অনুবাদ : তানিয়া হাসান
‘মার্জারি’, মা বললেন, ‘জগটা নিয়ে গিয়ে কুয়া থেকে টাটকা জল ভরে আনো তো, রাতের রান্না শুরু করি।’
‘যাই মা’, বলল মার্জারি। মাথার ওপর সাদা হুডিটাকে আরেকটু টেনে দিয়ে, রান্নাঘরের দেয়াল-আলমারি থেকে সুদৃশ্য একটা কাচের জগ বের করে নিয়ে কুয়াতলার দিকে রওনা হলো। যে বাংলোবাড়িতে মার্জারি আর ওর মা থাকে, সেটা বিশাল বড় না হলেও ভারি ছিমছাম আর সুন্দর করে সাজানো-গোছানো। বাংলোর সব দেয়াল বেয়ে লতিয়ে উঠেছে গাঢ় সবুজ আঙুরলতা আর থোকা থোকা বুনো গোলাপ ফুটে আছে জানালার ধার ঘেঁষে। বাংলোর সামনে ছোট্ট একফালি বাগানে শোভা পাচ্ছে বিচিত্র বর্ণের ফুল আর লতাপাতা, রাস্পবেরি ঝোপটায় গুচ্ছ গুচ্ছ হলুদ ফল ঝুলছে আর রোজমেরির ঝাড়।
বাংলোর মেঝে একেবারে ঝকঝকে-তকতকে, পুরনো দিনের কিছু আসবাবপত্র, একটা ওক কাঠের খাবার টেবিল, তার ওপর গোল একটা লেজি-সুজান। বাংলোর বারান্দায় সুন্দর একটা পাখির খাঁচা ঝুলছে, দাঁড়ে বসে আছে ছোট্ট মুনিয়া পাখি।
কাচের জগটা হাতে নিয়ে সাবধানে হেঁটে চলে মার্জারি, গ্রামের একমাত্র কুয়াটা তাদের বাড়ি থেকে বেশ খানিকটা দূরে। পথে তার দুই প্রাণের বন্ধু, রোজমন্ড আর বারবারার সঙ্গে দেখা, দুজনই হুটোপাটি করে খেলছিল, দুজনেরই চুল এলোমেলো, উত্তেজনায় গালদুটো টুকটুক করছে আর ঝিকিমিকি করছে চোখের তারা।
‘মার্জারি, শিগগির এসো, দ্যাখো কী চমৎকার একটা ঘোড়াগাড়ি, কেমন সবুজ আর সোনালি রং, আর কোচোয়ানকে দ্যাখো ঝকমকে টুপি আর ইউনিফর্ম পরে কেমন সেজেছে!’
বন্ধুদের ডাকে তাদের কাছে ছুটে যায় মার্জারি, তার চোখগুলো বড় বড় হয়ে ওঠে, বাহ্, কেমন সুন্দর চার ঘোড়ায় টানা একটা গাড়ি, গাড়ি থেকে নেমে এলো রাজপুত্রের মতো দেখতে একটা বালক। গোলাপি গালের বালকটির চেহারায় ফুটে উঠেছে আভিজাত্য, তার কাঁধ পর্যন্ত কোঁকড়ানো ঝাঁকড়া সোনালি চুল আর পরনে বহুমূল্যের পোশাক, হাতে চেইনে বাঁধা ধবধবে সাদা একটা কুকুরছানা।
তিন বন্ধুর পাশ দিয়ে বালকটি যখন হেঁটে গেল, তিনজনই মুগ্ধ বিস্ময়ে অভিভূত!
‘উহ্, দেখেছ কেমন নকশা করা ওর টুপি আর টুপিতে গোঁজা পালকগুলো কী অপূর্ব?’ প্রায় চেঁচিয়ে ওঠে রোজমন্ড।
‘আর, লেস-বসানো ওর পোশাক, বরফের গোলার মতো মিষ্টি সাদা কুকুরছানাটি, কী সুন্দর তাই না?’ উত্তেজনায় তোতলিয়ে বলে বারবারা।
ছেলেটির উপস্থিতি এমন একটা ইন্দ্রজালের সৃষ্টি করেছিল যে, মার্জারি কোনো কথাই খুঁজে পাচ্ছিল না, এমন অনিন্দ্যকান্তি আগন্তুক সে ইহজন্মে দেখেনি!
কুয়ো থেকে জল তুলে ভরা জগ নিয়ে বাড়ি ফেরে মার্জারি; সেই থেকে অনবরত শুধু আগন্তুক ছেলেটির কথাই বর্ণনা করতে থাকে মায়ের কাছে। হঠাৎ ঘরের মেঝেতে কার যেন ছায়া পড়ে, সেদিকে তাকাতেই তার বুক ধক্ করে ওঠে – ও-মা, এ যে সেই আগন্তুক ছেলেটা।
‘ও-মা, দ্যাখো কে এসেছে’, বিস্ময়ে-আনন্দে প্রায় চিৎকার করে ওঠে মার্জারি!
