‘The voice of the intellect is a soft one, but it does not rest until it has gained a hearing.’
– Sigmund Freud
১. মিঙ্কোছেতে
খোকা বলে উঠেছিল ‘ল ল ল’
সামনে তাকিয়ে দেখি বাসস্ট্যান্ডের দিক থেকে মার্বা আসছে। মার্বা কদিনেই আমাদের বেশ বন্ধু হয়ে উঠেছিল। আমাদের মফস্বল শহর অশোকনগরে পূর্ব পাকিস্তান থেকে আসা ছিন্নমূল মানুষদের বাস। একদিন একরাতে নাকি এক-একটি বাড়ি তখন তৈরি হয়েছিল। সেসব ১৯৪৯-৫০-এর কথা। আমরা সেইসব ছিন্নমূলের উত্তরপুরুষ। বালকবেলার, প্রাক-কৈশোরের লীলাভূমি কচুয়া মোড়ের রিকশাস্ট্যান্ডের কাছে শিবুদার তেলেভাজার দোকানের সামনে তখন আমরা দাঁড়িয়ে। উলটোদিকের অমূল্যদার (গুরু) চায়ের দোকানে বড়দের আড্ডা তখন চলছে রমরমিয়ে। প্রসঙ্গ দেশভাগ। মূল্যবৃদ্ধি। রাজনীতি। মার্বা কাছাকাছি এসে আমাকে বলল, ‘এই সুদু – এ আমাকে উদ্বাস্ত্ত বলে কেন? এ উদ্বাস্ত্ত নয়।’ ’৬৪ সাল তখন। আমার ক্লাস নাইন।
’৬৩-৬৪ সালে আবার একটা দেশত্যাগের ঘটনা ঘটেছিল। অশেষরা এলো পূর্ব পাকিস্তান থেকে। মার্বারা এলো বার্মা থেকে। মার্বা কারুর নাম হয় নাকি? বার্মাকে উলটে মার্বা করেছে খোকা। এত যুগ পরে মনে করার চেষ্টা করি মার্বার আসল নামটা কি ছিল! মনে পড়েছে পদবিটা ছিল দেব। খোকা তো আজ এ-পৃথিবীর কোথাও নেই। দেবের নামটা? বিজয় বলতে পারবে? যাকগে … একরোখা খোকা বলল, ‘ওসব থাক। তুমি সুদুকে বার্মিজ ভাষা শেখাবে, ওর ভাইকে রেডিও বানানো – আমার জন্য কি?’
মার্বা বলল, ‘আচ্ছা তোমাকেও শেখাব।’ এরপর মার্বা বলল, ‘সুদু পড়াটা দাও দেখি কেমন শিখলে -’
আমি বলি, ‘বাবা, হাগেন
মা, মাখেন
খোকা বলে উঠল
তবে কাকা ধোয়ান
জ্যাঠা মোছান?’
মার্বা রেগে গেল। বলল, ‘সুদু একরোখা খোকা সঙ্গে থাকলে কিছু হবে না।’ গুরুর দোকানে ট্রানজিস্টারে বাজছে দিল্লির খবর, পড়ছেন ইভা নাগ, রাষ্ট্রসংঘের সেক্রেটারি জেনারেল উথান্ট্ বলেছেন আমেরিকাকেও সমঝে চলতে হবে। সেটা শুনে মার্বা বলে উঠল, ‘সুদু ইনি আমাদের দেশের লোক। রাষ্ট্রসংঘে বিশ্বের উপকার করতে চলে না গেলে হয়তো আমাদের এ হাল হতো না … যাকগে …’ তারপর খোকার দিকে ফিরে বলল – ‘খোকা তুমিও সমঝে চলো।’
খোকা বলল – ‘কিরে বার্মা এখনো তোর দেশ?’
মার্বা বলল, ‘আলবাৎ। আরে মুখ্যু। কাকা ‘হলেন – আজে …’ খোকা দুঃখী দুঃখী মুখ করে তখন বলল, ‘এই আমাকে একটু বার্মিজ ভাষা শিখিয়ে দিবি।’ তারপর আমার দিকে ফিরে বলল, ‘শোন সুদু … এবার কিশলয় সংঘের সরস্বতী পুজোর দায়িত্ব আমার। সব খরচ আমি দেব। লাইট। মাইক। কিন্তু একটা শর্ত আছে।’ মার্বা অবাক গলায় বলল, ‘মাইকও লাগাবি? কিরে সুদু?’
খোকা বলল – ‘হ্যাঁ তো।’
সুদু বলল, ‘শর্তটা কি!’
‘শোন নীলদার বাড়িতে আমি এখন দোকান করি। ওর ছোট বোন বীণাপাণির সঙ্গে আমার একটু ইন্টুস-সিন্টুস … বীণাপাণি তোমাকে দিয়ে ফেলেছি আমার হৃদয়খানি। গেঁথেছি ওদেরই বাগানের ফুল দিয়ে মালাখানি।’
সুদু বলল, ‘তোমার তো বিপদ আছে? কিরে মার্বা?’
তখন মার্বা ওর দেশের ভাষায় একটা বাক্য বলল। খোকা বুঝল না। যার অর্থ – নীলদা ওকে বলস্নমের ফলায় বাঁধবে! সুদু বলল, ‘তুই জানিস না বীণাপাণি আর লক্ষ্মীরানিকে আমাদের দুই বন্ধুর কথা দেয়া আছে। বড়র ছোট। ছোটর বড়। হরেন্দ্রর বড় বোনকে। আর হরর বড় ভাই নরেন্দ্রদার ছোট বোনকে নীলদার।’
মার্বা ছড়াটা আওড়াল ‘বড়র ছোট্ট, ছোটর বড় হর, নর লক্ষ্মী, সর … খোকা তোর তো দুদিকেই বিপদ -’
খোকা দার্শনিকের মতো বলল, ‘প্রকৃত প্রেমিকের কাছে কোনো বিপদ-ই বিপদ না।’
তারপর মার্বার কাঁধে থাপ্পড় মেরে বলল – ‘এই ‘আই লাভ উই’র বার্মিজ বল এখুনি।’ মার্বা আমার দিকে একবার তাকাল। খোকাকে বলল, ‘তোর সঙ্গে আর মেশা যাবে না, সুদু তুইও ওকে পরিত্যাগ কর।’ তারপর বলল, ‘মিঙ্কোছেতে।’
আমি বললাম, ‘কী -’
খোকা ঠিকই শুনেছিল, কচুয়ার আকাশ বিদীর্ণ করে বলে উঠল, ‘বীণাপাণি মিঙ্কোছেতে। নীলদা মিঙ্কোছেতে।’ এতো জোরে চিৎকার করে উঠেছিল খোকা, শিবুদা চপের মশলা বেসনে ডুবিয়ে তেলে ছাড়তে ছাড়তে আমাদের দেখল – গুরুর দোকান থেকে তপনদা উঠে দাঁড়িয়ে বললেন, ‘সুদু পাকাটা কী ভাষা বলছে রে …’
আমি দাঁত বের করে বললাম, ‘আমরা বার্মিজ ভাষা শিখছি …।’ বাবলুদা হেসে বললেন, ‘বেশ তো অত চিৎকার করে বলতে হয় নাকি?’
