দশ

দরবেশ খাঁ

সোনাদিঘি গ্রামের মোস্তফা খাঁর জীবনে এক অলৌকিক ঘটনা ঘটেছিল। তাঁর বয়স তখন চার-পাঁচ বছর। দুপুরের দিকে শিশু মোস্তফা ঘরের পালঙ্কে ঘুমাচ্ছে। উঠোনের অন্যদিকে রান্নাঘরে বসে রান্না করছেন মা। ছেলে তাঁর প্রাণের অধিক। রান্না করতে বসেও বারবারই তাকাচ্ছিলেন বড় ঘরের দিকে। সেইসব দিনে শিয়ালের উৎপাত ছিল খুব। ক্ষুধার্ত শিয়ালেরা নিরিবিলি বাড়িঘর পেলে দলবেঁধে এসে শিশুদের আক্রমণ করতো। ছিঁড়েখুঁড়ে খেত। গোরস্তান থেকে কবরের লাশ তুলে তো খেতই, দিন-দুপুরে মানুষের বাড়িঘরেও আক্রমণ চালাতো। মায়ের ভয় ছিল নীরব-নিঝুম বাড়িটায় কখন না এসে হানা দেয় শিয়াল! তার কলিজার টুকরোটিকে ধরে।

শিয়ালের ভয়ে ঘরের খোলা দরজার দিকে তাকিয়ে তিনি দেখতে পেলেন অদ্ভুত এক দৃশ্য।

বিংশ শতাব্দীর শুরুর দিককার কথা। বিক্রমপুর অঞ্চলে তখন মানুষজন কম। বিশাল বিশাল বিল। মাঠের পাশে ছোট ছোট গ্রাম। বর্ষায় গ্রামের বাড়িগুলো জেগে থাকে বিচ্ছিন্ন দ্বীপের মতো। বাড়ির উঠোন পালানে চলে আসে পানি। গরিব মানুষের ঘরের ভেতর ঢোকে। একটু যারা অবস্থাপন্ন তাদের ঘরগুলো পাটাতন করা। চৌচালা টিনের। উঠোন থেকে তিন-চার ধাপ কাঠের সিঁড়ি ভেঙে পাটাতন ঘরগুলোতে ঢুকতে হয়। তখনকার বর্ষাদিনে বৃষ্টি হচ্ছে তো হচ্ছেই। একনাগাড়ে
সাতদিন-দশদিন ধরে চলছে। জ্যৈষ্ঠী মাসের মাঝামাঝি সময় থেকে শুরু হয়ে যেত বর্ষাকাল। চলতো একেবারে অঘ্রান মাস পর্যন্ত। কার্তিক মাসেও বৃষ্টির বিরাম থাকতো না।

অঘ্রানের মাঝামাঝি শুরু হতো ধান কাটা। পৌষ মাসের শুরুর দিককার কয়েকটা দিন পর্যন্ত চলতো। ওই দিনগুলোয় ধানের গন্ধে ভরে থাকতো দেশগ্রাম। নতুন ধানের গন্ধের সঙ্গে চলতো পিঠা-পায়েসের উৎসব। শীত আসার আগেই ‘ঝুরা’ হতো খেজুর গাছগুলো। মাথার কাছে বেঁধে দেওয়া হতো মাটির হাঁড়ি। রসে পরিপূর্ণ হতো হাঁড়িগুলো। রসে ভেজানো পিঠা আর পায়েসের গন্ধ পাওয়া যেত গৃহস্থ বাড়িতে ঢুকলেই। আর কী শীত! ফাল্গুন মাসের মাঝামাঝি পর্যন্ত শীত যেতে চাইতো না। ভোরবেলাকার রোদে জড়িয়ে থাকতো কুয়াশা। চৈত্র-বৈশাখে আবার বেজায় গরম। গ্রাম-মানুষের জীবন অতিষ্ঠ।

সে ছিল এক চৈত্র দিনের ঘটনা। শিশু মোস্তফা ঘুমিয়ে আছে বড়ঘরে। রান্না করতে বসে মা বারবার তাকাচ্ছেন খোলা দরজার দিকে। একসময় তাঁর চোখে পড়ল অদ্ভুত এক দৃশ্য। দেখতে পেলেন তাঁর ঘুমন্ত মোস্তফা শূন্যে ভেসে খোলা দরজা দিয়ে বেরিয়ে যাচ্ছে।

এই দেখে মা প্রথমে গেলেন হতভম্ব হয়ে। তারপর দিশেহারা ভঙ্গিতে ছুটে গিয়ে ছেলেকে জড়িয়ে ধরলেন। ‘এই ভাবে কই চইলা যাইতাছো তুমি, বাজান?’

