দলবেঁধে কোথাও যাওয়া আনন্দের উৎসব। একা একা ঘুরে বেড়ানো উৎসব হয় না। তখন বিচ্ছিন্ন জীবনের আর্তনাদ ধ্বনিত হয় বুকের ভেতর। ভালো লাগার আনন্দ নষ্ট হয়। সামনে দিয়ে হেঁটে যাওয়া বুনোপাখিও আনন্দের জোয়ারে ভাসায় না। সেজন্য আশিকা কোথাও একা যাওয়ার প্রোগ্রাম মেনে নেয় না। গাছের নিচে চুপ করে বসে থাকলে বুকের ভেতরটা জমাট হয়ে যায়। পাথরের স্তর যেন, যে-স্তর ভেঙে এগোনো কঠিন। সেজন্যে দলের দায় কখনো ওকে বেশি টানতে হয়। এই টানাটাকে ও নিয়মের মাঝে নিয়েছে। মন খারাপ করে না। টাকা জমায় বছরজুড়ে। টের পায় যে এতেও আনন্দ আছে। এর মাঝে নিজের ইচ্ছা পূরণ হয়। ইচ্ছা পূরণ তো স্বপ্নের মতো। আশিকা এমন ভাবনার সঙ্গে হাততালি বাজায়। দু-হাতে গাল চেপে ধরে। কপালে হাত বুলোয়। মধ্যরাতে ঘুম ভেঙে গেলে নিজেকে বলে, ইচ্ছা তুমি ঘুমিও না। জেগে থাক। আমরা হাত ধরে হেঁটে যাব দামতুয়া ঝর্ণার কাছে। সেখানে পাথরের ওপর বসে থেকে জলের স্রোত দেখব। দূরের পাহাড় দেখব। নীল আকাশকে বলব, আকাশ আমার মাথার ওপর ছায়া হয়ে থাক। পেঁজা তুলোর মতো মেঘ পাঠিও আমাকে তোমার কাছে নিয়ে যাওয়ার জন্য। আকাশ তোমাকে আমি বন্ধু মনে করি। তোমার দিকে তাকিয়ে থাকলে আমার সামনে নানা ছবি ভেসে ওঠে। সেই ছবি ধরে আমি মনের ডানায় উড়তে পারি।
ভাবনার মাঝে ঘুম আসে আশিকার। ও গভীর ঘুমে ডুবে যায়। সূর্য ওঠার আগে ওর ঘুম ভাঙে না। ঘুম ভাঙে বেলা ওঠার বেশ পরে। হামিদা বানু দুবার এসে দেখে গেছে আশিকাকে। গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন দেখে ডাকেনি। খেয়াল করেছে ওর চেহারায় আনন্দের জ্বলজ্বলে আভা লেপ্টে আছে। হামিদা বানু বুঝে যায় যে, মেয়েটি কোথাও যাওয়ার জন্য স্থান বাছাই করেছে সেজন্য এমন খুশিতে ভরে আছে ও। মেয়েটাকে কাছ থেকে দেখার এটাই আনন্দ। অনায়াসে বোঝা যায় ওর মনের ছবি। হামিদা বানু আশিকার মনের ছবি দেখে নিজেকে আপ্লুত করে। ভাবে, মেয়ের আনন্দ নিজের মধ্যে নিয়ে দিন কাটানো এক ভিন্ন ধরনের আনন্দ। নিজে ঘুরতে না গেলে কিছু যায়-আসে না। মেয়ের চেহারায় ফুটে ওঠা খুশির আভা তাকে বাইরে ঘোরার আনন্দে ভরিয়ে তোলে। হামিদা বানু আশিকার প্রতি কৃতজ্ঞ হয়।
নাস্তার টেবিলে হামিদা বানু সরাসরি জিজ্ঞেস করে, কী রে কোথায় যাবি বলে ঠিক করেছিস?
ঠিক করেছি? তোমাকে তো বলিনি। তুমি কী করে জানলে?
– তোর চেহারা দেখে। জায়গা ঠিক করলে তোর চেহারা সে-ছবি ফুটিয়ে তোলে।
– বাব্বা। মা গো তুমি দেখছি –
– হয়েছে, হয়েছে থাম। মাকে নিয়ে ভাবতে হবে না।
– তুমি তো আমাকে দেখতেই থাক। কত কিছু দেখতে পাও আমার মধ্যে। নিজের চেহারায় আমি নিজেও এতকিছু দেখতে পাই না।
– নিজের চেহারা তো আয়নায় দেখতে হয়। আয়নায় সবসময় সবটুকু ধরা পড়ে না। আর ধরা পড়লেও নিজের চোখে সেটা দেখা যায় না। অন্যরা দেখতে পায়।
– মা গো, তুমি আমার সামনে একজন দার্শনিক। শুধু স্কুলশিক্ষক না। তোমার দেখার ভিন্ন চোখ আছে। এখন থেকে আমি তোমার ছাত্রী হব।
– নতুন করে কি ছাত্রী হবি? ছোটবেলা থেকে কত কিছু তোকে শেখালাম।
– হ্যাঁ ঠিক। তোমার কাছে শিখতে শিখতেই তো বড় হলাম। এখন যেসব শিখি তা সব পানসে। রুটিরুজির শিক্ষা।
– হয়েছে থাম, থাম। এ-কথা শুনলে মন খারাপ হবে। আমার ক্লাসের ছেলেমেয়েরাও বলবে, আমার কাছে যা শিখছে তা সব পানসে। এমন কথা আর একদিনও বলবি না। শিক্ষকদের অপমান করা হবে।
– মাফ করে দাও মা গো, আর কখনো বলব না। এখন বুঝতে পারছি অনেককিছু না বুঝে বলা হয়ে যায়।
– থাক এসব কথা। ফ্রিজে দই আছে। দেব তোকে?
– না, মা এখন খাব না। বিকেলে খাব। আব্বা অফিসে গেছে?
– হ্যাঁ, বেরিয়ে গেছে। তুই তো জানিস তোর বাবা ঠিক সময়ে বের হতে না পারলে অস্থির হয়ে যায়।
– হ্যাঁ, জানি সময়ের নিয়ম বাবা খুব মানে।
– তুই ইউনিভার্সিটিতে যাবি না?
– যাব। এখনই রেডি হব।
– ক্লাস মিস হবে?
– না, মা ক্লাস মিস হবে না।
– তুই কোথায় ঘুরতে যাবি? ঠিক করেছিস বুঝেছি। জায়গাটা কোথায়?
– বান্দরবানের আলীকদম উপজেলায় যাব। ওখানে একটি চমৎকার ঝর্ণা আছে। ওটার নাম দামতুয়া ঝর্ণা। প্রকৃতির নয়ন ভোলানো দৃশ্য মুগ্ধ করবে আমাদের। মা গো তুমি যাবে আমার সঙ্গে?
– না রে মা, আমার যাওয়া হবে না। স্কুল থেকে ছুটি পাব না। তোর তো দলবল আছে।
– হ্যাঁ, তা আছে। আজ ওদের সঙ্গে বসব। যাই গোসল করে নিই।
খাবার টেবিল ছেড়ে একছুটে নিজের ঘরে যায়। বাথরুমে ঢুকে শাওয়ার ছাড়ার সঙ্গে সঙ্গে দামতুয়া ঝর্ণার অনুভব ওকে
আপ্লুত করে। মনে হয়, এই সকালবেলা শাওয়ারের ঝরে পড়া পানি ওকে দামতুয়া ঝর্ণার ছোঁয়া দিচ্ছে, তবে প্রকৃতির অনুভবের মাত্রা দিতে পারে না। নেট থেকে এই ঝর্ণার দারুণ ছবি বের করেছিল ও। ছবির দিকে তাকিয়ে থেকে গুনগুন করেছিল। একটু আগে নিজেকে শাসন করেছে। এমন নানামুখী অনুভব ওকে বিভিন্ন পথে হাঁটায়। এখন গায়ের ওপর গড়িয়ে পড়া পানির স্রোত ওর দেখা দামতুয়া ঝর্ণার অবিকল ছবি হয়ে বাথমরুমের ছোট পরিসর বিশাল করে তোলে। চারদিকের দেয়াল ওর সামেন পাহাড়ের ছবি হলে ভেনটিলেটারটা ঝর্ণা যেন। মাথার ওপর থেকে পানি পায়ের নিচে গড়িয়ে এলে সেটা সমুদ্র হয়ে যায়। আমি সমুদ্র ভালোবাসি মা। কতবার তো কক্সবাজার গিয়েছি। সমুদ্রে পা ডুবিয়ে বসে থেকেছি ঘণ্টার পর ঘণ্টা। আমি তো প্রকৃতির কন্যা। প্রকৃতির ভেতর থেকে উঠে আসা দিনের সঙ্গী হতে চাই। একই সঙ্গে পাব আদিবাসী মুরং জনগোষ্ঠীকে। ওদের কাছে গিয়ে দাঁড়াতে পারলে আমার দিনগুলো পাহাড় আর বনের মতো সবুজ হয়ে যায়। সাগরের মতো নীল হয়ে যায়। ঝর্ণার মতো শুভ্র হয়ে থাকে। পাখির মতো উড়ে যায় আকাশে। মেঘের মতো ভাসমান ফুল হয়। আমার নানা বিস্তার ঘটে মা গো। আমার বন্ধুদের দেখি প্রজাপতির মতো নিষ্পাপ সুন্দর। ওরা আমার সামনে ছেলে আর মেয়ে থাকে না – ওর শুধুই আনন্দ হয়। শাওয়ারের নিচে দাঁড়িয়ে হাত-পা ছুড়ে পা দাপায়। পায়ের নিচে জমে থাকা পানি থেকে ছপছপ শব্দ হয়, যেন ও কোনো এক খালের ভেতর দিয়ে হেঁটে যাচ্ছে। পায়ে ছলকাচ্ছে পানি। পানির শব্দ ঝর্ণার গড়িয়ে পড়া স্রোতের মতো দু-কান ভরিয়ে দিচ্ছে। মনের আনন্দে উচ্ছ্বসিত হয়ে নিজেকে উন্মাতাল হতে দেখার অনুভব ওকে ভরিয়ে রাখে। ওই ঝর্ণার আশেপাশে থাকে মুরংরা। ওদের ভাষায় দাম শব্দের মানে মাছ আর তুয়া শব্দের মানে বাস করার শেষ জায়গা। মুরং নারীদের আমি ঝর্ণাধারা বলব। ওখানে গেলে ওদের সঙ্গে আমার বন্ধুত্ব হবে। আর আমার বয়সী যারা থাকবে তারা হবে ঝর্ণার গান। কীভাবে পারবে? এমন ভাবনাও তো বোকামি। ঝর্ণা পাহাড়ি বনভূমির সোনালি উৎস। আহারে কী আনন্দ! আশিকা আনন্দে শাওয়ারের নিচে দাঁড়িয়ে দু-চার লাফ দেয়। মাথা ঘাড়ের পেছনে হেলিয়ে মুখজুড়ে পানির ছোঁয়া লাগায়, কিন্তু তাতে প্রাকৃতিক ঝর্ণার ছোঁয়াটি কোনোভাবে অনুভবে আসে না। পরক্ষণে নিজেকে শাসন করে বলে, এসব আমার পাগলামি। নিজের সঙ্গে পাগলামি করছি। হাত বাড়িয়ে শাওয়ার বন্ধ করে। আবার খুলে দেয়।
বাথরুমের আয়নার সামনে ভেজা চুল আঁচড়াতে আঁচড়াতে ওর ভেতরে নানামুখী চিন্তা ছড়াতে থাকে। ভাবে, প্রকৃতি ও মানুষের সঙ্গে ভালোবাসা গড়ে তোলা আমার জীবনদর্শন হবে। জীবনভর এই দর্শন অনুযায়ী কাজ করব। পাঁচ বছর আগে কুয়াকাটায় গিয়ে দেখেছিলাম ওখানকার সমুদ্রসৈকত সুন্দর করে গড়ে তোলা হয়নি। এই পাঁচ বছরে হয়তো কিছু পরিবর্তন হতে পারে। যদি না হয় তাহলে পটুয়াখালীর জেলা প্রশাসকের সঙ্গে দেখা করব। এই সমুদ্রসৈকত সুন্দর করার জন্য পাঁচশোজনের স্বাক্ষর নিয়ে একটি দরখাস্ত নিয়ে যাব।
আমি আদিবাসী জনগোষ্ঠীর জন্য কাজ করব। ওদের শিশুদের মাতৃভাষা শেখানোর জন্য ছোট ছোট স্কুল করতে হবে। ওদের মাতৃভাষা যেন বিলুপ্ত না হয়। যেখানে গেলে যে কাজ হবে সেখানে গিয়ে চেষ্টা করব। তার আগে সরকারি চাকরিতে ঢুকব। পরক্ষণে নিজেকে শাসন করে, বেশি বেশি ভাবছিস আশিকা। নিজেই নিজেকে উত্তর দেয়, নারে আশিকা, বেশি বেশি ভাবছি না। এটা আমার ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা। যেখানেই চাকরি করি না কেন, পাশাপাশি এসব করব।
আয়নার দিকে তাকিয়ে থাকে। নিজের চেহারা দেখে। চুল আঁচড়ানো হয়েছে। কিন্তু নিজের চেহারায় কিছু খুঁজে না পেয়ে দরজা খোলে। প্রায় দুই ঘণ্টা বাথরুমে কেটে গেল।
হা-হা করে হেসে ওঠে আশিকা। হাসতে হাসতে শাওয়ার বন্ধ করে। তোয়ালে দিয়ে গা মুছে জামা পরে বের হলে দেখতে পায় বাথরুমের দরজার সামনে দাঁড়িয়ে আছেন মা।
হামিদ বানু ভুরু কুঁচকে বলে, এতক্ষণ লাগিয়েছিস কেন গোসল করতে? ভিজেভুজে একসার করেছিস? ঠান্ডা লাগলে –
– কিছু হবে না মা গো। আমি শাওয়ারের নিচে দাঁড়িয়ে ঝর্ণার শব্দ শুনছিলাম। মুরং মেয়েদের সঙ্গে বন্ধুত্বের কথা ভাবছিলাম। শাওয়ার আমার কাছে ঝর্ণার মতো লাগছিল। ভিজতে ভিজতে অনেক মজা করেছি।
– পাগলামি করার আর জায়গা পাস না, না?
