আবুল হাসনাত

১ নভেম্বর সকালে হঠাৎ চিন্ময় গুহের ফোন। প্রায় অস্ফুট গলায় তাঁর এক বন্ধুবিয়োগের খবর। জানেন, আবুল হাসনাত চলে গেলেন? ভেজা গলা চিন্ময়ের। সে কী, আবুল হাসনাত? হ্যাঁ। কী হয়েছিল? হয়েছিল, হ্যাঁ, কিন্তু এমন বন্ধু আর আমি কোথায় পাব? অগাধ ভালোবাসা ছিল তাঁর। কেমন আপন করে নিতে পারতেন! এই তো সেদিনও। ভালোবাসতে তো সবাই পারে না। গলা বুজে আসছিল চিন্ময়ের। কী সান্ত্বনা জোগাই! পরে ওঁর এক নিকটতম বন্ধুকে ফোন করে বলি চিন্ময়ের সঙ্গে কথা বলতে।

এমনিই মানুষ ছিলেন আবুল হাসনাত। কেবল কালি ও কলমের মতো এক সর্বাঙ্গসুন্দর পত্রিকার সম্পাদক নন, মানুষ। ২০১৫-তে তিনি ছুটে আসছিলেন ভূমেন্দ্র গুহ-সম্পাদিত, ঢাকা থেকে বেঙ্গল পাবলিকেশন্স-প্রকাশিত মূলানুগ জীবনানন্দ কবিতা সংগ্রহ মরণাপন্ন ভূমেন্দ্রের হাতে তুলে দিতে। পৌঁছবার আগেই ভূমেন্দ্র চলে গেলেন : খেদ রয়ে গেল আবুল হাসনাতের। তাঁর সঙ্গে আমার যোগাযোগ এরপর থেকে। আনিসুজ্জামানের পরামর্শেই বোধকরি কালি ও কলমে আমাকে লিখতে বলেন। অতি সৌজন্যমূলক সেই আমন্ত্রণ – যেন আমি এক সত্যিকারের লেখক। কিন্তু আমি তো তা নই। লিখি কালেভদ্রে, আর তাও চাপে পড়ে। ২০১৭-তে বেঙ্গল ফাউন্ডেশনের আমন্ত্রণে সিলেট গিয়ে তাঁর সঙ্গে দেখা হয়। তাঁর আন্তরিকতায় অভিভূত হই এবং কেমন যেন মনে হয় উভয় বাংলার ওই লেখক-শিল্পীদের সম্মেলনে আমার মতো না-লেখককে ডাকিয়ে এনেছেন তিনিই। হোটেলে এক আড্ডায়ও তাঁর কথাবার্তা শুধু সহৃদয় নয় উদারও লাগল। আমার পক্ষে পুরোটাই এক সমাপতন, কারণ সিলেট আমার জন্মভূমি, আর এলাম ছেষট্টি বছর পর।

২০১৮-র প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী সংখ্যায় লেখা চেয়েছিলেন আবুল হাসনাত। আমি জিজ্ঞেস করি, আমাকে লেখা বুদ্ধদেব বসুর কিছু চিঠি কি ওঁরা ছাপবেন? সেইসঙ্গে পশ্চিমবঙ্গে পুনর্মুদ্রণের অনুমতিও দেবেন? আবুল হাসনাত সানন্দে রাজি। সেই ষোলোটি চিঠি যে কী যত্নে ছাপা হয়েছিল তা বলবার নয়। একটা অমার্জনীয় ভুল আমিই করেছিলাম কপিতে : ১১ নম্বর চিঠির ‘সূত্রে’ বুদ্ধদেব বসুর ছাত্র কালিকাপ্রসাদ বন্দ্যোপাধ্যায়কে আমি ভট্টাচার্য বানিয়ে দিয়েছিলাম। কিন্তু আমি যে ভুল করছি তা ওঁদের জানবার কোনো উপায় ছিল না। বুদ্ধদেব বসুর আরো পঁচিশটি চিঠি আবুল হাসনাত ২০১৯-এর প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী সংখ্যায় সাদরে ছাপেন। ওখানেও কপিতে ২১ নম্বর চিঠির ‘সূত্রে’ আগের ভুলটি (কালিকাপ্রসাদ বন্দ্যোপাধ্যায়ের জায়গায় ভট্টাচার্য) পুনরাবৃত্ত হয়। সেইসঙ্গে এক অন্য অমনোযোগও ঘটে (বাংলা ছাপায় ‘কপি এডিটিং’-এর ব্যবস্থা থাকলে তা হয়তো ধরা পড়ত)। ২৪ নম্বর চিঠিতে ‘কবিতা-পরিচয়’-এর লেখক হিসেবে আরো কয়েকজনের সঙ্গে ‘শঙ্খ’ নামটাও ছিল। ‘সূত্রে’ শঙ্খ ঘোষের পরিচয় দেওয়া হয়নি – এহ বাহ্য বলে নিশ্চয়ই নয়। নিতান্তই অমনোযোগ, অমার্জনীয় অমনোযোগ।

