ছায়াছন্ন

জীবনে একবারই দুপুরবেলা ঘুমে চোখ লেগে এসেছিল জামিলা বেগমের। সে-ঘটনা যে সারাজীবন বিষাক্ত দুঃস্বপ্ন হয়ে সঙ্গে সঙ্গে ঘুরবে, কে জানতো! 

শরীরে যৌবন ঢুকি ঢুকি করছে সময়েও তার ঘুম পেত না। অথচ পিঠাপিঠি বড়বোন ভাত খেয়ে দুপুর উপুড় করে ঘুমে তলিয়ে যেত। জামিলা একা একাই তাদের বাড়ির সামনের বড় কাঁঠালগাছে ঝোলানো পিঁড়িতে বসে দুলতেন। মনে হতো, ঘুমিয়ে গেলে চারপাশের ফুল-পাখি-পিপিলিকাদের তৈরি করা বিস্ময় যদি অগোচরে রয়ে যায়!

তবে সেই খরখরে দুপুরে পিঁড়ির দোলনায় দুলতে দুলতে ঝিমুনি এসেছিল, আধোঘুমে হতভম্ব জামিলা বেগমকে মুখ চেপে বাড়ির নিরাপদ চৌহদ্দি থেকে তুলে নিয়ে গিয়েছিল ওরা। তারপর থেকে দুপুর তো দূর, রাতের ঘুমও জামিলাকে ছেড়ে গেছে বহু বহু দিন।

সেই জামিলা বেগম আজকাল সকালের নাস্তা খেয়ে আবার ঘুমিয়ে পড়বেন, ভাবেননি কখনো।

ঘুম ভেঙে চমকে উঠেছেন জামিলা বেগম। ঘরের ভারি পর্দা জ্যৈষ্ঠ মাসের চণ্ড রোদ আটকে দিলেও তা ভেদ করে দূরের কী এক সমস্বর কান্না ঢুকে পড়ছে। রাস্তায় শিশু কাঁদে, নাকি বেড়ালছানা! জানালা খুলে দেখলে হয়, ভাবতে ভাবতে আবার চেতন-অচেতনের ঝিমুনি এসে যাচ্ছে। শিশু কিংবা বেড়ালের কোরাস থেমে থেমে মিলিয়ে গেল। তার বদলে ঘরে ঢুকে পড়ল অজগরের মতো কুণ্ডলী পাকানো রোদ। এই রোদকেও শত্রু মনে হয় জামিলার।

পর্দাটা কে কখন সরিয়ে দিয়ে গেল, টের পেলেন না, আশ্চর্য! এ-বাড়ির প্রতি ইঞ্চিতে যা কিছু আছে, নিজের হাতের তালুর মতো চেনা, অথচ চোখের সামনে দিয়ে কেউ পর্দা সরিয়ে ঘরের মধ্যে গরমের হলকা ঢুকিয়ে দিচ্ছে! ঘামে চুলের গোড়া পর্যন্ত ভিজে গেছে। জানালা খোলা আছে, ফ্যান চলছে ফুল স্পিডে, তবু গায়ের নীল ম্যাক্সির ভেতরে টপ টপ করে ঘাম ঝরছে, যেন রক্তের ব্যাগ থেকে নল বেয়ে ফোঁটা ফোঁটা রক্ত নেওয়ার মতো শরীরের তরল বেরিয়ে যাচ্ছে, টের পাচ্ছেন। অথচ তাঁকে মেপে মেপে পানি খেতে হয়। তাঁর শরীর নাকি বর্জ্য বের করতে অপারগ। এই যে শরীর থেকে তরল বেরিয়ে যাচ্ছে, তখন দু-চামচ বেশি পানির চাপ তাঁর কিডনি সহ্য করতে পারবে কি? তখন কি জামিলা একটু তরমুজের শরবত খেতে পারবেন!

এতসব কথা কাকে বলবেন ভেবে পান না জামিলা বেগম। ডেকে ডেকে কাহিল হয়ে গেলেও কেউ আর তাঁর কথা শুনতে পায় না। ঠোঁটজোড়া কবে থেকে শক্ত জমাট হয়ে গেল?

