চোখ থেকে চশমাটি নামিয়ে কিছুক্ষণ চেয়ে থাকেন তিনি চশমার দিকে। তারপর পাঞ্জাবির পকেট থেকে নরম কাপড়টি বের করে খুব যত্ন করে পরম মমতায় চশমার কাচ-দুটি ঘষে ঘষে পরিষ্কার করতে থাকেন, তবে তাঁর দৃষ্টি নিবদ্ধ থাকে রাস্তার ওপাশের ফুটপাতে বসে থাকা ভিখারিটির দিকে। এবার তাঁর দৃষ্টি নিবদ্ধ হয় ঠিক তাঁর নিজের নাকের চূড়ার ওপর। তিনি স্পষ্ট দেখতে না পেলেও অনুভব করেন যে, নাছোড়বান্দা বেত্তমিজ মাছিটি তাঁর নাকের ঠিক ডগায় বসে আছে। গা ঘিনঘিন করছে তাঁর; তবু এরই মাঝে কল্পনা করলেন যে, মাছিটি কি ভঙ্গিমায় থাকতে পারে এখন। ওটা কি ওর পেছনের পা-দুটি ওপর দিকে তুলে একটি অপরটির সঙ্গে ঘষাঘষি করছে? নিশ্চয়ই করছে কারণ তিনি তাঁর নাকের চূড়ায় মৃদু সুড়সুড়ি অনুভব করছেন; মাছিটি চুপচাপ বসে থাকলে সেটি হওয়ার কথা নয়। তিনি খুব কাছ থেকে মাছির কার্যকলাপ লক্ষ করেছেন এবং তিনি দেখেছেন যে, মাছি কোথাও বসার সামান্য পরেই পেছনের দুই পা শূন্যে তুলে পরস্পর ঘষাঘষি করে। তারা কেন এ-কাজটি করে তা তিনি ছোটবেলায় খুব চেষ্টা করতেন জানার জন্য। কিন্তু একবার খুব কাছ থেকে ব্যাপারটি মনোযোগ দিয়ে দেখার সময় তাঁর ঈষৎ হা হয়ে যাওয়া মুখে বদমাশ মাছিটি ঢুকে গেলে তিনি ভীষণ কাশতে শুরু করেন এবং তারপর তিনি বমিও করে দেন। তিনি আজো নিশ্চিত নন মাছিটি সেদিন কোনোভাবে তাঁর মুখ থেকে বের হয়ে পালিয়েছিল, নাকি তিনি সেদিন মাছিটিকে উদরস্থ করেছিলেন।
অতি সন্তর্পণে তিনি তাঁর ডান হাতের তর্জনী মাছিটির খুব কাছে নিয়ে আসেন। মাছিটি ঠিক বাঁ-পাশের দু-ফুট দূরের দেয়ালে ছিটকে গিয়ে বাড়ি খায় সজোরে আর পরক্ষণেই মেঝেতে পড়ে। তিন-চার সেকেন্ড পর সেটি বোঁ বোঁ করে একই জায়গায় ঘুরতে থাকে। আঙুলের টোকায় মাছি মারার প্রতি পাঁচটি চেষ্টায় তিনি অন্তত তিনবার সফল হন। তিনি তাঁর এই স্কিল নিয়ে গর্বিত। মাছিটি এখনো জীবিত তবে সেটি পিষে মেরে ফেলা এখন খুব সহজ, কারণ কাছে গেলেও এই মুহূর্তে ও পালাতে পারবে না। ওটাকে ছেড়ে তিনি আবার রাস্তার ওপাশের প্রতিবন্ধী ভিখারিটির দিকে দৃষ্টি দিলেন।
রাস্তার পাশে ফুটপাতে বসে আছে ভিখারিটি, এই রাস্তার দশ গজ সামনেই থাকা প্রশস্ত মেইন রোডের দিকে মুখ করে। মানুষ মেইন রোডের ওদিক দিয়ে এসে ফুটপাত ধরে হেঁটে ভিখারির পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় তার মুখোমুখি হবেই হবে। যে কেউ তাকে অতিক্রম করার সময় তার দিকে তাকালে সে তার ডান হাতটি আস্তে করে কপালের