একশ বছরেরও বেশি সময় ধরে বাঙালির ঘরোয়া বিনোদনের প্রধান মাধ্যম ছিল ‘গ্রামোফোন’ – কালের হিসাবে ১৮৭৯ থেকে বিশ শতকের আশির দশক পর্যন্ত। একটু বিস্মিতই হতে হয় এ-কথা জেনে যে, টমাস আল্ভা এডিসনের
‘গ্রামোফোন’-যন্ত্র আবিষ্কারের (১৮৭৭) মাত্র দু-বছরের মধ্যেই এই যন্ত্রটি বঙ্গদেশে পৌঁছে যায়। পার্থ চট্টোপাধ্যায় জানান : ১৮৮৯ সালে স্যামুয়েল হ্যারাডেন ‘একটি নিম্নমানের ফোনোগ্রাম যন্ত্র’ কলকাতায় নিয়ে আসেন। এই মার্কিন ভদ্রলোক কলকাতার ‘টাউন হলে মহমেডান লিটারেরি সোসাইটির বার্ষিক সম্মেলনে ফোনোগ্রাম যন্ত্রটির দক্ষতা প্রদর্শন করেছিলেন’ (দৈনিক আজকাল : ৩০ অক্টোবর ২০১১)। সম্ভবত এই প্রয়াসের পেছনে ছিল ব্যবসায়িক উদ্দেশ্য। আর এই মহমেডান লিটারেরি সোসাইটি ছিল মুসলিম সম্প্রদায়ের প্রধান সামাজিক সংগঠন এবং এর নেতৃত্বে ছিলেন নবাব আবদুল লতিফ। ১৮৮৮ সালে কলকাতার সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজের অধ্যাপক ফাদার লাফোঁ একটি ‘ফোনোগ্রাফ’ যন্ত্র সংগ্রহ করেন। অবশ্য আরেকটি অসমর্থিত তথ্যের সূত্রে জানা যায়, ১৮৭৮-এর শেষে অর্থাৎ আবিষ্কারের প্রায় বছরখানেকের মধ্যেই নাকি ‘ফোনোগ্রাফ’ যন্ত্রের সঙ্গে কলকাতার মানুষের পরিচয় ঘটে। যাই হোক, ফাদার লাফোঁর কিছু পরেই বিজ্ঞানী আচার্য জগদীশচন্দ্র বসু তাঁর সেই সময়ের কর্মস্থল কলকাতার প্রেসিডেন্সি কলেজের গবেষণাগারে এই ধরনের একটি ‘ফোনোগ্রাফ’-যন্ত্র স্থাপন (১৮৯১) এবং সেই যন্ত্রে রবীন্দ্রনাথের কণ্ঠে গানও রেকর্ড করেন। স্বামী বিবেকানন্দ আমেরিকা সফরকালে সেখান থেকে ১৮৯৪ সালের শেষদিকে তাঁর অন্তরঙ্গ সুহৃদ খেতরির মহারাজাকে একটি ‘ফোনোগ্রাফ’-যন্ত্র উপহার পাঠানোর কথা এক চিঠি থেকে জানা যায়। ১৮৯৬ সালের মধ্যেই জোড়াসাঁকোর ঠাকুরবাড়িতেও যে ‘ফোনোগ্রাফ’-যন্ত্র প্রবেশ করেছে তার প্রমাণ মেলে ‘খামখেয়ালি সভা’র প্রথম অনুষ্ঠানপত্রে। এর পরের কাহিনি বিশেষ থেকে নির্বিশেষ হওয়া – ব্যক্তির বলয় ভেঙে সর্বজনীন হওয়ার ইতিহাস।
দুই
বাঙালি মুসলমানের ঘরে ফোনোগ্রাফ বা গ্রামোফোনের প্রথম প্রবেশ কখন ঘটে, সেই তথ্য অজ্ঞাত – তবে
বঙ্গদেশে-বাঙালি সমাজে-কলকাতায় এই যন্ত্রের প্রথম প্রদর্শন যে মুসলিম সমাজের প্রধান সংগঠনের অনুষ্ঠানেই হয়েছিল, তা আমরা জেনেছি। কিন্তু মুসলিম-গৃহে গ্রামোফোনের প্রবেশ কিছুটা বিলম্বিতই হয়েছিল, কারণ – গানবাজনার ব্যাপারে শাস্ত্রীয় বাধা, সামাজিক রক্ষণশীলতা ও আর্থিক অসংগতি। অবশ্য বাংলায় ছোটো-বড়ো মুসলিম জমিদারের সংখ্যা একেবারে কম ছিল না। নিশ্চয়ই তাঁদের কারো কারো ঘরে উনিশ শতকেই গ্রামোফোন পৌঁছে গিয়েছিল। কেননা গানবাজনা বা আমোদ-প্রমোদের ব্যাপারে তাঁরা যে প্রতিবেশী হিন্দু জমিদারদের চেয়ে খুব পিছিয়েছিলেন তা নয়। অনুমান ছাপিয়ে অন্তত একটি স্পষ্ট সাক্ষ্য মেলে বিষাদ-সিন্ধুর লেখক মীর মশাররফ হোসেনের ভাষ্যে। পত্নীর মৃত্যুতে শোককাতর মশাররফ বিবি কুলসুম (১৯১০) বইয়ে স্মৃতিচারণা করতে গিয়ে কুলসুমের গ্রামোফোনের প্রতি অনুরাগের কথা জানিয়েছেন। গ্রামোফোন-রেকর্ডে গান শুনতে তিনি ভালোবাসতেন। কুলসুম বই আর গানের খুব অনুরাগী ছিলেন। বই পড়ার অবসরে গ্রামোফোনে গান শুনতেন। মশাররফ উল্লেখ করেছেন, ‘কুলসুম বিবি নিম্নলিখিত কয়েকটি গান আগ্রহ করিয়া শুনিতেন’, যেমন – পদাবলি কীর্তন, শ্যামাসংগীত, দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের গান – বিশেষ করে ‘গোঠ হইতে আইল নন্দদুলাল’, ‘সাধ না মিটিল আশা না পুরিল’, ‘এ কি সেই যমুনা প্রবাহিনী’, ‘হেসে নেও দুদিন বৈ ত নয়’ – এছাড়া তাঁর খুব প্রিয় ছিল চণ্ডীদাসের পদ। লালচাঁদ বড়ালের কণ্ঠে ‘ধিনতা ধিনা পাকা নোনা’ গানটি শুনে সবাই যখন আমোদে হাস্যমুখর হয়ে উঠতো – কুলসুম কিন্তু সেই হাস্যকৌতুকে অংশ নিতেন না – কোনো কোনো গান শুনে তাঁর ‘চক্ষে জল পড়িত’। গ্রামোফোন অবরোধবাসিনী এক মুসলিম বঙ্গললনার অন্তরকে কীভাবে প্লাবিত করে দিত, তার অন্তরঙ্গ সাক্ষ্য দেয় এই বিবরণ।
ভাওয়াইয়া গানের সুরের জাদু যাঁর কণ্ঠকে দিয়েছিল ভিন্ন এক মহিমা, সেই আব্বাসউদ্দীন আহমদের সঙ্গে গ্রামোফোনের পরিচয় তাঁর ছেলেবেলাতেই। তখন গ্রামের মুসলমান
চাষি-গেরস্তের ঘরে ঘরে গ্রামোফোন বাজিয়ে শোনানোর ভ্রাম্যমাণ কলের গান-অলার দেখা মিলতো। ১৯১২-১৩ সালের দিকে, তাঁর আমার শিল্পী জীবনের কথা (১৯৬০) নামের
আত্মস্মৃতি-পুস্তকে, ‘প্রথম গ্রামোফোনে গান শোনা’র বিস্ময়কর অভিজ্ঞতার বিবরণ দিয়েছেন। গান শুনে অভিভূত ও হতবাক আব্বাসের মনে হয়েছে : ‘তাজ্জব কাণ্ড – চোঙ্গাওয়ালা এক কলের গান থেকে সত্যিই গান বেরুচ্ছে। অবাক হয়ে গেলাম। কী করে একটা বাক্সের ভেতর থেকে গান হয় এ কৌতূহল আর দমন করতে না পেরে লোকটাকে বললাম, ‘খুলে দেখাও তো ভেতরে কে গান গাইছে?’ কিছু বাড়তি চালের বিনিময়ে গ্রামোফোন-অলা যন্ত্র খুলে রহস্য ফাঁস করে দেয় – সেখানে লুকিয়ে-থাকা গানের লোক নেই, রেকর্ডের ওপর পিন চাপিয়ে দিলেই বাক্স থেকে মন-ভোলানো সব গান বের হয়। ওই প্রথম গ্রামোফোনে গান শোনার সুযোগ আব্বাসউদ্দীনের মনে যে গায়ক হওয়ার স্বপ্নবীজ বুনে দিয়েছিল, উত্তরকালে তা সফল ও সার্থক হয়ে উঠেছিল। পরে যে এই গ্রাম্যবালক সাড়া-জাগানো শিল্পী হয়ে ওঠেন, তার মূলে ছিল গ্রামোফোনেরই একান্ত ভূমিকা।
গওহরজান-কে. মল্লিক-নজরুল-আব্বাসউদ্দীনের সাংগীতিক অবদানের পরিপ্রেক্ষিতে ধীরে ধীরে মুসলিম জনমানসেও গ্রামোফোন জায়গা করে নেয়। কলের গানের ব্যবসায়েও সেই একেবারে প্রায় গোড়ার দিকেই বাঙালি মুসলমান ঝুঁকেছিল। টাঙ্গাইল দেলদুয়ারের জমিদার-নন্দন বিশিষ্ট রাজনীতিক স্যার আবদুল হালিম গজনবী গ্রামোফোন ও রেকর্ড-ব্যবসায়ে প্রথম বাঙালি মুসলমান। গ্রামোফোন রেকর্ড কোম্পানি প্রতিষ্ঠাতেও মুসলমান সম্প্রদায়ের উদ্যোগের কথা জানা যায়। মীনা পেশোয়ারি নামে কলকাতার এক বিশিষ্ট ও বিত্তবান অবাঙালি মুসলমান ফল-ব্যবসায়ী বিশের দশকে, সম্ভবত ১৯২৫-২৬ সাল নাগাদ, কলকাতায় ‘শাহানশাহ্ রেকর্ড কোম্পানি’ গড়ে তোলেন। উদ্যোগটা অবাঙালির হলেও এর সঙ্গে বাঙালি হিন্দু-মুসলমানেরই মূলত সম্পৃক্ততা ছিল। ‘শয়তানের বাক্স’ গোনাহ্র বেড়া ডিঙিয়ে অবশেষে বাঙালি মুসলমানের শুধু অন্দরমহল নয়, অন্তরমহলেও প্রবেশের অধিকার পেল।
বাঙালি মুসলমান সমাজে কলের গানের কদর যে বাড়ছিল নানা সূত্রে সে-খবর পাওয়া যায়। ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ের অধ্যাপক কাজী মোতাহার হোসেন ছিলেন মুক্ত মন ও উদার দৃষ্টিভঙ্গির মানুষ। ১৯২৬-এ ঢাকায় গড়ে ওঠা বুদ্ধির
মুক্তি-আন্দোলনের প্রতিষ্ঠান ‘মুসলিম সাহিত্য সমাজে’র তিনি ছিলেন অন্যতম পুরোধা। বিজ্ঞানসাধক মোতাহার হোসেন সাহিত্য ও সংগীতের চর্চাতেও নিবেদিত ছিলেন। তাই কলের গানের প্রতি তাঁর অনুরাগ ও আকর্ষণ ছিল স্বাভাবিক।
১৯৩১-এর ১লা এপ্রিল স্ত্রীকে লেখা এক চিঠিতে তিনি গ্রামোফোন কেনার প্রসঙ্গে বলেছেন : ‘আজ ১৪০্ [টাকা] পাঠাচ্ছি। ১০০্ টাকা গ্রামোফোন বাবদ। ২১০্ টাকার গ্রামোফোনই নিয়ো। যদি Gramophone না হয়, তবে ৬১২৮৮ নং পলিসীর দরুন ধার ইনশিওর অফিসে শোধ দেয়া হয়। আমি বলি, যখন সুবিধায় পাওয়া যাচ্ছে, তখন Gramophone নেওয়াই ভাল।’ এ-থেকে বেশ বোঝা যায়, তিরিশের দশকে শিক্ষিত, সম্পন্ন ও রুচিবান বাঙালি মুসলমানের ঘরে বিনোদনের সামগ্রী হিসেবে গ্রামোফোন বেশ জনপ্রিয় হয়ে উঠেছিল।
তিন
‘গ্রামোফোন’, বাঙালির কাছে যার পরিচয় ছিল ‘কলের গান’ নামে – সেই চাকতি-ঘোরানো ধুতরো ফুলের আকৃতির চোঙ-অলা যন্ত্রের গানের যুগের অবসান হয়েছে বেশ কয়েক দশক আগেই। কলের গান আজ স্মৃতি ও শ্রুতির অন্তর্গত। অথচ গত শতকের আশির দশক পর্যন্তও কলের গানের অস্তিত্ব ছিল। একসময় বাঙালির বিনোদনের খুব প্রিয় উপকরণ ছিল গ্রামোফোন। বাঙালির জীবনের সঙ্গে গভীরভাবে মিশে গিয়েছিল
গ্রামোফোন-সংস্কৃতি। ‘সেনোলা রেকর্ড কোম্পানি’র প্রতিষ্ঠাতা বিভূতিভূষণ সেনের পিতা বিশের দশকে ট্রামে রেকর্ডের গান বাজিয়ে যাত্রী-শ্রোতাদের একদিকে মনোরঞ্জন, অপরদিকে রেকর্ড-বিক্রির প্রচারও করতেন। কেবল শহরে নয়, গ্রামে-গঞ্জেও পৌঁছে গিয়েছিল গ্রামোফোনের সুরের ধারা। গ্রামের মানুষকে পয়সা বা ফসলের বিনিময়ে গ্রামোফোনের গান-শোনানোর জন্যে ভ্রাম্যমাণ ব্যবসাদারেরও আবির্ভাব হয়েছিল। মেলা বা আড়ং ছিল কলের গান শুনিয়ে কড়ি আদায়ের আরেক শাঁসালো জায়গা। অনেক সময় গ্রামোফোন কোম্পানির উদ্যোগেও নানা জায়গায় কলের গানের প্রচার-সফরের ব্যবস্থা থাকতো।
চার
