ঐ নূতনের কেতন ওড়ে
‘তারুণ্যের একটি শক্তি আছে, সব বাধায় পথ কেটে তারুণ্য সামনের দিকে অগ্রসর হয়। এই শক্তিকে সংবর্ধিত করা প্রয়োজন। এ বোধ থেকেই তরুণ লেখকদের পুরস্কারের জন্য বাছাই করা হয়েছে।’ কথাগুলো বলেছেন কালি ও কলমের সম্পাদকম-লীর সভাপতি জাতীয় অধ্যাপক আনিসুজ্জামান। গত ৪ জানুয়ারি ২০২০, শনিবার, ধানমন্ডির বেঙ্গল শিল্পালয় মিলনায়তনে আয়োজিত ‘কালি ও কলম তরুণ কবি ও লেখক পুরস্কার-২০১৯’-এ সভাপতির ভাষণদানকালে তিনি এ-কথা বলেন।
কালি ও কলম তরুণ কবি ও লেখক পুরস্কার প্রসঙ্গে তিনি আরো বলেন, ‘দেশে যতগুলো পুরস্কার আছে, সেগুলোর মধ্যে এটি একটি বিশেষ জায়গা করে নিয়েছে। বিভিন্ন বছর যাঁদের আমরা পুরস্কৃত করেছি, পরে তাঁরা ভালো করেছেন। এতে বোঝা যায়, আমরা কবি ও লেখক বাছাই করতে ভুল করিনি। এবার যাঁরা পুরস্কার পেলেন, তাঁদের লেখায় তথ্য সংগ্রহের বিপুলতা আছে, ভাষার কারুকাজ আছে, অনুভূতির বিচিত্রতা আছে। এই সব মিলে যাঁরা পুরস্কৃত হলেন, আশা করি তাঁদের প্রচেষ্টা অব্যাহত থাকবে, তাঁরা আরো সম্মান লাভ করবেন।’
সাহিত্য শিল্প ও সংস্কৃতি বিষয়ক মাসিক পত্রিকা কালি ও কলম ২০০৮ সাল থেকে ‘তরুণ কবি ও লেখক পুরস্কার’ প্রদান করে আসছে। এরই ধারাবাহিকতায় ২০১৯ সালে দ্বাদশবারের মতো এ-পুরস্কার প্রদান করা হয়। পুরস্কার অর্জন করেন – কবিতা বিভাগে জলপরিদের দ্বীপে গ্রন্থের জন্য হানযালা হান; কথাসাহিত্যে লালবেজি গ্রন্থের জন্য কামরুন নাহার শীলা; প্রবন্ধ, গবেষণা ও নাটক শাখায় সৈয়দ নজরুল ইসলাম : মহাজীবনের প্রতিকৃতি গ্রন্থের জন্য ফয়সাল আহমেদ এবং মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক গবেষণা ও সাহিত্য শাখায় মুক্তিযুদ্ধে ভারতের চিকিৎসা সহায়তা গ্রন্থের জন্য চৌধুরী শহীদ কাদের।
যুগে যুগে নবীনরা সমাজে গতানুগতিক ধারাকে ভেঙে নতুন সমাজ নির্মাণের পথে এগিয়েছে। রাষ্ট্র, সমাজ, জাতি সর্বত্র ন্যায়নিষ্ঠার অনির্বাণ আলো জ্বেলেছে। একটি জাতির শিক্ষা, সংস্কৃতি এগিয়ে নেওয়ার ভারও সানন্দে নিজ কাঁধে তুলে নিয়েছে তরুণরা। সেই তরুণদের সাহিত্যচর্চাকে গতিশীল ও বেগবান করার লক্ষ্য নিয়ে মাসিক পত্রিকা কালি ও কলম প্রবর্তন করেছে ‘কালি ও কলম তরুণ কবি ও লেখক পুরস্কার’।