হঠাৎ শরীর চিড়বিড় করা অস্থিরতা ভর করে মনে। কোথাও কি এক পশলা শীতল বাতাস পাওয়া যাবে, যা তাঁর হাঁটুজোড়া বুকের কাছে এনে গুটিয়ে ফেলবে, জামিলা কি তখন আরো বেঘোরে ঘুমিয়ে পড়বেন!

ঘাম মুছতে বিছানার পাশে চেয়ারের ওপরে কমলা হলুদ ছোপ লাগা সাদা রুমালটা টেনে নেওয়া দরকার। কাত হয়ে হাত বাড়াতে চাইলেন জামিলা, মনে হয় বাড়িয়েও দিলেন। মনে হচ্ছে নিতে পারবেন। আমেনাকে ডাকার দরকার হবে না। মেয়েটা কেন যে কাছাকাছি থাকে না! এই যে কাত হয়ে থাকা শরীরটা আর চিৎ করতে পারছেন না, কেউ দেখবে না?

আমেনা বাইরে থেকে এক পাঁজা শুকনো কাপড় এনে খাটের কোনায় রেখে কোমরে হাত দিয়ে জামিলাকে জরিপ করল, মুখে গলায় জমে থাকা ঘামের দিকে দেখে হাতে সেই রুমালটা নিল। নাকের কাছে কাঁচা সুপারির বোটকা গন্ধ পেলেন জামিলা। আমেনা এই রুমাল ধুয়ে দেয়নি! ফাঁকিবাজ! একেই কি মেম্বার-চেয়ারম্যানের সালিশ থেকে উঠিয়ে এক কাপড়ে গ্রাম থেকে নিয়ে এসেছিলেন! হাত উল্টিয়ে একটা চটকনা দিতে পারলে শান্তি হতো।

আমেনার তিন কোনা মুখ জামিলা বেগমের দিকে ঝুঁকে এলে হাতটা সত্যি উঠে যেতে চায়। রুমাল দিয়ে মুছে ফেলা ঘামের মতো আমেনার নিশ^াসও কেমন চটচটে লাগে। জামিলা গলায় ঝাঁজ এনে এতবার বলছেন, আমেনা শুনছে না! খুব ঘষটে ঘষটে ঠোঁটের কোনা মুছে দিলো। শুরুতে কী যত্ন করে তাঁর মুখ মুছে দিত, যেন শিশুর মুখে হাত দিয়েছে। আঙুলের ডগায় একটু মায়া থাকলে স্পর্শের ভাষা যে বদলে যায় তা শুধু জামিলা কেন, সবাই জানে।

 এমন স্পর্শ কার কার কাছে পেয়েছেন, খতিয়ে ভাবতে ইচ্ছে করছে।

তাদের শিশুকালে জড়িয়ে ধরার আলগা অভ্যাস ছিল না। মা কখনো তাঁর হাত ধরেছেন বলে মনে পড়ে না। এমনকি যেদিন বিয়ে হচ্ছে, শাড়ি-গয়নায় সেজে কান্নায় বুক ভাসিয়ে শ্বশুরবাড়ি যাচ্ছেন, সেদিনও। মা কাঁদতে কাঁদতে রঙিন কাগজে সাজানো গেটের কাছে ফিট হয়ে পড়ে গেলেন, আত্মীয়স্বজনের কেউ তাঁকে ধরে রেখেছে, জামিলার খুব মন চেয়েছিল যে দৌড়ে গিয়ে মাকে জড়িয়ে ধরে, হাহাকার করে জানিয়ে যান যে, এই বাড়ি, মায়ের শাড়ির ঘ্রাণ তাঁর শ্বাস-প্রশ্বাস স্বাভাবিক রাখে।  কিন্তু বড় খালা আর বাবা তাঁকে ঠেলে দ্রুত গাড়িতে উঠিয়ে দিলো, যেন উঠিয়ে দিলে জামিলার সঙ্গের সব জটিলতাও বিদায় নেবে।

