এক নিভৃতচারীর সক্রিয় জীবন

সত্তর-উত্তীর্ণ মানুষ ক্রমান্বয়ে নিঃসঙ্গ হয়ে পড়ে। বিগত কয়েক মাসে স্বল্পকালের মধ্যে অভিভাবকতুল্যজন, সহপাঠী ও নিকটজনের তিরোধানের ফলে আমাকে একাকিত্ব গ্রাস করেছে। বিশেষ করে অধ্যাপক আনিসুজ্জামান ও আবুল হাসনাতবিহীন কালি ও কলমে হাসনাত সম্পর্কে কিছু লেখা বেশ কষ্টকর।

আবুল হাসনাত সারাজীবন স্বল্পবাক ও নিভৃতচারী। এজন্য আত্মজীবনীতে সে তার আত্মবিশ্বাসের অভাবকে দায়ী করেছে, যদিও বস্তুতপক্ষে দায়টি তার আত্মপ্রচারবিমুখতা ও মাত্রাতিরিক্ত সৌজন্যবোধের। অথচ কিশোর বয়স থেকে সে সক্রিয় জীবন যাপন করেছে, যৌবনে পদার্পণের পর নানা ধারার কাজে জ্ঞানার্জন ও পরিশ্রমের মধ্য দিয়ে দক্ষতার পরিচয় দিয়েছে, মধ্যবয়সে তার জ্ঞান ও চিন্তাধারা পরিণত রূপে প্রকাশ পেয়েছে। যথেষ্ট অনুরোধ সত্ত্বেও তাকে মঞ্চে আসীন করা যায় না, অনিচ্ছাসত্ত্বেও মঞ্চে উপস্থিত হলে সে সংক্ষিপ্ত লিখিত বক্তব্যের মধ্যে আপন অবস্থানকে সীমিত রাখে।

যে-দেশে সকলে মঞ্চে স্থান নিতে ব্যাকুল, সে-দেশে এ-ধরনের ব্যতিক্রমী ব্যক্তি নিয়ে কিছু সংগঠক প্রায়শ স্বস্তিবোধ করে। এই মিতবাক ব্যক্তিকে নিয়ে আর একটি সমস্যা রয়েছে। কেউ কটু কথা বললে কিংবা কোনো কারণে সে অসম্মানিত বোধ করলেও তা নীরবে মেনে নেয়। তার অন্তরে যে-রক্তক্ষরণ ঘটে, সেটি অনেকে টের পান না।

বাবার কঠোর শাসন ও মায়ের প্রশ্রয়ে হাসনাত বেড়ে উঠেছে। নিজ অভিজ্ঞতা থেকেই নালন্দা বিদ্যালয়ের দায়িত্ব গ্রহণের পর হাসনাত শিক্ষকদের এক সভায় স্মরণ করিয়েছে যে, কঠোর শাসন শৈশবকালেই শিশুর স্বাভাবিক বিকাশের পথ রুদ্ধ করে দিতে পারে। মায়ের পূর্বপুরুষ ছিলেন উত্তর ভারতে সুফিবাদের দর্শনে বিশ্বাসী আর তিনি নিজে স্বশিক্ষিত মানুষ। তাঁর প্রশ্রয়েই হাসনাতের ব্যবসায় যোগদানের জন্য বাবার আগ্রহ থাকা সত্ত্বেও উচ্চশিক্ষা গ্রহণের সুযোগ ঘটেছে, ভিক্টোরিয়া ক্লাবের পক্ষ থেকে প্রথম শ্রেণির ক্রিকেট খেলার সম্ভাবনা সৃষ্টি হয়েছে, এমনকি ছাত্র-আন্দোলনে যোগ দেওয়া সম্ভব হয়েছে। তিনিই তাঁর নাতনিকে প্রতি সপ্তাহে সংগীতশিক্ষার জন্য ছায়ানটে পৌঁছে দিয়েছেন। কিশোর বয়স থেকে হাসনাতের উদার ও মুক্ত চিন্তাধারা এবং শ্রেয়বোধ মায়ের কাছ থেকে পাওয়া, এমনকি স্ত্রীর সঙ্গে সমমর্যাদার ব্যবহারটিও ছিল মায়ের উপদেশ। সেটি শাণিত হয়েছে বামপন্থী ছাত্র-আন্দোলন ও সাহিত্য-সাধনায়। নবাব দেউড়ি, হাজী ওসমান গনি ও যুগীনগরে বেড়ে ওঠা হাসনাত ঢাকার আদিবাসীদের জীবনযাপন ও চিন্তাধারা সম্পর্কে বিশিষ্টজনের মনোগ্রাহী রচনা পাঠ করেছে বটে, তবে সে এই ধারাকে অতিক্রম করে আধুনিক চিন্তামনস্ক ব্যক্তিত্বে পরিণত হয়েছে। সমাজতত্ত্ববিদরা জানেন যে, ভাষা-আন্দোলনে নেতৃত্ব দিয়েছেন বাঙালি মুসলমান সমাজের প্রথম প্রজন্মের আধুনিক শিক্ষার শিক্ষার্থীরা, এই প্রথম প্রজন্মের শিক্ষিতরাই বাংলাদেশে মধ্যবিত্ত সমাজের ভিত গড়ে তোলেন। হাসনাত এ-ধারায় শামিল আধুনিক চিন্তামনস্ক ব্যক্তি।

