মানুষের, বিশেষত হোমো স্যাপিয়েন্স বা আধুনিক মানুষের, পরিব্রাজন শুরু হয়েছিল প্রায় সত্তর হাজার বছর আগে আফ্রিকা মহাদেশ থেকে। তারা জীবনধারণের প্রয়োজনে পৃথিবীর নানা জায়গা থেকে নানা কিছু শিখেছে।
একদিন সভ্যতার দোরগোড়ায় পৌঁছে সবিস্ময়ে ‘আকাশভরা সূর্য-তারা, বিশ্বভরা প্রাণ’-এর মাঝখানে তারা আবিষ্কার করল নানা বিষয়। এর পর পৃথিবী ছেড়ে সেই মহাকাশ জয়ের প্রত্যাশায় কতই না চেষ্টা করে চলেছে। সে চলমানতার ধারায় দৈনন্দিন জীবনকে কাঠামোবদ্ধ করার অভিপ্রায় থেকে আকাশের তারা, নক্ষত্র, চন্দ্র-সূর্যের গতিকে কেন্দ্র করে বৎসর, মাস, দিন, ক্ষণ গণনা করতে শুরু করল। এভাবে পৃথিবীর নানা দেশের মানুষেরা নানা দিক থেকে বর্ষপঞ্জি সম্পর্কে বিশেষ বিশেষ অবদান রেখেছে। তাদের সব পঞ্জিকার ধরন সম্পর্কে অবহিত হওয়াও সম্ভব নয়। সেজন্যে এ-প্রবন্ধে সৌরবর্ষ, চান্দ্রবর্ষ, হিজরিবর্ষ, জুলিয়াস সিজারের বর্ষসংস্কার, পোপ ত্রয়োদশ গ্রেগরির বর্ষসংস্কার ছাড়াও রাজা শশাঙ্কের বঙ্গাব্দের সূচনা ও সম্রাট আকবরের ফসলি সন নিয়ে আলোচনাসহ নববর্ষ বাঙালির জাতীয় জীবনে কতখানি প্রভাব বিস্তার করেছে, নববর্ষ উৎসবের ইহজাগতিক হয়ে ওঠা এবং এর পেছনে রবীন্দ্রনাথের প্রভাব সম্পর্কে দেখার চেষ্টা থাকবে।
বর্ষপঞ্জির প্রয়োজনীয়তা
পঞ্জিকা ও দিনপঞ্জি বা বর্ষপঞ্জির ভিন্নতা আছে। পঞ্জিকাকে ইংরেজিতে বলা হয় Almanac, আর, দিনপঞ্জিকে বলা হয় Calender| Almanac-এ থাকে বৎসরের বার, সপ্তাহ, তিথি, নক্ষত্র, যোগ, রাশিফল, জোয়ার-ভাটা, চন্দ্র-সূর্যের উদয়-অস্ত, সূর্যগ্রহণ, চন্দ্রগ্রহণ প্রভৃতি। যে-কারণে হিন্দু পঞ্জিকাকে ‘পঞ্চাঙ্গ’ বলা হয়েছে। আর, Calender-এ থাকে একটি বছরের দিন, সপ্তাহ, মাস। এটি দেয়ালে টানিয়ে রাখা যায়। নাগরিক জীবনে এখনো পর্যন্ত বর্ষপঞ্জি একটি অপরিহার্য অনুষঙ্গ। দিন-মাসের গণনা ছাড়া পালা-পার্বণ, ধর্মীয় উৎসব, জাতীয় দিবস, ছুটির তালিকা, আর হিন্দুদের দিন, ক্ষণ, তিথি, নক্ষত্রসহ পূজাপার্বণের সময় ও শুভ-অশুভ নির্ণয়ের ক্ষেত্রে পঞ্জিকার প্রয়োজন অপরিহার্য। (অজয় রায়, ‘প্রাচীন ভারতীয় বর্ষপঞ্জি : একটি সমীক্ষা’, শামসুজ্জামান খান-সম্পাদিত, বাংলা সন ও পঞ্জিকার ইতিহাস-চর্চা এবং বৈজ্ঞানিক সংস্কার, পৃ ২) এসব চিন্তা মাথায় রেখে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান বা ব্যক্তি বর্ষপঞ্জি তৈরি করে যাচ্ছেন। কিন্তু বার বা সপ্তাহ ও দিনের প্রথম ব্যবহার করেন সম্ভবত ক্যালেডিয়ান জ্যোতির্বিদগণ। সাত বারকে সাতটি জ্যোতিষ্কের নামে নামকরণ করেন তাঁরা। ৪৮৪ খ্রিষ্টাব্দে গুপ্ত সম্রাট বুদ্ধগুপ্তের একটি উৎকীর্ণ লিপিতে সপ্তাহভিত্তিক দিনের নাম প্রথম উল্লিখিত হয়।
বর্ষপঞ্জির প্রাচীনত্ব ও বর্ষপঞ্জি সংস্কার
অনেকে বলতে পারেন : হলকর্ষ বা হালখাতা থেকে, কিংবা বিভিন্ন লোকাচার থেকে বর্ষগণনার সূত্রপাত। পরবর্তীকালে এসব অনুষঙ্গ বা লোকসংস্কৃতি হিসেবে যুক্ত হলেও বর্ষগণনা বা নববর্ষ পালনের নিয়ামক নয়। ভারতবর্ষে আর্যদের আগমনের অনেক আগে থেকে রোমের অধিবাসী ও সম্রাটদের মধ্যে বর্ষগণনার প্রথা প্রচলিত ছিল। তখন রোমানদের বৎসর ছিল ৩০৪ দিনের মধ্যে সীমিত। মাস ছিল ১০টি। পরবর্তীকালে রাজা নুসা পম্পিলিয়াস খ্রিষ্টপূর্ব ৭৯৩ অব্দে ৩০৪ দিনের সঙ্গে ৬০ দিন যোগ করেন। আর, জুলিয়াস সিজার ১০ মাসের সঙ্গে জানুয়ারি ও ফেব্রুয়ারি যোগ করে ১২ মাসে বছর নির্ধারণ করেন। তখনকার দিনে বৎসর আরম্ভ হতো মার্চ মাস থেকে। ইরানে মার্চ মাসের ২১ তারিখ থেকে বর্ষগণনার সূত্রপাত হয় এবং সেখানে ইসলাম ধর্ম প্রধান হয়ে ওঠার পরও সৌর সাল প্রচলিত ছিল। রোমান সম্রাট জুলিয়াস সিজার মাসটির নামকরণ চূড়ান্ত করেন ৪৬ খ্রিষ্টপূর্বাব্দে লাতিন শব্দ ‘মার্তিয়াস’, বা রোমানদের যুদ্ধের দেবতা ‘মার্স’-এর নাম থেকে। রোমানদের মাসের নামগুলো দেব-দেবীনির্ভর। শুধু জুলিয়াস সিজারের পর তাঁর ভ্রাতুষ্পুত্র অগাস্টাস সিজারের নামে আগস্ট, সেপ্টেম্বরের septem মানে সাত, octo হলো আট, novem নয়, আর decem হলো দশ। এভাবে দশ মাসের নামকরণ করা হয়েছিল। এখনকার হিসাবে এ-নিয়ম নেই।
অন্যান্য দেশের কথা বাদ দিয়ে শুধু ভারতবর্ষের দিকে নজর দিলে দেখা যাবে, আর্যভারতে প্রায় ২৫ প্রকার অব্দের বা বর্ষগণনার প্রচলন ছিল। তার মধ্যে ঋগ্বৈদিক পর্বে বসন্তকে প্রথম ঋতু হিসেবে গণনা করা হতো। তখন ঋতুই ছিল বর্ষগণনার সূচক। ৩৬০ সাবন দিনে (civil days) হতো এক বছর এবং ৯০ দিন করে চারটি ঋতু ছিল। এক সূর্যোদয় থেকে পরবর্তী সূর্যোদয় পর্যন্ত হতো একদিন। (বেলাবাসিনী গুহ ও অহনা গুহ, ঋগে¦দ ও নক্ষত্র, পৃ ৬৩-৬৪)। তখন ঋতু ছিল বসন্ত, গ্রীষ্ম, শরৎ ও শীত। মানুষেরা