খুব সাম্প্রতিককালে প্রমদাচরণ সেনের (১৮৫৮-৮৫) মতো নিবেদিতপ্রাণ শিশুসাহিত্যিকের নাম মাঝেমধ্যে উল্লিখিত হয় তাঁর সম্পাদিত ছোটদের পত্রিকা সখা সূত্রে। বলা হয়, সখা ছোটদের একটি ভালো পত্রিকা ছিল। কিন্তু সেই সূত্রেও তাঁর দেশপ্রেম, তাঁর স্বাপ্নিকতা, তাঁর শিশুপ্রেম – সর্বোপরি তাঁর মানবিকতা নিয়ে হয়নি বিস্তারিত অবহিতির কোনো বড় আয়োজন। জানা যায়, তাঁর একটি ছোট জীবনীও প্রকাশিত হয়েছিল; কিন্তু সেটিও আজ দুষ্প্রাপ্য। স্বল্পায়ু এই মানুষটির একটি কর্ম ও মূল্যায়নভিত্তিক সম্পন্ন জীবনী আজো রচিত হয়নি। তাঁর সম্পাদিত সখা পত্রিকটি এখনো বাংলা শিশুসাহিত্যে প্রাসঙ্গিক থাকা সত্ত্বেও পুরোটা সংকলিত হয়নি। চাইলেও সহজে গবেষকেরা সখা দেখে তাঁর সম্পর্কে আলোচনা করতে পারবেন না। যেন ইতিহাসের অস্পষ্ট রেখা ধরে কখনো-সখনো বাংলা শিশুসাহিত্য প্রসঙ্গে তাঁর নাম উচ্চারিত হলেও কারো সময় হয়ে ওঠেনি তাঁর অবদান সম্পর্কে বিস্তারিত অনুসন্ধানের। বাংলাদেশে কেবল শিশুসাহিত্যিক ও শিশুসাহিত্য-গবেষক আতোয়ার রহমান আস্ত একটি প্রবন্ধ লিখে তাঁকে স্মরণ করেছিলেন তাঁর রচিত বইয়ে (রহমান, ১৯৯৮)। তিনি প্রমদাচরণ সম্পর্কে যখন লেখেন, তখন তাঁর সম্পর্কে তথ্যাদি ছিল আরো দুষ্প্রাপ্য। সখা পত্রিকার পাতা উলটে উলটে স্বচক্ষে দেখেছেন এমন মানুষও ছিল বিরল। আতোয়ার রহমানও তাঁর প্রবন্ধে জানিয়েছিলেন,
… তাঁর নাম এদেশের কেউ তেমন জানেন বলে মনে হয় না। কিছু খবর রাখেন, শ্রদ্ধেয় ব্যতিক্রম রূপে, কেবল দু’চারজন কৌতূহলী মনীষী, যাঁরা আধুনিক বাংলা শিশুসাহিত্যের ইতিহাস নিয়ে নাড়াচাড়া করেন। … যে অল্প সংখ্যক কৃতী পুরুষ আধুনিক বাংলা শিশুসাহিত্যের সামনে যৌবনের দ্বার খুলে দেন, তিনি তাঁদেরই একজন। …
পূর্বোক্ত ভাষ্যের পর বিশ বছর অতিক্রান্ত হলেও পরিস্থিতির তেমন উন্নতি হয়নি। বাংলাদেশে আরো কেউ কেউ তাঁর সম্পর্কে দু-এক লাইন লিখলেও তাঁকে নিয়ে পূর্ণাঙ্গ প্রবন্ধ লিখেছেন এমনটি বর্তমান লেখকের কাছে অজ্ঞাত রয়ে গেছে। বাংলাদেশের শিশুসাহিত্যভুবনে প্রমদাচরণ সেন এখনো প্রায় একই রকম প্রায়-অজ্ঞাত একটি নাম। প্রসঙ্গত, এখানে পশ্চিমবঙ্গের সাহিত্য-গবেষক অরুণা চট্টোপাধ্যায়-সম্পাদিত সখা, সখা ও সাথীর রচনা-সংকলনটির (চট্টোপাধ্যায়, ১৯৯৬) কথা উলেস্নখ না করলেই নয়। তিনি গবেষণাসূত্রে সখার প্রথম দুই বর্ষের সব সংখ্যা একত্রে সংকলিত করায় মূল পত্রিকা না দেখেও পত্রিকাটির প্রথম দুই বছর সম্পর্কে অনেকটাই সম্পন্ন ধারণা করা যাচ্ছে। প্রমদাচরণ সম্পর্কে বেশকিছু তথ্যও একত্র করেছেন তিনি ওই বইয়ে। এর জন্য শিশুসাহিত্যের গবেষক হিসেবে তাঁর প্রতিও সবসময় কৃতজ্ঞতা জানাতে হবে আমাদের। সখার তৃতীয় বর্ষ ও পরবর্তী সংখ্যাগুলো এবং সখা ও সাথীর সব সংখ্যার লেখাগুলো সংকলিত হয়ে প্রকাশিত হওয়ার কথা থাকলেও পরে প্রকাশিত হয়েছিল কিনা তাও বর্তমান লেখকের পক্ষে জানা সম্ভব হয়নি।
দুই
উনিশ শতকের মাঝামাঝি সময়ে ইয়োরোপে সৃষ্টিশীল শিশুসাহিত্যের উদ্ভবের কাছাকাছি সময়ে বাংলায়ও শিশুসাহিত্য নিয়ে ভাবনার শুরু। ওই শতাব্দীর শুরু থেকেই ছোটদের জ্ঞানাগ্রহী ও নীতিনিষ্ঠ করে তুলতে চেয়ে কয়েকটি পত্রিকা-প্রকাশনার সূচনা ঘটে। এর মধ্যে রয়েছে বাংলাভাষার প্রথম শিশুদের জন্য পত্রিকা দিগ্দর্শন (১৮১৮); এর কাছাকাছি সময়েই বের হয় পশ্বাবলী (১৮২২); আরো পরে একে একে বের হয় জ্ঞানোদয় (১৮৩১), বিদ্যাদর্পণ (১৮৫৩), সত্যপ্রদীপ (১৮৬০), অবোধবন্ধু (১৮৬৩), জ্যোতিরিঙ্গণ (১৮৬৯), বালকবন্ধু (১৮৭৮) প্রভৃতি ছোটদের পত্রিকা (মাযহার, ২০১৬)। পত্রিকাগুলোর মধ্যে পশ্চিমবঙ্গের গবেষক স্বপন বসুর সম্পাদনায় সত্যপ্রদীপ (২০১৪?) পত্রিকায় প্রকাশিত রচনার সংকলন-গ্রন্থরূপ ছাড়া একটিও স্বচক্ষে দেখার সুযোগ হয়নি বর্তমান লেখকের। তবে কেশবচন্দ্র সেন-সম্পাদিত বালকবন্ধু সম্পর্কে আতোয়ার রহমান জানাচ্ছেন (রহমান, ১৯৯৬),