সেই রূপকথার রাজপুত্রের মতো বালকটি স্বয়ং তাদের ঘরের দরজায় দাঁড়িয়ে। মার্জারির মা, ভেতরের বারান্দায় বসে রকিং চেয়ারে দোল খাচ্ছিলেন, মেয়ের চেঁচামেচিতে ধীরপায়ে হেঁটে এলেন। তিনি বড় মার্জিত ধরনের মহিলা, অকারণে অশোভন কৌতূহল প্রকাশ করা তাঁর স্বভাবে নেই।
মৃদু হেসে বালকটিকে ভেতরে আসতে অনুরোধ করলেন, সবিনয়ে বললেন, ‘আমাদের সঙ্গে নৈশভোজে যোগ দিলে খুব খুশি হবো। যদিও খাবারের আয়োজন অতি সামান্য; সদ্য রান্না করা ধোঁয়া-ওঠা পরিজ, নিজের ক্ষক্ষতের লালচে গম থেকে তৈরি গরম রুটি, ঘরে বানানো মাখন আর বুনো ফুলের মধু।’
বালকটি ক্ষুধার্ত ভঙ্গিতে সদ্যফোটা পরিজের মিষ্টি সুবাস বুকভরে টেনে নিল; তবু স্বভাবসুলভভাবে দু-এক মুহূর্ত শুধু ইতস্তত করে মার্জারির মাকে ভদ্রভাবে অশেষ ধন্যবাদ জানিয়ে ঘরে ঢুকল।
মার্জারি আর তার মা মিলে খুব সুন্দর করে নৈশভোজের টেবিল সাজায়। মার্জারি বাগানে ছুটে গিয়ে টাটকা একগুচ্ছ গোলাপ তুলে এনে টেবিলের মাঝখানে রাখা ফুলদানিতে সাজিয়ে দেয়। মার্জারির মা খাবার ঘরের আলমারি খুলে নিখুঁতভাবে ইস্ত্রি করা ফুলতোলা কাপড়ের ন্যাপকিন বের করলেন, এক বোতল মিষ্টি ওয়াইন এনে রাখলেন, ঘরে বেক করা রুটি সুন্দর করে সস্নvইস করে একটা সুদৃশ্য পেস্নটে করে সাজিয়ে দিলেন, একটা ক্ষুদ্র জগে ঘন ক্রিম ঢেলে দিলেন, ছোট্ট ঝুড়িভর্তি পাকা টুসটুসে রাস্পবেরি, মধুর জার আর পরিজ খাবার জন্য লাল গোলাপের ছবি আঁকা একটা খালি বাটি এনে বালকটির সামনে রাখলেন। ঠিক যেন একজন সত্যিকার রাজপুত্রকে নৈশভোজে আপ্যায়িত করা হচ্ছে। সামান্য আয়োজন, কিন্তু পরিবেশনের গুণে তা-ই অসাধারণ হয়ে উঠল! শুধু তাই নয়, তার ছোট্ট কুকুরছানাটিও আপ্যায়ন থেকে বাদ গেল না, তাকেও পেটপুরে খাইয়ে দেওয়া হলো।
খাবার শেষ করে বালকটি তার সিল্কের খুদে ব্যাগটি খুলে কতগুলো স্বর্ণমুদ্রা বের করল; কিন্তু মার্জারির মা তা কিছুতেই নিলেন না, সবিনয়ে ফিরিয়ে দিলেন। অগত্যা বালকটি অনেক ধন্যবাদ জ্ঞাপন করে কুকুরছানাটিকে নিয়ে বিদায় নিল।
‘আমরা আর কখনো ওকে দেখতে পাব না, তাই না মা’,
ব্যথাতুর শোনায় মার্জারির গলা।
‘আগন্তুকরা কি আর কখনো ফিরে আসে, ওদের স্মৃতিটাই শুধু রয়ে যায়’, বলেন মা।
‘খাবার সময় বুনো পাখির ঝাঁক কি মধুর সুরে গান জুড়েছিল, তাই না মা’, উদাস সুরে মার্জারি বলে।
টেবিলটা গুছিয়ে নিয়ে মা-মেয়ে সবে খেতে বসেছে, এমন সময় এই গ্রামের সবচেয়ে বয়োবৃদ্ধ মহিলাটি দুয়ারে এসে দাঁড়ায়। তার বয়স ১২০ বছর, বয়স আর অভিজ্ঞতার কারণে তাকে এ-গাঁয়ের সবচেয়ে জ্ঞানী মানুষ হিসেবে সম্মান করা হয়।
একটা চেয়ারে এসে ধুপ করে বসে পড়ে, খানিকটা লম্বা দম নিয়ে নাকিসুরে জানতে চায়, ‘তোমরা কি কোনো আগন্তুককে দেখেছ?’
