গত শতাব্দীর চুয়াল্লিশ কি পঁয়তাল্লিশ সাল, আমার জন্মের পরপরই বাবা সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন আর নয়! অনেক অর্থ উপার্জন হলো, জেলায় জেলায় ঘুরে, এবার দেশের বাড়ি গিয়ে থিতু হতে হবে। জমি, পুকুর, কন্ট্রোলের ব্যবসা খুলে, বাকি জীবন ভিটের ভাত খেয়ে দিব্যি জমিয়ে কাটাবেন। জন্মভিটে বলে কথা।
আমাদের যৌথ পরিবার। বরিশাল জেলার শোলনা গ্রামে। মনে আছে, ধুলো আর হাঁটুকাদার পথ ধরে বরিশাল শহরে যেতে হয়। বাবারা চার ভাই। আমার তিন জ্যাঠা, বাবাই কনিষ্ঠ। আর সংসারে ছিল দুই বাল্যবিধবা পিসি এবং তাদের ছেলেপুলেরা। বড় ও মেঝ জ্যাঠা কলকাতায় সরকারি চাকুরে।
সেঝ দেশের বাড়ির সামান্য জমিজমা দেখাশুনো করতেন আর বাবা বর্ধমান, মেদিনীপুর, কলকাতায়সাব-কন্ট্রাক্টরি করতেন। তার ব্যবসায় একজন পার্টনার ছিল। শুনেছি বর্ধমানের কোনো অঞ্চলের জোতদারের ঘরের ছেলে। তার ছিল ক্যাশ টাকা আর বাবার ছিল সোনা-দানা। মা-র অলঙ্কারসমূহ।
যুদ্ধের বাজারে দুই বন্ধুর সংস্থা দু-হাতে মুনাফা করেছিল। পুরো পানাগড় অঞ্চলের মিলিটারির এয়ারপোর্ট গড়বার বড় সাব-কন্ট্রাক্টরি পেয়েছিল। তখন পানাগড়-দুর্গাপুর গভীর অরণ্যে ঢাকা। এত কাজের চাপ এবং মুনাফার স্রোত – বাবা সেঝ জ্যাঠাকে টেনে আনলেন, লাগিয়ে দিলেন এখানে। সেঝ জ্যাঠার তিন ছেলে তিন মেয়ে। মাত্র ন’বছর বয়সে জ্যাঠিমা এসেছিলেন আমাদের সংসারে।
সেঝ জ্যাঠা পানাগড়েই যুদ্ধ শেষ হবার কয়েক মাস আগে ম্যানেঞ্জাইটিস ম্যালেরিয়ায় প্রাণ হারায়। জলের মতো অর্থ ঢেলেও বাবা বাঁচাতে পারেননি। অপরাধবোধ কুরে-কুরে খাচ্ছিল। বড় এবং মেঝ জ্যাঠা ছিলেন স্বভাবে কিছুটা আত্মকেন্দ্রিক। বাবার আহ্বানেই মেঝ জ্যাঠার জঙ্গলের দেশে আসা। নৈতিকতাবোধে বাবা শপথ করলেন নিজের ও জ্যাঠিমার – দুই সংসারই তাঁর এক সংসার। তাই ’৪৫-এর শেষেই ব্যবসা গুটিয়ে মূলধন নিয়ে দেশের বাড়িতে জাঁকিয়ে বসার পরিকল্পনা। পার্টনারটি বলেছিল, বর্ধমান বা কলকাতা – যেখানে খুশি জমিজমা, ঘরবাড়ি করে বসতে। বাবা হেসেছিলেন, বন্ধুকে ব্যঙ্গোক্তি করেছিলেন, দেশ থাকতে এখানে? ফুঃ। সে-যুগে রেডিও, খবরের কাগজ, রাজনৈতিক চেতনা – সাধারণ মানুষের মধ্যে কতটুকু? কংগ্রেস, লীগ, ক্যাবিনেট মিশন, লাহোরে পাকিস্তানের দাবি – এসব নিয়ে কমনম্যানদের মাথাব্যথা নেই। দেশের বাড়িতে গ্রামে-গ্রামে লীগের পদধ্বনি বাড়ছে বলে চাঁদ-তারা ফ্ল্যাগ নিয়ে মিছিল করে পাকিস্তানের দাবি জানাচ্ছে – হিন্দুরা বিশ্বাসই করতে পারছিল না, বাপ-দাদা বংশপরম্পরার দেশ কি খ-িত হতে পারে? অসম্ভব।
’৪৫-এর শেষে বাবা গ্রামে গিয়ে জমি কিনলেন, পুকুর কাটালেন, রেশন ডিলারের মালিক হলেন, দু-চার ঘর প্রজা ছিল আমাদের এজমালি পরিবারবর্গের – নতুন করে কাছারি ঘর বসালেন। পুজোর দালানসহ পাকা ঘরবাড়ি হলো আমাদের। কাঠের দোতলা ঘর। বাবা স্বভাবে একটু মেজাজি – কিছু মোসাহেব জোটালেন এবং স্বাভাবিক নিয়মে ঈর্ষা ও শত্রুতার গোপন টার্গেট হয়ে গেলেন। বাবার সর্বসময়ের সহকারী ও গোমস্তার ভূমিকায় ছিল কালে খাঁ নামে একজন মুসলমান। লোকটিকে এলাকার সবাই ভয় পেত।
দেশভাগের হাওয়া কিংবা সামান্য গুঞ্জন শুনলে বাবাকে শোনাত। আমার জান থাকতে কিছু হবে না উত্তরের বড় বাড়ির। আমাদের বাড়িটাকে বলা হতো শোলনা গ্রামের উত্তরের বড় বাড়ি। আমাদের বংশলতারা মস্ত ভিটের চারপাশে মোট আটটি পরিবার ছিলাম। সবগুলিই বড় বাড়ির অন্তর্ভুক্ত; আমাদেরটা উত্তর ভিটায় বলে উত্তরের বড় বাড়ি।