আবুল হাসনাতের পারিবারিক জীবন আর্থিক টানাপড়েনের মধ্যে অতিবাহিত হয়েছে। সে-কারণে ছাত্রাবস্থায় তাকে চাকরির সন্ধান করতে হয়েছে, ১৯৬৫ সালে দৈনিক সংবাদে শিক্ষানবিশ ও পরে সহকারী সম্পাদক পদে চাকরি করেছে। তখন সে ষাটের দশকের ছাত্র-আন্দোলনে গভীরভাবে যুক্ত। তার জন্য সে নাইট শিফটে সাংবাদিকতাকে বেছে নেয়। সারাদিন কাটে মধুর ক্যান্টিন, ৩১/১ হোসেনি দালানের ছাত্র ইউনিয়ন দফতর কিংবা ছাত্রাবাসকেন্দ্রিক সভায় ও প্রায়শ দীর্ঘপথের মিছিলে, দুপুরের খাদ্যগ্রহণ করে বকশীবাজারের পপুলার বা ডেলাইট রেস্তোরাঁয় এবং সন্ধ্যা থেকে গভীর রাত অবধি সংবাদ কার্যালয়ে। কী প্রচণ্ড পরিশ্রমী সক্রিয় জীবনযাপন। প্রতিটি কাজ সে নিষ্ঠার সঙ্গে করে। দৈনিক সংবাদে কর্মরত সন্তোষ গুপ্তের ভাষায় – ‘হাসনাত যখন কাজ করে, তখন সে ঘড়ির দিকে তাকায় না।’

আবুল হাসনাতের জীবনধারাকে বদলে দিয়েছিল তার বাল্যজীবনের বন্ধু মতিউর রহমান। অথচ, দুজন বিপরীতধর্মী চরিত্রের। মতি চৌকস দক্ষ সংগঠক ও সহজে বন্ধুত্ব গড়ে তুলতে সমর্থ, আর হাসনাত অন্তর্মুখী মিতবাক, সর্বদা নিজেকে নিয়ে সংকোচে রয়েছে। আনিসুজ্জামানের মতোই বন্ধুসূত্রে সে সাম্যবাদে পাঠ নিয়েছে, ছাত্র ইউনিয়নে যোগ দিয়েছে, ১৯৬৫ সালে পংকজ ভট্টাচার্যের সূত্রে নিষিদ্ধ কমিউনিস্ট পার্টির সদস্যপদ লাভ করেছে। এটি অবশ্য অস্বাভাবিক ঘটনা নয়। বিংশ শতাব্দীর পঞ্চাশ থেকে সত্তরের দশক অবধি সারাবিশ্বের সেরা সৃজনশীল শিল্পী-সাহিত্যিক-বুদ্ধিজীবীরা বৈষম্যপীড়িত দেশে বসবাস করে মানবিক মূল্যবোধ থেকে সমাজতন্ত্রের প্রতি আকৃষ্ট হয়েছেন; আবার তাঁদের অনেকেই রাষ্ট্রনিয়ন্ত্রিত সংস্কৃতি-চিন্তা এবং সোভিয়েত ইউনিয়নের সকল নীতি ও কৌশলের ক্ষেত্রে অন্ধ আনুগত্যের কারণে দলত্যাগ করেছেন।