মোস্তফা আগের মতোই ঘুমিয়ে আছে কিন্তু ভেসে আছে শূন্যে। মা তাকে জড়িয়ে ধরার সঙ্গে সঙ্গে খুব কাছ থেকে ভরাট পুরুষালি গলায় কে যেন বলল, ‘এই পাপের জগতে মোস্তফাকে আমি রাখবো না। তুমি তাকে ছেড়ে দাও।’

দু-হাতে শূন্যে ভাসমান ছেলেকে জড়িয়ে ধরে মা আকুল কান্নায় ভেঙে পড়লেন। ‘না না আমার পোলারে আমি কোনোখানে যাইতে দিমু না। সে আমার কাছে থাকবো। আমার বুকে থাকবো। আপনে কে?’

এই প্রশ্নের উত্তর পাননি মা। তবে মোস্তফাকে তিনি রেখে দিতে পেরেছিলেন। একটা সময়ে দেখা গেল ভাসমান ঘুমন্ত ছেলেটি তার পাঁজাকোলে। তিনি তাকে আবার এনে পালঙ্কে শুইয়ে দিলেন। তারপর মোস্তফার ঘুম ভেঙেছিল। মা তখন তাকে জড়িয়ে ধরে অঝোর ধারায় কাঁদছেন।

ঘুমভাঙা চোখে ছেলে বলল, ‘কী হইছে মা? কান্দো কেন?’

মা কাঁদতে কাঁদতে বললেন, ‘তুই আমারে কোনোদিন ছাইড়া যাইস না বাজান। তরে ছাড়া আমি বাঁচুম না।’

শিশু মোস্তফা কোনো কথা বলেনি। মায়ের মুখের দিকে অনেকক্ষণ তাকিয়ে ছিল। মা বুঝে গিয়েছিলেন মোস্তফার সঙ্গে জিন আছে। সেই জিনই তাকে অচিন কোনো পবিত্র জগতে নিয়ে যেতে চেয়েছিল। এ-কথা তিনি তাঁর স্বামীকে বলেছিলেন। আত্মীয়স্বজন-পড়শিরাও কেউ কেউ জেনে গিয়েছিল। ফলে সেই শিশু বয়স থেকেই সোনাদিঘি গ্রামের লোকজন আবালবৃদ্ধবনিতা মোস্তফাকে অন্যরকম চোখে দেখতো। সমীহ করতো। তার বয়সী শিশুরা খুব একটা মিশতো না মোস্তফার সঙ্গে।

মোস্তফা একা একা তার নিজের মতো করে বড় হচ্ছিল। আপনমনে ঘুরে বেড়াতো নির্জনে। গাছপালা আর শূন্যতার দিকে তাকিয়ে থাকতো। অন্ধকার রাতে তাকিয়ে থাকতো দূর আকাশের নক্ষত্রের দিকে। শিউলি ফুলের মতো জোছনা ভরা রাতে তাকিয়ে থাকতো চাঁদের দিকে।

বাড়ির অদূরে বিশাল ধানের মাঠ। লোকে বলে ‘চক’। সেই চকের ওপারে সমুদ্রের মতো পদ্মা। কখনো কখনো একাকী পদ্মার দিকে হেঁটে যেত মোস্তফা। ধানের চকে খেলা করতো আকাশ থেকে নেমে আসা রোদ আর পদ্মা থেকে ছুটে আসা হাওয়া। আকাশ নদী মাঠ আর প্রকৃতি, গাছপালা আর ফুলের বনে ছয় ঋতুর ছয় রকমের খেলা সেই শিশু বয়স থেকেই উপলব্ধি করতে শিখেছিল মোস্তফা। তার সঙ্গে থাকা কথিত জিন এই চলমান জগতের ভেতরে থাকা আরেক অদৃশ্য জগতের সঙ্গে তাকে যেন পরিচয় করিয়ে দিচ্ছিল। নিরিবিলিতে নির্জনতায় থাকতেই ভালোবাসতো মোস্তফা।

সেই জীবনের বহু বছর পর গভীর নির্জনতায় এই জগতের ভেতর লুকিয়ে থাকা অন্য জগৎটির অনুসন্ধান করতে সে চলে যাবে হিমালয় অঞ্চলে। মহান হিমালয়ের পাদদেশে গভীর গভীরতর নির্জনতায় বারোটি বছর ধরে সে অনুসন্ধান করবে সেই অন্তর্লীন জগতের। হয়তো সন্ধান সে পাবে এবং তার সঙ্গী জিনের কল্যাণে নিজের জীবনধারাও সে বদলে ফেলবে। তার নামের সঙ্গে যুক্ত হবে ‘দরবেশ’। ‘সে’ থেকে হয়ে উঠবেন ‘তিনি’। নামের আগে যুক্ত হবে ‘দরবেশ’ শব্দটি। তার নাম হয়ে যাবে দরবেশ মোস্তফা খাঁ। একসময় মোস্তফা আর কেউ বলবে না। বলবে ‘দরবেশ খাঁ’।

