বঙ্গবন্ধু, মুক্তিযুদ্ধ ও অংশুমানের গান

সংগীতের আবেদন যে-কত গভীর ও মর্মস্পর্শী এবং লোকরঞ্জনের অনন্য উপকরণ হতে পারে, তার সাক্ষ্য মেলে নিচের এই পঙ্্ক্তি-ক’টিতে : ‘… উপস্থিত হয়ে দেখলাম … আব্বাসউদ্দিন সাহেবকে দেখবার জন্য হাজার হাজার লোক সমাগম হয়েছে। বাংলার গ্রামে গ্রামে আব্বাসউদ্দিন সাহেব জনপ্রিয় ছিলেন। জনসাধারণ তাঁর গান শুনবার জন্য পাগল হয়ে যেত। তাঁর গান ছিল বাংলার জনগণের প্রাণের গান। বাংলার মাটির সাথে ছিল তাঁর নাড়ির সম্বন্ধ। …’ এই কথাগুলো বলার উপলক্ষ ছিল ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নবীনগর থানার কৃষ্ণনগরের এক সভা। সভা ও গানের পর রাত্রিযাপন শেষে পরের দিন নৌকায় তিতাস ও মেঘনা পেরিয়ে ফেরার পালা। নৌকার সওয়ারি আব্বাসউদ্দিন (১৯০১-৫৯) গানে-গানে ভরিয়ে দিলেন গন্তব্যে পৌঁছানোর সময়টুকু –    নৌকার আরেক মুগ্ধ যাত্রীর জবানিতে জানা যায় : ‘পথে পথে গান চলল। নদীতে বসে আব্বাসউদ্দিন সাহেবের ভাটিয়ালি গান তাঁর নিজের গলায় না শুনলে জীবনের একটা দিক অপূর্ণ থেকে যেত। তিনি যখন আস্তে আস্তে গাইতেছিলেন তখন মনে হচ্ছিল, নদীর ঢেউগুলিও যেন তাঁর গান শুনছে।’ এই অন্তরঙ্গ বিবরণের কথক জননেতা শেখ মুজিবুর রহমান (১৯২০-৭৫), এই কথাগুলো তাঁর অসাধারণ স্মৃতিচর্চার বই অসমাপ্ত আত্মজীবনীতে ধরা আছে।

আব্বাসউদ্দিন দেশভাগের আগে চারণের মতো সারাবাংলায় জাগরণী গান গেয়ে মানুষকে উদ্বুদ্ধ করেছেন। সভা-সমিতি, মজলিশ-মাহফিলে তাঁর গান মানুষকে মুগ্ধ ও প্রাণিত করেছে – পেয়েছেন ‘সভা-গায়কে’র মর্যাদা। দেশভাগের সামান্য পরেই এক অনুষ্ঠানে যোগ দিতে শেখ মুজিব ও আব্বাসউদ্দিনের ব্রাহ্মণবাড়িয়া-সফর। ফেরার পথে আব্বাস উদ্বিগ্ন হয়ে আবেগকম্পিত কণ্ঠে মুজিবকে যে-কথা বলেছিলেন, তা-তিনি তাঁর আত্মকথায় লিখে রাখেন : ‘মুজিব, বাংলা ভাষার বিরুদ্ধে বিরাট ষড়যন্ত্র চলছে। বাংলা রাষ্ট্রভাষা না হলে বাংলার কৃষ্টি, সভ্যতা সব শেষ হয়ে যাবে। আজ যে গানকে তুমি ভালবাস, এর মাধুর্য ও মর্যাদাও নষ্ট হয়ে যাবে। যা কিছু হোক, বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করতেই হবে।’ কথাটি মুজিবের খুব মনে ধরে –    তাই তিনি সেদিন বাংলা ভাষার মর্যাদা-রক্ষার বিষয়ে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন এবং সেকথা রাখার ‘চেষ্টা’ করেছিলেন। সেই বাংলা ভাষার দাবির সংগ্রামে তাঁর প্রত্যক্ষ-পরোক্ষ ভূমিকা আজ ইতিহাসের অন্তর্গত। বাঙালির ভাষার সংগ্রাম চিরায়ত সংগীত-সৃষ্টির প্রেরণা হতে পেরেছিল : ‘ঢাকা শহর রক্তে ভাসাইলি, ওরে বাঙ্গালী’, ‘ওরা আমার মুখের ভাষা কাইড়া নিতে চায়’ বা ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারী’ – এই গান বাঙালির শোক ও সংগ্রামের সহগামী হয়েছিল। দ্বিজাতিতত্ত্ব-প্রাণিত অলীক-ঐক্যের দেশ পাকিস্তান-পর্বের প্রায় চব্বিশ বছর বাঙালির সংগ্রাম চলেছে সমান্তরাল দুটি ধারায় –    রাজনৈতিক ও ভাষিক-সাংস্কৃতিক – এ-ছিল পরস্পরের পরিপূরক। ভাষা-আন্দোলনের চেতনার পথ ধরেই অবশেষে আসে চূড়ান্ত মুক্তির মহাসংগ্রাম। কে ভেবেছিল সেদিন, আব্বাস-মুজিবের সেই আলাপের দুই যুগ পরে শেখ মুজিবের সংগ্রামের ধারাবাহিকতায় তাঁর নেতৃত্ব ও নামের মাহাত্ম্যে হবে বাঙালির মুক্তিসংগ্রামের সূচনা ও সমাপ্তি। কে জানতো তাঁকে নিয়ে গান বাঁধা হবে – যার সুরে প্রাণিত হবে বাঙালি – রক্তে লাগবে কাঁপন – ‘শোন একটি মুজিবরের থেকে/ লক্ষ মুজিবরের কণ্ঠস্বরের ধ্বনি-প্রতিধ্বনি/ আকাশে বাতাসে ওঠে রণি/ বাংলাদেশ, আমার বাংলাদেশ। …’

দুই

কালপর্ব ১৯৭১। দক্ষিণ কলকাতার রামগড়ের পদ্মশ্রী সিনেমা হলের মুখোমুখি ছিল একটি অনেকদিনের পুরনো চায়ের দোকান। সেই দোকান কবেই উঠে গেছে – কিন্তু এক ঐতিহাসিক ঘটনার কারণে আজো তার কথা স্মরণ করতে হয়।

এই চায়ের দোকানে প্রায়-নিত্য আড্ডা বসতো গায়ক-গীতিকার-সুরকার-সাংবাদিক-রেডিয়োর কলাকুশলী-কর্মাধ্যক্ষদের। প্রায়-নিয়মিত আসতেন গৌরীপ্রসন্ন মজুমদার, দিনেন্দ্র চৌধুরী, অমিতাভ নাহা, শিবদাস বন্দ্যোপাধ্যায়, অংশুমান রায়। এঁদের সবারই আবাস ছিল আড্ডার কাছাকাছি – রামগড়-নাকতলা-গড়িয়া অঞ্চলে। কখনো কখনো দূর থেকেও কেউ কেউ আসতেন – যেমন দমদম থেকে রেডিয়োর উপেন তরফদার বা প্রণবেশ সেন। তখন এপ্রিল মাস – সব-জায়গাতেই বাংলাদেশের প্রসঙ্গ। কলকাতায় নানা সূত্রে পৌঁছে গেছে বাংলাদেশের খবর – পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর নির্বিচার গণহত্যা, গ্রেফতার হওয়ার আগে বঙ্গবন্ধুর বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণা, জীবন ও সম্ভ্রম বাঁচাতে শরণার্থীর ঢল পশ্চিমবঙ্গ-ত্রিপুরা-আসাম-মেঘালয় রাজ্যের অভিমুখে। তাই চায়ের দোকান থেকে রাজভবন, সবখানেই আলোচনার প্রধান বিষয় ‘বাংলাদেশ’। সবার মুখে-মুখে ‘বাংলাদেশ’ – বিশেষ করে যাঁরা একসময় পূর্ববঙ্গ থেকে ভারতে চলে আসেন – তাঁদের আবেগ ও স্মৃতিকাতরতা অন্যদের তুলনায় স্বভাবত বেশিই ছিল।