আমার জন্ম অশোকনগরে। আমি তো ঠাকুরদা, বাবা-কাকাদের দেশত্যাগের, মূলোচ্ছেদের দুঃখ-বেদনা বুঝতে পারিনি। মার্বার থেকে প্রথম জানি শরণার্থী হওয়ার বেদনা কী। বাবা কাকা ঠাকুরদারা চলে আসেন পাকাপাকি বাউকাঠি থেকে ’৪৫ সালের মার্চের শেষ দিকে, কলকাতায় পৌঁছান এপ্রিলের গোড়ায়। ঠাঁই হয় বাবা মেজো কাকা যে-বাড়িতে থেকে অফিস করতেন, ডাক্তারি পড়তেন, বৌবাজার বিশ্বনাথ মতিলাল লেনের সেই বাড়িতে।
পঞ্চাশে অশোকনগর। আর মার্বার কাছে শুনি মিলিটারিরা অত্যাচার করছিল। ওদের কিছু দূরের পাড়া ভেঙে গুঁড়িয়ে দিয়েছিল। ওরা পালিয়ে এসেছিল বাধ্য হয়ে। কীভাবে পালিয়ে এসেছিল বনজঙ্গল পেরিয়ে সে-বীভৎস বর্ণনা এখন আর বিশদ মনে নেই। মার্বাই বোধহয় প্রথম অন্যের দুঃখে দুঃখিত হতে শিখিয়েছিল আমাকে। মার্বা তুই কোথায় আছিস এখন! হায়ার সেকেন্ডারির পরে শুনেছিলাম তুই আবার বার্মা ফিরে গেছিস জেদ করে … কেমন আছিস, ভাই!
… বয়েজ সেকেন্ডারি স্কুল আমার। স্কুলের লনে আমাদের রসায়নের নলিনী বাবু স্যার আমাদের দুজনকে একসঙ্গে দেখে মার্বাকে ভ্রূকুটি হেনে বললেন, ‘কিহে তুমি একে আবার পড়াশুনো ছাড়িয়ে রেডিও বানানো শেখাচ্ছ না তো।’ আমাকে হেসেই বললেন, ‘এটার সঙ্গে বেশি মিশো না কিন্তু।’ আমরা পালিয়ে গেলাম। এদিকে গোপন খবর হলো, মার্বা বিজ্ঞানে ভর্তি হয়ে নলিনী বাবু স্যারের কাছেই প্রাইভেট পড়ছে। নলিনী বাবু ওকে নাকি বলেছেন, ‘তুমি তো কিছুই জানো না, কেচে গন্ডূষ করতে হবে … আমিই না রসায়ন ভুলে যাই … তোমাকে শেখাতে গিয়ে। ফরেন গবেট একটা …’
আমার বুদ্ধিতে মার্বা স্যারকে একটা ট্রানজিস্টার বানিয়ে উপহার দিয়েছিল। স্যার আবার হেসে একদিন বলেছিলেন, ‘হেই তোমার রেডিওতে তো রেঙ্গুন ছাড়া আর কোনো সেন্টারই আসছে না!’
আমরা যেন কিছুই জানি না ভাব করে স্যারকে বললাম – ‘কী স্যার!!’
স্যার বললেন – ‘ও আমাকে একটা বার্মিজ বাক্স উপহার দিয়েছে। সেইখানে শুধু রেডিও রেঙ্গুন বাজে।’
ক্লাস শেষ করে বাইরে বেরিয়ে খুব দুঃখী মুখ করে মার্বা আমাকে বলেছিল – ‘সুদু আমাকে একটু কেমিস্ট্রি পড়াবিরে! খালি বকা খাচ্ছি …’
আমি বললাম, ‘পড়াব। আর আগে তুই স্যারের বাড়ি গিয়ে ট্রানজিস্টারটা ঠিক করে দে। রেডিও রেঙ্গুন কেন হচ্ছে শুধু?’
ও শুধু বলল, ‘মিসটেক মিসটেক। ও তুই বুঝবি না। তুই শুধু ভেবে দেখ রসায়নের অ্যাভোগাড্রো সাহেবটা কি চুথিয়া, এমন হাইপোথেসিস না লিখলে হতো না? আমাদের থুরি আমাকে এমন বেইজ্জত করা।’
আমি দুদিকে মাথা দুলিয়ে বললাম, ‘মার্বা খারাপ কথা বলে না। এসব কথা আমি কানেও শুনেছি জানলে আমার ঠাকুরদা হয়তো আত্মহত্যা করবেন …’
২. ‘এবার বুঝি ভোলার বেলা হলো -’
প্রাণের ঠাকুর রবীন্দ্রনাথের এই গানটা সমেন্তাষ সেনগুপ্ত বড় ভালো খেয়েছেন। শেষ লাইনটিও সাংঘাতিক – আজিকে তবে আপন হাতে বিদায় দ্বার খোলো। কতদিন আগে গানটি লেখা! আন্তর্জাতিক বিচ্ছেদ বেদনা থাক … বিচ্ছেদবোধ আমাদের এখন লিভিং রুমেই ঘাপটি মেরে আছে! স্ত্রীর সঙ্গে স্বামীর, পিতার সঙ্গে পুত্রের। মাতার সঙ্গে … থাকগে ভাবছিলাম তো মার্বার কথা … এসব কথা কেন মনে আসছে … আচ্ছা মার্বার সঙ্গে বিচ্ছেদের পঞ্চাশ পূর্ণ হয়ে গেছে। ’৬৭-র পরে আর দেখা হয়নি। এখন মার্বাকে দেখলে চিনতে পারব?
ওর কপালের ক্ষতটা দেখে … সেও এক ….
বাহান্ন বছর হতে চলল। সবারই এমনটা হয়। বাবাকেও দেখেছি বোনকে ডাকতে গিয়ে পিসির নাম বলছেন … পিসিকে ডাকতে গিয়ে, আমি চোখ বুঁজে ফেললাম। মার্বার মুখটা মনে করতে পারি কিনা … ডান ভুরুর ওপরে সেই কাটা দাগ! ধুর নামটাই মনে করতে পারছি না, পদবি দেব। কী দেব!