সুপ্রাচীনকাল থেকে সূর্যের বিভিন্ন অবস্থিতি, যেমন – বাসন্ত বিষুব, দক্ষিণায়ন দিন, শারদ বিষুব, উত্তরায়ণ দিন সম্পর্কে জানার যে চেষ্টা করেছে, তার প্রমাণ হলো ইংল্যান্ডের Stonehenge, যা ২০০ খ্রিষ্টপূর্বাব্দের কথা। এই চতুঃসীমার মধ্যে দিনগণনা করে ক্যালডিয়ান ও গ্রিক জ্যোতির্বিদগণ মাসের মোট হিসাব পেয়েছিলেন।
বসন্ত গ্রীষ্ম শরৎ শীত মোট দিন
ক্যালডিয়ান ৯৪.৫০ ৯২.৭৩ ৮৮.৫৯ ৮৯.৪৪ = ৩৬৫.২৬
গ্রিক ৯৪ ৯২ ৮৯ ৯০ = ৩৬৫
ঋগ্বেদে প্রথমে তিনটি ঋতু, যেমন, গ্রীষ্ম ঋতু : চৈত্র, বৈশাখ, জ্যৈষ্ঠ, আষাঢ়; বর্ষা ঋতু : শ্রাবণ, ভাদ্র, আশ্বিন, কার্তিক, আর হেমন্ত ঋতু : অগ্রহায়ণ, পৌষ, মাঘ, ফাল্গুন, পরে পাঁচটি এবং সবশেষে ছয়টি ঋতুর আভাস দেওয়া হয়েছে। তৈত্তিরীয় (১।৫।২) ও শতপথ ব্রহ্মণে (২।১।৩) বলা হয়েছে বসন্ত, গ্রীষ্ম, বর্ষা ঋতু তিনটি দেবগণ এবং শরৎ, হেমন্ত ও শিশির হলো পিতৃগণ। রোমানরা মাসের নামকরণ করেছিল বিভিন্ন দেব-দেবী, গাণিতিক সংখ্যা ও সম্রাটের নামে, ভারতে প্রচলিত মাসের নামকরণ করা হয়েছিল নক্ষত্রের নামে। অর্থাৎ জ্যোতির্বিজ্ঞানচর্চা থেকে সূর্যের অবস্থান সাপেক্ষে এ-জাতীয় নামকরণ। এ নিরিখে বলা যায়, পাশ্চাত্য পঞ্জিকার সঙ্গে ভারতীয় পঞ্জিকার আছে বড় ব্যবধান।
প্রত্যেক অব্দ গণনার পেছনে একটি কাল পরিমাপনের প্রসঙ্গ-বিন্দু থাকে। সেটি কোনো ঐতিহাসিক ঘটনাকে প্রসঙ্গ বিন্দু হিসেবে ধরা যেতে পারে। যেমন, খ্রিষ্টীয় অব্দ গণনার ক্ষেত্রে যিশু খ্রিষ্টের জন্মের সময়কে গ্রেগরীয় অব্দের প্রারম্ভ বিন্দু হিসেবে ধরা হয়েছে। অথবা, কোনো রাজার সিংহাসনে আরোহণ করার সময়কে কাল পরিমাপন হিসেবে ধরা হয়। প্রাচীন ভারতে নানা ঘটনাকে কেন্দ্র করে কয়েকটি অব্দের প্রচলন আছে। আলবেরুনী তাঁর গ্রন্থে কয়েকটির উল্লেখ করেন, যেমন, শ্রীহর্ষাব্দ, বিক্রমাব্দ, শকাব্দ, বলভাব্দ ও গুপ্তাব্দ প্রধান। বিক্রমাব্দ বাংলাদেশ ছাড়া উত্তর ভারতজুড়ে প্রচলিত ছিল এবং এখনো বর্তমান। কথিত আছে উজ্জয়িনীর রাজা বিক্রমাদিত্য এই অব্দের প্রচলন করেন। তিনি ৫৭ খ্রিষ্টপূর্বাব্দে শকদের বিতাড়ন করেছিলেন। এই ঘটনাকে স্মরণীয় করে রাখার জন্য বিক্রমাব্দের প্রচলন হয়। এ-অব্দ সম্পর্কে একটা ভিন্নমত প্রচলিত আছে, যেমন, ‘শকাব্দ’-এর প্রচলন করেছিলেন কুশান রাজা কনিষ্ক। পরে এটি রাজা বিক্রমাদিত্যের