তারিখ ১৩ এপ্রিল, সময় সকালবেলা, আড্ডাধারীরা একে-একে সবাই এসে গেছেন – গৌরীপ্রসন্ন, দিনেন্দ্র, অংশুমান, শিবদাস – একটু পরেই চায়ের আড্ডায় এসে পৌঁছলেন দমদম থেকে রেডিয়োর উপেন তরফদার, সঙ্গে স্পুল টেপরেকর্ডার। অংশুমানের বড়ো ছেলে, পিতার রক্তের শুধু নয়, গানেরও উত্তরাধিকারী – ভাস্কর, সেই ভাস্কর রায়ের মুখে শোনা যাক পরের ঘটনা : ‘সেই সময়ে বাংলাদেশ স্বাধীনতা আন্দোলনে উত্তাল। দুই বাংলার শিল্পী সাহিত্যিক বুদ্ধিজীবীদের মধ্যে চলছে মতবিনিময়। সবারই লক্ষ্য এবং চিন্তা একটাই কীভাবে বাংলাদেশকে স্বাধীন করা যায়। দুই বাংলার সাহিত্যিক শিল্পীরা যে

যাঁর কাজের মাধ্যমে বাংলাদেশের জনগণের  জন্য সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিয়েছিলেন। ১৯৭১ সালের ১৩ এপ্রিল বিখ্যাত গীতিকার গৌরীপ্রসন্ন মজুমদার চারটি লাইন লিখলেন – ‘শোন একটি মুজিবুরের থেকে লক্ষ মুজিবুরের কণ্ঠস্বরের ধ্বনি-প্রতিধ্বনি …’। সেই সময়ে সকালের দিকে নিয়মিত একটি আড্ডা হত বাবাদের। আড্ডাতে সেইদিন ছিলেন বাবা অংশুমান রায়সহ দিনেন্দ্র চৌধুরী, তৎকালীন আকাশবাণীর ‘সংবাদ-বিচিত্রা’ যার দায়িত্বে ছিলেন – সেই উপেন তরফদার ও আরও কয়েকজন। উপেন জেঠু একটা টেপরেকর্ডার সঙ্গে নিয়ে এসেছেন। শোনা হচ্ছে ৭ মার্চের বঙ্গবন্ধুর সেই ঐতিহাসিক ভাষণ। উপেন জেঠু বললেন, এটি সংবাদ-বিচিত্রায় শোনানো হবে, কিন্তু ভাষণটি একটু ছোট। যদি একটা গান দিয়ে তার মাঝে মাঝে এই ভাষণটি চালানো হয়, তাহলে ঠিক হবে। যেমন চিন্তা তেমন কাজ। গৌরী জেঠুর কলম থেকে বেরিয়ে এল কথার মালা। সেই কথার উপর সুর বসালেন বাবা। তৈরি হয়ে গেল একটি নতুন গান। উপেন জেঠু সেইদিনই গানটি তাঁর রেকর্ডারে বন্দী করেছেন – শুধু হারমোনিয়াম বাজিয়ে গানটি গাইলেন বাবা। রাত্রে সংবাদ-বিচিত্রায় গানটি বাজানো হল। তখনও কেউ জানে না কী ঘটতে চলেছে। পরের দিন চারদিকে হৈ চৈ। কার কণ্ঠস্বরে এই গান! অংশুমান রায় প্রথম নিজের লোকগানের গণ্ডি ছাড়িয়ে এমন একটি গান গাইলেন, যা দুই বাংলার ইতিহাসে লেখা হয়ে গেল।’

বিবিসি কলকাতার প্রতিনিধি অমিতাভ ভট্টশালী বঙ্গবন্ধুর জন্মদিন ১৭ মার্চ ২০১৯ অংশুমান-পুত্রের এক সাক্ষাৎকার গ্রহণ করেন। এর আগে দৈনিক স্টেটসম্যান পত্রিকায় (২৩ আগস্ট ২০১৫) প্রকাশিত সাক্ষাৎকার-অপেক্ষা আলোচ্য গানটির প্রসঙ্গ এখানে কিছুটা বিশদ। স্টেটসম্যানের সঙ্গে আলাপ ছিল অংশুমানের প্রায় সমগ্র দিক নিয়ে – আর বিবিসি-গৃহীত কথোপকথন শুধুই ছিল ‘শোন একটি মুজিবরের থেকে’ গানটি নিয়ে। এই সাক্ষাৎকার ইন্টারনেটেও প্রচারিত হয়।

বিবিসির প্রতিনিধি-গৃহীত সাক্ষাৎকারে ভাস্কর রায় চায়ের দোকানে কীভাবে গানটির জন্ম হয় সে-বিষয়ে আগের চেয়ে আরেকটু বিস্তারিত বলেছেন। আর এসব কথা ভাস্কর তাঁর বাবা অংশুমান রায়ের মুখে যেমন-যেমন শুনেছিলেন, শ্রুতির স্মৃতি যতোটুকু সাহায্য করে, সেভাবেই বলতে চেয়েছেন : ‘উপেন তরফদার ছিলেন আকাশবাণীর প্রযোজক। পুরনো দিনে যে স্পুল টেপরেকর্ডার ছিল, সেই একটা নিয়ে এসেছিলেন। তাতে শেখ মুজিবুর রহমানের ঐতিহাসিক ৭ই মার্চের ভাষণটা ওই আড্ডাতেই শুনিয়েছিলেন …। ওই ভাষণ আর ওপার বাংলার পরিস্থিতি নিয়েই কথাবার্তা চলছিল। কিন্তু গৌরী জেঠু একটু অন্যমনস্ক ছিলেন সেদিন। উনি আর আমার বাবা চারমিনার সিগারেট খেতেন। প্যাকেটের ভেতরে একদিকে সাদা যে কাগজটা থাকে, সেই কাগজটা বার করে গৌরী জেঠু কিছু একটা লিখতে থাকেন। … কিছুক্ষণ পরে তিনি বাবা আর দিনেন জেঠুর হাতে ওই সিগারেটের প্যাকেটের কাগজটা দিয়ে বলেন, ‘দেখ তো  চলবে কীনা এটা।’ অংশুমান রায় ওটা পড়েই বলে উঠেছিলেন –    ‘গৌরীদা এটা আপনি আর কাউকে দিতে পারবেন না। এটা আমি সুর করব, আমিই গাইব।’ অবশেষে তাই হলো, চটজলদি অংশুমান এই গানের কথায় সুরারোপ করে ফেলেন শুধুই হারমোনিয়ামের সাহায্যে। ডুগি-তবলা বা অন্য-কোনো বাদ্যযন্ত্র ছিল না – ‘বাবার গলা, হারমোনিয়াম আর তালবাদ্য বলতে একটা শক্ত মলাটের গানের খাতায় দিনেন জেঠুর তাল ঠোকা।’

আকাশবাণী কলকাতা কেন্দ্রের ‘সংবাদ-বিচিত্রা’য় উপেন তরফদার স্পুল রেকর্ডারে বঙ্গবন্ধুর ওপরে-লেখা গানটা তুলে নেন। ৭ই মার্চের ভাষণ প্রচারের সিদ্ধান্ত হয় – এর মূলে ছিলেন রেডিয়োর প্রযোজক উপেন তরফদার। কিন্তু সমস্যা হলো, বঙ্গবন্ধুর ভাষণের যে-নির্বাচিত অংশ প্রচারের সিদ্ধান্ত হয়, তা ‘সংবাদ-বিচিত্রা’র সময়সীমার চেয়ে কিছুটা কম। ভাস্কর জানাচ্ছেন : ‘তাই প্রযোজক হিসেবে উপেন জেঠু ঠিক করেন যে ভাষণের মাঝে মাঝে বাবার গাওয়া গানটা বাজানো হবে। ওইভাবেই গানটা বেজেছিল সেই রাতে – সব নিয়ম ভেঙে এক-নয়, একাধিকবার।’ এইভাবে বঙ্গবন্ধুর ওপরে মুক্তিযুদ্ধের কালে জন্ম হয় অবিস্মরণীয় এই গানটির।