কাছাকাছি তুলে সালামের আভাস দেয়। কেউ তার দিকে তাকালে সে বেশিরভাগ ক্ষেত্রে সালামের উত্তর পায় আর কদাচিৎ টাকা-পয়সাও পায়, আর কেউ তাকে লক্ষ না করে চলে গেলে তার সালামের উদ্দেশ্যে তোলা হাতটি মাঝপথেই থেমে গিয়ে নেমে আসে নিচে। ভিখারির এই দুটি অভিব্যক্তিই খুব মন দিয়ে লক্ষ করেন তিনি বিপরীত দিকের বিল্ডিংয়ের ছয়তলার বারান্দা থেকে। কেউ ওর সালাম দেওয়ার দিকে না তাকালে অদ্ভুত স্বাভাবিকতা বা বলা যায় পেশাদারি দক্ষতার সঙ্গে কিছুই হয়নি – এমন একটি অভিব্যক্তির সঙ্গে ও নিজের অর্ধেক তোলা হাতটি নিচে নামিয়ে আনে। ব্যাপারটিকে খুব স্মার্ট বলে মনে হয় তাঁর কাছে। তিনি মাঝেমাঝে নিজেকে ভিখারিটির স্থানে বসিয়ে ওর মতো করে প্র্যাকটিস করেন, কিন্তু তাঁর ধারণা, তাঁরটি ওই ভিখারিটির মতো সাবলীল হয় না। কেউ তাঁর আশেপাশে থাকলে তিনি তাকে দেখিয়ে নিশ্চিত হতে পারতেন তাঁর পারফরম্যান্সের ব্যাপারে। কিন্তু তিনি কাউকেই কখনো পান না। হঠাৎ তাঁর নাকে পরিচিত গন্ধ ভেসে আসে, কোনো বাসায় মুরগির ঝোল রান্না করা হচ্ছে। গন্ধকে কে আটকাবে? আজকাল মানুষ নিজেদের প্রাইভেসি নিয়ে খুব সরব হলেও এই ব্যাপারটির কোনো কার্যকর সুরাহা করতে পারছে না। তা না হলে সুপার প্রাইভেসির এ-যুগে এই ব্যাপারটি নিয়েও থানা পুলিশ হতো নিশ্চিত, তিনি ভাবেন। পেটটা মোচড় দিয়ে ওঠে মুরগির ঝোলের লোভনীয় ও পরিচিত গন্ধে।
বাঁ-পায়ের পাতায় একটি অদ্ভুত ধরনের ব্যথা হয়েছে ইদানীং, পায়ের পাতা ফেলতে গেলেই তীক্ষè ব্যথা অনুভূত হয়। ব্যথাটি সবসময় থাকে না বলে তিনি তেমন একটা পাত্তা দেন না এটিকে। এখন অনুভূত হচ্ছে ব্যথাটি। ঘরে ঢুকে তিনি বাতি জ¦ালালেন না। সামান্য সময় পরই সবকিছু পরিষ্কার দেখতে পেলেন। নির্দিষ্ট স্থানে থাকা বিস্কিটের কৌটা খুলতে গিয়েও থমকে গেলেন। নাহ্, মুরগির মাংসের ক্ষুধা কি আর বিস্কিটে মিটবে? ফিরে আসেন তিনি তাঁর পূর্বের স্থানে।
ভিখারিটি ওর বাঁ-হাতটি দিয়ে কী যেন তাড়াচ্ছে খুব বিরক্ত ভঙ্গিতে। যদিও এখান থেকে তিনি বুঝতে বা দেখতে পারছেন না ভিখাীির শত্রুটিকে, তবে আন্দাজ করলেন মাছিই হবে। চকিতে তিনি মেঝের সেই জায়গায় তাকালেন। নাহ্ মাছিটি নেই। তার মানে সেটি সুস্থ হয়ে পালিয়েছে! ওই মাছিটিই ভিখারির কাছে যায়নি তো? নাহ্, অসম্ভব। হঠাৎ লোকজনের ভয়ার্ত চিৎকার শোনা গেল, যা প্রথমে দূর থেকে গুঞ্জনের মতো ভেসে এসে ক্রমশ পরিষ্কার হতে হতে এদিকেই আসতে লাগল। কিছু মানুষকে প্রাণভয়ে ওপাশ থেকে