মাকে অনভ্যাসের জড়িয়ে ধরতে না পারার কষ্ট অনেকদিন মনে ছিল জামিলার।

তারপর মিশু আর মিথিলা জন্মালো। মিথিলা গায়ে হাত লাগলে বিরক্ত হতো, কিন্তু মিশু ভালোবাসতো, মাকে যখন-তখন জড়িয়ে ধরা, এসে সটান কোলে শুয়ে পড়া – এসব করতো। খুব মা-ন্যাওটা ছিল মিশু। জামিলাও পক্ষপাত করেছেন।

মিথিলা-মিশু প্রতিযোগিতায় মিশু সবসময় বেশি নম্বর পেয়ে এগিয়ে থাকত। এ-কারণেই কি মেয়েটা দূরে সরে গেছে!

একটা ঘুঘু পাখি ডেকে যাচ্ছে। মনে হচ্ছে, একদম ছাদের কার্নিশ ঘেঁষে কোথাও। আধশোয়া হয়ে বসতে পারলে ভালো হতো। খাটের মাথার দিকটা উঁচু, দুটো বালিশ খাড়া করে দিলে হেলান দেওয়া যায়। আমেনা আজকাল আর এসব খেয়াল করছে না! একমনে শুকনো কাপড় ভাঁজ করে চলছে। ছাদে টান টান করে মেলে দেয়নি, ম্যাক্সির হাতা কুচকে রয়েছে। সারাজীবন সাফ-ধবধবে টান টান থাকা জামিলার এসব দেখলে মেজাজ খারাপ হয়।

আমেনার দু-হাত চলছে কিন্তু চোখ শব্দহীন টেলিভিশনে, ‘কপালে শনি আছে না রবি’র বিজ্ঞাপন হা করে দেখছে। রফিককে বলেকয়ে এই রফাতে আনিয়েছে যে, টিভিটা যেন জামিলা বেগমের শোবার ঘরে থাকে। সেও যেহেতু এখানেই মেঝেতে শোয়, তাই টেলিভিশন দেখতে পারে। তবে রফিক কড়া করে বলেছে, আওয়াজ বন্ধ রাখতে হবে, যাতে আওয়াজের কমবেশিতে জামিলা বেগমর কোনো অসুবিধা না হয়।

জামিলা বলতে চেয়েছেন, আওয়াজ ছাড়া কি করে টিভি দেখা যায়! এ কি সেই নির্বাক চলচ্চিত্রের যুগ? আর টিভির শব্দে তাঁর তেমন অসুবিধা নেই, বরং সময় কেটে যাবে। কিন্তু কেউ বুঝলে তো! আর আমেনাও বদের হাড্ডি, টিভির আওয়াজ শুনতে পায় না বলে ঠিক করেছে আর কিছু শুনবে না! এই যে জামিলা তখন থেকে বলছেন, তাঁর জামাকাপড় বদলে দিতে হবে, আজকে ডাক্তারের কাছে যাওয়ার দিন। শুনছে সে? বিরক্তিতে কপালের ভাঁজ হাতের বয়েসি ত্বকের মতো কুঞ্চিত হয়ে যায় জামিলার।

রফিক একেবারে গোয়েন্দাদের মতো বাসার কলিংবেল বাজায়, একেকবার একেক রকম করে, কখনো বেল চেপে ধরেই রাখে, দরজা না খোলা অবধি ছাড়ে না।

রফিকের কানে ফোন চাপা, মিশুর সঙ্গে ফোনে কথা বলে। একতরফা ধারাবর্ণনা, সে জামিলার কত যত্ন নিচ্ছে, দোয়া-খায়ের করছে ইত্যাদি।

আচ্ছা, রফিক তো চাইলে ওই ফোনটা জামিলার কানেও চেপে ধরতে পারে, পারে না?