উপেন তরফদার এই গান ও অনুষ্ঠান সম্পর্কে এক স্মৃতিচর্চায় বলেছেন : ‘বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসে ‘সংবাদ-বিচিত্রা’ অনুষ্ঠানে প্রচারিত একটি গানও আজ ইতিহাসে স্থান করে নিয়েছে। গানটির লেখক গৌরীপ্রসন্ন মজুমদার আর গেয়েছিলেন অংশুমান রায়। সেদিনের ‘সংবাদ-বিচিত্রা’ অংশুমানের গান আর বঙ্গবন্ধু মুজিবুরের রক্ত গরম করা সেই ঐতিহাসিক ভাষণের কিছু অংশ নিয়ে তৈরি করা হয়েছিল। সেদিনের ভাষণে বাংলাদেশের মানুষের প্রতি আগামী দিনের লড়াইতে ঝাঁপিয়ে পড়ার আহ্বান জানিয়ে বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, ‘মনে রাখবা – রক্ত যখন দিয়েছি – রক্ত আরও দেব –    এদেশের মানুষকে মুক্ত করে ছাড়ব – ইনশাল্লাহ – এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম – এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।’

‘সংবাদ-বিচিত্রা’র এই অনুষ্ঠান কেমন আবেদন সৃষ্টি করেছিল, সে-সম্পর্কে উপেন তরফদার জানান : ‘গানের হৃদয়স্পর্শী ভাষা, মনমাতানো সুর, দরদি কণ্ঠ আর বঙ্গবন্ধুর রক্ত গরম করা ভাষণ এবং সর্বোপরি দুই বাংলার মানুষের আবেগ আর উত্তেজনায় ভরা সে-সময়ের পরিবেশ, সব মিলিয়েই অনুষ্ঠানটি শ্রোতাদের মনে গভীরভাবে নাড়া দিতে পেরেছিল।’

তিন

গানটি অসাধারণ সমাদর পেয়েছিল। সেইসঙ্গে জনমনে বিপুল উদ্দীপনা সৃষ্টিতে সমর্থ হয়। পরদিন সকালে অংশুমান অভ্যাসমতো ওই চায়ের দোকানে উপস্থিত হলে, যাঁরা গানের বিষয়টি জানতেন, তাঁদের সানুরাগ উষ্ণ অভ্যর্থনা লাভ করেন। অন্যদিকে পরের দিন আকাশবাণী-ভবনে ভাষণ আর গানের যুগলবন্দি-অনুষ্ঠানের প্রতিক্রিয়া ছিল ব্যাপক। তার কিছু পরিচয় মেলে উপেন তরফদারের সূত্রে।

আকাশবাণীর ‘সংবাদ-বিচিত্রা’ অনুষ্ঠানের প্রযোজক ছিলেন উপেন তরফদার, প্রণবেশ সেন স্ক্রিপ্ট-লেখক ও উপস্থাপকের ভূমিকা পালন করতেন দেবদুলাল বন্দ্যোপাধ্যায়। এই ত্রয়ীর আন্তরিক যত্ন ও শ্রমে ‘সংবাদ-বিচিত্রা’ শুধু জনপ্রিয় নয়, বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে এক গভীর প্রেরণার উৎস হয়ে উঠেছিল।

১৩ এপ্রিল রাতে ‘সংবাদ-বিচিত্রা’য় বঙ্গবন্ধুর ভাষণের নির্বাচিত অংশ, গৌরীপ্রসন্ন-রচিত ও অংশুমান-গীত বঙ্গবন্ধু-বন্দনা দেবদুলালের উদাত্ত কণ্ঠের সংযোগ-বিবরণসহ প্রচারিত হয়। পরদিন অর্থাৎ ১৪ এপ্রিল উপেন তরফদার আকাশবাণী-ভবনে পৌঁছে এক ভিন্ন ধরনের পরিস্থিতির মুখোমুখি হন। উপেন তরফদার সেই চমকপ্রদ ঘটনার বিবরণ দিয়েছেন এইভাবে : ‘অনুষ্ঠানটি বেতারে প্রচারের পরের দিন আকাশবাণীতে এসে দেখি, সব জায়গায় একই আলোচনা, অংশুমানের সেই গান আর বঙ্গবন্ধুর ভাষণ। অনুষ্ঠানটির জন্য সবার অভিনন্দনে উচ্ছ্বসিত হয়ে স্টুডিয়োতে ঢুকতেই সামনে আমাদের কেন্দ্র-অধিকর্তা দিলীপকুমার সেনগুপ্ত। তিনি আমাকে বেশ ধমকেই বললেন – ‘কাল রাতে সংবাদ-বিচিত্রায় কী করেছ? তোমায় আমি মেমো দেব।’ আমি তো অবাক। উনি তো কখনো এভাবে আমার সঙ্গে কথা বলেন না! কী এমন ভুল করলাম, যাতে উনি এতটা উত্তেজিত হয়ে পড়লেন। কিন্তু কয়েকটি মুহূর্তের জন্যই আমাকে উদ্বিগ্ন থাকতে হয়েছিল। কেন্দ্র-অধিকর্তা হঠাৎ আমায় বুকে জড়িয়ে ধরে বললেন – ‘শুধু খারাপ কাজের জন্যে নয় – ভাল কাজের জন্যেও ‘মেমো’ দেওয়া হয়। কাল তোমার ‘সংবাদ-বিচিত্রা’ শুনে আমি কেঁদেছি।’ সত্যিই সেদিনের সংবাদ-বিচিত্রার প্রশংসা করে এক ঘণ্টার মধ্যেই তিনি আমায় মেমো পাঠিয়েছিলেন। … সেই সময় নিচু থেকে উঁচু পর্যায়ের প্রতিটি কর্মী কেমনভাবে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে জড়িয়ে পড়েছিলেন – আমাদের কেন্দ্র-অধিকর্তার কান্না তারই এক উজ্জ্বল নিদর্শন।’

চার

বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে তৈরি এই গানটির জন্মের কাহিনি নিয়ে সামান্য ভিন্ন ভাষ্যও আছে। গানটি যে লেখা হয়েছিল রামগড়ের পদ্মশ্রী সিনেমা হলের কাছের এক আড্ডার-ঠেক চায়ের দোকানে তাতে সন্দেহ নেই – কিন্তু কথা আছে উপেন তরফদার গানটি কোথায় রেকর্ড করেছিলেন তা-নিয়ে। একজন সন্ধিৎসু লেখক মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি ও তাঁর সম্পৃক্ততা নিয়ে উপেন তরফদারের যে-সাক্ষাৎকার নেন, তাতে তিনি বলেন : ‘… একদিন শুনলাম বাংলাদেশের প্রখ্যাত শিল্পী কামরুল হাসান সাহেব বন্ধু দেবদুলাল বন্দ্যোপাধ্যায়ের বাড়িতে এসেছেন। শুনেই আমি টেপরেকর্ডার নিয়ে হাজির দেবদুলালের বাড়িতে। ওখানে অংশুমান রায়ও উপস্থিত। অংশুমান রায় গৌরীপ্রসন্নের লেখা ওই বিশেষ গানটি কামরুল হাসানকে শুনাতে চাইলেন। ঠিক হলো গান শোনানো হবে। কিন্তু, হারমনিয়াম আর তবলা মিলবে কোথায়? পরে অবশ্য হারমনিয়াম মিললো। তবলা আর মিললো না। গান শুনে সবাই হতবাক। আবেগে আপ্লুত। ফিরে এলাম আকাশবাণীতে। শুনলাম ৭ মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণ, যা রেকর্ড করা আছে স্টুডিওতে। চিন্তা করলাম আজকের সংবাদ-বিচিত্রা করবো বঙ্গবন্ধুর ভাষণ আর অংশুমানের গান দিয়ে। স্ক্রিপ্ট লিখে ফেললাম। ভেসে এলো সংবাদ-বিচিত্রায় ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম’। আরও ভেসে এলো, ‘শোন একটি মুজিবরের থেকে লক্ষ মুজিবরের কণ্ঠস্বরের ধ্বনি’। এই সাক্ষাৎকার-গ্রহণকারীর কিছু তথ্য ও বক্তব্য গোঁজামিলে পূর্ণ – তা আদৌ নির্ভরযোগ্য নয়। এখানে ‘শোন একটি মুজিবরের কণ্ঠ থেকে’, গানটির পাঠই অশুদ্ধ – উদ্ধৃতিতে সঠিক পাঠ দেওয়া হলো। আর ‘সংবাদ-বিচিত্রা’র স্ক্রিপ্ট উপেন তরফদার কখনো লিখেছেন এমন কথা তো শোনা যায়নি – স্ক্রিপ্ট লিখতেন প্রণবেশ সেন।