পূর্ব পাকিস্তানের মূলধারার রাজনীতি ছিল গণতান্ত্রিক ও জাতীয়তাবাদী চরিত্রের – বায়ান্নোতে বাঙালি মুসলমানদের স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের সূচনা ঘটেছে; সামরিক শাসনাধীন ষাটের দশকে সেটি পরিণত হয়েছে এবং ’৬৬ থেকে তা পরিপূর্ণতা অর্জন করেছে। স্বজাত্য সন্ধানে অভিসারী মূলধারার ছাত্র-আন্দোলনে সক্রিয় অংশগ্রহণকারী আবুল হাসনাতের মননে তার স্বাভাবিক প্রভাব ঘটেছে। সে যৌবনের প্রারম্ভে মূলত পণ্ডিত দার্শনিক রণেশ দাশগুপ্তের প্রেরণায় প্রধানত বামপন্থী দেশ-বিদেশের সাহিত্য ও প্রবন্ধ পাঠে অভ্যস্ত থাকলেও বাঙালি জাতিসত্তার পুনর্জাগরণের আন্দোলনের ধারায় সে ক্রমাগত রবীন্দ্রনাথ ও সমকালীন সাহিত্যিকদের রচনার আগ্রহী পাঠক ও বিশ্লেষকে পরিণত হয়। সখ্য গড়ে ওঠে শামসুর রাহমান, আনিসুজ্জামান ও সৈয়দ শামসুল হকের সঙ্গে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা বিভাগে শিক্ষা গ্রহণকালে আবুল হাসনাতের উত্তরণ ঘটেছে চিরন্তন বাংলা সাহিত্যের একজন মনোগ্রাহী পাঠকরূপে। সুভাষ মুখোপাধ্যায় তার স্বপ্নের কবি; কিন্তু জীবনানন্দ দাশের কবিতা সম্পর্কে তাঁর বিরূপ মন্তব্য তাকে পীড়িত করেছে। বরং সে বুদ্ধদেব বসু, বিষ্ণু দে ও অলোকরঞ্জন দাশের লেখনীকে বিশেষ গুরুত্ব দিয়েছে। সর্বোপরি তার হৃদয় জুড়ে ছিল রবীন্দ্রনাথের রচনা ও জীবনদর্শন। গত বছর সিরাজগঞ্জে জাতীয় রবীন্দ্রসংগীত সম্মিলন পরিষদের সম্মেলনে সে রবীন্দ্রনাথের তিনটি নাটকের প্রাসঙ্গিকতা নিয়ে আলোচনা করেছে। আবুল হাসনাতের চিন্তাধারায় এই রূপান্তরে বিশেষ মাত্রা যুক্ত করে সংস্কৃতি কর্মকাণ্ডে তার যুক্ততা। এ-বিষয়টি পরে বিস্তার করা যেতে পারে – কারণ এটি  হাসনাতের জীবন ও কর্মের বড় অংশ জুড়ে রয়েছে। পাশাপাশি, সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধ-পূর্বে ও মুক্তিযুদ্ধকালে হাঙ্গেরি ও চেকোস্লোভাকিয়ায় সোভিয়েত সামরিক বাহিনীর অভিযানের প্রতি কমিউনিস্ট পার্টির সমর্থন এবং সর্বশেষ পঁচাত্তরের মর্মান্তিক ঘটনার পর সোভিয়েত পার্টির পরামর্শে ভ্রান্ত সিদ্ধান্তের কারণে সে ক্রমান্বয়ে দলের সংসর্গ ত্যাগ করে সাহিত্যসাধনার কর্মযজ্ঞে নিজেকে পরিপূর্ণভাবে সমর্পণ করে। অবশ্য আবুল হাসনাত রাজনীতি-উদাসীন নয়, সে সমাজসচেতন, সকল অনাচারের বিরুদ্ধে আমৃত্যু সে সমতাভিত্তিক সমাজ গঠনে বিশ্বাসী ছিল।