কিন্তু সেটা না করে সে জুতো পায়ে ঘরের ভেতরে ঢুকে যায়, যেন পুলিশ টহল দিতে এসেছে। জামিলা তখন ‘রফিক!’ – বলে একটা ধমক দিতে চান। এত বড় সাহস! না খেয়ে রেলস্টেশনে ঘুরতি, জামিলা বেগম দয়া করে আশ্রয় দিলো বলেই না এখন জুতো মচমচিয়ে হাঁটিস!

– ‘দাঁড়া, তোর একদিন কি’ … বলতে গিয়ে কাকে ডাকবেন ভাবতে থাকেন জামিলা।

রফিক আমেনাকে ভীষণ তাড়া দিচ্ছে – ‘এখনো রেডি করো নাই! টাইম তো দুইটায়। ডাক্তার কি বইসা থাকবে? কী করো সারাদিন?’

রফিকের ধমক আর আমেনার বিব্রত ভাব দেখে বিরক্ত লাগে। এত শিখিয়েও সফল হলেন না। আসলে শিখেই বা কি হয়! – জামিলা বেগম ভাবেন, এই যে শেলফ বোঝাই বই আর অভিধান, এসব ছাড়াই তো জীবন চলে যায়! সারাজীবন ধরে কত কি শিখলেন, কতজনকে শেখালেন!

আজকাল কত আজগুবি শব্দ মাথায় ঘোরে! আমেনা যখন তাঁর ঠোঁটের কাছটা রুমাল দিয়ে মুছে দিতে আসে, তাঁকে চামচে করে সুপ খাওয়ায়, ইচ্ছে করে যে ওকে বাঁ হাত দিয়ে ঠেলে সরিয়ে দিয়ে একটা লেকচার দিতে দাঁড়িয়ে যান ডায়াসে। তার পরনের শাড়ি সামান্য দুমড়ানো, রিকশায় উঠতে গেলে যেমন হয়। কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম, চক হাতে ব্ল্যাকবোর্ডের দিকে এগিয়ে যাচ্ছেন। চওড়া বোর্ডের বুকে হাঁসের মতো সাদা অক্ষরেরা ছুটে যাচ্ছে এক কোণ থেকে আরেক কোণে। ন-ত্ব বিধানের নিয়ম লিখছেন জামিলা। যুক্তাক্ষরের পরে দন্ত-ন না হয়ে মূর্ধণ্য-ণ হয়। যেমন তৃণা, ঘৃণা।

ঘৃণা শব্দটা অনেকক্ষণ জামিলার মাথার ভেতর ঘুরপাক খায়। কিসের প্রতি ঘৃণা তাঁর! জীবনের প্রতি? জীবনকে জামিলা ভালোবাসতেই তো চেয়েছেন। ই-প্রত্যয় এমন স্বয়ংক্রিয়ভাবে যোগ হচ্ছে কেন তাঁর বাক্যে! ভালো-ই আর ভালো’র তফাৎ না বুঝে জীবন তো কেটে গেল।

পুরো শরীর ধরে একটা হ্যাঁচকা টান লাগল। আমেনা তাঁর কাপড় বদলে দিচ্ছে। বাহু ধরে বসিয়ে রেখেছে রফিক। প্রিয় টাঙ্গাইল শাড়ির ছোঁয়া নেই সেখানে। হাঁটু অবধি কেটে ছোট করা ম্যাক্সির ওপরে ওড়না জড়িয়ে দিতে চাইছে আমেনা, আর রফিক বলছে – শাড়ির কোনো দরকার নেই। গাড়িতে যাবে, গাড়িতে আসবে। হাসপাতালে গেলে কোনোমতে হুইল চেয়ারে বসিয়ে লিফটে তুলে ফেলতে পারলেই হলো। আর সেখানে মানুষজন পাওয়া যায় – বলে চাপদাড়ির ভেতর থেকে একটু হেসেও দিলো রফিক।

মিশুর যখন প্রাইমারি স্কুল তখন জামিলা রফিককে সঙ্গে দিয়ে দিতেন। নিয়ে যাওয়া আর ফিরিয়ে আনার মধ্যের সময় সে স্কুলের সামনে বসে থেকেছে।  