এই গান সম্পর্কে প্রণবেশ সেন স্মৃতি হাতড়ে তাঁর এক লেখায় বলতে পেরেছেন : ‘একটা গানের কথা মনে পড়ছে। এই গানটি প্রথম প্রচারিত হয়েছে রেডিয়োতে, রেকর্ড হয় তার পরে। লোকসংগীতশিল্পী দিনেন্দ্র চৌধুরী, অংশুমান রায় এবং গীতিকার গৌরীপ্রসন্ন মজুমদার থাকতেন গড়িয়া অঞ্চলে। একটা চায়ের দোকানে ওঁদের আড্ডা বসত। সেদিনও বসেছে। কথার পিঠে কথা জমছে। কিন্তু গৌরীদা কেমন যেন একটু অন্যমনস্ক। একসময় পকেট থেকে একচিলতে কাগজ বার করে কী একটা লিখতে লাগলেন …। কিছুক্ষণ বাদে গৌরীদা অংশু আর দিনেনকে বললেন, ‘দেখো তো গানটা চলবে কি না।’ পড়া শেষ হতেই লাফিয়ে উঠল অংশু। বলল – ‘গৌরীদা, এটা আপনি কাউকে দিতে পারবেন না। গানটায় সুর দেব আমি, গাইবও আমি।’ কিছুক্ষণ সুর ভেঁজে টেবিলে তবলার বোল বাজিয়ে অংশু গেয়ে উঠল – ‘শোন একটি মুজিবরের থেকে লক্ষ মুজিবরের কণ্ঠস্বরের ধ্বনি-প্রতিধ্বনি আকাশে বাতাসে ওঠে রণি …।’১০ – এই কাহিনির খেই ধরে প্রণবেশ বলেছেন : ‘এর ক’দিন পর দেবুদের [দেবদুলাল বন্দ্যোপাধ্যায়] বাড়িতে আড্ডা জমেছে বাংলাদেশের বিশিষ্ট শিল্পী কামরুল হাসানের সঙ্গে। উপেন তরফদারও সেখানে হাজির তাঁর টেপরেকর্ডার-সমেত। গিয়েছিল কামরুল ভাইয়ের সাক্ষাৎকার নিতে। এমন সময় অংশু এসে পৌঁছল পূর্ণদাস রোডের ওই বাড়িতে। কামরুল ভাইয়ের সঙ্গে ওর পরিচয় করিয়ে দেওয়া হল। অংশু সঙ্গে সঙ্গে গেয়ে উঠল –    ‘শোন একটি মুজিবরের থেকে…’। টেবিলে তাল ঠুকতে থাকল দিনেন। উপেনের টেপরেকর্ডারও চালু হয়ে গেছে ততক্ষণে।

ওই আড্ডার শেষে উপেন ও অংশু চলে এল রেডিয়োতে। আমাকেও ডেকে নিল উপেন। তিনজনে বসলাম নিউজ রিলের কক্ষে। গানটা বার দুয়েক শোনা হল। ঠিক হল, এই গানটা আমরা … প্রচার করব একটা বিশেষ ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে। আরও ঠিক হল, গানটির সঙ্গে যখন ‘বাংলাদেশ, আমার বাংলাদেশ’ কথাটা ফিরে আসবে, তখন ওই ইন্টারলুডে শেখ মুজিবরের ৭ মার্চের ভাষণের কিছু কিছু অংশ ইনসার্ট করা হবে।’১১

 গৌরীপ্রসন্ন-রচিত এবং অংশুমান-সুরারোপিত ও গীত ‘শোন একটি মুজিবরের থেকে …’ –    এই গানটির জন্মবৃত্তান্ত সম্পর্কে কিছু ভিন্নতা আছে। একজনের সঙ্গে আরেকজনের কথার পুরোপুরি মিল হয় না – কিছু অসংলগ্নতা ও স্থান-কাল-পাত্রের কিছু গরমিল থেকেই যায়। দীর্ঘ-ব্যবধানে খুঁটিনাটি ঘটনার উল্লেখ ও বর্ণনার ক্ষেত্রে স্মৃতি সঠিকভাবে সাড়া দেয়নি –    তাই কেউ কেউ বিভ্রান্ত হয়েছেন মাঝেমধ্যে। তবে এই গানের জন্মকথার মৌল বিষয়গুলো ঠিকই আছে – তেমন কোনো হেরফের হয়নি। একটি ঐতিহাসিক ও অবিস্মরণীয় গানের জন্মকাহিনির সঠিক ইতিহাস হারিয়ে গেলে বা বিকৃত হলে সে-হবে বড়ো বেদনার বিষয়।

পাঁচ

‘শোন একটি মুজিবরের থেকে’ গানটি প্রথমে আকাশবাণী এবং পরে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে প্রচারিত হয়। দ্বিতীয় বেতার কেন্দ্র অনেকবার গানটি প্রচার করে। এই গান সম্পর্কে মুক্তিযোদ্ধা-কণ্ঠশিল্পী মোহাম্মদ আবদুল জব্বার উল্লেখ করেছেন : ‘… এ গানটি ছিল সেই গান, যেটি স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র চালু হওয়ার আগেই ভারতের কোনো এক বেতার থেকে বাজানো হয়েছিল। কোথা থেকে প্রচার হয়েছে, কে গেয়েছে তার কিছুই তখন জানতাম না, শুধু এই গানটি শুনেছি, তার পরেই আমি যুদ্ধে চলে গিয়েছি। এপ্রিলের দিকে কলকাতায় আমরা যখন স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র  খুলি, তখন এই গানটি আমি গেয়েছি এবং গেয়েছেন আরও অনেকে। তখন জানতে পেরেছিলাম, এটি লিখেছেন গৌরীপ্রসন্ন মজুমদার। সুর ও কণ্ঠ দিয়েছেন অংশুমান রায়।’১২ (উল্লেখ্য, ১৯৭১ সালের এপ্রিলে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের কার্যক্রম শুরু হলেও মিডিয়াম ওয়েভে অনুষ্ঠান সম্প্রচার শুরু হয় মে মাসের ২৫ তারিখ থেকে)।

আকাশবাণী ও স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে প্রচারের ফলে ‘শোন একটি মুজিবরের থেকে’ গানটি অসাধারণ জনপ্রিয়তা অর্জন করে। সেইসময়ে গ্রামোফোন যুগের অবসান হয়নি – কলকাতায় এইচএমভি, কলম্বিয়া, মেগাফোন, হিন্দুস্থান রেকর্ড, সেনোলার তখনো রমরমা বাজার। মুক্তিযুদ্ধে এইসব রেকর্ড কোম্পানি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। মুক্তিযোদ্ধা ও মুক্তিকামী বাঙালিকে প্রেরণা-দানের জন্যে এইসব কোম্পানি উদ্দীপনামূলক গান, আবৃত্তি, কথিকার রেকর্ড বের করে। কোম্পানিগুলোর মধ্যে হিন্দুস্থান রেকর্ড কোম্পানি ছিল সবচেয়ে তৎপর ও অগ্রণী। মুক্তিযুদ্ধের সবচেয়ে বেশি ও সমাদৃত গানের রেকর্ড বের করে হিন্দুস্থান। মোহাম্মদ আবদুল জব্বার, আপেল মাহমুদ ও আরো কোনো কোনো বাংলাদেশের শিল্পীর গানের রেকর্ড এখান থেকে বের হয় – রিহার্সাল ও রেকর্ডিংয়ের জন্যে এইসব শিল্পীকে হিন্দুস্থান রেকর্ড কোম্পানির ৬/১ অক্রুর দত্ত লেনের বাড়িতে বেশ কিছুদিন থাকতেও হয়। দেবব্রত বিশ্বাস-দ্বীপেন বন্দ্যোপাধ্যায়-দীপেন মুখোপাধ্যায়-অমর পাল-অংশুমান রায়দের মুক্তিযুদ্ধের গান রেকর্ডিংয়ের কাহিনিও শুনেছি হিন্দুস্থান রেকর্ড কোম্পানির প্রতিষ্ঠাতা চণ্ডীচরণ সাহার কৃতী-পুত্র হিন্দুস্থান রেকর্ড-ইনরেকোর কর্তা শোভনলাল সাহার মুখে।

‘শোন একটি মুজিবরের থেকে’ ও ‘A Million Mujiburs Singing’ এই দু’টি গানের রেকর্ড প্রকাশিত হয় হিন্দুস্থান রেকর্ড কোম্পানি থেকে। অংশুমান রায়ের গানের খাতার তথ্য-অনুসারে গান-দুটির