– মা গো মানুষের পাগলামিও থাকতে হয়। পড়ালেখার চাপ থেকে ছুটি পাওয়া যায় পাগলামি দিয়ে।
– কত কী যে তুই ভাবতে পারিস আমার মেয়ে –
– ভেবেই জীবন উড়িয়ে দেব। মা গো আমাকে আমার মতো থাকতে দাও।
– উড়িয়ে দিবি? উড়িয়ে দেওয়ার মানে কী?
– আমি তোমাকে বোঝাতে পারব না মা। ওটা আমার চিন্তায় থাকুক।
– ঠিক আছে থাকুক। কিন্তু আমার মরার আগে জীবন উড়াবি না। তাহলে আমি মরেও শান্তি পাব না।
– এমন কথা বলো না মা গো।
– তুই বলতে পারলে আমি পারব না কেন? তুইও আমার সামনে এমন করে আর কথা বলবি না।
– হ্যাঁ, মা, একদমই বলব না। যে-কথায় তুমি দুঃখ পাবে, সে-কথা কেন বলব আমি।
হামিদা বানু এক মুহূর্ত চুপ থেকে বলে, কখন বের হবি?
– এক্ষুনি মা গো। যাই রেডি হই।
– রেডি হওয়ার সময় আবার ঝর্ণা মাথায় ঢুকবে না তো?
হা-হা করে হাসতে হাসতে আবার আশিকা বলে, ওটা তো মাথায় ঢুকেই আছে। তবে হাতে সময় কম। সেজন্য ঝর্ণার পানিতে ডুবব না। ঝর্ণার পানি ঝরঝরিয়ে ঝরে পড়ে যাবে। একদিন তোমাকে নিয়ে যাব পাহাড়ি ঝর্ণার কাছে। দুজনে একসঙ্গে ভিজব। তোমাকে আমি জড়িয়ে ধরে রাখব মা গো।
– তোর বাবাকে নিবি না?
– হ্যাঁ, হ্যাঁ, বাবাকেও নেব। ইস কেন যে বাবার কথা বললাম না। বাবা অফিস থেকে ফিরলে বাবকে যাবার কথা বলব। তুমি একটুও মন খারাপ করবে না।
মাকে জড়িয়ে ধরে কপালে চুমু দিয়ে নিজের ঘরে ঢুকে দরজা বন্ধ করে আশিকা। জানালার পর্দা টেনে কাপড় বদলায়। গুনগুন শব্দে গানের বাণী ছড়ায়। মাঝে মাঝে কণ্ঠস্বর উঁচু করে, যেন বাইরে থেকে মা শুনতে পায়। মায়ের একটি প্রিয় গান – ‘অন্তর মম বিকশিত কর অন্তরতর হে – নির্মল করো, উজ্জ্বল করো, সুন্দর করো হে – জাগ্রত করো – উদ্যত করো – নির্ভয় করো হে – মঙ্গল করো, নিরলস নিঃসংশয় করো হে।’
এই কয় লাইন গাইতে গাইতে শাড়ি পরা হয়ে যায়। ভাবে, দরজা খুলে দিলে মা গানের পরের বাণী সরাসরি শুনতে পাবে। ও চলে গেলে মা একা হয়ে যাবে। এক মেয়ে নিয়ে তার সংসার। ওর পরে দুটো ছেলে হয়েছিল। দুজনই জন্মের সঙ্গে সঙ্গে মারা যায়। তারপর আর সন্তানের কথা ভাবেনি। স্কুলের চাকরি নিয়ে ব্যস্ত থেকেছে। আশিকার কখনো মনে হয় মায়ের সঙ্গে ওর সম্পর্ক বন্ধুত্বের। মা ওর প্রাণের বন্ধু। মায়ের সঙ্গে যে-কোনো বিষয় নিয়ে আড্ডা দেওয়া যায়। গান গাইতে গাইতে আর একটু সময় যায় – ‘যুক্ত করো হে সবার সঙ্গে, মুক্ত করো হে বন্ধ – সঞ্চার করো সকল কর্মে শান্ত তোমার ছন্দ – চরণপদ্মে মম চিত্ত নিস্পন্দিত করো হে – নন্দিত করো, নন্দিত করো, নন্দিত করো হে।’
শেষ পঙক্তি গাইতে গাইতে আশিকা দ্রুত বেরিয়ে আসে। দেখতে পায় মা ডাইনিং রুমের জানালায় পিঠ ঠেকিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। দৃষ্টি সরাসরি ওর ঘরের দরজার ওপর। মায়ের আজকে কী হয়েছে? কেন ওকে নিয়ে মায়ের এমন ব্যাকুলতা? দুটো সন্তান হারিয়েছে বলে একমাত্র জীবিত সন্তানের হৃৎপিণ্ডের টুনটুন ধ্বনি আজ বোধহয় তাকে ছন্নছাড়া করে ফেলেছে!
মেয়েকে দরজা খুলতে দেখে এগিয়ে আসে হামিদা বানু। মাথায় হাত রেখে বলে, এমন সুন্দর গানটি ঠিকমতো শুনতে পাইনি। তুই কখন ফিরবি? বাইরে বেশি সময় না কাটিয়ে তুই আমাকে সময় দিবি মা রে।
– আমি সন্ধ্যার আগেই ফিরব। আমি ফিরে এসে তোমাকে আর বাবাকে গান শোনাব মা।
– তোর বাবা বলেছে আজকে আমাদের নিয়ে বাইরে খেতে যাবে। তুই যে রেস্তোরাঁয় যেতে চাইবি সেখানে যাবে।
– হুররে – হুররে – মজা হবে। আমি বিকেলের মধ্যে ফিরে আসব। আমি চায়নিজ রেস্তোরাঁয় যাব।
– দেরি করিস না মা। তাড়াতাড়ি আসিস।
– তোমার আজকে কী হয়েছে মা? তোমার মন খারাপ কেন?
– তুই তো জানিস মাঝে মাঝে আমার এমন হয়। মরে যাওয়া ছেলে দুটোর চেহারা আমার সামনে আটকে থাকে। ওরা আমাকে বলে, মা গো আমাদের দুধভাত দাও। খিদে লেগেছে।
– আজকে তেমন লাগছে?
– হ্যাঁ, লাগছে। কোনো কাজে মন বসাতে পারছি না।
– তাহলে আমি বাসায় থাকব?
– না, না তুই যা। তোর ক্লাস আছে না। আর আমার এমন লাগলে আমি তো কারো সঙ্গে কথা বলি না। আমার একা থাকাটাই জরুরি হয়। আমি নিজের ভেতর থেকে কথা খুঁজে বের করি।
– মা গো, তাহলে আমি এখন যাই?
– যা মা। তাড়াতাড়ি যা। তোর দেরি হয়ে গেল নাকি?
– বেরিয়ে একটা রিকশা পেয়ে গেলে আর দেরি হবে না। যাচ্ছি।
দরজা খুলে বেরিয়ে যায় আশিকা। বাড়ির সামনেই রিকশা পায়। অল্প সময়ে ইউনিভার্সিটিতে চলে আসে। মনে মনে ভাবে, কপাল ভালো যে ট্রাফিক জ্যাম নেই। মনিরুজ্জামান স্যারের ক্লাস শেষ করে বন্ধুদের নিয়ে টিএসসির মাঠে বসে পড়ে আশিকা। গোল হয়ে বসে থাকা সবার মাঝে একগাদা বাদাম রাখে ও। বলে, বাদাম খাব আর গল্প করব।
– গল্প কিসের, তোর প্ল্যানের কথা বল। আমি তো তোর ই-মেইলে দামতুয়া ঝর্ণার বর্ণনা পড়ে মুগ্ধ হয়ে গেছি। কবে যাব এই অস্থিরতায় ভুগছি।
হাসিতে উচ্ছ্বসিত হয়ে ওঠে সেঁজুতি। বেশ শব্দ করে হাসতে থাকে।
আসিফ খেঁকিয়ে ওঠে।
– এত হাসির কী হলো সেঁজুতি?
– খুশি, খুশি। নিজের দেশকে নতুন করে দেখার খুশি। আমি তো আশিকার মতো দেশের আনাচে-কানাচে ঘুরিনি। এবারই প্রথম বাবা-মাকে ছাড়া যাচ্ছি।
– এতদিনে তুই বড় হয়েছিস। আমরা বুঝে গেলাম যে এক মাস আগেও তুই খুকি ছিলি।
– ফাজলামি করবি না আসিফ।
– মোটেই ফাজলামি করছি না। খুকিকে খুকি বলছি মাত্র।
– ঢং দেখানোর জায়গা পাস না তুই। সবার সঙ্গে এমন খারাপ ব্যবহার করিস। মতিগতি ঠিক রাখতে পারিস না। মনে হয় না তুই বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়িস।
– আমি মাত্র একটা কথা বলেছি। আর তুই কতগুলো কথা বললি।
– হয়েছে, হয়েছে তোরা থাম। বাদাম খেতে শুরু কর। তাহলে এমন কথা বন্ধ হবে। এসব কথা শুনে আমাদের মন খারাপ হচ্ছে।
আশিকা দু-হাত নেড়ে কথা বলে। ওরা ছয়জন বসে আছে। চারজন ছেলে ও দুজন মেয়ে। এবার ছয়জনের দল হয়েছে। কারো জন্য টাকা ব্যয় করতে হবে না আশিকার। দলের সবাই টাকা-পয়সায় সচ্ছল। সুহাস এদের মধ্যে বেশি সচ্ছল। এই দলের সঙ্গে এবারই ওর প্রথম যাত্রা। ওর নিজেরও উচ্ছ্বাসের শেষ নেই। বলে, দামতুয়া ঝর্ণার পুরো খবর আমি নেট থেকে দেখে নিয়েছি। আশিকার কাছ থেকে যাবার পরিকল্পনার কথা আমার দরকার নেই। ও যে পরিকল্পনা করেছে সেজন্য ওর কাছে আমি কৃতজ্ঞ। আমারও এলাকাটি দেখার আগ্রহ বেড়েছে।
– আশিকা যে-পরিকল্পনা করেছে সেটা আমাদের দরকার আছে। সবাই মিলে একসঙ্গে যাত্রার খবর মাথায় রাখব। নইলে এদিক-ওদিক হয়ে যেতে পারে।
– ঠিক বলেছে ইউসুফ। দলের সবাই একত্রে না থাকলে একে-ওকে খোঁজাখুঁজি শুরু হবে।
– আমরা তো যে যার মতো যাব না। সবাইকে একটাই ভাবনা মাথায় রাখতে হবে। আমাদের এক জায়গায় জড়ো হতে হবে। একই সময়ে। সময়ের হেরফের করা চলবে না।
– আশিকা এমন চুপ হয়ে আছিস কেন?
– আমি সবার কথা শুনছি। কে কী বলে তা তো আমার জানতে হবে। তারপর নিজের কথা বলব।
সুহাস হাসতে হাসতে বলে, আশিকার কথা শোনার আগে আমরা বাদাম শেষ করি।
– না, দুটোই একসঙ্গে হবে। আয় বাদাম চিবাই আর কথা শুনি।
– কথা গড়াবে ঝর্ণার মতো, ঠিক তো?
– তাহলে আশিকা শুরু করুক। বল কী ঠিক করেছিস।
– আমরা রাতে কক্সবাজারগামী বাসে উঠব। আমাদের চকরিয়ায় নামতে হবে। সেখান থেকে বাসে বা জিপ ভাড়া করে আলীকদম যাওয়ার ব্যবস্থা আছে। বাসে উঠলে দুই ঘণ্টা লাগবে। আর যদি জিপ ভাড়া করি তাহলে আরো কম সময় লাগবে একদিকে, অন্যদিকে নিজেদের ইচ্ছেমতো বিভিন্ন জায়গায় নামতে পারব। দেখাটাও দারুণ হবে। প্রকৃতির ছোঁয়া আমাদের মুগ্ধতার আবেশ বাড়াবে। আমরা প্রকৃতির রাজ্যে হারিয়ে যেতে পারি।
হা-হা করে হেসে ওঠে সবাই।
সেঁজুতি ওর দিকে সরাসরি তাকিয়ে বলে, হারিয়ে গেলে ফিরে আসতে পারব আমরা?
– ইচ্ছে করে হারিয়ে গেলে ফিরে আসার কথা ভাবব কেন? ঘোরাঘুরির মাত্রা বাড়ানোর জন্য হারাব। যখন মনে হবে ফেরা দরকার তখন তো ফিরতেই পারব। পথ খুঁজে ফেরা এমন কোনো কঠিন কাজ হবে না। এত অল্পে ঘাবড়ে যাস কেন?
আশিকা মুখ ঝামটা দিয়ে কথা বলে।
– দুর্গম পাহাড়ি এলাকা। যেতে সাহস করিস?