শক বিজয়ের বছর থেকে গণনা করা হয়। এ-অব্দকে সংবৎও বলা হয়। উপরিউক্ত বিষয়টিকে জনশ্রুতি হিসেবে ধরা হয়। এর পাশাপাশি উত্তর ভারতে গুপ্তাব্দের প্রচলন ছিল, ৫২০ খ্রিষ্টাব্দে গুপ্তদের ক্ষমতা চলে যাওয়ার পর এটি লুপ্ত হয়ে যায়। সম্ভবত গুপ্তাব্দের প্রচলন হয়েছিল ৩১৯ খ্রিষ্টাব্দে দ্বিতীয় চন্দ্রগুপ্তের আমল থেকে। এরপর হর্ষাব্দ চালু হয় হর্ষবর্ধনের সময় থেকে। (অজয় রায়, প্রাগুক্ত, পৃ ৩১) এছাড়া লক্ষ্মণাব্দ, জালালি সন, ত্রিপুরাব্দ প্রভৃতি প্রচলিত ছিল।
সন ও সালের প্রথমটি আরবি, দ্বিতীয়টি ফারসি। দুটোর অর্থ একই। কিন্তু বিশ্ববিশ্রুত পণ্ডিত সিভ্যাঁ লেভি আনুমানিক ‘৫৯৫’ খ্রিষ্টাব্দে বাংলা অব্দের সঙ্গে ‘সন’ শব্দটির সাদৃশ্য দেখতে পান তিব্বতী রাজা রি স্রঙ-সনের বা তাঁর ছেলে স্রঙ-সন-গাম-পোর নামের সঙ্গে। ‘সন’ শব্দের সঙ্গে মিল থাকলেও তিব্বতে কোনো অব্দ বোঝাতে এ-নামটি ব্যবহৃত হয়নি। একসময় জ্যোতিষ্কভাস্কর মহামুনি ভৃগুর সিদ্ধান্তমতে পঞ্জিকা প্রচলিত হয়। সে-পঞ্জিকায় বৈশাখ মাসের নাম তিনি রাখেন মধুসূদন (৩১), জ্যৈষ্ঠ – ত্রিবিক্রম (৩২), আষাঢ় – বামন (৩১), শ্রাবণ – শ্রীধর (৩২), ভাদ্র – ঋষিকেশ (৩১), আশ্বিন – পদ্মনাভ (৩০), কার্তিক – দামোদর (৩০), অগ্রহায়ণ – কেশব (৩০), পৌষ – নারায়ণ (২৯), মাঘ – মাধব (২৯), ফাল্গুন – গোবিন্দ (৩০) ও চৈত্র – বিষ্ণু (৩১)।
গ্রেগরীয় ক্যালেন্ডার ও বঙ্গাব্দ
১৫৮২ সালের ২৪শে ফেব্রুয়ারি পোপ ত্রয়োদশ গ্রেগরি একটি বর্ষপঞ্জির প্রচলন করেন। এ-বর্ষপঞ্জিটি ছিল সৌর বৎসরকে কেন্দ্র করে। অনেক ভ্রান্তি সত্ত্বেও আন্তর্জাতিকভাবে এ-ক্যালেন্ডারকে বাংলা বর্ষপঞ্জির সঙ্গে একীভূত করে ফেলা হয়েছে। এ-পঞ্জিকা আমেরিকা ও ব্রিটেনে গৃহীত হয় ১৭৫২ সালের সেপ্টেম্বর মাসে। গ্রেগরীয় বর্ষপঞ্জি গ্রহণের কারণ হলো : আগে জুলিয়ান নামক এক সম্রাট বর্ষপঞ্জি গণনায় একটি মহাবিষুব থেকে আরেকটি মহাবিষুবের সময়কাল ধরেছিলেন ৩৬৫.২৫ দিন, যা ছিল ১১ সেকেন্ড কম। এর ফলে ৪০০ বছর অন্তর তিনদিনের ব্যবধান হতো। সেজন্য পঞ্জিকা সংশোধনের কাজ শুরু হয়। বাংলাদেশে প্রচলিত আছে যুগপৎ সৌর ও চান্দ্র বছর। গ্রেগরীয় পদ্ধতিকে স্বীকরণ করার ফলে খ্রিষ্টাব্দের সঙ্গে বঙ্গাব্দের মিশ্রণ ঘনিষ্ঠতর হয়েছে। কারণ হিন্দুদের