পৌষের বিকেলে এ-আয়োজনে প্রধান অতিথি ছিলেন বিশিষ্ট কথাসাহিত্যিক সেলিনা হোসেন। সম্মানীয় অতিথি ছিলেন বিশিষ্ট চিত্রশিল্পী রফিকুন নবী এবং নাট্যজন আসাদুজ্জামান নূর এমপি। কালি ও কলমের সম্পাদকম-লীর সভাপতি জাতীয় অধ্যাপক আনিসুজ্জামানের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠানমঞ্চে আরো উপস্থিত ছিলেন পত্রিকাটির প্রকাশক আবুল খায়ের এবং সম্পাদক আবুল হাসনাত। অনুষ্ঠানটি সঞ্চালনা করেন বেঙ্গল ফাউন্ডেশনের মহাপরিচালক এবং কালি ও কলম সম্পাদকম-লীর সদস্য লুভা নাহিদ চৌধুরী।
তরুণদের সৃজনশীলতাকে উজ্জীবিত ও গতিশীল করার লক্ষ্যে ২০০৮ সালে প্রবর্তন করা হয় ‘কালি ও কলম তরুণ কবি ও লেখক পুরস্কার’। সে-বছর দুটি বিভাগে (কবিতা এবং প্রবন্ধ গবেষণা ও নাটক) এ-পুরস্কার প্রদান করা হয়। ২০০৯ সালে বিভাগ বেড়ে দাঁড়ায় তিনটি (কবিতা; কথাসাহিত্য এবং প্রবন্ধ গবেষণা ও নাটক)। ২০১০ সালে যোগ করা হয় আরো দুটি বিভাগ (কবিতা; কথাসাহিত্য; প্রবন্ধ গবেষণা ও নাটক; মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক গবেষণা ও প্রবন্ধ এবং শিশু-কিশোর সাহিত্য)। ফলে ২০১০ থেকে ২০১৩ সাল পর্যন্ত পাঁচটি বিভাগেই বই চাওয়া হয়। মাঝে ২০১৪ সালে তিনটি বিভাগে বই চাওয়া হলেও ২০১৫ সাল থেকে ফের পাঁচটি বিভাগেই পুরস্কার দিয়ে আসছে কালি ও কলম। প্রতিটি বিভাগে পুরস্কার বিজয়ীকে এক লাখ টাকা, একটি ক্রেস্ট ও সনদপত্র প্রদান করা হয়ে থাকে।
অনুষ্ঠানের শুরুতেই উপস্থিত সবাইকে স্বাগত জানিয়ে বক্তব্য রাখেন লুভা নাহিদ চৌধুরী। তিনি ‘কালি ও কলম তরুণ কবি ও লেখক পুরস্কারে’র বিচারকম-লী প্রাবন্ধিক অধ্যাপক বিশ্বজিৎ ঘোষ, কবি অধ্যাপক মাহবুব সাদিক এবং কথাসাহিত্যিক ইমদাদুল হক মিলনকে সবিশেষ ধন্যবাদ জানান। তিনি বলেন, ‘আগামী ১ ফাল্গুন কালি ও কলম ১৭ বছরে পদার্পণ করবে। এ-উপলক্ষে পত্রিকাটি বিশেষ সংখ্যা প্রকাশ করছে।’ ২০১৯ সালে পাঁচটি বিভাগের মধ্যে চারটি বিভাগে পুরস্কার প্রদান করা হয়েছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘এ বছর শিশুসাহিত্যে পুরস্কার দেওয়ার মতো পা-ুলিপি পাওয়া যায়নি। তাই বিচারকদের সিদ্ধান্ত অনুসারে এ-বছর এ-বিভাগে কাউকে পুরস্কৃত করা হয়নি।’
