক বছর অতিক্রান্ত হয়েছে, এবং আমি পৃষ্ঠাগুলো আবারো পাঠ করি। আমি প্রত্যয়ন করতে পারি যে, তারা সত্যের সীমানা থেকে বিচ্যুত হয় না, যদিও প্রথম অধ্যায়গুলোতে এবং এমনকি অন্যগুলোরও কিছু স্তবকে, আমার বিশ্বাস আমি কিছুটা মিথ্যাচার চিহ্নিত করতে পারি। সেটা সম্ভবত পরিপার্শ্বগত তথ্যাদির অতিরিক্ত সমাহারের জন্য, একধরনের লেখার রীতি যা আমি কবিদের কাছ থেকে শিখেছি; এটা এমন এক পদ্ধতি যা সবকিছুকে মিথ্যা দ্বারা সংক্রমিত করে, কেননা সেখানে হয়তো ঘটনায় সুপ্রচুর খুঁটিনাটি রয়েছে, কিন্তুতে স্মৃতিতে নয় …।  তার পরও আমি বিশ্বাস করি, আমি আরেকটি অধিকতর ব্যক্তিগত ও আত্মগত কারণ আবিষ্কার করি। আমি এটি প্রকাশ করব, কিছু আসে যায় না যদি এতে করে আমাকে বাস্তবতাবর্জিত স্বপ্নচারী বলে বিচার করা হয়।

আমি যে-গল্পটি বলেছি সেটাকে অবাস্তব বলে মনে হয় কেননা দুজন আলাদা মানুষের অভিজ্ঞতাগুলো এখানে মিলেমিশে যায়। প্রথম অধ্যায়ে ঘোড়সওয়ার জানতে চায় থিবির দেয়ালের ধার ঘেঁষে বয়ে যাওয়া নদীটির নাম; ফ্লামিনিয়াস রুফাস, যে এই শহরের ওপর ‘শততোরণের নগর’ উপাধি অর্পণ করে, তাকে বলে যে, নদীটির নাম ইজিপ্ট; এই দুটো বিবৃতির কোনোটিই তার নয়, বরং হোমারের, যিনি ইলিয়াড-এ ‘থিবিস হেকাটম্পিলোস’ এর কথা পরিষ্কারভাবে উল্লেখ করেন, এবং যিনি ওডিসিতে, প্রোটিয়াস ও ইউলিসিসের বয়ানে নাইল নদীকে ‘ইজিপ্ট’ বলেন। দ্বিতীয় অধ্যায়ে রোমান ব্যক্তিটি যখন অমরত্বের জল পান করে, তখন সে দুয়েকটি গ্রিক শব্দ উচ্চারণ করে। সেগুলোও হোমারেরই শব্দ, যা জাহাজসমূহের বিখ্যাত তালিকার শেষে পাওয়া যাবে। পরে সেই ঘোর লাগানো প্রাসাদে সে একপ্রকার ‘অসন্তুষ্টির কথা বলে যা প্রায় অনুতাপের সমান’, সেই শব্দগুলোও হোমারের, যিনি এমন এক আতঙ্কের পূর্বাভাস পেয়েছিলেন। এই অসংগতিগুলো আমাকে পীড়িত করেছিল; অন্যগুলো, একধরনের শৈল্পিক প্রকৃতির, আমাকে সত্য আবিষ্কারে সহায়তা করেছিল। এই শেষোক্ত ধরনের সূত্রগুলোকে শেষ অধ্যায়ে পাওয়া যেতে পারে, যেখানে বলা আছে আমি স্ট্যামফোর্ড ব্রিজে লড়াই করেছি, বুলাকে সিন্দবাদের নাবিকের সফরের গল্প লিখেছি, এবং অ্যাবারডিনে আমি পোপের ইংরেজি ইলিয়াড-এর গ্রাহক হয়েছি। সেই লেখা বলে, অন্য আরো কিছুর সঙ্গে, ‘বিকানিরে আমি হস্তরেখাবিদ্যা শিখিয়েছি, যেমনটি শিখিয়েছি বোহেমিয়াতে।’ এই দুটো বিবৃতির কোনোটিই মিথ্যে নয়, যেটা গুরুত্বপূর্ণ সেটা হচ্ছে প্রামাণিকতার জন্য এই দুটো তথ্যকে বেছে নেওয়ার বিষয়টুকু। প্রথমটিকে একজন যুদ্ধের মানুষের জন্য উপযুক্ত মনে হয়, কিন্তু তারপর দেখা যায় বর্ণনাকারী যুদ্ধের বিষয়ে খুব কমই মনোযোগ দিচ্ছেন, বরং মানুষের ভাগ্যের ব্যাপারে বেশি। যে ‘সত্যগুলো’ এর পরে আসে সেগুলো আরো কৌতূহলোদ্দীপক। একটি গূঢ় এবং মৌলিক কারণে আমি সেগুলো কাগজে লিখে রাখি : আমি জানি সেগুলো শোচনীয় ছিল। সেগুলো যখন রোমান ফ্লামিনিয়াস রুফাস কর্তৃক বর্ণিত হয়েছিল তখন শোচনীয় ছিল না, শোচনীয় হয়ে ওঠে যখন হোমার সেগুলো বর্ণনা করেন। এটা অদ্ভুত যে হোমার, ত্রয়োদশ শতাব্দীতে, সিন্দবাদের অভিযানের কথাগুলো লিখে রেখেছিলেন – আরেক ইউলিসিস – এবং আবার বহু শত বছর পরে তাঁর ইলিয়াড-এর মতোই কিছু আঙ্গিক আবিষ্কার করেছিলেন এক উত্তুরে রাজ্যের বর্বর ভাষায়। ‘বিকানির’ লেখা বাক্যটির ক্ষেত্রে দেখা যাবে একজন বিদ্বান ব্যক্তি (সেই জাহাজের তালিকার লেখকের মতো) কর্তৃক সেটি লিখিত হয়েছিল, চমকপ্রদ শব্দাবলি রচনার বাসনা ছিল যাঁর।