মার্জারির মা উত্তরে বলে, ‘অবশ্যই, এই তো কিছুক্ষণ আগে আমাদের বাড়ি থেকে রাতের খাবার খেয়ে গেল।’
উত্তর শুনে বুড়ো মহিলাটির চোখ ছানাবড়া হয়ে উঠল, ‘তাজ্জব ব্যাপার!’ বলে ঢোক গেলে সে, যথাসম্ভব গলার আওয়াজ স্বাভাবিক রেখে আবার বলে, ‘এদিকপানে আসার সময় তাকে একঝলক দেখলাম মনে হলো, ওকে তো আমি চিনি। ওকে একটা
বাটার-কাপ কেক দিলাম, কী যে খুশি হলো, সব লিন্ডসের মতোই ওরও বাটার-কাপ কেক খুব প্রিয় একটি খাবার’, দুধসাদা কেশভর্তি মাথাটা দোলায় সে। ‘বিখ্যাত লিন্ডসে পরিবারের ছেলে ও, আজ থেকে একশ বছর আগে আমি ওদের পরিবারে নার্স হিসেবে কাজ করেছি।’
পক্বকেশ বুড়ি যখন বলছে ছেলেটি লিন্ডসে পরিবারের সদস্য তার অর্থ-খবরটি শতভাগ সত্য। এ-গাঁয়ের প্রতিটি মানুষের বুড়ির ওপর অবিচল আস্থা। তার কথায় তাই সন্দেহ প্রকাশের কোনো অবকাশই থাকে না মার্জারি এবং তার মায়ের। আগন্তুক ছেলেটির সভ্যতা-ভব্যতা নিয়ে কিছুক্ষণ আলোচনা চলল তিনজনের মধ্যে, অল্প সময়ের মধ্যেই লিন্ডসে পরিবারের সদস্যটি মা ও মেয়ের মন জয় করে ফেলেছে।
সুদর্শন আগন্তুক বালক, মার্জারিদের বাড়ি থেকে নৈশভোজ শেষ করেই ঘোড়াগাড়ি চালিয়ে সোজা ফিরে যায়, পথে শুধু একবার মাত্র থেমেছিল, গাড়ির চাকায় কী জানি একটা সমস্যা দেখা দেওয়ায়।
পরদিন সারা গাঁয়ে আলোচনার একটিমাত্র বিষয়, তা হলো সুদর্শন সেই আগন্তুক, যে বা যারা তাকে দেখেছিল সবার মুখে মুখে আলোচিত হতে থাকে তার রূপবর্ণনা।
অন্যান্য দিনের মতোই মার্জারি গায়ের ছেলেমেয়েদের সঙ্গে পিঠে ব্যাগ ঝুলিয়ে স্কুলে গিয়ে পৌঁছাল। এখানেও গল্পের
মুখ্য-বিষয় সেই অনিন্দ্যসুন্দর আগন্তুক। মার্জারিদের স্কুলটিচার, তিনি একজন কবিও বটে, তাকে খুবই উত্তেজিত দেখাচ্ছিল, যদিও তিনি অল্পের জন্য আগন্তুককে দেখতে পাননি। তাতে কী, তিনি নিজের মনের মাধুরী মিশিয়ে কল্পনায় এমনভাবে আগন্তুকের বর্ণনা দিলেন যে স্কুলের ছেলেমেয়েদের মধ্যে রীতিমতো হইচই পড়ে গেল, সত্যি বলতে কী সেদিন স্কুলের ডিসিপিস্নন আর আগের মতো ততটা কড়াকড়ি রইল না। শিক্ষকপ্রবরও ক্লাসে মনোযোগ দেওয়ার চাইতে আগন্তুককে নিয়ে কবিতা রচনায়ই বেশি মনোযোগী হলেন।
শিক্ষক-কবির রচনায় আগন্তুকের পোশাক, চালচলনের নতুন নতুন রূপ সৃষ্টি হলো। তাঁর বর্ণনা অনুযায়ী আগন্তুকের পরনের কাপড়ে ছিল খাঁটি সোনার সুতায় বোনা কারুকাজ, তার ঠোঁটদুটো ছিল চুনি পাথরের মতো টুকটুকে আর চোখদুটো থেকে ঠিকরে পড়ছিল হিরের দ্যুতি। শুধু আগন্তুক কেন, শিক্ষক-কবির কল্পনায় নতুন করে ভূষিত হলো আগন্তুকের খুদে কুকুরছানাটিও। যেমন – কুকুরছানাটির ঝুঁটিবাঁধা ছিল দামি সিল্কের