মিশুর বইপত্র গুছিয়ে রাখতে রাখতে সেও কিছু পড়তে-লিখতে শিখে গেল। রফিকের গুলতির নিশানা ছিল তুলনাহীন। কথায় কথায় গুলতি ছুড়ে ফল পাড়তো, পাখি মেরে আনতো। মিশু পারতো না বলে মন খারাপ করতো। জামিলা পাখি মারা নিষেধ করলেন। এখন প্রায়ই মনে হয় যে, গুলতির ওই নিশানা যদি নিজের পেটের ছেলের হতো, জামিলা কি নিষেধ করতেন? বরং ছেলেকে আরো কোনো বড় কিছুর আশায় প্রশিক্ষণ দিতেন নিশ্চয়ই। গুলতি দিয়ে হাত পাকিয়ে তারপর বন্দুক পিস্তল তুলে নিক, তার উর্দিতে কয়েকটি তারা জ্বলজ্বল করুক। মায়ের জন্য কোথাও, যে-কোনো উপায়ে কিছু প্রতিশোধ নিক। চাইতেন তো!

মিশু ক্যাডেট কলেজে যেতে চায়নি, প্রথমবার অনেক কেঁদেছে! জামিলা কঠিন হয়েছিলেন। ওর বন্ধুরা নাকি তাঁকে মার্গারেট থ্যাচার বলে ডাকতো। জামিলা জানেন, ওই নাম মিশুই চালু করেছে। ছেলের ভেতর একটা দৃঢ় মেরুদণ্ড দেখতে না পেয়ে জেদি হয়ে উঠতেন জামিলা। মারধর করেও ছেলের ল্যাতপ্যাতা স্বভাবের কোনো হেরফের হলো না।

স্কুলের হোস্টেল থেকে পালিয়ে চলে এসেছিল মিশু।

– এই খাটে না শুলে ঘুম আসে না। এই জানালা দিয়ে না দেখলে ঠিকমতো আকাশ দেখা যায় না।

এই খাট মানে তো জামিলা বেগমর ঘরের সাবেকি খাট, কালো বার্নিশ করা বাজুতে খোদাই করে টিয়াপাখি আঁকা। সবুজ রং করা কাঠের জানালার পাল্লা দিয়ে খুব সহজে সকাল দুপুর বিকেলের বাতাস যাওয়া-আসা করে। খাটের চারকোনার খুঁটিতে মায়ের শাড়ি বেঁধে স্টেজ বানায় মিশু, গামছা মাথায় বেঁধে দইওয়ালা সাজে একবার, আরেকবার অমল সেজে একক অভিনয় করে, দর্শক শুধু রফিক। ততদিনে এ-বাড়িতে রফিকের দুই বছর হয়ে গেছে। খাটের মঞ্চে রফিকও উঠে পড়েছে, তার গানের গলা উদারা মুদারা ছাড়িয়ে অনায়াসে তারায় উঠে পড়ে। মিশু যতই রফিকের গুণে মুগ্ধ হয়, জামিলার দাঁতে দাঁত পেষা তত বেড়ে চলে। বাড়ির লাগোয়া গাছটায় একটা বেয়াক্কেলে কোকিল ডাকলেও জামিলা হিস হিস করে তাড়িয়ে দিতে চাইতেন। 

জামিলার হয়ে প্রতিশোধ নিতে কেউ তৈরি হচ্ছে না। কার ওপরে প্রতিশোধ? প্রশ্নটা করে নিজের সামনে একটা ধূসর দেয়াল ছাড়া কিছু চোখে ভাসতো না। তারপরও প্রস্তুত হতে ক্ষতি কি? কে জানে কখন কোন অদৃশ্য শত্রু সামনে এসে দাঁড়ায়। আবার যদি দুপুরের প্রখর আলোয় কেউ তার মিথিলার মুখ চেপে ধরে তুলে নিয়ে যায়!