রেকর্ডং-এর তারিখ ২২ এপ্রিল ১৯৭১। ইংরেজি গানটি বাংলা গানটিরই ভাষান্তরিত রূপ। গানটির রচয়িতা ও অনুবাদক গৌরীপ্রসন্ন মজুমদার, সুরকার ও শিল্পী অংশুমান রায়, ইংরেজি-তরজমার সহশিল্পী করবী নাথ, দুটি গানেরই সংগীত-পরিচালক দিনেন্দ্র চৌধুরী। ৪৫ আরপিএম-এর এই রেকর্ডের নম্বর এসএলএইচ ১৮৩ (৭ এক্সজেই ১০৩৪০ ও ৭ এক্সজেই ১০৩৪১)। গানটির গীতিকার-সুরকার-শিল্পী-সংগীত পরিচালক সবাই ছিলেন রামগড় পদ্মশ্রী সিনেমা হলের সামনের সেই চায়ের দোকানের নিত্য-আড্ডাধারী – সেখানেই এই গানটির জন্ম।

ছয়

‘শোন একটি মুজিবরের থেকে’, এই গানটি গীতিকার গৌরীপ্রসন্ন এবং সুরস্রষ্টা ও গায়ক অংশুমানের এক অনন্য যৌথ-সৃষ্টি। গানের সুপ্রযুক্ত শব্দ ও কথা একটি জাতির উত্থানপর্ব ও তার জনকের সংগ্রামী চেতনার পরিচয় মেলে ধরে – আবহমান বাংলার রূপপ্রকৃতির সঙ্গে স্বাধীনতার আকাঙ্ক্ষাকে এই গীতিকবি অপূর্ব শৈল্পিক চেতনায় মিলিয়ে দিয়েছেন। সুর-যোজনায় মিহি লোকজ সুরের আবহে প্রকাশ পেয়েছে এক আবেগী আবেদন। তুলনাহীন গায়কির বৈশিষ্ট্যে এই গান অমানিশার অবসানে মুক্তির দিগন্তকে ধীরে ধীরে উজ্জ্বল করে তুলতে প্রেরণা জোগায়।

গৌরীপ্রসন্ন (১৯২৪-৮৬) পূর্ববঙ্গের মানুষ – পাবনায় তাঁর জন্ম। এই মাটির সঙ্গে তাঁর নিজের ও পূর্বপুরুষের স্মৃতি ও স্বপ্ন মিশে আছে। দেশভাগের কালে চিরতরে ত্যাগ করতে হয় জন্মভূমি; কিন্তু অনিবার্যভাবে থেকে যায় এক অমোঘ পিছুটান। তাই এই মহান গীতিকার বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময়ে নিজেকে উজাড় করে দেন – হৃদয় দিয়ে শোনেন, অবিনাশী একক মুজিবকণ্ঠের বাণী যা লক্ষ মুজিবরের কণ্ঠস্বরের ধ্বনি প্রতিধ্বনিত হয়ে ওঠে ‘বাংলাদেশ, আমার বাংলাদেশ’ বলে। স্মৃতির কোষ উজ্জীবিত হয়ে ওঠে এই প্রত্যাশায় : ‘আমার হারানো বাংলাকে আবার তো ফিরে পাব’ – এই তাঁর সান্ত্বনা, এই তাঁর প্রাপ্তি ও অর্জন। এ-গান তো তাঁর হৃদয় দিয়ে লেখা – অন্তরের রক্তক্ষরণের বেদনায় রঞ্জিত। প্রেম-বিরহ-নিসর্গ, মূলত এই ছিল যাঁর গীতিকাব্যের বিষয়-গণ্ডি – একাত্তরের বাঙালির সংগ্রাম তাঁর চেতনাকে প্রবলভাবে নাড়া দিয়ে যায় – তাঁর কলম দিয়ে বের হয় বেশকিছু ভিন্ন জাতের গান। তিনি রচনা করেন : ‘ওরা পশুর চেয়েও ঘৃণ্য/ ওরা মানুষ হয়েও মানুষ থেকে ভিন্ন’, ‘পৃথিবী তুমি সত্যি হাসালে/ সত্যিটাকে চেপে রাখতে/ বিবেকটাকে শাসালে’, ‘মা গো ভাবনা কেন/ আমরা তোমার শান্তিপ্রিয় শান্ত ছেলে/ তবু শত্রু এলে অস্ত্র হাতে ধরতে জানি/ তোমার ভয় নেই মা আমরা/ প্রতিবাদ করতে জানি’। গৌরীপ্রসন্ন মজুমদার এক সাক্ষাৎকারে উল্লেখ করেন : ‘আমার জীবনের স্মরণীয় ঘটনা বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ। আমার বাড়ি ছিল পাবনায়। ১৯৪৭ সালে ভারতে চলে আসি। কিন্তু আমার মন পড়ে ছিল বাংলাদেশে। তাই গান দুটি লিখে সেই জন্মস্থানের ঋণ কিছুটা হলে আমি শোধ করেছি।’১৩ কিন্তু এসব শিল্পসৃষ্টির মধ্যে আলাদা মহিমায় ভাস্বর হয়ে আছে তাৎক্ষণিক আবেগে তাঁর কলম থেকে বেরিয়ে আসা ‘শোন একটি মুজিবরের থেকে’ গানটি – এমন আর হয়নি, হয়তো হয়ও না – এ-তাঁর স্মৃতি-সত্তা-ভবিষ্যতের স্মারক-সংগীত।

বাংলাদেশ নিয়ে গৌরীপ্রসন্নের যে-আবেগ ও অনুভূতি, তুলনামূলকভাবে অংশুমানের তা-থাকার কথা নয়, যেহেতু তিনি ছিলেন রাঢ়বঙ্গের মানুষ। কিন্তু তিনি এ-বিষয়ে প্রাণিত হয়েছিলেন বাঙালিত্বের চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে। বাঙালির ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির মূলধারার যে-ঐক্য তার প্রতি অংশুমান ছিলেন শ্রদ্ধাশীল ও দায়বদ্ধ। তাই পূর্ববঙ্গের বাঙালির বিপন্নতা ও অস্তিত্ব-সংকট তাঁকে গভীরভাবে স্পর্শ করেছিল – তাদের সার্বিক মুক্তির লড়াই তাঁর সমর্থন পেয়েছিল। তাই যখন সময় এলো, ‘শোন একটি মুজিবরের থেকে’ গানটি গেয়ে অংশুমান বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রামের সঙ্গে ঐতিহাসিক গৌরবে সম্পৃক্ত হন।

অংশুমান জন্মেছিলেন মেদিনীপুর (বর্তমান ঝাড়গ্রাম) জেলার অন্তর্গত বাছুরডোবা গ্রামে এক ক্ষয়িষ্ণু সামন্ত-পরিবারে, ১৯৩৬ সালের ১৯ আগস্ট। পাঁচ পুরুষ আগে রায়-পরিবারের আদি-নিবাস ছিল বাঁকুড়ার বিষ্ণুপুরে – প্রায় দুশো বছর আগের ভগ্ন-জীর্ণ রায়-বাড়ির নিদর্শন এখনো সেখানে আছে। কোনো সূত্রে রায়-পরিবার জমিদারি অর্জন করেছিলেন। বহুকাল আগে থেকেই এই পরিবারে গানবাজনার চল ছিল। এই রায়-পরিবারের পূর্বপুরুষেরা বংশ-পরম্পরায় বাঁকুড়ার সংগীতপ্রিয় জমিদারের সভা-গায়ক ছিলেন। অংশুমানের পূর্ব-পুরুষের পদবি ছিল ‘চৌধুরী’, সংগীতে অসামান্য ব্যুৎপত্তি ও নৈপুণ্যের জন্যে বাঁকুড়ার জমিদার তাঁদের ‘রায়’ উপাধি দেন – সেই থেকে পূর্ব-পদবি অপ্রচলিত ও ক্রমে বিলুপ্ত হয়ে বহাল থাকে এই ‘রায়’ উপাধিই। একসময় জমিদারের বোলবোলাও হ্রাস পায়, ফলে রায়-দেরও সংগীত-ঐতিহ্যের ধারাবাহিকতা ছিন্ন হয় অংশুমানের দু-এক পুরুষ আগে থেকেই। তাঁর পিতা ঝাড়গ্রাম আদালতের চাকুরে ও শখের হোমিওপ্যাথ চিকিৎসক রামপদ রায় সংগীতের সঙ্গে একেবারেই যুক্ত ছিলেন না – তবে তাঁর বড়ো ছেলে শঙ্কর রায়ের রক্তে আবার সংগীত জেগে ওঠে।