তো, বাবা দেশে পাকাপাকি ফিরে এসে, আঙুল ফুলে কলাগাছ হয়ে পড়ায়, গরিব মুসলমানদের চাইতে হিন্দু পরিবাররাই ঈর্ষায় আক্রান্ত হয়ে পড়ছিল। এমনকি, ভিটের দক্ষিণ, পশ্চিম, পুবের জ্ঞাতিগুষ্টিরাও ব্যাপারটা মন থেকে মেনে নিতে পারেনি। আসলে প্রায় সকলেই তো মোটামুটি আর্থিকভাবে অসচ্ছল। কারো বাড়ির কোনো পুরুষ সদস্য কলকাতায় আর্থিক উপার্জনে লেগে গেলে, খানিকটা সুরাহা। নগদ পয়সা আসত সংসারে। নইলে দেশে বাড়ির আর্থিক অবস্থা, ক্রয়ক্ষমতা বা সচ্ছলতার ছবি খুব সুখকর ছিল না।
কচু-ঘেঁচু, লতাপাতা, বনজঙ্গল, আর এটা-ওটা একটু চাষবাস করে যা কিছু জুটত, পুকুর খালে কিছু মাছ। কার্তিক থেকে ফাল্গুন – দেশের বাড়িতে মাছ-টাছ পাওয়া যেত। গ্রীষ্ম-বর্ষা-শরৎ, জল-কাদা জোঁকসাপ – নানা প্রতিকূলতার পরিবেশ। বাজার নেই, হাট নেই, তিন-চার ক্রোশ দূর দূর।
যাক, বাবা ছিলেন একগুঁয়ে, সাহসী – ওইসব শত্রুতা-টত্রুতাতে বিশেষ ঘাবড়াতেন না। এমনকি, বিশ্বাস করতেন দেশ ভাগ হবে না।
আমাদের গ্রামের কাছেই ছিল কালজিরা নদী। ভয়ংকর আড়িয়াল খাঁ নদীর একটি শাখা। হ্যাঁ আমাদের দেশ-বাড়ির পুকুর-খাল-নালা-নদীর মধ্যে এমন জালিকা সংযোগ ছিল যে পুকুরেও জোয়ার-ভাটা খেলত।
তো, এই পরিবেশে ’৪৭ এলো আমাদের পরিবারের ভাগ্যে অশনিসংকেত নিয়ে। বাবার বালির বাঁধের বিশ্বাস প্রথম ধাক্কা খেল এক গভীর রাতে। কালে খাঁ এসে ডাকাডাকি করে বাবাকে তুলে জানিয়েছিল সর্বনাশের কথা।
আমাদের কন্ট্রোলের মোট চাল আসত নৌকোযোগে, আড়িয়াল খাঁ হয়ে কালজিরা বেয়ে। কে বা কারা যেন দলবলসহ গভীর রাতে আমাদের পুরো নৌকোর মাল অন্তর্ঘাত করে কালজিরায় ডুবিয়ে দিয়েছে।
আমার তো তিন সাড়ে তিন বছর বয়স তখন। জানবার কথা নয়। পরে মা’র মুখে শুনেছি। তবে ওই বয়সের দেশের ছবিগুলো এতটা বয়সে পৌঁছেও অমলিন।
যেমন ও-বয়সেই পাঠশালায় যেতাম সেøট-পেন্সিল আর ভিজে ন্যাকরা নিয়ে। খালি গায়ে, একটা ইজের থাকত শুধু। প-িতের নাম কৃপানাথ। একদিন পশ্চিমের ভিটার গণেশ – আমার সমবয়সী, উলঙ্গ শরীরে হাতে সেøট নিয়ে হাজির হতে প-িতমশাই লম্বা মতো একটি ছেলেকে দিয়ে বাড়ি পাঠিয়ে দিয়েছিল। এখনো ভাসছে। ছায়াচ্ছন্ন একটা গোধূলির বিকেল মনে পড়ছে। গোল্লাছুটের মতো কী যেন খেলছিল দিদিরা। হঠাৎ ‘আলীর মা আসছে’ বলে দে ছুট। আমি একা পড়ে গেছি। কে আলীর মা জানি না, কিন্তু ওইটুকু বয়সে ভয় জন্মে গেছে। শুনেছি মাথা খারাপ কোনো মুসলমান গরিবের বউ মাঝে মধ্যে গ্রামে হাজির হতো। চোখে ভাসে কাছারিঘরের নতুন টিনের ঝিলিক, পাশেই মস্তবড় একটা হরীতকী বৃক্ষ। আমার খেলা ছিল হরীতকী কুড়োনো। বা মনে পড়ে, বিকেলের ছায়া নামলে মা-জ্যাঠিমা বা অন্যান্য ভিটার দু-একজন বউ পিতলের কলস কাঁখে জল আনতে যেত। পুকুরনাম ছিল ‘ছাড়াবাড়ির পুকুর’। আমাদের পারিবারিক ভিটে থেকে বর্তমানের মাপে আধ কিলোমিটার দূর। দুপাশে জঙ্গল, ধুলোর রাস্তা। আমাকে কিছুতেই মা সঙ্গে নিত না। কান্নাকাটি করলেও না। শেষে জ্যাঠিমার সঙ্গে একদিন গিয়েছিলাম। বলতে কী, বিধবা জ্যাঠিমা আমাকে তাঁর সন্তানের চাইতেও বেশি ভালোবাসতেন। শাসন করতেন।
তো, গিয়ে দেখি ছমছমে পরিবেশ, দুপাশে জঙ্গল, কাঁটাবন, সরু পথ। গিয়ে ভাঙা ঘাটলা ও মস্ত কাকচক্ষুজলের একটা দিঘিমতো। প্রচুর শাপলা। আর ছিল ঝাঁঝির জাল। ‘জলকে চল’-এর দল ওই নির্জনতায় গোধূলির আলো মরে যাবার আগেই দলবেঁধে ফিরে আসত। আজো স্মরণে আছে জ্যাঠিমা আমাকে বলেছিল, মইনুদ্দীন নামের মুসলমানপাড়ার এক দরিদ্র পরিবারের যুবক ঝাঁঝিতে পা আটকে মরে ছিল অনেক কাল আগে। আত্মা নাকি চারপাশে আজো ঘুরে বেড়ায়।
