বিভূতিভূষণ : অন্তর্জগৎ, বহির্জগৎ

বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় গ্রন্থটি সম্প্রতি পড়েছি আমি। সুব্রত বড়ুয়ার লেখা বইটি বিভূতিভূষণের পূর্ণাঙ্গ জীবনী, শৈশব থেকে মৃত্যু পর্যন্ত জীবনপরিধির সরস আলেখ্য। পথের পাঁচালী উপন্যাসের রচয়িতা বিভূতিভূষণ – এটি তাঁর প্রথম ও সর্বশ্রেষ্ঠ উপন্যাসও বটে। উপন্যাসটি তাঁকে পাঠকহৃদয়ে চিরস্থায়ী আসনে অধিষ্ঠিত করেছে। বাংলা সাহিত্যে পথের পাঁচালীর কোনো তুলনা নেই। এক অভূতপূর্ব, সুরভিত জীবনকাব্য নিয়ে সাহিত্যে এলেন বিভূতিভূষণ, চিরকালের জন্য আমাদের আবিষ্ট করে রেখে গেলেন।

বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় মহান কথাসাহিত্যিক, মহৎ রসস্রষ্টা। প্রথম উপন্যাস পথের পাঁচালী প্রকাশিত হতে না হতেই তিনি বিপুল পাঠকপ্রিয়তা অর্জন করেন। পরবর্তীকালেও তাঁর রচনার মনোমুগ্ধতা কমেনি, বরং বেড়েছে। কিন্তু তাঁর জনপ্রিয়তা কল্পনাবিলাসী পাঠকের সস্তা জনপ্রিয়তা নয়, মননশীল ও রসগ্রাহী পাঠকচিত্তে তাঁর অবস্থান চিরস্থায়ী। তাঁর শ্রেষ্ঠত্ব, তাঁর মহত্ত্ব, তাঁর শিল্পসার্থকতা আজ অবিসংবাদিত। বাংলা কথাসাহিত্যে বিভূতিভূষণের স্থান সেই বিরল স্বল্পসংখ্যক অভিজাতদের সারিতে, যাঁরা সর্বতোভাবে আজ নমস্য, সর্বতোভাবে সমাদৃত। কিন্তু এত সমাদর, এত স্বীকৃতি সত্ত্বেও ব্যক্তি বিভূতিভূষণ থেকে গেছেন অন্তরালে, তাঁর ব্যক্তিজীবনের ওপর আলোকপাত হয়েছে কম, অনেক দেরিতে। বিভূতিভূষণ মারা গেছেন ১৯৫০ সালে, কিন্তু তাঁর জীবনীসংগ্রহে পশ্চিমবাংলা বাংলা একাডেমিও মনোনিবেশ করেছে মাত্র সেদিন, গত শতাব্দীর শেষদিকে। রুশতী সেনকে নিযুক্ত করে জীবনী রচনার সে-উদ্যোগ অভিনন্দনযোগ্য হলেও তা বিলম্বিত, অনভিপ্রেত। ব্যক্তিগত উদ্যোগে লেখা সুনীলকুমার চট্টোপাধ্যায়ের জীবনী কিংবা কিশলয় ঠাকুরের পথের কবিও প্রায় সমসাময়িক, একটু আগে লিখিত। পশ্চিমবঙ্গে তবু বিভূতিচর্চায় গতি এসেছে, বাংলাদেশের অবস্থা আরো শোচনীয়। এদেশে বিভূতিভূষণের জীবন বা তাঁর সাহিত্যের আলোচনা প্রায় দুর্লক্ষ্য, পীড়াদায়ক। অথচ বিভূতিভূষণ এমন একজন উচ্চাঙ্গের শিল্পী, এমন অপূর্ব রসনির্মাতা, যার মূল্যায়ন শুধু প্রয়োজনীয় নয়, অপরিহার্যও। বিভূতিভূষণের গল্প-উপন্যাসের শিল্পসম্মত বিচার-বিশ্লেষণে শুধু তাঁর সাহিত্যের রসোপলব্ধি স্বচ্ছ ও বিস্তৃত হবে না, আমাদের সাহিত্যিক কূপমণ্ডূকতাও দূর হবে, সমুন্নত হবে শিল্পদৃষ্টি।

বাংলাদেশে বিভূতিচর্চার দুরবস্থার কথা মনে রাখলে সুব্রত বড়ুয়ার বিভূতিজীবনী একটি দিকনির্দেশক পদক্ষেপ, শুভ প্রচেষ্টা। কিন্তু শুধু জীবনী লেখার জন্যই তিনি জীবনী রচনা করেননি। এ-প্রচেষ্টায় লেখক যথেষ্ট শ্রম ও অভিনিবেশের পরিচয় দিয়েছেন, আমাদের জীবনভাবনাকে করেছেন প্রসারিত।

বিভূতিভূষণের পৈতৃক নিবাস অবিভক্ত বাংলার বারাকপুর গ্রাম (বর্তমানে চব্বিশ পরগনা জেলা)। তাঁর জন্ম নানাবাড়ি মুরাতিপুর গ্রামে। পিতার নাম মহানন্দ বন্দ্যোপাধ্যায়, মাতা মৃণালিনী দেবী। মহানন্দর দুই পক্ষ – প্রথম স্ত্রীর নাম হেমাঙ্গিনী। হেমাঙ্গিনীর কোনো সন্তান না হওয়ায় তাঁর আগ্রহ ও অনুরোধে মহানন্দ মৃণালিনী দেবীকে বিবাহ করেন। বিভূতিভূষণ এই মায়ের প্রথম সন্তান। বিভূতিভূষণের আরো পারিবারিক ইতিহাস আছে। বারাকপুর নয়, তাঁদের পূর্বপুরুষদের আদিনিবাস বসিরহাট মহকুমার পানিতর গ্রাম। তাঁর পিতামহ তারিণীচরণ পেশায় ছিলেন কবিরাজ, কবিরাজিতে পসারের আশায় তিনি বারাকপুরে স্থানান্তরিত হন। তারিণীচরণ অকালে স্ত্রীকে হারান, একাধিক সন্তানও অকালে মৃত্যুর কবলে পড়ে। মহানন্দই তাঁর একমাত্র জীবিত সন্তান, বংশের প্রদীপ। মহানন্দ হয়ে উঠলেন বাউন্ডুলে, উদাস ও আত্মভোলা প্রকৃতির মানুষ। মহানন্দর দরাজ গলা, গান গেয়ে বেড়ান ও কথকতা তথা আধ্যাত্মিক সংগীতকে বৃত্তি হিসেবে গ্রহণে প্রয়াসী হন। চিন্তিত পিতা ছেলের ভবিষ্যৎ ভেবে শঙ্কিত হন, বুদ্ধি করে ছেলেকে শিক্ষিত করার চেষ্টা করেন। কিন্তু সেখানেও বিপত্তি, মহানন্দ ম্যাট্রিক পাশ করতে পারলেন না, শিক্ষার পাট চুকালেন। পিতা তারিণীচরণ দিশা খুঁজে পান না। শেষমেশ কি আর করবেন, সংসারে বাঁধতে পুত্রের বিবাহ দিলেন।