কালি ও কলমের এই প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী (২০১৯) বেরোবার মাসদুয়েক আগেই কলকাতায় উভয় বাংলার সম্মিলিত ‘বাংলা উৎসব’-এর ‘মঙ্গল শোভাযাত্রা’ সংবলিত উদ্বোধনীতে আবুল হাসনাতের সঙ্গে আমার দ্বিতীয়বার দেখা হয়। এমন সমাদর করলেন যেন কতদিনের চেনা! আর যেন-বা আমি এই অনুষ্ঠানের অতিথি। অথচ আমার শহরে তো অতিথি হবার কথা তাঁরই। আত্মপর-অভেদের এক জাজ্বল্যমান উদাহরণ ওই মানুষটি, আবুল হাসনাত। স্বেচ্ছাসেবীর মতো প্রেক্ষাস্থলে নিয়ে গিয়ে আমাকে প্রথম সারিতে আনিসুজ্জামানদের পাশে বসিয়ে দিলেন। অথচ ওঁর ওজন তো কম নয়, দুই বাংলার শ্রেষ্ঠ সাহিত্য-শিল্প-সংস্কৃতিবিষয়ক মাসিক পত্রিকার সম্পাদক, রুচি ও মনন-বেদনের অক্লান্ত ধারক। দূরের পথে বাড়ি ফেরার তাড়ায় যখন একসময় বিদায় নিয়ে উঠে আসছি তখন আমাকে এগিয়ে দেবেন বলে বাইরে এলেন। যেন ওঁরই বাড়িতে এসেছিলাম, উনি সদর পর্যন্ত না এসে পারেন না। দুর্লভ মনুষ্যত্ব।

বছর শেষ হবার আগেই ওঁর অনুরোধ এলো : ২০২০-র গোড়ায় বঙ্গবন্ধুর শতবর্ষ উপলক্ষে কালি ও কলমের বিশেষ সংখ্যায় একটা লেখা। ই-মেইলের প্রথমেই কিন্তু কুশলজিজ্ঞাসা। কয়েক মাস যেতে না যেতেই করোনাকালীন বজ্রপাত : আনিসুজ্জামানের মৃত্যু। কঠিন, তবু মেনে নিতে হয়। স্মরণের অনুরোধ। আর সেই লেখা যখন শিলচরের এক দৈনিকের রবিবাসরীয় পুনর্মুদ্রণ করতে চাইল, তখন সানন্দ সম্মতি পেতে দেরি হলো না। এর কিছুদিন পরেই এলো আবুল হাসনাতের আরেক মেইল : কালি ও কলমের আনিসুজ্জামান সংখ্যা বই করবার পরিকল্পনা। কোভিডউনিশ সত্ত্বেও একের পর এক এই মুদ্রণ অবশ্যই প্রশংসনীয়। আর মেইল পাব না আবুল হাসনাতের কাছ থেকে। তিনি এখন ছবি।