আত্মা, মৃত্যু, ভূত-প্রেতের ভয় শিশুকাল থেকেই আমার মধ্যে ঢুকিয়ে দেওয়া হয়েছিল। গ্রাম বা পাড়ায় কারো মৃত্যু ঘটলে পরিবেশটা ভারি হয়ে যেত। একদল চলে যেত আমগাছ কাটতে, যার যার জমির সীমান্তে পোড়ানো হতো। গ্রামে কোনো শ্মশান থাকত না। শ্মশানকে বলত ‘মড়ক খোলা’। কালী, মনসা, শীতলার খোলাগুলো নির্জনতায় থাকত, আর সে-সম্পর্কে নানা অলৌকিক গল্প ছড়ানো হতো – যা ওই শিশু বয়সে অশেষ ভয়ের কারণ হয়ে উঠত। কারো ঘরে গুটিবসন্ত উঠলে মাছ-মাংস, পিঁয়াজ-রসুন বন্ধ। শুধু রোগীর পরিবারই নয়, পাড়ার সকলের ঘরে। ‘মায়ের দয়া’ হলে (বসন্তকে ওই নামে ডাকা হতো) রোগীকে পরিবারবিচ্ছিন্ন করে শীতলার থানে মাখন মাখিয়ে বড় বড় কচুপাতায় শুইয়ে রাখা হতো এবং সন্ধ্যার পর ঘরে ঘরে পোড়ানো হতো গন্ধক। ধোঁয়ায় বিষণœ সন্ধ্যা আচ্ছন্ন হয়ে থাকত।
তো, নানা গুজব, মাঝে মধ্যে লীগের মিছিলে হুঙ্কার, গ্রামের পরিবারগুলোর মধ্যে গোপনে টুকটাক সরে পড়া, কী হয় কী হয় ভাব, উলটোপালটা গুজব, এর মধ্যেই ১৫ আগস্ট দেশভাগ হয়ে গেল। বাবার তখনো অবচেতনে বিশ্বাস এই ভাগ ক্ষণস্থায়ী – দুদিন বাদেই দেশ জোড়া লেগে যাবে।
মাসতিনেকের মধ্যেই টের পাওয়া গেল, ব্যাপার অত সহজ নয়। আমার তখন কিছুই বোধের বয়স হয়নি। শুধু দেখতে পেলাম, পাঠশালা বন্ধ, বাবা বিশেষ বাইরে বেরুতে চান না। বা কালে খাঁ আসে মাঝেমধ্যে, দুজনে ঘরের মধ্যে কীসব কথা বলে। সংসারেও পারিবারিক কলতান কমে গেছে। পিসিমার একমাত্র ছেলে বেঙ্গল-নাগপুর রেলওয়েতে চাকরি করে। একদিন হঠাৎ হাজির। স্ত্রীর সন্তান হবে জানিয়ে মামার অনুমতি নিয়ে পিসিমাকে নিয়ে চলে গেল। বাবা বছরদুই আগে, ম-পে পারিবারিক দুর্গাপূজা চালু করেছিল, এ-বছর বন্ধ হয়ে গেল। আমাদের পারিবারিক ভিটের দক্ষিণ, পশ্চিম বা পুব দিকের ঘর থেকে টুকটাক টুকটাক গোপনে দু-একজন কলকাতা পাড়ি জমাল।
আরো মাসখানেক বাদে টের পেলাম বড়দিনে বড় জ্যাঠা কলকাতা ছেড়ে এলেন না। প্রতিবছরের মতো এ-বছর আর চকচকে দার্জিলিং কমলা এবং ফিরফো কোম্পানির কেক গ্রামে এলো না।
একদিন সন্ধ্যার পর হই-হট্টগোলের আওয়াজ তুলে, একটা ছোটখাটো মিছিলের শোলনা গ্রাম পরিক্রমা।
একটু রাত হতেই দরজায় ধাক্কা। বাবার হুঙ্কার পেয়ে ঘরের কোণে পরিচিত ‘ল্যাজা’ খানা খুঁজবার আগেই ‘খোলেন!’ বলে গম্ভীর মেজাজে কালে খাঁ।
দরজা খুলতেই বাবার চোখে চোখ রেখে বলল, আপনাদের আর বোধহয় বাঁচাইতে পাল্লাম না। আইজ রাত্তিরেই দ্যাশ ছাড়তে হবে।
নঈমুদ্দিনের …?
বাবা বাক্যটি সম্পূর্ণ করতে পারলেন না। নঈমুদ্দিন মাধবপাশা অঞ্চলের লীগের লিডার। কালে খাঁ মাথা নাড়ল।
আমার ক্যাল্লা না কাইট্টা, নঈমুদ্দিনের কি ক্ষ্যামতা?
এরপর সে সিংহবাড়ি, বসুবাড়ির ষড়যন্ত্রের কথা বলে জানাল, আপনাদের ঘরের শত্রু। বাবার হঠাৎ ‘আঙুল ফুলে কলাগাছ’ পর্ব থেকেই দুই পরিবারের সঙ্গে চ্যাটার্জি পরিবারের আক্রোশ ও চাপা বিরোধ ছিল। বাবাকে কিছুতেই কায়দা করতে পারছিল না।
যথাযথ অর্থেই কপর্দকহীন অবস্থায় ওই-রাতেই আমাদের ভিটে ছাড়তে হয়েছিল। কালে খাঁ, পরে শুনেছিলাম, দুই নৌকোর বন্দোবস্ত করে রেখেছিল।
পরিবারের সকলের পালানোর উপায় ছিল না। এবং তা নিরাপদ ও বুদ্ধিমানের কাজ হতো না। বাবা-মা-আমি এবং এক দিদি আমার, গ্যাদা ছোট এক ভাই ও বোন। তীব্র অভিমানের আমার বিধবা সেঝ জ্যাঠিমা এবং তার তিন পুত্র ও দুই কন্যাকে রেখে আসতে হয়েছিল। কেবল তাঁর বড় মেয়েটির বিয়ে হয়ে গেছিল বছর পাঁচেক আগে।
আমাদের নৌকোয় নাকি বড় জ্যাঠার বড় ছেলে শ্যামাপ্রসাদ এবং তার নবীনা স্ত্রী – আমার বড় বউদি – ছিল। বড় জ্যাঠামশাই নাকি ১৫ আগস্ট দেশভাগ হবার পর থেকেই বাবাকে তার করে হুকুম দিতেন, শ্যামাপ্রসাদ ও বউমাকে পাঠাইয়া দাও!