অগ্রজ শঙ্কর রায়ের কাছেই অংশুমানের গানের হাতেখড়ি। রেওয়াজের জন্যে অনুজকে একটি তানপুরাও কিনে দেন তিনি। এরপর অংশুমান পিতার এক সংগীতজ্ঞ বন্ধুর কাছে বেশ কিছুকাল ঠুমরি ও রাগপ্রধান গান শেখেন। পরে কলকাতায় গিয়ে জ্ঞানপ্রকাশ ঘোষ, প্রবীর মজুমদার ও আরো কারো কারো কাছে সংগীতের তালিম নেন। তবে তাঁর মূল আকর্ষণ ছিল লোকগানে। আদিবাসী মানুষ ও সংস্কৃতি, পরিবেশ ও প্রকৃতি তাঁকে মুগ্ধ ও আচ্ছন্ন করে রাখতো। শাল-মহুয়ার বন, লালমাটির পথরেখা, দিনের আলো নিবে গেলে ঢামসা-মাদলের সঙ্গে ভাদু-টুসু-ঝুমুর গান আর মহুয়া-রসের মন-কাড়া গন্ধ –    অংশুমান এই পরিবেশেই মানুষ। পিতার সাংগীতিক উত্তরাধিকারের ধারক ভাস্কর রায় এ-প্রসঙ্গে বলেছেন : ‘সেই বয়স থেকেই মাদলের শব্দ আর ভাদু-টুসু-ঝুমুর তাঁর সঙ্গী। তাই পরবর্তী সময়ে তাঁর বেশির ভাগ গানের মধ্যেই সেই ছোঁয়া খুঁজে পাওয়া যায়। তাঁর কণ্ঠের জাদু-মাদকতায় আজও বাংলা-সংগীতপ্রেমী মানুষ মজে আছেন।’

জীবনের চব্বিশ বছর বয়স পর্যন্ত অংশুমান রায় ঝাড়গ্রামে ছিলেন। স্কুলের লেখাপড়া শেষ করেন ঝাড়গ্রাম কে.কে.আই. হাইস্কুল থেকে – তারপরে ভর্তি হন ঝাড়গ্রাম রাজ কলেজে। তখন তিনি রাঢ়বঙ্গের লোকগানের চর্চায় নিমগ্ন – তাঁর নামও ছড়িয়ে পড়ে আশেপাশের জেলাগুলোতে। এইসময় তিনি রাঢ়বাংলার আদিবাসী জীবন ও সংস্কৃতির অনুসন্ধান ও তথ্য-সংগ্রহে আগ্রহী হন।

ষাটের দশকের একদম গোড়াতেই তিনি কলকাতা আসেন। অল্পদিনেই সংগীতজগতে তাঁর মেধা-প্রতিভা ও স্বকীয়তার গুণে পরিচিতি ও সমাদর লাভ করেন। ১৯৬১ সালের ৬ জুলাই তাঁর জন্মগ্রাম বাছুরডোবা গ্রামেরই কমলা বন্দ্যোপাধ্যায়কে বিয়ে করেন। কমলা গানের জগতের কেউ ছিলেন না, কিন্তু ঠিকঠাক সংসার-সামলিয়ে অংশুমানের সংগীতচর্চাকে নির্বিঘ্ন করেছিলেন, এ-তাঁর বড়ো কৃতিত্ব ও অবদান।

কলকাতায় তাঁর সংগীতজীবন দ্রুতই বিকশিত হতে থাকে। ১৯৬২-তে প্রথম বারেই আকাশবাণী কলকাতা কেন্দ্র থেকে অডিশনে পাশ করেন। তিনি আকাশবাণীতে নিজের সুরে প্রচলিত এই ঝুমুর গানটি প্রথম পরিবেশন করেন – ‘সাঁঝে ফোটে ঝিঙ্গা ফুল, সকালে মলিন গো’। শ্রোতারা মুগ্ধ ও অভিভূত হন এই গান শুনে – লোকগানের এক নতুন ধরন তাঁদের কাছে উন্মোচিত হয়। এ-বিষয়ে আব্বাসউদ্দিন তাঁর মহান পূর্বসূরি – যিনি উত্তরবঙ্গের লোকগান, মূলত ভাওয়াইয়াকে বিদগ্ধ নগরবাসীর সমাদরের যোগ্য করে তুলেছিলেন। অংশুমান জনপ্রিয়তার তুঙ্গে ওঠেন হিন্দুস্থান রেকর্ড ও ইনরেকো লেবেলে রাঢ়বাংলার লোকগান রেকর্ড করে। লোকের মুখেমুখে ফিরতে থাকে – ‘দাদা পায়ে পড়ি রে, মেলা থেকে বউ এনে দে’, ‘আমার বেটার বিহা দিবো’, ‘পাড়া-পড়শি সবাই জানে’, ‘আমার বধূ মান করেছে’, ‘বলি ও খোকার মা’, ‘প্রেমনগরে যাবো আমি’, ‘ভাদর আশ্বিন মাসে ভ্রমর বসে কাঁচা বাঁশে’ – এসব গান। এইচএমভি, কলম্বিয়া, সেনোলা বা অন্য দু-একটি কোম্পানি থেকেও অংশুমানের গানের কিছু রেকর্ড বের হয় – তবে হিন্দুস্থান রেকর্ড-ইনরেকোই রেকর্ডে তাঁর গানের প্রধান ধারক –    তাঁর পরিচিতি ও জনপ্রিয়তার প্রসারে এদের অবদানই মুখ্য।

অংশুমান রায় রাঢ়বাংলার লোকগানের শিল্পী হিসেবেই মান্যতা ও প্রতিষ্ঠা পান। অন্য ধরনের গান গাওয়ার প্রয়াস কতটুকু গ্রহণযোগ্যতা পেতে পারে, তা নিরীক্ষিত ছিল না। যে-বিশেষ লোকগানের জন্যে তাঁর খ্যাতি, তার বাইরে গিয়ে তিনি শ্রোতার মনোযোগ ও সমাদর কতটুকু পাবেন, সে-প্রশ্নটি তো যুক্তিহীন নয়। ভিন্ন এক মেজাজের গান – আলাদা ঘরানার এক শিল্পী –    এসব সংশয় ছাপিয়ে নতুন ইতিহাস রচনা করে – ‘শোন একটি মুজিবরের থেকে’ গানটি – সংগীতশিল্পী অংশুমানের সফলতার মুকুটে আরেকটি স্বর্ণপালক যোজিত হয়। এই গানের পর অংশুমান আরো প্রায় কুড়ি বছর বেঁচেছিলেন – এই সময়ে তিনি রেডিয়ো-গ্রামোফোন-মঞ্চে অনেক গানই করেছেন, কিন্তু তার প্রায় সবই লোকগান – আর কখনো দ্বিতীয়বারের জন্যে সৃষ্টি হয়নি মুজিব ও বাংলা-বন্দনার এমন গান। এ-ও সত্য, ধ্রুপদি শিল্পের জন্ম হামেশাই হয় না – তার জন্যে প্রয়োজন সুবর্ণ মুহূর্ত ও মাহেন্দ্রক্ষণের।