খোকার চাপাচাপিতে সেবার সরস্বতী পুজোটা নীলদার বাড়ির সামনেই করতে হয়েছিল। সেই সঙ্গে খোকার মাতববরি। পুজোশেষে আমাদের আমন্ত্রিত সম্পাদক পরিমলদা, শ্রী পরিমল সান্যাল আমাদের সবাইকে একটা করে নতুন নাম দিয়েছিলেন।
সবারই নামের আগে একটা সাম্মানিক উ। খোকা হলো – উ কু (পাকু থেকে), বার্মিজ উ দে (দেব থেকে) আর আমি অবশ্যই উ সু। আমরাও পরিমলদার একটা নাম দিয়েছিলাম। থাক আজ স্বর্গগত সেই দাদাকে ছাড় দিয়েছিলাম আমাদের ছেলেবেলার কত দুষ্টুমির তিনি প্রত্যক্ষদর্শী, প্রশ্রয়দাতাও …।
রাজাবাজারের চৌমাথা থেকে অটোয় উঠে পড়েছি। কোথায় যাব অটোচালক জিজ্ঞেস করতে (‘কোথায় যাবেন’ জিজ্ঞেস করে নিজেই হেসে ফেলল, চেনে) আমি মনে করতে থাকি। জায়গার নাম মনে পড়ে না। অথচ আমার মনে পড়ে ছোটবেলা ফুটবলের বস্নাডার ফুটো হয়ে গেলে জায়গাটা ঝামা দিয়ে ঘষতে হতো। তারপর সলিউশন লাগিয়ে তাপ্পি লাগাতে হতো। ঝামাঘষা, ঝামাঘষা – ওই গলিতে রাজা দিগম্বর মিত্রের বাড়ি। যিনি ম্যালেরিয়া নিয়ে অনেক কাজ করেছেন। যাঁর বাড়িতে রামকৃষ্ণ দেব এসে উঠেছিলেন। যাঁর ছোট ভাই মধুসূদন দত্তের বন্ধু ছিলেন। খ্রিষ্টান হবেন বলে মধুকবি গির্জাতে অন্তরীণ হওয়ায় তাকে ছিনিয়ে আনতে গৌরদাস বাবুর সঙ্গে তিনিও ছুটে ছিলেন … পাশেই এখন গিল্ড অফিস –
আমার বিব্রত অবস্থা দেখে অটোচালক আবার বলেন, ‘মনে পড়ল না কোথায় নামবেন? আমি তো জানি। অমন করছেন কেন! যাদব ঘোষের মিষ্টির দোকানের গলিতে নামেন তো আপনি!’
ঝামা মনে পড়ল, সব মনে পড়ল, কচুয়ার সুনীল সাইকেলের সুনীলদা একবার ছোট কাকাদের তরুণ সংঘের ফুটবল বস্নাডার ঝামাঘষে ফাদরাফাই করে দেওয়ায় ছোট কাকা সপাটে একবার বস্নাডার দিয়ে মেরেছিলেন বলে সুনীল দত্ত উত্তরকালে তার ভাইপোদের খুব খাতির করতেন না। নেমে পড়ে, অটো থেকে নেমে আমি আক্ষেপ করি, ঝামা মনে পড়ল … ঝামাপুকুর মনে পড়ল না! ভোলা রোগের ডাক্তার নিজেই ভুলু হয়ে গেল …!
কিন্তু অটো থেকে নামতে নামতে বিদ্যুচ্চমকের মতো একটা নাম মনে পড়ায় এই বয়সেও আমি একপাক নেচে নিই! এই বয়সেও! আমার মার্বার নাম মনে পড়েছে। পড়েছে।
অনঙ্গ দেব। দেখি এবার মুখটা মনে করি। দুপাশের অটোর ছোটাছুটির মধ্যে আমি চোখ বুঁজে অনঙ্গ দেবের মুখটা স্মৃতিতে আনার চেষ্টা করি। বাহান্ন বছর আগেই সেই মুখ …
এবার অনঙ্গর নামটা মনে পড়ল, মুখটা স্মৃতির পর্দায় ভেসে উঠেও কেমন ঘোলাটে হয়ে যাচ্ছে। আসলে মুখের স্মৃতি তো জমা থাকে আমাদের মস্তিষ্কের শঙ্খখ– (মেসিয়াল টেম্পোরাল লোবে) মুখাবয়ব শনাক্তকরণ অঞ্চলে। কিন্তু চেনামুখের নামটা জমা থাকে ভার্নিক্স অঞ্চলে যার অবস্থান ঊর্ধ্ব শঙ্খগিরি (টেম্পোরাল জাইয়াস) এবং নিম্ন পার্শ্বগিরি (প্যারাইটাল জাইয়াস) সংযোগস্থলে। এই দুটি স্নায়ুকেন্দ্রকে যে স্নায়ুবর্তনী সংযুক্ত করে তার গোলমালে এইসব বিপত্তি … আবার রবীন্দ্রগান – চিনিলে না আমারে কী চিনিলে না …
নিজেকেই বলে উঠি – ‘ডাক্তার সাবধান …’ অথচ গলার স্বরে নিজেরই চমক লাগে। নিজেই নিজেকে বলি, ‘পুলক কিসের উ সু? আরে উ অনঙ্গর নাম মনে পড়েছে এত কষ্টে আনন্দ তো হবেই …’
৩. সব চিঠির উত্তর আশা করতে নেই … আসেও না
রাষ্ট্রসংঘের সচিবালয় থেকে ই-মেইলে চিঠির প্রাপ্তিসংবাদ এসেছে। তাঁরা আন্তর্জাতিক ছোট গাধা পরিষদের ভারতীয় সংগঠনের পক্ষ থেকে পাঠানো চিঠির প্রাপ্তি স্বীকার করে লিখেছেন, বছরের কোনো দিন বিশেষভাবে চিহ্নিত করতে হলে আবেদনপ্রার্থীর দেশের সভাপতির সচিবালয় এবং রাজ্যপালের দপ্তরের অনুমোদন জরুরি। সেই অনুমোদনসাপেক্ষে এই প্রার্থনা বিবেচনা করা হবে – বিশ্বব্যাপী অস্থির পরিম-লে হিংসার বিরুদ্ধে আপনাদের প্রতিবাদের ধরনকে আমরা স্বাগত জানাই।
জাস্টিস মহা বিষ্ণু বিষ্ণু ফিকফিক করে হাসছেন। ওই পর্যন্তই! রাজ্যপালের সচিবালয় থেকে এই চিঠি এলো বলে। মজা পেয়েছেন? আর কোনো দিবসের রজনীর নাম পেলেন না? আন্তর্জাতিক গর্দভ দিবস? এরপর কেউ ছাগিনী রজনীর ডাক দিলে? কেন্দ্রীয় সরকারের বিরুদ্ধে চক্রান্ত …?