ফোনোগ্রাফ বা গ্রামোফোন-যন্ত্র আবিষ্কার ইউরোপ-আমেরিকায় আলোড়ন তোলে। দ্রুত এর প্রসার ঘটতে থাকে। আমেরিকা ও ইউরোপের নানা দেশে গ্রামোফোন কোম্পানি গড়ে ওঠে। ক্রমে গ্রামোফোন-ব্যবসার উপনিবেশ গড়ে তুলতে প্রাচ্যদেশের প্রতি নজর পড়ে গ্রামোফোন-বেনিয়াদের। ১৮৯৮ সালে লন্ডনে প্রতিষ্ঠিত ‘গ্রামোফোন কোম্পানি’র প্রতিনিধি হিসেবে জন ওয়াটসন হড্ ১৯০১-এর মাঝামাঝি ভারতে এসে কলকাতা-মাদ্রাজ-বোম্বে-দিল্লি নানা শহর জরিপ করে এদেশে গ্রামোফোনের এক বিশাল সম্ভাবনাময় বাজারের সন্ধান পান। আশাবাদী হডের সুপারিশমতো ওই বছরেই কলকাতায় ‘গ্রামোফোন কোম্পানি’ অফিস খুলে বেশ জাঁকিয়ে বসে। হডের অনুরোধমাফিক লন্ডন-অফিস এদেশে শিল্পীদের কণ্ঠ ও যন্ত্রসংগীত রেকর্ডে ধারণের জন্যে রেকর্ডিং বিশেষজ্ঞ ভারতে পাঠাতে সম্মত হয়। ফলে ফ্রেডরিক্ উইলিয়ম গেইস্বার্গ ও তাঁর কয়েকজন সহকর্মী ১৯০২-এর ২৮শে অক্টোবর কলকাতা পৌঁছান। এরপর তাঁদের কর্মকাণ্ডের ভেতর দিয়ে বাংলা এবং সেইসঙ্গে ভারতে গ্রামোফোন-সংস্কৃতির এক গৌরবময় অধ্যায়ের সূচনা হয়।
কলকাতায় এদেশীয় শিল্পীদের নিয়ে গেইস্বার্গের রেকর্ডিংয়ের যাত্রা শুরু হয় ১৯০২-এর ৮ই নভেম্বর। ওই তারিখে প্রথম রেকর্ড হয় একটি কীর্তন – ‘কাঁহা জীবনধন’ – ক্ল্যাসিক থিয়েটারের চতুর্দশী নর্তকী মিস্ শশীমুখীর কণ্ঠে। ওই একই তারিখে ক্ল্যাসিক থিয়েটারের আর-এক নাচিয়ে মিস্ ফণীবালার গানও রেকর্ড করা হয়। তবে শশীমুখী বা ফণীবালা বাংলা গানের জগতে কোনো নামি গাইয়ে ছিলেন না; কিন্তু ইতিহাসের পাতায় তাঁদের নাম লেখা হয়ে গেল এইভাবে। গেইস্বার্গের প্রথম সংগীত-রেকর্ড-অভিযানে শ্রেষ্ঠ আবিষ্কার নিঃসন্দেহে কিন্নরকণ্ঠী গওহরজান – তার পরেই নাম করতে হয় লালচাঁদ বড়ালের। এর কিছু পরে অন্য-এক গান-শিকারি দলের হতে ধরা পড়েন পিয়ারা সাহেব ও জানকি বাই। এঁদের পাশাপাশি থিয়েটারসহ বাইজিমহল ও পতিতাপল্লি থেকে যেসব শিল্পী আবিষ্কৃত হন, কয়েক দশক ধরে তাঁরা গ্রামোফোনের মাধ্যমে বাংলার সংগীতজগৎকে সমৃদ্ধ করে তোলেন। যে-গান ছিল অভিজাত বা বিত্তবানের বৈঠকখানা-জলসাঘর-বাগানবাড়ি কিংবা বাইজিমহল-পতিতালয়ে সীমাবদ্ধ, ক্রমে ক্রমে তা হয়ে উঠলো আমজনতার বিনোদনের সামগ্রী। এর পরের কাহিনি গ্রামোফোনের ক্রম-প্রসার ও জন-মন-জয়ের ইতিবৃত্ত।
পাঁচ
প্রথম যুগে তো কেবল গ্রামোফোন-যন্ত্র ও বিদেশি ভাষার রেকর্ড বিক্রি হতো, এখন গেইস্বার্গ ও তাঁর উত্তরসূরিদের কল্যাণে বাংলা, হিন্দুস্থানি ও মার্গসংগীতের রেকর্ড তৈরি ও বিক্রির সুযোগ মিললো। প্রথম প্রথম এদেশে ধারণকৃত রেকর্ড জার্মানির হ্যানোভারে পাঠাতে হতো চূড়ান্ত ছাপার জন্যে। এতে সময় যেমন বেশি লাগতো, পাশাপাশি অনেক রেকর্ড নষ্টও হতো। এসব কারণে ১৯০৭-এ কলকাতার বেলেঘাটায় ভারতে ‘গ্রামোফোন কোম্পানি লিমিটেডে’র প্রথম কারখানা প্রতিষ্ঠিত হয়। এর ফলে সিলিন্ড্রিক্যাল রেকর্ড থেকে ডিস্ক রেকর্ড-যুগে প্রবেশ করে গ্রামোফোন। এই কারখানা স্থাপনের ভেতর দিয়ে এদেশে গ্রামোফোন-সামগ্রীর বাজার দ্রুত প্রসারিত হতে থাকে। ততদিনে বিদেশি গ্রামোফোন কোম্পানিগুলো একে একে এসে ভিড় জমিয়েছে কলকাতায় : দ্য গ্রামোফোন অ্যান্ড টাইপরাইটার লিমিটেড এবং পরে পরিবর্তিত নামে দ্য গ্রামোফোন কোম্পানি লিমিটেড (গ্রামোফোন রেকর্ড, হিজ মাস্টার্স ভয়েস ও কলম্বিয়া রেকর্ড : প্রথম পর্যায়ে ভারতের সোল্ এজেন্ট ছিল – মিউটোস্কোপ অ্যান্ড বায়োগ্রাফ), দ্য নিকোল রেকর্ড কোম্পানি লিমিটেড (নিকোল রেকর্ড), দ্য বেকা রেকর্ড জি.এম.বি.এইচ. (বেকা রেকর্ড), ইন্টারন্যাশনাল টকিং মেশিন কোম্পানি (ওডিয়ন রেকর্ড), দ্য নিওফোন কোম্পানি লিমিটেড (নিওফোন রেকর্ড), লাইরোফোন-হ্বের্ক অ্যাডল্ফ্ ল্যেবান অ্যান্ড কোম্পানি (এলিফোন রেকর্ড), প্যাথি কোম্পানি (প্যাথি রেকর্ড), ইউনিভার্সাল টকিং মেশিন ডিপো (নভেল রেকর্ড ও ইউনিভার্সাল রেকর্ড), ভিক্টর টকিং মেশিন কোম্পানি (মনার্ক রেকর্ড), এ. জানোউইটজার-রেকর্ডকৃত (আজানো ডবল-ফেস রেকর্ড), কলম্বিয়া গ্রামোফোন কোম্পানি (কলম্বিয়া রেকর্ড), ভায়েলোফোন, ফেভারিট রেকর্ড ইত্যাদি। এ-থেকে সহজেই ধারণা করা যায়, গ্রামোফোন কতখানি জনপ্রিয় হয়ে উঠেছিল এদেশে এবং কী পরিমাণ ব্যবসার সুযোগ তারা পেয়েছিল। বিদেশি কোম্পানির সাফল্যে অনুপ্রাণিত হয়ে গ্রামোফোন-যন্ত্র ও রেকর্ড বিক্রি থেকে বাঙালি উদ্যোক্তারা ক্রমে রেকর্ড তৈরির ব্যবসায়েও নামেন এবং সাফল্যের এক অনন্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করেন। এই উদ্যোগের পেছনে ব্যবসায়িক মনোভাবের পাশাপাশি স্বদেশি সংস্কৃতির পৃষ্ঠপোষকতা ও স্বাদেশিকতার চেতনাও অনেকাংশে কাজ করেছিল। গ্রামোফোন রেকর্ড তৈরির এই স্বদেশি উদ্যোগের প্রথম পুরুষ ছিলেন হেমেন্দ্রমোহন বসু ওরফে এইচ. বোস। ১৯০৬ সালের শুরুতেই ফোনোগ্রাফ-যন্ত্র ও ফরাসি দেশের প্যাথি কোম্পানির সহায়তায় সিলিন্ডার রেকর্ড প্রস্তুত ও বিক্রির ব্যবসা শুরু করেন কলকাতায়। বঙ্গদেশে গ্রামোফোনের আদিপর্বে রেকর্ডে প্রথম রবীন্দ্রকণ্ঠ ধরে রাখার কৃতিত্ব একান্তভাবেই হেমেন্দ্রমোহন বসুর। তাঁর মূল নির্ভরতা ছিল স্বদেশি গান ও রবীন্দ্রনাথের ওপর। স্বদেশি আন্দোলনের প্রতি সহানুভূতিশীল ছিলেন বলে তাঁর ‘টকিং মেশিন হল’ পুলিশি খানাতল্লাশির হাত থেকে রক্ষা পায়নি – ফলে নষ্ট হয়েছে অনেক মুদ্রিত-অমুদ্রিত সিলিন্ডার রেকর্ড এবং মূল্যবান কাগজপত্র। আবার অন্য রেকর্ড কোম্পানির সঙ্গে প্রতিযোগিতায় টিকে থাকাও নানা কারণে অসম্ভব হয়ে পড়ে। অবশেষে এইচ. বোসের রেকর্ড কোম্পানি সম্ভবত ১৯১০ সাল নাগাদ উঠে যায়। হেমেন্দ্রমোহনকে আমরা দেশি রেকর্ড-নির্মাতাদের অগ্রণী হিসেবে উল্লেখ করেছি। কিন্তু অন্যদের হাতে যে অস্পষ্ট ও সামান্য তথ্য আছে তাতে দেখা যায়, তাঁরও আগে বাণিজ্যিকভাবে রেকর্ডে গান ধরে রাখার সূচনা করেছিলেন কলকাতার এক ঐতিহ্যবাহী বাদ্যযন্ত্র, গ্রামোফোন ও রেকর্ড বিক্রির বাঙালি প্রতিষ্ঠান ‘ডোয়ার্কিন অ্যান্ড সন’। এই ধারণার উৎস ১৯০৪ সালের একটি বিজ্ঞাপন। কিন্ত ‘ডোয়ার্কিনে’র রেকর্ডের লেবেল ও শিল্পীদের গানের বিবরণের কোনো হদিস মেলেনি। তবে খুব বেশিদিন নয়, বোধহয় ১৯০৫-এর মধ্যেই রেকর্ড তৈরির কাজ গুটিয়ে, তাঁরা আবার পুরোনো ব্যবসাতেই পুরোপুরি মন দেন।
ছয়
এরপর বাঙালি গ্রামোফোন ও রেকর্ড-ব্যবসায়ীদের রেকর্ড-প্রকাশের বেশ ধারাবাহিক ঝোঁক তৈরি হয়। এই কাজে নিছক ব্যবসায়ের মনোভাবই শুধু নয়, কিছু ক্ষেত্রে এর সঙ্গে যুক্ত হয় স্বাদেশিকতার চেতনাও। ১৯০৩-এ সুরেন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায় কলকাতার হ্যারিসন রোডে ‘মুখার্জি অ্যান্ড মুখার্জি’ নামে গ্রামোফোন-যন্ত্র ও রেকর্ড ব্যবসায়ের বেশ বড়ো এক প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলেন। পরের বছরেই তাঁরা নিকোল রেকর্ডের ডিলারশিপ পেয়ে যান। নিকোল ও অন্যান্য রেকর্ডের ক্রমবর্ধমান চাহিদা সুরেন্দ্রনাথকে রেকর্ড তৈরিতে উৎসাহিত করে। ১৯০৬ সালের শেষদিকে ‘রয়্যাল রেকর্ড’ নামে তাঁদের প্রতিষ্ঠানের নিজস্ব রেকর্ড বের হয়। ‘মুখার্জি অ্যান্ড মুখার্জি’ই প্রথম বাঙালি কোম্পানি, যারা সিলিন্ডারের বদলে ডিস্ক রেকর্ড তৈরি করে। গওহরজান ও নরীসুন্দরীর মতো সেকালের নামি শিল্পীও ‘রয়্যাল রেকর্ডে’ গান দেন। অল্পসময়েই এই রেকর্ড কোম্পানি বেশ জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। তবে এদের বায়োস্কোপ মেশিনের রমরমা ব্যবসার কারণে রেকর্ড তৈরির উদ্যোগে ভাটা পড়ে। কেউ কেউ নানা তথ্যসূত্রে অনুমান করেন, হয়তো ১৯০৮-এর পরে ‘রয়্যাল রেকর্ডে’র আর কোনো অস্তিত্ব ছিল না।
অনেক উৎসাহ-উদ্দীপনা নিয়ে শুরু করলেও তিরিশের দশকের পূর্ব পর্যন্ত দেশীয় রেকর্ড কোম্পানিগুলো নানা কারণে ছিল নিতান্তই স্বল্পায়ু। এই ধরনের প্রতিষ্ঠানের মধ্যে ‘বীণাপাণি রেকর্ডিং কোম্পানি’র নাম বিশেষ কারণে উল্লেখ করতে হয়। ১৯০৮-এর জানুয়ারি মাসে কলকাতার ক্রিক রো-তে এস. সি. দাস এই রেকর্ড কোম্পানির কারখানা স্থাপন করেন। শুরুতেই ‘স্বদেশি বীণাপাণি রেকর্ডস্’ শিরোনামে ইংরেজি ভাষায় যে-বিজ্ঞাপন প্রকাশিত হয় তাতে আশান্বিত হওয়ার কারণ ছিল। ‘বীণাপাণি রেকর্ড’-এর লেবেলে বেশ কিছু ডিস্ক রেকর্ড বেরিয়েছিল। মালিকানা বা কর্তৃত্ব নিয়ে অন্তর্দ্বন্দ্ব এবং দক্ষ পরিচালনার অভাবে ‘বীণাপাণি রেকর্ডিং কোম্পানি’ আত্মপ্রকাশের কিছু পরেই বিলুপ্ত হয়। ‘বীণাপাণি’র সঙ্গে সম্পৃক্ত যোগীন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায় মতবিরোধের কারণে ওই প্রতিষ্ঠান থেকে বেরিয়ে এসে ‘কমলা রেকর্ডিং কোম্পানি’ নাম দিয়ে আলাদা প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলেন। কাগজে বিজ্ঞাপন ছাপা হয়, ১৯০৯ সালের গোড়াতেই স্বদেশি প্রয়াস ও উপকরণে ‘কমলা রেকর্ড’ বের হবে। কিন্তু অজানা কারণে সেই ঘোষণা কখনো বাস্তবায়িত হয়নি। এর প্রায় দেড় দশক পরে, আনুমানিক ১৯২৫-২৬ সাল নাগাদ, এক অবাঙালি ব্যবসায়ী মীনা পেশোয়ারি কলকাতায় প্রতিষ্ঠা করেন ‘শাহানশাহ্ রেকর্ড কোম্পানি’। কেউ কেউ দেশভাগের কাছাকাছি সময়েও এই রেকর্ড কোম্পানির ক্ষীণ-অস্তিত্ব লক্ষ করেছেন।