মহানন্দর কোনো পরিবর্তন নেই, তিনি আছেন আগের স্বভাবে। তাঁর জ্যেষ্ঠপুত্র বিভূতিভূষণ অবশ্য পিতার বৃত্ততে থাকলেন না, শিক্ষার দিকে এগোলেন। মেধাবী ছাত্র ছিলেন বিভূতিভূষণ – বনগাঁ হাইস্কুলে থেকে প্রথম শ্রেণিতে ম্যাট্রিক ও রিপন কলেজ থেকে প্রথম শ্রেণিতে ইন্টারমিডিয়েট পাশ করলেন। পিতার অকালমৃত্যু, চরম দারিদ্র্য, এসবের মধ্যে আত্মীয়-অনাত্মীয় অনেকের সাহায্যে এতদূর এলেন। পথ মোটেই মসৃণ নয়। বনগাঁ হাইস্কুলের প্রধান শিক্ষক চারুচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়ের সাহায্য পেয়েছিলেন, ছোট মামা বসন্তও সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিলেন। একসময় উদারচেতা আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায়েরও আর্থিক সহানুভূতি জুটলো। স্মরণীয়, ম্যাট্রিক পরীক্ষার ফিস জোগাড় করতে মায়ের রুপার বিছা বিক্রি করতে হয়েছিল তাঁকে।

রিপন কলেজেই বি.এ-তে ভর্তি হলেন। কিন্তু আর যেন চলতে চায় না – অর্থের অনটন গুরুতর – কি করে চলবে লেখাপড়া? বইটিতে বিভূতিভূষণের এই অসহনীয় অর্থকষ্টের বিবরণ উঠে এসেছে। সঙ্গে অভিন্ন কারণে বিবাহের প্রসঙ্গও। অর্থকষ্টে নাকাল, অনন্যোপায় বিভূতিভূষণ এসময় শ্বশুরের অর্থে শিক্ষা চালিয়ে যেতে বিবাহ করতে বাধ্য হন। বিবাহ হয় পূর্বপুরুষদের গ্রাম পানিতরে, কালিকান্ত তথা কালিভূষণ মোক্তারের কন্যা গৌরীদেবীর সঙ্গে। বাধ্য হয়ে বিবাহ করলেও এ-বিবাহ বিভূতিভূষণের জীবনে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা হিসেবে চিহ্নিত হয়ে আছে। চোদ্দ বছরের সুন্দরী এই কিশোরী স্ত্রী স্বামীর প্রতি ছিলেন সীমাহীন অনুরক্ত। যুবক বিভূতিভূষণও তাঁকে প্রাণ দিয়ে ভালোবেসেছিলেন, আপন করে নিয়েছিলেন। কিন্তু সে-সুখ স্থায়ী হয়নি। বিবাহের মাত্র এক বছর তিন মাস পর গৌরী পিতৃগৃহে কলেরায় মৃত্যুবরণ করেন। গৌরী চলে গেলেন বটে, কিন্তু এর প্রভাব বিভূতিভূষণের জীবনে হলো স্থায়ী, সুদূরপ্রসারী। গৌরীর মৃত্যু বিভূতিভূষণকে দারুণ উন্মনা করেছিল, উদ্ভ্রান্ত করেছিল। বলতে গেলে তাঁর জীবনটাই এলোমেলো হয়ে গিয়েছিল। প্রেমময়ী এই স্ত্রীকে, প্রথম যৌবনের এই নিকটতম প্রেয়সীকে তিনি কখনো ভুলতে পারেননি। গৌরীর মৃত্যুতে তাঁর জীবনে এমন ধস নামে, মন এমন করে ভেঙে যায়, প্রায় তেইশ বছর তিনি আর বিবাহ করতে পারেননি। জীবিত থাকতে যেমন, মৃত্যুর পরও গৌরী ছিলেন তাঁর একান্ত সহচর, পাশে পাশে। এই আঘাত, এই বিয়োগব্যথা তাঁকে জর্জরিত করেছিল সত্য, কিন্তু পরে শক্তিতে রূপান্তরিত হয়ে সৃজনশীল লেখক করেছিল, তাও মিথ্যা নয়। বাংলা উপন্যাসে একদিন যে তিনি শ্রেষ্ঠত্বের গৌরবে অভিষিক্ত হয়েছিলেন, সন্দেহ নেই, তার মূলে ওই অকালপ্রয়াত গৌরী।

দরিদ্রের সন্তান বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের জীবন আগাগোড়া বন্ধুর, সমস্যাসংকুল। বিভূতিভূষণ ডিস্টিংশনসহ বি.এ. পাশ করে হাইস্কুলে শিক্ষকতার চাকরি নেন। মাসিক মাত্র পঞ্চাশ টাকা বেতনে প্রথমে জাঙ্গিপুর দ্বারকানাথ হাইস্কুলে ও পরে হরিনাভি অ্যাংলো স্যান্‌সক্রিট ইনস্টিটিউটে। প্রথম স্কুলে এক বছর তিন মাস ও পরের স্কুলে দুই বছরের মতো চাকরি করেন। হরিনাভির স্কুলটি আবার বিশেষভাবে উল্লিখিত হওয়ার দাবি রাখে – এখান থেকেই এক ছাত্রের প্ররোচনায় ও অপপ্রচারে ‘উপেক্ষিতা’ নামক একটি গল্প তিনি লিখতে বাধ্য হন। সেটি প্রবাসীতে পরে প্রকাশিত হয়। ‘উপেক্ষিতা’ তাঁর প্রথম গল্প, সাহিত্যচর্চার সূত্রপাতও বলতে গেলে। এরপর স্বল্প বেকারত্বের পর মাড়োয়ারি কেশোরাম পোদ্দারের গোরক্ষিণী সভার চাকরি, বেতন সেই পঞ্চাশ টাকা। চাকরিটা অদ্ভুত, গোহত্যার বিরুদ্ধে ঘুরে ঘুরে প্রচার চালানো। বিভিন্ন স্থানে যাওয়ার সুবাদে এ-সময় তাঁর দেশভ্রমণের নেশাটা সার্থক হয়েছিল। সভার খরচে কুষ্টিয়া থেকে রাজবাড়ী, বরিশাল, চাটগাঁ, সীতাকুণ্ড, আগরতলা, বার্মার বিভিন্ন স্থান, সব দেখা হয়ে গেল। সঙ্গে বিচিত্র নিসর্গপ্রকৃতি – অরণ্য, নদী, পাহাড়-পর্বত, ঝর্ণা, সবুজ গাছপালা, বর্ণগন্ধময় নানা পুষ্পরাজি তাঁকে মুগ্ধতায় ভরিয়ে দিলো। চন্দ্রনাথ পাহাড়ে এসে বিভূতিভূষণের ভাষ্য, ‘প্রতিদিন বেলা পড়তে আমি চন্দ্রনাথ পাহাড়ের তলায় একটি ঝর্ণার ধারে বেড়াতে যেতুম। সন্ধ্যাবেলায় স্থানটা এক অপরূপ শ্রী ধারণ করত। গাছপালার শ্যামলতা, বনকুসুমের শোভা, সম্মুখের শৈলশ্রেণীর গম্ভীর উন্নত সৌন্দর্য, বনের পাখির ডাক, ঝরণার কুলকুল শব্দ – আর সকলের উপরে স্থানটির নিবিড় নির্জনতা আমাকে প্রতিদিন সন্ধ্যায় টেনে নিয়ে যেতো সেখানটিতে।’