দুই

আমার সঙ্গে আবুল হাসনাতের পরিচয় ছয় দশকের। বাষট্টির সামরিক শাসনবিরোধী ছাত্র-আন্দোলনের শেষে কিছুটা সময় পাওয়া গেলে ছাত্র সংগঠনগুলোর দফতরে কার্যক্রম শুরু হয়। ১৯৬৩-৬৪ সালে ছাত্র ইউনিয়নের কার্যালয় প্রান্তিক ও ৩১/১ হোসেনি দালানে, তখন মতি ও হাসনাতের প্রবেশ ঘটে। আবুল হাসনাত যুক্ত হয়ে পড়ে ষাটের দশকে ছাত্র-আন্দোলনের স্বর্ণযুগের সকল কার্যক্রমে। সে-সময় ক্ষমতার সঙ্গে সংগঠনের সংশ্লিষ্টতা ছাত্র সংগঠনগুলোকে কলুষিত করেনি। সে প্রধান দায়িত্ব গ্রহণ করে প্রকাশনার। বিশেষ করে একুশে ফেব্রুয়ারিতে ছাত্র ইউনিয়নের পক্ষ থেকে যে-সাময়িকী প্রকাশ পেয়েছে সেগুলোতে লেখা সংগ্রহ, প্রচ্ছদ ও অঙ্গসজ্জার মূল দায়িত্ব গ্রহণ করে। সে-সূত্রেই আনিসুজ্জামান, শামসুর রাহমান ও অন্য বুদ্ধিজীবীদের সঙ্গে তার যোগাযোগ ও সখ্য গড়ে ওঠে। সে-সময় প্রান্তিক ও হোসেনি দালানে রফিকুন নবী, বীরেন সোম, গোলাম সারওয়ার, আলভী, হাসান আহমেদ নিয়মিত পোস্টার লিখেছেন, নির্দেশনায় ইমদাদ হোসেন, দেবদাস চক্রবর্তী ও প্রাণেশ মণ্ডল, আর অভিভাবকত্বে পটুয়া কামরুল হাসান। তাঁদের সকলের সঙ্গে আবুল হাসনাতের প্রাথমিক সংযোগ সে-সময় ঘটেছে, যে-সম্পর্ক পরবর্তীকালে সমৃদ্ধ হয়েছে এবং সে উচ্চমানের চিত্রকলা-সমালোচকে পরিণত হয়েছে। ১৯৬৭ সালে আপন কর্মতৎপরতা ও দক্ষতাগুণে সে কেন্দ্রীয় কমিটির প্রথমে সাংস্কৃতিক সম্পাদক ও পরে সহসভাপতি নির্বাচিত হয়। সে সক্রিয়ভাবে যুক্ত ছিল ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থানে। বিশেষভাবে উল্লেখ্য, ২২শে ফেব্রুয়ারি ১৯৭১ সালের উত্তাল দিনে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে ছাত্র ইউনিয়নের উদ্যোগে যে-বিশাল ছাত্র-জনসমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়, এই সভায় সভাপতিত্ব করে আবুল হাসনাত। এই সভায় ছাত্র ইউনিয়নের পক্ষ থেকে কমিউনিস্ট পার্টি নেতৃত্বের দ্বিধা উপেক্ষা করে বাংলাদেশের স্বাধীনতার দাবি উত্থাপিত হয়। মুক্তিযুদ্ধকালে সে কলকাতার আমির আলী অ্যাভিনিউয়ে পার্টির দফতরের দায়িত্ব গ্রহণ করে, দাফতরিক কাজের পাশাপাশি পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন প্রান্তে শরণার্থী শিবির ও মুক্তিযোদ্ধাদের ক্যাম্পে খাদ্য, অন্যান্য রসদ ও ইশতাহার পৌঁছে দিয়েছে। আর প্রায় হানা দিয়েছে তার প্রিয় লেখকদের বাসভবনে। কলকাতা-বিশারদ হাসনাতের সঙ্গে পশ্চিমবঙ্গে শিল্পী-সাহিত্যিকদের এ-সময়কালে প্রাথমিক পরিচয় পরবর্তী জীবনে তার সাহিত্য সাধনাকে ঋদ্ধ করেছে।