… তার ভাষা, বিষয়গত বৈচিত্র্য, সম্পাদনার কৌশল এবং প্রকাশনার পরিপাট্য বাংলা শিশুসাহিত্যকে সার্বিক আধুনিকতা তথা বিকাশের দোরগোড়ায় পৌঁছে দেয়। …
শিশুসাহিত্য প্রাসঙ্গিক ইতিহাস-সংক্রান্ত সকল বইয়েই এ-কথা বলা হয়েছে যে, পূর্বোক্ত পত্রিকাগুলোতে ছোটদের উপযুক্ত লেখা প্রকাশ করার চেষ্টা প্রধান হলেও পরিণত বয়স্কদের উপযোগী রচনাও স্থান পেত। যে-ধরনের গুরুগম্ভীর ভাষায় লেখা রচনা প্রকাশিত হতো ছোটদের কতটা তা আকৃষ্ট করতে পারত তা বলা শক্ত। এসব সীমাবদ্ধতা সম্পর্কে সচেতন থাকা সত্ত্বেও উপর্যুক্ত পত্রিকাগুলো প্রকৃত ছোটদের পত্রিকা হয়ে উঠতে পারেনি। ১৮৮৩ সালের ১ জানুয়ারি প্রমদাচরণ সেনের সম্পাদনায় প্রথম ছোটদের পূর্ণাঙ্গ মাসিক পত্রিকা সখা আত্মপ্রকাশ করে। ছোটদের জন্য প্রথম সৃজনশীল এই বাংলা মাসিক পত্রিকা সখার সূত্রে বাংলা শিশুসাহিত্যের আধুনিকতার উদ্ভবের সঙ্গে প্রমদাচরণ সেনের নাম যেমন জড়িয়ে থাকবে, তেমনি উল্লিখিত হতে থাকবে আত্মত্যাগের সূত্রেও।
কিন্তু এতটা নৈর্ব্যক্তিকভাবে দেখার মতো ব্যাপার নয় এই ঘটনাটি। একজন মহৎপ্রাণ মানুষের কতটা আত্মত্যাগের বিনিময়ের প্রাপ্তি ছিল এই সখা পত্রিকা তা অনুসন্ধান করতে গেলে যে-কারো অন্তর বেদনায় ভারাক্রান্ত হয়ে উঠবে। ছোটদের প্রতি প্রমদাচরণের ভালোবাসার এক মহান দৃষ্টান্ত ছিল পত্রিকাটি।
তিন
সখার সম্পাদক প্রমদাচরণ সেনের ত্যাগ ও সাধনা শিবনাথ শাস্ত্রীর মতো মানুষের কাছ থেকে যে শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা আদায় করে নিয়েছিল তার পরিচয় পাওয়া যাবে তাঁর লেখা আত্মচরিত (শাস্ত্রী, ১৯১৮) গ্রন্থে :
… প্রমদা হেয়ার স্কুলে আমার কাছে পড়িত এবং সে সময়ে আমি ছাত্রদিগকে লইয়া যে সমস্ত সভা-সমিতি করিতাম তাহাতে উপস্থিত থাকিত। সেই সময় হইতে সে আমাকে পিতার ন্যায় ভালবাসিত এবং সবর্ববিষয়ে আমার অনুসরণ করিত। ধর্ম্মপুত্র কথাটি যদি কাহারও প্রতি খাটা উচিত হয়, তাহা হইলে বলা যায় যে প্রমদা আমার ধর্ম্মপুত্র ছিল। ইহার পরে সে ব্রাহ্মসমাজে প্রবিষ্ট হয় এবং আমার বাড়ীর ছেলের মতো হয়। সিটি স্কুল স্থাপিত হইলে সে তাহার একজন শিক্ষক হইয়াছিল। সে উদ্যোগী হইয়া অপর কয়েকজন যুবক বন্ধুকে লইয়া সিটি স্কুল ভবনে বালকদিগের জন্য একটি নীতিবিদ্যালয় স্থাপন করে। …
মৃত্যুর পর শিক্ষক ও পত্রিকার পরবর্তী এক বছরের সম্পাদক শিবনাথ শাস্ত্রী তাঁর অতিপ্রিয় ছাত্র সম্পর্কে স্মৃতিচারণ করে ১৮৮৫-র জুলাই সংখ্যা সখায় লিখেছিলেন (চট্টোপাধ্যায়, ১৯৯৬),
এই সখার জন্য তিনি কত খাটিয়াছিলেন, আমরা স্বচক্ষে দেখিয়াছি। না খাইয়াও ইহার জন্য টাকা জমান, রাত্রি জাগিয়া পড়া, ইহার ছবি যোগাড় করিবার জন্য ঘুরিয়া বেড়ান, এই করিতে করিতে তাঁহার শরীর শীর্ণ হইয়া গিয়াছিল। এই সখা তিনি যখন বাহির করিলেন তখন অনেকে তাঁহাকে বলিয়াছিলেন যে, এ কাগজ টিকিবে না, ইহা চালাইলে ক্ষতি হইবে, এ কাগজ ভাল হইবে না, এমন কি তাঁহার অনেক বন্ধু বান্ধবে তাঁহাকে নিরাশ করিয়াছিলেন; কিন্তু তিনি যে কাজ ভাল বলিয়া বুঝিতেন তাহা সহজে ছাড়িতেন না। তিনি কাহারও কথায় ভয় না পাইয়া ইহার উন্নতির জন্য মন প্রাণ সমর্পণ করিলেন এবং অবশেষে উন্নতি করিয়া তুলিলেন।
সখা বের হওয়ার পর ১৮৮৩ সালে প্রথম সংখ্যা হাতে পেয়ে বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় উচ্ছ্বসিত হয়ে লেখেন (চট্টোপাধ্যায়, ১৯৯৬),
সখা পড়িয়াছি। সকল পড়ি নাই, কিন্তু যতদূর পড়িয়াছি তাহাতে বিশেষ প্রীতি লাভ করিয়াছি। সখা প্রধানত বালক বালিকাদের সহায় বটে কিন্তু এ সখার সাহায্য অনেক পলিত কেশ বৃদ্ধের পক্ষেও অনবলম্বনীয় নহে। বালক বালিকার এমন সদ্বন্ধু অতি দুর্লভ। এই পত্রের রচনা অতি সরল, বিষয়গুলি জ্ঞানগর্ভ, রুচি মার্জিত। … আপনি যশস্বী এবং কৃতকার্য্য হউন জগদীশ্বরের নিকট প্রার্থনা করি।