– সাহস না করলে এত কথা বলছি কেন? সাহস করেছি বলেই তো পরিকল্পনা করেছি। তোদের দলে যুক্ত হওয়ার অনুরোধ করেছি। দুর্গম এলাকায় একা একা যাওয়া উচিত নয়।
এবার আশিকার কণ্ঠে রাগ ছড়ায়।
– প্রকৃতির রাজ্যে আর কী দেখব রে আশিকা?
– মুরংদের তিনটি পাড়া পথে পড়বে। ওদের সঙ্গে কিছু গল্প হতে পারে আমাদের।
আসিফ দুটো বাদাম দূরে ছুড়ে বলে, শুধু গল্প? একজন মুরং মেয়ের সঙ্গে প্রেম হবে না?
– দেব একটা থাপ্পড় শয়তান। কেবল খারাপ চিন্তা। প্রেম করবি কেন? বিয়ে করতে পারবি?
– বিয়ে করতে হবে কেন? প্রেমের বন্ধুত্ব হবে।
– দুদিনের জন্য এসে এত শখ কিসের? ফাজলামি করার জায়গা পাস না। ঢাকা শহরে থেকে কীভাবে বন্ধুত্ব রাখবি?
– এত প্রশ্ন করবি না আশিকা। আমি তোর এত প্রশ্নের উত্তর দিতে বাধ্য নই।
– রেগে উঠছিস কেন? মারামারি করবি নাকি?
– বাজে প্রশ্ন করলে উত্তর দিতে হবে। বাধ্য না হলে বলবি না। এভাবে বললে পার পাবি না। আজকে ছেড়ে দিলাম। ভবিষ্যতে ছাড়ব না।
– ছাড়িস না। একদম ছাড়বি না। নিবিড় করে জড়িয়ে ধরে রাখিস।
হা-হা-হি-হি হাসিতে ভরে যায় মাঠ। হাসির রেশ কমলে আশিকা সবার দিকে তাকিয়ে বলে, তোরা সবাই আসিফকে সাপোর্ট দিলি কেন? ওর এত বাজে ভাবনা হলো কেন?
আসিফ জোরেশোরে বলে, মোটেই এটা আমার বাজে ভাবনা না। আমি ফান করেছি। একটি মেয়ের সঙ্গে প্রেম করা কি সোজা কথা!
– তাহলে বললি কেন? আমি এসব কথা সহ্য করতে পারি না। দু-একটা প্রেমের কথা বলে গায়ে হাত দিবি এটা একদম অসহনীয় ব্যাপার।
সেঁজুতি ওর হাত ধরে বলে, তোকে ফান বুঝতে হবে আশিকা। তুই তো এমন হাবা মেয়ে না যে ফান বুঝবি না।
– আমি সবই বুঝি। কিন্তু বাজে ফান বুঝতে চাই না। গায়ের জোরে বোঝাতে আসিস না। ফান এত সোজা কথা না, ফান বুঝতে মেধা লাগে। একটা ঢাউস মাথা থাকলে কেবল হয় না।
– হয়েছে বাপু, আর কোনোদিন বলব না। আমাদের ছাত্রছাত্রী পেয়েছিস। শিক্ষকের মতো কথা বলছিস।
– আমাদের এখন বাদাম খেয়ে শেষ করতে দে। সুহাস হাসতে হাসতে বলে, আশিকা আমাদের সঙ্গে টিচারের মতো কথা বলছে।
– ও তো ফার্স্টক্লাস পাবে। ডিপার্টমেন্টের টিচার হয়ে যাবে। এজন্য ও ছাত্র-শিক্ষক সম্পর্ক প্র্যাকটিস করছে।
আবার হাসির তোড়ে বয়ে যায় সময়। আশিকা নিজে হাসতে পারে না। বুঝতে পারে ওরা ওকে টিজ করছে। ও থম ধরে চুপ থাকে। চোখ ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে সবার মুখের দিকে তাকায়।
হাসি থামলে আশিকা ভুরু কুঁচকে তাকিয়ে বলে, তোরা এভাবে আমার সিরিয়াস কথাটির অপব্যাখ্যা করলি। আমি চাই না আমাদের বন্ধুরা ভ্রমণের আনন্দের সময় কোনো মুরং মেয়েকে বিব্রত করবে।
মেয়েরা সঙ্গে সঙ্গে বলে, আশিকা ঠিক বলেছে। আমরাও চাই না কোনো বাজে ঘটনা ঘটুক।
– আমরাও চাই না। আসিফ ফান করে যে-কথা বলেছে সেটা আমাদের কাছে ফানই থাকবে।
ছেলেরাও একসঙ্গে কথা বলে।
– আমি যা ফান ভেবে বলেছিলাম দ্বিতীয়বার তা আর বলব না। আমার কথার এমন ব্যাখ্যা হবে আমি তা ভাবতেও পারি নাই।
আসিফ প্রতিজ্ঞার মতো করেই বলে। সঙ্গে সঙ্গে এটাও বলে, আমাদের বান্ধবীদের পাহাড়ের চুড়োয় বসে প্রেম নিবেদন করতে পারলে আমার ভ্রমণের আনন্দ সার্থক হবে। আমি ধন্য হব।
– বাব্বা, স্বপ্নের মতো কথা বললি। কিন্তু এভাবে কথা বললে তুই আমাদের হাতে মার খাবি। আমরা তোকে ছাড়ব না।
– চল, আমরা আগে গিয়ে ঝর্ণার ধারে দাঁড়াই। তারপর নিজেদের আবেগের হিসেব কষব। আসিফ বেশ বাড়াবাড়ি করছে।
– ঠিক আছে, তুই দিন-তারিখ ঠিক করে ফেল। কী পরিমাণ টাকা লাগবে তাও আমাদের জানা। আমরা রেডি হয়ে যাব। আমাদের যেন টাকার টানাটানিতে পড়তে না হয়।
– ঠিক আছে। জানাচ্ছি। সবাইকে মেইল করে দেব।
– হুররে, আমাদের যাত্রা শুভ হোক।
– শুভ হোক মন্ত্র। শুভ হোক ধ্বনি।
– শুভ হোক কলরব। শুভ হোক মিলন।
– ধর্মের সঙ্গে, বর্ণের সঙ্গে, নৃগোষ্ঠীর সঙ্গে এক হয়ে যেতে চাই। দামতুয়া শুধু ঝর্ণা নয়, আমাদের প্রাণের কলকল ধ্বনি।
– বাব্বা, আশিকার শেষ কথাটাই আমাদের চেতনার দীপশিখা। আমরা এভাবেই দেখব প্রকৃতি আর মানুষকে।
– একই সঙ্গে সম্পর্কের সূত্রকে। কেউ যেন সম্পর্কের সূত্র নষ্ট না করি। জয় হোক আশিকার।
– হয়েছে, আর ফাটাতে হবে না। চলো বাড়ি যাই।
রিকশার জন্য টিএসসির সামনে এসে দাঁড়ায় আশিকা। ওর সঙ্গে অন্যরাও আছে। আশিকা রিকশায় ওঠার আগে বলে, আমাদের যাত্রা বেশ দুর্গম পথের। পার হতে হবে চারটি পাহাড়, অনেকগুলো ছড়া, চারটি মুরং পাড়া।
সুহাস বলে, মুরং পাড়াগুলোর নাম পেয়েছিস। পেয়ে থাকলে বল। কাগজে লিখে রাখব। যেন ভুলে না যাই।
– পারব কেন? সব জোগাড় করেই তো তোদের সঙ্গে যোগাযোগ করেছি। আমি তো ধরে নিয়েছিলাম যে জায়গার বিবরণ তোরা জানতে চাইবি। আন্দাজে এক জায়গায় যাওয়ার জন্য তোরা তৈরি হয়ে থাকবি না।
– বুঝেছি তুই অনেক মেধাবী মেয়ে। আর ব্যাখ্যা করতে হবে না। পাড়াগুলোর নাম বলো।
– প্রথমে পড়বে বার্মিজ পাড়া, তারপরে হমথৈই পাড়া। এরপর আছে নামদা পাড়া। সবশেষে কাউখই পাড়া।
– নামগুলো বেশ অন্যরকম। শুনতে ভালো লাগলো।
– মুরংদের ভাষার নাম। অন্যরকম তো আমাদের কাছে মনে হবে। তবে পাড়াগুলো দেখতেও ভালো লাগবে। সবুজ প্রকৃতির মাঝে ছোট ছোট বাড়িঘর। নেটে দেখতে কী যে অপরূপ লাগছিল। আমার মুগ্ধতা সীমা ছাড়িয়ে গিয়েছিল। তখনই মনে হয়েছিল এলাকায় গিয়ে কাছ থেকে না দেখলে বেঁচে থাকার স্বপ্ন পূরণ হবে না। এমন শূন্যতা নিয়ে মরে যেতে চাই না।
– বাবারে বাবা, কতকিছু যে ভাবতে পারিস তুই আশিকা।
– তোরা সবাই তো আমার ভাবনার সহযোগী। তোদের না পেলে আমার ইচ্ছা পূরণ হতো না।
– ঠিক বলেছিস। তোর কাছে আমরা কৃতজ্ঞ হলাম।
– এবার আমরা কাছ থেকে দেখব তোর স্বপ্নের বনভূমি। আমি মনে করি ওরা প্রকৃতির সন্তান। ওদের বেঁচে থাকা অসাধারণ জীবনদর্শন। পুরো দেশটা এভাবে পূর্ণ থাকুক আমাদের সামনে।
প্রত্যেকের কথায় অজানাকে জানার সুর শুনতে পায় আশিকা। সব কথা সংগীতের মতো ধারণ করে নিজের হৃদয়ে। ভেসে আসে গানের বাণী, ‘গ্রাম ছাড়া ওই রাঙামাটির পথ আমার মন ভোলায় রে …’। মেয়েরা একসঙ্গে গানটি গাইতে থাকে। একটি পঙক্তিই, পুরো গানটি কারো মুখস্থ নেই। কারণ ওরা কেউ গানের শিল্পী নয়। একটু পরে ছেলেরাও ওদের সঙ্গে যুক্ত হয়। বেশিক্ষণ গাওয়া হয় না। রাস্তার ধারে দাঁড়িয়ে গান গাইতে হাসি পায় সবার। পথে যারা হাঁটছে কিংবা রিকশায় আছে সবাই তাকিয়ে থাকে ওদের দিকে। আশিকা চারদিকে তাকিয়ে লজ্জা পায়। সবার দিকে তাকিয়ে বলে, যাই বাড়িতে গিয়ে যাবার দিন ঠিক করি।
একটি রিকশা দাঁড় করায় ইউসুফ। বলে, উঠে পড়। বাড়ি গিয়ে কাজে বসে যা। দূরে কোথাও যাবার কথা ভাবলে আবেগে আপ্লুত হয়ে যাই। মনে হয় কলম্বাসের মতো একটি দেশ আবিষ্কার করব। মানুষের বসতিতে পূর্ণ হয়ে উঠবে দেশের ছবি। হাতে আঁকা ক্যানভাসের ছবি নয়। প্রকৃতির ক্যানভাসে আঁকা ছবি। প্রকৃতি নিজের হাতে এঁকেছে সে-ছবি।
– নাহ, আমাদের সবাই কবি হয়ে যাচ্ছে দেখি। সবার চিন্তায় দিগন্তের রেখা এসে ঢুকছে।
– আমারও তাই মনে হচ্ছে। আশিকা মৃদু হাসিতে নিজেকে উদ্ভাসিত করে। এদিকে-ওদিকে পথচারীদের কেউ কেউ দাঁড়িয়ে ওদের কথা শুনছে। মঞ্জুরিকে বলে, তুই নিজে কী ভাবছিস মঞ্জুরি?