আল্লার কৃপায় পড়ে রইল সেঝ জ্যাঠাইমা, তার পুত্র-কন্যারা আর বিধবা দ্বিতীয় পিসিমা – তার এক ছেলে, দুই মেয়ে।
জীবনে আমার ভেসে বেড়ানো শুরু। ঠিক চার বছর বয়স আমার। আজ সে-যাত্রার খুঁটিনাটি মনে নেই। যে-নদীতে চালের নৌকা ডুবিয়ে দিয়ে আমাদের নিয়তির খেলা শুরু হয়েছিল, তারই বুক বেয়ে অন্ধকারে আমরা নাকি বরিশাল শহরে হাজির হয়েছিলাম।
শুনেছি, নোনাধরা পুরনো একটা বাড়ি নাকি কিছুদিনের জন্য বাবা ভাড়া নিয়েছিলেন। স্মৃতিতে অস্পষ্ট কয়েকটি দৃশ্য ছাড়া কিছু মনে নেই আজ।
১. একটা বারান্দা। সামনেই সুড়কির রাস্তা, তারপরই নদী। কীর্তনখোলা। ঠিক ওপারেই আগুনের শিখা জ্বলছে। মরণখোলা। শ্মশানে চিতা জ্বলছে।
২. আমার বউদি ফর্সা, সুন্দরী। শীতের রোদে বসে আছি। আমি আর বউদি। বউদির মুখটি শুকনো। কে যেন উঁকি দিয়ে বলল, রান্নাবান্না হয়ে গেছে? বউদি মøান হেসে বলছে, আজ তো অরন্ধন! কেন?
গান্ধীজিকে হত্যা করেছে। (আজ একটা বয়সে এসে বুঝি, দিবসটি ছিল ১৯৪৮ সালের ৩১ জানুয়ারি)
৩. অন্ধকার এবং মস্ত একটা ঘরের মধ্যে পর্দা টাঙানো। একটি মেয়ে সাঁতরে একবার ডুবছে, জেগে উঠছে ফের। কয়েক হাত দূরে সাঁতরাচ্ছে একজন পুরুষ। (আজ বুঝতে পারি, ছবিটির নাম চন্দ্রশেখর এবং সাঁতরাচ্ছিলেন কানন দেবী ও অশোক কুমার। শ্যামাদাদা বউদিকে নিয়ে সিনেমায় গিয়েছিল, সঙ্গে নিয়েছিল চার বছরের আমাকে। সম্ভবত একটা কাটলেট খাইয়েছিল। কারণ চোখ বুজলে আজো আমি ক্ষীণ কাটলেটের গন্ধ পাই নাকে।
ভাড়াটে হিসেবে ওখানে কতদিন ছিলাম বিস্মৃতিতে ডুবে গেছে। মনে পড়ছে, দাদা-বউদির সঙ্গে আমাদের পুরো গুষ্টি উঠলাম এসে বড় জ্যাঠার সংসারে। তখন তিনি মির্জাপুর স্ট্রিটে (বর্তমানে সূর্য সেন স্ট্রিট) বাসাভাড়া করে থাকেন। পিডব্লিউডিতে চাকরি করেন – অফিস লাটভবন (বর্তমানে রাজ্যপালের বাড়ি)।
সেইসব দিনগুলো অধিকতর স্পষ্টভাবে আজো মনে পড়ে। বাবার মধ্যে পলাতক স্বভাব জন্মে গেল। জ্যাঠামশাইয়ের ঘাড়ে আমাদের তুলে দিয়ে তিনি কোথায় যেন বেপাত্তা। মা লজ্জায় সংসারের পুরো খাটুনিটা মাথায় তুলে নিল। অন্ধকার, লালচে, তুষের আলোয় রান্নাঘরেই পড়ে থাকতে হয়; এমন কী কয়লা ঘরে গিয়ে মাঝে মাঝে তার কয়লা ভাঙার দৃশ্য ভেসে ওঠে।
তবে, আমি বেশ মজায় থাকতাম। জ্যাঠামশাই আমাকে খুবই ভালোবাসতেন। প্রতিদিন হাত ধরে গোলদীঘিতে (কলেজ স্কোয়ার) চান করাতে নিয়ে যেতেন, রংচংয়ে টিনের বাক্সে নানা কিসিমের বিস্কুট আনতেন। জ্যাঠিমা সারাদিন একটা তালপাতার পাখা হাতে, গাড়িবারান্দা সংলগ্ন আলোবাতাসওয়ালা ঘরখানায় শুয়ে থাকত। জ্যাঠিমা ছিল জন্ম খোনা, এবং বধির। সংসারে কোনো পরিশ্রমের কাজ পারত না। ভিন্ন মেয়ে দেখিয়ে জ্যাঠামশাইর সঙ্গে একটি ছলনা করা হয়েছিল। জ্যাঠামশাই অবশ্য কোনো প্রতিক্রিয়ায় যাননি উত্তর-বিবাহপর্বে। যথাযথ মর্যাদা রক্ষা করেছেন স্ত্রী হিসেবে।
আমি প্রায় সময়টা গাড়িবারান্দা থেকে মুগ্ধচোখে গাড়িঘোড়া, মানুষ, জনস্রোত, আকাশের ঘুড়ি, দূরে রাস্তায় ছাদখোলা দোতলা বাস (মেডিক্যাল কলেজের দিকে) ছুটতে দেখতাম।