ছুটে মেইন রোডের দিকে ও বাঁয়ের আরেকটি গলিতে যেতে দেখা গেল, আর পরমুহূর্তেই দানবাকৃতির একটি ষাঁড় উদয় হলো ফ্রেমের মধ্যে। সবশেষ লোকটির হাত-পাঁচেকের মধ্যে মূর্তিমান বিভীষিকাটি চলে এসেছে। পরমুহূর্তেই বিশালাকার জন্তুটি মাথা নিচু করে হতভাগ্য লোকটিকে তার বিশাল ও তীক্ষ্ন শিংয়ে লটকে নিয়েই সঙ্গে সঙ্গে ডান দিকে অন্তত দশ হাত দূরে ছিটকে ফেলল। লোকটির আর্তচিৎকার শুনে গায়ের লোম দাঁড়িয়ে গেল তাঁর। লোকটি মাটিতে পড়েই উঠে দাঁড়ালো আর পেছন দিকে ছুটল। বিভীষিকাটি তার দৌড় না থামিয়ে বাঁয়ের গলিতে অদৃশ্য হয়ে গেল। লোকজন যে যেদিকে পারে পালাল এবং নিমেষে রাস্তা ফাঁকা হয়ে গেল। তাঁর মনে পড়লো হতভাগ্য ভিখারিটির কথা। এতক্ষণ তিনি ভুলেই গিয়েছিলেন ওর কথা। ভিখারিটি বিস্ফারিত চোখে তাকিয়ে আছে সামনের গলির দিকে, যেদিকে ষাঁড়টি অদৃশ্য হয়েছে সেদিকে। মনে হচ্ছে থরথর করে কাঁপছেও। মিনিট খানেক পর আবার অস্পষ্ট আর্তচিৎকার শোনা গেল ও পরমুহূর্তেই বিশালাকার প্রাণীটিকে দেখা গেল। একটু থেমে সে বাতাসে কি যেন শুঁকলো, তারপর হাম্বা করে গলা উঁচু করে ডাকল। তারপর সোজা হতভাগ্য ভিখারিটির দিকে এগিয়ে যেতে লাগল। তিনি চেয়ার ছেড়ে উত্তেজনায় দাঁড়িয়ে গেলেন। কী হয় – সেই ভয়ে তিনি সত্যিই ভীত হলেন। এরপর যা হলো তার জন্য তিনি একেবারেই প্রস্তুত ছিলেন না।
প্রথমে ‘ওমা’ বলে একবার তারস্বরে চিৎকার করেই বিদ্যুৎগতিতে ভিখারিটি তার পা দুটি কাপড়ের বন্ধনমুক্ত করে তীরের বেগে ছুটল মেইন রোডের বিপরীত দিকে। এত দ্রুত কোনো মানুষকে কখনো ছুটতে দেখেননি তিনি। দশাসই চেহারার ষাঁড়টি ওর সামনের ডান পা দিয়ে মাটিতে কয়েকটি ঘষা দিয়ে সম্ভবত নতুন প্রাণশক্তি নিজের মধ্যে ঢুকিয়ে নিল, কারণ পরক্ষণেই ওকে আগের চেয়েও বিধ্বংসী চেহারায় সেই ভিখারিটির পিছু নিতে দেখা গেল। তিনি বারান্দার কোনায় এসে সামনে গলা বাড়িয়ে দেখার চেষ্টা করলেন এই অভাবনীয় উত্তেজনাকর দৃশ্য; কিন্তু সামান্য এগিয়েই লোকটি ডানদিকের রাস্তায় ঢুকে পড়ায় তিনি সিনেমার বাকি অংশ দেখতে পেলেন না। প্রাণীটিও মুহূর্তে ওর পিছু পিছু অদৃশ্য হলো।
মানুষ এত অসৎ হয়? এত বড় প্রতারণার আশ্রয় মানুষ নিতে পারে? সুস্থ এবং পুরোপুরি কর্মঠ একটি মানুষ এভাবে শারীরিক প্রতিবন্ধী সেজে ভিক্ষা করতে পারে দিনে-দুপুরে রাস্তায়? তিনি চেয়ারে বসে চোখ বন্ধ করে ভাবতে লাগলেন ব্যাপারটি নিয়ে। প্রতারক লোকটি বা সেই দশাসই ষাঁড়টির পরবর্তী ঘটনাপ্রবাহ নিয়ে তাঁর আর কোনো আগ্রহ দেখা গেল না।
