ওস্তাদ শাহাদাত হোসেন খানের চিরবিদায় : উচ্চাঙ্গ সংগীতাকাশের একটি উজ্জ্বল নক্ষত্রের পতন

পৃথিবীতে আসা-যাওয়ার চিরন্তন সত্যকে মেনে নিয়ে আমাদের পথ চলতে হয়। সাম্প্রতিককালে ‘না ফেরার দেশে’ শব্দসমষ্টি ব্যবহারের আধিক্য লক্ষ করা যায়। কারো মৃত্যু হলে এই শব্দসমষ্টির ব্যবহার লক্ষণীয়। সত্যিকার অর্থে এমন কোনো দেশ আছে কি না যেখানে কেবল বিদেহী আত্মারা বসবাস করে তা কেউ বলতে পারে না। আত্মা অবিনশ্বর – এ-কথা সবাই জানেন। মৃত্যুর পরে কোথায় তার অবস্থান তা কেউ সঠিকভাবে বলতে পারে না। তবে কল্পনার জগতে মানুষ স্বর্গ-নরক ইত্যাদির অবস্থানের কথা গুরুত্ব দিয়ে থাকেন। মানুষের বেঁচে থাকার মূলে রয়েছে মানুষের কর্ম। যে-কর্ম পৃথিবীর মানুষের কল্যাণকর, যার দ্বারা মানবতা উপকৃত হয় সেই কর্মই মানুষক অমরত্ব দান করে।

প্রতিদিন আকাশে শত-সহস্র তারকার দেখা পাওয়া যায়। সময়ের আবর্তে তারা খসে পড়ে। আবার উদিত হয় আবার খসে পড়ে। এই চিরাচরিত নিয়মের সঙ্গে পৃথিবীতে মানুষের আসা-যাওয়ার একটি সাদৃশ্য রয়েছে। তবে তফাৎ এই যে, মানুষ তার

কৃতকর্মের জন্য পৃথিবীতে দীর্ঘদিন স্মরণীয় হয়ে থাকতে পারেন, যা আকাশের তারার ক্ষেত্রে প্রযোজ্য নয়। পৃথিবীর প্রতিটি প্রাণীর স্বতন্ত্র কিছু ক্ষমতা বা শক্তি রয়েছে। প্রতিটি মানুষের মধ্যেও স্বতন্ত্র কিছু প্রতিভা লক্ষ করা যায়। এই প্রতিভার সঠিক উন্মেষের জন্যে পরিচর্যা আবশ্যক। সংগীত একটি শ্রেষ্ঠ শিল্পকলা। জন্মগতভাবে মেধা না থাকলে এই শিল্পের যোগ্য ধারক-বাহক হওয়া যায় না। চারুশিল্পের ক্ষেত্রে ভিন্ন ভিন্ন মাধ্যমে তৈরি শিল্প যেমন স্বতন্ত্রভাবে সৌন্দর্য প্রকাশ করে তেমনি সংগীতও ভিন্ন ভিন্ন মাধ্যমে ভিন্ন ভিন্ন আবহ তৈরি করে। অর্থাৎ কণ্ঠ এবং বিভিন্ন প্রকার যন্ত্র থেকে নির্গত ধ্বনি স্বতন্ত্র ভাব কিংবা রস তৈরিতে সমর্থ। সরোদ, সেতার, বাঁশি ইত্যাদি যন্ত্র এর অনন্য উদাহরণ।