মৃত্যুর শতাধিক বছর পর বাংলা শিশুসাহিত্যের অনুসন্ধানী গবেষক পার্থজিৎ গঙ্গোপাধ্যায়ের কাছে তাঁর আত্মত্যাগ কতটা মর্মস্পর্শী হয়ে উঠেছিল এবং তাঁর প্রতি তিনি কতটা শ্রদ্ধা অনুভব করেছেন তার পরিচয় পাওয়া যাবে তাঁর নিম্নোদ্ধৃত উক্তি থেকে (গঙ্গোপাধ্যায়, ২০১০),
… কোনো সাহায্য না-পেয়ে শেষে নিজের দৈনন্দিন খরচে যথেচ্ছ কাটছাঁট করেন। নিজের ন্যূনতম প্রয়োজন মেটাতেও তাঁর অনীহা। নিজেকে কষ্ট দিয়ে, না-খেয়ে, কম খেয়ে সামান্য অর্থ প্রতিদিন সঞ্চয় করতে পারলে একদিন ঠিকই পত্রিকা প্রকাশের মতো অর্থের সংস্থান হয়ে যাবে, এ বিষয়ে প্রমদাচরণ ছিলেন স্থির নিশ্চিত, দৃঢ় প্রত্যয়ী। …
চার
১৮৫৯ সালের ১৮ মে কলকাতার এন্টালিতে জন্ম নেওয়া প্রমদাচরণের বাবা ছিলেন এন্টালি থানার দারোগা। যশোর জেলার সেনহাটি গ্রামের পাঠশালায় তাঁর শিক্ষাজীবন শুরু। ছোটবেলায় অত্যন্ত দুরন্ত ও ডানপিটে স্বভাবের ছিলেন। পড়াশোনায় মন তেমন ছিল না বলে প্রায়ই শিক্ষক ও গুরুজনদের শাসনের মুখে পড়তে হতো তাঁকে। ডানপিটে ছেলেদের সঙ্গে চলাফেরার সূত্রে নানা অপকর্মে যুক্ত হয়ে পড়ায় প্রায়ই তিনি স্কুলে এবং নিজের বাড়িতে বকুনি এবং মার খেতেন। মাত্র সাত বছর বয়সে মাতৃহারা হওয়ায় চিরদিনের জন্য মাতৃসুখ থেকে বঞ্চিত হন। হয়তো এ-কারণে একটা বিদ্রোহী ভাব দেখা দেয় তাঁর ব্যক্তিত্বে। ১২ বছর বয়স পর্যন্ত দিনকাল তাঁর এভাবেই কাটছিল।
১৮৭২ সালে গ্রামের স্কুল থেকে ছাত্রবৃত্তি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে সে-বছরই ভর্তি হন কলকাতার হেয়ার স্কুলে। ব্রাহ্মসমাজের শিবনাথ শাস্ত্রীকে সেখানেই শিক্ষক হিসেবে পান প্রমদাচরণ। নানা জনহিতকর কাজে তিনি যুক্ত হন শিক্ষক শিবনাথ শাস্ত্রীর অনুপ্রেরণায়। মাদ্রাজে একবার ভীষণ দুর্ভিক্ষ হলে শিবনাথ শাস্ত্রীর আহবানে প্রমদাচরণ চারশো টাকা সংগ্রহ করে দিয়েছিলেন। ১৮৭৬ সালে প্রমদাচরণ কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বৃত্তিসহ এন্ট্রান্স পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। ভর্তি হন প্রেসিডেন্সি কলেজের এল.এ ক্লাসে। সে-সময় শিক্ষক শিবনাথ শাস্ত্রীর দ্বারা এতটাই গভীরভাবে প্রভাবিত হয়ে পড়েন যে, তিনি ব্রাহ্মসমাজে যোগ দেন। রক্ষণশীল সমাজের অনুসারী তাঁর বাবা এর প্রতিক্রিয়ায় তাঁকে ত্যাজ্যপুত্র করেন। বাড়ি থেকে চলে যেতে হয় তাঁকে। কলেজে পড়ার খরচ বন্ধ হয়ে যায়। বিলেতে উচ্চশিক্ষা গ্রহণ করতে যাবেন – এমন একটা সুপ্ত বাসনা ছিল; সে-লক্ষ্যেই ভর্তি হয়েছিলেন সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজে। প্রস্ত্ততি নিতে থাকেন গিলখ্রিস্ট পরীক্ষার। পাশাপাশি সে-সময়ই শিখতে শুরু করেন লাতিন এবং ফরাসি ভাষাও। ১৮৭৮ সালে এল.এ পরীক্ষা দেন তিনি। একটি উত্তরপত্র জমা দিতে দেরি হওয়ার অজুহাতে পরীক্ষক তাঁর উত্তরপত্রটি ছিঁড়ে ফেললে এল.এ পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতে পারেননি। পরের বছর গিলখ্রিস্ট পরীক্ষায় তিনি তৃতীয় স্থান অধিকার করলে তাঁর ভাগ্যে বৃত্তি জোটেনি। তবে বিলেত যাওয়ার আশা তখনো শেষ হয়ে যায়নি তাঁর। কলকাতায় বসেই লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয়ের বি.এ পরীক্ষা দেওয়ার জন্য আবেদন করেন। লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয়ের আপত্তি না থাকলেও কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় সম্মতি দেয়নি বলে তাঁর পক্ষে আর বি.এ পরীক্ষা দেওয়াই সম্ভব হয়ে ওঠেনি।