পূজা-পার্বণ তিথিভিত্তিক বলে গ্রেগরীয় বঙ্গাব্দ মেনে সবকিছু করা সম্ভবপর হলেও মুসলিমপর্ব চান্দ্রবর্ষের
এদিক-ওদিক হওয়ার নয়। উপমহাদেশে একজন হিন্দু নাগরিকের জীবন নিয়ন্ত্রিত হয় – ১. গ্রেগরীয় পঞ্জিকা দ্বারা, ২. সৈদ্ধান্তিক সৌর পঞ্জিকা দ্বারা, ৩. সৈদ্ধান্তিক চান্দ্র পঞ্জিকা দ্বারা। অপরদিকে একজন মুসলমান নাগরিকের জীবন চালিত হয় গ্রেগরীয় ও ইসলামি চান্দ্র পঞ্জিকা বা হিজরি পঞ্জিকা দ্বারা।
এ-বৈষম্য দূর করার জন্য সর্বভারতীয় একটি বর্ষপঞ্জি ১৯৫৫ সালে প্রথম শুরু হয় বিজ্ঞানী মেঘনাদ সাহার (১৮৯৩-১৯৫৬) সভাপতিত্বে গঠিত একটি কমিটির সিদ্ধান্তমতে। তিনি ‘শকাব্দ’কে ধরে বৈশাখ থেকে ভাদ্র মাস ৩১ দিনে এবং বাকি আশ্বিন থেকে চৈত্র মাসকে ৩০ দিনে ধরে একটা সিদ্ধান্তে আসার চেষ্টা করেন। অধিবর্ষ, মলমাস, ক্ষয়মাস বা Leap year-এর ক্ষেত্রে প্রতি চার বছর অন্তর একদিন বাড়িয়ে দিয়ে বর্ষগণনার নিষ্পত্তি করতে চেয়েছিলেন। মলমাস বা অধিবর্ষ শুধু ঋগ্বৈদিক আমলে নয়, অনেক আগে জুলিয়ান বর্ষপঞ্জিতেও উল্লিখিত হয়েছে। এদিক থেকে বাংলাদেশে গ্রেগরীয় ক্যালেন্ডার ও বাংলা বর্ষপঞ্জি মিলেমিশে প্রচলিত আছে।
বঙ্গাব্দ ও পঞ্জিকা সংস্কার
বঙ্গাব্দ বাংলা সন হিসেবেই প্রচলিত, কিন্তু এটি কোনো মৌলিক অব্দ নয়। এর সঙ্গে গ্রেগরীয় বর্ষপঞ্জি, হিজরি, শকাব্দ প্রভৃতি দেশি-বিদেশি বর্ষপঞ্জি মিশে আছে। বাংলাদেশের মানুষের ভাষা ইন্দো-ইউরোপীয় জনগোষ্ঠীর বলে এই সমতা যথার্থ কি না তা গবেষণার বিষয়। তবে সমতা থাকলেও স্থানিক প্রভাবজনিত কিছু সংযোজন যে হয়নি তা নয়। বঙ্গাব্দের কথা উঠলে মহামতি আকবর বাদশার ‘ইলাহি’ অব্দের কথা বলতেই হয়। এর আগে রাজা অবশ্য শশাঙ্ককে কয়েকজন পণ্ডিত বঙ্গাব্দের সূচনাকারী হিসেবে উল্লেখ করেছেন। সুনীলকুমার বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁদের মধ্যে অন্যতম। এ-সম্পর্কে তিনি বলেন যে, ৫৯৪ খ্রিষ্টাব্দের ১২ই এপ্রিল (১লা বৈশাখ, সোমবার) বঙ্গাব্দ গণনা শুরু হয়। কেননা, ওইদিন শশাঙ্ক গৌড়-বঙ্গে রাজত্ব শুরু করেন। দুঃখের বিষয়, এ-সম্পর্কে প্রমাণযোগ্য যথেষ্ট তথ্য বা সূত্র পাওয়া যায়নি।