বেসিনের সামনে দাঁড়িয়ে চেয়ে আছেন তিনি আয়নায় নিজের প্রতিবিম্বের দিকে। মুখে জলের ছিটা দেওয়ার ফলে চেহারাটা বেশ পরিষ্কার ফুটে উঠেছে স্বচ্ছ আয়নায়। চেহারায় এখনো তিক্ততার চিহ্ন লেগে আছে তাঁর – মানুষ কীভাবে পারে এত বড় ভণ্ডামি করতে? তিনি নিজের প্রখর বিবেকবোধ অনুভব করে একটু শান্ত হন, ঠোঁটের বাঁ-পাশে মৃদু হাসির রেখা ফুটে ওঠে। কিন্তু পরক্ষণেই সেটি মিলিয়ে যায়। তিনি আয়নার সামনে থেকে সরে আসেন। মনে হয় তিনি বাধ্য হন আয়নার সামনে থেকে সরে আসতে।
বারান্দার ধারে বসে তিনি চেয়ে আছেন মেঘমুক্ত আকাশের দিকে। দূরে, আরো দূরে, কোথায় আকাশের শেষ? তিনি যেতে চান সেখানে। এখানে যা আছে তার সবকিছুই দেখা হয়ে গেছে তাঁর, তিনি বহুদূরে যেতে চান। না, মৃত্যু তিনি চান না, সেটি সময়মতো আসবে। মৃত্যুভয় তাঁর নেই। কিন্তু তিনি কিছুদিনের জন্য বহুদূরে যেতে চান। পুরনো চিন্তাটি হঠাৎ তাঁকে এভাবে গ্রাস করবে তা তিনি ভাবতেও পারেননি।
তিনি তাঁর কপালের দুপাশে নিজের দু-হাতের আঙুলগুলোর অগ্রভাগ দিয়ে বেশ শক্ত করে চেপে ধরে থাকেন বেশ কিছুক্ষণ, তারপর ছেড়ে দেন। বসে পড়েন তাঁর প্রিয় চেয়ারটির ওপর। তাঁর জীবনের অর্জনগুলোর মাঝে এরকম একটি বেমানান বাস্তবতা কিভাবে সহাবস্থান করতে পারে তা তিনি ভেবে পান না, ভেবে পাননি। তিনি খুব ভালো করেই জানেন যে, তাঁর ব্যাপারটি আসলে তেমন কিছুই নয়, যা তাঁর উঁচু মাথাকে হেঁট করে দিতে পারে, কারণ ঘটনাটি তো কেউ জানেই না। কিন্তু তিনি আজ ওই ভণ্ড ভিখারিটিকে মনে মনে ধিক্কার দেওয়ার সময় নিজের অপকর্মটিকে সামনে নিয়ে এলেন নিজেরই অজান্তে। তিনি একা থাকেন, কারণ এটাই তাঁর নিয়তি; কিন্তু তিনি কারো মুখাপেক্ষী নন এখন পর্যন্ত। তিনি একা থাকতে পছন্দ করেন, তাই একা থাকেন। তিনি দাম্ভিক নন, কিন্তু একটু বেশি আত্মমর্যাদাসম্পন্ন। অন্যায় সহ্য করতে পারেন না, তাই নিজেকে সমাজে বেমানান মনে করে সামাজিক মেলামেশা করেনই না বলতে গেলে। কিন্তু তাঁর আত্মতুষ্টিতে একটি বড় ঝাঁকুনি লাগল আজ। সেদিনের সেই ঘটনাটি এত প্রবলভাবে অতীতে কখনোই তাঁকে এভাবে পীড়া দেয়নি। তাঁর অপকর্মটি কি ওই ভিখারির ভণ্ডামির চেয়েও গর্হিত কাজ? তাই তো! তাঁর ঘটনাটির তুলনায় ভিখারির ব্যাপারটি তো কিছুই নয়! তিনি অনেক বড় ক্ষতি করেছিলেন একজন অসহায় মানুষের, ভিখারিটি তো কারো তেমন কোনো ক্ষতিই করেনি! তবে তিনি কেন ভিখারিটির ভণ্ডামিতে এত রেগে গেলেন?