জ্যাঠামশাই পাঁড় রেসুড়ে ছিলেন। প্রতি শনিবার রেস খেলতেন। জিতলেই বাড়িতে ফল-মিষ্টি এটা-সেটা নিয়ে হাজির। আর হেরে গেলে পরদিন সকালে দেয়ালে কপাল ঠেকিয়ে বিছানায় বসে থাকতেন অনেক বেলা পর্যন্ত। আমাকে পাঠাতেন সিঁড়ির তলায় চায়ের দোকানে। কলায়ের মস্ত একটা গ্লাস ছিল তাঁর। বারবার গিয়ে ভর্তি চা আনতে হতো। সেদিনের চায়ের সুবাসটি আজো ভুলিনি। একবার সিঁড়ির ধাক্কায় গরম চা চলকে কচি আঙুলে পড়েছিল। ছোট্ট একটি স্পট আজো বাল্যের দিনটির কথা মনে করায়। এই দাগ সংক্রান্ত একটি দৃশ্য আজো স্মরণে আছে। গাড়িবারান্দার নিচে একটা দোকানঘর বরাবর বন্ধ থাকতে দেখেছি। হঠাৎ দেখি, ছোট্ট ভিড়। ঘরটার দরজা ভাঙা হচ্ছে। কৌতূহলে কাউকে না বলে নিচে এসে আমিও দাঁড়িয়ে ছিলাম। দরজা ভাঙতেই দু-চারজন ভেতরে ঢুকল। খুঁটিয়ে সবাই দেয়ালে চাপ চাপ কিছু দাগ পর্যবেক্ষণ করছিল।
রাতে জ্যাঠামশাইকে জানাতে বলেছিলেন, ওটা নাকি তুলোর একটা পুরনো গুদাম। বৃদ্ধ এক মুসলমানের। রায়টে একদঙ্গল লোক ঢুকে লোহার
রডে মাথা দু-ফালা করে দিয়েছিল। রক্ত ছিটকে দেয়ালে যায়। রায়টের পর দু-বছর দোকানটা বন্ধ। দেয়ালে পুরনো সেই রক্তের দাগ।
মির্জাপুরের আমার চমৎকার দিনগুলো হঠাৎ বন্ধ হয়ে গেল। সংসার, অর্থনীতি, ঘাড়ের ওপর বসে খাওয়া – ইত্যাকার জটিলতা ও-বয়সে কিছু বুঝিনি। বাবা পলাতক স্বভাব নিয়ে ক্বচিৎ কখনো জ্যাঠামশাইয়ের সামনে হাজির হতেন। একদিন দরজা বন্ধ অবস্থায় দু-ভাইয়ের মধ্যে তক্কাতক্কির আওয়াজ ভেসে আসছিল। তার হপ্তাখানেকের মধ্যে ফের ভাসতে হলো আমাদের।
এবার কোথায়? অস্পষ্ট মনে পড়ছে কয়লার ধোঁয়া নিয়ে ডাকগাড়ি (মেলগাড়ি) ছুটছে, চারপাশে গভীর জঙ্গল।
আর কিছু মনে নেই। তারপর ছোট্ট একটা স্টেশন। চারপাশ রুক্ষ। ভাষা বুঝি না। একটু উঁচু ঘাস-জমি হচ্ছে প্ল্যাটফর্ম, লাল নুড়িপাথরে ছাওয়া। ছোট্ট ছিলে পথ, লাল ধুলো, এঁকেবেঁকে চলে গেছে। আমরা ওই-পথে হেঁটে লাল রঙের বেঁটে একটা রেল কোয়ার্টারের বারান্দায় গিয়ে উঠলাম। স্টেশনটার নাম মনে আছে হলুদ একখ- পাথরে কালো অক্ষরে হিন্দিতে লেখা ‘বিল্হা’।
সেই দেশভাগের পর যে পিসিমার ছেলে মাকে নিয়ে গিয়েছিল! নাম বীরেশ্বর মুখার্জি – আমরা ডাকতাম বীরু দাদু। সম্পর্কে দাদা কিন্তু বয়সে অনেক বড় বলে আমরা দাদু বলতাম।
আদিগন্ত ধুধু মাঠ, দূরে দূরে ঝাঁকড়া দু-চারটে বৃক্ষ। কোথায় মির্জাপুর, আর কোথায় এই বিভুঁই। হিন্দি কথাবার্তা। মোষের পিঠে চেপে লোকজন মাঠ পার হয়। কোয়ার্টারঘেরা ছোট্ট বাগান করেছে পিসিমা। বীরু দাদু রাতবিরেতে ডাক পেয়ে স্টেশনে যায়। এই প্রথম আমি রেলের সিগন্যাল দেখলাম। হাত বাড়িয়ে থাকে নয়তো ঘাড় কাত। ঘাড় কাত করা মানে কোনো গাড়ি লাইন ধরে ছুটে যাবে।
ছোট্ট স্টেশন। গাড়ি থামে খুব কম। বেশির ভাগই ছুটে বেরিয়ে যায়। তখন নাকি সবুজ পতাকা হাতে দোলাতে হয় বীরু দাদুকে।
পিসিমা এখানে হিন্দি শেখার পাঠশালায় ভর্তি করিয়ে দিয়েছিল। বুড়ো হাড়গিলে চেহারার প-িত। চোখ বুজলে এখনো দেখতে পাই, টিকি-ফোঁটাওয়ালা প-িত থুথু ছিটিয়ে কথা বলে। মুখ থেকে মাটি মাটি গন্ধ। সম্ভবত প্রজাতন্ত্র দিবস ছিল, আমাদের সকল বাচ্চাকে চটি একটা হিন্দি বই ও সেøটে লিখবার পেনসিল, একটি চিনির গাদের লজেন্স ফ্রিতে সকলকে দিয়েছিল। ওখানে আমাকে বড় বড় চেহারার কিছু সহপাঠী হিন্দির কিছু অশ্লীল শব্দ শিখিয়েছিল। ওগুলো খারাপ কথা জানতাম। বীরু দাদু একদিন শুনে জিভ কেটেছিলেন। বারণ করেছিলেন আর যেন উচ্চারণ না করি। একটি শব্দ আজো মনে আছে – ‘ভোসরি’!