অসামান্য সাংগীতিক প্রতিভার অধিকারী ওস্তাদ শাহাদাত হোসেন খান, আমার প্রিয় শাহীনভাই, গত ২৮ নভেম্বর ২০২০ তারিখ নশ্বর দেহ ছেড়ে অনন্তলোকে যাত্রা করেছেন। ১৯৫৮ সালের ৬ জুলাই কুমিল্লায় পিতামহ ওস্তাদ আয়েত আলী খাঁর বাসভবনে জন্মগ্রহণ করেন। জন্মের কিছুদিন পর মাত্র দেড় মাস বয়সে মা ফরিদা খানম তাঁকে নিয়ে তাঁর পিতার কর্মস্থল ঢাকায় চলে আসেন। ওস্তাদ শাহাদাত হোসেন খানের সরোদ-শিক্ষার প্রাথমিক পাঠ শুরু হয় পিতা আবেদ হোসেন খানের কাছে। এরপর চাচা ওস্তাদ বাহাদুর খাঁর কাছে তিনি দীর্ঘদিন সরোদের তালিম নিয়েছিলেন। মাত্র ১৪ বছর বয়সে ১৯৭২ সালে ওস্তাদ বাহাদুর খাঁর সঙ্গে ঢাকায় ‘ওস্তাদ আলাউদ্দিন সংগীত সম্মেলনে’ অংশগ্রহণ করে তিনি মঞ্চে সংগীত পরিবেশনা শুরু করেন। এরপর থেকে তিনি দেশ-বিদেশের বহু সংগীত সম্মেলনে অংশগ্রহণ করে কৃতিত্বের স্বাক্ষর রাখেন। ওস্তাদ শাহাদাত হোসেন খানের জীবনে আরো একটি বড় প্রাপ্তি ছিল। ১৯৭৪ সালে ঢাকায় একটি অনুষ্ঠানে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর সামনে তিনি সংগীত পরিবেশন করেছিলেন। বাজনা শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বঙ্গবন্ধু তৎকালীন তথ্য প্রতিমন্ত্রী তাহের উদ্দিন ঠাকুরকে বললেন অল ইন্ডিয়া রেডিও কনফারেন্স কবে হয় তার খোঁজ নিতে। তিনি আরো বললেন, এইবার আমাদের দেশ থেকে শাহাদাত এবং ওর পিতা আবেদ হোসেন খান ‘অল ইন্ডিয়া রেডিও কনফারেন্সে’ অংশগ্রহণ করবে। নির্দেশমতো তাহের উদ্দিন ঠাকুরও সঠিকভাবে দায়িত্ব পালন করলেন এবং যথাসময়ে তাঁরা সেই সম্মেলনে যোগদান করলেন। সেই সম্মেলনে আমজাদ আলী খান, বেগম আকতারের মতো ভারতের তৎকালীন বিখ্যাত শিল্পীদের পাশাপাশি একই মঞ্চে শাহাদাত হোসেন খান এবং তাঁর পিতা আবেদ হোসেন খানও সংগীত পরিবেশন করে ভূয়সী প্রশংসা অর্জন করেছিলেন। একটি অনুষ্ঠানের শেষে মঞ্চ থেকে নামার পর গজল সম্রাজ্ঞী বেগম আকতার শাহাদাত হোসেন খানকে জড়িয়ে ধরে অনেক আশীর্বাদ করেছিলেন যা শাহাদাত হোসেন খানের জীবনে একটি অমূল্য স্মৃতি হয়ে ছিল সারাজীবন। এ-সবকিছুর সূত্রপাত ঘটেছিল বঙ্গবন্ধুর ঐকান্তিক ইচ্ছার ফলে। তাঁর মতো এতো বড় একজন রাজনীতিবিদের সংগীতপ্রীতি এবং সংগীত সম্মেলন সম্পর্কে এতো খোঁজখবর রাখার বিষয়টি ওস্তাদ শাহাদাত হোসেন খানকে বিস্মিত করেছিল। এরপর থেকে তিনি বিশ্বের বহু প্রান্তে সরোদবাদন পরিবেশন করে বাংলাদেশের মুখ উজ্জ্বল করেছিলেন। দেশের জন্যে তাঁর টান ছিল অপার। তিনি চাইলেই ইউরোপ, আমেরিকা কিংবা অস্ট্রেলিয়ায় স্থায়ীভাবে চলে গিয়ে প্রতিষ্ঠিত হতে পারতেন। কিন্তু দেশের প্রতি তাঁর প্রবল আকর্ষণ থাকার কারণে তিনি অন্য কোথাও স্থায়ী হওয়ার কথা চিন্তা করেননি।