তাঁর ছোটবেলাটি খুব বর্ণিল কেটেছে। তাঁর গ্রামটি ছিল সত্যিকার অর্থেই ছবির মতো সুন্দর। আনন্দময় কত স্মৃতি তাঁর শৈশব ও কৈশোরের! আজ কিন্তু সেইসব আনন্দময় স্মৃতিগুলো তাঁর মন থেকে যেন মুছেই গেছে, বারবার সেই অন্ধকার দিনটির স্মৃতি তাঁর মনে কাঁটার মতো বিঁধছে। তিনি আবার গেলেন বেসিনের আয়নাটির কাছে, তারপর কাছ থেকে নিবিড়ভাবে নিজের দিকে চেয়ে থাকলেন প্রায় মিনিটখানেক। শক্তভাবে নিজেকে বললেন যে, এরকম কাজ বহু মানুষই জীবনের কোনো না কোনো সময় এক-আধবার করেই থাকে। তিনি তো মানুষ, ফেরেশতা বা স্বর্গদূত নন। দ্রুত তিনি বাইরে গিয়ে আবার তাঁর চেয়ারটিতে বসলেন।
ঘটনাটি কোনোভাবেই মন থেকে তাড়াতে না পেরে তিনি এবার সিনেমার মতো সেটি তাঁর মনের পর্দায় চালু করে দিলেন।
ও ছিল মানসিক প্রতিবন্ধী। বয়সে তাঁর থেকে তিন-চার বছরের ছোটই ছিল ও। সবাই ওকে নিয়ে হাসাহাসি করত, তবে সারাদিন ছেলেমেয়েদের দলের সঙ্গেই থাকত ও। সাধারণত কোনো খেলায় ওকে কেউ দলে নিত না, কারণ ওর বুদ্ধিশুদ্ধি ছিল না। ওর চুলও ছেলেদের মতো করে কাটা থাকত সবসময়। তিনি তখন সদ্য যুবক আর ও তখন যুবতীপ্রায়।
যেদিন তিনি কোনো একটি খবর নিয়ে ওদের বাড়িতে গিয়েছিলেন সেদিন ওর মা বাড়িতে ছিল না। তিনি যাওয়ার পরপরই আকাশ ভেঙে বৃষ্টি শুরু হয়। বিদ্যুচ্চমকের পর প্রচণ্ড শব্দ হলে ও তার বুকে আশ্রয় নেয় দৌড়ে এসে। তারপর যা হয় তা তিনি আর মনে করতে চান না। বৃষ্টির মধ্যেই তিনি দৌড়ে বের হয়ে আসেন ওদের বাড়ি থেকে। এর কিছুদিন পরই তিনি ঢাকায় চলে আসেন এবং তাঁর বিশ্ববিদ্যালয় জীবন শুরু হয়। তিনি ছুটিতে বাড়িতে গেলেও ওর সঙ্গে দেখা হয়নি আর এবং তিনিও তেমন উৎসাহী হননি। উনি পরবর্তীকালেও কখনো জানতে চাননি যে, কেন ওকে আর দেখা যেত না ওর সমবয়সীদের ভিড়ে। ওর কথা কাউকে জিজ্ঞেস করতেও তাঁর সংকোচ হতো, যদিও সেই দুপুরের ঘটনাটি কেউ জানত না। একজন অসহায় ও বিশেষ করে মানসিক প্রতিবন্ধী মেয়ের অসহায়ত্বের এত বড় সুযোগ নেওয়া মানুষকে কীভাবে মূল্যায়িত করা উচিত? তিনি চোখ বন্ধ করলেন। নিরপেক্ষভাবে বিচার করলে তিনি নরপশুরও অধম। কারণ অন্য কেউ এমন কাণ্ড করলে তিনি তার সম্পর্কে এমনই রায় দেবেন। তাহলে নিজের বেলায়?