– যাব, দেখব, ভ্রমণের আনন্দ নিয়ে ফিরে আসব। এটুকুই আমার ভাবনা। আমার তোদের মতো কবিত্ব শক্তি নেই যে ভাবনার অতলে নিজেকে ডুবিয়ে দিয়ে দার্শনিক হয়ে যাব।
– ব্যস, ব্যস। থাম। অনেক বলেছিস। যাই।
আশিকার রিকশা চলতে শুরু করে। সূর্য পশ্চিম আকাশে চলে গেছে। হুড-খোলা রিকশায় নিজেকে একজন পর্যটকের মতো লাগছে। চারদিকে গাড়ি, কখনো তুমুল শব্দে হর্ন বাজে। শোনা যায় রিকশার টুনটুন ধ্বনি। ফুটপাত দিয়ে হেঁটে যাচ্ছে মানুষ। নিজেকে পর্যটকের ভাবনা থেকে বের করে না এনে চিন্তায় ঢোকায় বান্দরবানের পাহাড়ের চূড়ায় নীলগিরি পর্যটন কেন্দ্র। রিকশার হুড তুলে দিয়ে মাথা ঠেকালে মনের পাতায় ভেসে ওঠে পাহাড়ের অসাধারণ সৌন্দর্য। বছরখানেক আগে বাবা-মায়ের সঙ্গে গিয়েছিল নীলগিরিতে। যাওয়ার উদ্যোগ ছিল ওর বাবার। ওর মাকে বলেছিল, মেয়েটির ইচ্ছা পূরণের জন্য যাওয়ার উদ্যোগ নিয়েছি। আমার এক বন্ধু বলেছে, খুবই সুন্দর এলাকা। গেলে মন ভরে যায়। আশিকার কথা ভেবে আমিও মন ভরাতে চাই। তুমিও মন ভরাবে গো বানুবিবি।
হামিদা বানু হাসতে হাসতে উচ্ছ্বসিত হয়ে বলেছিল, আমি তো মেয়েটার দিকে তাকালে ওর চেহারায় অনেককিছু দেখতে পাই।
– আমিও ওর আনন্দ দেখলে সব দুঃখ আড়াল করে রাখতে পারি। ও কাছে না থাকলে দুঃখ আবার ফিরে আসে।
আশিকা ক্ষণিকের জন্য চোখ বন্ধ করে। ভাবে, রাস্তার চেনাছবি এই মুহূর্তে দেখার দরকার নাই। বাবা বলেছিলেন, আমার বন্ধু আমাকে বলেছিল, বান্দরবানের চিম্বুক-থানচি সড়কটি নির্মাণ করেছিল সেনাবাহিনীর সতেরো ইঞ্জিনিয়ার কনস্ট্রাকশন ব্যাটেলিয়ন। এই সড়কের কাপ্রুপাড়া এলাকায় নিরাপত্তা চৌকি হিসেবে প্রথমে এটা বানানো হয়েছিল। পরবর্তী সময়ে এটা পর্যটন কেন্দ্র হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়।
হামিদা বানু সঙ্গে সঙ্গে বলেছিল, ভালোই হয়েছে গো, এজন্য আমরা যেতে পারছি। নইলে তো যেতে পারতাম না।
আশিকা চোখ খুলে সামনে তাকায়। ঘাড় কাত করে আকাশ দেখে। যেন ও নীলগিরি পর্যটন কেন্দ্রে দাঁড়িয়ে আকাশ দেখছে। পাহাড়ের নিচ দিয়ে বয়ে যাচ্ছে বঙ্গোপসাগর। সমুদ্র থেকে পাহাড়ের উচ্চতা দুই হাজার দুশো ফুট। এক অসাধারণ প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে ভরপুর এলাকাটা। ওপরে আকাশ, মাঝখানে পাহাড়, নিচে সমুদ্র। বাবা-মায়ের হাত ধরে দাঁড়িয়ে থেকে ও চিৎকার করে বলেছিল, আমার বাংলাদেশ দেখা তোমরা পূর্ণ করলে আব্বা-আম্মু।
আতিকুর রহমান মেয়ের মাথায় হাত রেখে বলেছিল, আমাদের দেশে সাতান্নটি আদিবাসী নৃতাত্ত্বিক জনগোষ্ঠী আছে। এ-বিষয়টিও তুমি ভালোবেসে জানবে।
– এই এলাকাটা কোন আদিবাসীদের আব্বু?
– এখানে ম্রো জনগোষ্ঠী বেশি সংখ্যায় বাস করে। আমাদের সব জনগোষ্ঠীর সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্য ভিন্ন। প্রত্যেক জনগোষ্ঠীর উৎসব-আনন্দ দেখলে তোর মনে ভরে যাবে আশিকা। এই সাংস্কৃতিক উৎসব আমাদের দেশের বৈচিত্র্য বাড়িয়েছে।
আতিকুর রহমান আরো বলে, এই এলাকার নদীর নাম সাঙ্গু নদী। ছোট ছোট পাহাড়ের গা-ঘেঁষে বয়ে গেছে সাঙ্গু নদী। আমরা একবার এই নদী পথে থানচি যাবরে আশিকা। দেখবি কত নয়নভরা দৃশ্য। তোর জন্যই আমি এসব খোঁজখবর করেছি।
আশিকা বসে পড়ে বাবা-মায়ের পায়ে মাথা ঠেকায়। হামিদা বানু দু-হাতে ওকে বুকে টেনে নেয়। আশিকা দুজনের দিকে তাকিয়ে বলে, তোমরা আমার জীবনকে ধন্য করে দিয়েছ। যতদিন বেঁচে থাকব তোমাদের ভালোবাসা আমার বঙ্গোপসাগর হয়ে থাকবে। নিজেকে জীবনভর সমুদ্রের পাড়ে দাঁড় করিয়ে রাখব।
আতিকুর রহমান বলে, আবার আসব তোকে নিয়ে। এবার আমরা রাঙামাটির সাজেক ভ্যালিতে যাব। ওটাই আমাদের শেষ সীমান্ত। তারপরে ইন্ডিয়া।
– এখানকার কটেজগুলোর নাম খুব সুন্দর আব্বা।
হামিদা বানু বলে, হ্যাঁ রে, ঠিক বলেছিস।
আশিকা মুখস্থের মতো বলতে থাকে, যেমন মেঘদূত, আকাশলীনা, নীলাঙ্গনা, মারমা হাউজ। আমরা যেটায় আছি এটার নাম আকাশলীনা। আমি তো এই কটেজে ঢোকার সময় নাম দেখে মন ভরে গিয়েছিল। ভেবেছিলাম, এই নাম ধরে একটা গান বানাব।
হামিদা বানু উৎফুল্ল কণ্ঠে বলে, বানিয়ে ফেল। আমরা তিনজনে তোর সঙ্গে গান গাইব। পাহাড় থেকে নামতে নামতে সমুদ্রের ধারে যাব।
– না গো মা, পারব না। মাথায় আসে না। ইচ্ছা হলেই যদি সব পারতাম তাহলে তো –
আশিকা কথা শেষ করে না।
আতিকুর রহমান হাসতে হাসতে বলে, তুই আমাদের আনন্দ খেয়ে ফেললি মা।
– না, বাবা, তোমরা সবাই সাগর, নদী, আকাশ, পাহাড়ের দিকে তাকিয়ে থাক দেখবে গান ভেসে আসছে। এখানে দাঁড়িয়ে প্রকৃতির গান শোন বাবা। মানুষের কণ্ঠের গান না।
– ঠিক বলেছিস মা। দ্যাখ দ্যাখ আকাশে রঙধনু দেখা যাচ্ছে।
– রঙধনুর দিকে তুমি তাকিয়ে থাক। শোন সাতরঙের গান।
মেয়ের কথায় হা-হা করে হাসে আতিকুর রহমান। বলে, আমার বন্ধু বলেছিল, রোদ, বৃষ্টি, আকাশের পেঁজা তুলোর মতো মেঘ, সেইসঙ্গে রঙধনুর রঙের সোনালি দৃশ্য, কখনো মেঘের গর্জন – সব মিলিয়ে প্রকৃতির নানা দৃশ্য দেখে মোহিত হয়ে যাবি। পাখিদের ওড়াউড়ি, বিচিত্র ডাকাডাকি সব মিলিয়ে বেঁচে থাকার অনুভব গভীর হয়ে যাবে। মনে হবে এখান থেকে ফিরব না।
আতিকুর রহমান হাসলে হামিদা বানু বলে, তোমার বন্ধু ঠিকই বলেছে। ভাগ্যিস তোমার বন্ধুর কথা মনে করে এসেছ।
আমার আর আশিকার তিনদিন ধন্য হয়ে গেছে। আমরা কখনো নীলগিরিতে পাওয়া আনন্দ ভুলব না।
আতিকুর রহমান বলে, হ্যাঁ, ভুলব না।
– আমরা আবার আসব বাবা।
– হ্যাঁ, আসব। আসতেই হবে।
আশিকা দু-হাতে তালি বাজায়। স্লোগানের মতো বলতে থাকে, বাবা বাবা, জয়তু বাবা। আমি এখানে আরো দুদিন থাকতে চাই বাবা। কাপ্রুপাড়ায় ঘুরে ঘুরে ম্রো মেয়েদের সঙ্গে আড্ডা দেব। পারব আরো দুদিন থাকতে?
– না রে, পারব না। আমি তো তিনদিনের বুকিং দিয়েছিলাম। এখানে আসতে হলে আগাম বুকিং দিতে হয়। এই তিনদিনে দেখছিস তো দেশি-বিদেশি পর্যটকে ভিড় হয়ে আছে এলাকা।
– হ্যাঁ, ঠিক বাবা। ঠিক আছে আমরা চলে যাব। প্রকৃতি দেখতে এত মগ্ন ছিলাম যে মানুষের কথা মনে হয়নি। প্রকৃতি দেখার আনন্দের পরে মানুষের কথা মনে হলো। ম্রো জনগোষ্ঠী কীভাবে জীবন কাটায় তা বুঝতে চেয়েছিলাম।
– এবার হলো না। আমরা আবার আসব রে। মন খারাপ করিস না।
– ঠিক আছে বাবা। আমরা আবার আসব।
এই ভাবনার সঙ্গে সঙ্গে রিকশার হুড ফেলে দিয়ে মাথা সোজা করে বসে আশিকা। নীলগিরির স্মৃতি ওকে মুগ্ধতার আমেজে ভরিয়ে রাখে। চারপাশের ঘরবাড়ি, গাড়ি, রিকশার দিকে তাকিয়ে থাকলেও শহর ওর মনোলোকে ধরা পড়ে না। ওর বাড়ির কাছাকাছি এসে গেছে। আর দুই মিনিটে নামতে হবে।
নিজের বাড়ির সামনে রিকশা থামলে ভাড়া মেটায় ও। বাড়ির সামনে বারান্দায় উঠে বেল বাজায়। দরজা খুলে দেয় হামিদা বানু।
– কী রে ক্লাস করেছিস? বেশ তাড়াতাড়ি চলে এসেছিস। ভালোই করেছিস।
– হ্যাঁ মা। ক্লাস করেই তো এলাম। বিশ্ববিদ্যালয়ে গিয়ে ক্লাস ফাঁকি দেব এটা আমি ভাবতে পারি না। কখনো ক্লাস মিস করি না।
– বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা দিসনি? এটা তো তোর নেশা।
– দিয়েছি। ওরা আমাকে বান্দরবানে যাবার দিন ঠিক করার কথা বলেছে। যাদের সঙ্গে বান্দরবান যাব ঠিক করেছি ওরা সবাই ছিল।
– ও আচ্ছা। প্রোগ্রাম ঠিকঠাক করে ফেলেছিস।
আশিকা মুখে কিছু না বলে মাথা কাত করে সায় দেয়। হামিদা বানু হাসিমুখে তাকিয়ে থাকে মেয়ের দিকে। মুখে কিছু বলে না।
– আব্বা এসেছেন? আব্বার সাড়াশব্দ পাচ্ছি না।
– এখনো আসেনি। আমরা তো সন্ধ্যায় খেতে যাব। তাড়াহুড়োর কিছু নাই। তুই দুপুরে তো কিছু খাসনি। হাতমুখ ধুয়ে টেবিলে আয়। যা, ঘরে যা।
– আমরা সবাই মিলে বাদাম খেয়েছি মা।
– বাদাম তো শখের খাবার। ওতে কি পেট ভরে?
– পেট ভরে না মা। কিন্তু আমার এখন ভাত খাওয়ার ইচ্ছে হচ্ছে না। ফ্রিজে যে গাজরের হালুয়া আছে সেটা খাব।
– নুডলস করেছি। সেটাও খেয়ে নে।
– ওয়াও, এই দিয়ে আমার পেট ভরে যাবে। এসব তো মায়ের রান্নার মায়াবী খাবার।
– বলতেও পারিস কথা। মা গো তোর কথা শুনে আমার প্রাণ জুড়ায়। দুঃখ ভোলে।
আশিকা মাকে জড়িয়ে ধরে কপালে চুমু দেয়। বেশ কিছুক্ষণ জড়িয়ে ধরে রাখে। আদরে আদরে ভরিয়ে দেয় কিছুটা সময়। হামিদা বানুও মেয়েকে জড়িয়ে ধরে রাখে। ছাড়তে চায় না মেয়েকে। পরস্পরের ধারণায় দুজনে মিলে এক হয়ে গেছে। এ-সময় হামিদা বানু বলে, আয়, খেতে আয়।
– তোমাকে ছাড়তে আমার মন চায় না। মনে হচ্ছিল, তুমি আর আমি মিলে একজন হয়ে গেছি।
– ওরে আমার সোনা মেয়েরে। আয় খেয়ে নে।
– আচ্ছা মা, কাপড় বদলে আসছি।
আশিকা নিজের ঘরে গিয়ে ঢোকে।
রাতে চায়নিজ রেস্টুরেন্টে খেতে আসে সবাই। ওর বাবা আতিকুর রহমান সরকারি কর্মকর্তা। নিজেও ঘুরতে ভালোবাসে। আশিকা কোথাও যেতে চাইলে না করে না। বলে, ভ্রমণ এক ধরনের শিক্ষা। এই শিক্ষা থেকে ছেলেমেয়েদের বঞ্চিত করা ঠিক না।
আশিকা বাবা-মায়ের দিকে তাকিয়ে কৃতজ্ঞ বোধ করে। আতিকুর রহমান মেয়েকে বলে, কী রে কী খাবি, অর্ডার দে।
আশিকা মেন্যুর দিকে তাকিয়ে পছন্দের খাবারের কথা বলে বেয়ারাকে। ও লিখে নিয়ে গেলে আশিকা মা-বাবার দিকে তাকিয়ে বলে, আমি কি ঠিক ঠিক আইটেমের কথা বলেছি?