এই আখ্যান সেই দরবেশ খাঁয়ের।

একাকী নিজের মতো বড় হয়ে উঠছিলেন দরবেশ খাঁ। লোকজনের সঙ্গে তেমন মেলামেশা করতেন না। বাবা মা ভাই বোনদের সঙ্গেও কথা বলতেন কম। বাবা নিয়ামত খাঁ তাঁকে রতনপুর হাইস্কুলে ভর্তি করিয়ে দিয়েছিলেন। পড়াশোনায় ছিল তাঁর ব্যাপক আগ্রহ। নিবিষ্ট মনে অনেক রাত পর্যন্ত হারিকেনের আলোয় স্কুলের পড়া পড়তেন। একটু বড় হয়ে ওঠার পর নানা রকমের ধর্মীয় বই পড়তেন। শিশু বয়সের অভ্যাসটি আরো পাকাপোক্ত হয়ে গেছে বড় হয়ে ওঠার সঙ্গে সঙ্গে।

লক্ষ্মীদিঘি গ্রামে ছিল তাঁর মামাবাড়ি। সেই গ্রামে বলতে গেলে তিনি যেতেনই না। বিয়েবাড়ি কিংবা আনন্দ-উৎসবের কোনো বাড়িতে যেতেন না। তার বন্ধু বলতে গেলে ছিলই না। প্রকৃতি দেখে, আকাশ নদী দেখে নির্জনে তিনি সময় কাটাতেন। কখনো কখনো পদ্মাতীরে গিয়ে এমনভাবে দাঁড়িয়ে থাকতেন, গোধূলিবেলার আলোয় তখন তাঁকে দেখে মনে হতো এই জগতে থেকেও তিনি যেন এই জগতে নেই। তাঁর শরীর পড়ে আছে এই জগতে, মন চলে গেছে অন্য জগতে।

কখনো কখনো তাঁকে দেখা যেত ধানিচক ভেঙে পদ্মার দিকে হেঁটে যেতে যেতে খুব নিচু স্বরে কার সঙ্গে যেন কথা বলছেন।

কে সে? কার সঙ্গে কথা বলতেন দরবেশ? সে কি তাঁর সঙ্গী জিন? জিনের সঙ্গে কথা বলতেন? কী কথা বলতেন? তাঁর ভাবনার জগৎ জুড়ে কী ছিল তখন? কোন পবিত্র ধর্মের বাণী ধীরে ধীরে গ্রাস করছিল তাঁর অন্তর্জগৎ?

পড়াশোনায় দরবেশ ছিলেন অত্যন্ত মেধাবী। রতনপুর হাইস্কুল থেকে ম্যাট্রিকুলেশন পাশ করলেন ১৯১৯ সালে। বরাবরই স্কুলের শিক্ষকরা তাঁকে খুব ভালোবাসতেন। তাঁকে নিয়ে অনেক আশা ছিল শিক্ষকদের। সেই আশা তিনি পূরণ করেছিলেন। ফার্স্ট ডিভিশন পেলেন ম্যাট্রিকুলেশনে।

তখন অবিভক্ত বাংলা। পূর্ব বাংলায় কোনো ‘বোর্ড’ নেই। ‘বোর্ড’ কলিকাতায়। সেখানে গিয়ে পরীক্ষা দিতে হয়েছিল। দরবেশ খাঁ পাঁচটি বিষয়ে লেটার মার্কস পেলেন। রতনপুর হাইস্কুল গৌরবে অনেক উচ্চতায় উঠে গেল।

দরবেশ খাঁকে তারপর কলিকাতায় পাঠিয়ে দিয়েছিলেন তাঁর বাবা। আইএ পাশ করলেন সেখান থেকে। ১৯২১ সাল। এবারো ফার্স্ট ডিভিশন। তারপর তিনি পড়তে গিয়েছিলেন আলীগড় বিশ্ববিদ্যালয়ে। ১৯২৩ সালে কৃতিত্বের সঙ্গে বিএ পাশ করলেন। দরবেশ খাঁর আগে বিক্রমপুরের সোনাদিঘি গ্রাম তো দূরের কথা, আশপাশের বিশ-পঞ্চাশ গ্রামের কেউ আলীগড়ে পড়তে গিয়েছে কি না তেমন ইতিহাস পাওয়া যায় না। বহু মানুষের মধ্যে থেকেও একাকী নিজের জগতে বসবাস করা মানুষটি ধীরে ধীরে বিভিন্ন ভাষা রপ্ত করতে লাগলেন। পণ্ডিত হয়ে উঠলেন ছয়টি ভাষায়। বাংলা ইংরেজি আরবি উর্দু ফারসি ও সংস্কৃত। বিক্রমপুরের অখ্যাত সোনাদিঘি গ্রামের মধ্যবিত্ত পরিবারের একটি ছেলে আলীগড় থেকে বিএ পাশ করবেন, ছয়টি ভাষায় সুপণ্ডিত হয়ে উঠবেন – এ-কথা কেউ কল্পনাও করেনি।