সমাপ্তি যখন ঘনিয়ে আসছে তখন স্মৃতিতে কোনো ছবি নেই আর – সেখানে কেবল শব্দ। এটা অস্বাভাবিক নয় যে সময় হয়তো তাদের বিভ্রান্ত করেছে যারা আমাকে বর্ণনা করেছিল সেসব দিয়ে যেগুলো আসলে সেই মানুষটির নিয়তির প্রতীক ছিল, যে আমাকে এতগুলো শতাব্দী ধরে সঙ্গ দিয়েছিল। আমি হোমার ছিলাম; দ্রুতই, ইউলিসিসের মতো, আমি হয়ে পড়ব কেউ-না ; দ্রুতই আমি হয়ে পড়ব যে-কোনো মানুষ, আমি হয়ে যাব মৃত।

পুনশ্চ (১৯৫০) : পূর্বতন প্রকাশনা দ্বারা অনুপ্রাণিত ধারাভাষ্যসমূহের মধ্যে সবচেয়ে আগ্রহোদ্দীপক (সবচেয়ে পরিশীলিত না হলেও) যেটি, তার একটি বাইবেলীয় শিরোনাম ছিল, ‘অনেক রঙের একটি’ (ম্যানচেস্টার ১৯৪৮); এটি ড. নেয়াম কর্ডোভেরোর সেই চূড়ান্তরকম ধৈর্যশীল কলমের কাজ, যার দৈর্ঘ্য প্রায় শতপৃষ্ঠা। এটি গ্রিক সংকলনসমূহের কথা বলে, দূরবর্তী লাতিন সংকলনের কথা, বলে সেই বেন জনসনের কথা যিনি তাঁর সমসাময়িকদের সংজ্ঞায়িত করেছিলেন সেনেকা ও আলেক্সান্ডার রসের ভার্জিলিয়াস ইভানজেলিসান্স-এর, জর্জ মুর ও এলিয়টের চাতুর্য, এবং সবশেষে ‘দুর্লভ বইয়ের ব্যবসায়ী জোসেফ কার্টাফিলিয়াস বিষয়ক গল্পের দ্বারা’। প্রথম অধ্যায়ে এটি প্লিনির কিছু সংক্ষিপ্ত সংযুক্তির উল্লেখ করে (হিস্তোরিয়া নাতুরাতে, খণ্ড : ৮); দ্বিতীয় অধ্যায়ে টমাস দ্য কিন্সির রচনার (রাইটিংস, ৩য় খণ্ড : ৪৩৯); তৃতীয় অধ্যায়ে রাষ্ট্রদূত পিয়ের শান্যুকে লেখা দেকার্তের একটি চিঠির; চতুর্থ অধ্যায়ে বার্নার্ড শ’র (ব্যাক টু মেথুসেলা, ৫)। সেইসব ‘আগ্রাসন’ (অথবা চৌর্যকর্ম)-এর দৃষ্টান্ত থেকে তা এই সিদ্ধান্তে উপনীত হয় যে, পুরো দলিলটিই আসলে মেকি, যদিও সত্য বলে প্রচারিত।

আমার চিন্তাপদ্ধতি অনুসারে এই উপসংহার গ্রহণযোগ্য নয়। সমাপ্তি যখন আসন্ন, কার্তাফিলাস লিখছেন, সেখানে স্মৃতিতে আর কোনো ছবি নেই, কেবলই শব্দ। শব্দ, শব্দ, প্রসঙ্গ থেকে বিচ্যুৎ এবং দলিতমথিত শব্দ, অন্যদের কাছ থেকে নেওয়া শব্দ … সেগুলোই ছিল অসংখ্য ঘণ্টা এবং শতাব্দীর দান করা রসদ তাঁর।

সেসিলিয়া ইনহেনিয়েরসের জন্য

১. পাণ্ডুলিপির অংশবিশেষ ঘষে তুলে ফেলা হয়েছে এখানে, বন্দরের নামটি হয়তো মুছে গেছে।

২. এর্নেস্তো সাবাতো বলেন, যে ‘জিয়ামবাতিস্তা’

ইলিয়াড-এর উৎপত্তি বিষয়ে আলোচনা করেছেন দুর্লভ বইয়ের ব্যবসায়ী কার্তাফিলাসের সঙ্গে তিনি আসলে জিয়ামবাতিস্তা ভিকো, সেই ইতালিয়ান যিনি এই তত্ত্বকে সমর্থন করেছিলেন যে, হোমার প্লুতো কিংবা একিলিসের মতোই একটি প্রতীকী চরিত্র।