সাত
বিদেশি রেকর্ড কোম্পানির সঙ্গে দেশি কোম্পানি নানা কারণে প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে পারেনি – তাই অল্পদিনেই এ-ব্যবসা থেকে তাদের সরে যেতে হয়েছে। দেশি-বিদেশির এই প্রতিযোগিতা ছিল অসম। বিদেশি কোম্পানির লগ্নি পুঁজির বিশালত্ব, ব্যবসায়িক কৌশল ও অভিজ্ঞতা, সৃজনশীল দৃষ্টিভঙ্গি এবং ব্যবসা-পরিচালনার নৈপুণ্য – এ-সবই দেশি কোম্পানির পরাভবের মূল কারণ। তাই ১৯০৯ থেকে ১৯৩১ – এই দীর্ঘ বাইশ বছরে কোনো বাঙালি উদ্যোক্তার সাক্ষাৎ মেলে না গ্রামোফোন রেকর্ড কোম্পানি প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে। এ-পর্যন্ত বিদেশি রেকর্ড কোম্পানির ব্যবসা ছিল একচেটিয়া – বাঙালি ব্যবসায়ীদের গ্রামোফোন-যন্ত্র ও রেকর্ড বিক্রি করেই সন্তুষ্ট থাকতে হয়েছে। তবে তিরিশের দশক থেকে অবস্থার পরিবর্তন হতে শুরু করে। ফলে দশক-শুরুর প্রায় প্রথম দিকেই আরো উদ্যম ও আগ্রহ, সামর্থ্য ও সুষ্ঠু পরিকল্পনা নিয়ে বেশ কয়েকটি দেশি রেকর্ড কোম্পানির আবির্ভাব ঘটে। এই উদ্যোগের পেছনে ছিলেন মিউজিক্যাল প্রোডাক্টস্-ব্যবসায়ের তিন ঘনিষ্ঠ সহযাত্রী জিতেন্দ্রনাথ ঘোষ, চণ্ডীচরণ সাহা ও বিভূতিভূষণ সেন – যাঁদের নিষ্ঠা ও শ্রমে গড়ে উঠেছিল তিন যুগপ্রবর্তক দেশি রেকর্ড কোম্পানি ‘মেগাফোন’, ‘হিন্দুস্থান’ ও ‘সেনোলা’। এরা কোনো কোনো ক্ষেত্রে বিদেশি কোম্পানির বেশ শক্ত প্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে উঠেছিল। জনপ্রিয়তার পাশাপাশি প্রতিষ্ঠা পেতেও বিলম্ব হয়নি – দ্রুতই বাংলার ঘরে ঘরে পৌঁছে যায় এদের নাম। এই স্বদেশি কোম্পানিগুলোর সাফল্যের প্রেরণায় পরে আরো কিছু রেকর্ড কোম্পানি গড়ে ওঠে – এদের মধ্যে বিশেষ করে নাম-উল্লেখ করতে হয় ‘পাইওনিয়ার’, ‘ভারত’, ‘রিগ্যাল’, ‘কলম্বিয়া’, ‘কোহিনুর’, ‘মেল-ও-ডি’ ও ‘ভারতী’র। ততদিনে ‘গ্রামোফোন কোম্পানি লিমিটেড’ বাদে আর প্রায় সব বিদেশি কোম্পানিই এদেশে ব্যবসা গুটিয়ে ফিরে গেছে। ‘গ্রামোফোন কোম্পানি লিমিটেডে’র তখন একক প্রাধান্য – প্রতিষ্ঠান হিসেবে অতি বিশাল। তবে পারস্পরিক স্বার্থের কারণে ‘গ্রামোফোন কোম্পানি লিমিটেডে’র সঙ্গে বাঙালি মালিকের এইসব কোম্পানির একধরনের সুস্থ প্রতিযোগিতা ও সহযোগিতার সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল। স্বদেশি কোম্পানির স্টুডিওতে গান রেকর্ডিং হলেও তা ছাপা হতো ‘গ্রামোফোন কোম্পানি লিমিটেডে’র কারখানায় – তারপর নিজ নিজ কোম্পানির লেবেলে বাজারে ছাড়ার জন্যে রেকর্ড প্রস্তুত হতো। ‘গ্রামোফোন কোম্পানি’ প্রতিভাবান-প্রতিশ্রুতিশীল শিল্পী সন্ধান করে প্রশিক্ষণের মাধ্যমে যোগ্য করে তুলে তাঁদের দিয়ে গান রেকর্ড করাতো। ‘গ্রামোফোন কোম্পানি’র বাঁধা শিল্পী, সুরকার, গীতিকার, প্রশিক্ষক ও বাদ্যযন্ত্রীও থাকতেন। তিরিশের দশকে স্বদেশি কোম্পানিগুলোও এই একই পদ্ধতিতে কাজ শুরু করেছিল। এই পর্যায় থেকে আবার নতুন করে গ্রামোফোন রেকর্ডের সুবাদে সূচনা হলো বাংলা গানের স্বর্ণযুগের আরেক অধ্যায়ের।
আট
চণ্ডীচরণ সাহা বিলেতে গিয়ে রেকর্ডিং-বিদ্যা শিখে কলকাতায় ফিরে ১৯৩১-এ (১৪ জুলাই ১৯৩২-এ রেজিস্ট্রিকৃত) ৬/১ অক্রূর দত্ত লেনে ‘হিন্দুস্থান মিউজিক্যাল প্রোডাক্টস্ অ্যান্ড ভ্যারাইটিস্ সিন্ডিকেট লিমিটেড’ নামে একটি প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলেন। ‘হিন্দুস্থান রেকর্ড’ নামে গ্রামোফোন রেকর্ড প্রকাশের সূচনালগ্নে রবীন্দ্রনাথের আনুকূল্য লাভের জন্যে তাঁর সঙ্গে দেখা করেন। এ-বিষয়ে রবীন্দ্রনাথ ৭ই চৈত্র ১৩৩৮-এ দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশের পত্নী বাসন্তী দেবীকে এক চিঠিতে প্রসঙ্গক্রমে বলেছিলেন : ‘একজন ভদ্রলোক গ্রামোফোনের সুর ধরবার বিদ্যা য়ুরোপে শিখে এসেছেন। তিনি এখানে এসেছেন আমার কণ্ঠ থেকে কিছু আদায় করবার প্রস্তাব নিয়ে।’ শেষ পর্যন্ত চণ্ডীচরণ রবীন্দ্রনাথের কণ্ঠে কবিতা ও গান ধারণে তাঁর সম্মতি পান। ৫ই এপ্রিল ১৯৩২ সালে হিন্দুস্থান মিউজিক্যাল প্রোডাক্টসের নিজস্ব স্টুডিওতে গিয়ে রবীন্দ্রনাথ যে কবিতা ও গান রেকর্ড করেন, তা দিয়েই ‘হিন্দুস্থান’-এর রেকর্ড-প্রকাশের যাত্রা শুরু। কবিকণ্ঠের ‘ঐ.ও’ চিহ্নিত রেকর্ডটির এক পিঠে কবিতা ‘আমি যখন বাবার মত হব’ এবং অপর পিঠে ‘তবু মনে রেখো’ এই গানটি ছিল। জানা যায়, এর পরেও – ১৯৩৬ ও ১৯৩৯-এ হিন্দুস্থান মিউজিক্যাল প্রোডাক্টসের পক্ষ থেকে রবীন্দ্রনাথের গান রেকর্ড করা হয়। প্রথম যেবার রবীন্দ্রনাথ হিন্দুস্থান রেকর্ডের স্টুডিওতে আসেন, এই প্রতিষ্ঠান সম্পর্কে মন্তব্য লিখে দেন এই বলে : ‘হিন্দুস্থান ম্যুজিকাল প্রডাক্টস ভেরাইটি সিন্ডিকেট জয়যুক্ত হৌক, – এরূপ প্রতিষ্ঠান এদেশে এই প্রথম, ইহার সফলতায় আমাদের সকলেরই গৌরব।’ সূচনালগ্নে রবীন্দ্রনাথ যে আশাবাদ প্রকাশ করেন, চণ্ডীচরণের যোগ্য পরিচালনায় উত্তরকালে এই প্রতিষ্ঠান তার ‘সফলতায়’ যথার্থই ‘আমাদের সকলেরই গৌরব’-এর দৃষ্টান্ত হয়ে দাঁড়ায়।
এখানে একটি তথ্য জানানো প্রয়োজন, প্রথম পর্যায়েই ঠাকুরবাড়ির সঙ্গে ‘হিন্দুস্থানে’র ব্যবসায়িক সম্পর্কও গড়ে ওঠে। একেবারে সূচনাপর্ব থেকেই কবিপুত্র রথীন্দ্রনাথ ঠাকুর অনেকদিন পর্যন্ত ‘হিন্দুস্থান মিউজিক্যাল প্রোডাক্টস্ লিমিটেডে’র পরিচালনা পর্ষদের (ডিরেক্টর বোর্ড) সভাপতি ছিলেন। রথীন্দ্রনাথের সভাপতিত্বেই প্রথম সভাটি অনুষ্ঠিত হয় ২৬শে জুলাই ১৯৩২-এ।
নয়
চণ্ডীচরণ সাহা, যিনি সি.সি. সাহা নামেও পরিচিত, শিক্ষিত ও উদ্যমী পুরুষ ছিলেন। তাঁর পারিবারিক ঐতিহ্যের কথা এ-প্রসঙ্গে স্মরণ করতে হয়। বিশেষ করে সংগীত-সামগ্রী বিক্রির ক্ষেত্রে অন্যতম আদি স্বদেশি প্রতিষ্ঠানের দাবি এই সাহা-পরিবার করতে পারেন। চণ্ডীচরণের পিতা মতিলাল সাহা ১৮৯৫-এ এম. এল. সাহা ((M. L. Shaw) নামে হারমোনিয়াম তৈরির ব্যবসায়ে নামেন কলকাতার ধর্মতলায় দোকান খুলে। এরপর ১৯০৫-এর দিকে এম.এল. সাহা নিকোল কোম্পানির প্রতিনিধি হিসেবে ‘নিকোল রেকর্ড’ এবং ‘নিকোলফোন’-যন্ত্র বিক্রির একমাত্র পরিবেশক নিযুক্ত হন। গ্রামোফোন-সামগ্রীর ব্যবসায়েও এম.এল. সাহার ব্যাপক সাফল্য ছিল উল্লেখ করার মতো। পিতার আদর্শ ও প্রেরণায় ১৯২২ সাল নাগাদ চণ্ডীচরণ এই ব্যবসায়ের সঙ্গে যুক্ত হন। এরপর নিজের মনে গ্রামোফোন রেকর্ড কোম্পানি প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন বুনে পিতার সমর্থনে রেকর্ডিং-বিদ্যা শিক্ষায় আগ্রহী হয়ে ওঠেন। তাই চণ্ডীচরণের আকাক্সক্ষা, উদ্যোগ ও সাফল্যের পেছনে পারিবারিক প্রেরণার দান যে অনেকখানি তা স্বীকার করতেই হয়। চণ্ডীচরণের পুত্র শোভনলাল সাহাও উত্তরকালে ‘ইনরেকো’ নামের প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলে শতবর্ষের পারিবারিক ঐতিহ্যের ধারাবাহিকতা রক্ষা করে চলেছেন। এখন ‘হিন্দুস্থান’ ও ‘ইনরেকো’র সঙ্গে যুক্ত হয়েছেন সাহা-পরিবারের চতুর্থ প্রজন্মের প্রতিনিধি শোভনলালের পুত্র রিয়াদ সাহা।
হিন্দুস্থান রেকর্ড কোম্পানির রূপকার চণ্ডীচরণ সাহা বিদেশ থেকে রেকর্ডিং সম্পর্কে যে-প্রশিক্ষণ লাভ করেন, তার বাস্তব প্রতিফলন ঘটে তাঁর প্রতিষ্ঠিত ‘হিন্দুস্থান রেকর্ড’ প্রকাশের কার্যক্রমে। এই প্রশিক্ষণের জ্ঞান ও তাঁর নিজের উদ্ভাবনী চিন্তার সমন্বয়ে যে নিরীক্ষাধর্মী প্রয়াস তিনি গ্রহণ করেন তা বিশেষ উল্লেখের অপেক্ষা রাখে। শিল্পী ও সুরস্রষ্টা পঙ্কজকুমার মল্লিক স্মরণ করতে পারেন : ‘বাংলা সঙ্গীত রেকর্ডিং-এর জগতে এই উদ্যোগী ও নিরলস মানুষটি [চণ্ডীচরণ সাহা] স্মরণীয় হয়ে থাকবেন। তিনি অক্রূর দত্ত লেনে হিন্দুস্থান মিউজিক্যাল প্রডাক্টস্ নামে একটি প্রতিষ্ঠান স্থাপন করলেন। তাঁর উদ্দেশ্য ছিল, শব্দযন্ত্রের আধুনিক কলাকৌশল – যা তিনি জার্মানী থেকে শিক্ষা করে এসেছিলেন – তাকে নিপুণভাবে প্রয়োগ করে এদেশে সঙ্গীত রেকর্ডিং-এর ক্ষেত্রে গ্রামোফোন কোম্পানীর সমকক্ষতা অর্জন করা।’…
পঙ্কজ মল্লিকের সূত্রে আরো জানা যায় : ‘চণ্ডীবাবুর উদ্দেশ্য ছিল তাঁর নবলব্ধ (১৮৮৯-১৯৫৯), অমিয়নাথ সান্যাল (১৮৯৫-১৯৭৮), শ্রীশচন্দ্র নন্দী (১৮৯৭-১৯৫২), তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায় (১৮৯৮-১৯৭১), বলাইচাঁদ মুখোপাধ্যায় (বনফুল) (১৮৯৯-১৯৭৯), মন্মথ রায় (১৮৯৯-১৯৮৮), শৈলজানন্দ মুখোপাধ্যায় (১৯০১-১৯৭৬), অচিন্ত্যকুমার সেনগুপ্ত (১৯০৩-১৯৭৬), বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্র (১৯০৫-১৯৯১), অজয় ভট্টাচার্য্য (১৯০৬-১৯৪৩), বুদ্ধদেব বসু (১৯০৮-১৯৭৪), শান্তিদেব ঘোষ (১৯১০-১৯৯৯), অনুপম ঘটক (১৯১১-১৯৫৬), রাজ্যেশ^র মিত্র (১৯১৭-১৯৯৫), নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায় (১৯১৮-১৯৭৩), সমরেশ বসু (১৯২৪-১৯৮৮), কাজী সব্যসাচী (১৯২৭-১৯৭৯), ধীরেন বসু (১৯৩০-২০০৬), অশোকতরু বন্দ্যোপাধ্যায় (১৯৩০-১৯৯৩)।