দরবেশ খাঁর ভাষাজ্ঞানের পরিচয় পাওয়া যাবে আরো কিছুকাল পরে, যখন তিনি পবিত্র কোরআন মজিদের চার পারা আরবি থেকে ইংরেজিতে অনুবাদ করবেন। এই অনুবাদকর্ম চার পারার পর আর এগোবে না। কেন তিনি পুরো কোরআন শরিফ ইংরেজিতে অনুবাদ করলেন না – এর সঠিক উত্তর কেউ দিতে পারবে না। দরবেশ খাঁ নিজেও এই নিয়ে কখনো কোনো উচ্চবাচ্য করবেন না। অনুবাদকর্মটি তিনি ধীরে ধীরে করে যাচ্ছিলেন। একটা সময়ে হয়তো তাঁর মনে হবে, জীবদ্দশায় এই কাজ তিনি শেষ করে যেতে পারবেন না অথবা তিনি কোনো আধ্যাত্মিক নিষেধাজ্ঞায় পড়বেন। হয়তো তাঁর অনুবাদ সঠিক হচ্ছে না, এই ভয়ও মনের গভীরে কাজ করবে।

ততদিনে নিজের চারপাশে দরবেশ খাঁ দেখতে পাবেন তাঁর ভক্তসংখ্যা বেড়ে চলেছে। কারো সঙ্গে তিনি তেমন কথা বলেন না। মতবিনিময় করেন না। তারপরও মানুষ জড়ো হচ্ছিল তাঁর চারপাশে। রাত জেগে জেগে কিংবা দিনের প্রখর আলোয় তিনি আধ্যাত্মিক গান লিখতেন। অতিযত্নে কবিতা রচনা করে খাতা ভরিয়ে রাখতেন। সেই সব কবিতা ও গানে রহস্যময় জগৎ-সংসারের কথা, ধর্ম ও পরম করুণাময়ের প্রতি প্রেম আর গভীর ভালোবাসার চিহ্ন ছড়ানো থাকবে।

যেমন বাংলা ১৩৩৮ সনের ২রা শ্রাবণ এক বৃষ্টিমুখর রাতে তিনি লিখবেন,

স্ত্রী নয়, পুরুষ নয়, সর্ব গুণময়;

আকারে সে নিরাকার, শাস্ত্র পরিচয়।

বসিতে আসন আছে, মুখে কথা কয়;

বেদ, কোরাণ, বা’বেল বাণী কতিপয়।

স্বরূপে সৃজনে সব প্রভু দয়াময়;

ময়ূর, ভুজঙ্গ তিনি অচিন্ত বিষয়।

গুরু ধর কর সাধন শিখ বিনয়;

পাবে কান্ত সে অনন্ত রূপে রূপে জয়। 

এই রচনার তলায় টীকা হিসেবে লিখবেন, ‘কিছুই না এইরূপ অবস্থা হইতে তাঁহাকে ডাকিতে হইবে। গভীর ভক্তি সহকারে ডাকিতে ডাকিতে আপনি-ই তিনি হৃদয় স্থান হইতে জাগিয়া উঠিবেন।’

স্কুলে উপরের ক্লাসে পড়ার সময় থেকেই এই বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের মালিক, জগতের সৃষ্টিকর্তা পরম করুণাময়ের আলোয় তাঁর মনোজগৎ আলোকিত হয়ে উঠছিল। কলেজে পড়ার সময়ও লেখাপড়ার ফাঁকে ফাঁকে উদাস হয়ে তিনি সৃষ্টিকর্তার কথা ভাবতেন। আলীগড়ে পড়তে গিয়ে এই ভাবনা আরো বিস্তৃতি লাভ করে। সেখান থেকে গ্র্যাজুয়েট হওয়ার পর তিনি চলে গিয়েছিলেন বাগদাদ শরিফে।

এতদিনে পরম করুণাময়ের সান্নিধ্য লাভের সন্ধান করার ধ্যানে তো তিনি মগ্ন ছিলেনই, অন্যদিকে হজরত মুহাম্মদ (সা.), রাসুলে পাকের এশকে আশেক হয়ে মোর্শেদের সন্ধানে তাঁর বাগদাদ শরিফে যাওয়া। সেখানে অলিকুলের শিরোমণি পীরানে পীর দস্তগীর গাওছ-উল্-আজম হজরত মহীউদ্দীন সৈয়দ আব্দুল কাদের জ্বিলানী সাইয়েন লিল্লাহ্ (র.)-এর বংশধর অলিয়ে কামেল হজরত আল্ আল্ কাদেরী (র.)-এর কাছে বায়েত হন। তারপর তিনি চলে গিয়েছিলেন মদিনা শরিফে। রাসুলে পাকের রওজা শরিফ জিয়ারত করলেন। কিছুদিন কাটালেন মদিনায়। মদিনা থেকে চলে গেলেন মক্কা শরিফে। পালন করলেন পবিত্র হজব্রত।