বীরু দাদু আমাকে মজার মজার ভূতের গল্প বলতেন। রেললাইন-সংক্রান্ত ভূতের গল্প। একবার নাকি বিল্হার পরের স্টেশন দাদাপাড়া থেকে লাইন ধরে হেঁটে আসছিলেন। অনেক রাত। হঠাৎ কোত্থেকে গোল গোল পাথর পড়তে শুরু করল। মজার ব্যাপার, পায়ের কাছে পাথর পড়ে আর ছিটকায় না। ওখানেই গেঁথে থাকে। চারদিকে চামসে গন্ধ। শেষে বীরু দাদু রাম নাম করতে করতে কোয়ার্টারে ফেরেন।
বিকেলের দিকে দেখলাম স্টেশনের কাছে কিছু যুবক গলায় ঝুড়ি ঝুলিয়ে চিনাবাদাম বেচছে। সকলেরই কাছে একটা কেরোসিনের লম্ফ। ওদেশে চিনাবাদামকে বলে ‘মোমফলি’। বীরু দাদু বলেছিল, ওরা নাকি সব সিন্ধি যুবক। দেশভাগ হয়ে ছিটকে এ-প্রান্তে এসে স্বাবলম্বী হতে মোমফলি বেচছে।
মাঝে মাঝে দেখতাম ডাকগাড়িতে গাদিয়ে প্যাসেঞ্জাররা কী যেন সেøাগান দিতে দিতে চলেছে। বীরু দাদুর মুখে শুনেছিলাম ওরা সব দলবল নিয়ে নাথুরাম গড্সের মুক্তির দাবিতে চলেছে। মুক্তির জন্য না ফাঁসির দাবি – বীরু দাদু কী বলেছিল মনে নেই আজ। আমি নিতান্ত বালক। মনে না থাকার কথা। তবে, বালকের বয়সের, বালকোচিত কিছু চিহ্ন মনে আছে। কোয়ার্টারের ছোট্ট ক্ষেতের এক কোণে আমি কাঠি দিয়ে সিগন্যাল বানিয়েছিলাম। একটা কাঠি মাটিতে পোঁতা আর সুতো দিয়ে একটা কাঠি ঘাড়ের সঙ্গে এমনভাবে বাঁধা, যেন একটা হাত মেলে রেখেছে। যেই কোনো ডাকগাড়ি ঝমঝমিয়ে স্টেশন দিয়ে বেরিয়ে যেত, ছুটে বাইরে গিয়ে হাতটাকে নামিয়ে দিতাম। যেন আমার ক্লিয়ারেন্সে গাড়িটা অমন বেগে ঝলমলিয়ে ছুটে গেল। এক-আধদিন বীরু দাদু আমার সঙ্গে রঙ্গ করতেন, যা! যা! সিগন্যাল না থাকলে গাড়ি থেমে যাবে? সেদিন সত্যিই ভাবতাম হয়তো ঘ্যাস্ করে গাড়িটা দাঁড়িয়ে পড়বে। দরজা খুলে ছুটে গিয়ে সন্ধ্যা রাতেও কাঠির ঘাড় নামিয়ে দিতাম। কোনো দিন গভীর রাতে ঘুম ভাঙলে ভয়ে সিগ্ন্যাল দিতে পারতাম না। ভাবতাম, ভোরে উঠে দেখব গাড়িটা দাঁড়িয়ে আছে। আলো ফুটলেই দরজা খুলে বারান্দায় দাঁড়িয়ে নজরে পড়ত খাঁ-খাঁ লাইনটা; কোনো ডাকগাড়ি দাড়িয়ে নেই।
আমার পলাতক স্বভাবের পিতা, এই পা-ববর্জিত পরিবেশে কচিৎ কখনো আরেসারে এসে পিসিমার সঙ্গে কীসব কথাবার্তা বলে চলে যেত।
ফের একদিন আমরাও পাততাড়ি গুটিয়ে চলে গেলাম। কারা সঙ্গে ছিল, কীভাবে গেলাম – আজ স্মৃতি থেকে সম্পূর্ণ মুছে গেছে।
শুধু মনে আছে, জায়গাটার নাম কালীপাহাড়ি। রানীগঞ্জের কাছে। কয়লা খাদানের অঞ্চল। আবছা মনে আছে, বিধবা জ্যাঠিমা তার সন্তানদের নিয়ে ফের কালিপাহাড়ীতে একত্রিত হয়েছিল। কালে খাঁ-কে আমাদের পরিবারের সকল সম্পত্তি দেখভালের দায়ভার গছিয়ে জ্যাঠিমা সন্তানদের নিয়ে চলে এসেছিলেন এ-পাড়ে। তখনো দুই অংশে অবাধ চলাচল ছিল, কিন্তু ঝক্কি বিশাল। জ্যাঠিমা শেষ পর্যন্ত দেশের ওই গিলে খাওয়া বিসর্জিত হাতে নিজেকে নিরাপদ মনে করতে পারেনি। দু-মেয়েও তখন ঋতুকালে প্রবেশ করেছিল।
কালিপাহাড়ীতে সম্ভবত কয়েকটা মাস অবস্থান করেছিলাম, কোনো স্মৃতি আজ তাই ভেসে উঠছে না। কেবল মনে পড়ছে, ভীষণ নির্জনতা, বড় বড় ঘাসের বাসা, মস্ত একটা বটগাছের ছায়াঘেরা, উঠোনে কপিকল লাগানো মস্ত একটা কুয়ো। ও-দেশে বলত ‘চানক’। জ্যাঠিমা আর মা’র চোখমুখে সর্বদা আতঙ্ক। ওটা নাকি ডাকাতদের এলাকা।