আর একজন হলেন মিথিলার রাজা শিবসিংহ। তাঁর এক লেখ-এ চারটি তারিখ দেওয়া আছে। সেগুলো হলো – ল সং ২৯২, শক ১৩২১, সম্বৎ ১৪৫৬, সন ৮০৭। কিন্তু এ-লেখর সালটিও যথার্থ প্রমাণের অভাবে গ্রহণযোগ্য হয়ে উঠতে পারেনি। সংস্কারকদের মধ্যে বাংলার স্বাধীন সুলতান হোসেন শাহী বংশের আলাউদ্দীন হোসেন শাহর (১৪৯৩-১৫১৯) নামও উঠে আসে। কিন্তু এটি প্রমাণিত হয়েছে একটি প্রবাদ হিসেবে। অবশ্য হোসেন শাহর আমল বা তার কিছু পরে হিজরি অব্দ ছাড়া ‘পরগণাতি সন’ নামে একটি সনের প্রচলন ছিল। সেটি ১২০১-২ খ্রিষ্টাব্দ থেকে গণনা করা হতো। বল্লাল সেনের নামে ‘বলালী সন’-এর প্রচলন ছিল; কিন্তু সত্যিকার অর্থে তার অস্তিত্ব নেই। তবে বাংলায় শকাব্দ, হিজরি, কোথাও বা লক্ষ্মণ সেন সম্বৎসরের অর্থাৎ ল-সং-এর উল্লেখ পাওয়া যায়।
তবে অধিকাংশ পণ্ডিতের ধারণা, মুঘল সম্রাট আকবরের আমলেই ইলাহি অব্দের প্রচলন হয়। অন্তত আবুল ফজলের আইন-ই-আকবরিতে সেরকমই উল্লেখ আছে।
আকবর বহুদিন ধরেই হিন্দুস্তানের বিভিন্ন অঞ্চলে (দিনগণনার) সমস্যাকে সহজ করে দেওয়ার জন্য এক নতুন বৎসর ও মাস গণনাক্রম প্রবর্তন করতে ইচ্ছুক ছিলেন। তিনি হিজরা (অব্দ) ব্যবহারের বিরোধী ছিলেন। … আমীর ফত্হুল্লাহ্ শিরাজীর প্রচেষ্টায় এই অব্দের প্রবর্তন হলো। এর বৎসর ও দিনগুলি স্বাভাবিক সৌর, অধিবর্ষহীন। পারসিক মাস ও দিনগুলির নামের কোনো পরিবর্তন হয়নি। মাসিক দিনগুলির সংখ্যা ২৯ থেকে ৩২ এবং শেষের মাসের (শেষ) দুদিন রোজ-ও-শব্ (দিন ও রাত্রি) নামে পরিচিত। … ইলাহি (দৈব) অব্দের মাসগুলি হচ্ছে ফরওরদিন, অর্দিবিহিষ্ট, খুবর্দাদ, তির, অমুরদাদ, শারেবার, মিহ্র, আবান, আজব, দয়, রহ্মন ও ইস্ফন্দারমাজ্। (ব্রতীন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায়, বঙ্গ, বাঙ্গালা ও ভারত, পৃ ৮২-৮৩)।
অন্য অধ্যায়ের এক স্থানে বলা হয়েছে : ‘সম্রাট ২৯ দৈব বৎসরের (প্রকৃতপক্ষে রাজ্য বর্ষের) এবং হিজরি অব্দের ৮ই রবিউল আউয়াল, বুধবার রাত্রির কিছু সময় অতিক্রান্ত হলে পর সূর্য মেষ রাশিতে প্রবেশ করে এবং সমান দিন ও রাত্রির (অর্থাৎ মহাবিষুব দিবসের) শুরু হয়। এই বৎসরের প্রারম্ভে (অর্থাৎ ২৯তম রাজ্য বর্ষে) ইলাহি অব্দ প্রবর্তিত হয়েছিল।’ (অজয় রায়, প্রগুক্ত, পৃ ৩৫)