– হ্যাঁ, বলেছিস। তুই তো জানিস আমাদের প্রিয় খাবারের কথা। তবে ডেজার্ট খাব কী সেটা তো বললি না।
– আমরা তো ভ্যানিলা আইসক্রিম খাব আব্বা। ছেলেটি এলে বলে দেব। আগে তো স্যুপ দিয়ে যাক। আমি তো জানি স্যুপ মায়ের সবচেয়ে বেশি পছন্দ।
– হ্যাঁ, তাই তো। চায়নিজ খাবার খেতে এলে আমি স্যুপ খেয়ে পেট ভরাতে চাই।
শব্দ করে হেসে ওঠে আশিকা। হাসে আতিকুরও। হাসতে হাসতে বলে, তোর মা নিজেও কিন্তু ভালো স্যুপ রান্না করে। আমি তো খেয়ে পেট ভরিয়ে ফেলি। তারপর বাইরে আসি খাবারের টেস্ট বদলের জন্য।
– এটাও খুব দরকার আব্বা। বাইরে খেতে এলে আমার দিন অন্যরকম হয়ে যায়। মনে হয় দিন বদলের পালা। বাইরের খাবার খেয়ে দিনের সঙ্গে ভিন্নরকম বন্ধুত্ব করি।
– আমরা তো এসেছি তোর ভ্রমণ সেলিব্রেট করতে। এটা না করলে আমার মন খারাপ হয়।
– আমি তা জানি আব্বা। তুমি আমাকে টাকা দাও। ঘোরাঘুরিকে শিক্ষা বল। দেশ দেখা বল। দেশকে ভালোবাসতে বল। জীবনের বিনিময়ে ভালোবাসা। তুমি আমাকে মুক্তিযুদ্ধের কথা বল। লাখ লাখ মানুষ দেশের স্বাধীনতার জন্য জীবন উৎসর্গ করে যুদ্ধ করেছিল। তুমি নিজেও বীর মুক্তিযোদ্ধা। আর আমার জন্ম স্বাধীনতার পরে। এভাবেই মানুষ দেশের জন্য জীবন দেয়। তোমার কাছে মুক্তিযুদ্ধের কথা শুনে মনে হয়, ইস্! আমি যদি তখন যুদ্ধ করার বয়সে থাকতাম তাহলে আমিও যুদ্ধ করতাম।
বাবা-মা দুজনেই মেয়ের দিকে তাকিয়ে হাসে। হামিদা বানু হাসতে হাসতে বলে, তোর এত সাহস রে মেয়ে? আমি তো তোর বয়সী ছিলাম তখন। আমি কিন্তু যুদ্ধের কথা ভাবিনি।
– কেন মা? ভাবনি কেন?
– থাক, এসব কথা না বলাই ভালো। পাকিস্তানি সেনাদের আমি খুব ভয় পেতাম।
আতিকুর রহমান বলে, বঙ্গবন্ধুর দেশের জন্য ভালোবাসা দেখে আমি শিক্ষা নিয়েছিলাম। এমন করে দেশকে যিনি ভালোবাসতে পারেন, তিনি জাতির মাথার ওপর থাকবেন। অর্থাৎ জীবনের বিনিময়ে ভালোবাসা।
– হ্যাঁ, অবশ্যই জীবনের বিনিময়ে ভালোবাসা। দেশের কোনো বড় ধরনের সংকট হলে সর্বশক্তি দিয়ে রুখতে হবে।
হামিদা বানু নীরবে কথা শোনে। মাথা নাড়ায়। সে-সময় বেয়ারা স্যুপ নিয়ে আসে। হামিদা বানু সবার বাটিতে স্যুপ দেয়। আশিকা চামচে স্যুপ তুলে বলে, চিয়ার্স।
আতিকুর আর হামিদা বানু দুজনেও চিয়ার্স বলে।
স্যুপ খাওয়া হলে ফ্রাইড রাইস আসে। মিক্সড ভেজিটেবল ও ফ্রাইড চিকেন আসে। এবার আশিকা সবার প্লেটে রাইস তুলে দেয়। যে যার মতো ফ্রাইড চিকেনের টুকরো নেয়। আশিকা ভাবে, এ যেন স্বপ্নের ভুবন। বেঁচে থাকার সত্যকে রঙিন করে রাখা। বাবা-মা দুজনই ওকে এমন নির্মল আনন্দে ভরিয়ে রেখেছে। আশিকা ওদের একমাত্র সন্তান। এই নিয়ে দুজনের মন খারাপ নেই। কখনো দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে না, আরো দু-একজন সন্তান হলে ভালো হতো।
– তোরা কি যাবার দিন ঠিক করেছিস রে?
– হ্যাঁ, আব্বা আমি আগামী এগারো তারিখ ঠিক করেছি। বাড়ি গিয়ে অন্যদের মেইল করে তারিখটা জানাব। সবাই যাবার জন্য প্রস্তুত আছে।
– ফিরবি কবে?
– পাঁচদিন থাকব। এর বেশি একদিনও না।
– থাকার জায়গা ঠিক হয়েছে?
– হ্যাঁ, হয়েছে। উপজেলায় একটি হোটেল পেয়েছি। আমি বুকিং দিয়েছি।
– বাহ্, সব তো বেশ গুছিয়ে ফেলেছিস। তুই পারিসও মা। তোর এসব গুণ আমার প্রাণ ভরিয়ে দেয়।
– মায়ের কাছ থেকে গুছিয়ে কাজ করা শিখেছি বাবা। তোমাকে ভেজিটেবল দিই।
– দে মা। তোর হাতে খাবার পাওয়া আমার অনেক বড় আনন্দ।
– আব্বা আমাকে অন্য চোখে দেখে। শুধু নিজের মেয়ে হিসেবে না।
হামিদা বানু স্যুপের চামচ মুখের কাছে নেওয়ার আগে বলে, তোকে তোর আব্বা কীভাবে দেখে বলত আমাকে।
আশিকা গম্ভীর স্বরে বলে, বাবা আমাকে একজন ব্যক্তি হিসেবে দেখে, যার কাছ থেকে আব্বা সবরকম সহযোগিতা পেতে চায়। শুধু মেয়ে বলে আমাকে আদর করে রাখে না।
– বাব্বা, এত বুঝিস! তোর বোঝার তো শেষ নেই রে মেয়ে।
– ওর বোঝাকে তো আমি স্যালুট করি হামিদা। তুমি ওর জন্ম দিয়ে আমাকে ধন্য করেছ।
– সেজন্যই তুমি শুধু ওর বাবা নও, মাথার ওপরের মানুষ। আমাকে তুই কীভাবে দেখিস রে মা?
– তুমি আমার বন্ধু মা গো। আমার প্রাণের মানুষ। তোমার সঙ্গে কথা বলা আমার একদিকে যেমন শেখার বিষয়, অন্যদিকে ভালো লাগার গভীরতা।
আতিকুর মেয়ের দিকে তাকিয়ে মুগ্ধ চোখে বলে, বাব্বা, এতকিছু! মেয়েটাকে বুঝতে আমাদের জ্ঞান লাগবে।
আশিকা শব্দ করে হেসে বলে, আব্বা তোমাদের ভালোবাসা পেয়ে শুধু বড় হইনি। ভালোবাসার সঙ্গে বড় হওয়ার স্বপ্ন পেয়েছি। আমার বড় হয়ে ওঠা পূর্ণ করে দিয়েছ তোমরা। আজকে বাড়ি ফেরার সময় শুধু নীলগিরি পাহাড়ের কথা মনে হয়েছিল।
হামিদা বানু বলে, সমুদ্রসৈকত দিয়ে হাঁটার কথা মনে হয়নি?
– সেটাও মনে আছে মা গো। টেকনাফ থেকে সমুদ্রসৈকত দিয়ে হেঁটে হেঁটে আমরা কক্সবাজারে এসেছিলাম। ওহ্ মা গো এ-যাত্রা কি ভোলার কথা।
– ঠিক বলেছিস, একদম ভোলার কথা না। আর বেশি কথা না, চল খাওয়া শেষ করি।
বাবা-মা দুজনে হাসিমুখে খাবারে মনোযোগী হয়। কাঁটাচমচ দিয়ে ভাত খাওয়ায় তারা অভ্যস্ত নয়, তবু নানা চেষ্টায় খেতে থাকে। রেস্তোরাঁয় তো হাত দিয়ে খাওয়া যাবে না। অন্য টেবিলের সবাই তো একইভাবে খাচ্ছে। নিজেদের প্রেস্টিজ রাখতে হবে। এভাবে খেতে আশিকা অভ্যস্ত। ওর কোনো ঝামেলা হয় না। তারপরও খাওয়া শেষ করে তিনজনে। প্লেট খালি হলে বেয়ারা এসে জিজ্ঞেস করে, ডেজার্ট লাগবে স্যার?
– লাগবে। ভ্যানিলা আইসক্রিম আন।
বেয়ারা চলে যায়। আতিকুর মেয়েকে বলে, কি রে ঠিক বলেছি? নাকি অন্যকিছু খাবি?
– না বাবা, ঠিক আছে। আমি তো আইসক্রিম ভালোবাসি।
– আমিও আইসক্রিম খাব। হামিদা বানু মাথা নেড়ে বলে। তিনজনে কোকের গ্লাসে চুমুক দেয়। কেউ কোনো কথা বলে না। নিশ্চুপ কেটে যায় কতক্ষণ। আইসক্রিম এলে তারা খেয়ে নিজেদের খাওয়ার পর্ব শেষ করে। বিল মিটিয়ে বেরিয়ে আসে। আশিকা গাড়িতে ওঠার আগে বাবা-মায়ের দিকে তাকিয়ে বলে, থ্যাংক ইউ আব্বা। থ্যাংক ইউ মা।
– এটা হলো তোর ভ্রমণের সেলিব্রেশন।
– বাবা তুমি এতকিছু করতে পার। আমি মাঝে মাঝে অবাক হই।
আতিকুর কিছু বলার আগে হামিদা বানু বলে, মাঝে মাঝে এমন সময় কাটানো খুব দরকার গো। দিনগুলো ভরে যায়। তুমি যে আমাদের মাঝে মাঝে বাইরে খেতে নিয়ে আস এটা তোমার খুব ভালো ভাবনা।
– তোমাদের ভালো লাগা তো আমার আনন্দ গো। এতে পরিবারের ভালোবাসার বন্ধন দৃঢ় হয়। তুমিও তো আমাদের জন্য নানা খাবার রান্না কর। স্কুলে চাকরির পরে থাকে আরো কাজ। খাতা দেখা থেকে শুরু করে নানা কিছু। এত কাজের পরেও তুমি রান্নাঘরের দরজা বন্ধ করে রাখ না।
– হয়েছে, চলো আমরা যাই। মেয়েটা কয়দিন বাড়িতে থাকবে না, তার জন্য আমাদের মন খারাপ থাকবে।
– না মা, আমি তো সবসময় বলি তোমরা মন খারাপ করবে না। মনে করবে আমি শেখার স্কুলে গিয়েছি। তোমরা আমার ফিরে আসার অপেক্ষায় আছ।
– হয়েছে অনেক কথা। এখন চল।
গাড়িতে ওঠে তিনজন। রাস্তায় প্রবল যানজট। রাত বাড়ে। রাস্তা খালি হয় না। বাড়ি ফিরতে ফিরতে রাত হয়ে যায়। বেশ রাতে বাড়ি ফিরে যে যার ঘরে ঢুকলে আশিকার মনে হয় তারাভরা রাতের আকাশ নেমে এসেছে ওর ঘরে। এ-রাত তো শুধু রাত নয়। এ-রাত পারিবারিক বন্ধনকে আকাশ করার রাত। নইলে বেঁচে থাকা কঠিন হয়।
আশিকা ঘুমানোর প্রয়োজন মনে করে না। কেবলই ভাবে, শরীরটা পাখি হয়ে আকাশে উড়ছে। ওটা উড়তে চায়। বিছানাকে গাছের ডাল ভেবে বসতে চায় না। দিগন্তের কাছে পৌঁছালে শরীরে মনে দিগন্তজোড়া শান্তি হবে। ও হেসে গড়িয়ে পড়ে। ঘরের ভেতরে ঘুরতে ঘুরতে হাসে। হাসির তোড়ে ভালো লাগার জায়গায় রঙিন ফানুস ওড়ে। শুনতে পায় দরজায় টুকটুক শব্দ। দরজা খুললে দেখতে পায় বাবা-মা দুজনেই দাঁড়িয়ে আছে।
– কি রে একা একা হাসছিস কেন? কী ভাবছিস রে?