এগারো
‘হিন্দুস্থান রেকর্ড’কে কেন্দ্র করে বাঙালি সমাজে এক সমৃদ্ধ সংগীত-সংস্কৃতি গড়ে উঠেছিল। রবীন্দ্রনাথের কণ্ঠে ধারণকৃত আবৃত্তি ও গানের রেকর্ড প্রকাশের মাধ্যমে উদ্বোধন হয়েছিল এই প্রতিষ্ঠানের। তার পরের ইতিহাস শুধুই সাফল্য, অর্জন ও গৌরবের। রবীন্দ্রনাথের পরপরই ‘হিন্দুস্থান’ থেকে বের হয় অতুলপ্রসাদের কণ্ঠের গানের রেকর্ড (‘মিছে তুই ভাবিস মন’ ও ‘জানি জানি তোমারে গো রঙ্গরানী’)। অবশ্য অতুলপ্রসাদ গান রেকর্ড করার সুবাদে ‘হিন্দুস্থান রেকর্ড’-ভবনে এসেছিলেন ১৯৩২-এর ২৭শে মার্চ, অর্থাৎ রবীন্দ্রনাথের নয়দিন আগে। ওইদিন তিনি এই নবীন প্রতিষ্ঠানের কার্যক্রম দেখে যে-মন্তব্য লিখে দিয়েছিলেন একই সঙ্গে তা প্রেরণাদায়ক ও দিক-নির্দেশক। তিনি বলেছিলেন : ‘হিন্দুস্থান রেকর্ড গৃহে যাইয়া সেখানকার যন্ত্রাদি ও গানের ছাপ তুলিবার সুনিপুণ প্রণালী দেখিয়া বড় প্রীত ও আশান্বিত হইয়াছি। এ দেশের এ নবীন উদ্যমের আমি পূর্ণ সফলতা কামনা করি। যে আদর্শ ও উৎসাহ লইয়া এ প্রতিষ্ঠানের শিল্পী ও কর্ত্তৃপক্ষীয়েরা এ কার্য্যে হস্তক্ষেপ করিয়াছেন আমি ভরসা রাখি যে প্রতিযোগিতায় তাঁহাদের চেষ্টা প্রতিহত হইবে না, বরঞ্চ দেশবাসীগণের সহানুভূতি ও পোষকতা লাভ করিয়া উত্তরোত্তর উন্নতির পথে অগ্রসর হইবে।’ দুর্ভাগ্যের বিষয় অতুলপ্রসাদ এর বছর দুই পরেই প্রয়াত হন, ফলে ‘হিন্দুস্থান রেকর্ডে’র সূচনাটুকুই দেখেছিলেন, পূর্ণ বিকাশ দেখে যেতে পারেননি। এই প্রতিষ্ঠান থেকে পরে অন্য শিল্পীর কণ্ঠেও অতুলপ্রসাদের গানের রেকর্ড বেরিয়েছে।
বারো
কাজী নজরুল ইসলামের লেখা গানের প্রথম রেকর্ড বের হয় ১৯২৫ সালের সেপ্টেম্বর মাসে হিজ মাস্টার্স ভয়েস (এইচএমভি) থেকে – ‘জাতের নামে বজ্জাতি সব জাত জালিয়াত খেলছে জুয়া’ এই গানটিতে কণ্ঠ দেন হরেন্দ্রনাথ দত্ত। এরপর নজরুল সম্পর্কে এইচএমভি আগ্রহী হয়ে ওঠে – ফলে ১৯২৮ সালে নজরুল
গীতিকার-সুরকার-প্রশিক্ষক হিসেবে ‘গ্রামোফোন কোম্পানি লিমিটেড’-এ যোগ দেন। ‘গ্রামোফোন কোম্পানি’র সঙ্গে তিনি ছিলেন চুক্তিবদ্ধ। ওই একই বছরে (১৯২৮) নজরুল কলকাতা বেতারের সঙ্গেও যুক্ত হন। কেউ কেউ মনে করেন, এর পেছনে হাত ছিল নজরুলের অগ্রজ-বন্ধু নলিনীকান্ত সরকারের। ‘গ্রামোফোন কোম্পানি’তে বেশ ভালোই কাটছিল নজরুলের। কিন্তু শিল্পী-সুরকার-গীতিকারের সম্মানী ও রয়্যালটি নিয়ে কর্তৃপক্ষের সঙ্গে বিরোধ বাধে – এঁদের পক্ষে এই আন্দোলনে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন নজরুল। কিন্তু এ-বিষয়ে ‘গ্রামোফোন কোম্পানি’র সঙ্গে কোনো ফয়সালা না-হওয়ায় নজরুল ও তাঁর সহকর্মী-সহযোদ্ধা ধীরেন দাস, হীরেন বসু, কানন দেবী এবং আরো কেউ কেউ এইচএমভি থেকে বেরিয়ে আসেন। জিতেন্দ্রনাথ ঘোষের পরিকল্পনা-আর্থিক আনুকূল্য ও এইসব শিল্পী-সুরকার-গীতিকার-প্রশিক্ষকের সহায়তায় কলকাতা ৭১/১ হ্যারিসন রোডের ঠিকানায় ১৯৩২ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় ‘মেগাফোন রেকর্ড কোম্পানি’। এখানেও নজরুল ছিলেন মধ্যমণি – কিন্তু চুক্তিবদ্ধতার বাধ্যবাধকতা ছিল। তবে কিছু কিছু ক্ষেত্রে নজরুল চুক্তির নিষেধাজ্ঞা থেকে ছাড়ও পেয়েছিলেন – তাঁর জন্যে শিথিল করা হয়েছিল চুক্তির কোনো কোনো শর্তও – ‘হিন্দুস্থান রেকর্ডে’ তাঁর লেখা গানের প্রকাশ তার প্রমাণ দেয়।
‘হিন্দুস্থান রেকর্ড কোম্পানি’ নজরুলের শুভকামনা থেকে কখনোই বঞ্চিত হয়নি। ‘হিন্দুস্থান রেকর্ডে’ নজরুলের অনেক বন্ধু-সুহৃদ-অনুরাগী-সহকর্মী যুক্ত ছিলেন – এর অধিকর্তা চণ্ডীচরণ সাহাও ছিলেন তাঁর বিশেষ গুণগ্রাহী ও ঘনিষ্ঠ। ‘হিন্দুস্থান রেকর্ডে’র সূচনাপর্বেই (রেকর্ড নং : ঐ-৭) নজরুলের লেখা ‘কুঁচবরণ কন্যারে তোর’ ও ‘তোমার আঁখির কসম সাকী’ এই দুটি গান ১৯৩২-এ রেকর্ড করেন কবির প্রীতিভাজন শিল্পী ও সংগীত পরিচালক উমাপদ ভট্টাচার্য। ১৯৪০ সালে নজরুলের স্নেহসিক্ত শচীন দেববর্মনের কণ্ঠে দুটি গানের রেকর্ড বের হয় ‘হিন্দুস্থান’ থেকে – ‘কুহু কুহু কুহু কোয়েলিয়া’ ও ‘মেঘলা নিশি ভোরে’। নজরুলের কথায় ওই শচীনকর্তারই আরো দুটি গানের রেকর্ড প্রকাশ পায় – এই গান দুটি অবশ্য নন্দিনী ছায়াছবির ‘চোখ গেল চোখ গেল কেন ডাকিস্ রে’ ও ‘পদ্মার ঢেউ রে’। ১৯৪১-৪২ সালে নজরুল-রচিত মোট ২০টি গান ‘হিন্দুস্থান রেকর্ড’ থেকে বের হয়। ১৯৪১ সালের রেকর্ডের মধ্যে আছে সুপ্রভা সরকারের গাওয়া ‘কাবেরী নদী জলে’ ও ‘মোর প্রথম মনের মুকুল’। কালীপদ সেন দুটি রেকর্ডে গেয়েছিলেন : ‘মহুয়া বনের ধারে’ ও ‘বনের ওপারে মন’ এবং ‘ওরে গো-রাখা রাখাল তুই’ ও ‘এসো ঠাকুর মহুয়া বন ছেড়ে বৃন্দাবন’। নজরুলের রচনায় সুপ্রভা ঘোষ রেকর্ডে গেয়েছিলেন এই গান দুটি : ‘নওল শ্যাম তনু গোরীর পরশে’ ও ‘শ্যাম মুখ আর না হেরব সজনী’। গৌরী বসুর রেকর্ড বের হয় নজরুলের ‘বঁধু ফিরে এসো’ ও ‘সখী বল্ কোন্ দেশে যাই’ শিরোনামে। রেণুকা দাশগুপ্তা রেকর্ড করেন : ‘কোন রস যমুনার কূলে’ ও ‘শুক-শারি সম তনু মন মম’। নজরুল আকস্মিক অসুস্থতায় নির্বাক হয়ে গেলেন ১৯৪২-এ, – ওই বছরেও নজরুল-রচিত বেশ কয়েকটি গানের রেকর্ড হয় ‘হিন্দুস্থানে’, যেমন – কালীপদ সেন ও শান্তা বসুর দ্বৈতকণ্ঠে ‘কুনুর নদীর ধারে ঝুনুর ঝুনুর বাজে’ ও ‘ঝুমুর নাচে ডুমুর গাছে’, বিজনকুমার বসুর ‘নিশি নিঝুম ঘুম নাহি আসে’ ও ‘যাও মেঘদূত দিও প্রিয়ার হাতে’, তৃপ্তি সিনহার ‘প্রিয়তম এত প্রেম দিও না গো’ ও ‘যাই গো চলে যাই’, একটি বৃন্দগান ‘হলুদ গাঁদার ফুল’ এবং অজানা শিল্পীর দিকশূল চলচ্চিত্রের গান ‘ফুরাবে না এই মালা গাঁথা মোর’।
নজরুল তখন ছিলেন ‘মেগাফোন রেকর্ড কোম্পানি’র চুক্তিবদ্ধ শিল্পী-গীতিকার-সুরকার-প্রশিক্ষক। নিয়ম-অনুসারে তাই অন্য কোনো রেকর্ড কোম্পানির সঙ্গে কোনো ধরনের কাজ বা সহায়তা করারও সুযোগ ছিল না। কিন্তু ‘হিন্দুস্থান রেকর্ড কোম্পানি’র সঙ্গে তাঁর অনানুষ্ঠানিক সম্পর্ক ছিল এক ব্যতিক্রমী ঘটনা। চণ্ডীচরণ সাহার আমন্ত্রণে ‘হিন্দুস্থান রেকর্ড কোপানি’র উচ্চাকাক্সক্ষী কর্মযজ্ঞ দেখার জন্যে সবার আগে সেখানে যান কাজী নজরুল ইললাম – সে-তারিখ ১৯৩২ সালের ১০ই ফেব্রুয়ারি – তখন তাঁর নিবাস ছিল কলকাতার ৩৯ নম্বর সীতানাথ রোডে। সেদিন পরিদর্শক বইতে নজরুল যা লিখেছিলেন, তা বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ : ‘আপনাদের
গ্রামোফোন-জগতে নব প্রচেষ্টার প্রাথমিক নিদর্শন দেখে অত্যন্ত খুশী হ’লাম। শুধু খুশী নয়, গর্ব্বও অনুভব করছি এই ভেবে যে, এতদিন পরে আমরা ঘরের পানে তাকাতে আরম্ভ করেছি। আমাদের বাঙ্লার বহু অর্থ – এই গ্রামোফোন ও রেকর্ড-এর মারফত বিদেশে রপ্তানী হয়, অন্ততঃ তার সামান্য-কিছুও যদি আপনারা আপনাদের চেষ্টা ও অধ্যবসায় দিয়ে ফিরিয়ে আন্তে পারেন, তা হ’লে দেশকে অনেকটা এগিয়ে দেবেন তার এই অর্থ-সঙ্কটের দিনে।
‘আপনাদের প্রচেষ্টা, আয়োজন, উদ্যম, সহৃদয়তা এবং সকলের উপরে আপনাদের চণ্ডীবাবুকে দেখে আমার গভীর বিশ্বাস হচ্ছে, আপনারা দেশের সকল সঙ্গীত-শিল্পী, সঙ্গীত-রচয়িতা ও সর্ব্বসাধারণের সহানুভূতি সাহায্য লাভ করবেন।
আপনাদের নব আশার উদয়-আলোকে নব নব গানের অবদানে বাঙ্লার শ্যামকুঞ্জ মুখর ক’রে তুলবে।’
তেরো
পঞ্চ-সংগীতগুণীর তিনজনের মন্তব্য আমরা আলাদাভাবে এই লেখার পূর্বভাগে উদ্ধৃত করেছি। আর অবশিষ্ট যাঁরা তাঁদের মূল পরিচয়কে সামনে রেখে, যেমন লেখক-সাহিত্যসেবী; আবার সংগীতব্যক্তিত্ব পর্যায়ে গায়ক-সুরস্রষ্টা-পরিচালক-গীতিকার-সমালোচক;
নাট্য-বেতারব্যক্তিত্ব-আবৃত্তিকার; সংগীতের পৃষ্ঠপোষক ও সমঝদার। অবশ্য এই বিভাজন ও বিন্যাস চূড়ান্ত হতে পারে না – কেননা কখনো কখনো এই তালিকায় অন্তর্ভুক্ত কেউ কেউ একাধিক ঘরেই যাতায়াতের যোগ্য। উদাহরণ পেশ করতে বললে সরলা দেবী, তারাশঙ্কর, শৈলজানন্দ, অমিয়নাথ, অজয় ভট্টাচার্য্য, শান্তিদেব বা বীরেন্দ্রকৃষ্ণের নাম-উল্লেখ সহজেই করা যেতে পারে। তাই সবিনয় প্রত্যাশা ও নিবেদন, গুণী পাঠক শিথিল অর্থেই এই বিভাগ বিবেচনা করবেন।
সরলা দেবী ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা জানকীনাথ ঘোষাল ও সাহিত্যসেবী স্বর্ণকুমারী দেবীর কন্যা বা রবীন্দ্রনাথের ভাগিনেয়ী – এ-তাঁর পারিবারিক বা আত্মীয়তার সম্পর্ক – তবে তাঁর নিজের স্বতন্ত্র পরিচয়ও আছে, যাতে তিনি বিশিষ্ট ও খ্যাতিমান। তিনি যেমন সমাজকর্মে নিবেদিত ছিলেন – দীক্ষিত হয়েছিলেন স্বাদেশিকতা ও জাতীয়তাবোধে – তেমনি সাহিত্য ও সংগীতের মানুষও ছিলেন। সংগীতে তাঁর বিশেষ অধিকার ছিল। তিনি দেশাত্মবোধক ও জাতীয় উদ্দীপনামূলক একশটি গানের সংকলন স্বরলিপিসহ ‘শতগান’ নামে প্রকাশ করেন। কিছুকাল ভারতী পত্রিকার সম্পাদক ছিলেন। বেশ কয়েকটি গ্রন্থ রচনা করেন – তাঁর জীবনের ঝরাপাতা বাংলা স্মৃতিচর্চাবিষয়ক একটি উচ্চাঙ্গের বইয়ের নিদর্শন।