দেশে ফিরে আসার পর দরবেশ খাঁয়ের চালচলন আগের চেয়েও অনেক বদলে গেল। আগের তুলনায় শতগুণ ভাবুক হয়ে উঠলেন তিনি। একান্তই আপনমনে থাকেন। তাঁর পোশাক-আশাক বদলে গেল। আহার-নিদ্রা সবকিছুতেই ব্যাপক পরিবর্তন ঘটল। নিজের মনোজগতের বাইরে অন্য কোনো কিছুই যেন তাঁর চোখে পড়ে না। সংসার ধর্ম, দৈনন্দিন বিষয়কর্ম,
রুজি-রোজগার অর্থাৎ সাধারণ মানুষ যেরকম জীবন কাটায়, বর্তমান আর ভবিষ্যৎ নিয়ে চিন্তিত থাকে, সেসবের কোনো কিছুই তাঁর মধ্যে কাজ করে না। সংসারে থেকেও তিনি আসলে সংসারে থাকেন না। চলমান জগতের মানুষ হয়েও তিনি থাকেন অন্য এক জগতে। সেই পবিত্র জগৎ ভরে থাকে পরম করুণাময়ের আরশ থেকে, সাত আসমানের উপর থেকে আসা অলৌকিক আলোয়। যে-আলো তিনি ছাড়া আর কেউ দেখতে পায় না।

বাবা-মা ছেলেকে নিয়ে চিন্তিত। কী হবে এই ছেলের জীবনে? কেমন হবে তাঁর ভবিষ্যৎ?

তখন ব্রিটিশ ইন্ডিয়ার কাল। বাঙালির একটি বড় অংশ বার্মামুলুকের রেঙ্গুনে কাজ করে। পশ্চিমবঙ্গ পূর্ববঙ্গ দুই বঙ্গের মানুষেরই কর্মসংস্থানের একটি বড় জায়গা হয়ে উঠেছে রেঙ্গুন। দরবেশ খাঁয়ের বাবা কর্মসূত্রে রেঙ্গুনে থাকা তাঁর এক দূরসম্পর্কের আত্মীয়কে ধরে ছেলের জন্য সেখানে একটি চাকরির ব্যবস্থা করলেন। উদ্দেশ্য একটাই, যদি ছেলেকে বিষয়কর্মে নিয়োজিত করা যায়! যদি তাঁকে বৈষয়িক করা যায়! যদি তাঁকে সংসারের দিকে ফিরিয়ে আনা যায়!

কলিকাতা থেকে জাহাজে চড়ে বঙ্গোপসাগর পাড়ি দিয়ে দরবেশ খাঁ চলে গিয়েছিলেন রেঙ্গুনে। চাকরিতে যোগ দিলেন। কিন্তু চাকরি তাঁর একদমই ভালো লাগল না। রেঙ্গুনের পরিবেশে তিনি নিজেকে মানিয়ে নিতে পারলেন না। কিছুদিন কাটালেন সেখানে। তারপর আবার বঙ্গোপসাগর পাড়ি দিয়ে দেশে ফিরে এলেন।

ছেলের ফিরে আসা বাবা-মাকে ভীষণই হতাশ করল। কী হবে এই ছেলের?

দরবেশ খাঁ আগের মতোই আছেন। সংসারের দিকে তিনি তাকিয়েও দেখেন না। তিনি থাকেন নিজেকে নিয়ে।

বাবা নিয়ামত খাঁ আবার তৎপর হলেন। কলিকাতায় ছেলের চাকরির জন্য চেষ্টা করতে লাগলেন।

পড়াশোনায় খুবই মেধাবী দরবেশ খাঁ। ম্যাট্রিকুলেশনে গোল্ডমেডেল, আইএতে ফার্স্ট ডিভিশন। আলীগড় থেকে গ্র্যাজুয়েট হয়েছেন কৃতিত্বের সঙ্গে। সুতরাং সরকারি চাকরি পাওয়া তাঁর জন্য মোটেই কঠিন কাজ নয়।

চাকরি হয়ে গেল কলিকাতার ‘মহাকরণে’। এখনকার দিনে যাকে বলা হয় ‘সেক্রেটারিয়েট’। সেখানে বড় চাকরি পেলেন দরবেশ খাঁ। সেকশন অফিসার। এ এক স্বপ্নের চাকরি। বাঙালি মুসলমান পরিবারের ছেলেদের জন্য তো বটেই! কিন্তু এই আকর্ষণীয় চাকরিটিও দরবেশ খাঁ করলেন না। পনেরো দিনের মাথায় ইস্তফা দিলেন। কারণ বিশ্বপ্রকৃতি তখন তাঁকে ডাকছিল। সংসারজীবন তাঁকে মোটেই আকর্ষণ করছিল না। বৈষয়িক চিন্তা তাঁকে বাধাগ্রস্ত করতে পারল না।

বিক্রমপুর অঞ্চলের মানুষ জানে, দরবেশ খাঁ অবিবাহিত। তিনি চিরকুমার। নারী-সান্নিধ্য তাঁকে আকর্ষণ করেনি। তবে দরবেশ খাঁয়ের বক্তব্য অন্য। তিনি মনে করেন, তিনি বিবাহিত। তাঁর বিয়ে হয়েছিল। এই মনে করার কারণ বা রহস্য কী?