সুরসম্রাট ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁর কনিষ্ঠ ভ্রাতা ওস্তাদ আয়েত আলী খাঁর পৌত্র এবং আবেদ হোসেন খানের পুত্র ওস্তাদ শাহাদাত হোসেন খান ছিলেন একজন প্রাণোচ্ছল, বিনয়ী এবং সদা হাস্যোজ্জ্বল মানুষ। জীবনকে তিনি অত্যন্ত আনন্দের সঙ্গে উপভোগ করতেন এবং সেই সঙ্গে অপরকেও আনন্দে রাখতে চাইতেন। সাদা পাজামা-পাঞ্জাবি পরিহিত গৌরবর্ণের মানুষটির ভেতর ছিল অন্য এক রসিক শিল্পী মানুষ। জাগতিক সমস্ত বিষয়কে তিনি রসিকতা দিয়ে বিশ্লেষণ করতেন। তাঁর ঝুলিতে অনেক মজার মজার কৌতুক ছিল। তাঁর সঙ্গে কথোপকথনের বিভিন্ন পর্যায়ে তিনি এই সমস্ত কৌতুক বলে নিজেও আনন্দ পেতেন, অন্যদেরও আনন্দ দিতেন। জীবনের অন্তিম মুহূর্তে হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার পরেও তাঁর এই স্বভাব অক্ষুণ্ন ছিল। করোনা-আক্রান্ত হয়েও নিজেকে নিয়ে তিনি রসিকতা করেছেন। এ-প্রসঙ্গে ওস্তাদ মোবারক হোসেন খানের কন্যা ওস্তাদ শাহাদাত হোসেন খানের চাচাতো বোন বিশিষ্ট সেতারবাদক রিনাত ফৌজিয়া একটি ফেসবুক পোস্টে লিখেছেন :

ঠিক এক বছর আগে আমাদের বাবা পরপারে চলে গেলেন। উনার প্রথম মৃত্যুবার্ষিকীতে প্রাণপ্রিয় ভাতিজা একটি লেখা লিখলেন। লেখা ছাপা হলো মাসিক সারগাম পত্রিকায়। শাহিন ভাইয়ার (আমার চাচাত ভাই ওস্তাদ শাহাদাত হোসেন খান) জন্য একটা বাড়তি কপি নিয়ে এলাম। ব্যস্ততায় কয়েকটা দিন কেটে গেল। পত্রিকার কথাটা উনাকে বলব বলে ফোন করার কথা ভাবছি, ঠিক তখনি ওনার ফোন এলো। আমি প্রথমেই বলে উঠলাম, ভাইয়া, আপনার লেখা ছাপা হয়েছে ‘সারগাম’ পত্রিকায়। এবং আমি ওই পত্রিকার একটা কপি নিয়ে এসেছি, আপনার কাছ পৌঁছে দেব। ভাইয়া সারা জীবন খুব মজা করে কথা বলেন। উনি উত্তর দিলেন, আমি তো সারগাম হইয়া গেসি গা। কিছুই বুঝতে না পেরে জিজ্ঞেস করলাম এর অর্থ কী। উত্তর দিলেন, আমি তো হাসপাতালে, করোনা হইসে। আমার সাথে ফোনে কথা হয়েছে ১৫ তারিখ। এর পরের কয়েকটা দিন যমে-মানুষে টানাটানি। তারপর ২৮ তারিখে সব শেষ। আমাদের চাচি ছেলেকে প্রাণের চেয়ে ভালোবাসেন। আর ছেলে যে কি পরিমাণ মাতৃভক্ত, যারা জানার তারা জানে। বহুদিন আগে আশি পেরোনো আমার চাচি অসহায়ের মত জিজ্ঞেস করছিলেন, আমাকে রাতে ওষুধ খাইয়ে দিবে কে?

অশীতিপর একজন মায়ের এই আর্তনাদের কথা ভাবলে হৃদয়টা কেমন যেন ডুকরে কেঁদে ওঠে। জন্ম দেওয়ার পর থেকে একজন মা তাঁর সন্তানকে সাধ্যের চরম মাত্রা অতিক্রম করে নিঃস্বার্থভাবে মানুষ করেন। শুধু মানুষ কেন প্রাণিজগতের মধ্যেও সন্তানের জন্য মায়ের দরদ, স্নেহ, মায়া, মমতা এবং আগলে রাখার প্রবণতা দেখা যায়। ছোটবেলায় পিতা-মাতার কোলে সন্তান যেমন নিশ্চিন্ত নির্ভরতায় থাকে তেমনই বার্ধক্যের সময় পিতা-মাতাও ছেলের কাছে নিশ্চিন্ত নির্ভরতায় জীবন কাটায়। এটাই আমাদের বাঙালি সমাজের চিরাচরিত প্রথা। সনাতন এই বাঙালি সংস্কৃতির বন্ধনে আবদ্ধ ছিলেন শাহাদাত হোসেন খান। তাই তিনি সযত্নে মায়ের দেখাশোনা এবং সেবা-শুশ্রƒষা করতেন। পিতা-মাতা মনে কষ্ট পান – এমন কাজ তিনি কখনো করতেন না। ১৯৯৬ সালে তাঁর পিতা আবেদ হোসেন খানের মৃত্যুর পর থেকে দীর্ঘ প্রায় ২৫ বছর তিনি মা ফরিদা খানমকে আগলে রেখেছিলেন। শাহাদাত হোসেনের পিতা-মাতা তাঁকে সংগীতে এবং লেখাপড়ায় যোগ্য করে তুলেছিলেন।