একটা আমন্ত্রণপত্র এগিয়ে দিলেন মিস্টার জাস্টিস বিষ্ণু। আপনাদের কতদূর? হ্যাঁ, শুনুন, লন্ডনের কুইন মার্সি বিশ্ববিদ্যালয়ের এক প্রতিনিধিদল আসছে। আন্তর্জাতিক রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস প্রবর্তকের গবেষণাদলের প্রধান স্যার জেমস বোল্টার বলবেন। ইউনিভার্সিটি ছাড়িয়ে তো আপনি কাজে যান। ব্যানার চোখে পড়েনি। বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান দপ্তর পরিবেশ বিজ্ঞান দপ্তর এই সভার আহবায়ক। মানবাধিকার সংগঠনেরও কেউ কেউ থাকবেন। নানা রকম ফেস্টুন চোখে পড়েছে না আপনার? আপনাদের গাধা সমিতিকে এর মধ্যে ভিড়িয়ে দেবেন নাকি। আমি বলব ওদের। সেদিনের উ-সু, আজকের মৃদঙ্গ মৌলিক বলল, ‘আপনি আসছেন তো …।’ একগাল হেসে মিস্টার জাস্টিস বললেন, ‘আসা তো উচিত – উই শুড ফাইট অ্যাগেইনস্ট টেরোরিজম, ইনটলারেন্স অ্যান্ড ইনক্রিসিং ভায়োলেন্স।’
আর হ্যাঁ, মহাবিষ্ণু বললেন – ‘সব চিঠির উত্তর কোনো দিনই আসে না। আমাদের ব্যানারগুলোও সেদিন যেন থাকে, হবে না, এতেই হবে। আমাদের বার অ্যাসোসিয়েশনের ‘অন্তরান্তা’ও থাকবে।’
রাতে অশোকনগর থেকে বিজয়ের ভারী গলার ফোন। বলল, ‘এই অনঙ্গকে মনে আছে?’ হঠাৎ মুখ দিয়ে বেরিয়ে যায়, ‘কোন অনঙ্গ?’
‘আরে তোর অনঙ্গকে মনে নেই … বার্মিজ রেডিও মাস্টার উ দে! রেডিও রেঙ্গুন!’ এক নিশ্বাসে বলে যায় বিজয় – আমি নিস্পৃহ গলায় বলি, ‘কী হয়েছে!’
ও বলে, ‘চিনতে পেরেছিস এবার! শোন না, ও কুয়ালালামপুর থেকে আসবে।’
– অশোকনগরে?
– হ্যাঁ।
– তো – (আগ্রহ দেকাচ্ছি না)
– বাহান্ন বছর বাদে কাউকে একা একা চেনা যায় নাকি। তোকে আসতে হবে। ছোটবেলার বন্ধু ভেবে শেষে …
– শেষে কী?
– পুলিশি ঝামেলায় যদি পড়ি।
– ছোটবেলার বন্ধুকে চিনতে পারবি না? ঝামেলা কেন? পুলিশ কেন?
– না, পারবো না। তোমাকে অশোকনগরে একবার আসতে হবে আমার বাড়িতেই না হয় থাকবে। … তখন সব না হয় বলব।
আমি এবার হো-হো করে হাসতে থাকি। বলি, ‘জানিস কত কষ্ট করে আজ অনঙ্গের নামটা মনে করেছি, আর আজই তোর ফোন -’
৪. ‘… কোটেশন পড়ে আছে শুধু। কণ্ঠ আমার রুদ্ধ আজিকে
ইত্যাদি ইত্যাদি … (‘প্রতিক্রিয়া’, শঙ্খ ঘোষ)
এ হাসপাতালের পেছন দিকে স্টেশন রোড, উলটোদিকে বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি প্রবেশপথ। বন্ধুর সঙ্গে চা খেতে বেরিয়ে উ সু (ছেলেবেলায় ফিরে যেতে কি যে আনন্দ হচ্ছে) বিশ্ববিদ্যালয়ে ঢুকে পড়ল। কদিন আগে এই বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাবর্তন অনুষ্ঠান ছিল। তার সঙ্গে ওয়ালে এখন যোগ হয়েছে সভাঘরে আগামী জনসভার জন্য নানা রকম প্রচারবার্তা এবং উদ্ধৃতিও। বাংলা এবং ইংরেজিতে। বাহ্ বেশ সুন্দর তো … মৃদঙ্গ মনোযোগ দিয়ে পড়া শুরু করে।
* প্রতিটি মানুষ যে কোনো উৎস বা মূলেরই হোন না কেন বা বাসস্থানের। অবশ্যই সম্মানযোগ্য। আমাদের প্রত্যেকের উচিত অন্যকে সম্মান করা যেমন আমরা নিজেদের সম্মান করি।
* যে যুদ্ধে আমরা আজ বৃত হয়েছি তার একটিই লক্ষ্য, তাহলো আমাদের এই পৃথিবীটিকে বিবিধ মধুর বৈচিত্রের জন্য নিরাপদ করে গড়ে তোলা।
* আমরা যখন সূর্যকে নেমে যেতে দেখি সন্ধ্যার পর। সন্ধ্যা ধোঁয়াশার মধ্যে আমাদের চেনা পৃথিবীর বিষময় জলের ভিতর। আমাদের নিজেদের জিজ্ঞেস করা উচিত আন্তরিকভাবে আমরা প্রকৃতপক্ষে সত্যিই কী চাই যে ভবিষ্যতের কোনো আন্তর্জাতিক ঐতিহাসিক অন্য কোনো গ্রহে আমাদের সম্পর্কে বলছেন, ‘তাদের সকল মেধা ও শৈলী সত্ত্বেও তারা দূরদৃষ্টি, পরিকল্পনা, জলবায়ু খাদ্যের অভাবে পিছিয়ে গেল।
তারা রাজনীতির খেলায় এমন ঘোর মত্ত ছিল যে তাদের পৃথিবী কখন যে ধ্বংসপ্রাপ্ত হলো তাদের নিয়েই … হায় টেরও পেল না! ব্রেভো! মৃদঙ্গ মনে মনে বলে।
* যুদ্ধ শুরু হয় মানুষের মনে এবং সেই সকল মনে যেখানে ভালোবাসা, করুণা এবং সমবেদনার শান্তির প্রতিরক্ষা গড়ে তোলা উচিত ছিল।
* সরকার নিয়মতন্ত্র ভাবতত্ত্ব বা অধিবিদ্যা আসে আর যায় কিন্তু একমাত্র মানবতা যা অবিনশ্বর।
* শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের ধারণাকে অনেকেই সমালোচনা করেন যারা পৃথিবীকে বৈচিত্র্যের জন্য নিরাপদ করে গড়ে তোলার প্রয়োজন মনে করেন না। আমি আশ্চর্য হই এবং ভাবি তারা কি কখনো কখনো নিজেদের এই প্রশ্নটা করেছে! – সহাবস্থানের বিকল্প কী?