‘আকবরনামা’য় উল্লেখ আছে, ‘৯৬৩ হিজরি সনের ২রা রবিয়াস্্সানি শুক্রবার প্রায় দ্বিপ্রহরের সময় (১৫৫৬ খ্রিষ্টাব্দ, ১৪ ফেব্রুয়ারি) সম্রাট সিংহাসনে আরোহণ করেন।’ আর তাঁর পিতা হুমায়ুনের মৃত্যু হয় ১৫৫৬ সালের ২৪শে জানুয়ারি। আকবর সিংহাসনে বসেন ১৫৫৬ সালে ১০ বা ১১ই মার্চ। এই আরোহণের তারিখ নিয়ে একটা মতান্তর দেখা দিলেও একথা সত্য যে, এ সময় থেকে ফসলি সন বা ইলাহি সন গণনা শুরু হলেও এটি প্রযুক্ত হয়েছিল রাজত্বের ২৮ কি ২৯তম বছর থেকে। এ-প্রসঙ্গে ড. আহমদ শরীফ বলেন যে, বৈরাম খানের অভিভাবকত্ব থেকে আকবর মুক্ত হন ১৫৬০ সালের দিকে। তখন আকবরের বয়স ১৮ বা ২০। ১৫৭৫ থেকে ১৬১৬ সাল পর্যন্ত তাঁকে বারো ভুঁইয়াদের সঙ্গে বিভিন্ন অঞ্চলে লড়াই করতে হয়। এর মধ্যে ইলাহি সাল চালু করা আদৌ সম্ভব কি না, আরো বঙ্গদেশে, তা ভেবে দেখা দরকার। আর, এ-সালটিকে ‘বঙ্গাব্দ’ বলার যৌক্তিক ও বৌদ্ধিক কারণ কী? ‘বঙ্গ’ একটি অঞ্চল মাত্র। হিজরি অব্দ বাদ দিয়ে ইলাহি অব্দ প্রচলনে মুসলমানদের আপত্তি ও দ্রোহের আশঙ্কা তাঁর ছিল। কিন্তু যে আকবর মুসলমান সন্তান হয়ে কুরআন, হাদিসকে উপেক্ষা করে ‘দ্বীন-ই-ইলাহি’ মত প্রচারে দ্বিধা করেননি, তিনি ইলাহি সন প্রতিষ্ঠার জন্য কাউকে পরোয়া করবেন, এটি ভাবা যায় না। তখন বাঙলা ও বঙ্গ নামে দেশ বা অঞ্চলের পরিচিতি থাকলেও বাংলার ঠিক কোন অঞ্চলে ইলাহি সনের প্রচলন হয়েছিল, তা নির্দিষ্ট করে বলা যায় না। এমনকি, কোন অঞ্চলটি বঙ্গ তাও নির্দিষ্ট করে বলা যায়নি। (আহমদ শরীফ, ‘বঙ্গাব্দের উদ্ভব কবে ও কোথায়?’, প্রাগুক্ত, পৃ ৭৪-৭৫)
বঙ্গাব্দের সঙ্গে তারিখ-ই-ইলাহি সনের সম্পৃক্ততা আছে। এ-প্রসঙ্গে বিজ্ঞানী জ্যোতির্পদার্থবিদ ড. মেঘনাদ সাহার মন্তব্য স্মরণ করা যেতে পারে। ড. সাহা বলেন : ‘ওহ ১০৭৯ In 1079 A.D. Sultan Jalaluddin Melik Shah of Iran introduces solar calendar of Iran, and this was introduced by Emperor Akber in India in 1584 A.D. under the name tarik-i-ilahi, Akber’s calendar was used to date all events from his accession (1556 A.D.) and was official calendar during the reign of Jahangir and early part of Sahjahan’s reign when it fell into disuse. But it gave rise to a number of hybrid Eras like the ‘Bengali San’ and of ‘Fasli’ Era which are still in use. (M.N. Saha, ‘The Reform of the Indian Calendar’, Presidential Addresses of the Indian Astronomical and Astrophysical Society, 1952; the Indian Science News Association, 1952).