– আমার মনে হচ্ছে আমি একটা পাখি হয়ে আকাশে উড়ছি। সেজন্য আমার ঘুম আসছে না।
বাবা-মা দুজনে হা-হা করে হাসে। হাসির দমকে ভেসে যায় পুরো বাড়ি।
আতিকুর বলে, আমার বাড়িতে এমন হাসির জোয়ার আছে ভাবতেই আমার বুক ভরে যাচ্ছে রে ময়নাপাখি।
হামিদা বানু সঙ্গে সঙ্গে বলে, ওরে আমার টুনটুনি। বিছানায় শুয়ে দেখ ঘুম আসবে।
– আমি তোমাদের ময়নাপাখি আর টুনটুনি।
– না, শুধু দুইটা পাখি না। তুই আমাদের সব পাখি।
– আমি কাক হব না, শকুন হব না।
হামিদা বানু ওর মাথায় হাত রেখে বলে, না, না, এসব নামে ডাকব না তোকে। এখন থেকে অনেক পাখির নাম শিখব।
সুন্দর সুন্দর নাম।
আশিকা প্রথমে মাকে জড়িয়ে ধরে। পরে বাবাকে জড়িয়ে ধরে বুকে মাথা রেখে বলে, তোমরা আমার মাথায় হাত রাখ। তাহলে আমার ঘুম আসবে।
দুজনে মাথায় হাত রেখে মিনিট পাঁচেক জড়িয়ে রাখে মেয়েকে। তারপর বলে, যা শুয়ে পড়। অনেক রাত হয়েছে।
আবার ঘরের দরজা বন্ধ করে আশিকা। টেবিলে বসে কম্পিউটার খোলে। বন্ধুদের মেইল করে তারিখটা জানায়। পাশাপাশি লেখে, শুভযাত্রার জন্য সবাইকে অভিনন্দন। আমাদের জয়যাত্রায় নন্দিত হোক পাহাড়ি পথ। অচেনাকে চেনার দৃষ্টি খুলে যাক আমাদের। আমাদের মাথার ওপর বিছিয়ে থাকুক বনরাজির সবুজ ছায়া।
ওদের কাছে ই-মেইল পাঠিয়ে বিছানায় গেলে ঘুমে চোখ জড়িয়ে আসে আশিকার। পরক্ষণে ঘুম কেটে যায়। চোখ বড় করে তাকালে মশারির চারপাশে দৃষ্টি ঘুরে বেড়ায়। মনে হয় মশারির চারদিকে জমে উঠেছে কক্সবাজারের সমুদ্রসৈকত। বাবা-মায়ের সঙ্গে ঘুরতে যাওয়া সেই দৃশ্য আবার স্মৃতির বালুকাবেলায় ভেসে ওঠে। টেকনাফ থেকে কক্সবাজার পর্যন্ত সমুদ্রের সৈকত দিয়ে হেঁটে যাওয়া এক অসাধারণ অ্যাডভেঞ্চার। ভাবতে গেলে আশিকার ঘুম উধাও হয়ে যায়। ঘুমের রেশও থাকে না।
আশিকার খালাতো ভাই বাবুল ওর কয়েকজন বন্ধু-বান্ধবী নিয়ে এমন একটি প্রোগ্রাম করেছিল যে, টেকনাফ থেকে সমুদ্রসৈকতে হেঁটে কক্সবাজার যাবে। দেখবে সমুদ্রের নানা দৃশ্য। এ-কথা শুনে ওর মা নূরবানু উচ্ছ্বসিত হয়ে বলেছিল, দারুণ প্রোগ্রাম করেছিস। তোদের সঙ্গে আমি আর তোদের বাবাও যাব।
– হ্যাঁ, মা চলো চলো। জীবনের এমন আনন্দ পেতে –
– শুধু আনন্দ না রে ছেলে, এমন একটি ভ্রমণ করতে পারলে আমার জীবন ধন্য হবে।
– হাঁটতে পারবে তো মা? কষ্ট হবে না।
– হাঁটতে পারব। কষ্ট একটু হতে পারে। সেজন্য ভেবেছি বড় একটা চাদর নিয়ে যাব। কষ্ট লাগলে বালুর ওপর চাদর বিছিয়ে কিছ্ক্ষুণ শুয়ে থাকব। আবার উঠে হাঁটতে শুরু করব।
– সমুদ্রসৈকতে অনেক পাথর আছে। বসতে চাইলে পা মেলে বসে থাকতে পারবে।
– আহারে সোনা, এমন বেড়ানো জীবনে পাইনি। আমি হামিদা বুবুর কাছে যাব। দেখি সে যেতে চায় কি না।
– আশিকা তো লাফালাফি করবে যাওয়ার জন্য। ওকে তো তুমি চেন।
– হ্যাঁ, চিনব না কেন? আমি তো এটাও ভাবি যে, ওর মতো মেয়ে দুটো হয় না। আমার জন্য একটা রিকশা ডাক। আমি এখনই বের হব।
বাবুল রিকশা ডেকে আনলে নূরবানু বোনের বাসায় চলে আসে। আশিকা বাসায় নেই। হামিদা বানু দরজা খোলে।
– কেমন আছিস বুবু?
– ভালোই আছি।
– তোর জন্য একটা সুন্দর খবর নিয়ে এসেছি।
– বল, বল। ভেতরে আয়।
– ভেতরে আর ঢুকব না। আমাকে তাড়াতাড়ি যেতে হবে।
– তাহলে কী বলবি বলে ফেল?
– আমরা ঠিক করেছি টেকনাফ থেকে কক্সবাজার পর্যন্ত হেঁটে যাব সমুদ্রসৈকত দিয়ে। তুই কি যাবি?
– যাব, যাব। দারুণ ভ্রমণ হবে। কবে যাবি?
– বুবু ডেট ঠিক করে এসে তোকে আবার জানাব। দুলাভাই, আশিকা যাবে?
– হ্যাঁ, সবাই যাবে। এমন ভ্রমণ জীবনে আর কি পাব?
– ঠিক আছে, তাহলে আমি যাই।
নূরবানু যে রিকশায় এসেছিল সে রিকশায় উঠে পড়ে। তাড়াতাড়ি যেতে হবে দেখে রিকশা ছেড়ে দেয়নি।
মায়ের কাছ থেকে শোনা খবরটি আশিকা একটুও ভোলেনি। ভ্রমণের কোনো কিছু হলেই তা ওর স্মৃতির পাতায় ভাসতে থাকে। নীল-সবুজের রঙে জ্বলজ্বল করে। কখনো তা হারিয়ে যায় না। আজো চোখের সামনে ভেসে ওঠে সেদিনের দৃশ্যপট। প্রায় ত্রিশজন সঙ্গী গিয়েছিল সেখানে। যে এই ভ্রমণের কথা শুনেছে তার আগ্রহের সীমা ছিল না। যেজন্য সংখ্যা এত বেড়েছিল। এত বেশি নারী-পুরুষ দেখে আশিকার প্রথমে মন খারাপ হয়েছিল। কিন্তু হামিদা বানু যখন বলল, এত লম্বা পথ হাঁটা তো সহজ কথা না। বেশি লোক থাকলে ভালো হবে। যদি কোনো বিপদ-আপদ হয় সবাই মিলে সাহায্য করব। ধর, হাঁটতে হাঁটতে কেউ একজন পড়ে গিয়ে জ্ঞান হারাল তখন একজন-দুজন থাকলে এইসব অবস্থা সামাল দেওয়া কষ্টকর হয়। সেজন্য যারা যারা যেতে চেয়েছে আমি কাউকে না বলিনি। নূরবানুও তাই করেছে।
– আচ্ছা মা ঠিক আছে। এটা আমার একদম অন্যরকম ভ্রমণ হবে। সাগরের পাশ দিয়ে হেঁটে যাব, চিন্তা করলেই মাথায় ফুর্তি ভরে যায়। হাঁটতে তোমার কোনো কষ্ট হলে তুমি আমাকে বলবে।
– দেখা যাবে। সবকিছু গুছিয়ে নে।
– তোমার জন্য বড় চাদরটা নেব তো?
– হ্যাঁ নিবি।
অশিকা হাসতে হাসতে বলে, তোমার সঙ্গে আমিও শুয়ে থাকব মা। আমার ইচ্ছা মাটিতে কান পেতে রাখলে পানির কলকল ধ্বনি আমার কানে ঢুকবে। জানো আমি খোঁজ নিয়েছি যে টেকনাফ থেকে কক্সবাজার পর্যন্ত সৈকত পঁচাত্তর থেকে আশি কিলোমিটার।
– এত কথা বলে আমাকে ভয় দেখাস না। আমি যাবই। তোর বাবাও সঙ্গে
থাকবে।
– তোমাকে ভয় দেখাব কেন মা? তোমার মানসিক প্রস্তুতির জন্য বললাম। শুনে তুমি আনন্দ পেলে না?
– হ্যাঁ, পেয়েছি রে।
– আমরা হাঁটতে হাঁটতে একদিকে সমুদ্র দেখব, আর একদিকে পাহাড় আর বনরাজি দেখব। আমাদের আনন্দের সীমা থাকবে না।
– হ্যাঁ, ঠিকই, বুকভরা আনন্দ পাব। যা তিনটা ছোট ব্যাগ গুছিয়ে ফেল।
আশিকা তালি বাজাতে বাজাতে নিজের ঘরে যায়। ঘরের মেঝেতে দাঁড়িয়ে নিজেকে বলে, জীবনের আনন্দ এভাবে বেঁচে থাকার সৌরভ হয়।
বাবুল তিরিশজনের জন্য এক বাসে টিকেট কাটে। এই যাত্রার জন্য আরো পাঁচদিন অপেক্ষা করতে হবে। নইলে এক বাসে একসঙ্গে এতগুলো টিকিট পাওয়া যাচ্ছিল না। পাঁচদিন বসে থাকতে হবে শুনে আশিকার ছটফটি বাড়ে। একবার ভাবে, ও একাই চলে যাবে টেকনাফ। ওখানে গিয়ে অপেক্ষা করবে। শাহপরি দ্বীপে ঘুরে বেড়াবে। শাহপরি দ্বীপ দেশের শেষ ভূখণ্ড, তারপর সমুদ্রের শুরু। পরে ভাবে, না থাক, দরকার নেই। এতবড় একটা দলে যোগ দিয়ে ঘুরে বেড়ানোর আনন্দ অন্যরকম হবে। বান্ধবী শীলা যোগ দিয়েছে। ওর সঙ্গে নানামুখী আড্ডায় সময় কাটবে।
তারপর নির্দিষ্ট দিনে যাত্রা শুরু হয়েছিল। তুমুল হাসিতে, গল্প-কথায় ভরে গিয়েছিল বাসের যাত্রা। আশিকা এমন একটি বাস-যাত্রা এর আগে পায়নি। কতবারই তো কতদিকে গেছে। এবারই এত মানুষ একসঙ্গে যুক্ত হয়েছে। ভালো লাগছে ভাবতে যে এ এক ব্যতিক্রমী যাত্রা। মনে মনে বলে, বাবুল তোর কাছে আমি কৃতজ্ঞ।
বিকেলে টেকনাফ পৌঁছে যায় বাস। যে যার হোটেলে চলে যায়। ঠিক করা আছে যে হোটেলে সকালের নাস্তা খেয়ে সবাই চলে আসবে সৈকতে। আশিকা মা-বাবাকে তাড়া দিয়ে রেডি হয়। সমুদ্রসৈকতে তখনো কেউ আসেনি, ওরাই সবার আগে এসেছে। আশিকা মাকে বলে, মা আমি একটু দৌড়াদৌড়ি করি।
আতিকুর রহমান সঙ্গে সঙ্গে বলে, না রে মা আগেই দৌড়াদৌড়ি করবি না। টায়ার্ড হয়ে যাবি। অনেকটা পথ তো হাঁটতে হবে।
– টায়ার্ড হব না বাবা। একটু যাই?
হামিদা বানু শান্ত কণ্ঠে বলে, না রে মা, তুই আমাদের কাছে থাক। তুই দূরে গেলে আমার মন খারাপ হবে।
– তাহলে তো যাবই না। চলো সমুদ্রে পা ভেজাই।
আশিকা বাবা-মায়ের হাত ধরে পানির ধারে গিয়ে দাঁড়ায়। জোয়ারের জলে তিনজনই দাঁড়িয়ে থাকে। ঢেউ এসে পায়ে গড়ায়। ধাক্কা লাগে, যেন পানির সঙ্গে বৈরী পরিবেশ তৈরি হয়েছে। ঢেউ যেন বলতে চায়, নেমে আস আরো ভেতরে। ডুবে যাও সমুদ্রে। দেখ সমুদ্র কীভাবে তোমাকে নীল আকাশ ছুঁইয়ে দেবে। আশিকা নিজের ভাবনায় মগ্ন হয়ে তাকিয়ে থাকে বিস্তৃত পটভূমিতে। এমন দৃশ্য আগে কখনো সমুদ্রে পা ডুবিয়ে রেখে দেখা হয়নি। বাবা-মা দুজনে তাকিয়ে আছে ওর দিকে।
হামিদা বানু আতিকুরকে বলে, আশিকাকে পরির মতো লাগছে। মনে হচ্ছে সমুদ্রকে কোলে উঠিয়ে নিয়ে ও বাড়ি যাবে। পাড়ে গিয়ে বলবে, ওরে সাগর তোকে নিয়ে আমি ঘরে যাব।
আতিকুর হো-হো করে হসে। হাসতে হাসতে বলে, তুমিও মেয়েটার মতো পরি হয়ে যাচ্ছ।
– আমি তো পরি না, আমি পেত্নি।
– তাহলে আমি কি ভূত?
– তাই তো, ভূতই হবে।
দুজনে খলবলিয়ে হাসতে থাকে। আশিকা তাকিয়ে থাকে বাবা-মায়ের দিকে। বুঝতে পারে না বাবা-মায়ের হাসির উৎস কী। ওকে নিয়ে নয়তো? হতেও পারে। দেখতে পায় ওদের যাত্রাসঙ্গীরা সবাই বেরিয়ে এসেছে।
ওরা এদিক-ওদিক দৌড়াচ্ছে। আশিকা পানি থেকে উঠে আসে। ফিসফিসিয়ে মাকে বলে, আমি সমুদ্রের প্রেমে পড়েছি।
হামিদা বানু রূঢ় কণ্ঠে বলে, কোনো লাভ হবে না। উঠে আয় পানি থেকে।
– তুমি আমার সঙ্গে রাগ করছ কেন মা?
হামিদা বানু ওর কথার উত্তর না দিয়ে সরে আসে। সঙ্গের যাত্রীরা ওদের কাছাকাছি পৌঁছে গেছে।
নূরবানু বলে, কী রে বুবু তুই এত ভোরে বের হয়ে আসলি?