* নতুন শিক্ষা না এলে এই পৃথিবী পালটাবে না এবং শান্তিও আসবে না।
* সত্যের জন্য শ্রদ্ধা সকল ন্যায়পরায়ণতার ভিত্তির এক মূল্যবান নিয়ামক।
* আধুনিক যুদ্ধে জয়ী বা পরাভূত বলে কোনো বস্ত্ত নেই সেখানে শুধু বঞ্চিতরা থাকে – এবং মানবতা যারপরনাই ক্ষতিগ্রস্ত হয় … বা ভালো সাজিয়েছে তো … সত্যিই তো দেশজুড়ে একটা প্রতিবাদের দরকার আছে এই অসহিষ্ণুতার, মৌলবাদী ভাবনাচিমন্তার ও বিশ্বব্যাপী সন্ত্রাসের …
ফোনটা বাজছে … ফোনটা …
– হ্যালো …
– মি. বিষ্ণু স্পিকিং। কথা বলতে পারি ডা. মৌলিক। আমাদের ফ্লেক্স হোর্ডিং ব্যানারের কাজ কতদূর এগোল …
– কিছু ভাববেন না স্যার। ঠিক সময় শহরের ব্যস্ততম জায়গাগুলিতে ঝুলিয়ে দেওয়া হবে।
– ঝুলিয়ে দেবেন না যেন। হেঃ হেঃ সময় হবে? একটু বালিগঞ্জ ফাঁড়ি ঘুরে যাবেন?
– ম্যাডাম?
– না না ম্যাডাম আপনার বন্ধুর ওষুধে বলতে নেই অনেকটাই ভালো …
– বলতে নেই কেন … ডাকছেন কেন তবে!
– অন্য একটু ধান ভানতে হবে। আমার বন্ধু মি. রায়বর্মণের স্ত্রীর ব্যাপারে আপনার একটু সাজেশনস দিতে হবে। থাইল্যান্ড, মালয়েশিয়া বেড়াতে গিয়েছিল … ফিরেছে, ফিয়ার সাইকোসিস নিয়ে … জানেন তো ওদের কোনো ইস্যু নেই। বেচারা …
– আমার বন্ধুর কেস তো …
– আপনি একটু আসুন, ইন্টারেস্টিং … রায়বর্মণকে ডেকে নেব। আমরা একটা তথ্যসূত্র পেয়ে যাব বোধহয় …
– তথ্যসূত্র -?
– আপনার কাজের মিসিং লিঙ্ক।
মৃদঙ্গ বলল – ‘নাউ ইট ইজ ফাইভ থার্টি। সন্ধে সাড়ে ছটা বেজে যাবে কিন্তু স্যার!’
– আই অ্যাম ওয়েটিং … সিনিয়র অ্যাডভোকেট রায়বর্মণকে ডেকে নিচ্ছি তাহলে …
– পেশেন্ট?
– ওর বউ … বললাম তো, আগে আপনি আসুন তো … তারপর।
– ওকে স্যার –
হন্তদন্ত হয়ে পৌঁছে মৃদঙ্গ দেখে দুজনেই বসে আছেন। অ্যাডভোকেট রায়বর্মণ চিন্তিতমুখে গালে হাত দিয়ে বসে, মি. বিষ্ণু যথারীতি পাইপ ধরিয়ে ধোঁয়া ছাড়ছেন …
‘এই রায়বর্মণ কাগজটা দাও তো’, মহাবিষ্ণু বললেন।
রায়বর্মণের হাত থেকে একটা কাগজ প্রায় ছিনিয়ে নিয়ে জাস্টিস মহাবিষ্ণু বিষ্ণু মৃদঙ্গ মৌলিকের হাতে চালান করলেন। কাগজটা হাতে নিয়ে মৃদঙ্গ ফের দাঁড়িয়ে পড়ল, ইংরেজি হরফে অন্য ভাষালেখ – Asgar, bhaalmhor sain shiparsalell Saint rae mashihkyiunn aatwat ngarsai Saithoet eatsarr samee thoet nhong a bhaalshoet pyukya lim mai naee. চোখ বড় বড় করে মৃদঙ্গ মৌলিক বলে উঠল, ‘সবে তো ডিসেম্বর স্যার! তবে এই ভরসন্ধেতে এপ্রিল ফুল করা কেন খামোকা ডেকে এনে আমায় …’
পাইপটা নামিয়ে রেখে সহাস্য জাস্টিস বিষ্ণু বললেন, ‘আপনিই একা বাচ্চা ছেলের মতো শুধু টেলিফোনে যখন-তখন ‘মিঙ্কোছেতে’ বলতেন! আমরা কিছু করলেই দোষ। পাঠোদ্ধার করা হয়েছে স্যার। তথ্যসূত্র বলেছিলাম না … রায়বর্মণ কী বলেন মন দিয়ে শুনুন প্লিজ এবার।’ গম্ভীর রায়বর্মণ মস্নান হেসে শুরু করলো : ‘প্রথম লাইনে, আসগর বলে একটি শব্দ আছে নজর করেছেন?
বিব্রত মৃদঙ্গ বলল – ‘হু।’
রাতের দিকে অশোকনগর থেকে বিজয় ঘোষ আবার ফোন করে বলল – ‘শনিবার তুই আসতে পারবি?’
– কেন?