১৯৭৪ সালে দৈনিক সংবাদের সাহিত্য সাময়িকীর দায়িত্ব গ্রহণের পর, হাসনাতের এই ছাত্র ও জাতীয় রাজনীতি সক্রিয়তার সঙ্গে মিল খুঁজে পাওয়া যাবে না। তবে অনস্বীকার্য যে, বাঙালি জাতির পুনর্জাগরণের মাহেন্দ্রক্ষণে আবুল হাসনাতের যুক্ততা তার সমাজসচেতনতাকে সমৃদ্ধ করেছে, বিশেষ করে তার রচিত কবিতায় তার প্রভাব লক্ষ করা যাবে। ’৬৫ থেকে ’৬৮ অবধি তার ঢাকার তামাক ব্যবসায়ী পাঠান আলী হায়দারের সাথে দলীয় সূত্রে বন্ধুত্ব গড়ে ওঠে, পশতু কবি আজমল খাটকের সঙ্গে  সে পরিচিত হয় এবং শিশুসাহিত্য ছাড়া তার প্রথম পশতু কবিদের অনুবাদগ্রন্থ প্রকাশ পায়।

আবুল হাসনাত বাহাত্তরে গণসাহিত্য, চুয়াত্তর থেকে দৈনিক সংবাদের সাহিত্য সাময়িকী ও সংবাদ ছাড়ার পর কালি ও কলমের সম্পাদনায় চার দশকের মতো সময় অতিবাহিত করেছে, সর্বজনের কাছে সেটিই তার প্রধান পরিচয়। তার মৃত্যুর পর মূলধারার সংবাদপত্র ও তথ্যমাধ্যমে নবীন ও প্রতিষ্ঠিত লেখকরা যে-অভিব্যক্তি প্রকাশ করেছেন তাতে মনে হয়, সে তার নিকটজনদের অগোচরে শিল্পী-সাহিত্যিক-বুদ্ধিজীবীদের শ্রদ্ধা ও ভালোবাসার অনন্য উচ্চতায় আসীন হয়েছিল। সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম তাকে একটি বই উৎসর্গ করেছেন। সেখানে তিনি আবুল হাসনাতকে উৎসর্গপত্রে লিপিবদ্ধ করেছেন যে সে‘সম্পাদকদের সম্পাদক’। বাংলা ভাষা, সাহিত্য, শিল্পকলা ও অঙ্গসজ্জায় সে দৈনিক সংবাদের সাময়িকীকে এমন এক পর্যায়ে উন্নীত করতে সমর্থ হয়েছিল যে, কথাসাহিত্যিক সেলিনা হোসেনের ভাষায় তিনি নানাভাবে তাঁর দৃষ্টি আকর্ষণের চেষ্টা করেছেন। আর হাসনাত ওঁর উপন্যাসের মান সম্পর্কে এতটাই নিশ্চিত হয়েছিল যে, সে সেলিনা হোসেনের ধারাবাহিক উপন্যাস প্রকাশ করেছে। জনপ্রিয় কথাসাহিত্যিক ইমদাদুল হক মিলন লিখেছেন যে, দৈনিক বাংলার সাহিত্য সাময়িকীর