পরদিন সকালে তিনি খুব আগ্রহভরে বারান্দায় গিয়ে বসলেন নাটকের পরের দৃশ্য দেখার আশায়। কিন্তু নাহ্, আশাহত হলেন তিনি, কারণ ওই স্থানে কাউকে দেখলেন না তিনি। অবশ্য ভণ্ড খোঁড়াটিকে ওখানে তিনি আশাও করেননি, কারণ সে ওখানে বসলে পিটুনি খাবেই খাবে। পরপর সাতদিন জায়গাটি খালি থাকার পর অষ্টম দিন সকালে, যখন তিনি ভুলেই যাচ্ছিলেন ব্যাপারটি, দেখলেন একজন বসে আছে একই জায়গায়। তিনি খুব উজ্জীবিত হয়ে অত্যন্ত আগ্রহের সঙ্গে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখতে লাগলেন নতুন লোকটিকে। তিনি নতুন একজনকে দেখে অবাক হলেন একটু। তিনি আসলে অপেক্ষায় ছিলেন ভিখারিটি ফেরে কি না সেটা দেখার। তিনি চিন্তা করে দেখলেন যে, আসলেই ওর পক্ষে আর এখানে বসা সম্ভব নয়। সবাই জেনে গেছে তার ব্যাপারটি। নতুন আমদানি হওয়া লোকটি অন্ধ বা হতে পারে ভণ্ড অন্ধভিখারি। লোকজন সবাই যার যার কাজে ব্যস্ত থাকার কারণে নতুন ভিখারি নিয়ে কেউ মাথা ঘামায় না। তিনি ভেতরে ভেতরে খুব বিরক্ত হন নতুন আমদানি হওয়া ভিখারিকে দেখে, নিশ্চিতভাবেই এও ভণ্ডই হবে। এদের কি বিশ্বাস করা যায়। তিনি উঠে দাঁড়ালেন আর ঘৃণাভরে একবার নতুন ভিখারিটির দিকে তাকিয়ে ঘরের ভেতরে ঢুকলেন। মনটা বিষিয়ে গেছে তার। মানুষ এত নিচু হয়? বেসিনের আয়নায় নিজের দিকে তাকাতেই আবার তার মনে পড়ল পঞ্চাশ বছর আগের ঘটনাটির কথা। তিনি থমকে দাঁড়ালেন আর ফিরে গেলেন সেই দিনটিতে। তিনি আত্মপক্ষ সমর্থন করার কোনো পথই পেলেন না। তিনি যা করেছিলেন ঠান্ডা মাথায় পরিকল্পনামাফিকই করেছিলেন। নিজের কাছে নিজেকে কীভাবে লুকাবেন তিনি? তিনি চলে আসেন বেসিনের সামনে থেকে।
নতুন ভিখারিটিকে দেখে বেশ বয়স্ক বলে মনে হলো। হয়তো তাঁর সমবয়সীই হবে লোকটি। চুল আর দাড়িগোঁফ সবই ধবধবে সাদা। বেশ সুন্দর করে সৃষ্টিকর্তার নাম নিচ্ছে আর মাথাটি মাঝে মাঝে এদিক-ওদিক ঘোরাচ্ছে। অন্ধদের চোখমুখের অভিব্যক্তি দেখে মনে হয় তারা যেন মাঝে মাঝেই দেখার চেষ্টা করে। তিনি ভাবতে লাগলেন এই লোকটিও নিশ্চয়ই ভণ্ড হবে। কিন্তু যারা এভাবে ভিক্ষা করে তারা সবাই কি ভণ্ড হয়? একজনের জন্য কি প্রতিটি ভিখারিকে ভণ্ড ভাবা যুক্তিসংগত? আর যারা ভণ্ড তারা কি সবাই সাধ করে এই পেশায় এসেছে? তিনি মনে মনে খুব অশান্ত হয়ে গেলেন এবং আবার ওয়াশরুমে গিয়ে চোখমুখে