তখনকার বিক্রমপুর অঞ্চল ছিল গাছপালা আর বনজঙ্গলে ভর্তি। গ্রামগুলোর চারপাশ ঘিরে বনবনানী চকমাঠ আর ঝোপজঙ্গল। বনে আর ঝোপজঙ্গলে শিয়াল খাটাশ বাঘডাস ইত্যাদি তো ছিলই, সাপ ছিল বিস্তর। নিম্নাঞ্চলে যেমন হয়। চিতাবাঘও ছিল জঙ্গলগুলোতে। কলিকাতার দৈনিক আনন্দবাজার পত্রিকায় সংবাদ বেরিয়েছিল, বিক্রমপুর অঞ্চলের এক গ্রামের নিরিবিলি বাড়ি থেকে দিনের আলোয় ঘরে ঢুকে চিতাবাঘে নিয়ে গেছে তিন-চার বছর বয়সী শিশুকে।

আশ্বিন-কার্তিকে যখন নামতে শুরু করতো বর্ষার পানি, চকবিলের পানি তখন পচে কালো হয়ে যেত। মশার উৎপাত ছিল ব্যাপক। মাছি ছিল নানা রকমের। মৌমাছি আর বল্লার চাক ছিল প্রায় প্রতিটি বাড়িতে। মশামাছির উৎপাতে গৃহস্থলোক শান্তিতে থাকতে পারত না।

সোনাদিঘি গ্রামের পাশের গ্রামটির নাম লক্ষ্মীদিঘি। সোনাদিঘা আর লক্ষ্মীদিঘা নামে তখন দুরকম ধানও ছিল। এই দুই গ্রামে সেই ধানের আবাদ ব্যাপক হারে হতো বলে হয়তো বা গ্রাম দুটোর নাম সোনাদিঘা লক্ষ্মীদিঘা থেকে সোনাদিঘি আর লক্ষ্মীদিঘি হয়েছে। নাম শুনে মনে হতে পারে এই গ্রাম দুটোতে বিশাল বিশাল দিঘি আছে। হয়তো বা সেই কারণে এই রকম নাম। আসলে তা নয়। নাম দুটো এসেছে ধানের নাম থেকে।

লক্ষ্মীদিঘি গ্রামের তরফদার বাড়ি খুবই নামকরা। বনেদি গৃহস্থ হিসেবে বেশ খ্যাতি এই পরিবারের। দেশভাগ হওয়ার পর, পাকিস্তানের একজন কেন্দ্রীয় মন্ত্রী এই তরফদার বাড়িতে বিয়ে করেছিলেন। সেই মন্ত্রী মহোদয়ের শ্যালিকার নাম মরিয়ম বিবি। মরিয়ম বিবির বাবার নাম মতিন তরফদার। মতিন তরফদার সাহেবের ছোট কন্যা মরিয়ম বিবির সঙ্গে দরবেশ খাঁয়ের বিয়ে ঠিক হয়েছিল। বিয়ের আগের সন্ধ্যায় মরিয়ম বিবির জীবনে নেমে এসেছিল ঘোরতর অন্ধকার। সন্ধ্যাবেলায় হাত-মুখ ধুয়ে ঘরে ফেরার সময় বিষধর কালজাত সাপ দংশন করল তাঁকে। দেশগ্রামে তখন সাপের ওঁঝা ছিল অনেক। ওঁঝা ডাকা হলো। চেষ্টা-তদবির যতটা করার করা হলো। কিন্তু মরিয়ম বিবিকে বাঁচানো গেল না। সাপের বিষ সেই রাতেই তাঁকে পাঠিয়ে দিলো অনন্তলোকে।

এই খবর পেলেন দরবেশ খাঁ ও তাঁর পরিবার। তরফদার পরিবারের মতো তাঁদের পরিবারেও উঠল হাহাকার। পরদিন মরিয়ম বিবির জানাজা ও দাফন। দরবেশ খাঁ সেই বাড়িতে গিয়ে উপস্থিত হলেন। জানাজা ও দাফনে শরিক হলেন। তাঁর মুখে বিষাদের ছায়া।

তখনকার দিনের নিয়ম অনুযায়ী তরফদার সাহেব মেয়ের বিয়েতে জামাইকে যা দান করতেন বা উপহার হিসেবে দিতেন সবই কেনা হয়ে গিয়েছিল। তরফদার সাহেব তা দরবেশ খাঁকে দিয়ে দিতে চাইলেন। দরবেশ খাঁ প্রত্যাখ্যান করলেন। শুধু একটি জিনিস তিনি অত্যন্ত আন্তরিকতার সঙ্গে গ্রহণ করলেন। একটি পানদান। সোনা আর রুপার মিশেলে তৈরি। ভারি সুন্দর একটি ময়ূরের ছবি আঁকা ছিল সেই পানদানে।