ফিতায়, গলায় বাঁধা চেইনটিও নাকি নকল নয়, খাঁটি রুপার তৈরি। শুধু কি তাই, ঘোড়াগাড়িটিও তাঁর কল্পনায় তেমনি মনোমুগ্ধকর সাজে সজ্জিত হলো, গল্পের গরু গাছে ওঠার মতো। এমন ঝলমলে সাজে সাজালেন গাড়িটিকে, তার ভাষ্য অনুযায়ী – শুধু গাড়িটির রূপ দেখেই নাকি অনেক মানুষের চোখ ঝলসে গেছে। আগন্তুককে তিনি সত্যিকার রাজপুত্রের মতো এমনভাবে উপস্থাপন করলেন তার স্বরচিত কবিতায়, যে-কারো পক্ষে তাই নিয়ে সন্দেহ করার মতো আর অবকাশ রইল না।
দুদিন পর আগন্তুক তার ঘোড়াগাড়িসহ আবার গাঁয়ে এসে উপস্থিত, আজ তাকে দেখাচ্ছিল ভিখিরির মতো, তার কোলের কুকুরছানাটিও কেমন যেন নোংরা নির্জীব ধরনের। প্রথম এসেই সে সরাইখানায় গিয়ে উপস্থিত; কিন্তু সরাইখানার মালিক তাকে
ধুলো-পায়ে বিদায় করে দেয়, ভেতরে ঢুকতেই দেয়নি। একটা ধাতুর তৈরি ছাইদানি ছুড়ে মারে তার দিকে। তবে ভাগ্য ভালো, সেটা আগন্তুকের গায়ে না লেগে কুকুরছানাটির গায়ে লাগে। কঁকিয়ে ওঠে ছানাটি। সেখান থেকে বিদায় হওয়ার পর রাস্তার যত লোকের সঙ্গে তার দেখা হয়েছে, সবার সঙ্গে খুবই দীনহীনের মতো করে কথা বলে। এরপর যত মানুষের দুয়ারে গিয়ে সে কড়া নাড়ে, সবাই তাকে দূরদূর করে খেদিয়ে দেয়। এমনকি যখন গাঁয়ের সবচেয়ে বৃদ্ধ মহিলাটির সঙ্গে দেখা হয়, সেও নাকমুখ কুঁচকে রাস্তা থেকে সরে দাঁড়ায়। নিজের পোশাক-আশাক এমনভাবে সামলায়, যেন আগন্তুকটি একজন অস্পৃশ্য, তার সঙ্গে ছোঁয়া লাগলেই তার জাতমান খোয়া যাবে, টুপি দিয়ে মুখ ঢেকে অন্যদিকে মুখ ঘুরিয়ে রাখে।
আগন্তুক খুব মোলায়েম গলায় বলে, ‘নানিমা আমাকে চিনতে পারছ না আমি পৃথ্বী, মনে নেই আরেকদিন আমাকে বাটার-কাপ কেক খেতে দিয়েছিলে? আজো দিয়ে দেখো না, আমি কত মজা করে খাই।’
ডাক শুনে বুড়ি ফিরে তাকাল, তার চোখে-মুখে অদম্য কৌতূহল। একটা ঢোক গিলে মনে মনে বলে, ‘তা কী করে হয়, একজন লিন্ডসের এমন বেহাল দশা!’ সত্যতা যাচাই করার জন্য একটা কাপ-কেক নিরাপদ দূরত্ব বজায় রেখে আগন্তুকের হাতে কোনোমতে গুঁজে দেয়। ‘বাহ্, কোনো সন্দেহ নেই লিন্ডসেদের বংশধরই বটে। পুরা গুষ্টিই কাপ-কেকের পাগল। আমি জানব না কে জানবে। হাজার হলেও একশ বছর আগে আমি ওই পরিবারের নার্স ছিলাম যে।’ তারপর বুড়ি পড়িমড়ি করে এমন ঊর্ধ্বশ্বাসে ছুট লাগাল, যা তার বয়স অনুযায়ী অকল্পনীয়। আগন্তুক বুড়ির কা- দেখে হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে রইল।
এরপর আগন্তুকের সাক্ষাৎ ঘটল স্কুলশিক্ষকের সঙ্গে, যে
তাকে কল্পনার তুলিতে একজন রূপকথার রাজকুমারের আসনে
Leave a Reply
You must be logged in to post a comment.