প্রচলিত প্রথার বাইরে যাপিত জীবনের গ্লানিবোধ, যন্ত্রণায় কেঁাঁকড়ানো সৃষ্ট অনুভূতি থেকে গড়ে উঠেছে মাহির শিল্পের অবয়ব। এই দুনিয়ার আলো-বাতাসে খুব বেশিদিন ভেসে বেড়াননি আফ্রিদা তানজিম মাহি (১৯৯৭-২০১৯)। মাত্র ২২ বছর বয়সে তিনি পৃথিবী ছেড়ে যান। তিনশোর কিছু বেশি ছবি এঁকেছিলেন মাহি।
বড় হতে হতে একটু একটু করে মাহি বুঝতে শুরু করেছিলেন শিল্পের সারকথা। তাঁর কাজ আমাদের জানান দেয়, জীবনের মানে মৃত্যুরও মানে। শিল্পকলা প্রদর্শনশালা কলাকেন্দ্র মাহির জন্মবছরকে স্মরণ রেখে এ-আয়োজন করেছে।
প্রদর্শিত ৬০টি কাজ থেকে শিল্পীর ব্যক্তিগত জীবনবোধ, অন্তর্গত বেদনার আকুতি, আর্তচিৎকারে কাঁপুনি ধরা সময়ের ডাক শোনা যায়।
শিল্পী ওয়াকিলুর রহমানের কিউরেটিংয়ে এ-প্রদর্শনী সাজানো হয়েছে। প্রদর্শনীর শিরোনাম ‘সেলফ ডিপিকশান’ বা নিজের আঁকা আত্মপ্রতিকৃতি। আফ্রিদা তানজিম
মাহির প্রতিকৃতিচিত্রে গতানুগতিক ধারার অবলম্বন নেই। মুখের আদলে নেই বাস্তবানুগ প্রতিফলন। একসঙ্গে মুখ ও মুখোশ দুই-ই সামনে এনেছেন। প্রাতিষ্ঠানিক প্রথাগত শিল্পশিক্ষা না থাকলেও তাঁর কাজ আমাদের পরিপক্বতার খোঁজ দেয়।
শিল্প হিসেবে কতটা উৎকৃষ্ট সে-আলোচনায় না গিয়ে তাঁর কাজের মাঝে যে জীবনবোধ, সময়, পারিপার্শ্বিকতার নন্দনহীন উল্লাস প্রকাশ পেয়েছে সেটি ভাববার আছে আমাদের।
বেশ কিছু মুখাবয়ব জ্যামিতিক আকারের। কোনো কোনো ক্ষেত্রে মুখের চাহনিতে দ্বৈততা রয়েছে। চোখের মাঝে যুক্ত হয়েছে আরেক চোখ। চোখের বিভোর চাহনিতে আকস্মিকতা, এক ধরনের বিভ্রম দেখা দেয়। মাহি মানবমুখের অভ্যন্তরীণ রূপ বিশেষভাবে দেখাতে চেয়েছিলেন। ফলে তাঁর কাজ আমাদের একটা বিচ্ছিন্নতার ইঙ্গিত দেয়।
মাহির শিল্পকর্ম নানাবিধ উপকরণ দিয়ে গড়া। যার ফলে এক কাজের চেয়ে অন্য কাজে ভিন্নতা গড়ে উঠেছে। মাহির কাজ প্রসঙ্গে শিল্পী ওয়াকিলুর রহমানের মত এমন, ‘মাহি নিজেকেই অবজেক্ট হিসেবে গ্রহণ করেছেন এবং ছবি এঁকে তা ফিরিয়ে দিয়েছেন। আপসকামিতা, ঐতিহ্যগত পরম্পরায় আচ্ছাদিত সামাজিক আচার, বিশ্বাসকে এড়িয়ে, তোয়াক্কা না করে, অঙ্গীকার করে সরাসরি প্রকাশ করেছেন। সাহস তাঁর অবলম্বন এবং ছবি এঁকে প্রকাশই তাঁর ঘনিষ্ঠ মাধ্যম।’
এ-প্রদর্শনীর মুখাবয়বগুলোতে একরকম সুন্দর নাকচ করে দেওয়ার প্রবণতা দেখা যায়। রং নির্বাচনে ধূসর, কালো, বাদামি বর্ণের উপস্থিতি ছবির জমিনে শোকগ্রস্ততা তৈরি করেছে। শিল্পকলার অ্যাকাডেমিক নান্দনিক রূপ নিয়ে বিশেষ ভাবনা মাহির কাজে নেই। তাঁর কাজ প্রথাগত সামাজিক আচারগুলোর ছাপ স্পষ্ট করে দেখায় না। প্রথাগত শিল্পপাঠ নয়, ব্যক্তি সমাজ আর তথাকথিত পরম্পরায় আচ্ছাদিত সামাজিক মোড়ক উন্মোচন করেই প্রকাশ করেন ছবিতে।
মাহি তাঁর নিজের কথায় ছবি আঁকা সম্পর্কে বলেন, ‘যখন সমস্ত আত্মপ্রতিকৃতি আঁকা শেষ, তখন আমি নতুন এক নিজেকে নির্মাণ করি।’ এভাবেই আফ্রিদা তানজিম মাহি নিজেকে ভেঙে আবার গড়েন। রঙের খেলায় মত্ত থেকে নিজেকে আত্মাহুতি দেন।
সাহস আর রঙের সঙ্গে সখ্য Ñ দুইয়ে মিলে গড়ে উঠেছে ক্যানভাস।
গত ২১ অক্টোবর রাজধানীর কলাকেন্দ্রে শুরু হয়ে এ-প্রদর্শনী শেষ হয় ১২ নভেম্বর।
Leave a Reply
You must be logged in to post a comment.