সাত

এই গানটির বহুমাত্রিক ব্যঞ্জনার কথা নানা ঘটনা-কাহিনি-উপলব্ধি-ব্যাখ্যার সূত্রে জানা যায়। মুক্তিযুদ্ধে পূর্ববাংলার মানুষের পাশে এসে দাঁড়িয়েছিল ভিনদেশি বাঙালিরাও – বিশেষ করে পশ্চিমবঙ্গ-আসাম-ত্রিপুরার বঙ্গভাষী মানুষ। ধর্ম-সম্প্রদায়-জাতিনির্বিশেষে বাঙালির সঙ্গে বাঙালির এমন প্রীতি-অনুরাগ-ঐক্য-মিলন ইতিহাসের আর কোনো পর্বে ঘটেছে কী না জানা নেই। একজন প্রত্যক্ষদর্শী এই গানটি নিয়ে কিছু অজানা কথা জানিয়েছেন, তা কম গুরুত্বপূর্ণ নয়। সে-কথা ১৯৭১ সালের দুর্গাপূজার সময়ের। সেবারে দুর্গাপূজা হয় সেপ্টেম্বরের একেবারে শেষের দিকে। পূজার আয়োজনে অভিনব কিছু বিষয়ের সংযোজন হয় যা অতীতে কখনো হয়নি, ভবিষ্যতেও আর হবে কী না তা বলা কঠিন। ১৯৭১-এর দুর্গাপূজার প্রসঙ্গে এক-লেখক চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সে-সময়ের উপাচার্য অধ্যাপক এ.আর. মল্লিকের বরাত দিয়ে জানান : ‘সে সময় ভারতে বাংলাদেশের সমর্থনে এমন একটি জোয়ার এসেছিল যে, সব জায়গায় এমনকি দুর্গাপূজা মণ্ডপের প্রবেশ দ্বারেও বঙ্গবন্ধুর প্রতিকৃতি টানানো দেখেছি।’ আবার কেউ কেউ এ-ও দেখেছেন : ‘একাত্তরে স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় কলকাতা ও পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন স্থানে বহু পূজামণ্ডপে বঙ্গবন্ধুর ছবি ফুল দিয়ে সাজিয়ে ঠাকুরের পাশে সম্মানের সাথে রাখা হয়েছিল।’ একাত্তরের দুর্গাপূজায় মুক্তিযুদ্ধের গান নিয়েও আয়োজকদের মধ্যে যথেষ্ট উদ্দীপনা দেখা দেয় – সেখানেও প্রাধান্য ছিল ‘শোন একটি মুজিবরের থেকে’ গানটির। পূজার আয়োজনে-অনুষ্ঠানে মুক্তিযুদ্ধের প্রতি যাতে সমর্থনের বিষয়টি স্পষ্ট ও জোরালো হয়ে ওঠে, তার জন্যে গানের সঙ্গে মিছিল নিয়ে মানুষের কাছে ‘ভিক্ষা’ ও ‘দান’ গ্রহণের সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। সেদিন অংশুমান কী-এক আবেগ ও প্রেরণায় তাঁর মুক্তিযুদ্ধের অবিনাশী গান নিয়ে রাস্তায় নামেন। প্রত্যক্ষদর্শী লেখক জানান : ‘বাবার বন্ধু ছিলেন অংশুমান রায়। তখন তিনি দারুণ হিট। আরেক বন্ধু সুধীন দাশগুপ্ত, টলু কাকু। নামি সুরকার। এঁদের ধরে নিয়ে গলায় হারমোনিয়াম বেঁধে, ভ্যানে তবলা ও মাইক রেখে হেঁটে হেঁটে এলাকা প্রদক্ষিণ শুরু হলো। অংশুমান রায় উদাত্ত কণ্ঠে গাইছেন, শোন একটি মুজিবরের থেকে লক্ষ মুজিবরের …। আমরা গাইছি, বাংলাদেশ, আমার বাংলাদেশ। … সেকী উন্মাদনা! প্রত্যাশার চেয়েও বেশি দান ও নতুন জামাকাপড় পেলাম আমরা।’১৪

আট

নয় মাসের মুক্তিযুদ্ধের সমাপ্তি হয় ১৯৭১-এর ১৬ ডিসেম্বর, হানাদার পাকবাহিনীর আত্মসমর্পণের মধ্য দিয়ে। বিশ্ব-জনমতের চাপে পাকিস্তানের কারাগার থেকে মুক্তি পেয়ে ১৯৭২-এর ১০ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধু ফিরে আসেন স্বাধীন দেশে – বাঙালির মুক্তিযুদ্ধের মহানায়কের স্বদেশ-প্রত্যাবর্তনের ফলে বাংলাদেশের বিজয় ও স্বাধীনতা পূর্ণতা পায়। মুক্তির সংগ্রাম শেষ হয়, কিন্তু গৌরীপ্রসন্ন-অংশুমানের ‘শোন একটি মুজিবরের থেকে’ এই গানের আবেদন ও মহিমা কখনো ফুরায় না – এই গান চিরায়ত সংগীত-শিল্পের মর্যাদা লাভ করে।

এ-গানের অনুরণন নিরন্তর বাজতে থাকে অংশুমানের অন্তরে। তাঁর একান্ত বাসনা ছিল এই গানের স্মৃতি-স্মারক নিয়ে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে সাক্ষাতের – তাই আকাশবাণী থেকে সংগ্রহ করে গুছিয়ে রাখেন ‘সংবাদ-বিচিত্রা’য় প্রচারিত বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ ও অংশুমানের গানের রেকর্ডকৃত টেপ এবং হিন্দুস্থান রেকর্ড কোম্পানি-প্রকাশিত ডিস্্ক রেকর্ডটি। ‘সংবাদ-বিচিত্রা’র টেপের মলাটে লিখে রাখেন – ‘বঙ্গবন্ধুকে – আকাশবাণী থেকে প্রচার [প্রচারিত] বিশেষ সংবাদ বিচিত্রা – অংশুমান রায় –    ৫/২/৭২’। কিন্তু কাল ছিল বিরোধী – তাই বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে সাক্ষাৎ হয়নি, ফলে তাঁর হাতে এই উপহারও তুলে দিতে পারেননি।

১৯৭৫ সালে বাংলাদেশ সরকারের তরফে প্রণবেশ সেন, দেবদুলাল বন্দ্যোপাধ্যায়, গৌরীপ্রসন্ন মজুমদার ও অংশুমান রায়কে ‘বঙ্গবন্ধু স্বর্ণপদক, ১৯৭৫’ (‘Bangabandhu Gold Medal, 1975’) প্রদানের কথা ঘোষণা করা হয়। সম্মাননা-প্রাপক এই চারজন ছিলেন আকাশবাণী কলকাতা কেন্দ্র থেকে প্রচারিত বিশেষ ‘সংবাদ-বিচিত্রা’র প্রধান কুশীলব, যথাক্রমে – স্ক্রিপ্ট-লেখক, উপস্থাপক, গীতিকার ও সুরস্রষ্টা-শিল্পী। এই ঘোষণার পরিপ্রেক্ষিতে কলকাতার বাংলাদেশ উপ-দূতাবাস ১৯৭৫-এর ১৯ জুলাই সন্ধ্যা সাতটায় এঁদের সম্মানে এক সংবর্ধনার আয়োজন করেন। এর প্রায় এক মাসেরও কম সময়ের ব্যবধানে ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধু নৃশংসভাবে নিহত হন। এরপর বাংলাদেশের পরবর্তী সরকারের পক্ষ থেকে এ-বিষয়ে আর  কোনো উদ্যোগ নেওয়া হয়নি।

কখনো দেখেননি, লাভ করেননি তাঁর সাহচর্য, জন্মসূত্রে পূর্ববঙ্গের মানুষও ছিলেন না – তবুও বঙ্গবন্ধু ও বাংলাদেশের প্রতি অংশুমানের গভীর অনুরাগ ও আকর্ষণ ছিল – এই অনুভূতির জন্ম বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের কালে। ১৯৭৫-এর ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধুর নির্মম হত্যাকাণ্ড অংশুমানকে গভীর শোক ও বেদনায় মুহ্যমান করে তোলে। রেডিয়োতে এই মর্মান্তিক খবর শুনে তিনি হাহাকারে দীর্ণ হন। অংশুমানের শোকার্ত প্রতিক্রিয়া কেমন ছিল, সে-সম্পর্কে তাঁর পুত্র ভাস্কর উল্লেখ করেছেন : ‘বঙ্গবন্ধু-হত্যার খবর রেডিয়োতে শুনে বাবা আর্তনাদ করে ওঠেন। তাঁর দুই চোখ ভরে ওঠে জলে – স্বজন-হারানোর মতো শোকে তিনি ছেলেমানুষের মতো কাঁদতে থাকেন অবিরাম। সেই দৃশ্যের স্মৃতি এখনো আমার মন থেকে মুছে যায়নি।’ এ-থেকে বোঝা যায়, বঙ্গবন্ধু তাঁর মনের গভীরে কতটুকু জায়গা জুড়ে ছিলেন।