এই বংশের অভিভাবক কিংবদন্তি সংগীতজ্ঞ ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁ, নৃত্যগুরু উদয়শংকরের সংগীতের দলের সদস্য হিসেবে বিদেশভ্রমণকালে সুদূর প্যালেস্টাইন থেকে কনিষ্ঠ ভ্রাতা ওস্তাদ আয়েত আলী খাঁকে লিখেছিলেন : ‘বাবা জীবনদের শিক্ষার যেন কোনো ত্রুটি না হয়। ভিক্ষা করিয়া হইলেও তাহাদের মানুষ করিবে’ [সূত্র : মোবারক হোসেন খান, ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁ ও তাঁর পত্রাবলি, শিল্পকলা একাডেমি, দ্বিতীয় সং, জুন ২০০১, পৃ ৪৫] ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইতিহাস বিষয়ে ১৯৭২ সালে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জন করেন শাহাদাত হোসেন খান। কর্মজীবনে তিনি ‘বাংলাদেশ জুট মিল করপোরেশনে’র একজন উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা ছিলেন।

শাহীনভাই ছিলেন খুব শৌখিন মানুষ। নিজের উপার্জিত অর্থে গাড়ি কিনেছিলেন ছাত্রাবস্থায়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াকালে তিনি নিজেই গাড়ি চালিয়ে যেতেন বিশ্ববিদ্যালয়ে। নির্মোহ এবং নিরহংকারী একজন মানুষ ছিলেন শাহাদাত হোসেন খান। সংগীত তাঁর পুরোপুরি পেশা ছিল না। তাই সংগীতের প্রচার-প্রসারে অর্থ ছিল তাঁর কাছে নিরর্থক। বাংলাদেশের মানুষের গড় আয়ু ৭২.৬ বছর। সেই হিসাবে শাহীনভাই বড্ড তাড়াতাড়ি চলে গেলেন। তাঁর মতো নিবেদিত শিল্পী এবং মানবিক মূল্যবোধযুক্ত একজন মানুষের আরো অনেকদিন বেঁচে থাকা প্রয়োজন ছিল।