তারপর দরবেশ খাঁ আর বিবাহ করেননি। বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হওয়ার ব্যাপারে আসলে কখনোই তাঁর কোনো আগ্রহ ছিল না। মরিয়ম বিবির সঙ্গে তাঁর বিবাহ ঠিক হয়েছিল দরবেশ খাঁয়ের অমতে আর পরিবারের জোরাজুরিতে। মরিয়ম বিবি ইন্তেকাল করলেন। যেহেতু এই নারীর সঙ্গে তাঁর বিবাহের কথা পাকা হয়েছিল, এই কারণে নিজেকে তিনি বিবাহিত মনে করতেন।

প্রকৃত অর্থেই দরবেশ খাঁ ছিলেন সংসার বিবাগী। তাঁর ধ্যানজ্ঞান সবই পরম করুণাময়ের জন্য। অন্য কোনো দিকে তিনি তাকানও না, অন্য কোনো কিছু তিনি ভাবেনও না।

সাধারণ মানুষের কাছে খাওয়াদাওয়ার ব্যাপারটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। ভালো খাবারের প্রতি আকর্ষণ প্রায় প্রতিটি মানুষের। এ-ব্যাপারেও দরবেশ খাঁ ছিলেন চরম উদাসীন।

খাওয়া-দাওয়ার ব্যাপারে বিন্দুমাত্র লোভ ছিল না তাঁর। ভালো মানের খাবার, উন্নত খাবার তিনি পছন্দই করতেন না। খেতেন অতি সাধারণ মানুষের খাবার। দেশগ্রামের সাধারণ মানুষ, গৃহস্থলোক নিয়মিত যে-ধরনের খাবার খেয়ে থাকে, দরবেশ খাঁ ওরকম খাবারই খেতেন। পরিমাণ খুবই কম। স্বল্পাহারী বলতে যা বোঝায়, তিনি ছিলেন তাই। প্রাণী জাতীয় খাবার গ্রহণ করতেন না। অর্থাৎ মাছ-মাংস খেতেন না। উদ্ভিদ জাতীয় খাবার ছিল তাঁর পছন্দ। বিভিন্ন রকমের শাক আর প্রতিটি ঋতুর সবজি থাকত তাঁর খাদ্যতালিকায়।

খেতে বসে নিজের খাবার তিনটি ভাগ করতেন। তিন ভাগের দু-ভাগ নিজে খেতেন, এক ভাগ কুকুর-বিড়াল আর পোকামাকড়ের জন্য আলাদা করে রেখে দিতেন। কুকুর-বিড়ালেরও খিদে পায়, পোকামাকড়েরাও খায়, বেঁচে থাকে। মানুষ তো আছেই! মানুষের চারপাশে ছড়িয়ে থাকা জীবজগতের খাদ্যের কথাও তিনি ভাবতেন। জীবন ধারণের জন্য সামান্য যেটুকু খাবার হলেই চলে, তিনি সেটুকুই গ্রহণ করতেন।

পোশাক পরিধানের ব্যাপারেও তিনি ছিলেন অন্যরকম। সেলাই করা পোশাক পরতেন না। দর্জিদের কাছে গিয়ে জামাকাপড় তৈরি করা, সেগুলো পরিধান করা তাঁর চরিত্রে ছিল না। পরতেন সেলাইবিহীন পোশাক। মার্কিন কাপড়ের, লম্বা শাড়ির মতো একপ্রস্থ কাপড় গায়ে জড়িয়ে রাখতেন। শীতকাল গরমকাল সব সময় ওই একই পোশাক। লম্বা কাপড়টির একপ্রান্ত পরতেন লুঙ্গির মতো করে, অন্যপ্রান্ত চাদরের মতো করে গায়ে জড়িয়ে রাখতেন।

দরবেশ খাঁর পোশাকের রং ছিল নীল। মার্কিন কাপড়ের ওই নীল রঙের একপ্রস্থ কাপড় ছাড়া অন্য কিছুই গায়ে জড়াতেন না। পোশাক নিজ হাতে ধুয়ে রাখতেন। কেন সেলাইবিহীন কাপড় পরতেন, আর কেনই বা সেই কাপড়ের রং নীল, কোন নিগূঢ় রহস্য রয়ে গিয়েছিল তাঁর পোশাকের ক্ষেত্রে, তা কখনোই কাউকে বলেননি। প্রকাশ করেননি।

আশ্চর্যের ঘটনা হলো, তিনি তাঁর ভক্তদের একসময় বলবেন, দেহত্যাগের পর কাফনের কাপড় হিসেবেও ওই নীল রঙের কাপড়ই যেন তাঁর জন্য ব্যবহার করা হয়। তিনি নিজ হাতে ওই রকম একপ্রস্থ কাপড় ধুয়ে সযত্নে রক্ষা করবেন তাঁর কাফন হিসেবে। মৃত্যুর পর সেই কাপড়েই দাফন করা হবে তাঁকে। দরবেশ খাঁয়ের এই নির্দেশ কেউ অমান্য করবে না। এমনকি তিনি তাঁর নিজের জানাজাও নিজে পড়ে যাবেন। তারপরও আরো তিনটি জানাজা হবে তাঁর।