তারপর আসানসোল। আমার পলাতক স্বভাবের পিতা এখানেও সংসারে বিশেষ হাজির থাকতেন না। পাঁচিলঘেরা, বিশাল এরিয়ার একটা বাড়ি। সর্বদা যেন আমাদের গিলে খেত। শুনেছিলাম, বাড়িটা ছিল মহাযুদ্ধে ব্যবহৃত পরিত্যক্ত কোনো ডিপো। আমার মা এবং জ্যাঠাইমা – দুই নারী অজানা-অচেনা দেশে সংসারের কা-ারি। মা রান্নাবান্নায় ব্যস্ত, মুখচোরা, ঘরোয়া স্বভাবের। বিধবা জ্যাঠাইমা বলতে গেলে ধাপাখাপা পুরুষ সদস্য। এতগুলো ছেলেমেয়ে, শিশুকে নিয়ে বিভুঁইয়ে দিনগুজরান কি চাট্টিখানি ব্যাপার।
সে-বয়সে অবিশ্যি এসব গুহ্য বিষয় মাথায় রাখার কথা নয়। অচেনা আনন্দে মেতে থাকতাম। বাড়ির সীমানায় শিশু-জাম-শিমুলের গায়ে ভোরের রোদ, সন্ধ্যার আঁধার থেকে কাকের বাসা, পাখির ডিম – আর জানলায় বসে পথ ধরে হাঁটা ‘হাওয়াই মিঠাই’, ‘আইসক্রিম’, ‘ছাতি সারাই’ নানা স্বরের অদ্ভুত ডাক।
অঞ্চলটার নাম বুধাডাঙা। চলাচলের পথের চিহ্ন ছাড়া, সরকারি স্বীকৃত রাস্তা নেই। কখনো মাঠ চিরে, কখনো এর-ওর ঘরের পাশ দিয়ে কিংবা প্রাচীন কোনো পুকুরের উঁচু পাড় ধরে মানুষজন চলাচল করত। বিশেষত, বার্নপুরের লোহার কারখানায় খাটতে যাওয়া কিছু মজুর চলাচল করত এ-পথ ধরে। স্থানীয় বাসিন্দাদের মধ্যে ছিল কিছু বাঙালি খ্রিষ্টান, কিছু বিহারি মুসলমান, বাউড়ি জনজাতি। বিচিত্র জীবিকা – ঘোড়ার গাড়ি চালায়, কেউ মুদি দোকান খুলে আছে, মাটির হাঁড়ি-কলসি বানায়। ছাতি সারানো হয়, দর্জির মেশিন চলে কোথাও; আর আছে আমাদের মতো দু-একঘর বাস্তুত্যাগী।
জুয়া, মাতলামো, ভানুমতীর ভেল্কি দেখানো – আমার মধ্যে অপার রহস্য সৃষ্টি করে দিনগুলো কাটছিল। ক্বচিৎ ধুলোর রাস্তায় কেউ হয়তো আমার কান বা থুতনি ধরে লাল পুরনো দিনের পয়সা বার করে ফেলত।
রোদের মধ্যে বিড়ি ফুঁকতে ফুঁকতে কয়েকজন হয়তো গোল হয়ে বসে জুয়া খেলত। নির্দিষ্ট গোল সীমানায় এক আনা-দুআনা পয়সা ছড়িয়ে বসত; যার পয়সায় প্রথম মাছি বসবে – সবটাই তার। এদের ছেলেপুলেদের সঙ্গে মিশতে ভালো লাগত জ্যাঠাইমার নিষেধ থাকা সত্ত্বেও।
এরা আমাকে হাওয়াই মিঠাই খাওয়ার লোভ দেখিয়ে, বাস্তুত্যাগী পরিবারের মেয়েদের সম্পর্কে নানা অসত্য কথা শিখিয়ে দিত।
আর ছিল আমাদের বাসাটার পেছনে মস্ত একটা দিঘির ওপাশে পুরনো একটা পাড়া। নাম আগুরি পাড়া। পরে জেনেছিলাম, শব্দটা উগ্রক্ষত্রিয়। এককালে নাকি বর্ধমান মহারাজের লেঠেল, বরকন্দাজের কাজ করত।
মাঝেমাঝে বিকেলের দিকে পঙ্গপালের মতো হানা দিয়ে বাস্তুত্যাগী পরিবারের ছেলেপুলেদের ওপর হামলা করত। চুল টানত, চিমটি কাটত, কখনো ছড়ি হাতে শপাং শপাং গায়ে চালাত। বিশেষ করে, মাথায় একটু লম্বা হলে রক্ষে নেই।
এখানেই প্রাইমারিতে ভর্তি হয়েছিলাম। টু-ক্লাসে। একজন আগুরি স্যার আমাদের ক্লাস নিতেন। খুবই ভালো। কিন্তু জুলফি ধরে টান দেওয়া তাঁর স্বভাব। হাসতে হাসতে কথায় কথায়! প্রথম দিন, মনে আছে আজো, ক্লাসে সব্বার কাছে জানতে চেয়েছিলেন কে কোথা থেকে এসছে। কেউ বর্ধমান, মেদিনীপুর, কেউবা বাঁকুড়া বলছে। হঠাৎ আমি বললাম, পূর্ববঙ্গ।
হেসে ‘তুই বাঙাল?’ বলে একটা ছড়া কেটে দিলেন
বাঙাল মনুষ্য নয়, উড়ে এক জন্তু,
লাফ দিয়ে গাছে ওঠে,
ল্যাজ নাই কিন্তু!