খেলায় মিশুর কাছে রফিক যত না প্রতিপক্ষ, জামিলার কাছে তার চেয়ে বেশি। বহুদিন মনে হয়েছে – তাড়িয়ে দেন, কিন্তু ছেলের খেলাধুলার সঙ্গী কেউ নেই ভেবে নিরস্ত হয়েছেন। উপরন্তু ফাই-ফরমাশ খাটতে লোক লাগে। মায়ের ছেলে হয়ে মিশু কোনো প্রতিবাদ, প্রতিশোধের উপযুক্ত হবে – এমন ভেবে ভেতরে ঘূর্ণিঝড়ের উত্তেজনা নিয়ে মায়ের ভূমিকায় অভিনয় করতেন জামিলা।

অভিনয়ই তো! স্ত্রীর ভূমিকায়, মায়ের ভূমিকায়। এর বাইরের পুরোটা দখল রাখা খরখরে দুপুরের দিনগুলো ভুলতে পারতেন না।

কোনো কারণে বিদ্যুৎ চলে গেলে, বা দরজা থেকে অনতিদূরের সিঁড়িতে ঝপাৎ করে মিশকালো অন্ধকার নেমে এলে, জামিলা বেগম এক লহমায় সেই অন্ধকার ঘরে ডুবে যেতেন। মুহূর্তের দৈর্ঘ্য বেড়ে যাওয়া গভীর অন্ধকার তৈরি হতো। ভারি, ভোঁতা শব্দেরা কাঠের ওপরে ঘাসের স্তূপ চাপা দেওয়া প্রবেশমুখ দিয়ে নিচে নামতে নামতে মিলিয়ে যেত। রাগী ঈগলের মতো বোমারু বিমানের শব্দ আর গুলিবর্ষণ শুরু হতো। সিঁড়িতে বুটের শব্দ তখন ক্রূর, জীবন্ত। সংজ্ঞাহীন জামিলাকে কারা যেন টেনে তুলে আনে, টেনেহিঁচড়ে একটা ট্রাকে তুলে নিত। তারপর কোনো তালাবন্ধ ঘরে। খাবার নেই, আলো নেই। অন্যদের সঙ্গে একঝুড়িতে তাজা রাখতে গিয়ে দিনকয়েক খাওয়া-দাওয়া জোটে, তারপর শুকনো সবজির মতো এককোনায় ছুড়ে দেয়। জামিলার ঘৃণায়, অনায়াস থুথু ছুড়ে দেওয়ায় তাদের কিছু যায়-আসে না। বেশ অনেকদিন পরে এক শীর্ণ নদীর ধারে নিজেকে আবিষ্কার করেন জামিলা।

দুঃসহ সেসব দিন এরচেয়ে বেশি খুঁড়তে চান না জামিলা বেগম। মানুষের সঙ্গে সঙ্গে স্মৃতিরও কবর খুঁড়তে হয়। জামিলা প্রাণপণে সেটি চেয়েছেন, কিন্তু ঘূর্ণিঝড়ের সময় সোজা হেঁটে যাওয়ার মতোই সে-চাওয়া সহজ ছিল না।

মিশু মিথিলার বাবা ছিল দূরসম্পর্কের ফুপাতো ভাই।

এখন, এই এতদিন বাদে জামিলা জানেন, যুধিষ্টিরের মতো অন্ধ, বিবেচক পুরুষ ছিল না সে। তার চোখ জামিলাদের একরের পর একর শরিকবিহীন জমিতে, আর তাঁর আব্বার প্রতিশ্রুতিমতো নিখরচার উচ্চশিক্ষায়। সেসব আয়ত্তের মধ্যে চলে আসায় তার কোনো ভান করতে হয়নি, বরং দরকার পড়েছে জামিলাকে আড়াল করার।

তবে মিশু-মিথিলার বাবা টের পায়নি যে, যুদ্ধের নয় মাস বন্দি আর অত্যাচারিত হওয়া জামিলাকে বর্শাবেঁধা চিতাবাঘের মতো বদলে দিয়েছে। ঝড়জল উপেক্ষা করে শিরদাঁড়া সোজা করেছে। কিন্তু ঘরের পুরুষ বোধহয় আহত প্রাণীকে আরো আহত করতে আমোদ পায়।