জল দিলেন ও নিজের দিকে চাইলেন। নিজেকে তিনি যতটা ভালো মানুষ ভাবতেন এখন আর তা মনে হচ্ছে না। তিনি নিশ্চিত হচ্ছেন এখন যে, সেদিনের তাঁর করা অপকর্মটি অত্যন্ত গর্হিত অপরাধ ছিল, যা এই ভণ্ড ভিখারিদের তুলনায় শতগুণে বড় অপরাধ। এ ব্যাপারে তাঁর মনে এখন বিন্দুমাত্র সন্দেহ নেই। ব্যাপারটি কেউ জানেনি বলেই তাঁর চরিত্রে কোনো কালিমা পড়েনি। যদি তিনি ধরা পড়তেন তাহলে কি হতো? তিনি শিউরে উঠলেন চিন্তা করেই। তিনি বা তার পরিবার কি কারো সামনে মুখ দেখাতে পারতেন? তিনি সেই ঘটনার পর ওর সঙ্গে আর যোগাযোগ রাখেননি ভয়ে। তবে যেহেতু ও বাকপ্রতিবন্ধী ছিল তাই ধরা পড়ার ভয়টা তার তেমন ছিল না। কিন্তু একটা অজানা ভয় তার মধ্যে কাজ করত। আজ এত বছর পর তার মনে হচ্ছে, তিনি যে অপরাধটি সেদিন করেছিলেন তা আসলে অনেক বেশি গুরুতর। মাঝে মাঝে তার সেদিনের ঘটনা মনে পড়লেও তিনি মন থেকে সেটা সরিয়ে দিতেন, আসলে কি তিনি তার পাপের মুখোমুখি হতে ভয় পেতেন? আজ ভণ্ড ভিখারিদের পাপের হিসাব করতে গিয়ে তাঁর নিজের পাপের ওজন অনেক বেশি অনুভূত হলো তাঁর কাছে। সবাই তাঁকে ভালো জানলেও তিনি আসলে ধরা না পড়ার কারণে চরিত্রবান! তিনি নিজেকে সান্ত্বনা দিতে চান যে, কতজনের জীবনেই তো এর চেয়েও বড় অনৈতিক কর্ম আছে, কিন্তু মনে কোনো শান্তি পান না। এত বছর বাদে এই ভিখারি তাঁর সারাজীবনের শান্তি আর আত্মমর্যাদাকে ধ্বংস করতে শুরু করেছে।
ঝিরঝির করে বাতাস বইছে। গাছের পাতা ঝরে পড়ছে মাঝে মাঝেই। কিছু পাতা তার গায়েও এসে পড়ে। তিনি বহু বছর পরে তাঁর গ্রামে এসেছেন। যে-ছেলেটি তাকে পথ দেখিয়ে নিয়ে এসেছিল এই পর্যন্ত, তাকে তিনি বিদায় করে দিয়েছেন একা থাকবেন বলে। একটি ঘুঘুপাখির মন উদাস করা চিরচেনা ডাক তাঁর কানে ভেসে আসে। আরো বেশকিছু চিরচেনা পাখির ডাক তাঁর কানে আসে। তিনি একদৃষ্টিতে চেয়ে আছেন তাঁর সামনের মাটির দিকে। তাঁর সামনে একটি সমাধিক্ষেত্র, যেখানে ঘুমাচ্ছে ও। সেই ঘটনার পর মাত্র কয়েক বছরের ব্যবধানেই ও মারা যায়, তবে কীভাবে মারা যায় – তার কোনো তথ্য কেউ দিতে পারেনি এতদিন পর। বৃদ্ধের মনে উঠেছে ঝড় আর সেই ঝড় সামাল দেওয়া তাঁর পক্ষে সম্ভব হচ্ছে না। মনটা তাঁর দুমড়ে-মুচড়ে যাচ্ছে। হঠাৎ একেবারেই কাছের একটি গাছের থেকে টুনটুনি পাখির ডাক ভেসে আসে। তীক্ষ্ন ও পরিষ্কার সেই