বাড়ি থেকে অর্থসাহায্য বন্ধ হওয়ায় প্রমদাচরণ অনেকটা বাধ্য হয়েই চাকরির জন্য চেষ্টা করতে থাকেন। একপর্যায়ে চবিবশ পরগনায় নকিপুর এন্ট্রান্স স্কুলের প্রধান শিক্ষক পদে চাকরি পান। কিন্তু স্কুলটিই কিছুদিন পরে উঠে যায়। উপায়ান্তর না পেয়ে এ-সময় তিনি ৫০ নম্বর সীতারাম ঘোষ স্ট্রিটের ব্রাহ্মসমাজের ভবনে আশ্রয় নেন। এখানেই সঙ্গী হিসেবে পান পরবর্তীকালে ছোটদের বিখ্যাত পত্রিকা সন্দেশ-খ্যাত উপেন্দ্রকিশোরকে; পরিচয় ঘটে গগনচন্দ্র হোম (১৮৫৭-১৯২৯), হেমেন্দ্রমোহন বসু (১৮৬৬-১৯১৬), পরেশনাথ সেন (?), মথুরানাথ নন্দী (?) প্রমুখ ব্যক্তির সঙ্গে। এরপর তিনি সিটি কলেজিয়েট স্কুলের অতিরিক্ত শিক্ষক পদে যোগদান করেন। স্কুলের ছোট ছোট ছেলেমেয়ের সঙ্গে তাঁর সখ্য গড়ে ওঠে। তখনই তিনি উপলব্ধি করেন, এদের চরিত্র ও সুস্থ মানসিকতা গঠন করার প্রয়োজনীয়তা। রাজনীতিক বিপিনচন্দ্র পাল (১৮৫৫-১৯৩২) তাঁর সম্পর্কে লিখেছিলেন,
শিশুদিগকে প্রমদা এরূপ ভালবাসিতেন, নানা গল্প ও নানা আমোদে তাহাদের হৃদয় জয় করিতে এমন পারিতেন যে, এই বিষয়ে তাঁহার মত লোক আমরা আর বড় দেখিতে পাই নাই।
মাসিক ২৬ টাকা বেতনের উলেস্নখযোগ্য অংশ তিনি শিশুকল্যাণের জন্য ব্যয় করতেন। শিশুদের জন্য একটি নিজস্ব আনন্দময় পরিবেশ ও পরিসর গড়ে তোলার উদ্দেশ্যে তিনি স্থাপন করেন রবিবাসরীয় নীতি বিদ্যালয়। এরই একটি সমাবেশে তিনি মাসিক শিশু পত্রিকা সখা প্রকাশ করার ইচ্ছা প্রকাশ করেন। সখা প্রকাশের জন্য অনেকের কাছে অর্থসাহায্য চেয়েও পাননি। অনেকদিন ধরে কৃচ্ছ্র সাধন করে জমানো নিজের অর্থ ব্যয় করে পত্রিকাটির প্রথম সংখ্যা তিনি প্রকাশ করেন ১৮৮৩ সালের ১ জানুয়ারি। মুদ্রণের কাজ হয়েছিল ‘ব্রাহ্মসমাজ যন্ত্রে’। পত্রিকার আখ্যাপত্রে লেখা থাকত Child is father of the man। আখ্যাপত্রের ছবিটিও এঁকেছিলেন তিনি নিজেই। সখাকে ছোটদের কাছে আকর্ষণীয় ও সুসজ্জিত করে তুলতে প্রমদাচরণের কী প্রাণান্ত চেষ্টাই না ছিল! সখা পত্রিকায় তিনি ‘ড্রপ লেটার’ (Drop letter) ব্যবহার করেছিলেন। ইংল্যান্ডে ভিক্টোরীয় যুগে প্রথম এই রীতি চালু হয়। প্রতিটি রচনার প্রথম বর্ণ অলংকৃত ও বড় আকারের হয়ে থাকে। পরের হরফগুলি সাজানো হয় স্বাভাবিক নিয়মে। সখায় প্রথম বর্ণটি তৈরি করা হতো কাঠে খোদাই করে এবং অন্যগুলো সাজানো হতো যথানিয়মে ধাতুনির্মিত হরফে। ছোটদের কাছে যথেষ্ট আকর্ষণীয় করে তোলার এটি ছিল অন্যতম উদাহরণ! সম্পাদক প্রমদাচরণ সম্পর্কে সংক্ষেপে চমৎকার মূল্যায়ন করেছেন খগেন্দ্রনাথ মিত্র (মিত্র, ১৯৯৯) :
প্রমদাচরণ ছিলেন উদার ও বাস্তব দৃষ্টিভঙ্গিসম্পন্ন। তাঁর রচনায় ও সমগ্র পত্রিকাখানিতে তার প্রচুর পরিচয় মেলে। আর, তাঁর রুচিও ছিল উন্নত। চাষি, অনুন্নত শ্রেণি ও দরিদ্রের প্রতি তাঁর দরদ ছিল গভীর। তাদের সম্বন্ধে সখার সুকুমারমতি পাঠকমহলকে সচেতন করা ছিল তাঁর অন্যতম লক্ষ্য। [পৃ ১৬]
প্রমদাচরণের আরেক বন্ধু গগনচন্দ্র হোম তাঁর স্মৃতিকথায় লিখেছেন,
প্রমদাচরণ সুলেখক ও সুবক্তা ছিলেন। একদিন হিন্দু স্কুলের থিয়েটারে ছাত্রদের নিকট বক্তৃতা করিয়া আসিয়াছেন; সেইদিনই গভীর রাত্রিতে প্রমদাবাবু আমার ঘরের দরজায় আসিয়া ডাকিলেন – শীঘ্র উঠে আসুন। যাইয়া দেখি তাঁহার রক্তবমন হইতেছে। পরদিন সকালে সংবাদ পেয়ে শিবনাথ শাস্ত্রী এলেন। ডাক্তার করুণাচন্দ্র সেন প্রমদাচরণের বুক পরীক্ষা করে এবং রক্ত দেখে বললেন, এ রোগ সারবার নয়।
চিকিৎসা চলল, জলবায়ু পরিবর্তন করা হলো। পরেশনাথ সেন, কালীপ্রসন্ন দাস, উপেন্দ্রকিশোর রায় এবং গগনচন্দ্র হোম পালা করে রাত জেগে প্রমদাচরণের সেবা করতেন। কিন্তু স্বদেশহিতৈষী যুবক প্রমদাচরণকে কিছুতেই বাঁচানো গেল না।
পাঁচ
সখার বার্ষিক মূল্য ছিল এক টাকা; প্রকাশিত হতো ৫০ সীতারাম ঘোষ স্ট্রিট থেকে। মুদ্রণ হতো ব্রাহ্মসমাজ যন্ত্রে, ৮১ নং বারাণসী ঘোষ স্ট্রিটে। ছোটদের মধ্যে উচ্চ আদর্শ বোধ জাগিয়ে দেওয়ার জন্যই যে প্রমদাচরণ সখা প্রকাশ করার পরিকল্পনা করেছিলেন তার পরিচয় পাওয়া যায় সখার প্রথম ভাগ অর্থাৎ প্রথম বর্ষের প্রথম সংখ্যার শুরুতেই ‘প্রস্তাবনা’ অংশে। তিনি লিখেছিলেন,