সরলা দেবী ২৭শে সেপ্টেম্বর ১৯৩৪ তারিখে ‘হিন্দুস্থান রেকর্ডে’র অক্রূর দত্ত লেনের বাড়িতে আসেন। এখানে আসার সঠিক কারণ জানা না-গেলেও অনুমান করা চলে রথীন্দ্রনাথ ঠাকুর যেহেতু এই প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে পরিচালনা-সূত্রে জড়িত ছিলেন, তাই হয়তো পরিদর্শনের আমন্ত্রণ এসেছিল। ‘হিন্দুস্থানে’র গান রেকর্ডের পদ্ধতি দেখে তিনি খুশি ও আশান্বিত হয়েছিলেন। তাঁর পর্যবেক্ষণে এর যে বৈশিষ্ট্য ধরা পড়েছে তা এইরকম : ‘হিন্দুস্থান রেকর্ড আপিসে আসিয়া ও হিন্দুস্থান রেকর্ড শুনিয়া আনন্দিত হইলাম। বিজ্ঞানের আবিষ্কার স্বায়ত্ত করিয়া বাঙ্গালী তার দ্বারা নিজের ধন … বৃদ্ধি করিবে ইহা সুখের কথা, কিন্তু তার চেয়েও আশার কথা এই যে ইহাতে দেশী সঙ্গীতের আদর ও তদ্বির বাড়িবে। নির্দ্দিষ্ট সময়ের মধ্যে গান শেষ করা, গানে কর্ডের অলঙ্কার বসান, শুধু বহুকণ্ঠের নয় – বহুস্বরিক গানেরও প্রবর্তন করা, গানের স্বর কখনো প্রবল কখনো মৃদু করিয়া গানে ভাবের সমাবেশ করা প্রভৃতি নানাদিকে বিস্তৃতির পথ যে খোলা আছে তার প্রতি দৃষ্টি পড়িবে; ঐকতানিক যন্ত্রসঙ্গীতের উন্নতি করা সম্ভব হইবে।
‘‘হিন্দুস্থান’এর কর্ত্তৃপক্ষদের আমি তাঁদের প্রচেষ্টার জন্য অভিনন্দিত করিতেছি [।]’
ক্ষিতিমোহন সেনশাস্ত্রী ‘পণ্ডিত’ হিসেবে পরিচিত ও খ্যাতিমান। ভারতের মধ্যযুগের মরমি সাধনা ও বাংলার বাউল বিষয়ে তিনি বিশেষজ্ঞ হিসেবে সম্মানিত। রবীন্দ্রনাথের খুব কাছের মানুষ ছিলেন। ক্ষিতিমোহনের সংগৃহীত সাধক কবির প্রমুখ সন্ত-মহাজনের দোঁহা ও বাংলার নানা বাউলসাধকের পদাবলি রবীন্দ্রনাথ ব্যবহার করেছেন। ১৯০৮ থেকে মৃত্যুকাল পর্যন্ত শান্তিনিকেতনে বসবাস ও বিশ^ভারতীর নানা কর্মকাণ্ডে যুক্ত ছিলেন – বিশ^ভারতীর অস্থায়ী উপাচার্যের দায়িত্বও পালন করেন তিনি। সংগীত ও অভিনয়ের প্রতিও আগ্রহ ছিল তাঁর। ১৪ ফাল্গুন ১৩৫৫-তে ‘হিন্দুস্থান রেকর্ড’-ভবনে এসে তিনি মন্তব্য করেন : ‘ইঁহাদের আয়োজন আমাকে বিস্মিত করিল। লিখিতে অনুরুদ্ধ হইয়া ভাবিতেছি কি আজ লিখি? ভাগবত মন্দিরে প্রবেশ করিতে গিয়া মহারাষ্ট্র দেশীয় কোথা মেলা, বাহিরেই প্রণাম করিলেন। সকলে বলিলেন, এই স্থান তো মন্দিরের বাহিরে। তিনি বলিলেন, “মন্দিরের কথা পরে হইবে। আগে এখানে পূর্বপূর্ববর্ত্তী ভাগবতদের যে পদধূলি সঞ্চিত হইয়া আছে তাহাকেই প্রণাম করি। [”]
‘এখানেও প্রথমেই দেখি গুরুদেবের আশীর্বাদ, তার পরে অতুলপ্রসাদ প্রভৃতির। সেই সব আশীর্বাদকে এখন প্রণাম করি।’
‘হিন্দুস্থান রেকর্ডে’র উদ্যোগ ক্ষিতিমোহনকে ‘বিস্মিত’ করেছিল, আসল খবর এটুকুই – আর যা-কিছু তা ‘গুরুদেব’-স্মরণ।
কবিতা-গান-গল্প-উপন্যাস-অনুবাদ-শিশুসাহিত্য-প্রবন্ধ-রম্যরচনা-ভ্রমণকথা – সাহিত্যের নানা শাখায় অবদান থাকলেও সৌরীন্দ্রমোহন মুখোপাধ্যায় মূলত কথাসাহিত্যিক হিসেবেই খ্যাত ও পরিচিত। সাময়িকপত্র-সম্পাদনাতেও জড়িত ছিলেন – এক্ষেত্রে মাসিক বসুমতী বা ভারতীর কথা উল্লেখ করা যায়। চলচ্চিত্র-বেতার-গ্রামোফোনের সঙ্গেও তাঁর গভীর যোগ ছিল। বাড়িতে গানবাজনার চল ছিল। গীতিকার হিসেবে সৌরীন্দ্রমোহন সেকালে বেশ নাম করেছিলেন। চলচ্চিত্র ও গ্রামোফোন রেকর্ডের জন্যে গান লিখেছিলেন। দেবকী বসু পরিচালিত চণ্ডীদাস ছবিতে ‘ফিরে চল আপন ঘরে’ এবং গ্রামোফোন রেকর্ডে ‘ও কেন গেল চলে’ বা ‘জীবনে জেগেছিল মধুমাস’ তাঁর লেখা এইসব গান খুবই শ্রোতা-সমাদর লাভ করেছিল। তাঁর সাংগীতিক উত্তরাধিকার বর্তেছিল কন্যা বিশিষ্ট রবীন্দ্রসংগীতশিল্পী সুচিত্রা মিত্রের ওপরে। এই যে সৌরীন্দ্রমোহন, ১৩৩৯-এর ২৬শে পৌষ, রেকর্ড কোম্পানি ‘হিন্দুস্থান’ সম্পর্কে মন্তব্য করেন : ‘হিন্দুস্থান মিউজিক্যাল প্রডাক্টস্ এন্ড ভ্যারাইটিস সিন্ডিকেট লিমিটেডের সর্বাঙ্গীণ সাফল্য কামনা করি।
কর্ম্ম-সচিবগণের কাল্চারের দিকে সুগভীর লক্ষ্য আছে – ইহাই মস্ত আশার কথা – সে আশা সফল হইবে বলিয়া আমার বিশ্বাস। তাঁহাদের জয় হৌক্!’
তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায় আধুনিক বাংলা সাহিত্যের সৃজনশীল ধারার অন্যতম প্রধান ব্যক্তিত্ব। তাঁর গল্প-উপন্যাস মঞ্চ-বেতার-চলচ্চিত্রে রূপায়িত হয়েছে। এসব কাহিনির প্রয়োজনে ও স্বাভাবিক কারণেও তিনি গান-রচনার প্রয়োজন অনুভব করেছেন। তাঁর রচিত বেশকিছু গান অসামান্য জনপ্রিয়তা অর্জন করেছিল। এক্ষেত্রে মনে পড়বে বিশেষ করে এই গানগুলোর কথা – ‘মধুর মধুর বংশী বাজে’, ‘প্রাণের রাধার কোন্ ঠিকানা’, ‘তোমার শেষ বিচারের আশায়’, ‘আহা ভালবেসে এই বুঝেছি, ‘আমার বাজুবন্ধের ঝুমকো দোলায়’, ‘কাচের চুড়ির ছটা ছোঁয়া বাজির ছলনা’, ‘এই খেদ মোর মনে মনে’, ‘মন জানে না মনের কথা’। তারাশঙ্করের গানে সুরারোপ করেছিলেন অনিল বাগচী, জ্ঞানপ্রকাশ ঘোষ, সুধীন দাশগুপ্ত, হেমন্ত মুখোপাধ্যায়, মানবেন্দ্র মুখোপাধ্যায় প্রমুখ সংগীত পরিচালক। এসব গান মূর্ত হয়ে উঠেছিল রবীন মজুমদার, হেমন্ত মুখোপাধ্যায়, মান্না দে, মানবেন্দ্র মুখোপাধ্যায়, সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়, গীতা দত্ত, প্রতিমা বন্দ্যোপাধ্যায়ের মতো শিল্পীদের কণ্ঠে।
বহুদিন পরে, ততদিনে ‘হিন্দুস্থান রেকর্ড কোম্পানি’ প্রতিষ্ঠার ৩৫ বছর পার করেছে, এক আমন্ত্রণে তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায় আসেন ‘হিন্দুস্থান রেকর্ড’-ভবনে। তাঁর হার্দ্য-অভিমত লিখে দেন প্রতিষ্ঠানের খাতায় : ‘বাংলা দেশে হিন্দুস্থান মিউজিক্যাল প্রডাক্টস – আমাদের সাহিত্যসংস্কৃতির ক্ষেত্রে যে সেবা করে আসছেন – তার মধ্যে ব্যবসায় বোধ ও বুদ্ধি থেকে সাহিত্যসংস্কৃতির শ্রদ্ধা বড় – এই সত্য নিজে অন্তরে উপলব্ধি করেই সকলকে বলতে আনন্দ বোধ করছি। এর মধ্যে একটি শুভবুদ্ধি ও প্রেরণা আছে। ব্যবসায়ের সার্থকতা নিশ্চয়ই কাম্যবস্তু – কারণ ব্যবসায় সফল না-হলে পরমায়ু হারায় কিন্তু এই সেবার শুভবুদ্ধি ও প্রেরণা, আরও বড়। ব্যবসায়ের পরমায়ুকে সে আশীর্ব্বাদযুক্ত করে। সেই আশীর্ব্বাদে হিন্দুস্থান মিউজিক্যাল প্রডাক্টস জয়যুক্ত হোক’ (১ বৈশাখ ১৩৭৪)। এই মূল্যায়ন ও শুভকামনা ছিল বাংলার সাহিত্য-শিল্প ও
সংগীত-সংস্কৃতি ভুবনের খ্যাতকীর্তি মানুষদেরই মনের কথার প্রতিধ্বনি।
পেশায় চিকিৎসক বলাইচাঁদ মুখোপাধ্যায় ছিলেন সুখ্যাত লেখক। তাঁর লেখক-নাম ছিল ‘বনফুল’, এই নামেই তাঁকে পাঠকেরা জানেন। গ্রামোফোনের সূত্রে গানের প্রতি তাঁর অনুরাগ। এক স্মৃতিচারণায় তিনি বলেছেন : ‘সত্তর বছর [১৯০৬/১৯০৭] আগের ঘটনা। তখন আমি সাত আট বছরের বালক মাত্র, তবু সেই ঘটনাটি এখনো আমার স্পষ্ট মনে আছে। তার কারণ তখন আমি, শুধু আমি কেন আমাদের বাড়ির সবাই, এমন-কি, আমাদের পাড়ার সকলেও, সেই প্রথম দেখলাম এক আশ্চর্য যন্ত্র যা মানুষের মতো কথা বলতে পারে, হাসে-কাঁদে-গান করে, এমন-কি বাজনা পর্যন্ত বাজায়। চলতি কথায় তাকে বলত ‘বাজা কল’ যার ইংরাজি নাম গ্রামোফোন।’ এই স্মৃতি গ্রামোফোন রেকর্ডের প্রথম পর্বের। এর প্রায় ষাট বছর পর বনফুল ‘হিন্দুস্থান রেকর্ড’-ভবনে যান (১৬ই জানুয়ারি ১৯৬৭) এবং এদের কর্মকাণ্ডের পরিচয় লাভ করে সানন্দে বলেন : ‘হিন্দুস্থান মিউজিকাল প্রোডাক্ট্স্ লিমিটেড বিখ্যাত প্রতিষ্ঠান। রবীন্দ্রনাথের আবৃত্তি, গান এঁরা চমৎকারভাবে জনসাধারণের মধ্যে ছড়িয়ে দিয়েছেন। আরও অনেক গুণী ও শিল্পী এঁদের সহায়তায় আত্মপ্রকাশ করতে সমর্থ হয়েছেন। এ প্রতিষ্ঠানের বয়স পঁয়ত্রিশ বৎসর। এদের চিরায়ু কামনা করি।’
মন্মথ রায় বিশিষ্ট নাট্যব্যক্তিত্ব। তাঁর রচনায় নবনাট্যচেতনা, জাতীয়তাবোধ ও প্রগতিপন্থার পরিচয় মেলে। কারাগার তাঁর বিখ্যাত মঞ্চসফল নাট্যকর্ম। কাজী নজরুল ইসলাম এই নাটকের জন্যে গান রচনা এবং তাতে সুরারোপ করেন। এই ‘প্রতিবাদী নাটক’টি ব্রিটিশ সরকার নিষিদ্ধ ঘোষণা করে। তিনি থিয়েটার-বেতার-চলচ্চিত্রের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। তাঁর বেশকিছু নাটক চলচ্চিত্রায়িত ও গ্রামোফোনে রেকর্ড হয়। ‘হিন্দুস্থান রেকর্ড কোম্পানি’র সঙ্গেও মন্মথ রায়ের যোগ ছিল। ১৯৬৭ সালের ১১ই জানুয়ারি তিনি কোনো এক উপলক্ষে এই প্রতিষ্ঠানে যান – মাত্র ‘হিন্দুস্থান জিন্দাবাদ’ এই ধ্বনিটুকুতেই প্রতিষ্ঠান-বন্দনা করেন, ধ্বনি ছোটো তবে তার ব্যঞ্জনা স্বল্প নয়।
মন্মথ রায় যে-দিনটিতে ‘হিন্দুস্থান রেকর্ড’-ভবনে গিয়েছিলেন, ওই একই তারিখে শৈলজানন্দ মুখোপাধ্যায়ও সেখানে উপস্থিত ছিলেন। হয়তো উপলক্ষ ছিল অভিন্ন। শৈলজানন্দ বিশিষ্ট কথাসাহিত্যিক। নিম্নবর্গের মানুষের জীবনযাপন-চিত্র ফুটে উঠেছে তাঁর গল্প-উপন্যাসে। কয়লাকুঠির জীবনের প্রথম রূপকারও তিনি।