প্রকৃতিপ্রেমিক বিভূতিভূষণের পথের পাঁচালী ও অপরাজিত রচনায় এসব সৌন্দর্য খুব কাজে লেগেছিল। কিন্তু এরচেয়েও বড় লাভ – নানা স্থানে নানা দেশে ঘুরে ঘুরে বিচিত্র সব মানুষের সংস্পর্শলাভ। কথাসাহিত্যিক বিভূতিভূষণের মানবচরিত্রনির্মাণে – মানুষের অন্তর্লোক উন্মোচনে ও বৈচিত্র্য পরিস্ফুটনে এ-ভ্রমণ সহায়ক হয়েছিল।

সুব্রত বড়ুয়া বিভূতিভূষণকে তুলে ধরতে পূর্বসূরি জীবনীকারদের সাহায্য নিয়েছেন এবং সেটা অস্বাভাবিক নয়। কিন্তু বিভূতিভূষণকে রক্তমাংসের জীবন্ত মানুষরূপে অঙ্কন করতে তিনি স্বাতন্ত্র্য দেখিয়েছেন, মুনশিয়ানার পরিচয় দিয়েছেন। সাদামাটা, অকপট মানুষ ছিলেন বিভূতিভূষণ। তাঁর নির্দোষ সারল্য ও বিনয়, চরিত্রের মাধুর্য তাঁকে সবার কাছে গ্রহণযোগ্য করেছিল। তাঁর বন্ধুভাগ্য ঈর্ষণীয়, শুভাকাক্সক্ষী কম ছিল না। সুবিখ্যাত নীরদ সি. চৌধুরী শুধু সহপাঠী ছিলেন না, ছিলেন তাঁর নিকটজনও। পথের পাঁচালীর প্রথম পাণ্ডুলিপি পাঠ করে সমঝদার নীরদ চৌধুরী মুগ্ধ হন, এর অপরূপ সৌন্দর্য ও জীবনসঙ্গীতে অভিভূত হন। একবাক্যে প্রশংসা তো করেনই, পথের পাঁচালী প্রকাশেরও তাগিদ দেন, গ্রন্থাকারে প্রকাশে সক্রিয় সাহায্য করেন। চৌধুরীর নিজের বক্তব্য শুনি, ‘১৯২৪-এ প্রথম কয়েক পৃষ্ঠা লিখিয়াই তিনি আমাকে পড়িয়া শুনাইয়াছিলেন। আমি এত আত্মবিশ্বাসী ছিলাম যে তিনবৎসর কাল তাহাকে তাড়া দিয়া চলি। ১৯২৮-এ উহা ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হইবার পর আমি এক প্রকাশককে খুঁজিয়া পাই যিনি উহা গ্রন্থকারে ছাপিতে সম্মত হন।’

নীরদ চৌধুরী বিলেত বাসকালে যে-প্রসিদ্ধ আত্মজীবনীমূলক গ্রন্থ অটোবায়োগ্রাফি অফ অ্যান আননোন ইন্ডিয়ান ও দ্যাই হ্যান্ড, গ্রেট অ্যানার্ক রচনা করেন, তাতেও বিভূতিভূষণকে নানাভাবে মেলে ধরে স্মরণীয় করে রেখেছেন। বিভূতিভূষণের সারল্য, অকপটতা নীরদ চৌধুরীর স্ত্রী অমিয়া চৌধুরানীর মনও জয় করেছিল। তিনি তাঁর লেখায় বিভূতিভূষণকে খুব সমীহ করে স্মরণে এনেছেন, ফুটিয়ে তুলেছেন।

জীবিকার প্রসঙ্গে আবার ফেরা যাক। গোরক্ষিণী সভার স্বল্পকালীন চাকরি শেষ হলে বিভূতিভূষণ পাথুরেঘাটার জমিদার খেলাতচন্দ্র ঘোষ এস্টেটে সিদ্ধেশ্বরী ঘোষের অধীনে কাজ পেলেন। প্রথমে তাঁর পিতৃমাতৃহীন ভাগ্নে বালক বিভূতিকে পড়ানোর কাজ, পরে তাঁর সেক্রেটারির দায়িত্ব। সততা ও বিশ্বস্ততা ছিল বিভূতি চরিত্রের অন্যতম অলংকার। ফলে বছরখানেকের মধ্যে আস্থাভাজন হয়ে ওঠেন – তাঁকে পাঠানো হয় খেলাতচন্দ্র ঘোষ এস্টেটের ভাগলপুর জঙ্গল মহলের অ্যাসিট্যান্ট ম্যানেজার করে। এই চাকরিটি বিভূতিভূষণের জীবনে যেমন, আমাদের কাছেও তেমনি তাৎপর্যপূর্ণ। বলতে গেলে, এখান থেকেই বিভূতিভূষণের সুপ্ত শিল্পীসত্তা দৃপ্ত সমারোহে আত্মপ্রকাশ করে। বিভূতিভূষণের সর্বশ্রেষ্ঠ উপন্যাস, বাংলা সাহিত্যের অন্যতম সেরা মাস্টারপিস পথের পাঁচালী এখান থেকে প্রথম লেখা শুরু হয়। তাঁর আর এক অসাধারণ উপন্যাস আরণ্যক-এর মালমশলা সংগৃহীত হয় জঙ্গলমহলের এই অদ্ভুত অরণ্যপ্রকৃতি ও বিচিত্র জীবনধারা থেকে।