নয়

২০১২ সালের মার্চে বাংলাদেশ সরকার বিদেশি নাগরিক যাঁরা ১৯৭১-এর মুক্তিযুদ্ধে নানাভাবে সমর্থন-সহায়তা করেন ও মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে অবদান রাখেন, তাঁদের ‘মুক্তিযুদ্ধ মৈত্রী সম্মাননা’ (‘Friends Of Liberation War Honour’) প্রদানে স্বীকৃতি ও সম্মান প্রদর্শন করা হয়। ‘শোন একটি মুজিবরের থেকে’, এই গানের গীতিকার গৌরীপ্রসন্ন মজুমদার এবং সুরকার ও শিল্পী অংশুমান রায় দু’জনই তখন পরলোকে। গৌরীপ্রসন্ন প্রয়াত হন ১৯৮৬-তে। অংশুমান চলে যান ৪ এপ্রিল ১৯৯০। তাঁর স্ত্রী কমলা রায়ের আকস্মিক মৃত্যু হয় ১৯৯০-এর ৬ ফেব্রুয়ারি। পুত্র ভাস্কর রায়ের সূত্রে জানা যায়, তাঁর মায়ের মৃত্যু বাবা অংশুমানকে ‘গভীর শোক-অবসাদের মধ্যে নিয়ে যায়’ – এই বিচ্ছেদ সইতে না-পেরে ‘তিনি ইহজগতের মায়া ত্যাগ করেন।’ এ-কারণে না-গৌরীপ্রসন্ন না-অংশুমান, দুজনের কেউই এই সম্মাননা-স্মারক নিজের হাতে গ্রহণ করতে পারেন।

বাংলাদেশ সরকারের আমন্ত্রণে ঢাকায় এসে ২৭ মার্চ ২০১২ (১৩ চৈত্র ১৪১৮) অংশুমান রায়ের পক্ষে তাঁর শিল্পী-পুত্র ভাস্কর রায় এই মরণোত্তর ‘মুক্তিযুদ্ধ মৈত্রী সম্মাননা’ গ্রহণ করেন গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের মহামান্য রাষ্ট্রপতি মো. জিল্লুর রহমান ও সরকারের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার হাত থেকে। রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রী-স্বাক্ষরিত এই সম্মাননা-স্মারকে উল্লেখ করা হয় : ‘শ্রীঅংশুমান রায়/ সংগীতশিল্পী ও গীতিকার, ভারত/ কে/ গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে অনন্যসাধারণ অবদানের জন্য/ বাঙালি জাতির শ্রদ্ধা ও কৃতজ্ঞতার নিদর্শনস্বরূপ/ মুক্তিযুদ্ধ মৈত্রী সম্মাননা (মরণোত্তর) প্রদান করা হল।’ প্রয়াত পিতার পক্ষে এই ‘মুক্তিযুদ্ধ মৈত্রী সম্মাননা’ গ্রহণ প্রসঙ্গে  ভাস্কর রায়ের অনুভূতি জানা যায় এইভাবে : ‘সেই দিনের কথা-অনুভূতি আমি ভাষায় লিখে বোঝাতে পারছি না। … আমার পিতা অংশুমান রায়ের তথা সমগ্র বাঙালি জাতির হয়ে একজন ভারতীয় হিসাবে এই ‘সম্মাননা’ গ্রহণ করে আমিও সম্মানিত।’ ‘জয় বাংলা জয় বঙ্গবন্ধু।’১৫

দশ

আমরা দাঁড়িয়ে আছি ২০২১-এ – বাঙালি জাতির জন্যে এ-এক মহাযোগের কাল। এই সময়পর্ব মুজিববর্ষ – বাঙালি জাতিসত্তার উদ্বোধক ও জাতিরাষ্ট্রের জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের চলমান জন্মশতবর্ষ, মহান মুক্তিযুদ্ধ ও বাংলাদেশ-প্রতিষ্ঠার পঞ্চাশ বছর, পাশাপাশি মুক্তিযুদ্ধের অবিস্মরণীয় সংগীতের জন্মেরও অর্ধশতবর্ষ। উদ্্যাপনের এই ত্রিধারার দুর্লভ মিলনে, বহমান পদ্মা-মেঘনা-যমুনার জলধারায় যেন চেতনার ধ্বনি জাগে – ‘জয় বাংলা’।

তথ্যসূত্র

        ১.      শেখ মুজিবুর রহমান। অসমাপ্ত আত্মজীবনী। পঞ্চম মুদ্রণ : ঢাকা, জানুয়ারি ২০১৯; পৃ ১১১।

        ২.      ওই; পৃ ১১১।

        ৩.      ওই; পৃ ১১১।

        ৪.      দৈনিক স্টেটসম্যান (কলকাতা) : ২৩ আগস্ট ২০১৫। ভাস্কর রায়ের সাক্ষাৎকার : রানা দাস-গৃহীত।

        ৫.      বিবিসিতে প্রচারিত ভাস্কর রায়ের সাক্ষাৎকার : ‘চায়ের আড্ডায় সিগারেটের কাগজে যেভাবে জন্ম হয় ‘শোন একটি মুজিবরের থেকে’ গানটির’। বিবিসির কলকাতা-প্রতিনিধি অমিতাভ ভট্টশালী-গৃহীত : ১৭ মার্চ ২০১৯। সূত্র : ইন্টারনেট।

        ৬.      স্নেহাশিস সুর-সম্পাদিত : বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ : কলকাতার সাংবাদিকরা ও প্রেস ক্লাব কলকাতা। কলকাতা, জুলাই ২০১৯। উপেন তরফদার : ‘রক্তের মৈত্রী-বন্ধনে ভারত-বাংলাদেশ’; পৃ ১৯৩।

        ৭.      ওই; পৃ ১৯৪।

        ৮.      ওই; পৃ ১৯৪।

        ৯.      অমর সাহা : কলকাতার বুদ্ধিজীবীদের দৃষ্টিতে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ। দ্বিতীয় মুদ্রণ : ঢাকা, জুলাই ২০১৯; পৃ ১১৮।

        ১০.     বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ : কলকাতার সাংবাদিকরা ও প্রেস ক্লাব কলকাতা। পূর্বোক্ত। প্রণবেশ সেন : ‘সময় ও স্বপ্নের যৌথ শিল্প : একাত্তরের সংবাদ পরিকল্পনা’; পৃ ১৭২।

        ১১.     ওই; পৃ ১৭২-১৭৩।

        ১২.     প্রথম আলো (দৈনিক, ঢাকা) : ১০ মার্চ ২০০৫ (পুনর্মুদ্রণ : ১৩ ডিসেম্বর ২০১৮)। আশা নাজনীন : ‘যুদ্ধদিনের মুক্তির গান’।

        ১৩.     প্রথম আলো (দৈনিক, ঢাকা) : ৯ ডিসেম্বর ২০১৮। আখতার হুসেন : ‘মুক্তির ইতিহাসে গৌরীপ্রসন্ন মজুমদারের দুই গান’।

        ১৪.     ভোরের কাগজ (দৈনিক, ঢাকা) : ১৯ অক্টোবর ২০১৮। অমিত গোস্বামী : ‘১৯৭১-এর মুক্তিযুদ্ধ ও কলকাতার দুর্গাপূজা’।

        ১৫.  এখানে ব্যবহৃত ভাস্কর রায়ের সূত্রহীন বক্তব্য ও তথ্য প্রবন্ধকার আবুল আহসান চৌধুরীকে তাঁর প্রেরিত নানা-সময়ের ই-মেইল বার্তা থেকে গৃহীত।

ব্যক্তিঋণ

১. ভাস্কর রায় : অংশুমান রায়ের জ্যেষ্ঠ পুত্র। সংগীতশিল্পী, কলকাতা।

২. বিষ্ণু দাশ : চিত্রশিল্পী ও ভাস্কর, কলকাতা।

৩. শোভনলাল সাহা : ম্যানেজিং ডিরেক্টর, হিন্দুস্থান মিউজিক্যাল প্রোডাক্টস্্ লিমিটেড ও ইনরেকো, কলকাতা।

৪. দীপক দাশগুপ্ত : প্রাক্তন প্রধান আধিকারিক, হিন্দুস্থান মিউজিক্যাল প্রোডাক্টস্্ লিমিটেড, কলকাতা। ৫. সঞ্জীব কুমার মুখার্জি : আধিকারিক, হিন্দুস্থান মিউজিক্যাল প্রোডাক্টস্্ লিমিটেড, কলকাতা।