পরে ক্লাস ফোর-অবধি আমি পরীক্ষায় প্রথম হতে, অরুণ স্যর আমায় ভীষণ স্নেহ করতেন। প্রাইমারি পাশের পরপরই ফের ভাঙা জাহাজ বন্দর ছাড়তে বাধ্য হলো। আমার পলাতক স্বভাবের পিতা এক রাতে হঠাৎ হাজির হয়ে, কেন জানি জ্যাঠাইমার সঙ্গে ঝগড়া করলেন। কান্নাকাটির শব্দ হলো। পরের পরের দিন লটঘট নিয়ে চিরতরে আসানসোল ত্যাগ।
একটু বয়স হলে মা-র কাছে জানতে পেরেছিলাম বাবা তার নিকট এক জ্ঞাতির ইটভাটায় ম্যানেজারি করত। দেশের বাড়ির ভিটেয় তারা পশ্চিমের দিকে থাকত। বাবা হঠাৎ আঙুল ফুলে কলাগাছের দিনে তাদের হাঁড়ি চড়ত না। গোপনে এসে আমাদের পিসিমার কাছ থেকে চাল ধার করত। দেশভাগের আগেই এদিকে এসে সচ্ছল হয়ে পড়েছিল।
এলাম, কলকাতার উপকণ্ঠে, গঙ্গার ধারে সম্পূর্ণ এ-দেশীয় অঞ্চল সুখচর। তবে, আসানসোল স্মৃতিতে জেঁকে রইল। অরুণ স্যারের ছড়াটি ছাড়াও একটি দিনের কথা, সম্পূর্ণ রহস্যের কথা – যা আজো আমার জীবনে অমীমাংসিত একটি রহস্য।
ক্লাস ফোরে পড়ি। জ্যাঠাইমার অনুমতি পেয়ে গমের থলি নিয়ে ভাঙিয়ে আনতে হয়। একদিন নিস্তব্ধ দুপুরে, নির্জন মাঠ ঝোপময়, ভাঙাচোরা বহু পুরনো বাড়ির পাশ ধরে বাড়ি ফিরছি। চারপাশ ধু-ধু। হঠাৎ দেখি ভাঙা দেয়ালের একটি ফোকরে এক স্তূপ চকচকে কয়েন – আনি, সিকি, পয়সা। এই ঘন দুপুরে চৌহদ্দির মধ্যে কোনো জনপ্রাণীর টিকি নেই। আমার কচি বুকটা লোভে চঞ্চল হলো। এপাশ-ওপাশ তাকিয়ে চটপট একমুঠো তুলে পকেটে ভরলাম। মনের আনন্দে হাঁটলাম বাসার উদ্দেশে। আমাকে পায় কে! মনের সুখে ‘হাওয়াই মিঠাই’ খাব।
সদর দরজার কাছে পৌঁছে মনে হলো, পকেটে যে সংসারের গম ভাঙানোর ফেরত পয়সা ছিল, গুণে আলাদা করে রাখি। নইলে এতগুলো পয়সার জবাবদিহি করতে হবে। পকেটে চুপি চুপি হাত দিয়ে দেখি, সংসারের পয়সা কটিই পড়ে আছে। বাকিটা ফক্কা!
এক বছর সুখচরের বাসায়। পলাতক স্বভাবের পিতাকে দেখতাম একগাল কাঁচাপাকা দাড়ি রেখে খাটিয়ায় শুয়ে থাকতেন আর বিকেল হলে বেরিয়ে যেতেন। মা বলত, মির্জাপুরে জ্যাঠামশাইয়ের পুরনো বাসায় দেখা করতে যায়। তখন তো উপলব্ধির বয়স হয়েছে আমার। বাবার মধ্যে লক্ষ করতাম আমার ওপর হঠাৎ হঠাৎ ক্ষেপে যাওয়া এবং ভরসার স্থান খোঁজার অদ্ভুত এক গোঁজামিল।
পরের বছর, মাইল তিনেক পুবে, ন্যানশিকা অঞ্চলে চলে এলাম। সেখানে ঝোপ, জঙ্গল, বাঁশবন, কাঁটাবন, ধানক্ষেত ছাড়া দেশভাগের আগে কোনো জনবসতি ছিল না। দেশের বাড়ির, বাবার বাল্যের কিছু পরিচিত, ঢেউয়ে ভেসে ভেসে এখানে আস্তানা গেড়েছিল। তাদেরই উৎসাহে বাবা ঝাঁপ দিলেন। পঞ্চাশের দশক তখন। সস্তা-গ-ার বাজার যদিও, বাবা স্বভাবজাত পলায়মানতা নিয়ে কোথায় যে থাকতেন, জানতাম না। জ্যাঠাইমারা সেই যে আসানসোল ত্যাগের পর বিচ্ছিন্ন, বহু রাত চোখের জল ভিজিয়েও দেখা করতে পারতাম না। সারা পঞ্চাশ দশক। মা সংসার আগলে ছিল। সন্তানদের মুখে দুটো অন্ন তুলে দিতে তার নীরব সংগ্রাম টের পেতাম। আজ বুঝি, বেনামে ভিক্ষাবৃত্তিও মাথা পেতে নিতে হতো মাকে। খুবই সস্তা-গ-ার দিন যদিও। আমরা ভাইবোনরা সারাজীবন জিভের ঘায়ে ভুগতাম। মা বলত, সোহাগায় জিভের ঘা সারে। কোথায় সোহাগা? শব্দটি আজো যেন চমৎকারভাবে চোখ বুঝলেই নৃত্যরত দেখি।
ষাটের দশকের শুরুর কয়েক বছর পরই বাধ্য হলাম উপার্জনে নামতে। বাবা ফিরে এলেন। অকর্মণ্য মন ও ভাঙা শরীর নিয়ে। এক রাতে রক্তবমি শুরু। সরকারি হাসপাতাল। রাত জাগলাম না সেখানে। পরদিন থানা থেকে খবর। সে-যুগে কাঁধের গাড়ি ছিল না। কাঁধে চেপে শ্মশানে। এ-সব কা-ে আমার মধ্যে বিশেষ প্রতিক্রিয়া ছিল না। একটানা শৈশবে একটা ঘটনা ঘটল যেন, যা অন্য মানুষকে একটা মতবাদ হিসেবে দিতে পারব।
ভারি অবাক হয়েছিলাম শ্মশানে। তখন এ-সব এলাকার শ্মশানে ইলেকট্রিক চুল্লি ছিল না। কাঠ ও চিতা। দাউ দাউ আগুন জ্বলা।
পিতা ভস্ম হবার পর, প্রথম টের পেলাম গোপনে, বাবার পিঠে একটা কাঠের ক্রুশ। গোপনে বয়ে নিয়ে পলাতক হয়ে থাকতেন।
এত আগুনেও সেটি পুরো দগ্ধ হয়নি। বলতে গেলে আস্তই আছে। কেউ আমার বিস্ময় সমাধান করতে পারল না। যেন সেই চকচকে এক স্তূপ সিকি-আধুলির অমীমাংসিত স্মৃতি! কে ওটা চাপিয়ে দিয়েছিল?
Leave a Reply
You must be logged in to post a comment.