মঞ্চ-বেতার-গ্রামোফোন-চলচ্চিত্রে কাজ করার অভিজ্ঞতাও তাঁর ভালোই ছিল। বন্ধু প্রেমেন্দ্র মিত্রের মতো তিনিও পরিচালক হিসেবে নিজের লেখা বেশকিছু গল্প-উপন্যাসের চলচ্চিত্রে রূপ দিয়েছেন। গ্রামোফোনেও তাঁর লেখা রেকর্ড-নাট্য প্রকাশ পেয়েছে। ‘হিন্দুস্থান রেকর্ডে’র অভিমত-পুস্তকে তিনি লিখেছিলেন : ‘হিন্দুস্থান রেকর্ডিং কোম্পানীর জয় হোক্্! রেকর্ডিং ব্যাপারে এইখানেই বাঙ্গালীর প্রথম পদক্ষেপ। সেদিক দিয়ে এঁরা যে সাহসের পরিচয় দিয়েছেন, তার প্রশংসা না করে পারি না। হিন্দুস্থানের যাত্রাপথ কুসুমাস্তীর্ণ হোক – এই কামনা করি।’ এই হ্রস্ব-মন্তব্যে ‘হিন্দুস্থানে’র সাফল্যের মূল জায়গাটিকে স্পর্শ করা হয়েছে।
‘কল্লোল’-যুগের প্রতিনিধিস্থানীয় লেখকদের অন্যতম অচিন্ত্যকুমার সেনগুপ্ত। গল্পকার, ঔপন্যাসিক, কবি, জীবনীকার হিসেবে বিশিষ্ট তিনি। লেখার প্রসঙ্গ ও প্রকরণের অভিনবত্ব ও বৈশিষ্ট্যের জন্যে স্মরণীয়। ১১ই জানুয়ারি ১৯৬৭ সালে অচিন্ত্যকুমার ‘রাজার বেটা হ, মাসোয়ারা পাবি’, শ্রীরামকৃষ্ণের এই কথাটি লিখে নিজের নাম স্বাক্ষর করেছেন ‘হিন্দুস্থান রেকর্ডে’র খাতায়। হয়তো এ-কথার কোনো গভীর অর্থ-ব্যঞ্জনা আছে ‘হিন্দুস্থান রেকর্ড কোম্পানি’র প্রসঙ্গে।
নিশ্চয়ই ১১ই জানুয়ারি ১৯৬৭-তে কোনো আনুষ্ঠানিক উপলক্ষ ছিল, তা নাহলে বুদ্ধদেব বসুও আরো অনেকের মতো কেন ওইদিনই ‘হিন্দুস্থান রেকর্ড কোম্পানি’তে আসবেন! বুদ্ধদেব বসু আধুনিক বাংলা সাহিত্যের সব্যসাচী লেখক – বহুমাত্রিক সাহিত্যবোদ্ধা। সাহিত্যের প্রায় সব শাখাতে বিচরণ করলেও কবিতাই ছিল তাঁর মূল আরাধ্য – কবিতার শুশ্রƒষা ও পুষ্টির জন্যে তাঁর ভূমিকা ও অবদান অসামান্য। তাঁর সংগীত-বিবেচনার ছিটেফোঁটা পরিচয় কোনো কোনো রচনায় প্রচ্ছন্ন। বুদ্ধদেব-ভার্যা প্রতিভা বসু ছিলেন জনপ্রিয় লেখিকা – তারও আগে সংগীতে নিবেদিত ছিলেন তিনি। প্রতিভার পদবি যখন ছিল ‘সোম’, থাকতেন ঢাকায় – তখন নজরুলের কাছে বনগ্রামের বাড়িতে গান-শেখার সুযোগ ও সৌভাগ্য হয়েছিল। সুকণ্ঠী ও সম্ভাবনাময়ী শিল্পী প্রতিভা সোমের রবীন্দ্রনাথ ও নজরুল এবং আধুনিক গানের বেশ কয়েকটি ডিস্ক রেকর্ড বেরিয়েছিল এইচএমভি থেকে এবং তা বেশ সমাদরও লাভ করে। বিয়ের পর প্রতিভা নিজের ইচ্ছেতেই গানের ভুবন থেকে বিদায় নেন – এতে বুদ্ধদেবের কোনো হাত ছিল না। বর্তমান প্রবন্ধকার একবার প্রতিভা বসুর এক দীর্ঘ সাক্ষাৎকার গ্রহণ করেন – এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেছিলেন, বুদ্ধদেব কখনো-সখনো তাঁর কাছে গান শুনতে চাইতেন – সে একান্তই তাঁর পছন্দের রবীন্দ্রনাথের গান। ‘হিন্দুস্থান রেকর্ড’ ভবনে বুদ্ধদেবের আসাটা বিস্ময়েরই ব্যাপার বটে – আর এই আমন্ত্রণরক্ষা তাঁর জন্যে যে একঘেয়ে বা নিরানন্দের হয়নি, তা বেশ বোঝা যায় এই প্রতিষ্ঠানের খাতায় লেখা বুদ্ধদেবের এক-পঙ্ক্তির সংক্ষিপ্ত মন্তব্যে : ‘হিন্দুস্থান রেকর্ডিং কোম্পানিতে এসে বিশেষ আনন্দ পেয়েছি।’
গল্পকার-ঔপন্যাসিক-নাট্যকার-প্রাবন্ধিক-গবেষক-গীতিকার-শিক্ষাবিদ – নানা পরিচয়ে নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায় বিশিষ্ট ও খ্যাতিমান। সাপ্তাহিক দেশ পত্রিকায় প্রকাশিত ‘সুনন্দর জর্নাল’ ও কিশোরপাঠ্য ‘টেনিদা’র গল্পকথা তাঁর লেখকখ্যাতির ভিন্ন দুই উৎস। তাঁর রচিত গানের সংখ্যাও কম নয় – তাঁর অনেক গান গ্রামোফোন রেকর্ডে মুদ্রিত ও চলচ্চিত্রে ব্যবহৃত হয়েছে। ১১ই জানুয়ারি ১৯৬৭-এ ‘হিন্দুস্থান রেকর্ড’-ভবনে লেখক, শিল্পী,
সংস্কৃতিসেবীদের সমাবেশে উপস্থিত নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায় এই প্রতিষ্ঠান সম্পর্কে তাঁর যে-মনোভাবের কথা লিখে জানান, তা এইরকম : ‘এই প্রতিষ্ঠান বাঙালীর গৌরব। এর আহ্বানে এখানে এসে আমিও কৃতার্থ।’ – বিনীত অভিব্যক্তির এ-এক মনোজ্ঞ দৃষ্টান্ত।
সমাজমনস্ক ও জীবনঘনিষ্ঠ লেখক ছিলেন সমরেশ বসু। একসময়ে কমিউনিস্ট পার্টির সঙ্গে যোগ ছিল। মূলত গল্পকার ও ঔপন্যাসিক। স্বনামে যেমন অপরদিকে তেমনি ‘কালকূট’ ছদ্মনামেও লিখেছেন। উপন্যাস গঙ্গার জন্যে খ্যাতি অর্জন করেন – চলচ্চিত্রেও রূপায়িত হয় এই আখ্যান। শাম্ব উপন্যাস তাঁকে এনে দেয় সাহিত্য অকাদেমি পুরস্কার। বিবর ও প্রজাপতি উপন্যাসের কারণে অশ্লীলতার দায়ে অভিযুক্ত হন। প্রখ্যাত ভাস্কর ও চিত্রশিল্পী রামকিঙ্কর বেইজের জীবনভিত্তিক উপন্যাস দেখি নাই ফিরে সাপ্তাহিক দেশ পত্রিকায় ধারাবাহিক প্রকাশের কালে তাঁর মৃত্যু হয়। লেখালেখির বাইরে ছবি আঁকা, বাঁশি বাজানো, অভিনয় ও বৈঠকী আড্ডাতেও তাঁর বিশেষ ঝোঁক ছিল। ১৬ই আগস্ট ১৯৬১ সমরেশ বসু প্রতিষ্ঠান-কর্তৃপক্ষের আমন্ত্রণে ‘হিন্দুস্থান রেকর্ড কোম্পানি’তে আসেন এবং প্রতিষ্ঠান সম্পর্কে এই মন্তব্য লিখে দেন : ‘হিন্দুস্থান রেকর্ড নতুন গৌরবে গৌরবান্বিত হোক, বর্তমান কাল প্রতিধ্বনিত হোক তার সাংস্কৃতিক জয়যাত্রায়।’ তাঁর এই প্রত্যাশা জয়যুক্ত হয়েছে ‘হিন্দুস্থান রেকর্ডে’র অব্যাহত ‘সাংস্কৃতিক জয়যাত্রায়’।
চোদ্দো
গায়ক-সুরকার-প্রশিক্ষক-গীতিকার-বাদ্যযন্ত্রী-রেকর্ডিস্ট ও অন্যান্য কলাকুশলীর সমাবেশে ‘হিন্দুস্থান রেকর্ড কোম্পানি’র ভবন নিত্য মুখর থাকতো। এর ওপরে আমন্ত্রিত গানের মানুষেরাও থাকতেন। এঁদের মন্তব্য-অভিমতে এই প্রতিষ্ঠান সম্পর্কে একটি স্পষ্ট ধারণা পাওয়া সম্ভব হতো।
প্রথমে অমিয়নাথ সান্যালের কথা বলি। অমিয়নাথ ছিলেন ভারতীয় মার্গসংগীতের এক মহান কলাকার ও বোদ্ধা। উচ্চাঙ্গসংগীতের দেশখ্যাত ওস্তাদদের সঙ্গ-সান্নিধ্য লাভের সুযোগ ও সৌভাগ্য তাঁর হয়েছিল। ওস্তাদ বাদল খাঁর মতো সংগীতগুণীর কাছে তালিম নেন। Rags and Raginis ও স্মৃতির অতলে সংগীত সম্পর্কে তাঁর দুটি উল্লেখযোগ্য বই। সংগীতচর্চার পরম্পরা ছিল পরিবারে – পিতা দীননাথ সান্যাল পেশায় চিকিৎসক হলেও সাহিত্য ও সংগীতাচর্চাতেও নিবেদিত ছিলেন এবং কন্যা রেবা মুহুরী বিশিষ্ট ঠুমরি-শিল্পী হিসেবে পরিচিতি পেয়েছিলেন। ৭ই জানুয়ারি ১৯৩৩, এই প্রতিষ্ঠান সম্পর্কে অমিয়নাথ সংক্ষেপে যে অভিমত জানান তা অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ : ‘হিন্দুস্থান সঙ্গীত প্রতিষ্ঠান, তাঁহাদের উদ্দেশ্য ও তাঁহাদের কীর্ত্তি দেখে আশা হয় বাঙ্গালী বোধ হয় বাঙ্গলা গান ভালবাসতে আরম্ভ করেছে। তাঁদের বাঙ্গলা রেকর্ড শুনে বাঙ্গলা গান হিন্দুস্থানী গানের চেয়ে ভাল লেগেছে অন্ততঃ আমার নিজের।’ শাস্ত্রীয় সংগীতের পরিবেশনার যে ঢং ও মেজাজ তা যে তিন-সাড়ে তিন মিনিট সময়ের মধ্যে নিখুঁতভাবে ফুটিয়ে তোলা ভারি কঠিন, এই মন্তব্যে হয়তো তার ইঙ্গিত আছে বলে মনে হয়।
অজয় ভট্টাচার্য্য কবি-গীতিকার-চলচ্চিত্রের চিত্রনাট্যকার। তবে গীতিকার হিসেবেই তাঁর মূল পরিচিতি। বেসিক রেকর্ড ও চলচ্চিত্রের জন্যে অসংখ্য গান রচনা করেছেন। কারো কারো অনুমান, তাঁর রচিত গানের সংখ্যা প্রায় দুই হাজার। একসময়ে ‘হিন্দুস্থান রেকর্ড কোম্পানি’র বাঁধা-গীতিকার ছিলেন। তাঁর লেখা গান অত্যন্ত জনপ্রিয় হয়েছিল – সেই তালিকা যথেষ্ট দীর্ঘ। ১৯৩৯ সালের ১৫ই জুলাই, সম্ভবত তখনো তিনি ‘হিন্দুস্থান রেকর্ডে’র চুক্তিবদ্ধ গীতিকার, প্রতিষ্ঠানের
মন্তব্য-খাতায় এই কথাটি লেখেন : ‘হিন্দুস্থানকে ভালবাসি, এবং সে কথা জানাবার এই সুন্দর সুযোগকে অগ্রাহ্য করতে পারি না।’
নৃত্য-গীত-অভিনয়ে পটু শান্তিদেব ঘোষের জীবন কেটেছে শান্তিনিকেতনে – লাভ করেন রবীন্দ্রনাথের অন্তরঙ্গ সঙ্গ ও সান্নিধ্য। রবীন্দ্রসংগীত ও নৃত্যনাট্য-বিশেষজ্ঞ।
গায়ক-সংগীতশিক্ষক-স্বরলিপিকার ও লেখক হিসেবেও খ্যাত। বাংলা ও ইংরেজি ভাষায় রচিত তাঁর গ্রন্থাবলি দেশে-বিদেশে সমাদৃত। বিশ্বভারতীর সংগীতভবনের পরিচালক ও অধ্যক্ষ এবং বিশ্বভারতী কেন্দ্রীয় বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে স্বীকৃতিলাভের পর রবীন্দ্রসংগীত ও নৃত্যের প্রধান অধ্যাপকের দায়িত্ব পালন করেন। দেশিকোত্তম, সাম্মানিক ডি. লিট, ওস্তাদ আলাউদ্দীন পুরস্কার, পদ্মভূষণ – এইসব নানা সম্মাননা-স্বীকৃতি-পুরস্কারে ভূষিত হন। ‘হিন্দুস্থান রেকর্ড কোম্পানি’ থেকেই শান্তিদেবের প্রথম রবীন্দ্রসংগীতের রেকর্ড বের হয়। ১৯৬৬-এর ২৩শে মার্চ এই প্রতিষ্ঠানে উপস্থিত হয়ে সেই পূর্বকথা স্মরণ করে বিনয় ও কৃতজ্ঞতার সঙ্গে শান্তিদেব ঘোষ মন্তব্য-খাতায় লিখেছিলেন : ‘হিন্দুস্থান মিউজিক্যাল প্রডাক্টস্ আমার মত সামান্য গাইয়েকে রেকর্ড করাতে উৎসাহ দিয়ে আমাকে ধন্য করেছেন।’
বাংলা গানের গ্রামোফোন ও