বর্তমানে ভারত উপমহাদেশ তথা সমগ্র বিশ্বে ভারতীয় উচ্চাঙ্গ যন্ত্রসংগীতের যে চর্চা, প্রচার ও বিকাশ দেখা যায় তার অধিকাংশই মহান সংগীতজ্ঞ ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁর সাংগীতিক বংশপরম্পরাকে কেন্দ্র করে। এই সাংগীতিক পরিবারের বংশধর ওস্তাদ শাহাদাত হোসেন খানের সরোদের প্রাথমিক শিক্ষা হয়েছিল তাঁর পিতামহ ওস্তাদ আয়েত আলী খাঁর কাছে। ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁ তাঁর ভ্রাতা ওস্তাদ আয়েত আলী খাঁকে অত্যন্ত স্নেহ করতেন। যন্ত্রনির্মাণে ওস্তাদ আয়েত আলী খাঁ ছিলেন অত্যন্ত পারদর্শী। ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁর পরামর্শে তিনি সরোদযন্ত্রের সংস্কার করেন। এ-প্রসঙ্গে মোবারক হোসেন খান তাঁর ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁ ও তাঁর পত্রাবলি গ্রন্থে চিত্রসহ সরোদযন্ত্রের উল্লেখ করেছেন। ওস্তাদ আয়েত আলী খাঁ তাঁর পৌত্র শাহাদাত হোসেন খানকে অত্যন্ত স্নেহ করতেন। শাহাদাত হোসেনও পিতামহের প্রদর্শিত পথ অনুসরণ করে চলতেন। আয়েত আলী খাঁ তাঁর সাধ্যমতো দরিদ্র এবং এতিমের সাহায্যে হাত বাড়িয়ে দিতেন। একইভাবে শাহীনভাইও আর্তমানবতার সেবায় নিজেকে নিযুক্ত রেখেছিলেন আজীবন। ওস্তাদ আয়েত আলী খাঁর আশীর্বাদ পেয়ে ধন্য হয়েছিল ওস্তাদ শাহাদাত হোসেন খানের জীবন। কতটা আশীর্বাদ তিনি পেয়েছিলেন তা একটি ঘটনা থেকে জানা যায়। মৃত্যুর কিছুদিন পূর্বে ওস্তাদ আয়েত আলী খাঁ নিজ হাতে একটি সরোদ তৈরি করে কুমিল্লা থেকে নিজে বহন করে নিয়ে এসে আদরের ছোট নাতি শাহাদাতের হাতে দিয়ে বলেছিলেন, ‘দাদু আমার তো শেষ সময়, তোমাকে দেওয়ার মতো আমার আর কিছু নাই, এই সরোদটা তোমাকে আমার আশীর্বাদ হিসাবে দিয়া গেলাম।’ পড়াশোনার ক্ষতি হবে ভেবে পিতা তখন সরোদ শিক্ষার ব্যাপারে কিছুটা আপত্তি করলেও পরে তিনি নিজেই পুত্র শাহাদাত হোসেনকে তালিম দিয়েছিলেন। এই কথাগুলো বলার কারণ এই যে, ওস্তাদ শাহাদাত হোসেন খানের একটি ঐতিহ্যবাহী সাংগীতিক পরম্পরা ছিল। জন্মের পর থেকেই তিনি এই আবহেই বেড়ে উঠেছেন। সেই সঙ্গে লেখাপড়া এবং মানবিক মূল্যবোধে যোগ্য হয়ে উঠেছিলেন তিনি। মানুষের শ্রেণি কিংবা যোগ্যতা নির্ধারণ করা হয় মূলত মানবিক মূল্যবোধের ওপর ভিত্তি করে। আক্ষরিক অর্থে বিএ-এমএ পাশ করলে তাকে শিক্ষিত বলা হয়। কিন্তু শিক্ষিত হয়েও মানুষ যদি মানবিক মূল্যবোধের বিচারে উত্তীর্ণ না হয় তাহলে তাকে মানুষ বলা যায় না। ওস্তাদ শাহাদাত হোসেন খান প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার পাশাপাশি মানবিক মূল্যবোধেও ছিলেন অত্যন্ত জাগ্রত। তাঁর সঙ্গে বহুবার সাক্ষাতে এবং আলাপচারিতায় এর প্রমাণ পেয়েছি।

শাহীনভাইয়ের সঙ্গে আমার প্রথম সাক্ষাৎ হয় সম্ভবত ১৯৯৯ সালে। কিংবদন্তি সংগীতজ্ঞ আজাদ রহমানের প্রতিষ্ঠান ‘সংস্কৃতি কেন্দ্রে’ তখন আমি গান শেখাই। একদিন আজাদ রহমান আমাকে একটি অনুষ্ঠানে গান করার কথা বললেন। অনুষ্ঠানটি হবে একটি প্রমোদতরীতে। কিছু বিদেশি অতিথি এসেছেন, মূলত তাঁদের মনোরঞ্জনের জন্যই এই অনুষ্ঠান। নির্ধারিত দিনে একটি গাড়িতে করে রওনা হলাম। আমার মনে আছে মালিবাগ রেলগেট থেকে আমাদের সঙ্গে গাড়িতে উঠেছিলেন শাহীনভাই। ওঠার পরপরই আমাদের পরিচয়পর্ব হয়ে গেল। এরপর থেকে গাড়ি নদীর ঘাটে যাওয়া পর্যন্ত প্রায় এক ঘণ্টা তিনি অনেক মজার মজার কৌতুক বলে আমাদের উৎফুল্ল রেখেছিলেন। এরপর সকলে মিলে লঞ্চে উঠে সারাদিন একসঙ্গে গানবাজনায় মেতে রইলাম। আমি গেয়েছিলাম রাগ ‘নটভৈরবে’ আজাদ রহমানের সৃষ্ট বাংলা বন্দিশ ‘শৃঙ্খলা দেখ ভূমণ্ডলে, দেখ সব গ্রহ কত নিয়মে চলে’। যতদূর মনে পড়ে শাহীনভাই সরোদে বাজিয়েছিলেন প্রথমে রাগ ‘ঝিঁঝোটি’ এবং পরে রাগ ‘ভৈরবী’। তবলা সঙ্গতে ছিলেন সঞ্জয় মজুমদার। শাহীনভাইয়ের বাজনার সঙ্গে সঞ্জয় মজুমদারের দীর্ঘদিনের তবলার খুব সুন্দর একটা বোঝাপড়া ছিল। শাহীনভাই জীবনে অনেক রাগ বাজিয়েছেন। কিন্তু আমার মনে হয় তাঁর সবচেয়ে পছন্দের রাগ ছিল ‘ভৈরবী’। এই রাগে এমন সুন্দরভাবে তিনি কিছু স্বরবিন্যাস এবং ক্রোমাটিক স্বরের ব্যবহার করতেন যা সত্যিই অসাধারণ। বিশেষ করে ‘দ্া ণ্া সা ঋা জ্ঞা গা জ্ঞঋা গা জ্ঞা ঋা সা’ এবং ‘সা জ্ঞা মা পা দা পা হ্মা মা জ্ঞা রা জ্ঞা মা জ্ঞঋা সা’ এই ধরনের স্বরসমাবেশে তিনি এক স্বর্গীয় আবহ তৈরি করতেন। সেই অনুষ্ঠানে বিদেশি অতিথিরা শাহীনভাইয়ের বাজনা খুব উপভোগ করেছিলেন। সত্যিকার অর্থেই সেদিনের বাজনা ছিল অত্যন্ত প্রাণবন্ত। ফিরে আসার সময় শাহীনভাই আমার গানের তারিফ করছিলেন। তাঁর সঙ্গে একদিনের পরিচয়েই মনে হয়েছিল তিনি যেন অনেক দিনের চেনা। খুব আপন মনে হয়েছিল মানুষটিকে। বন্ধু হয়ে গেলাম আমরা দুজন।