লুভা নাহিদ চৌধুরীর বক্তব্যশেষে বিচারকম-লীর পক্ষে পুরস্কার বিজয়ীদের নাম ঘোষণা করেন অধ্যাপক বিশ্বজিৎ ঘোষ। পরে ২০০৮ থেকে ২০১৯ সাল পর্যন্ত দেওয়া এ-পুরস্কার নিয়ে নির্মিত স্বল্পদৈর্ঘ্য তথ্যচিত্র প্রদর্শন করা হয়। ২০১৯ সালের বিজয়ীদের উদ্দেশে শংসাবচন পাঠ করেন অধ্যাপক মাহবুব সাদিক ও কথাসাহিত্যিক ইমদাদুল হক মিলন।
শংসাবচন পাঠশেষে বক্তব্য রাখেন কালি ও কলমের প্রকাশক আবুল খায়ের। তিনি বলেন, ‘বেঙ্গল ফাউন্ডেশনের অনেকগুলো কাজের অন্যতম হচ্ছে কালি ও কলম প্রকাশ। গত ১৬ বছর ধরে কালি ও কলম ঠিক সময়ে প্রকাশের জন্য আমার অনেক কষ্ট কমে যায়।’ এ-সময় তিনি কালি ও কলমের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট, বিশেষ করে পত্রিকাটির সম্পাদকম-লীর সভাপতি জাতীয় অধ্যাপক আনিসুজ্জামান, পত্রিকার সম্পাদক আবুল হাসনাত, সম্পাদকম-লীর সদস্য লুভা নাহিদ চৌধুরীসহ সবাইকে ধন্যবাদ জানান। একই সঙ্গে তিনি উল্লেখ করেন, নানা কারণে বর্তমানে অনেক কাজ করতে গিয়ে তাঁকে বাধার সম্মুখীন হতে হচ্ছে, তবে তিনি তাঁর স্বপ্ন থেকে সরে আসবেন না, ক্ষুদ্রপরিসরে হলেও তা বাস্তবায়নে সচেষ্ট থাকবেন।
অনুষ্ঠানের সম্মানীয় অতিথি আসাদুজ্জামান নূর এমপি তাঁর বক্তব্যের শুরুতেই কালি ও কলমের এ আয়োজনকে ধন্যবাদ জানান। তিনি বলেন, সংস্কৃতি অঙ্গনে কাজ করতে গিয়ে বহু গুণী মানুষের সঙ্গে তাঁর পরিচয় ও ঘনিষ্ঠতা হয়েছে। তাঁদের সান্নিধ্য তাঁকে করেছে অনুপ্রাণিত ও জ্ঞানের আলোয় আলোকিত। কালি ও কলম-প্রবর্তিত তরুণ কবি ও লেখক পুরস্কার নতুনদের স্বীকৃতিদানের পাশাপাশি তাদের পথচলাকে আরো বেগবান করবে বলে তিনি উল্লেখ করেন।
অপর সম্মানীয় অতিথি বিশিষ্ট চিত্রশিল্পী রফিকুন নবী বলেন, সাহিত্যের সঙ্গে চিত্রকলার যে গভীর সম্পর্ক তা কালি ও কলম পত্রিকা দেখলেই অনুধাবন করা যায়। এ-পত্রিকার বিভিন্ন লেখায় নানা শিল্পীর অলংকরণ পত্রিকাটিকে আরো সমৃদ্ধ করছে বলে তিনি উল্লেখ করেন। পুরস্কারপ্রাপ্তদের অভিনন্দন জানিয়ে কালি ও কলমের এ-প্রচেষ্টাকে তিনি সাধুবাদ জানান।