জামিলার মাথা ঠান্ডা ছিল, যে-কোনো দিন যে-কোনো প্রসঙ্গে মিশুর বাবার ভাষায় ‘পুরানা কাঁসুন্দি’ সামনে আসতে পারে – এমন মানসিক প্রস্তুতিও ছিল।

মিশু-মিথিলার বাবা ঠান্ডা মাথায়, ছুটির দিনে বিকেলে চায়ের কাপ হাতে, বুকের ভেতরে ঘাপটি মেরে থাকা এক ভয়ের কথা বলতো, জামিলা কেন কোনো সাধারণ স্ত্রী হলেন না! – এই আক্ষেপ ছিল। মেয়ের বিয়ে, ছেলের শ্বশুরবাড়িতে জামিলাকে সামনে আনার অনিচ্ছার কথা খুব গুছিয়ে বলতো। বিকেলের আলো তখন ঘাটে জাহাজ ভেড়ার ভঙ্গিতে মিলিয়ে যেত। মিশুর বাবার ভারি চশমায় চায়ের ভাপ জমে উঠতে না উঠতে উবে যেত, ঠিক তার কথার মতো।

সাধারণের অর্থ প্রসঙ্গে কলেজ অধ্যক্ষের কাছ থেকে মৌখিক ব্যাখ্যা পাওয়া যেত না। অব্যক্ত অর্থ হলো – সাধারণ স্ত্রী মানে যে নারী অতীতহীন। যাকে যুদ্ধের সময় মিলিটারি তুলে নিয়ে যায়নি। বন্দুক, বেয়নেটের মুখে বন্দি করেনি। যাকে দিনের পর দিন আটকে রাখেনি। তারপরও যে নারী তেজী হয়ে নিজের পায়ে দাঁড়ায়। এমন নারী তো জন্মেছেই প্রতিপক্ষ হতে।

দেশ স্বাধীন হওয়ার পরপর যে মিশু-মিথিলার বাবা জামিলাকে আপন করে নিয়েছে, তা নাকি করুণা আর দয়া।  ফলাফল, জামিলা এ-জীবনে আর কাঁদলেন না। জীবন নিয়ে তাঁর নিজেরও শুধু হিসাব কষতে মন চাইল। হিসাবের খাতায় নিজের সন্তানদেরও তেমন দেখতে পান না, ওরা দূর থেকে আরো দূরের। ওদের ভূ-উপগ্রহ কেন্দ্র হয়ে তাঁর সঙ্গে যোগাযোগ শুধু রফিকের। স্ট্রোকের পর জামিলা না হয় এখন কথা বলতে পারেন না, ডানহাত পুরোপুরি অবশ, শরীর কাত হলে আর সিধে হয়ে শুতে পারেন না। কিন্তু শুনতে তো পারবেন! ওরা কী এত বলে রফিককে? জমিজমা, ঘরবাড়ির হিসাব?

সদ্য হাঁটতে শেখা শিশুর মতো জামিলা বেগম দরজার বাইরে, যেন চোখে পট্টি বাঁধা। যেন গান্ধারী। যুধিষ্টিরের সঙ্গে সঙ্গে স্বেচ্ছায় অন্ধ সেজে বসে আছেন।

একপাশে রফিক, অন্য বাহু আমেনা শক্ত করে ধরে রেখেছে।

পা দুটো শরীর থেকে খুলে নিয়েছে কেউ? কাঁধ শক্ত করে ধরে রেখেছে কে, রফিক? কিন্তু জামিলা দাঁড়াতে পারছেন কই?