২০০৪ সালে রাজশাহীতে আমি এবং রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘নাট্যকলা ও সংগীত বিভাগে’র প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি অধ্যাপক ড. সফিকুন্নবী সামাদী দুজনে মিলে ‘কলাসঙ্গম’ নামে একটি সংগঠন করি। ২০০৫ সালে এই সংগঠন থেকে ‘রাগ-নিশি’ নামে একটি অনুষ্ঠান করি। উক্ত অনুষ্ঠানে ওস্তাদ শাহাদাত হোসেন খানকে আমি আমন্ত্রণ জানাই এবং বলি যে আমরা কেবল যাতায়াত ভাড়া দিতে পারবো। সম্মানী দেয়ার মতো সামর্থ্য আমাদের ছিল না। সত্যিকার অর্থেই বাংলাদেশে এখনো পর্যন্ত উচ্চাঙ্গসংগীতের পৃষ্ঠপোষকতার যথেষ্ঠ অভাব রয়েছে। বলতে গেলে সরকারি পর্যায় এবং বেঙ্গল ফাউন্ডেশনের মতো দু-একটি প্রতিষ্ঠান ছাড়া আর কোথাও তেমন কোনো পৃষ্ঠপোষকতা নেই। বিষয়টি তিনিও উপলব্ধি করতে পারতেন। তাই তিনি কেবল আমাদের বন্ধুত্বের খাতিরে এবং উচ্চাঙ্গসংগীতের প্রচারের স্বার্থে সানন্দে আসার জন্যে রাজি হন। সেবারে শাহীনভাইয়ের সঙ্গে এসেছিলেন তাঁর সহধর্মিণী পূরবী খান, দুই কন্যা আফসানা খান এবং রুখসানা খান। দুই কন্যাকে তিনি সরোদ এবং সেতারে তালিম দিয়ে তৈরি করছিলেন। বিবাহের পর থেকে স্বামী ওস্তাদ শাহাদাত হোসেন খান এবং তাঁর দুই কন্যার সংগীতচর্চার পরিবেশ তৈরি করে একে বেগবান করার জন্য নেপথ্যে বিশেষ ভূমিকা রেখেছিলেন পূরবী খান। পরিবারের সকলের সঙ্গে শাহীনভাইয়ের ছিল এক অটুট বন্ধন। অনুষ্ঠান হোক কিংবা কোথাও ভ্রমণ হোক তিনি পরিবারের সবাইকে নিয়ে একসঙ্গে যেতে পছন্দ করতেন।

বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে সহায়তা তহবিল গঠনের জন্য পণ্ডিত রবিশংকর শিল্পী জর্জ হ্যারিসনকে নিয়ে আমেরিকার মেডিসন স্কোয়ারে যে বিশাল অনুষ্ঠান করেছিলেন তা বিশ্বমানবতার ইতিহাসে এক নতুন অধ্যায় সৃষ্টি করেছিল। ওস্তাদ শাহাদাত হোসেন খানও সেই পথ অনুসরণ করে ১৯৮৮ সালে বাংলাদেশের ভয়াবহ বন্যার পর প্যারিসে এককভাবে সংগীত পরিবেশন করে উপার্জিত অর্থ দিয়ে ক্ষতিগ্রস্ত মানুষকে সহায়তা করেছিলেন। আত্মপ্রচারের জন্য তিনি কখনো এই বিষয়ে কোথাও ফলাও করে প্রচার করেননি। নীরবে, নিভৃতে আর্তমানবতার সেবায় আত্মনিয়োগ করেছিলেন তাঁর ঘরানার পূর্বসূরি পণ্ডিত রবিশংকরের প্রদর্শিত পথে।

আমার কাছে ‘শিল্পী’ শব্দটির অর্থ ব্যাপক। কেবল গান গাইলেই কিংবা ছবি আঁকলেই শিল্পী হওয়া যায় না। সৃষ্টি এবং উপস্থাপনের পাশাপাশি পোশাক-পরিচ্ছদ, চলাফেরা, কথাবার্তা, আচার-আচরণ, সর্বোপরি মানবিক সমস্ত গুণ একজন শিল্পীর মধ্যে থাকা বাঞ্ছনীয়। সমাজের অন্যান্য শ্রেণি-পেশার মানুষের কাছে একজন শিল্পীর এই সমস্ত গুণ অনুসরণীয়। ওস্তাদ শাহাদাত হোসেন খান এই সমস্ত গুণের অনেকগুলোরই অধিকারী ছিলেন।

শাহীনভাইয়ের সঙ্গে আমার খুব ভালো বন্ধুত্ব ছিল। খুব সহজেই তিনি মানুষকে আপন করে নিতে পারতেন। আমার অনুরোধে তিনি বেশ কয়েকবার রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সংগীত বিভাগে পরীক্ষা নিতে এসেছিলেন। সেই সূত্রে সংগীত বিভাগের অনেক শিক্ষকের সঙ্গে তাঁর সুসম্পর্ক গড়ে উঠেছিল। তিনি এই পৃথিবী থেকে চলে যাবার পর তাঁরাও অনেক কষ্ট পেয়েছিলেন। এত বড় একজন সংগীতশিল্পী হলেও তাঁর অন্তরে কোনো অহংকারবোধ ছিল না।

ওস্তাদ শাহাদাত হোসেন খানের কাছে আমার তিনটি আশা অপূর্ণ রয়ে গেল। ২০২০ সালের জানুয়ারি মাসে আমার অনুরোধে তিনি টাঙ্গাইলে এসেছিলেন ‘ষড়জ-পঞ্চম রাগসংগীত শিক্ষালয়ে’র বাৎসরিক পরীক্ষা গ্রহণের জন্য। পরীক্ষাশেষে ভারতীয় দূতাবাস থেকে প্রাপ্ত চারটি সরোদ তাঁকে দেখিয়ে বললাম যে, আমাদের এখানে শুধু কণ্ঠসংগীতের ক্লাস নেওয়া হয়। যেহেতু আমাদের চারটি সরোদ রয়েছে তাই আমি আপনাকে ‘ষড়জ-পঞ্চমে’ নিয়মিতভাবে একটি ক্লাস নেওয়ার জন্য অনুরোধ করছি। সরোদগুলো দেখে তিনি এগুলো কিছুটা মেরামতের প্রয়োজন আছে বলে পরামর্শ দেন এবং ক্লাস নেওয়ার জন্যে সানন্দে রাজি হন। কিন্তু তার কিছুদন পরই করোনা মহামারি শুরু হওয়ার কারণে এ-ব্যাপারে আর কোনো অগ্রগতি হয়নি। তাই আমার আশাও আর পূরণ হলো না।

ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁ কয়েকটি নতুন রাগ সৃষ্টি করেছিলেন। সেই রাগগুলো সম্পর্কে বিস্তারিত জানার আগ্রহে একদিন শাহীনভাইকে জিজ্ঞাসা করেছিলাম। তিনি আমাকে পরে বলবেন বলে আশ্বস্ত করেছিলেন। কিন্তু সে-আশাও আর পূরণ হলো না। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে সর্বশেষ এসেছিলেন সম্ভবত ২০১৮ সালে। সেবারে পরীক্ষা নেওয়ার পর বিভাগের পক্ষ থেকে ওস্তাদ শাহাদাত হোসেন খানের আগমন উপলক্ষে একটি অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়েছিল। ঢাকা থেকে বিশিষ্ট তবলাবাদক সঞ্জীব মজুমদার এসেছিলেন তাঁর সঙ্গে সঙ্গত করার জন্যে। শাহীনভাইয়ের দীর্ঘদিনের সহচর সঞ্জীব মজুমদার অনেক কাছ থেকে শাহীনভাইকে দেখার সুযোগ পেয়েছিলেন। অনুষ্ঠান শুরু হওয়ার ঠিক পূর্বমুহূর্তে শাহীনভাই আমাকে বললেন ‘দাদা চলেন দুজনে একসঙ্গে যুগলবন্দি করি।’ আমি বললাম, ‘এ তো আমার জন্যে খুবই আনন্দের কথা। কিন্তু অন্তত একবার রিহার্সাল না করে কিভাবে বসি?’ তিনি বললেন, ‘রিহার্সাল করার দরকার নেই, দুজনে বসলে ঠিক অ্যাডজাস্ট হয়ে যাবে।’ সত্যিকার অর্থে তাঁর মতো একজন এতো বড়মাপের শিল্পীর সঙ্গে কোনো রিহার্সাল ছাড়া সরাসরি মঞ্চে বসে গান করার মতো সাহস আমি করতে পারিনি। আমি তাঁকে বলেছিলাম, ভবিষ্যতে আমরা রিহার্সাল করে একসঙ্গে যুগলবন্দি করবো। তিনি স্বভাবসুলভ ভঙ্গিতে মৃদু হেসে তাঁর সম্মতি জানিয়েছিলেন। কিন্তু করোনা ভাইরাস আমাদের সেই আশা চিরদিনের মতো শেষ করে দিলো। কেড়ে নিল আমার অত্যন্ত প্রিয় সংগীতজ্ঞ, আমার বন্ধু ওস্তাদ শাহাদাত হোসেন খানের প্রাণ। অব্যক্ত রয়ে গেল আমাদের যুগলবন্দি। শাহীনভাইয়ের ‍প্রিয় রবীন্দ্রসংগীত ‘দিনগুলি মোর সোনার খাঁচায় রইলো না, সেই যে আমার নানান রঙের দিনগুলি।’ এই গানটি তিনি মাঝে মাঝেই গুনগুন করে গাইতেন। এই গানের রেশ ধরে বলতে চাই, শাহীনভাইয়ের সঙ্গে কাটানো নানান রঙের দিনগুলি আজ শুধুই স্মৃতি। অসাধারণ বাদননৈপুণ্য এবং উচ্চাঙ্গসংগীতে বিশেষ অবদানের জন্যে ওস্তাদ শাহাদাত হোসেন খান ১৯৯৪ সালে ‘একুশে পদক’ লাভ করেন। এছাড়া বহু পুরস্কারে ভূষিত হন। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো : ১৯৭৪ সালে রাষ্ট্রীয় পুরস্কার, ১৯৮৩ সালে নিখিল বঙ্গ সংগীত সম্মেলনে স্বর্ণপদক লাভ, ১৯৯১ সালে ভারতের আইটিসি সংগীত রিসার্চ একাডেমী পুরস্কার, পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য সংগীত একাডেমি পুরস্কার এবং বাংলাদেশ চলচ্চিত্র সংস্থা থেকে শ্রেষ্ঠ যন্ত্রশিল্পী হিসেবে পুরস্কার। ওস্তাদ শাহাদাত হোসেন খানের সবচেয়ে বড় পুরস্কার মানুষের ভালোবাসা। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান থেকে শুরু করে বিশ্বের নানান প্রান্তের মানুষের হৃদয়কে তিনি তাঁর সরোদের তারের ঝংকারে স্পর্শ করতে পেরেছিলেন। অকুণ্ঠ ভালোবাসা পেয়েছিলেন মানুষের। এর চেয়ে বড় প্রাপ্তি আর কিছুই হতে পারে না। ওস্তাদ শাহাদাত হোসেন খানের আত্মা যেখানেই থাকুক তিনি যেন শান্তিতে থাকেন এবং সুরের মাঝেই থাকেন এই প্রার্থনা করি পরম করুণাময়ের কাছে।