প্রকৃতিকে চিরকাল ভালোবাসেন বিভূতিভূষণ, এবার সেই প্রকৃতির সমুদ্রে এসে পড়লেন। উত্তরে আজমাবাদ থেকে দক্ষিণে কিষাণপুর, পূর্বে ফুলকিয়া, লবটুলিয়া, নাড়াবইহার আর পশ্চিমে মুঙ্গের জেলার সীমান্ত পর্যন্ত কি বিরাট বিশাল অরণ্য!
এ-প্রকৃতি বারাকপুর-নিশ্চিন্দিপুরের সীমাবদ্ধ প্রকৃতি নয়, অবারিত, উন্মুক্ত তার বিস্তার, অসীম তার পরিসীমা। আত্মহারা বিভূতিভূষণ ধরে রাখতে পারেন না নিজেকে – এ যে কেবল কবিত্ব আনে মনে, মৌন ভাবুকতায় আত্মমগ্ন করে দেয়। ‘বনগ্রামের বারাকপুরের ছোট ছোট বনঝোপে তার কৈশোর লালিত, তাঁর উদ্ভিন্ন যৌবনকে উদ্দীপিত করে তুলেছে এই উদ্দাম অরণ্য : উদার প্রান্তর, উদ্ধত পর্বতমালা। মরুম ছড়ানো রাঙামাটির উপর দিয়ে তাঁর ঘোড়া ছোটে। কখনও কলবলিয়া বা কোশিনদীর তীরে তীরে, কলাই খেত, খেরিখামারের আর হলুদরঙের বন্যা – ঢালা রাইচি জমির আল বেয়ে চলা। মাঝে মাঝে ঢালু দূর্বাঘাসের মাঠ, ফুলে ফুলে ভরা কাশবন, উলুখড় ধুতরার ঝাড়, জরদারঙের সন্ধ্যামণি ফুলমেলার মধ্য দিয়ে অপূর্ব রূপের ভুবনে মনটা যেন ছড়িয়ে ছড়িয়ে যায়।’

বিভূতিভূষণের অন্তর্সত্তা সুব্রত বড়ুয়ার লেখায় চমৎকারভাবে উন্মোচিত হয়েছে। ফুলকিয়া লবটুলিয়ার জঙ্গলমহলে এসে, জনারণ্যে এসে লোকালয়ের বিভূতিভূষণের আশ্চর্য ভাবান্তর হয়েছে। নির্জন, নিস্তব্ধ অরণ্যে খড়ের ছাউনির মাটির ঘরে থাকেন, ঘোড়ায় চড়ে বিরাট এলাকায় ঘুরেফিরে বেড়ান, মহলের তদারকি করেন। দিগন্তবিস্তৃত সবুজের মেলায় পাখির অন্তহীন কাকলি, কূলপ্লাবী জোছনার হাসিতে রাতের মায়াভরা মধুর মৌনতা – মন কেমন হয়ে যায়, কিরকম আকুলিবিকুলি করে। এ পরিবেষ্টনী তো মানুষকে কবি করে, সৃষ্টিশীল হতে প্রেরণা দেয়। বিভূতিভূষণও এগোলেন সে-পথে, মন দিলেন সৃষ্টিতে – লেখায়। গৌরীকে অকালে হারিয়ে এসেছেন, যৌবনের স্বপ্ন লণ্ডভণ্ড হয়ে গেছে – এখন তিনি রক্তাক্ত, ক্ষতবিক্ষত। তারপর স্নেহময়ী মায়ের অকালবিদায় – আরো শূন্যতা, আরো একাকিত্ব। মনের এতসব ভার বয়ে এই অরণ্যে এসে মনের দুঃখ-দুর্দশা জয়ের অবলম্বন হলো কল্পনা, কল্পনাশ্রয়ী সৃষ্টি। বিচ্ছিন্ন এমন নীরব, নির্জন পরিবেশে পথের পাঁচালী ডানা মেললো ধীরে ধীরে, পরিবেশ তাঁকে করলো আশীর্বাদ। কিন্তু সৃষ্টির পথ তো সরল নয়। পথের পাঁচালী নিয়ে চললো নানা
পরীক্ষা-নিরীক্ষা। প্রথমে বিভূতিভূষণ যে পথের পাঁচালী রচনায় মনোনিবেশ করলেন, তা ছিল দুর্গাবিহীন। এ-সময় একটা ঘটনা ঘটলো। জঙ্গলমহলের নিকটস্থ ভাগলপুর শহরে গিয়ে এক উসকোখুসকো চুলের উদাসমুখ বালিকা তাঁর চোখে পড়লো। আন্দোলিত হলেন বিভূতিভূষণ, এ-বিচিত্র বালিকা তো অপুর সঙ্গে উপন্যাসে জায়গা পেতে পারে।

আর কালবিলম্ব নয়, আগের পাণ্ডুলিপি রেখে নতুন করে লিখে চললেন পথের পাঁচালী। দুর্গা স্থান তো পেলই, অপুর বড় বোন হয়ে নতুন জীবনের আহ্বান এনে অবিস্মরণীয় হয়ে রইলো চিরকালের জন্য। সেই দুর্গা, নিশ্চিন্দপুরের প্রকৃতির কোলে যে এক বিস্ময় – যে-বালিকার জীবনের পরতে পরতে জাদু, ভাঁজে ভাঁজে অভিনবত্ব, পদে পদে রহস্যের ঝিলিক। সেই সাধারণ, সামান্য দুর্গা, ম্যালেরিয়ায় ভুগে যে অকালমৃত্যুর কোলে ঢলে পড়লো, চিরবিদায় নিল – কাঁদিয়ে ভাসিয়ে গেল আমাদের, একান্ত কোনো আপনজনের মতো। হতভাগা, অসহায়, দরিদ্র কিশোরী দুর্গা আমাদের অশ্রুতে, আমাদের ভালোবাসায় চিরদিনের মতো অমর হয়ে রইলো।

তিন বছরের একটানা, অক্লান্ত পরিশ্রমের ফসল পথের পাঁচালী বিভূতিভূষণের যুগান্তকারী সৃষ্টি। প্রথমে বিচিত্রায় ধারাবাহিকভাবে বেরুনোর পর বই আকারে প্রকাশিত হলো। সালটা ১৯২৫। আর বেরুল কি, সাড়া পড়ে গেল, বাঙালি পাঠকমহলে অভিনন্দনের ঝড় বয়ে গেল। গোপাল হালদার ঠিকই বলেছেন, ‘কোন বাঙালী লেখক সাহিত্যেক্ষেত্রে প্রবেশের সঙ্গে সঙ্গে এমন শুভকামনা ও অকুণ্ঠ প্রশংসালাভ করেছিলেন কিনা সন্দেহ।’