– আবার বলে কেন? বার্মিজটা মুম্বাই থেকে ফোন করেছিল – কাল দমদমে নামছে। তুই শনিবার আয় না অশোকনগরে …
– শনিবার হবেনারে। শনিবার, তুই জানিস তো কলকাতায় আমাদের একটা বড় মিটিং আছে। বাইরের লোকজন আসবে। তোকে বন্ধু কথা দিচ্ছি সব ঠিকঠাক থাকলে রোববার বিকেলে যাব – রাতে ফিরে আসব ওর সঙ্গে কথা বলে –
– রাতে তোমার ফেরা হবে না কিন্তু –
– আচ্ছা আগে পৌঁছই তো …
৫. ‘ওগো ভোলা ভালো তবে, কাঁদিয়া কী হবে মিছে আর’
মালাক্কা প্রণালি দিয়ে প্রমোদ তরণী ভেসে চলেছে। চার রাতের প্রমোদভ্রমণ। গতকাল ক্লাঙ্গ বন্দর থেকে যাত্রা শুরু হয়েছে। আজ বৃহস্পতিবার সন্ধ্যার একটু পরে আন্দামান সাগরের অনন্ত জলরাশির ভেতরে ঢুকবে রায়বর্মণ দে-র ক্রুজটি। ফুকেট আজ রাতে পৌঁছে যাবে।
মালাক্কা প্রণালি বেশ যানজমাট। দুদেশের মাঝের প্রণালিতে কত জাহাজ। সেঁজুতি রায়বর্মণের মনোকষ্ট লাঘব করার জন্যই এই ভ্রমণ। জীবনভর মিস ক্যারেজ, তারপর অর্থ জলাঞ্জলি দিয়ে ইনভিট্রো ফার্টিলাইজেশনের দু-দুবার ব্যর্থ প্রচেষ্টা। সত্যি কথা, এই ভ্রমণের নেপথ্যে সারোগেট জননী খোঁজার একটা সুপ্ত বাসনাও ছিল। দায়রা জজ সুহাসদা বলেছিলেন, ‘… থাক ওসব।’ মাঝখান থেকে সেঁজুতি ফিরে এলো ভীষণ মনোবেদনা নিয়ে, যার থেকে এই ভীতি-প্রাবল্য, এখন যা বাতিকের মতো হয়েছে।
বাঙালি হিসেবে সে প্রমোদভ্রমণে গর্বেরও হেতু ছিল। হঠাৎ সন্ধ্যায় রায়বর্মণ রাজেশ্বরী দত্তের গায়কিতে অনেকদিন বাদে রবীন্দ্রগানে আলোকিত হলো। গলায় রাজেশ্বরী দত্তের সেই দাপট … ভদ্রমহিলা বাংলাদেশের নাগরিক। শান্তিনিকেতনে নীলিমা সেনের কাছে তালিম নিয়েছেন – অনেক দিন। সেঁজুতির তো প্রায় চোখে জল এসে গিয়েছিল যখন শেষ চরণে এসে গলার সব মাধুর্য, আকুতি দিয়ে গাইছিলেন – কুঞ্জ দুয়ারে অবোধের মতো রজনী প্রভাতে বসে রব কত –
এবারের মতো বসন্ত গত জীবনে। সেঁজুতির অনেক কথা হয়েছিল ভদ্রমহিলার সঙ্গে। কলকাতায় পরের বছর এলে আড্ডার প্রতিশ্রম্নতি অবধি। ভদ্রমহিলার নামটিও ভারি সুন্দর – আম্না ফিরদৌসি পূরবী …
পরদিন সকালেই সমুদ্রসৈকতে সেঁজুতি রায়বর্মণের তাল কেটে গেল। সুরও। সমুদ্রসৈকতে নিঃস্ব-হয়ে-পড়া সেই রোহিঙ্গা রমণীর আর্তচিৎকারে। সংসার নিয়ে পালানোর সময় পাড়ের কাছে এসে তাদের শীর্ণ নৌকাডুবি হয়েছে।
মরা ছেলেটিকে বালির ওপর শুইয়ে দিয়ে সে আর্তস্বরে কাঁদছিল। দুটি মেয়ে তার কণ্ঠলগ্না, তাদের দশও পেরোয়নি … ভীত, সন্ত্রস্ত, বাক্যহারা – ভাষা না বুঝলেও পূরবী এবং সেঁজুতি মহিলার ইঙ্গিতে বুঝতে পেরেছিলেন, মেয়ে দুটিকে বাঁচাতে তিনি মা, যা খুশি তাই করতে পারেন। তার আর্তচিৎকারের অর্থ পর্যটকদের কেউ বুঝতে পেরেছিলেন তারপর লিখে দিয়েছিল। ওই কাগজটা তো মহিলা হাতে ধরে ছিল। মিসেস রায়বর্মণ পেয়েছেন?
– আসগর তুমি কোথায়? আসগর তোমার ছেলেমেয়েদের নিয়ে আমি এখন কী করব!
আসগর কে? মেয়ে দুটির, মৃত পুত্রসমন্তানের পিতা, মহিলাটির স্বামী … নাকি নিছকই অভিনিষ্ক্রমণ বণিক? মাইগ্রান্ট স্মাগলার। মহিলাটির চেনা … কিন্তু আসগর, আসগর বলে অবিরত কান্নাকাটির আর একটা মা সেও হতে পারে। স্বামীরতনটিও সুযোগ বুঝে সটকেছেন …
পুত্রকন্যাহীন সেঁজুতি রায়বর্মণ – মেয়ে দুটির দিকে যখন এগিয়ে গেলেন … নিরাপত্তারক্ষীরা পর্যটকদের কোনো কথাই শুনল না, তাদের সরিয়ে নিয়ে গেল … রীতিমতো বল প্রয়োগে! সাতদিন ধরে যারা পালিয়ে বেড়াচ্ছে একূল থেকে ওকূলে নিরন্ন অভুক্ত …
রায়বর্মণ মৃদঙ্গকে সেদিনের ঘটনা ব্রিফ করতে করতে ভাবলেন কী অমোঘ লাইন লিখেছেন প্রাণের ঠাকুর – ‘নয়নের জল ঝরিছে বিফল নয়নে …’
মৃদঙ্গ মৌলিক বলেছিল – ‘চলুন মিসেস রায়বর্মণকে দেখেই আসি।’ মহাবিষ্ণুর দিকে তাকিয়ে বলল সে তখন, ‘আপনিও যাবেন? স্যার!’
উঠে দাঁড়িয়ে মহাবিষ্ণু বললেন, ‘যাবো তো। মিসেস বিষ্ণুও যাবেন।’ তারপর মৃদঙ্গর দিকে তাকিয়ে দুষ্টু হাসি হেসে বললেন – ‘মিঙ্গোছেতে।’
৬. হিংসায় উন্মত্ত পৃথ্বী নিত্য নিঠুর দ্বন্দ্ব …
কত কিছুই আজ সাহেবের বক্তৃতা থেকে জানা গেল।
রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী হলো এক রাষ্ট্রহীন ইন্ডো এরিয়ান সম্প্রদায়ভুক্ত যারা মায়ানমারে (বার্মা) অবস্থিত রাখাইন প্রদেশে বসবাস করতো। ২০১৬-১৭ সংকটের আগে প্রায় দশ লাখ রোহিঙ্গা মায়ানমারে বাস করতো। ২০১৭-এর ডিসেম্বরের মধ্যে প্রায় ছয় লাখ পঁচিশ হাজার শরণার্থী সীমান্ত পেরিয়ে অন্যদেশে আশ্রয়ের সন্ধানে ঢুকে পড়েছে প্রাণভয়ে। এদের সংখ্যালঘু অংশ হিন্দু – রাষ্ট্রসংঘ রোহিঙ্গাদের পৃথিবীর চরম নির্যাতিত যন্ত্রণাগ্রস্ত সংখ্যালঘু সম্প্রদায় বলে ঘোষণা করেছে। ১৯৮২ সালের মায়ানমার নাগরিকত্ব আইনে রোহিঙ্গা জনজাতিগোষ্ঠীর নাগরিকত্ব অস্বীকার করা হয়েছে।
মানবাধিকার নিরীক্ষা মোতাবেক ১৯৮২-র আইন কৃতকার্যতার সঙ্গে রোহিঙ্গা জনজাতির নাগরিকত্ব লাভের সম্ভাবনাকে চূড়ান্তভাবে অস্বীকার করে অতি অন্যায়ভাবে রোহিঙ্গা জনজাতির ইতিহাসকে আটের শতক পর্যন্ত চিহ্নিত করতে সমর্থ হয়েও।
অর্থাৎ এই আইন মায়ানমারের সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠীকে অষ্টম জাতীয় স্বদেশীয় গোষ্ঠী (অরিজিনাল সেটলার) হিসেবে স্বীকার করে না। তাদের চলাচলের স্বাধীনতা খর্ব করা হয়েছে, পঠন-পাঠনের অধিকার এবং সরকারি চাকরি থেকে বঞ্চিত করা হয়েছে। সাহেব তার ভাষণে বলছেন, ‘দিস ইজ সিমিলার টু অ্যাপার্থিড! কারা না নিন্দে করেছেন? আন্তর্জাতিক শিক্ষাব্রতীরা, বিশেস্নষণকারীরা এবং স্বনামধন্য রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বরা, যাদের মধ্যে নোবেলজয়ী বিশপ ডেসমন্ড টুটুও আছেন!’