চিরচেনা ডাক। কি অদ্ভুত সাদৃশ্য, সেদিনও পাশের বাগান থেকে টুনটুনি পাখির ডাক ভেসে এসেছিল তাঁর কানে, হয়তো বিবেক তাঁকে জাগাতে চেষ্টা করছিল, কিন্তু পারেনি। মাংসের তীব্র কামনার তোড়ে ভেসে গিয়েছিল বিবেকের ক্ষীণ কণ্ঠস্বর খড়কুটোর মতো। টুনটুনি পাখিটিকে তিনি দেখতে পান। তিনি চেয়ে থাকেন বেশ কিছুক্ষণ সেটির দিকে। এ-ডাল থেকে
ও-ডালে যাচ্ছে আর তারস্বরে ডেকে চলেছে পাখিটি। হঠাৎ পাখিটি উড়ে গিয়ে একটু দূরে আরেকটি গাছে গিয়ে বসে। বৃদ্ধ আবার তাঁর সামনে মাটির দিকে তাকিয়ে থাকেন। তাঁর চোখ দিয়ে জলের ধারা গড়িয়ে পড়ে। মনের মাঝে বয়ে চলা ঝড় আরো উত্তাল হয়ে উঠেছে। তিনি দু-হাতে মুখ ডেকে বেশ কিছুটা সময় বসে থাকেন। কেউ হঠাৎ এসে পড়লে ওনাকে এভাবে বসে থাকতে দেখে খুব অবাক হয়ে যাবে নিশ্চিত। তবু তিনি ওভাবে বসে থাকেন বেশ কিছুটা সময়। ফেরার পথে পুরোটা সময় তিনি একটা ঘোরের মধ্যে থাকেন।
ফুটপাতের সেই অন্ধভিখারিটির সঙ্গে তাঁর বেশ ভাব হয়ে গেছে। ভিখারির জীবনের গল্প প্রায় সবটাই তিনি শুনেছেন তার কাছ থেকে। তিনি ভিখারিকে নিয়ে বেশ কদিন এলাকার একটি পার্কে গিয়ে বসেছেন আর তাঁর জীবনের গল্প শুনেছেন। প্রতিদিনই তিনি আসার সময় ভিখারিকে তার নিজস্ব জায়গায় পৌঁছে দেন আর তার হাতে কিছু টাকা গুঁেজ দেন। আজো এই মুহূর্তে তিনি বসে আছেন ভিখারির সঙ্গে। ভিখারি তাঁকে শোনাচ্ছে তার জীবনের গল্প। তিনিও আজ একটি গল্প শোনাবেন ভিখারিকে, একটি কুড়ি বছর বয়সী যুবকের অন্ধকার একটি গল্প। বলে বোঝাটা নামাবেন নিজের কাঁধ থেকে। কিন্তু ভিখারি যখন তার মেয়ের গল্প শোনাতে শুরু করল তখনই বৃদ্ধ টের পেতে থাকলেন তাঁর পায়ের নিচের মাটি আস্তে আস্তে সরে যাচ্ছে। মনে হচ্ছে অনেক দূর থেকে ভেসে আসছে ভিখারির কণ্ঠ, তিনি শুনতে পাচ্ছেন ভিখারির কথা – ভিখারির বুদ্ধিপ্রতিবন্ধী মেয়ের কথা। কেউ তার মেয়ের নাজুক অবস্থার সুযোগ নিয়ে তার মেয়ের সর্বনাশ করেছে। ভিখারি বলে যায় তার কাহিনি আর বৃদ্ধ বসে থাকেন তার পাশে, শেষের দিকে কোনো কথাই তাঁর কানে আর ঢোকে না। ভিখারির চোখে জল কিন্তু বৃদ্ধের সেদিকে তাকানোর সময় নেই, তিনি উঠে যান, ধীরে ধীরে পা বাড়ান তার বাড়ির দিকে। ভিখারিকে নিজের জীবনের গল্প আর শোনানো হলো না তাঁর।
Leave a Reply
You must be logged in to post a comment.