ড. সাহার নেতৃত্বে ১৯৫৭ সালে ভারত সরকার বর্ষপঞ্জি সংস্কার কমিটির সুপারিশ গ্রহণ করে। সেখানে ‘শকাব্দে’র সংস্কার সাধন করা হয়। যেমন –
১. ১৯৫৭ খ্রিষ্টাব্দের ২২শে মার্চকে [মহাবিষুব সংক্রান্তির (াবৎহধষ বয়ঁরহড়ী) পরদিন] ধরা হলে ১৮৭৯ শকাব্দের প্রথম মাস : ১লা চৈত্র।
২. মাসের দিনের সংখ্যা হবে
প্রথম মাস চৈত্র : ৩০ দিন
পরবর্তী পাঁচ মাস (বৈশাখ থেকে ভাদ্র) হবে : প্রতিটি
৩১x৫ = ১৫৫ দিন
পরবর্তী ছয় মাস (আশ্বিন থেকে ফাল্গুন) : প্রতিটি
৩০x৬ =১৮০ দিন
অর্থাৎ সাধারণ বর্ষ হবে ৩৬৫ দিনে।
৩. অধিবর্ষে (leap year) প্রথম চৈত্র মাস হবে ৩১
দিনে। অর্থাৎ অধিবর্ষ হবে ৩৬৬ দিনে।
ড. সাহার সুপারিশকে সামনে রেখে বাংলা একাডেমিও ১৯৬৩ সালে ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহর নেতৃত্বে ‘বাংলা পঞ্জিকা সংস্কার’-এর উদ্যোগ নেয়। যাকে বলা হয় ‘শহীদুল্লাহ কমিটি’। এ কমিটির সুপারিশগুলো নিম্নরূপ :
১. বর্তমান বাংলা মাসের তারিখ গণনা অত্যন্ত দুষ্কর বিধায় ১৩৭১ সালে (১৯৬৪ সালের ১৪ই এপ্রিল) বৈশাখ হইতে প্রতিবছর ভাদ্র মাস পর্যন্ত এই ৫ মাস ৩১ দিন এবং আশ্বিন থেকে চৈত্র পর্যন্ত এই ৭ মাস ৩০ দিন ধরে গণনা করা হউক।
২. যেহেতু ১৩৬৯ অধিবর্ষ (লিপ ইয়ার) গণনা করা হইয়াছে, এ বর্ষ হইতে প্রতি ৪র্থ বৎসরে ১ দিন বৃদ্ধি পাইয়া চৈত্রমাস ৩১ দিনে গণনা করা হউক। (১৯৬৩ খ্রিষ্টাব্দে ১৩ই জুন তারিখে গৃহীত)
উল্লেখ্য যে, ১৩৬৯ বাংলা সনের প্রাতিষঙ্গিক গ্রেগরি বর্ষ ছিল নিম্নরূপ :
১লা বৈশাখ – ১৭ই পৌষ (১৩৬৯) : ১৩৬৯+৫৯৩ = ১৯৬২ (১৪ই এপ্রিল – ৩১শে ডিসেম্বর)
১৮ই পৌষ – ৩০শে চৈত্র (১৩৬৯) : ১৩৬৯+৫৯৪ = ১৯৬৩ (১লা জানুয়ারি – ১৩ই এপ্রিল)
এ-পঞ্জিকা সংস্কার করা হলেও লিপ ইয়ার নিয়ে একটা সমস্যা থেকে গেছে। যে-সংখ্যাটি প্রতি চার বছর অন্তর ৪ দ্বারা বিভাজ্য সেটি লিপ ইয়ার বা অধিবর্ষ হয়। কিন্তু শহীদুল্লাহ্ কমিটির উল্লিখিত ১৯৬২ বা ১৯৬৩ যেমন লিপ ইয়ার নয়, তেমনি বাংলা ১৩৬৯-ও লিপ ইয়ার নয়। এটিই এ-কমিটির একটি দুর্বলতার দিক।
বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর প্রথম প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ সরকারি কাগজে বাংলায় নোট লেখা, স্বাক্ষর করা এবং তারিখ প্রদানের প্রথা চালু করেন। পরে শেখ মুজিবুর রহমানও এ-কাজটি আরো জোরদার করেন। অবশেষে ১৯৮৭ সালে বাংলাদেশ সরকার ইংরেজি সালের পাশাপাশি বাংলা সন তারিখ লেখার নির্দেশ জারি করেন। ১৯৮৮-৮৯ অর্থবছরে শহীদুল্লাহর কমিটির সুপারিশকৃত বাংলা ক্যালেন্ডার তৈরির নির্দেশ দেওয়া হয়। (অজয় রায়, প্রাগুক্ত, পৃ ৩৮-৩৯)
বাংলা নববর্ষ একটি সর্বজনীন সংস্কৃতি। এর পেছনে রয়েছে যেমন সংগ্রামী পটভূমি, তেমনি প্রতিবাদী মানবিক চেতনা। সেই প্রতিবাদ ছিল পাকিস্তানকেন্দ্রিক ঔপনিবেশিক শাসনযন্ত্রের বিরুদ্ধে। সেই প্রতিবাদের সূত্র ধরে রমনার বটমূলে ছায়ানটের নববর্ষোৎসবের আয়োজন। অবশ্য এর পেছনে ছিল রাবীন্দ্রিক মিলন মহোৎসব রচনার তাগিদ। কেননা রবীন্দ্রনাথই ছিলেন এই প্রাকৃতিক ও সর্বজনীন উৎসবের প্রধানতম কবি সার্বভৌম।
Leave a Reply
You must be logged in to post a comment.