পীর অলি সাধু সন্ন্যাসী পাগল আর দরবেশদের সম্পর্কে সাধারণ মানুষের কতগুলো প্রচলিত ধারণা আছে। মানুষ মনে করে, এই ধরনের মনীষীরা ধর্মকর্মের বাইরে থাকেন। তাঁরা নামাজ পড়েন না। রোজা রাখেন না। ধর্মীয় শিক্ষা গ্রহণ করেন না। নিজ ধর্মের রীতিনীতি মেনে চলেন না। হয়তো কারো কারো ক্ষেত্রে কথাটা খাটে, কিন্তু দরবেশ খাঁয়ের ক্ষেত্রে মোটেই তা খাটে না। তিনি ছিলেন ব্যতিক্রমী মহাপুরুষ। বহুগুণে গুণান্বিত মানুষ। সাধক দরবেশ। পরম করুণাময়ের প্রেমে নিমগ্ন থাকা মানুষ। অত্যন্ত ধার্মিক। সাধক। কবি। গীতিকার।

পরম করুণাময়ের প্রেমে নিমজ্জিত থাকা মানুষটির কাছে মানবিক প্রেম ছিল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। নিয়মিত নামাজ পড়তেন। রোজা রাখতেন। মসজিদে ইমামতিও করতেন প্রয়োজনে। কথা কম বলা মানুষ। তারপরও মহিলাদের পর্দা নিয়ে কথা বলতেন। ছোট ছেলেমেয়েদের ধর্মীয় শিক্ষা নিয়ে কথা বলতেন। ধর্মীয় অনুশাসন মেনে চলার জন্য চারপাশের প্রত্যেক মানুষকে তাগিদ দিতেন।

পরিবারের যারই মৃত্যু হতো দরবেশ খাঁ নিজেই তার নামাজে জানাজা পড়াতেন। নিয়মিত কোরআন তেলাওয়াত করতেন। জুমার নামাজে ইমাম সাহেব কোনো কারণে অনুপস্থিত থাকলে তিনি ইমামতি করতেন। খুতবা পাঠ করতেন। পরিবারের সবাইকে নিয়ে ঈদের নামাজে শরিক হতেন। শুধুমাত্র ধর্মীয় আলোচনা ও আধ্যাত্মিক জগতের রহস্যময়তা ছাড়া, পরম করুণাময় আল্লাহপাক ও নবীজীর জীবনের বিভিন্ন দিক ছাড়া অন্যান্য জাগতিক আলাপ-আলোচনায় কখনোই তিনি সময় নষ্ট করতেন না।

তবে চরিত্রের সঙ্গে মেলে না এমন একটি অভ্যাস দরবেশ খাঁয়ের ছিল। ধূমপান করতেন। বিড়ি বা তামাক নয়, সিগারেট পানে আসক্ত ছিলেন। চেইনস্মোকার বলতে যা বোঝায় তিনি ছিলেন তাই। একটার পর একটা, একটার পর একটা সিগারেট পান করতেন।

একটা সময়ে যখন তিনি সোনাদিঘি গ্রামে এসে পাকাপাকিভাবে বসবাস শুরু করবেন, তখন দেশগ্রামের মানুষ লক্ষ করবে, ওই একপ্রস্থ নীল রঙের মার্কিন কাপড় গায়ে জড়ানো মানুষটি আপনমনে রতনপুর বাজারের দিকে হেঁটে যাচ্ছেন। বিড়বিড় করে একটি-দুটি কথা বলছেন হয়তো তাঁর অশরীরী সহচরের সঙ্গে। জন্মের পর থেকেই কথিত জিন হিসেবে দেশগ্রামের লোক যাকে গণ্য করে।

বাজারে আমীর খাঁয়ের পাইকারি দোকান। পদবি খাঁ হলেও আমীর খাঁ দরবেশ খাঁয়ের আত্মীয়-পরিজন নয়। তাঁর বাড়ি মান্দ্রা গ্রামে। বাজারের বড় দোকানটি আমীর খাঁয়ের। বিশাল দোকানটির ভেতর বহুকালের ঘাপটি মারা অন্ধকার। রাব ঝোলাগুড়, তেল সাবান আর নানা প্রকারের নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের অদ্ভুত একটা গন্ধ আছে। দোকানের অর্ধেক জুড়ে কাঠের পাটাতন। কত বছরের পুরনো কে জানে! কাঠের রং হয়ে গেছে রাবের মতো। সেই দোকান থেকে দু-তিন প্যাকেট করে সিগারেট কিনতেন দরবেশ খাঁ। ম্যাচ কিনতেন। তারপর সিগারেট টানতে টানতে বাড়ির দিকে ফিরতেন। [চলবে]