সেই যে সুধীমহল বরণ করে নিলেন, হৃদয়ে স্থান দিলেন, তা আর ক্ষুণ্ন হলো না। যত দিন গেল, পথের পাঁচালীর মর্যাদা তত বাড়লো, তত স্থায়িত্ব বেড়ে হয়ে উঠলো অনন্যসাধারণ, ক্ল্যাসিক, চিরকালীন।

বইটিতে জঙ্গলমহলের ইসমাইলপুরের কাছারি ও পাশের শহর ভাগলপুরের বিবরণ আছে। ভাগলপুরে বিভূতিভূষণ মূল্যবান অভিজ্ঞতা লাভ করেন। এখানে এ-সময় নবাগত বিভূতিভূষণ এক সমৃদ্ধ সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলের সান্নিধ্যে আসেন।
সে-পরিমণ্ডলে, বিশেষ করে বিশিষ্ট ব্যক্তিত্ব, বিচিত্রা সম্পাদক উপেন্দ্রনাথ গঙ্গোপাধ্যায়ের সঙ্গে তাঁর পরিচয় বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। এই পরিচয়ের সূত্রেই অচেনা, অখ্যাত লেখক বিভূতিভূষণ তাঁর পথের পাঁচালী উপন্যাসটির বিচিত্রায় ধারাবাহিকভাবে প্রকাশের সুযোগ পান।

বিভূতিভূষণের জীবনে পুনরায় জীবিকার পরিবর্তন। ছয় বছরের জঙ্গলমহলের ম্যানেজারি ছেড়ে চলে এলেন কলকাতায়। কিন্তু নিষ্ঠাবান, নিরীহ এই ভালো মানুষটিকে তারা ছাড়লেন না। সিদ্ধেশ্বর ঘোষদের নতুন খোলা স্কুল খেতাবচন্দ্র ক্যালকাটা ইনস্টিটিউশনেই শিক্ষকতায় নিযুক্তি পেলেন, সততা ও সহৃদয়তার স্বীকৃতি মিললো। কলকাতায় স্থিত হয়েই নতুন উপন্যাসের পরিকল্পনা করলেন। নাম আলোক সারথি, যাকে পথের পাঁচালীর শেষখণ্ডও বলা যায়। উপন্যাসটি শুরুর কথা বিভূতিভূষণ তৃণাঙ্কর-এ নিজেই বলেছেন, ‘ভারী ঘটনাবহুল দিনটি। ভোরে উঠে প্রথমে গেলুম হেঁটে ইডেন গার্ডেনে। শিশিরসিক্ত ঘাসের ধারে ধারে বেড়াতে বেড়াতে খালের জলের রক্তমৃণালগুলো দেখছিলুম। দুটি রাঙা ফ্রকপরা ফিরিঙ্গি বালিকা ফুল তুলে বেড়াচ্ছিল। কেয়াঝোপে খানিকটা বসে বসে ‘আলোক সারথি’র ছক কাটলুম।’

অবশ্য পরে নামটি ‘আলোক সারথি’ থাকেনি, হয়ে গেছে অপরাজিত। পথের পাঁচালীর আখ্যান ধারাবাহিকভাবে অগ্রসর হয়ে অপরাজিত উপন্যাসে এক চূড়ান্ত পরিণতি লাভ করেছে। অপরাজিত দীর্ঘ উপন্যাস, ঘটনাবহুল বহু চরিত্র ও বিষয়ের সমাবেশে এক মহাকাব্যিক ঐশ্বর্য লাভ করেছে। শিল্পের বিচারে অপরাজিত অনুপম, অসাধারণ – বিভূতিপ্রতিভার অলোকসামান্য স্পর্শে উদ্ভাসিত, জীবনবীক্ষায় চিরন্তনতার রূপ পরিগ্রহ করেছে। পথের পাঁচালীর শিল্পসংযম এখানে আরো দৃঢ, সংহত হয়েছে, মুগ্ধতায় পাঠককে অভিভূত করেছে। উভয় উপন্যাস প্রকাশের পর, ততদিনে, সুব্রত বড়ুয়ার ভাষায়, ‘লেখককে নিয়ে টানাটানি, অভিনন্দন, সভাসমিতিতে সংবর্ধনা, আলোচনা সমালোচনা, পত্রপত্রিকায় লেখালেখির ঝড়।’ রবীন্দ্রোত্তর যুগের কথাসাহিত্যে তখন তিনি স্বীকৃত প্রতিভা, প্রতিষ্ঠিত কথাসাহিত্যিক। শরৎচন্দ্রের পর তাঁর পাশে আর মাত্র দুজন ঔপন্যাসিক আসীন হওয়ার যোগ্য – মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় ও তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়।

বিভূতিভূষণের কীর্তি নিয়ে বিতর্কের অবকাশ নেই। বিভূতিভূষণ বড় লেখক, মহৎ জীবনশিল্পী। তাঁর ভাষা প্রাঞ্জল, সুললিত, কবিত্বমণ্ডিত – সবমিলে হৃদয়গ্রাহী। বিভূতিভূষণের উপন্যাসপাঠ এক বিরল ও সুখকর অভিজ্ঞতা। তিনি কোনো নিরীক্ষায় অবতীর্ণ হননি, তবু তিনি স্বতঃস্ফূর্ততায় অনন্য, অসামান্য। বিভূতিভূষণ প্রকৃতিকে ভালোবাসতেন, জীবন ও প্রকৃতি তাঁর উপন্যাসে একাকার, একসূত্রে গাঁথা। তাঁর প্রকৃতি-বর্ণনা এমনই মনোগ্রাহী, নিবিড় ও মনোরম, বারবার আস্বাদন করেও তার আবেদন ফুরায় না। শ্রেষ্ঠ উপন্যাস পথের পাঁচালী এর উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। এর প্রকৃতিও এত জীবন্ত, সরস ও প্রাণময় – দুর্গা-অপু যেন সে-প্রকৃতিরই সন্তান, তার আশ্রয়ে, তার ভালোবাসায়ই তাদের বেড়ে ওঠা।

প্রকৃতি ছিল বিভূতিভূষণের অন্তর্গত সত্তার নিত্যসহচর। এই নিসর্গ প্রকৃতিকে আশ্রয় করে বিভূতিভূষণ লিখলেন সর্বশেষ কীর্তি – আরণ্যক। ফুলকিয়া-মহলিখা রূপের সে-প্রকৃতিও নিশ্চিন্দিপুরের অনুভবযোগ্য প্রকৃতি থেকে আলাদা, সেখানকার জীবনও। বিভূতিভূষণের উপলব্ধি, ‘এখানকার আদিম অরণ্য – পর্বতের সঙ্গে মানুষগুলিও অভিন্ন। যীশুখ্রীষ্ট যেদিন ক্রুশে বিদ্ধ হয়েছিলেন, সেদিনও এখানকার লোকগুলি মহুয়া বীজ ভেঙে তেল বের করত, আজও তাই করছে। কত সরল, এরা কত গরীব অথচ কী আনন্দময় উচ্ছলিত জীবনধারা।’