– আসব না কেন? সমুদ্র দেখতে এসে হোটেলের ঘরে বসে থাকব? ঘর তো জীবনভরই দেখতে হবে। ইচ্ছা করলেই তো সমুদ্র দেখতে পারব না।
চারদিক থেকে একসঙ্গে অনেকে বলে, ঠিক বলেছেন। দারুণ কথা। আমাদের সবার জীবনের কথা।
তুমুল তালি বাজায় সবাই।
– চলেন, যাত্রা শুরু হোক আমাদের।
আশিকা মায়ের পাশে দাঁড়িয়ে বলে, আমরা পঁচিশ কিলোমিটার হাঁটলে শিলখালি বাহারছড়া গ্রামে পৌঁছে যাব। ওখানে ইউনিয়ন পরিষদের অফিস আছে, রেস্ট করা যাবে। চমৎকার একটি রেস্তোরাঁও আছে। চলেন আমরা হাঁটতে শুরু করি। শুরু হয় যাত্রা। এদিকে-ওদিকে ঘুরে ঘুরে সবাই আনন্দ নিয়ে হেসে-গেয়ে যাচ্ছে। আশিকার মনে হয়, এইভাবে সৈকতের পথে হাঁটা শুধু হাঁটা না, একই সঙ্গে উড়ে যাওয়াও। ও সবার দিকে তাকিয়ে দেখতে পায় আনন্দের উচ্ছ্বাস। শীলা এসে ওর হাত ধরে বলে, আমার খুব ইচ্ছা হচ্ছে মাঝে মাঝে বনের মধ্যে ঢুকতে। আশিকা সঙ্গে সঙ্গে সায় দেয়।
– চলো আমরা ঢুকে পড়ি। পাহাড়ের পাশ দিয়ে কিছুদূর হেঁটে আবার চলে আসব সৈকতে। ভালোই লাগবে। বন আর সমুদ্র – বন আর সমুদ্র – সুর মিলিয়ে গানের মতো উচ্চারণ করতে থাকে আশিকা।
শীলা বলে, হয়েছে আর গান গাইতে হবে না। চল দৌড়াই। দুজনে দৌড় দিয়ে বনে ঢুকে পড়ে। ওদের পেছনে আরো চার-পাঁচজন আসে।
বাবুল বলে, বনের মধ্যে আমাদের সাবধানে হাঁটতে হবে। চারদিকে অনেক বন্যপ্রাণী আছে।
আশিকা চেঁচিয়ে বলে, আমরা বন্যপ্রাণীর খবর জানি। বন ওদের এলাকা। সেজন্য আমরা বেশি ভেতরে যাব না।
– তাহলে চলো চারপাশে ঘুরেটুরে বেরিয়ে যাই।
– না, বনের ভেতর দিয়ে আমরা সামনের দিকে এগোব। তাহলে সবার সঙ্গে থাকা হবে।
শীলা উচ্ছ্বসিত হয়ে বলে, ঠিক বলেছিস আশিকা। আমাদের বনও দেখা হবে, দলের সঙ্গেও থাকা হবে।
বাবুল হাসিতে মেতে ওঠে। হাসতে হাসতে বলে, চলো আমরা সবাই মিলে একটা গান করি।
– কী গান, আমাদের তো মুখস্থ নাই।
– মুখস্থ লাগবে না, আমি গাইব তোমরাও আমার গান ধরে গাইবে।
– তোমাকে আমাদের অভিনন্দন বাবুল ভাই। এমন একটি প্রোগ্রামের আয়োজক তুমি।
– আশিকা আমি তো জানি এমন প্রোগ্রাম তোমার নেশা। তুমি না হলে এ-প্রোগ্রাম হতো না।
– থাক হয়েছে, আর বলতে হবে না। চলো এগোই।
সৈকতের পাশে বন তেমন ঘন নয়। সহজে হাঁটা যাচ্ছে। হঠাৎ করে একটা খেঁকশিয়াল দেখতে পায় বাবুল। হাত নেড়ে বলে, বন্ধু আমরা এসেছি। তুমি আমাদের সঙ্গে হাঁট। খুক-খুক করে আমাদের সঙ্গে গান গাইবে।
তুমুল হাসিতে সবাই ভরিয়ে ফেলে এলাকা। খেঁকশিয়াল দৌড় দিয়ে চলে যায় বনের ভেতরে। বাবুল বলে, আমাদের হাসিতে ও মজা পায়নি। ভয়ে পালিয়ে গেছে।
– তাহলে তুই যা ডেকে নিয়ে আয়। বলবি, ভয়ের কিছু নাই। তুই আয় আমাদের সঙ্গে।
– সমুদ্রের ধারে এসে তোদের মাথা খারাপ হয়ে গেছে দেখতে পাচ্ছি রে। থাক, আর ইয়ার্কি করতে হবে না। চল এগোই।
দুপদাপ পা ফেলে সবাই এগোয়। কখনো পড়ে থাকা শুকনো পাতা পায়ের নিচে মচমচ করে। মাথার ওপর দিয়ে উড়ে যায় পাখি। গাছের মাথায় বসে থেকে ডাকে।
– বেশ মজা লাগছে হাঁটতে।
তুহিন উৎফুল্ল হয়ে হাত তুলে ঘুরপাক খায়। তারপর এক দৌড়ে বনের ভেতরের দিকে চলে যায়। মাসুমও অন্যদিকে যায়।
আশিকা হাসতে হাসতে বলে, বনরাজিতে আমাদের ছোটাছুটি। দারুণ।
তখন ও শুনতে পায় বাবা ওর নাম ধরে চিৎকার করে ডাকছে। ও ঘাবড়ে গিয়ে একদৌড়ে সৈকতে নেমে আসে। বাবার কাছে গিয়ে দাঁড়ায়।
– তোর মা তোকে খুঁজছে?
– কী হয়েছে মায়ের?
– তেমন কিছু হয়নি। আমাদের তো আরো অনেকটা পথ হাঁটতে হবে। তোর মা কিছুক্ষণ রেস্ট করবে।
– হ্যাঁ, চলো চলো বাবা।
আশিকা দৌড়ে মায়ের কাছে যায়। মাকে জড়িয়ে ধরে বলে, কী হয়েছে মা?
– হয়রান লাগছে। চাদর বিছিয়ে শুব কি না চিন্তা করছি।
– না গো মা, চলো মা ওই পাথরের ওপর কিছুক্ষণ বসে থাকি।
– হ্যাঁ চল। পাথরের ওপর বসি।
আতিকুর রহমান বলে, আমিও তোমাদের সঙ্গে বসব। কী সুন্দর লাগছে চারদিক দেখতে।
– আব্বা, আজকের এই বসা হবে আমাদের ঘরের বাইরে ঘর। আমাদের
ঘরের আনন্দ।
বাবা-মা দুজনেই হেসে ওঠে। আতিকুর বলে, মেয়েটার কথা শুনলে প্রাণ ভরে যায়। ও যে কত সুন্দর করে সবকিছু দেখে। বেঁচে থাকার জন্য এমন ঘরের আনন্দও আমাদের খুব দরকার।
– আব্বা, ঘরে বসে আমাদের এমন গল্প করা হয় না। কত কাজ থাকে মায়ের। আব্বা তো প্রায় সারাদিন অফিসে থাকে। নইলে বাইরে। আমার তো ইউনিভার্সিটি যেতে হয়। নইলে পড়ার টেবিলে।
হামিদা বানু আশিকার মাথায় নিজের মাথা ঠেকিয়ে বলে, দেখি ওর চোখ দিয়ে চারদিক দেখব।
– তা হবে না মা গো। তোমার দেখা তোমার নিজের। তুমি নিজের মতো করে দেখ। যা দেখবে সেটা তোমার স্মৃতিতে থাকবে। আমার দেখা আমার স্মৃতি। বাবারও তাই। তাই না বাবা?
– হ্যাঁ রে মেয়ে, তাই।
– বাবা তুমিও আমাদের সঙ্গে এখানে বস।
আতিকুর পাথর ডিঙিয়ে আর একটু এগিয়ে বড় একটি পাথরের ওপর পা ছড়িয়ে বসে। পাশ দিয়ে চলে যাওয়া অনেকে ওদের দিকে হাত নাড়ায়। নূরবানু কাছে এসে বলে, তোর কি খারাপ লাগছে বুবু?
– নারে সেইরকম খারাপ লাগছে না। একটু বসে দম নিচ্ছি। এমন হাঁটায় তো আমাদের অভ্যাস নাই।
– তা ঠিক। হঠাৎ করে হাঁটতে গিয়ে হয়রান লাগছে। তাই না?
– হ্যাঁ, এইরকমই। তোরা যা, আমরা একটু পরে উঠে আসছি।
নূরবানু হাত নাড়িয়ে চলে যায়। দুপুর গড়িয়েছে। মাথার ওপর সূর্য ঝকঝক করছে। আতিকুর উৎফুল্ল হয়ে চারদিকে তাকায়। মাথা অনবরত এদিক-ওদিক ঘুরছে। এই দেখা তো জনমভর দেখা হবে না। সময়টা এজন্য সমুদ্র বাতাসের সঙ্গী হয়ে ওঠে। মনে পড়ে একবার চিম্বুক পাহাড়ে গিয়েছিল। সে-স্মৃতি এখন পুরোদমে সমুদ্রের পানিতে ভেসে উঠেছে। মনে হচ্ছে এলাকাটি একটি স্বর্গপুরি। সবুজ পাহাড়ে ওঠার জন্য আঁকাবাঁকা পথ আর পথ থাকে না। বদলে দেয় সবকিছু। দুপাশের অসাধারণ প্রাকৃতিক দৃশ্য সময়ের পরিধিকে স্থির করে ফেলে, যেন এই স্মৃতি আর কখনো মুছে যাবে না। পাহাড়ের পাশ দিয়ে বয়ে যাওয়া সাঙ্গু নদী এই মহূর্তে আতিকুরের সামনে সমুদ্র হয়ে যায়। যেন সাঙ্গু নদী সবুজ প্রকৃতি বুকে নিয়ে সবুজ সমুদ্র হয়ে গেছে। আর পাহাড়ে উঠে গেলে মেঘ নেমে আসে মাথার ওপরে। বলে, দেশকে ভালোবেসে সুন্দর রাখ। যেন দেশ কখনো মলিন না হয়ে যায়। তারপরে আতিকুর গুনগুন করে, ঝর্ণা ঝরে রে ঝরঝরিয়ে –
– আব্বু তুমি কি গান করছ?
– গান না রে মা, এটা হলো মনের সুখের সুর।
– সুরের সঙ্গে তো কথাও আছে আব্বু?
– হ্যাঁ, আছে রে মা, আছে। আমাদের এই পাহাড়ি এলাকায় এলে চারদিকে যতকিছু দেখি এসব তো ঢাকা শহরে বসে দেখা যায় না।
– পুরো দেশ কি একরকম হতে পারে বাবা? আমি তো এটা মানব না। ঢাকাসহ সব জেলাশহর একরকম সুন্দর হবে না। পার্বত্য ভূমির সব জায়গাও একরকম হবে না। সব জায়গার সৌন্দর্য ভিন্ন ভিন্ন হবে।
– মা গো তোর মতো এত কল্পনা আমার নাই।
– বাবা-মা তোমাদের কি মনে আছে সেই ঝর্ণাটার কথা, যেটার সামনে দাঁড়িয়ে কেউ কেউ বলছিল এটা আমাদের নায়াগ্রা জলপ্রপাত।
– হ্যাঁ মা, মনে আছে।
বাবা-মা দুজনে জোরে জোরে বলে। আশিকা হাততালি দিতে দিতে বলে, আমাদের বাংলাদেশে নায়াগ্রা জলপ্রপাত আছে। আমরা সেটা দেখেছি। আমরা নায়াগ্রা বলব না। আমরা বলব ঝর্ণাধারা, ঝর্ণাধারা।
– ঠিক আছে, তোর মতো আমরাও বলব।
বাবা-মা দুজনে হাততালি দেয়। আশিকা হাসিতে ভেঙে পড়ে।
মা হাসতে হাসতে বলে, এসব জায়গায় এলে তোর হাসি ফুরোয় না মা রে।
– মা গো, হাসতে পারা তো সুখে আনন্দে। তোমরা আমার জীবনটা আনন্দে ভরিয়ে দিয়েছ।
আতিকুর পাথর থেকে নেমে বলে, চল আমরা এগোই। সামনে গিয়ে রেস্টুরেন্টে ভাত খাব।
– আমারও খুব খিদে পেয়েছে আব্বু।
মা ওকে ব্যাগ থেকে বিস্কুট বের করে দিয়ে বলে, নে খা।
– না গো মা। খাব না। পেটে খিদে রেখে সমুদ্রপাড়ের রেস্তোরাঁয় গিয়ে খাব। তখন খাওয়ার সঙ্গে সমুদ্রের মিল খুঁজে পাব।
– কেমন মিল রে মা?
আতিকুর হাসিমুখে মেয়ের দিকে তাকায়।
আশিকা হাসতে হাসতে বলে, বাবা আমার মনে হবে ছোট ছোট ভাতের দানা এক বিশাল সমুদ্র আমাদের বেঁচে থাকার শক্তি। আমাদের বাঁচিয়ে রাখার জোয়ার।
হামিদা বানু হাসতে হাসতে বলে, তুই বানাতেও পারিস কথা। এটাও তোর বেঁচে থাকার শক্তি।
আশিকা কল্লোলিত ধ্বনির মতো বলে, চলো চলো এগিয়ে যাই।
তিনজনে সৈকতের পথে পা বাড়ায়। আশেপাশের অন্যরা অনেকটা পথ এগিয়ে গেছে। আতিকুরের মনে হয় এই সমুদ্রসৈকতে হেঁটে যাওয়ার আনন্দ আশিকার মতো আর কারো নয়। ওর চিন্তা কারো সঙ্গে মিলবে না। ও আনন্দ উপভোগের জায়গা খুঁজে নিতে পারে অনায়াসে।
দূর থেকে বাবুল ওদের দেখে এগিয়ে আসে। বলে, আপনারা যে সমুদ্রের ধারে পাথরের ওপর বসেছিলেন দেখে ছবির মতো লাগছিল। একদিকে বিশাল সমুদ্র আর তার কিনারে তিনজন মানুষ। সাগর আর মানুষ মিলেমিশে এক হয়ে গিয়েছিল।
আশিকা হাসতে হাসতে বলে, তোমার কথাটা স্বপ্নের মতো লাগল বাবুলভাই।
– তুই তো নতুন কথা শুনলে এমন করেই উত্তর দিস। খালাম্মা আপনার খিদে পেয়েছে? হাঁটতে পারবেন?