মি. জেমস বেল্টোর বেশ সুপুরুষ। বাগ্মী। মজার কথা সিগমুন্ড ফ্রয়েডের বেশ ভক্ত। শুরু করেছিলেন তাঁর উদ্ধৃতি দিয়েই। বললেন, ‘নাজিরা তাঁকেও রেয়াত করেনি। তাঁর বইপত্র পুড়িয়ে দেয়া হয়েছিল। তাঁকেও তাঁর দেশ ছাড়তে হয়েছিল। তাঁর দুই দিদি কনসেনট্রেশন ক্যাম্পেই মারা যান। অনাদিকাল থেকে একই জিনিস চলে আসছে।’ তিনি বললেন, ‘Mankind is now devoid of love and affection, nurturing now only cruelty sex and aggression. Little aggression is, however, required to thrive but it is now maldestined. Never the less, state violence, seclusion and social neglect creates chaos both in lifestyle and behavior.
If you have a desire to maintain a sovereign country – peace and communal harmony you will have to give-up atrocity and get rid of avidity for nepotism.’
বক্তাদের কথায় ঘুরেফিরে উনু এবং তাঁর বন্ধু উ থান্টের প্রসঙ্গ আসছিল। পরিতাপের বিষয়, এই তাদেরই দেশের রাষ্ট্রসংঘের তৃতীয় সচিবের মতবাদকে তারা তো এখন পাত্তাই দেয় না।
আর আমি চোখ বন্ধ করে সদলবলে পৃথিবীর সকল রাষ্ট্রহারা মানুষের প্রচরণ প্রক্রিয়া যেন দেখতে পাচ্ছি এখন। রোহিঙ্গারা ‘নৌকো মানুষ’ খেতাব পেয়েছে সংবাদমাধ্যমে। আমি দেখতে পাই মালাক্কা প্রণালির জলরাশির ভেতর দিয়ে, আন্দামান সমুদ্রে কিংবা বঙ্গোপসাগর ধরে উপকূলের দিকে ছুটছে ত্রস্ত, নিরন্ন, বিপন্ন নৌকো মানুষরা …
ফুকেটের সমুদ্রসৈকতে জননী হতে না পারা এক রমণী দুহাত বাড়িয়ে দিয়েছেন ক্রন্দনরত এক বিপন্ন রোহিঙ্গা রমণীর অভুক্ত কন্যাসমন্তানের দিকে … নিরাপত্তারক্ষীরা ওই যেন তাদের সরিয়ে নিয়ে যাচ্ছে …
রাষ্ট্রসংঘের শরণার্থী মহাধ্যক্ষ জানাচ্ছেন, ২০১৫ সালের জানুয়ারি থেকে মার্চ ২৫০০০ মানুষকে নৌকোয় তোলা হয়েছে, তুলেছে অবৈধ অভিপ্রয়াণকারীরা (মাইগ্র্যান্ট স্মাগলার)। যাত্রাপথে ১০০ মানুষ ইন্দোনেশিয়ায় মারা গেছে, ২০০ জন মালয়েশিয়ায়, দশজন থাইল্যান্ডে …
ওই রমণীর পুত্রসমন্তানটি কি ওই দশজনের মধ্যে পড়েছে …? না গণনার বাইরে!
অনুষ্ঠানটি ভালোই হয়েছে। দু-একটি বিক্ষিপ্ত ঘটনা ছাড়া। মাথায় ফিতে বাঁধা কিছু ছেলে এসে বিশ্ববিদ্যালয় আঙিনায় ঢুকে চড়া গলায় বলছেন, ‘কিসের মিটিং কাদের মিটিং আমরা খোঁজ নিতে এসেছি … আধপোড়া শহুরে নকশাল হলে … শালা পিটিয়ে …’ বাইরের লোকজন আছেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের সম্মানে জড়িয়ে আছে … মহাবিষ্ণুর স্নেহধন্য মুকুল ব্রহ্মকে দেখা গেল ঝামেলার দিকে ছুটে যেতে, ফিরে এসে চোখ টিপে বললেন, ‘পালাবেন না, মিটিংশেষে আপনাদের অ্যারেস্ট করে নিয়ে যাব -’
ভ্রূকুটি করে বললাম – ‘মানে?’