অনুষ্ঠানের প্রধান অতিথি সেলিনা হোসেন ২০০৮ সাল থেকে ধারাবাহিকভাবে কালি ও কলমের এ-পুরস্কার প্রদান একটি বিশেষ ঘটনা উল্লেখ করে বলেন, ‘এ রকম পুরস্কার মানুষকে নানাভাবে অনুপ্রাণিত করে। তরুণ লেখকেরা এ-পুরস্কার পেয়ে বড় মানুষ হয়ে ওঠার যে প্রেরণা পেলেন, তা খুব গুরুত্বপূর্ণ। এমন ক্ষেত্র যাঁরা তৈরি করেছেন, তাঁদের সাধুবাদ জানাই।’ তিনি আরো বলেন, বাংলাদেশের সকল সংগ্রামে তরুণরা রেখে চলেছে অগ্রণী ভূমিকা। এ-সময় তিনি ১৯৫২ থেকে ১৯৭১ সময়কালে তরুণদের সাহসী ও তেজোদীপ্ত ভূমিকার কথা স্মরণ করেন।
এরপর আসে সেই মাহেন্দ্রক্ষণ। পুরস্কার বিজয়ী চার নবীন সাহিত্যিকের হাতে একটি করে ক্রেস্ট, সনদপত্র ও শংসাবচন তুলে দেন মঞ্চে উপস্থিত বিশিষ্টজনেরা। আনন্দঘন পরিবেশে পুরস্কার গ্রহণের পর সংক্ষিপ্তাকারে একে একে নিজেদের অনুভূতি ব্যক্ত করেন বিজয়ীরা।
হানযালা হান বলেন, এ-পুরস্কার তাঁর কবিতাচর্চার স্বীকৃতি। ফয়সাল আহমেদ বলেন, পুরস্কারটি তিনি তাঁর মাকে উৎসর্গ করছেন, যিনি তাঁকে সবসময় সাহিত্যচর্চায় উৎসাহ জুগিয়েছেন। কামরুন নাহার শীলা বলেন, স্বীকৃতি অবশ্যই আনন্দের, আর কালি ও কলম পুরস্কার সেই আনন্দকে বাড়িয়ে দিয়েছে বহুগুণ। চৌধুরী শহীদ কাদের বলেন, কালি ও কলম পুরস্কার তাঁর গবেষণায় নতুন মাত্রা যোগ করবে নিঃসন্দেহে। সবশেষে ধন্যবাদ জ্ঞাপন করে বক্তব্য রাখেন কালি ও কলমের সম্পাদক আবুল হাসনাত। তিনি বলেন, ষোলো বছর ধরে বিরতিহীনভাবে প্রতিমাসে কালি ও কলম প্রকাশিত হয়ে আসছে, যা যে-কোনো বাংলা সাহিত্য পত্রিকার জন্য একটি বিরল ঘটনা। তিনি আরো বলেন, ‘বাংলাদেশের যে-কোনো সংকটকালে এদেশের যুব সম্প্রদায় ও তরুণ লেখকরাই অগ্রণী হয়ে ওঠেন। তাঁদের বিদ্রোহ ও অনুভবশীলতা নতুন পথ নির্মাণ করে। এই বোধকে বিবেচনায় নিয়েই কালি ও কলম হয়ে উঠেছে তরুণদেরও পত্রিকা। প্রতিষ্ঠিত ও প্রবীণ লেখকরাও এই পত্রিকায় মর্যাদার সঙ্গে উপস্থিত।’
ধন্যবাদ জ্ঞাপনের পর শেষ হয় অনুষ্ঠানের প্রথম পর্ব। এরপর শুরু হয় অনুষ্ঠানের দ্বিতীয় পর্ব – নাট্যজন আসাদুজ্জামান নূর, এমপি তাঁর ভরাট কণ্ঠে একের পর এক কবিতা আবৃত্তি করে মোহময় এক পরিবেশ তৈরি করেন হলজুড়ে। তাঁর আবৃত্তির পর মঞ্চে আসেন বেঙ্গল পরম্পরা সংগীতালয়ের বিদ্যার্থী সেতারবাদক সোহিনী মজুমদার। তাঁর সঙ্গে তবলায় সংগত করেন সুপান্থ মজুমদার। তাঁদের দুজনের যুগলবন্দি-বাদনের মধ্য দিয়ে সমাপ্তি ঘটে এ-আয়োজনের। ঘড়ির কাঁটা তখন রাত ৮টার ঘর ছুঁইছুঁই।
Leave a Reply
You must be logged in to post a comment.