সম্পাদক কবি আহসান হাবীব ও সংবাদের আবুল হাসনাতের হাত দিয়ে লেখা ছাপা হলে সে-লেখককে আর পিছনে ফিরে তাকাতে হবে না। সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম আরো জানাচ্ছেন যে, হাসনাতভাইয়ের কাছে কোনোভাবে ঋণী নয়, এমন মানুষের সংখ্যা কম। অবশ্য আবুল হাসনাতের সম্পাদনাগুণের সম্পূর্ণ পরিণত রূপ লক্ষ করা যায় আনিসুজ্জামানের অভিভাবকত্বে কালি ও কলম সাময়িকীতে, যা সম্ভবত বর্তমানে একমাত্র উচ্চমানের সাহিত্য সাময়িকী। পশ্চিমবঙ্গের বহু পণ্ডিত ও বিশিষ্টজনকে এই বড়মাপের কাজে হাসনাত যুক্ত করতে সমর্থ হয়েছে এবং তাদের প্রশংসা কুড়িয়েছে। আবুল হাসনাত কেবল অগণিত নবীন সাহিত্যিক সৃষ্টি করেনি। তার সম্পাদনায় প্রকাশিত কালি ও কলম প্রবন্ধ, কবিতা, সাহিত্য ও শিল্পকলা সমালোচনায় মূল মানদণ্ড রচনার ভাষা ও সাহিত্যগুণ, এটি জনপ্রিয়তা প্রত্যাশী নয়। উল্লেখ্য, একসময় সমাদৃত পশ্চিমবঙ্গের কিছু সাহিত্য সাময়িকী জনপ্রিয়তার আকর্ষণে তার আদি রূপটি হারিয়েছে। এ-লক্ষ্যটি হাসনাত সুরক্ষা করেছে। ফলে কালি ও কলম গম্ভীর রাশভারী গবেষণালব্ধ দীর্ঘ লেখনীরও সমঝদার পাঠক সৃষ্টি করতে প্রয়াসী হয়েছে; বহুলাংশে সমর্থও হয়েছে।

আবুল হাসনাত একজন কবি। তার ভাষায় – ‘আমি ষাটের দশক থেকে কবিতা লিখেছি কখনো অঙ্গীকারের তাগিদে, কখনো ভাবাবেগে তাড়িত হয়ে’ এবং তার কবিতার ভাষায় ‘মিছিলে নারীর উদ্বেলিত হাতের’ মানুষটিকে জীবনসঙ্গিনী করেছে। তার কবিতা প্রসঙ্গে কবি শামসুর রাহমানের আত্মজীবনী কালের ধুলায় লেখার উদ্ধৃতিটি যথেষ্ট – ‘আবুল হাসনাতের অন্য একটি নাম মাহমুদ আল জামান। দ্বিতীয় নামটির আড়ালে রয়েছে একটি কবিসত্তা, যে তাকে দিয়ে লিখিয়ে নিয়েছে কিছু কবিতা … আমি তার লেখা যে কয়টি পড়েছি, সেগুলো বলে দেয় মাহমুদ আল জামান প্রকৃত কবি মনের অধিকারী।’