– এই তো, আর একটু! আর একটু। এই তো দাঁড়াইতে পারছেন! – রফিক খেলার মাঠের দর্শকের মতো উৎসাহ দিচ্ছে।

সিঁড়ি দিয়ে জামিলা নিজে নামলেন, নাকি রফিক কোলে করে নামালো বুঝতে না বুঝতে রফিকের শক্ত হাত এক লহমায় ঢিলে হয়ে গেল। প্রায় থেবড়ে যাওয়া জামিলাকে গাড়ির সিটে চেপে বসিয়ে আরেকটা লম্বা শাড়ি দিয়ে তাঁকে পেঁচিয়ে রাখছে। জামিলা হাত নাড়াতে পারছেন না, ঘাড়-মাথাও ঘোরানো যাচ্ছে না।

– এই বেশিক্ষণ লাগবে না। আজকে জ্যাম নাই, একটানে নিয়ে যাবো। – রফিক কাকে যেন শুনিয়ে শুনিয়ে বলছে।

ট্রাকের পেছনে তাঁদের পরনের শাড়িতেই বাঁধা হয়েছিল জামিলাসহ আরো কয়েকজনকে। জনসমক্ষে বেআব্রু হওয়ার লজ্জায় জ্ঞান হারিয়েছিলেন অনেকেই। প্রকাণ্ড সূর্যের তেজী আলোয় দিনের বেলার খোলা ট্রাক, শহরের মধ্য দিয়ে চলেছিল। তৃষ্ণায় বুকের ভেতর শুকিয়ে কাঠ।

জামিলার এখনো খুব পিপাসা পাচ্ছে। আমেনা তার কাত হয়ে যাওয়া মাথা সোজা করে ধরে রাখছে।

বাইরের রোদ চোখে খুব লাগছে। বাইরের রোদকে খুব ভয় জামিলার।

মিশু-মিথিলাকে রোদে বেরোতে দিতেন না কখনো।

মিথিলা ঘরে থাকতে থাকতে রোদ ভয় পেতে শুরু করল। তাকে পাখার ডাঁট দিয়ে মারতেন জামিলা। ওরা নাকি মাকে ভয় পেত যমের মতো। বাবার সঙ্গে হাসিমুখে গল্প করছে, জামিলা সামনে পড়লে কেঁপে উঠত। মেয়ের ভেতর নিজেকে দেখতে পেলে ব্যথায় বুক কুঁকড়ে আসত জামিলার। খুব চাইতেন মেয়েকে জড়িয়ে ধরে রাখেন শক্ত করে। কিন্তু মিথিলা কাছে ঘেঁষতে দিত না।

আবার রোদের তেজ বর্শার মতো বিঁধছে চোখে।

– এমন রোগী কেউ অ্যাম্বুলেন্স ছাড়া আনে? – অচেনা কণ্ঠস্বর বলছে।

– একটা স্ট্রেচার আনেন তাড়াতাড়ি! – রফিকের গলা।

মানুষের ব্যস্ত চলাচল। জামিলাকে চার-পাঁচটা হাত জাপ্টে ধরলো। তুলে ধরছে। উঁচুতে। ধপ করে ফেললো আবার। দড়ি দিয়ে দু-হাত বেঁধে দিলো। পানির ছিটা এসে লাগছে চোখেমুখে।

দৌড়ে যাচ্ছে কেউ, ধুপধাপ শব্দ। কিছু মুহূর্তের জন্য সবকিছু নিঃশব্দ। জামিলার মুখ বাঁধা। শ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে। কাছে কোথাও খুব জোরে সাইরেন বাজছে। তীক্ষ্ন, অনতিদীর্ঘ।

জামিলা ট্রেঞ্চের দিকে দৌড় দিচ্ছেন, একা। দ্রুত নিচে গিয়ে জোরে জোরে হাঁফাচ্ছেন। মাটির নিচে আবছা শীতল অন্ধকারে আঁচল দিয়ে ঘাম মুছলেন। কতগুলো পায়ের ভারি বুটের শব্দ।

সাইরেন তখনো বেজে চলছে, নাকি থেমে গেছে বুঝতে পারছেন না জামিলা।

দুপুর অতিক্রান্ত আলোয় তাঁর বন্ধ দু-চোখের পাতা ধীরে কেঁপে চলছে।