এতদিন পরে ‘সখা’ প্রকাশিত হইতে চলিল। এইরূপ পত্রিকা আমাদের দেশে নাই বলিয়াই আমরা এই পত্রিকাখানি প্রকাশ করিবার ইচ্ছা করিয়াছিলাম। আমাদিগের হতভাগ্য দেশে বালকবালিকাদিগের জ্ঞানের ও চরিত্রের উন্নতির জন্য অধিক লোক চিমত্মা করেন না; অথবা করিবার অবকাশ হয় না, এই জন্যই ‘সখা’র জন্ম হইল। ‘সখা’ পিতামাতার উপদেশ ও শিক্ষকদের শিক্ষা দুইই প্রদান করিবে। যাহাতে বালকবালিকারা বাস্তবিক মানুষ হইতে পারেন, তজ্জন্য ‘সখা’র লেখক ও লেখিকাগণ প্রাণপণে চেষ্টা করিবেন – ফলতঃ যাহাতে পত্রিকাখানির সখা এইনাম সার্থক হয়, সে দিকে সকলেরই দৃষ্টি থাকিবে।
লেখা বা ধাঁধার উত্তরদানের ওপর নির্ভর করে পুরস্কারের ব্যবস্থাও করা হয়েছিল। তখন পর্যন্ত এই ধারণা ছিল নতুন। ছোটদের প্রশ্নশীল মনকে উস্কে দেওয়ার পথও খোলা রেখেছিলেন তিনি। কোনো বিষয় নিয়ে মতামত লেখার ব্যবস্থাও ছিল। ‘প্রস্তাবনা’ অংশে এ-প্রসঙ্গে লেখা হয়েছে :
বালকবালিকাদিগের নিকটেও আমাদের একটি নিবেদন আছে; তাঁহারা যদি তাঁহাদের যখন যে কোন বিষয় জানিবার ইচ্ছা হয়, আমাদিগকে জিজ্ঞাসা করিতে পারেন, তাহা হইলে আমরা প্রত্যেক বিষয়ে যতদূর সম্ভব সদুত্তর দিতে চেষ্টা করিব। ইহাতে বালকবালিকাদিগের উপকার হইবার সম্ভাবনা। তাঁহাদের নিকট আরও একটি কথা এই যে, তাঁহাদের রচনাশক্তি এবং চিমত্মাশক্তি বাড়াইবার জন্য আগামী মাস হইতে এই পত্রিকার মধ্যে খানিকটা স্থান নির্দ্দিষ্ট থাকিবে; তাঁহারা ইচ্ছা করিলে যে কোন বিষয়ে আলোচনা করিতে পারিবেন।
সখা যখন প্রকাশিত হয়, সরলাদেবী চৌধুরাণী তখন ছিলেন নিতান্তই বালিকা। পরে তিনি জীবনের ঝরাপাতা (১৯৫৭) স্মৃতিগ্রন্থে লিখেছিলেন,
সে সময় ‘সখা’ নামে বালকবালিকাদের জন্যে মাসিক পত্রিকার একটি কবিতা প্রতিযোগিতা ঘোষিত হল। মা উৎসাহ দেওয়ায় আমি সেই প্রতিযোগিতার জন্যে দাঁড়ালুম। নির্দিষ্ট বিষয়ে কবিতা রচনা করে সখা-অফিসে পাঠিয়ে দিলুম। ফার্স্ট আমিই হলুম, প্রাইজ পেলুম একখানা ইংরেজি ‘ক্লাসিকাল ডিকশনারি’, যত প্রাচীন গ্রীক ও রোমান মাইথলজির। প্রকাশ্যে রচনায় এই আমার হাতে খড়ি। … ‘সখা’ আমাদের সত্যিকার সখা ছিল তখন। দুপুরবেলা ঘরের ভিতর বিশ্রাম করতে করতে তার সব রচনা পড়ে পড়ে আমায় রচনা চাপল। দুতিন দিন ধরে অন্যদের লুকিয়ে দু-একটা ছোট গল্প লিখলুম।
সখা হয়তো এরকম আরো অনেককে লিখতে প্রবুদ্ধ করেছে।
ছয়
বাংলা ভাষায় লেখা প্রথম কিশোর-পাঠ্য মৌলিক উপন্যাস ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হয়েছিল সখার পাতায়; লিখেছিলেন সম্পাদক প্রমদাচরণ সেন নিজে, নাম ভীমের কপাল। ১৮৮৩ সালে সখা পত্রিকার প্রথম সংখ্যা থেকে শুরু করে ১০ সংখ্যা ধরে তিনি উপন্যাসটি লেখেন (চট্টোপাধ্যায়, ১৯৯৬)। ভীমের কপাল উপন্যাসের কাহিনি গড়ে উঠেছে বাংলার গ্রামীণ জীবনকে কেন্দ্র করে, অনেকটা লেখকের নিজের জীবনকে ভিত্তি করে। উদার জীবনবোধসম্পন্ন এই উপন্যাসে বলা হয়েছে মানুষের মধ্যে সম্পর্কের সৌহার্দ্যের কথা, ঘটি-বঙালের মধ্যকার
ঘৃণা-বিদ্বেষের বিরুদ্ধে মানবিক দৃষ্টিভঙ্গি প্রকাশ পেয়েছে এতে। একটি বিপথগামী কিশোর এর কেন্দ্রীয় চরিত্র। সে বিচিত্র ঘটনাবলির মধ্য দিয়ে ধীরে ধীরে সৎপথে ফিরে আসে। সত্যিকারের বাস্তব জীবন যাপনের মধ্য থেকেই মনুষ্যত্বের বোধ জাগিয়ে তোলা ভীমের কপাল উপন্যাসের অন্যতম উদ্দেশ্য ছিল। যদিও প্রমদাচরণ তাঁর রচনাটিকে আনন্দময় করে তুলতেই চেয়েছিলেন তারপরও উন্নত মূল্যবোধের প্রতি উজ্জীবিত আগ্রহ ছিল এই উপন্যাসের অন্যতম অভিপ্রায়! এটি লেখক-সম্পাদিত সখা পত্রিকার সম্পাদকীয় নীতি অনুযায়ী রচিত হয়েছিল। সখায় প্রকাশিত রচনাগুলোর উদ্দেশ্য ছিল সাহিত্যরস পরিবেশনের পাশাপাশি শিশু-কিশোরদের চরিত্রের বিকাশ ও জ্ঞানের বিস্তার ঘটানো। ভীমের চরিত্র সৃষ্টির মধ্য দিয়ে সেজন্যে প্রমদাচরণ শিশু-কিশোরদের শিক্ষণীয়কে সামনে এনেছেন। ভীমকে নানা প্রতিকূল অবস্থায় ফেলে তার স্বভাব-চরিত্র সংশোধনের চেষ্টা করা হয়েছে। উদ্দেশ্যপ্রধান রচনা হওয়া সত্ত্বেও এর গল্পরস অক্ষুণ্ণ রয়েছে। আকর্ষণীয় প্রকাশভঙ্গি ও চমকপ্রদ ঘটনাবিন্যাসে উপন্যাসটি হূদয়গ্রাহী হয়ে ওঠে। জীবিতকালে প্রমদাচরণ সেন ভীমের কপাল উপন্যাসটি গ্রন্থাকারে প্রকাশ করে যেতে পারেননি। অল্প বয়সে মৃত্যুবরণ করায় রচিত হওয়ার প্রায় একশ বছর ধরে তাঁর এ-উপন্যাসটি সাময়িক পত্রের পৃষ্ঠায় চাপা পড়ে থাকে নিদারুণ অবহেলায়। বঞ্চিত থাকে বাংলার শিশু-কিশোররা। ১৩৮৭ বঙ্গাব্দে এটি প্রথম গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হয়।