চলচ্চিত্র-মাধ্যমে অনুপম ঘটকের অবদান স্মরণীয় হয়ে আছে। গায়ক-সুরকার-সংগীত পরিচালক-চলচ্চিত্রনির্মাতা ও অভিনেতা – নানা পরিচয়ে তিনি চিহ্নিত। বিখ্যাত সুরকার ও চিত্রপরিচালক হীরেন বসুর আনুকূল্যে অনুপম ঘটক বেতার-চলচ্চিত্র-গ্রামোফোনে গান গাওয়া ও সুরারোপের সুযোগ পান। বাংলার বাইরে তিনি বোম্বাই ও লাহোরে ফিল্ম ও রেডিয়োতে কাজ করেন। লাহোর রেডিওতে সহকর্মী হিসেবে পেয়েছিলেন উপমহাদেশের ধ্রুপদি সুরস্রষ্টা নওশাদকে। ১৯৩২ সালে ‘হিন্দুস্থান রেকর্ডে’ অনুপম ঘটকের প্রথম রেকর্ড বের হয় – ‘জানি তোমার সাথে দেখা হবে সাগর কিনারায়’। এর পরেপরেই সুরকার-সংগীতপরিচালক হিসেবে তিনি ‘হিন্দুস্থান রেকর্ডে’ যোগ দেন। ১৯৩৫ সালে প্রথম চলচ্চিত্রে সংগীতপরিচালক হিসেবে আবির্ভূত হন – ছবির নাম পায়ের ধুলো। ১৯৪০-এ প্রমথেশ বড়ুয়ার শাপমুক্তি এবং তারপর একে একে শ্রীতুলসীদাস, কার পাপে, অনুপমা, পরেশ, একটি রাত, শঙ্করনারায়ণ ব্যাঙ্ক, কীর্তিগড় এবং বিশেষ করে উল্লেখ্য অগ্নিপরীক্ষা ছায়াছবির সংগীত পরিচালনা করেন। পরিসংখ্যান বলে, তিনি প্রায় ২৬টি বাংলা ও ১৬টি হিন্দি ছায়াছবির সংগীতপরিচালক ছিলেন। ‘একটি পয়সা দাও গো বাবু’, ‘লিখিনু যে চিঠিখানি প্রিয়তমারে’, ‘শুকনো পাতা ঝরে যায়’, ‘কে তুমি আমারে ডাক’, ‘গানে মোর কোন ইন্দ্রধনু’ এবং এমন অনেক কালজয়ী গানের সুরস্রষ্টা অনুপম ঘটক। এই বিশেষ বৈশিষ্ট্য-চিহ্নিত সুরসাধক ১৭ই বৈশাখ ১৩৩৯-এ ‘হিন্দুস্থান রেকর্ড’-ভবনে প্রথম আসেন, পরে সম্পৃক্ত হন এই প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে। সেদিন তাঁর লিখিত প্রতিক্রিয়া ছিল এইরকম : ‘হিন্দুস্থান ম্যুজিকাল প্রডাক্টস ভেরাইটি সিন্ডিকেটে আসিয়া যাহা দেখিলাম ইহা যে আমাদের বাঙ্গালীর দ্বারা সম্ভব হইতে পারে ধারণা ছিল না। এই অনুষ্ঠানের [ প্রতিষ্ঠানের ক্রমোন্নতি কামনা করি [।]’
রাজ্যেশ্বর মিত্র গায়ক-সংগীত বিশেষজ্ঞ-সংগীত সমালোচক ও গবেষক। পুরাতনী বাংলা গান-নিধুবাবুর টপ্পা-উচ্চাঙ্গসংগীত-রবীন্দ্রসংগীত শিক্ষা করেন বিষয়ক-অধিকারী গুণী সংগীতসাধকদের কাছে। তবে সংগীতবিষয়ক রচনার জন্যেই তাঁর খ্যাতি ও পরিচিতি। তাঁর উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ : বাংলা সঙ্গীত, সঙ্গীত সমীক্ষা, বেদগানের প্রাকৃত রূপ, বৈদিক ঐতিহ্যে নামগান, আর্যভারতের সঙ্গীতচিন্তা, মুঘল ভারতের সঙ্গীতচিন্তা, উত্তর ভারতীয় সঙ্গীত, বাংলার গীতিকার ও বাংলা গানের নানান দিক, অতুলপ্রসাদ। ‘শার্ঙ্গদেব’ নামে সাপ্তাহিক দেশ পত্রিকায় তিনি যে
সংগীত-সমালোচনা করতেন তাতে তাঁর প্রজ্ঞা, মেধা ও বিষয়জ্ঞানের পরিচয় মিলতো। বিশ^ভারতী ও রবীন্দ্রভারতী বিশ^বিদ্যালয়ে তিনি আমন্ত্রিত অধ্যাপক ও খণ্ডকালীন অধ্যাপক হিসেবে সম্পৃক্ত ছিলেন। ১৯৬৭ সালের ২৮শে অক্টোবর রাজ্যেশ্বর মিত্র ‘হিন্দুস্থান রেকর্ড কোম্পানি’ পরিদর্শনের পরিপ্রেক্ষিতে উল্লেখ করেন যে : ‘বাংলার সঙ্গীতসংস্কৃতির রক্ষাকল্পে হিন্দুস্থান মিউজিকাল প্রোডাক্ট্স্-এর মহৎ প্রচেষ্টা সকৃতজ্ঞ চিত্তে স্মরণ করি। এঁদের প্রচেষ্টায় চলমান সঙ্গীতের শ্রেষ্ঠ বস্তুও সংরক্ষিত হবে এই আশা রইল।’ সংগীত-সমালোচকের এই প্রত্যাশা ব্যর্থ হয়নি।
বাংলার সংগীতজগতে তিনজন ‘ধীরেন’-এর আবির্ভাব ঘটেছিল ভিন্ন ভিন্ন সময়ে – তাঁদের পদবি যথাক্রমে ‘দাস’, ‘মিত্র’ ও ‘বসু’ – ধীরেন্দ্রনাথ দাস (ধীরেন দাস), ধীরেন্দ্রচন্দ্র মিত্র (ধীরেন মিত্র) ও ধীরেন্দ্রনাথ বসু (ধীরেন বসু)। শুধু নামে নয়, আরো একটি বিষয়ে এঁদের মিল পাওয়া যায় – এঁরা তিনজনই ছিলেন নজরুলসংগীতের রূপকার। আমাদের কথা সর্বকনিষ্ঠ ধীরেন (বসু)-কে নিয়ে।
ধীরেন বসু মূলত নজরুলসংগীতের শিল্পী – তবে কিছু রবীন্দ্রসংগীত ও আধুনিক গানও তিনি গেয়েছেন। নজরুলের সব গানই তিনি রেকর্ড করেন ‘হিন্দুস্থান রেকর্ড কোম্পানি’ থেকে – তিনি ছিলেন এই প্রতিষ্ঠানের বাঁধা-শিল্পী। ‘হিন্দুস্থান রেকর্ডে’র মন্তব্য-খাতায় তিনি কৃতজ্ঞতা ও ঋণ স্বীকার করে ২২শে নভেম্বর ১৯৭২ তারিখে এই কথাগুলো জানিয়েছিলেন : ‘হিন্দুস্থান রেকর্ড কোম্পানীর কাছে আমি কৃতজ্ঞ। এর পরিচালকমণ্ডলী ও কর্মিদের সহযোগীতা [সহযোগিতা] আমাকে নানাদিক দিয়ে ভীষণ সাহায্য করেছে। কাজী নজরুলের নীরব আশীর্বাদের সার্থক রূপ দেবার সুযোগ দিয়েছেন আমাকে হিন্দুস্থান কোম্পানী, তাই চিরদিনের জন্যই রইলাম হিন্দুস্থানে।’
কৃতজ্ঞ ও সহায়তামুগ্ধ এক শিল্পীর আন্তরিক প্রতিবেদন এখানে প্রকাশিত।
অশোকতরু বন্দ্যোপাধ্যায় রবীন্দ্রসংগীতের বিশিষ্ট শিল্পী এবং সেইসঙ্গে গুণী শিক্ষকও। শান্তিনিকেতনের আবহে মানুষ। রবীন্দ্রনাথের গান শেখার সুযোগ হয় শৈলজারঞ্জন মজুমদারের কাছে। উচ্চাঙ্গসংগীতের গুরু রবীন্দ্রলাল রায় ও সুরেশচন্দ্র চক্রবর্তী। আঠারো বছর বয়সে বেতারে রবীন্দ্রসংগীত পরিবেশনের সুযোগ পান। রবীন্দ্রসংগীতের একক অনুষ্ঠান করার ক্ষেত্রেও অগ্রণী শিল্পী। প্রথমে গ্রামোফোন রেকর্ডে ও পরবর্তীকালে ক্যাসেট-সিডিতে তাঁর কণ্ঠের রবীন্দ্রসংগীত ধরা আছে। মূলত ‘হিন্দুস্থান রেকর্ডে’র জন্যেই বরাবর রবীন্দ্রসংগীত রেকর্ড করেছেন। ২১শে জুন ১৯৭৬ ‘হিন্দুস্থান রেকর্ড কোম্পানি’র খাতায় কিছুটা স্মৃতিকাতর হয়ে অঙ্গীকারবদ্ধ অশোকতরু লিখেছিলেন : ‘প্রাথমিক অবস্থায় সব শিল্পীকেই রেকর্ড করবার সুযোগের জন্য সুযোগের অপেক্ষায় ধৈর্য্যরে পরীক্ষা দিতে হয়। গুরুদেবের আশীর্বাদ আমাকে মুখ ফুটে কারো কাছে দরবার করতে হয়নি। শ্রীনিরোদ বন্দ্যোপাধ্যায় মহাশয় নিজে থেকে খবর পাঠিয়ে আমাকে হিন্দুস্থানের শিল্পী হবার জন্য যোগাযোগ করেন। স্বর্গীয় চণ্ডী সাহা আমাকে আশীর্বাদ করে বলেছিলেন আমি একদিন বড় হব। যেদিন তিনি শেষ এই দপ্তরে এসেছিলেন আমাকে প্রতিজ্ঞা করিয়ে গেছেন আমি যেন চিরদিন হিন্দুস্থানেরই শিল্পী থাকি। তাঁর স্নেহ ভুলব না। আমিও চিরদিনের জন্যই হিন্দুস্থানেরই।’ চণ্ডীচরণ সাহার কল্যাণে ‘হিন্দুস্থান রেকর্ডে’র সঙ্গে যে অচ্ছেদ্য বন্ধন গড়ে উঠেছিল অশোকতরুর, শিল্পীর প্রয়াণের ফলেই তা শুধু ছিন্ন হতে পেরেছিল।
পনেরো
ভিন্ন-অর্থে সব মানুষই বহুমাত্রিক – একের মধ্যে থাকে অনেক মানুষের উপস্থিতি। সৃজনশীল মানুষের ক্ষেত্রে এ-কথা আরো বেশি সত্য। তাই গ্রামোফোনের সঙ্গে গানের শিল্পী ছাড়াও সম্পর্ক স্থাপিত হবে মঞ্চ-বেতার-চলচ্চিত্রের নানা ভূমিকার মানুষের – এর ভিত গড়ে উঠবে রংধনু-বৈশিষ্ট্যের বর্ণচ্ছটায়। এবারের আলোচনা সেই পথ অনুসরণ করবে।
অধ্যাপনা এবং নাট্যাভিনয় ও নির্দেশনায় নাট্যাচার্য শিশিরকুমার ভাদুড়ী অসামান্য খ্যাতি ও প্রতিষ্ঠা লাভ করেন। তাঁকে ‘থিয়েটারে নবযুগের প্রবর্তক’ বলা হয়ে থাকে। অভিনয়নৈপুণ্য ও নির্দেশনাবৈচিত্র্যের কারণে রবীন্দ্রনাথও তাঁর বিশেষ গুণগ্রাহী ছিলেন। শিশিরকুমার অভিনীত সীতা, জনা, চন্দ্রগুপ্ত, আলমগীর, প্রফুল্ল, সধবার একাদশী, মাইকেল, ষোড়শী, বিন্দুর ছেলে, দুঃখীর ইমান এবং রবীন্দ্রনাথের বৈকুণ্ঠের খাতা, বিসর্জন, শেষরক্ষা, চিরকুমার সভা, যোগাযোগ – দর্শক-সমাদর লাভ করে। আমেরিকাতেও অভিনয়ের জন্যে তাঁর নাট্যদল নিয়ে যান। শিশির ভাদুড়ী ছিলেন বাংলা রঙ্গালয়ের শেষ মহাতারকা ব্যক্তিত্ব। মৃত্যুর সামান্য আগে জাতীয় নাট্যশালার দাবিতে ভারত সরকারের ‘পদ্মভূষণ’ উপাধি প্রদানের প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেন।
গ্রামোফোন রেকর্ড কোম্পানির সঙ্গেও শিশিরকুমার ভাদুড়ীর খুব ভালো যোগাযোগ ছিল – ‘হিন্দুস্থান’ ও ‘মেগাফোন’ থেকে তাঁর আবৃত্তি ও নাটকের রেকর্ড প্রকাশ পায়। ‘হিন্দুস্থানে’র
রেকর্ড-নাট্যের কথা বিশেষভাবে উল্লেখ করতে হয়। ১৯৩২ থেকে ১৯৪৮ সাল পর্যন্ত বাংলা-হিন্দি-উর্দু-উড়িয়া-গুরখালি-নেপালি ভাষায় অন্তত ৩০টি সামাজিক-ঐতিহাসিক-পৌরাণিক পালা-রেকর্ড বের হয়। শিশিরকুমার ভাদুড়ীর অভিনয় ও পরিচালনায় প্রকাশিত হয় দুই খণ্ডের রেকর্ড-নাট্য আলমগীর। মঞ্চের মতো এখানেও মূল ভূমিকায় ছিলেন শিশির ভাদুড়ী। কবিতা আবৃত্তির রেকর্ড প্রকাশেও ‘হিন্দুস্থান’ অগ্রণী ভূমিকা পালন করে। রবীন্দ্রনাথের নিজের কণ্ঠেই তাঁর কবিতার আবৃত্তির রেকর্ড শুরু ‘হিন্দুস্থানে’, আর তা পূর্ণতা পায় শিশিরকুমার ভাদুড়ীর রবীন্দ্র-কবিতা আবৃত্তির রেকর্ড-প্রকাশে – যাতে ছিল এই দুটি কবিতা : ‘কালি মধুযামিনীতে’ ও ‘বহুদিন মনে ছিল আশা’।
‘হিন্দুস্থান রেকর্ড কোম্পানি’র জন্মবছরেই সেখানে গিয়েছিলেন (২৬শে পৌষ ১৩৩৯) শিশিরকুমার ভাদুড়ী। মন্তব্য-খাতায় তাঁর লেখায় এই প্রতিষ্ঠান সম্পর্কে প্রশংসার কথা আছে। তিনি লিখেছিলেন : ‘হিন্দুস্থান মিউসিকাল সিণ্ডিকেটের মঙ্গল কামনা করি। তাঁহাদের আয়োজন সফলতা অর্জ্জন করিবার যোগ্যতা রাখে নিরপেক্ষভাবে তাহা বলিতে পারি।’ তবে এখানে তিনি নিজের পদবির প্রচলিত বানান, যা নিজেও তিনি ব্যবহার করতেন, ‘ভাদুড়ী’ না লিখে কেন যে ‘ভাদূড়ী’ লিখলেন তা বোঝা মুশকিল। ‘দু’-কে ‘দূ’-লেখা কি অন্যমনস্কতার ফল, না অসচেতনতাই এর কারণ – সে-ব্যাখ্যা আজ আর কোথায় পাওয়া যাবে!