আরণ্যক প্রচলিত ধাঁচের উপন্যাস নয়, সম্পূর্ণ নতুন ধরনের এক উপাখ্যান। যেমন এর বিচিত্র প্রকৃতি তেমনি বিচিত্র সব মানুষ। এমনসব অদ্ভুত, অচেনা, খাপছাড়া তাদের বৈশিষ্ট্য, বাংলা সাহিত্যে এমন চরিত্র আমরা আর দেখিনি। কিন্তু মানুষগুলো মোটেও আকাশচারী, অবাস্তব, উদ্ভট নয়। মাটির সঙ্গেই তাদের সংলগ্নতা, মাটির গন্ধেই তারা পরিপুষ্ট – সেই পরিবেশের প্রসাদে তারা সজীবতা পেয়েছে। চরিত্রও কম নয় – রাজু পাঁড়ে, বালক ধাতুরিয়া, ধাওতাল, সাহু, মটুকনাথ পাঁড়ে, যুগলপ্রসাদ, কবি বেঙ্কটেশ্বর প্রসাদ, মুসম্মত কুণ্ডী, মঞ্চী, রাজা দোবরু পান্না, রাজকুমারী ভানুমতি, রাসবিহারী সিং, নন্দলাল ওঝা – সবাই বিচিত্র, কাকে ছেড়ে কার কথা বলবো। তার মধ্যে যুগলপ্রসাদ যেন সবচেয়ে বিচিত্র, যে সৌন্দর্যসাধক যুগলপ্রসাদ বনের সৌন্দর্য বাড়াতে অন্য বন ও শহরের সায়েবদের বাগান থেকে বিভিন্ন ফুলের বীজ, গোঁড় এনে এ-বনে লাগায়। নিজের খেয়ে বনের মোষ তাড়ানো আর কি। কোনো লাভ নেই, স্বার্থ নেই, বিনিময়ে কিছু চাওয়ার নেই – শুধু নতুন নতুন ফুল জন্মিয়ে বনের শোভা বাড়াতেই সে আত্মতুষ্ট। যুগলপ্রসাদ আসলে জাত বোহেমিয়ান, কবি, সৃষ্টিশীল শিল্পী – সৃষ্টিতে তার আনন্দ, ভাবেই তার তৃপ্তি। বিভূতিভূষণ মিথ্যা বলেননি, স্থূল বিষয় সে ভালোবাসে না, ‘ও আর এক ধরনের ব্রাত্য মন লইয়া পৃথিবীতে আসিয়াছে – জমিজমা গরুমহিষের আলোচনা করিতে ভালবাসে না, তাহাতে যোগ দেয় না।’

মোটের উপর আরণ্যক ব্যতিক্রমী রচনা, বিষয়বস্তুর নতুনত্বে অপরূপ, অসাধারণ। বাংলা সাহিত্যে কেন, বিশ্বসাহিত্যেও এর তুলনা দুর্লভ।

বিভূতিভূষণ কম উপন্যাসের রচয়িতা নন। গল্পও লিখেছেন অসংখ্য। ‘পুঁইমাচার’ মতো জীবনধর্মী, হৃদয়ছোঁয়া গল্পও তিনি লিখেছেন। ছাপ্পান্ন বছরের সংক্ষিপ্ত জীবনে পথের পাঁচালী, আরণ্যকের বাইরে ইছামতির মতো অবিস্মরণীয় উপন্যাস উপহার দিয়েছেন। আদর্শ হিন্দু হোটেল তাঁর আর একটি জীবনঘনিষ্ঠ উপন্যাস। এছাড়া দৃষ্টি প্রদীপ, বিপিণের সংসার, অশনি সংকেত – এগুলো স্মরণীয় কাজ। ঊনপঞ্চাশের মন্বন্তর নিয়ে লেখা অশনি সংকেত আমাদের চেতনাকে নাড়া দিয়ে যায়।

বিভূতিভূষণ অলৌকিকতায় বিশ্বাস করতেন এবং ভৌতিক বিষয় নিয়ে রোমহর্ষক গল্প লিখে আমাদের রোমাঞ্চিত করেছেন। বিভূতিভূষণ ক্ষমতাবান কথাকার, তাঁর শৈল্পিক শক্তিমত্তা দিয়ে আমাদের বহুবার চমৎকৃত করেছেন। কিন্তু অ্যাডভেঞ্চারধর্মী চাঁদের পাহাড় রচনায় তাঁর অভাবনীয় শক্তি ও কল্পনার ঐশ্বর্য পাঠককে হতবাক করে। বিভূতিভূষণ কখনো আফ্রিকা দেখেননি, আফ্রিকায় যাননি, বলতে গেলে দেশের বাইরেই যাননি। তবু বিভূতিভূষণ আফ্রিকার আদিম গহিন অরণ্যে স্বর্ণহীরা অনুসন্ধানের দুঃসাহসী অভিযানের ভয়ংকর বিশ্বাসযোগ্য আখ্যান লিখতে পারেন, বিশ্বাস করা কঠিন বৈকি। আর সে-কল্পিত অভিযানের নায়ক এক রোমাঞ্চপ্রিয় বাঙালি যুবক শঙ্কর, আরো বিস্ময়কর। আফ্রিকার অরণ্যসম্পর্কে বিশ্ববিখ্যাত পর্যটক Sir Harry Johnson-এর কাহিনি পড়ে তার আদলে এমন কাহিনি নির্মাণ অসম্ভবও বটে। চাঁদের পাহাড়ে সেই অসম্ভবকেই তিনি সম্ভব করেছেন। উপন্যাসটি নিয়ে কলকাতায় চলচ্চিত্র নির্মিত হয়েছে। সেটিও মূল রচনার মতোই হয়েছে জনপ্রিয়।

সুব্রত বড়ুয়া বিভূতিভূষণকে পরিপূর্ণরূপে অঙ্কন করতে পূর্বোক্ত জীবনীকাররা ছাড়াও আরো অনেকের বক্তব্য কাজে লাগিয়েছেন। তাঁরা বিভিন্ন সময়ে বিভূতিভূষণের সান্নিধ্যে এসেছিলেন, তাঁদের ঘনিষ্ঠ স্মৃতি লিপিবদ্ধ করে গেছেন। বন্ধু নীরদ চৌধুরী এর মধ্যে অন্যতম। আরো আছেন ভ্রাতৃবধূ যমুনা বন্দ্যোপাধ্যায়, পরিমল গোস্বামী, আফিফ ফুয়াদ প্রমুখ। এছাড়া স্মৃতিচারণ করেছেন বিহারের হিন্দিভাষী যোগেন্দ্রনাথ সিংহ। বনবিভাগের উচ্চপদস্থ এই কর্মচারীর সঙ্গে একসময় বিভূতিভূষণের গভীর সখ্য হয়েছিল – তিনি বিভূতিভূষণের ওপর স্মৃতিচারণমূলক গ্রন্থ পথের পাঁচালীকে বিভূতিভূষণ আমাদের জন্য রেখে গেছেন। এতেও বিভূতিচরিত্রের অনেক পরিচয় পাওয়া যায়।

বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় বাংলা কথাসাহিত্যের একজন নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিত্ব। সুব্রত বড়ুয়া যুক্তি ও নিষ্ঠাসহকারে তাঁর সে নিরঙ্কুশ কর্তৃত্ব ও গৌরবের মূল্যায়ন করেছেন। তিনি ছিলেন খাঁটি শিল্পী, যুগোত্তীর্ণ সাহিত্য সাধক। কিন্তু বিভূতিভূষণ শুধু কথাশিল্পী নন, তিনি মানুষও, রক্তমাংসে গড়া মানুষ। লেখক সুব্রত বড়ুয়া এদিককার প্রতিও অবিচার করেননি। বিভূতিভূষণ বিবাহের মাত্র এক বছর তিন মাস পর স্ত্রী গৌরিকে হারান এবং সে-শোক বয়ে বেড়িয়েছেন সারাজীবন। কিন্তু বিপত্মীক বিভূতিভূষণের জীবনে পরে আমরা তিনজন নারীর পদধ্বনি শুনতে পাই। জন্মস্থান বারাকপুরের প্রতিবেশী খুকু ওরফে প্রীতিলতা বন্দ্যোপাধ্যায়, কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী সুপ্রভা দত্ত ও সবশেষে বনগাঁয়ের রমা বন্দ্যোপাধ্যায়। জীবনীকার এদের পুঙ্খানুপুঙ্খরূপে আমাদের সামনে উপস্থাপিত করেছেন। ব্যক্তিমানুষ বিভূতিভূষণকে বুঝতে, তাঁর অন্তর্লোকের সন্ধান পেতে এই নারীরা বিশেষ ভূমিকা রেখেছেন। খুকু তাঁর সাহচর্যে এসেছেন দশ-এগারো বছর বয়সে, বালিকা বয়সে, পনেরো বছর বয়স পর্যন্ত তা অব্যাহত থেকে উষ্ণ হয়েছে। কিন্তু একজন কিশোরী যুবতীর সঙ্গে বিভূতিভূষণের সম্পর্ক কি শুধু নিরেট প্রীতির উত্তাপেই আবদ্ধ, না আছে অন্যকিছু? সেটা দুজনের সম্পর্কের বিভিন্ন স্তর, নৈকট্য ও অনুরাগ থেকে বুঝতে কষ্ট হয় না। দুজনেই পরস্পরের প্রতি অনুরক্ত ছিলেন, ভালোও বেসেছিলেন, যদিও বিবাহে তা পরিণতি লাভ করেনি। দুজনের হৃদয়ের পরিচয় পেতে বিভূতিভূষণের ১৯৩৪ সালে লেখা দিনলিপির একটি অংশ লিপিবদ্ধ করছি, ‘খুকুর সঙ্গে সন্ধ্যাবেলা কত কথা হোল। আমি বললুম, বাড়ুয্যে না হলে তোকে বিয়ে করতুম। ও হাসলে – বল্লে, আপনি চলে গেলে আমার মন পালাই পালাই হবে।’ এ-বিষয়ে বিভূতিভূষণের আরো অকপট স্বীকারোক্তি, ‘কতকাল চলে যাবে – তখন খুকুও থাকবে না, আমিও থাকবো না – কে জানবে ইছামতির তীরের এক ক্ষুদ্র গ্রামে শেফালী বকুলগাছের নিবিড় ছায়ায় ছায়ায় কত হেমন্তদিনের সন্ধ্যায়, কত শীত-শরতের জ্যোৎস্নায় দুটি প্রাণীর মধ্যে কী নিবিড় প্রীতির বন্ধন ধীরে ধীরে গড়ে উঠেছিল।’

খুকুর বিবাহ হয় ১৩৪৬ সনের আষাঢ়ে। বিয়েতে বিভূতিভূষণ সম্মতি দিয়েছেন, অনটনগ্রস্ত খুকুর পিতাকে বিয়ের জন্য পাঁচশত টাকাও দিয়েছেন, কিন্তু তবু যেন হৃদয় থেকে মেনে নিতে পারছেন না। বিয়েয় যোগদান করেছেন, বিয়েবাড়িতে পৌঁছেছেন দেরিতে, (উল্লেখ্য, খুকুর উক্তি, ‘এত দেরি করে এলেন যে।’), সন্ধের পরে। শুধু তাই নয়, শেষরাতে সবার অলক্ষ্যে ভগ্নহৃদয় বিভূতিভূষণ রাত তিনটার ট্রেনে কলকাতায় ফিরে গিয়েছেন।