সাত
ছোটদের পত্রিকা হিসেবে সবচেয়ে বিখ্যাত সন্দেশের সম্পাদক উপেন্দ্রকিশোরের সাহিত্যিক হিসেবে গড়ে উঠতে প্রমদাচরণ ও তাঁর সখার অবদান অনেকটা। সখায় ধাঁধা ও সংক্ষিপ্ত গ্রন্থ-সমালোচনাও ছাপা হতো। ধাঁধার উত্তরও দিয়ে দেওয়া হতো। অনেক গল্প ও কবিতার মধ্য দিয়ে অনেক নীতিকথা ও শিক্ষণীয় বিষয়গুলো মনের মধ্যে গেঁথে দেওয়ার চেষ্টা করা হতো। উপেন্দ্রকিশোর ছাড়া কবি কামিনী রায়, বিপিনচন্দ্র পাল, মন্মথনাথ মুখোপাধ্যায় প্রমুখ লেখক নিয়মিত লিখতেন। সখার বার্ষিক মূল্য ছিল এক টাকা; মফস্বলে স্বতন্ত্র ডাকমাশুল লাগবে না বলে জানানো হয়েছে। প্রথম সংখ্যায় যে-কটি লেখা বেরিয়েছিল তার বেশিরভাগই ছিল প্রমদাচরণের – ‘প্রস্তাবনা’, ‘ভীমের কপাল’, ‘আঃ ছেড়ে দাও না!’ (সচিত্র কবিতা), ‘সতীশ এবং তাহার সঙ্গী’, ‘ঊষা’ (কবিতা), ‘মহাত্মা হেয়ার সাহেব’ সচিত্র, ‘মেয়েরা আমাদের কে?’, ‘বৃষ্টি’, ‘ধাঁধা’, ‘সখা সংক্রান্ত নিয়মাবলী’। অনুমান করা যায় যে, যে-ধরনের লেখা দিয়ে সম্পাদক পত্রিকাটি সাজাতে চেয়েছিলেন সে-ধরনের লেখা পাওয়া কঠিন ছিল বলে অনেক লেখা সম্পাদক নিজেই লিখেছেন।
সেকালের অনেক পত্রিকার মতোই রচনার শেষে বা প্রথমে লেখকের নাম দেওয়া হতো না, বর্ষশেষের সূচিতে নাম থাকত। এর একটা ব্যাখ্যা পাওয়া যায় ১৮৮৩-এর এপ্রিল সংখ্যায়। ‘পত্র প্রেরকদের প্রতি’ বিভাগে তারাপ্রসন্ন বসুর চিঠির উত্তর দিতে গিয়ে বলা হয়েছিল,
সখার লেখকদিগের মধ্যে অনেকেই সুপরিচিত নহেন, কাজেই নাম প্রকাশ করা হয় নাই; যাহা হউক, যদি জানিতে ইচ্ছা করেন, সখার আগামী কোন সংখ্যায় তাহাদের নাম প্রকাশ করা যাইতে পারে।
সখায় প্রকাশিত লেখাগুলোর মধ্যে এমন কিছু রচনা সন্নিবেশিত করা হয়েছিল যেসব রচনায় উন্নত মূল্যবোধের কথা বলা হতো। দৈনন্দিন জীবনের বদঅভ্যাসগুলো দূর করার কথা উলেস্নখ করে কিছু লেখা প্রকাশিত হতো। যেমন ‘ধূমপান’ নিয়েও লেখা ছাপা হয়েছিল। পাঠকদের মধ্য থেকে একজন সখার লেখায় উজ্জীবিত হয়ে ধূমপান ছেড়ে দেওয়ার কথাও জানিয়েছেন। ‘বিজ্ঞানমনস্কতা’, ‘শিশু-স্বাস্থ্য’, ‘নীতিশিক্ষা’, ‘পোশাকের শালীনতা’ ইত্যাদি নিয়ে লেখা প্রকাশিত হতো।
সখার প্রথম সংখ্যা যে দ্বিতীয়বার ছাপা হয়েছিল তার প্রমাণ পাওয়া যায়। পত্রিকার প্রথম সংখ্যা প্রকাশিত হয়েছিল ১৮৮৩ সালের জানুয়ারিতে। প্রকাশের অল্প সময়ের মধ্যে সব কপি নিঃশেষিত হয়ে যাওয়ায় ১৮৮৪ সালে দ্বিতীয়বার ছাপা হয়েছিল। পত্রিকাটি যে সে-সময় খুব সাড়া তুলেছিল তারও পরিচয় পাওয়া যায় এই ঘটনা থেকে (চট্টোপাধ্যায়, ১৯৯৬)।
প্রমদাচরণ ধর্মান্তরিত হয়ে ব্রাহ্মধর্ম গ্রহণ করলেও তাঁর পত্রিকায় প্রকাশিত লেখায় সে-বিষয়ের কোনো ছাপ পড়েনি। তিনি নিজেই জানিয়েছিলেন সে-কথা (সেনগুপ্ত, মার্চ ২০১৬) :
‘সখা’ হিন্দু সমাজেরও কাগজ নয়, ব্রাহ্মসমাজেরও কাগজ নয়; কেবল বালকবালিকাদিগের যাহাতে উপকার হয়, তাহাই করিতে ইহার জন্ম, ‘সখা’ চিরকাল তাহাই করিবে।
আট
প্রথমদিকে লেখকের অভাবে প্রমদাচরণকে নিজেই বহু লেখা লিখতে হয়েছে, কিন্তু পরে অনেকেই যোগ দিয়েছিলেন। প্রথম বর্ষে সম্পাদক প্রমদাচরণের সঙ্গে ছায়াসঙ্গীর মতো ছিলেন উপেন্দ্রকিশোর রায়। লিখেছেন হেমলতা দেবী, প্যারীশঙ্কর দাসগুপ্ত, মন্মথনাথ মুখোপাধ্যায়, হিরণ্ময়ী দেবী প্রভৃতি। দ্বিতীয় বর্ষ থেকে অনেক