মুকুল হাসলেন, ‘স্যারের অর্ডার।’
প্রশ্নোত্তর পর্বেও দু-একটি বিপজ্জনক প্রশ্ন ছোড়া হয়েছিল সাহেবকে … সেসব প্রশ্ন আয়োজক এবং বক্তারা এড়িয়ে গিয়েছেন বুদ্ধিমত্তার সঙ্গে।
– নো অ্যানসার টু কমিউনাল কোশ্চেনস। কেউ বললেন, মুখ্যমন্ত্রী রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দেবেন বলে তো ঠিকই করেছেন।
ইয়েস আওয়ার কান্ট্রি ইজ এ সেক্যুলার ওয়ান। নানা ভাষা, নানা মত, নানা পরিধান বিবিধের মাঝে …
রামসহায় রায়বর্মণ সেদিন বলেছিলেন – ‘যোধপুরের লেখাটা দেখেছেন, হাজার হাত শান্তির হাত, মা দুর্গা নাকি হাজার হাতে শান্তি আনবেন? শান্তি না ঘণ্টা, সারাদেশ, এ বিপুল বিশ্ব অশান্ত নগরী হয়ে উঠছে।’
আমার মনে হলো সব হাতে তো তেলের বাটি, সব হাতই তো তোষামোদের –
বায়ে থেকে ডাইনে
সোনা এলে কোন আইনে
দাঁড়ে বসে পুচ্ছ দোলাও, তুমি
এবার পোষা ওদের
বললাম না। শুধু বললাম, ‘স্যার মিসেস রায়বর্মণকে ভর্তি করতে হবে। ভয়ের সঙ্গে সন্দেহপ্রবণতাও আছে। উনি ভয় পাচ্ছেন বাকি মেয়ে দুটোকেও যদি মেরে দেয় ওরা … সন্দেহ করছেন … ওনার মাতৃত্ব আন্তর্জাতিক মর্যাদা পাওয়ার মতো …।’ মহাবিষ্ণু রায়বর্মণকে আড়ালে ডেকে বলেছিলেন, ‘সব ঠিক হয়ে যাবে, তোমার নামেই তো রামসহায় আছে। চিমন্তা নেই। ডা. মৌলিক আছেন -’
রসিকতা করে জাস্টিস বিষ্ণু বলেছিলেন, ‘একদিন – মিনিয়েচার ডাঙ্কি অ্যাসোসিয়েশন? জানেন ড. মৌলিক রামসহায় ইচ্ছে করলে সারাশহর গাধায় ভরিয়ে দিতে পারেন। তোমার সেই … তিনজনে একসঙ্গে সেদিন হাতে হাত রেখেছিলাম প্রমিস।’
প্রজ্ঞার স্বর খুব নরম। কিন্তু এই কোমল ধ্বনিও বিশ্রামবিমুখ হয়ে থাকে। যতক্ষণ না সে শ্রম্নতি সমাদর পায়। জানেন, ঢিলের বদলে যে প্রথম মানুষটি অপমান ছুড়ে ছিলেন তিনিই সভ্যতার স্থপতি।
স্বপ্নের ব্যাখ্যাই আপনাকে মনের অনেক ক্রিয়াকলাপের জ্ঞানের রাজকীয় পথের সন্ধান দেবে।
জানেন তো, আপনার মন যেন একটি হিমশৈল সাত ভাগের এক অংশ জলের উপর রাখিয়া ইহা ভাসমান। মনে রাখবেন ব্যক্তিসত্তার স্বাধীনতা কোনো সভ্যতার দান নয়, স্বাধীনতা সব চাইতে বেশি ছিল কোনো সভ্যতা প্রতিষ্ঠার আগেই। প্রতি ‘মা’তেই দুর্গা? বেশ। এমন মিছিল বা গণজোয়ার কলকাতা, এ-শহর, আগে আর দেখেনি …
তারা আসছে। এখন প্রতি মানুষেই ‘না’, এখন মানুষ ললাটলিখন অগ্রাহ্য করে দেওয়াললিখন বেশ পড়ে … পুজো আসছে আবার …
আক্রমণের ঝোঁক বা প্রবণতা মানুষের একটি স্বাভাবিক জন্মগত সহজাত স্বাধীন মেজাজ বা সংস্কৃতি বা কৃষ্টির জন্য একটি শক্তিশালী প্রতিবন্ধকতা তৈরি করে –
পস্ন্যাকার্ড, ব্যানারগুলো দেখে মহাবিষ্ণু বিষ্ণু বললেন – ‘অপূর্ব! এবার ঝুলিয়ে দিন।’ রামসহায় বললেন, ‘কিছু তো ওখানেও লাগবে! – ইয়েস স্যার।’
আপাতত এগুলো এখানেই থাক। আর তাদের ব্যবস্থা? রামসহায়ের দিকে উৎসুক চোখে চাইলেন মহাবিষ্ণু।
– ‘লরি গতকালই কলকাতা রওনা হয়ে গিয়েছে।’ হে হে হাসলেন মহাবিষ্ণু। ‘ওদের যাতে কেউ আটকাতে না পারে তাই আমি পশুপ্রেমী অন্য সংগঠনগুলিকেও বলেছি -’
রাতে বিজয়কে ফোন করি আমি …
বিজয় ওপার থেকে হাউমাউ করে ওঠে। ‘আরে আমার ব্যাংক অ্যাকাউন্ট থেকে হাজার পঁচিশ টাকা হাপিস হয়ে গেছে -’
– হাউ? মার্বা এসেছে?
– না। মার্বার ফোনের আগে একটা মিসড কল ছিল।
– তুই ঘুরিয়ে ফোন করেছিলি?
– হ্যাঁ?
– বেশ মার্বা বলে যে তোকে ফোন করে কথা বলেছিল সে যদি আবার ফোন করে তুই ভিডিও কল করতে বলবি।
– বলেছি, করেনি – আর ফোন ধরি আমি …
নম্বরটা পুলিশকে জানিয়েছে – ও মার্বা নয়, গ-গোল আছে …
‘তোর মনে আছে আমাদের অনঙ্গর মাথায় একটা কাটা দাগ ছিল … সেই অশোকনগরে চৌরঙ্গিতে ওর মাথায় ওড়া ঢিল পড়েছিল … খোকাই ওকে হাসপাতালে নিয়ে গিয়েছিল।
– হ্যাঁ তো।
– তোমাকে জানাই, কালকে দমদমে একটা ছেলে ধরা পড়েছে। মাইগ্র্যান্ট স্মাগলার, ‘সি রবার’, ওর নামে অ্যালার্ট ছিল। ও ব্যাটা মালয়েশিয়া থেকে অন্যের ব্যাগ পাসপোর্ট হাতিয়ে পালাচ্ছিল – তুই পুলিশে যোগাযোগ কর। জানি না অনঙ্গটা কোথায় আছে!
এ-শহর এমন মিছিল আগে কখনো দেখেনি। পশুপ্রেমী সংগঠনের মানুষরা নানা মুখোশ পরে সামনে। পেছনে সহস্রাধিক গাধার মিছিল। সামনেই গাধা সাজা একটি পুরুষের হাতে একটি পস্ন্যাকার্ড – সে আমার অন্তরান্তা – সেখানে লেখা অবিলম্বে আন্তর্জাতিক গর্দভ দিবস চাই। মেট্রো চ্যানেলের সামনে সহস্রাধিক গর্দভ একসঙ্গে ডেকে উঠল।
মহাবিষ্ণু আমার কানের কাছে ফিসফিস করলেন, ‘রামসহায়ের ক্ষমতা দেখলেন। এ শহরে এত গর্দভ তো ছিল না …’
– আছে আছে। বাকিটা মি. রায়বর্মণের বাহাদুরি।’
মহাবিষ্ণু হেসে উঠলেন, ‘আপনি একটা মিথ্যে বলেছেন কিন্তু। বলছেন প্রজ্ঞার স্বর মোলায়েম?’ আবার গাধারা ডেকে উঠল।
– আমি তো বলিনি। ওটা মহামতি ফ্রয়েডের কথা।
Leave a Reply
You must be logged in to post a comment.