– পারবরে বাবুল। তুই সবার জন্য এমন একটা আয়োজন করেছিস যে আমি এখানে আসার পর থেকে ভাবছি তোকে বুকে জড়িয়ে ধরে কপালে একটা চুমু দিব।
– খালাগো দিবেন। এই সমুদ্রের ধারে বসেই দিবেন।
আতিকুরও বলে, তুই যে এমন একটা চিন্তা করতে পেরেছিস তা আমাদের ধন্য করেছে।
– আপনারা তো এই পার্বত্যভূমিতে বেশ কয়েকবার এসেছেন।
– হ্যাঁ এসেছি। আশিকার তাড়নায় আসতে হয়েছে।
– নিজেরা আনন্দ পাননি?
– পেয়েছি রে। শুধু পাইনি বললে কম বলা হবে, আনন্দে ডুবে গিয়েছি। এই সমুদ্রের সমান আনন্দ পেয়েছি।
আশিকা উচ্চকণ্ঠে হাসতে হাসতে বলে, বাবার আনন্দের কথা শুনে মনে হচ্ছে ভ্রমণ আমাদের চিন্তাকে সুন্দর করেছে। নইলে বাবা কীভাবে সমুদ্রের সঙ্গে তুলনা করল।
– আমি তোর কাছেই শিখেছি মা।
আশিকা হাসতে হাসতে দৌড়াতে থাকে। ভাবনায় ভেসে ওঠে সমুদ্রসৈকত। সৈকতে দৌড়ানো গভীর আনন্দ, যেন মনে হয় সমুদ্র আমার সঙ্গী। একদিন সমুদ্র ওর ঘরে গিয়ে ওকে বলবে, আয় আজ রাতে তুই আর আমি একসঙ্গে ঘুমাব। তোর বিছানায় আমাকে পাবি। পরক্ষণে দৌড়ের গতি কমিয়ে দাঁড়িয়ে পড়ে। নিজেকে ধমক দিয়ে বলে, কল্পনার সীমা থাক উচিত। নইলে লোকে ওকে পাগল বলবে।
পাশ দিয়ে হেটে যাওয়া হরিপ্রসাদ বলে, দাঁড়ালি কেন রে?
– বাবা-মায়ের জন্য। হঠাৎ করে তাদের ছেড়ে এসেছি।
– চল, আমরা আস্তে আস্তে হাঁটি।
– না, আমি যাব না। আমি মায়ের হাত ধরে হাঁটব।
– ঠিক আছে, দাঁড়িয়ে থাক।
হরিপ্রসাদ চলে যায় দ্রুতপায়ে হেঁটে। ভদ্রলোক বাবুলের বন্ধুর বাবা। আশিকা তাকে আগে দেখেনি। এই ভ্রমণে পরিচয় হয়েছে। ভদ্রলোক ওকে একা দেখে সিকিউরিটির প্রশ্নে এগিয়ে এসেছে। ও দূর থেকে দেখতে পায় খালামণিও যুক্ত হয়েছে বাবা-মায়ের সঙ্গে। তিনজনে গল্প করতে করতে হাঁটছে। আশিকা বসে পড়ে। পাশে পড়ে থাকা একটি ছোট কাঠি কুড়িয়ে নিয়ে বালুর ওপর নানারকম দাগ কাটতে থাকে। আশিকার মনে হয় এটা একধরনের ছবি আঁকার আনন্দ। এই মুহূর্তে সমুদ্রসৈকত ওর সামনে শিল্পের ক্যানভাস। ও বড় বড় দাগ কেটে নানা আঁকিবুকি টানতে থাকে বালুর ওপর। স্থিরদৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে সেদিকে। ভাবে, এ এক দারুণ খেলা। খেলতে খেলতে জমে ওঠে জীবনবেলা। ক্ষুধার্ত অনুভূতি মাঝে মাঝে ঘাবড়ে দেয় নিজেকে। কিন্তু পরক্ষণে সেটা তাড়িয়ে নিজের অনুভবের মাত্রাকে গাঢ় করে তোলে। আশিকা নিমগ্ন হয়ে যায় বালুর রেখা ফুটিয়ে তোলার মগ্নতায়। চারদিকে খেয়াল রাখতে পারে না। একসময় বাবা-মা-খালা এবং অন্যরা কেউ কেউ ওর চারপাশে এসে দাঁড়ায়।
– কী করছিস মা? এমন করে বালু ঘাঁটছিস কেন?
– বাবা, বালু ঘাঁটছি না। বালুর মধ্যে ছবি আঁকছি।
নূরবানু ধমক দিয়ে বলে, একবার দেখলাম দৌড়াচ্ছিস। আবার দেখলাম ছবি আঁকছিস। ঢং দেখানোর আর জায়গা পাস না।
– বকছেন কেন খালা? এমন একটি জায়গায় আসার জন্য তো –
– হয়েছে, হয়েছে থাম। তোর পাগলামি আর দেখাস না।
– ঠিক আছে, আমি হাত ধুয়ে আসছি।
আশিকা ছুটে সমুদ্রের পানির ধারে গিয়ে হাত ধুয়ে নেয়। সবাই দাঁড়িয়েছিল ওর জন্য। ফিরে এলে একসঙ্গে হাঁটতে শুরু করে। মাসুম হাঁটতে হাঁটতে বলে, শিলখালিতে পৌঁছে আমরা রেস্তোরাঁয় বসার জায়গা পাব কি না ভাবছি। কারণ আমরা তো সবার থেকে পিছিয়ে আছি।
– থাম, থাম এত ভাবতে হবে না। ভাত না পেলে ওদের সঙ্গে আমি ভাত রান্না করব।
সবাই হেসে ওঠে।
আতিকুর বলে, তোকে কেউ ঠেকাতে পারে না মেয়ে।
সবাই হাসে। আশিকা কোনো কথা বলে না।
শিলখালিতে গিয়ে রেস্তোরাঁয় ঢুকে আতিকুর বলে, আমরা সবাই ভাত খাব।
– আসেন স্যার, আসেন। আপনাদের আগে যারা এসেছিলেন তারা বলেছেন আপনাদের ভাত-তরকারি শেষ হয়ে গেলে আবার রাঁধেন। আমাদের পরে আরো অনেকে আসবে। আমরা রান্না করেছি।
– বাহ্! সাবাস!
আতিকুর লোকটির ঘাড়ে হাত দিয়ে ঝাঁকুনি দেয়। সবাই মিলে বিভিন্ন টেবিলে ভাত খেতে বসে। পেটপুরে ভাত খেয়ে সবাই স্বস্তির নিশ্বাস ফেলে। রেস্তোরাঁর বিল মিটিয়ে দিয়ে বাইরে এলে সবাই বলে, সূর্য পশ্চিম আকাশে চলে গেছে। আমাদের এখন আর হাঁটা শুরু করা উচিত নয়। কিছুক্ষণ পর সন্ধ্যা নামবে।
– ঠিক বলেছেন চাচি। বাকি পথ আমরা কাল সকালে সূর্য ওঠা দেখতে দেখতে যাব।
– ঠিক বলেছিস রে আশিকা।
– সবাই চলো আমরা এখন ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যানের কাছে যাই। রাত কাটানোর ব্যবস্থা করতে হবে। ঘুম দরকার।
আতিকুর সবাইকে নিয়ে ইউনিয়ন পরিষদের অফিসে আসে। চেয়ারম্যানের সঙ্গে কথা বলে ইউনিয়ন পরিষদের অফিসের দুই ঘরে মেঝেতে ঘুমানোর ব্যবস্থা হয়। চেয়ারম্যান নিজে বাড়ি থেকে মাদুর আর বালিশের ব্যবস্থা করে। এক ঘরে নারীদের, অন্য ঘরে পুরুষদের দেওয়া হয়। সবাই খুব খুশি হয় এই ভেবে যে, এক ঘুমে রাত কেটে যাবে। মাইলের পর মাইল হেঁটে সবাই ক্লান্ত। সন্ধ্যা হয়ে গেলে যে যার মতো শুয়ে পড়ে। শুধু আশিকা মাকে বলে, এই জানালার ধারে বসে আমি রাতের আকাশ দেখব মা গো। তারপরে ঘুমাব। এমন দিন আমার জীবনে আর দ্বিতীয়বার আসবে না।
– ঠিক আছে বসে থাক। আমি ঘুমাতে বললে তোর মন খারাপ হবে। বেড়াতে এসে তোর মন খারাপ হবে এটা তো আমি চাই না।
– মা গো তুমি একজন তুলনাহীন মা। তুমি সন্তানকে ঠিকমতো বোঝ।
হামিদা বানু কথা না বাড়িয়ে শুয়ে পড়ে। আশিকা মাথা ঘুরিয়ে সবাইকে দেখে। সবাই কাত হয়ে শুয়ে আছে। কারো মুখ ঠিকমতো দেখা যাচ্ছে না। আশিকা মাথা ঘুরিয়ে বাইরে তাকায়। দিনভর যে-সমুদ্র দেখা হয়েছে সে-সমুদ্র এখন আঁধার গায়ে মেঘে অন্যরকম হয়ে গেছে। আশিকার মনে হয় এ এক ভিন্ন দৃশ্য। সব দৃশ্য বুকে নিয়ে ফিরে যাবে ঢাকা শহরে। আহ্, এই অপরূপ পৃথিবীতে বেঁচে থাকলে জীবন ধন্য। পরক্ষণে ওর মন কুঁকড়ে যায়। আর একবার এসেছিল বন্ধুদের সঙ্গে। মুরং পাড়ার সেই মানুষদের দেখে বুঝেছিল ওদের সামনে সমুদ্র নেই, পাহাড়ের সবুজ সৌন্দর্য নেই, ঝর্ণাধারার সংগীত নেই। ওদের সামনে পরিত্যক্ত প্রান্তরে বেঁচে থাকার কষ্ট ছাড়া আর কোনো অনুভব নেই। কষ্টই ওদের পাহাড়ের পাদদেশে বেঁচে থাকার শিল্পকলা। আহ্, কষ্ট কষ্ট … – আশিকা উচ্চারণ করতে গিয়ে থেমে যায়। যারা ঘুমিয়ে আছে তারা বিরক্ত হবে। তারচেয়ে মুরং পাড়ার সেদিনের ছবি অন্ধকার সমুদ্রের ক্যানভাসে তুলে ধরলে সেটা ওর স্মৃতিতে ভরে থাকবে। একজন হামশী নামের নারীর সঙ্গে ওর যোগাযোগ হয়েছিল। একসময় কোনো একটা অফিস স্থাপনের জন্য ওদের উচ্ছেদ করা হয়েছিল। ওরা নিজেদের ভিটেমাটি থেকে উচ্ছেদ হয়ে রাস্তার ধারের অস্থায়ী ঘরে দিন কাটাচ্ছিল। মেয়েটির পিঠে ছিল দুই বছরের শিশুপুত্র। ও বলেছিল, আমাদের দুশো মানুষকে উচ্ছেদ করেছে। আমাদের বেঁচে থাকা শুধু ভগবানের কৃপা। আমাদের জন্য আর কেউ নাই। দেশের সরকারও নাই। এটা কি আমার দেশ, নাকি অন্যের দেশ? আমরা কেন উৎখাত হব? উৎখাত হলেও কেন আমরা ঘরবাড়ি পাব না? রাতের অন্ধকারে সেই ছবির দিকে তাকিয়ে আশিকা মনে মনে বলে, তোমরা আমাদের মাফ করে দাও বোন। আমরা তোমাদের ভালোবাসি। একদিন তোমাদের বাসভূমি ঠিকই আলোর দিশা পাবে। তোমাদের কতকাল আর ঠকিয়ে রাখতে পারবে দেশবাসী। এমন অপরূপ জায়গায় বাস করেই তোমাদের জীবন ধন্য। তোমরা দেখতে পাও আপন আলোয় নিজের পৃথিবীর অসাধারণ ছবি। এই পাহাড়ি এলাকা তোমাদের আপন ভুবন। ভাবতে ভাবতে জানালার শিকে মাথা ঠেকায় আশিকা। চোখ প্রসারিত হয়ে থাকে। ঘুম আসতে চায় না। যাদের কথা ভাবছে তারা ওর ঘুম কেড়ে নিয়েছে। কী করে ওদের জীবনকে ওদের ইচ্ছার মতো করা যাবে সে-কথা ভাবতে গিয়ে প্রবল ধাক্কা খায়। মনে হয়, সমুদ্রের কলকল ধ্বনি শুনতে পাচ্ছে না। অন্ধকার গাঢ় হয়ে গেছে। কোথাও কিছু দেখতে পাচ্ছে না। পরক্ষণে ভাবে, ওর নিজের মাথাই শূন্য হয়ে গেছে। ওদের জন্য কিছু করতে না পারার চিন্তা ওকে ঘায়েল করে। ওদের দেখতে আসা শুধু নিজের উপভোগ। ওদের কিছু আসে-যায় না। এভাবে কাটাতে হবে জীবনের বাকি দিন।