নামি-অনামি লেখক পত্রিকার সঙ্গে যুক্ত হয়েছেন। তাঁদের মধ্যে ছিলেন শিবনাথ শাস্ত্রী, বিপিনচন্দ্র পাল, বিপিনবিহারী সেন, ফণীভূষণ মুখোপাধ্যায়, খেলাতচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়, সুবর্ণপ্রভা বসু, ভুবনমোহন রায়, কুঞ্জবিহারী ঘোষ, শরৎচন্দ্র চক্রবর্তী, অন্নদাচরণ সেন, চিরঞ্জীব শর্ম্মা প্রমুখ। বেশকিছু রচনায় লেখক বা লেখিকার নাম প্রকাশিত হয়নি, ‘জনৈক বঙ্গমহিলা’ বা ‘কুমারী দেবী’ নাম ছাপা হতো, এখন আর তাঁদের পরিচয় জানার কোনো উপায় নেই।
দ্বিতীয় বর্ষের মার্চ সংখ্যায় বিখ্যাত রাজনীতিক বিপিনচন্দ্র পাল একটি বিদেশি গল্প অবলম্বনে ‘পাহারা ওয়ালার ভেল্কী’ নামে একটি ধাঁধাযুক্ত মজার গল্প লিখেছেন। ছোট ছোট ছেলেমেয়ের চিমত্মাশক্তি জোরাল করে তুলতে এ-ধরনের লেখা খুবই সহায়ক বিবেচনা করে প্রমদাচরণ এ-ধরনের লেখা প্রকাশ করতে চেয়েছেন। খুদে পাঠকরা যে অনেক আগ্রহ নিয়ে সেগুলো পড়ত তার পরিচয় পাওয়া যায় একজন খুদে পাঠিকার প্রতিক্রিয়া থেকে। বিপিনচন্দ্র দ্বিতীয় বর্ষের এপ্রিল সংখ্যায় ‘এলাইচ’ নামে একটি প্রবন্ধ লিখেছিলেন। তাতে তিনি লিখেছিলেন,
আদার পাতায় আদার গন্ধ পাওয়া যায়, হলুদের পাতায় হলুদের গন্ধ পাওয়া যায়, শুঁটের পাতা হাতে রগড়াইলে তাহা হইতে ঠিক শুঁটের গন্ধ বাহির হয়। এলাইচের পাতাতেও কি ঠিক এলাইচের গন্ধ পাওয়া যায়? না। … এলাইচের পাতা রগড়াইলে তাহা হইতে কেমন এক প্রকার বুনো গন্ধ বাহির হয়, এ যে এলাইচের পাতা তাহা ঠিক করা অসাধ্য। এলাইচের গন্ধ কেবল তার আপনার ভিতরেই বন্ধ থাকে, পাতা বা ফুলে সে গন্ধ পাওয়া যায় না।
কিন্তু বিপিনচন্দ্রের এই মতের সঙ্গে এক খুদে পাঠিকা একমত হতে পারেনি। জুন সংখ্যায় ‘পত্র প্রেরকের প্রতি’ শিরোনামে এর উত্তর দেওয়া হয়েছিল। বলা হয়েছিল,
আমরা ইতিপূবের্ব এলাইচের সম্বন্ধে লিখিয়াছিলাম যে, এলাইচের পাতায় গন্ধ নাই; আমাদের একজন বালিকা পাঠিকা, এই কথা তুলে, ইহা দেখাইবার জন্য কতকগুলি এলাইচের ফুল ও পাতা পাঠাইয়া দিয়াছেন। আমরা দেখিলাম এ পাতার বেশ গন্ধ আছে, ফুলগুলির গন্ধ আরও চমৎকার। এ সম্বন্ধে আমাদের বক্তব্য এই যে, ‘এলাইচ’ প্রবন্ধের লেখক মান্দ্রাজ অঞ্চলে যে পাতা দেখিয়াছিলেন, তাহাতে গন্ধ ছিল না; বাঙ্গালা দেশে এলাইচের গাছে ফল হয় না, এই জন্যই হয় ত পাতায় ফলের গন্ধ পাওয়া যায়।
সখায় জ্ঞান ও নীতিশিক্ষাবিষয়ক রচনা প্রচুর পরিমাণে পরিবেশিত হয়েছে। বিশেষত ছোটদের বিজ্ঞান সচেতন করে তুলতে চেষ্টার কমতি ছিল না। বিখ্যাত লোকদের জীবনীও প্রায় নিয়মিত প্রকাশিত হয়েছে, এঁদের মধ্যে ছিলেন অক্ষয়কুমার দত্ত, রামতনু লাহিড়ী, তারকনাথ প্রামাণিক, কৃষ্ণমোহন বন্দ্যোপাধ্যায়, কেশবচন্দ্র সেন, কুইন ভিক্টোরিয়া, এব্রাহাম লিঙ্কন, রামমোহন রায়, জর্জ স্টিফেনশন, টমাস আলভা এডিসন, দ্বারকানাথ বিদ্যাভূষণ, ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর প্রমুখ স্বনামধন্য ব্যক্তি। খ্যাতনামা ব্যক্তিদের মৃত্যুসংবাদও দেওয়া হতো। পত্রিকার একটি বড় আকর্ষণ ছিল ধাঁধা। আগের সংখ্যার ধাঁধার উত্তরসহ নতুন ধাঁধা প্রায় প্রতি সংখ্যাতেই ছাপা হয়েছে। মাঝেমধ্যে চিঠির উত্তর দেওয়া হয়েছে ‘পত্র প্রেরকের প্রতি’ বিভাগে।
নয়
প্রমদাচরণের মৃত্যুর পর তাঁর শিক্ষক শিবনাথ শাস্ত্রী সখাকে বাঁচাতে পত্রিকাটির সম্পাদনার ভার নেন। ১৮৮৫ সালের জুলাই মাস থেকেই সখা শিবনাথের সম্পাদনায় প্রকাশিত হতে থাকে। জুলাই সংখ্যাতেই প্রমদাচরণের একটি ছবি ছাপা হয়েছিল। এটিই তাঁর একমাত্র ফটো। শিবনাথ শাস্ত্রী ১৮৮৬ সাল পর্যন্ত ‘সংখ্যা’ সম্পাদনা করেছেন। ১৮৮৬ সালের জানুয়ারি মাসে ‘চতুর্থ বর্ষে’র শুরুতে প্রকাশিত সম্পাদকীয়তে বলা হয় (সেনগুপ্ত, মার্চ ২০১৬)
আজ ‘সখা’র জন্মদিন। ছেলেমেয়েদের জন্মদিনে বাড়ীতে সকলেই আনন্দ করে। কিন্তু আজ আমরা ‘সখা’কে বাহিরে যাইবার জন্য কাপড় পরাইতেছি, আর প্রমদাচরণের জন্য চোখের জল ফেলিতেছি। ‘সখা’র একটু আদর দেখিলে যে প্রমদাচরণ স্বর্গের চাঁদ হাতে পাইত, সেই প্রমদাচরণ আজ নাই। এখন যদি আমরা ‘সখা’কে ভাল করিয়া মানুষ করিতে পারি তবেই সে শোক নিবারণ হয়। অতএব পাঠক পাঠিকা তোমরা নূতন বছরে ‘সখা’কে সকলে আশীবর্বাদ কর, যেন ‘সখা’ প্রমদাচরণের উদ্দেশ্য সিদ্ধ করিতে পারে।