দগ্ধ হৃদয়, মনে কষ্ট – বলতে পারছেন না, তবু বোঝা যায়।

সুপ্রভার ক্ষেত্রে এটা বেশ স্পষ্ট ও পরিস্ফুটিত। সুপ্রভা স্বল্পশিক্ষিত, অপরিণত খুকু নয়, উচ্চশিক্ষিতা ও পরিণত – কলকাতা বিশ^বিদ্যালয়ে অধ্যয়নরত ইংরেজি বিভাগের এম.এ. শেষবর্ষের ছাত্রী। নিজে কবিতা লেখেন, সংস্কৃতিমণ্ডিত ও মননশীল, জীবনবোধও অগভীর নয়। ধনী, শিল্পমনা এই মেয়ে সাদামাটা বিভূতিভূষণকে পছন্দ করেছিলেন, ভালোও বেসেছিলেন অন্তর থেকে। কিন্তু বিভূতিভূষণের এক প্রকার নিস্পৃহতার কারণে সম্পর্ক বিবাহবন্ধন পর্যন্ত গড়ায়নি। কায়স্থ সুপ্রভার সঙ্গে ব্রাহ্মণ বিভূতিভূষণের বর্ণগত সমস্যা হয়তো ছিল, আরো ছিল সামাজিক অবস্থানের অসংগত দূরত্ব। বিভূতিভূষণ গরিবের ছেলে, সাদাসিধে জীবনযাপন, স্থায়ী আবাস বলতে বারাকপুরের নিতান্ত সাধারণ টিনের একচিলতে বাড়ি, সুপ্রভাদের সঙ্গে সবদিক দিয়ে ব্যবধান। অবশ্য লেখক হিসেবে বিভূতিভূষণ ততদিনে প্রতিষ্ঠিত, সম্মানিত এবং তাঁর স্বপ্নের শেষ অভীষ্ট ঠিকানা হলো নিসর্গশোভিত বারাকপুর। প্রকৃতির উন্মুক্ত লীলাক্ষেত্র, সেই সৌন্দর্যের স্বর্গ বারাকপুর তাঁর অস্থিমজ্জাগত। সুপ্রভার মতো অভিজাত মেয়েকে, সুশিক্ষিতা শহরবাসীকে তিনি বারাকপুরে অধিষ্ঠিত করবেন কি করে? এ যে স্বপ্নেরও অতীত। ফলে পিছুটান, সুপ্রভাকে গ্রহণে দ্বিধাদ্বন্দ্ব। বন্ধুপত্নী অমিয়া চৌধুরাণীর, প্রাক্তন সহপাঠীর পক্ষে সাফাই গাওয়ার পরও বিভূতিভূষণের নীরব প্রস্থান। অথচ সুপ্রভাকে ভালো সত্যি বেসেছিলেন, সুপ্রভার দিক থেকে সেটা আরো সত্য। এর অন্যদিকও ছিল। সুপ্রভার মতো একজন অনূঢ়া তরুণীর পরবর্তী জীবনে এজন্য বিব্রতকর পরিস্থিতির মুখোমুখি হওয়ার ঝুঁকিও ছিল (জীবনীকার রুশতী যেন সে-প্রশ্ন যথাযথভাবে তুলেছেন)। বিবাহের পরও গোপনে বিভূতিভূষণকে চিঠি লেখেন সুপ্রভা – তাতেও ব্যর্থ ভালোবাসার বিক্ষোভ ও পূর্বোক্ত ঝুঁকির ইঙ্গিত পাওয়া যায়।

বিভূতিভূষণ কি মনে মনে অক্ষত থাকতে পেরেছেন? এ-ভালোবাসাকে তিনি নিজেই দ্বিধাহীন স্বীকৃতি দিয়েছেন। এক্ষেত্রে কি মানসিক সন্তাপ এড়ানো সম্ভব? বারাকপুর থেকে ১৯৩৮ সালে সুপ্রভাকে লেখা সেই বিখ্যাত চিঠি, যেখানে তাঁর স্বাক্ষর আছে, ‘কত লোকের অর্থাৎ কত মেয়ের সঙ্গে তো তারপর আলাপ হলো – কিন্তু তোমার সঙ্গে প্রথম আমলের যে ভালবাসা, এমনটি আর হোল কৈ আর কারো সঙ্গে? তা হয় না। একজায়গায় একবার হোলে দু’জায়গায় হয় না। আমি কথাটা এতদিন ভাল বুঝতাম না – আজকাল বুঝি।’

বিভূতিভূষণের জীবনের শেষ নারী বনগাঁয়ের সতেরো বছরের রমা। এই রমাই তাঁর স্ত্রীর আসন অধিকার করেছিল।

এখানে একটা কথা উল্লেখ করা দরকার। বিভূতিভূষণের জীবনের প্রিয়তম নারী কিন্তু তাঁর প্রথম স্ত্রী গৌরী। মাত্র পনেরো বছর বয়সে গৌরী তাঁকে ছেড়ে অনন্তলোকে চলে যান। এই মৃত্যু তাকে পঙ্গু করে দিয়েছিল, মনের সুস্থতা ধ্বংস করেছিল। পরে গৌরীর স্মৃতিই ছিল তাঁর বাঁচার প্রধান অবলম্বন, প্রেরণা। গৌরীর চিঠি, গৌরীর কারুকাজ করা হাতপাখা, বালিশের অলংকৃত ওয়াড় – এগুলো তিনি সর্বদা সঙ্গে নিয়ে চলতেন। নারীমাত্রই তাঁর কাছে গৌরীর প্রতিচ্ছায়া, সুন্দরী গৌরীর প্রতিরূপ। যে-কোনো নারী তাঁর সান্নিধ্যে এলে তার মধ্যে তিনি গৌরীর প্রতিচ্ছায়া, গৌরীর বৈশিষ্ট্য খুঁজে ফিরতেন। তাঁর দীর্ঘকাল বিবাহ না করার, নারীবিহীন জীবন কাটানোর প্রধান কারণ গৌরী। বিভূতিভূষণের জীবনে প্রথমদিকে (গৌরীর মৃত্যুজনিত) ছন্নছাড়া সময়ে বন্ধুদের পুনর্বিবাহ দেওয়ার প্রচেষ্টায় তাই কোনো ফল হয়নি। খুকু বা সুপ্রভাতেও তা হতে পারে, গৌরীর স্বরূপ তাঁদের মধ্যে ছিল না, কেউই গৌরীর সুস্পষ্ট ছায়া নিয়ে আবির্ভূত হতে পারেননি। শেষমেশ সে-সন্ধান মিলল রমার মধ্যে, গৌরী এতদিন পর, সুদীর্ঘ তেইশ বছর পর বনগাঁয়ের রমার মধ্যে এসে দেখা দিলো কোনো না কোনোভাবে। বিভূতিভূষণকে রমা সহজে জয় করে ফেললেন।

বিভূতিভূষণের মতো অসামান্য কালজয়ী লেখকের আলোচনা এদেশে ক্বচিৎ চোখে পড়ে। এটি আমাদের সাহিত্যিক দীনতা, রসোপলব্ধিগত সীমাবদ্ধতা, গভীতর জীবন রহস্য উন্মোচনে অপারগতা। সুব্রত বড়ুয়া বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে বিভূতিভূষণের মহৎ স্বরূপ উপহার দেওয়ার প্রয়াস পেয়েছেন। বিভূতিভূষণের জীবন কষ্টের – সে-জীবন এ-গ্রন্থে অনাবৃত। তাঁর সাহিত্যিক সাধনা, তাঁর একান্ত ব্যক্তিগত জীবনের প্রতিভাস – কোনো কিছুই বাদ যায়নি।

এ-গ্রন্থের শেষে আছে খুকু, সুপ্রভা ও কল্যাণীর ছবি। বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের জীবনের একান্ত কাছের এসব মানুষের তথা নারীর ছবি এর আগে আমার দেখার সৌভাগ্য হয়নি।

বাংলা সাহিত্যে বিভূতিভূষণ একটি বিশেষ স্থান অধিকার করে আছেন। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য, তাঁকে নিয়ে তেমন লেখাজোখা হচ্ছে না, যা এ-প্রবন্ধের শুরুতেই আমি উল্লেখ করেছি। যদি এই শক্তিশালী মহান কথাকারকে নিয়ে আরো চর্চা করা হয়, তাহলে আমাদের সাহিত্যচর্চা আরো সমৃদ্ধ হবে বলে মনে করি।