স্মরণীয় বেতার-ব্যক্তিত্ব বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্র নাট্যকার-রম্যলেখক-অভিনয়শিল্পী হিসেবেও পরিচিত। ১৯২৮-এ কলকাতা বেতার কেন্দ্রে যোগ দেন। বেতারে তাঁর পরিচালিত ‘মহিলা মজলিশ’ ও ‘মহিষাসুরমর্দিনী’তে তাঁর স্তোত্রপাঠ বিপুল জনপ্রিয়তা পায়। তাঁর বেতার-নাটক পরিচালনা ও ‘বিরূপাক্ষ’ ছদ্মনামের রম্যরচনা-পাঠও দারুণ শ্রোতাপ্রিয় হয়। স্বনামে ও ছদ্মনামে রচিত তাঁর উল্লেখযোগ্য রচনা : ভোটভণ্ডুল, প্রহারেণ ধনঞ্জয়, বিরূপাক্ষের ঝঞ্ঝাট, বিরূপাক্ষের নিদারুণ অভিজ্ঞতা, সুবর্ণ গোলক। মঞ্চ-চলচ্চিত্র-গ্রামোফোনের সঙ্গেও তাঁর সম্পর্ক ছিল। ব্ল্যাক আউট ও ৪৯ নম্বর মেস তাঁর দুটি মঞ্চসফল নাটক। ‘হিন্দুস্থান’, ‘মেগাফোন’ ও ‘সেনোলা রেকর্ডে’ তাঁর প্রায় ৩০টি পালাগানের রেকর্ড প্রকাশ পায় – এই সূত্রেই মূলত ‘হিন্দুস্থান রেকর্ড কোম্পানি’র সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক ও যোগাযোগ।
বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্র ৫ই ফেব্রুয়ারি ১৯৭৪ আমন্ত্রিত হয়ে ‘হিন্দুস্থান রেকর্ড’-ভবনে এসেছিলেন – এ-ছিল তাঁর যৌবনের স্মৃতিগৃহে দীর্ঘ-ব্যবধানে পুনরাগমন। তিনি যে-মন্তব্য এই প্রতিষ্ঠানের খাতায় লিখেছিলেন, তা অন্যদের মতো একেবারে সংক্ষিপ্ত নয় – তাঁর সেই বক্তব্য এখানে উদ্ধৃত হলো : ‘হিন্দুস্থান মিউজিক্যাল প্রোডাক্টস লিমিটেড যখন প্রথম স্থাপিত হ’ল তখন থেকে আমি এই সংস্থার মহৎ উদ্দেশ্য তখন ছিল বা এখনও আছে তা জানি। এই প্রতিষ্ঠানের যিনি প্রাণ দিয়েছিলেন সেই মানুষটিকে আমি ব্যক্তিগতভাবে চিনি – তিনি আমার একান্ত প্রিয় ও শ্রদ্ধেয় বন্ধু। বাঙলাদেশের ব্যবসায়ী মহলেও তিনি একজন সৎ ও সদাশয় ব্যক্তি হিসাবে পরিচিত। তাঁর নাম শ্রীচণ্ডীচরণ সাহা। এমন অমায়িক, বন্ধুবৎসল ও কর্মী আমি জীবনে খুব অল্পই দেখেছি। একটা মহান আদর্শ নিয়ে তিনি এই সংস্থা গড়েছিলেন এবং তাঁর সুযোগ্য পুত্র শ্রীমান শোভনও সেই আদর্শে ব্রতী হয়ে এই সংস্থাকে শুধু লাভের ব্যবসায় নয় বাঙালীর রসবোধ যাতে তৃপ্ত হয় তার জন্য চেষ্টা করে যাচ্ছেন। আমি সর্বতোভাবে এই সংস্থার উন্নতি কামনা করি।’ বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্র এই প্রতিষ্ঠান এবং তার স্থাপয়িতা ও উত্তরসূরির চমৎকার মূল্যায়ন করেছেন অল্প কথায়।
সুকণ্ঠের অধিকারী কাজী সব্যসাচী ছিলেন প্রখ্যাত আবৃত্তিশিল্পী – বলা চলে তাঁর সময়ের শ্রেষ্ঠ আবৃত্তিকার। পিতা কাজী নজরুল ইসলামের কিছু সাংস্কৃতিক গুণ তিনি পেয়েছিলেন। গ্রামোফোন রেকর্ডে তাঁর কণ্ঠে নজরুলের কিছু নির্বাচিত কবিতার আবৃত্তি খুবই জনপ্রিয় হয়েছিল। রবীন্দ্রগীতিনাট্যের রেকর্ডে, বিশেষ করে শাপমোচনে, সূত্রধারের ভাষ্য এক বিশেষ মাত্রা যোগ করেছিল। ‘হিন্দুস্তান রেকর্ড কোম্পানি’র সঙ্গে তাঁর বিশেষ সংযোগ-সম্পর্ক ছিল। সব্যসাচী শেষবার ‘হিন্দুস্থান রেকর্ডে’র গৃহে এসেছিলেন ১৯৭৫-এর ১৮ই নভেম্বর। সেদিন মন্তব্যের খাতায় লিখেছিলেন : ‘হিন্দুস্থান মিউজিক্যাল প্রোডাকটস লিমিটেড চলছে চলবে।’ কাজী সব্যসাচীর এই সেøাগানধর্মী মন্তব্যের ভেতর দিয়ে ‘হিন্দুস্থান রেকর্ডে’র প্রতি তাঁর দৃঢ় আস্থা প্রকাশ পেয়েছে।
ষোলো
‘হিন্দুস্থান রেকর্ড কোম্পানি’ পরিদর্শনে নানা পেশার দেশি-বিদেশি খ্যাতিমান মানুষ এসেছেন – রাজা-মহারাজারাও বাদ পড়েননি। ‘হিজ হাইনেস মহারাজা অব্ ময়ূরভঞ্জ’-এরও আগমন ঘটেছে। শ্রীশচন্দ্র নন্দী মুর্শিদাবাদের কাশিমবাজার রাজবংশের সন্তান – মহারাজা মণীন্দ্রচন্দ্র নন্দীর পুত্র – সাহিত্য-সংস্কৃতির পৃষ্ঠপোষক এবং বিদ্যোৎসাহী ও জনকল্যাণমূলক কর্মকাণ্ডে যুক্ত উদারহৃদয় ব্যক্তি। ছোটো লাটের অধীনে ওজারতিও করেছেন কয়েক বছর। বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষৎ-এর সভাপতির দায়িত্বেও ছিলেন একসময়। প্রসঙ্গত উল্লেখ যে, মহারাজা মণীন্দ্রচন্দ্রের অর্থানুকূল্যে কলকাতায় সাহিত্য পরিষৎ-এর ভবন নির্মিত হয়। সংগীতানুরাগী শ্রীশচন্দ্র নন্দী ১৩৪৩-এর ২১শে বৈশাখ ‘হিন্দুস্থান রেকর্ড কোম্পানি’তে আসেন এবং দু-ছত্র লিখে তাঁর শুভেচ্ছা জ্ঞাপন করেন : ‘হিন্দুস্থান মিউজিক্যাল প্রডাক্টস্ এন্ড ভ্যারাইটিজ্ সিন্ডিকেট্ বাংলাদেশে গ্রামোফোন্ রেকর্ড প্রস্তুত বিষয়ে বাঙ্গালীর মধ্যে অগ্রণী; আমি সর্ব্বান্তঃকরণে এই প্রতিষ্ঠানের মঙ্গল কামনা করি।’ গ্রামোফোন রেকর্ড তৈরির ক্ষেত্রে ‘হিন্দুস্থান’ যে ‘বাঙ্গালীর মধ্যে অগ্রণী’ – এই স্বীকৃতির মূল্য কম নয়।
সতেরো
বাঙালির সংগীত-সংস্কৃতি বিকাশের ক্ষেত্রে গ্রামোফোন বা কলের গানের ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ – আর যেসব স্বদেশি রেকর্ড কোম্পানি ধারণ করেছে বিচিত্র সুরেলা কণ্ঠের গান – আয়োজনে-নৈপুণ্যে-আবেদনে এদের মধ্যে চার-পুরুষের পরম্পরায় ঋদ্ধ ‘হিন্দুস্থান মিউজিক্যাল প্রোডাক্টস্ অ্যান্ড ভ্যারাইটিজ সিন্ডিকেট’কে আলাদা মূল্য ও মর্যাদা দিতে হয় – শ্রেষ্ঠত্বের শিরোপা, সেও বোধহয় রাখাল বালকের বাঁশি-বাজানোর রেকর্ড-লেবেলের প্রতিষ্ঠানেরই প্রাপ্য। সেই ভাষ্যই পঁচিশ বাঙালি সংগীতপ্রেমীর মন্তব্যে-অভিমতে রচিত হয়েছে।
তথ্যসূত্র
ব্যক্তিঋণ
১. শোভনলাল সাহা : ম্যানেজিং ডিরেক্টর, ইনরেকো এবং হিন্দুস্থান মিউজিক্যাল প্রোডাক্টস্ অ্যান্ড ভ্যারাইটিজ সিন্ডিকেট, কলকাতা।
২. দেবযানী চলিহা :
প্রতিষ্ঠাতা-সভাপতি, মৈতৈ জগোই, উদয়শঙ্কর সরণি, কলকাতা। মণিপুরি নৃত্যের বিশিষ্ট শিল্পী ও বিশ^বিদ্যালয়ের প্রাক্তন অধ্যাপক।
গ্রন্থঋণ
১. সন্তোষকুমার দে : কবিকণ্ঠ ও কলের গান। বিশ্বভারতী, ১৩৯৯।
২. আব্বাসউদ্দীন আহমদ : আমার শিল্পী জীবনের কথা। ঢাকা, ১৯৬০।
৩. পঙ্কজকুমার মল্লিক : আমার যুগ আমার গান। কলকাতা, ১৯৮০।
৪. যূথিকা রায় : আজও মনে পড়ে। কলকাতা, ১৪০৯।
৫. সিতাংশুশেখর ঘোষ : বিমানে বিমানে আলোকের গানে। কলকাতা, ২০০৩।
৬. আবদুশ শাকুর : সংগীত সংগীত। ঢাকা, ১৪১১।
৭. আবুল আহসান চৌধুরী : বাঙালির কলের গান। ঢাকা, ২০১২।
৮. Michael Kinnear : The Gramophone Company’s First Indian Recordings 1899-1908. Delhi, 1994.
৯. আজকাল (দৈনিক, কলকাতা) : ১১ই সেপ্টেম্বর ২০১১ ও ৩০শে অক্টোবর ২০১১।
১০. কালি ও কলম (মাসিক, ঢাকা) : ফাল্গুন ১৪১৬।
১১. হিন্দুস্থান রেকর্ড কোম্পানির ক্যাটালগ এবং অন্যান্য অপ্রকাশিত কাগজপত্র।
১২. বিভিন্ন গ্রামোফোন রেকর্ড কোম্পানির পুস্তিকা, ক্যাটালগ ও কাগজপত্র।
১৩. সাক্ষাৎকার : শোভনলাল সাহা (হিন্দুস্থান রেকর্ড কোম্পানি, কলকাতা : ১৫ই নভেম্বর ২০১৮)।
Leave a Reply
You must be logged in to post a comment.