যে-বিষয়টি একেবারে উল্লিখিত হয়নি, সেটি হচ্ছে আবুল হাসনাতের সংস্কৃতিবিষয়ক কর্মকাণ্ড ও তার সংস্কৃতিবোধ। ষাটের দশকে উজ্জ্বল সংগঠন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সংস্কৃতি সংসদ। এ-সংগঠনের সে প্রথমে সাধারণ সম্পাদক, আসাদুজ্জামান নূর সভাপতি; পরে হাসনাত সভাপতি, মাহফুজ আনাম সাধারণ সম্পাদক। পাশাপাশি আবুল হাসনাত তখন ছাত্র ইউনিয়নের সাংস্কৃতিক সম্পাদক – সে-সূত্রে বিশেষ করে একুশে ফেব্রুয়ারি সন্ধ্যায় শহিদ মিনারে অনুষ্ঠিত সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের অন্যতম আয়োজক, অনুষ্ঠানে সে ও অন্যরা অংশী করেছে আলতাফ মাহমুদ, শেখ লুৎফর রহমান, অজিত রায় ও ফাহমিদা খাতুনকে, যে-অনুষ্ঠানে রবীন্দ্র ও নজরুল সংগীতের সঙ্গে যোগ হয়েছে গণসংগীত। সংস্কৃতি সংসদের উদ্যোগে বড় আয়োজন মাসুদ আলী খানের পরিচালনায় তাসের দেশ, যার পোশাকসজ্জায় ছিলেন মুস্তাফা মনোয়ার। পরবর্তী আয়োজন সৈয়দ হাসান ইমামের পরিচালনায় রক্তকরবী। উল্লেখ্য, আজকে যাঁরা মঞ্চনাটককে আলোকিত করেছেন, তাঁদের অনেকের প্রথম অভিনয় এই দুটি নাটকে। লক্ষণীয় যে, বাঙালির স্বাধিকার অর্জনের রাজনৈতিক আন্দোলনের সমান্তরালে অগ্রসর হয়েছে সাংস্কৃতিক পুনর্জাগরণের কার্যক্রম, আর তার শরিক আবুল হাসনাত। সেখানে অনিবার্যভাবে সরকারের আপত্তি উপেক্ষা করে রবীন্দ্রনাথের সৃষ্টি প্রধান হয়ে আবির্ভূত হয়েছে। সে-কারণে সংস্কৃতির প্রধান প্রকাশ সংগীতকে অবলম্বন করে বাঙালি জাতিসত্তাকে সর্বজনের হৃদয়ে ধারণ করানোর লক্ষ্য নিয়ে যে-ছায়ানটের জন্ম হয়েছে তার আদর্শ ও ঐতিহ্যের প্রতি হাসনাত নৈকট্যবোধ করেছে। ১৯৬৭ সালে বাঙালির সর্বজনীন মিলনমেলা রমনার বটমূলে ছায়ানটের নববর্ষের প্রথম আয়োজনে আবুল হাসনাত স্বেচ্ছাসেবকের ভূমিকায় এবং বেশ কয়েক বছর পরে পূর্ণ উদ্যমে ছায়ানটে যোগদান, সে-সূত্র ধরে জাতীয় রবীন্দ্রসংগীত সম্মিলন পরিষদে। অবশ্য আবুল হাসনাতের একক উদ্যোগে আয়োজিত হয়েছে তার রচিত গীতি আলেখ্য লাল গোলাপের জন্য, যা ১৯৭২ সালে মঞ্চস্থ হয়েছে কলকাতায় বাংলাদেশ-ভারত মৈত্রী মেলায়। আবুল হাসনাতের মৃত্যুর পর আনন্দবাজারে যে শোক সংবাদ প্রকাশিত হয়েছে সেখানে এ-বিষয়টি উল্লিখিত হয়েছে আর উল্লেখ হয়েছে যে, এই অনুষ্ঠান বিষ্ণু দে, সুভাষ মুখোপধ্যায় ও মায়া সেন দ্বারা প্রশংসিত হয়েছে। স্বল্পবাক নিভৃতচারী আবুল হাসনাত আত্মপ্রচারে অনাগ্রহী ছিল। কিন্তু নিভৃতচারী মানুষ মাত্রই অলস জীবন যাপন করে না। কষ্টসহিষ্ণু, প্রচণ্ড পরিশ্রমী ও প্রাপ্ত দায়িত্বের প্রতি নিষ্ঠাবান আবুল হাসনাত কেবল সাহিত্য ও শিল্পের সাধক নন, প্রতিটি ক্ষেত্রে সে সক্রিয় ভূমিকা রেখে গেছে।