এরপর প্রমদাচরণের ভাই অন্নদাচরণ সেন সম্পাদক ছিলেন ১৮৮৭ থেকে ১৮৯২ সাল পর্যন্ত। পরবর্তী সম্পাদক ছিলেন শিশুসাহিত্যিক নবকৃষ্ণ ভট্টাচার্য; তিনি সম্পাদক ছিলেন ১৮৯৪ সাল পর্যন্ত।
দশ
সখায় বিজ্ঞান ও ইতিহাস বিষয়ক প্রবন্ধকে খুব গুরুত্ব দেওয়া হতো। বিদ্যাসাগরেরও দুটি লেখা ছাপা হয়েছিল সখা ১৮৯৩ সালের এপ্রিল সংখ্যায় ‘মাতৃভক্তি’ এবং ১৮৯৪ সালের জানুয়ারি সংখ্যায় ‘ছাগলের বুদ্ধি’তে। প্রমদাচরণের অকালমৃত্যুর পরেও তাঁর শুভানুধ্যায়ীরা তাঁকে মনে রেখেছেন, মৃত্যুর পরেও তাঁর লেখা সখায় প্রকাশিত হয়েছে। সখার শেষ সংখ্যা বেরোয় ১৮৯৪ সালের মার্চ মাসে। এপ্রিল থেকে সখা আর প্রকাশতি হয়নি। সাথী চলেছে ১৮৯৩ সালের মে থেকে ১৮৯৪-এর এপ্রিল পর্যন্ত [চৈত্র, ১৩০০]। সাথীর সম্পাদক ভুবনমোহন রায় ছিলেন প্রমদাচরণ সেনের অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ ও আত্মীয়স্থানীয়। সখাতেও ভুবনমোহন রায় লিখেছেন। প্রমদাচরণের মৃত্যুর পরও ভুবনমোহন তাঁকে বিস্মৃত হননি। কেবল সখার সঙ্গে মিলেই নয়, সখাকে অগ্রাধিকার দিয়ে ১৩০১-এর বৈশাখ থেকে তাঁর সম্পাদনায় প্রকাশিত হতে থাকে সখা ও সাথী। পত্রিকার প্রথম সংখ্যায় ভুবনমোহন লিখেছেন (সেনগুপ্ত, ডিসেম্বর ২০১৬),
যে বয়সে বড় তাহার সম্মান করিতে হয়। সখা, সাথী অপেক্ষা যে বয়সে বড়ো সুতরাং সখাকে সাথীর সম্মান করা উচিত। বিশেষ করে প্রমদাচরণ এদেশে এ প্রকার পত্রিকার প্রবর্ত্তক বলিলে হয়। তাই প্রমদাচরণের সম্মান ও স্মৃতিরক্ষার জন্য এবং তাঁহার প্রতি আমাদের হৃদয়ের গভীর শ্রদ্ধাপ্রীতির নিদর্শন স্বরূপ এই সম্মিলিত পত্রিকার নামকরণে তাঁহার সখার নামই প্রথমে দেওয়া হইল। আমরা আশা করি সাথীর গ্রাহকগণেরও এখন কোন ক্ষোভের কারণ নাই।
অর্থাৎ সাথী পত্রিকা তার দ্বিতীয় বর্ষ থেকে সখা ও সাথী নামে প্রকাশিত হতে থাকে। সখা ও সাথী চলেছিল চার বছর, ১৮৯৮ সালের এপ্রিল (চৈত্র ১৩০৪) পর্যন্ত।
প্রমদাচরণ মৃত্যুর পূর্বে সখা সম্পাদনা করেছেন মাত্র আড়াই বছর। কিন্তু ব্যক্তিজীবনের সমস্ত ব্যথা-বেদনা সরিয়ে রেখে সখাকে ছোটদের কাছে আকর্ষণীয় করে তুলতে তাঁর নিরলস প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয়নি। শিশুসাহিত্যের ইতিহাসে সখার অবদানের জন্য প্রমদাচরণ অনুপ্রেরণাদায়ক ও চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবেন। প্রমদাচরণকে স্মরণ করলে আমরা অনুভব করব ছোটদের পত্রিকার লক্ষ্য হওয়া উচিত সখার মতো শিশুচিত্তের উৎকর্ষ সাধন এবং তাদের অন্তরে শুভবোধের অনুপ্রেরণা সৃষ্টি করা। অথচ এখনকার দিনে কোনো শিশুপত্রিকার লক্ষ্য হয়ে উঠছে মুনাফা অর্জন। এমন পরিস্থিতিতে প্রমদাচরণের আকাঙক্ষা ও আত্মত্যাগকে শ্রদ্ধা জানানোর জন্য আমরা বঙ্কিমচন্দ্রকে অনুসরণ করতে পারি। তিনি যেমন পতাকা উড়িয়ে তাতে নাম লিখতে বলেছিলেন ‘শ্রীমধুসূদন’, তেমনি প্রমদাচরণের সখা প্রকাশের মধ্য দিয়ে বাংলা শিশুসাহিত্য তথা বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের যে-কল্যাণ সাধিত হয়েছে তার জন্য পতাকা উড়িয়ে তাতে নাম লিখে দিতে পারি ‘প্রমদাচরণ’।
সূত্র
১. শিবনাথ শাস্ত্রী, আত্মচরিত, কলকাতা, ১৯১৮।
২. সরলাদেবী চৌধুরাণী, জীবনের ঝরাপাতা, কলকাতা, ১৯৫৭।
৩. আতোয়ার রহমান, শিশুসাহিত্য : নানা প্রসঙ্গ, ঢাকা, ১৯৯৮।
৪. অরুণা চট্টোপাধ্যায়-সম্পাদিত সখা, সখা ও সাথী : প্রথম ও
দ্বিতীয় বর্ষ, কলকাতা, ১৯৯৬।
৫. দীপক সেনগুপ্ত, সখা, http://www.abasar.net/mag_bangla_sakha.htm, মার্চ ২০১৬।
৬. দীপক সেনগুপ্ত, সখা ও সাথী, http://www.abasar.net/mag_bangla_Sakha_zsathi.htm, ডিসেম্বর ৩০, ২০১৬।
৭. আহমাদ মাযহার, বাংলাদেশের শিশুসাহিত্য, কলকাতা, ২০১৬।
Leave a Reply
You must be logged in to post a comment.