সিদ্ধান্তটা নিতে বারেকের কয়েক মাস দেরি হয়ে গেল।
হোমসিকনেস। অভাব-অনটনের ঘানি টানতে টানতে মেরুদণ্ড বাঁকা হয়ে গেলেও বাড়ি ছেড়ে দূরে কোথাও কাজের জন্য যেতে ওর মন সায় দেয় না। বিয়ের আগে যুবক বয়সে, গ্রামের অনেক দরিদ্র যারা নিজ গ্রাম ছেড়ে দূরদূরান্তে কাজের সন্ধানে বের হয়েছে, তাদের অনুরোধেও সে বাড়ি ছেড়ে কাজে যায়নি। সারা দিনে এক বেলা খেয়েও দিন পার করেছে, তবু মা-বাবাকে ছেড়ে দূরে কোথাও কাজের সন্ধানে যেতে মন চায়নি তার। বাড়ি ছাড়ার কথা মনে হলে তার চোখ থেকে আগেই দরদরিয়ে পানি পড়তে থাকে। তখন কি
বাবা মারা গেছে নিষ্ঠুর বজ্রাঘাতে। সেই কষ্টের স্মৃতি তার মনে দাগ কেটে আছে, মরার আগে ভুলতে পারবে কি না কে জানে। সেদিন গাঁয়ের হাজি মুসলেম খাঁয়ের জমিতে বোরো ধান কাটতে গিয়েছিল বাপ-বেটা একসঙ্গে। হঠাৎ আকাশে মেঘ জমতে লাগল, জমতে জমতে আকাশ যেন হাঁড়ির তলা। সকালের দিকে উজ্জ্বল কড়কড়ে রোদের আভা সোনালি ধানের ছড়ায় পড়াতে কেমন যেন ঝিলমিল করছিল। বারেক সেই পাকা ধানের সোনালি ছড়ার দিকে আত্মবিস্তৃত হয়ে মুগ্ধ চোখে তাকিয়েছিল অনেকক্ষণ। সমস্ত মাঠের ধানের ছড়াগুলো যখন বাতাসে একটু একটু কাঁপছিল, তখন তার মনেও দোলা লাগছিল। আহা কী সুন্দর সোনালি ধানের আভা! এই ধানে যদি তাদের গোলা ভরতে পারত আর সারা বছর খেতে পারত, কত সুখীই না হতো! বারেকের বাবার সামান্য জমি আছে, কিন্তু তাতে টেনেটুনে তিন মাসের খোরাকি হয়। বাকি সময় কামলা-মজুরিতেই চলতে হতো তখন। তখন বললে ভুল হবে – এখনো।
মেঘে মেঘে ছেয়ে যাওয়া আকাশের অবস্থা দেখে ধান কাটা বন্ধ করবে কি না, এই নিয়ে হাজি মুসলেম খাঁ যেমন দোটানায় পড়লেন, ঠিক তেমনই মাঠের সব কামলাও। কিছুক্ষণের মধ্যে দু-এক ফোঁটা করে বৃষ্টি শুরু হলে ধান কাটা বন্ধ করে দিলেন হাজি সাব। মুহূর্তের মধ্যে বজ্রপাত শুরু হলো। একটার পর একটা বজ্রনিনাদে আকাশ যেন ফেটে চুরমার হয়ে যাচ্ছিল। কামলারা দৌড়ে বাড়ির দিকে যেতে লাগল। মাঠের সব কামলার সঙ্গে বারেক ও তার বাবাও ছিল। বারেক অনেকটা আগে ছিল। একটু পরেই মনে হলো দিগন্ত প্রসারিত মাঠটি আসমানি আলোর ঝলকানিতে পুড়ে গেল। আর শব্দ তো একেবারেই কানফাটা। মাঠ-ফিরতা মানুষগুলোর বুকের ভেতর ধড়ফড় শুরু হয়ে গেল। বারেক পেছনে তাকিয়ে দেখল, বাবা মাটিতে পড়ে গেছে। পা দুটি একটু একটু নড়ছে। পরক্ষণেই নিথর। শুধু তার বাবা নয়, আরও তিনজন কামলা ওর বাবার মতোই মাটিতে নিথর পড়ে রইল।
সারা গ্রামে আহাজারি শুরু হলো। মাঠের সব মানুষ চিৎকার করতে করতে দৌড়াতে দৌড়াতে বাড়ির দিকে ছুটলো। চারটি লাশ পড়ে রইল খোলা মাঠে। বজ্রপাত কিছুটা কমল বটে, কিন্তু তুমুল ঝড়বৃষ্টি হলো বিকেল অব্দি। বিকেলে লাশগুলো এনে গাঁয়ের মানুষেরা সৎকার-দাফন করল।
সেদিনের কথা মনে হলে বারেক চুপ হয়ে যায়। তখন তার মুখে আর কথা সরে না। ট্রমাটাইজড। দীর্ঘক্ষণ পর কখনো তার চোখ দুটি ঝাপসা হয়ে আসে। আবার কোনো দিন পিতৃস্মৃতি হানা দিলে দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে নিজ কাজে মনোযোগ দেয়।
তারপর সে বিয়ে করল পাশের গ্রামের মেয়ে আকালিকে। তাদের প্রথম সন্তান মেয়ে। বাক্প্রতিবন্ধী। দ্বিতীয় সন্তান ছেলে। কী যে দুরন্ত! মেয়েটার নাম ফুলমতি আর ছেলে ওসমান। পাশের বাজারের সবচেয়ে বড়ো মহাজনের নাম ওসমান। তিনি বিরাট মহাজন হওয়ার সুবাদে ওসমান নামটিও তার প্রিয় হয়ে গেল। ছেলের নাম রাখার সময় তার মনে হয়েছিল, যদি ওসমানের মতো তার ছেলেও একদিন বড়ো মহাজন হতে পারত! বারেক বিশ্বাস করে, মানুষের নামেও নাকি রাশি হয়। ভালো রাশির মানুষের ভাগ্যও ভালো হয়। কত বড়ো গুদাম ওসমান মহাজনের! স্বাস্থ্যবান ফর্সা মানুষটা কত বড়ো গদিতে বোয়াল মাছের মতো তেলতেল বপুটা নিয়ে বসে থাকে আর পান চিবুতে থাকে। কখনো বারেক ওই গদিতে তার ছেলেকে কল্পনা করে। কল্পনা করতে তার বড়ো ভালো লাগে।
আর ফুলমতি তো বারেকের অন্তঃপ্রাণ। যতক্ষণ বাড়িতে থাকে, ততক্ষণ চোখের আড়াল হলেই ডাকতে থাকে, ‘কই রে আমার ফুলমতি। তুইন আমার ফালায় থইয়া কই যাস মা? আমার বোহালে থাহিস। তুইন অইলে গিয়া আমার জান।’
ফুলমতি কথা বলতে পারে না বলেই ফ্যালফ্যাল করে বাবার মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে। কখনো বাবার মুখটি ফুলের মতো কোমল হাতে টেনে এনে চুমো খায়। বারেক তখন খুশিতে ফেটে পড়ে আর হাসতে হাসতে বলতে থাকে, ‘আমার মা, আমারে চুম্বা দিছে, ও মা তুমি কই, দেইখ্যা যাও।’ তখন বারেকের মা কাছে-পিছে থাকলে হাসতে হাসতে দৌড়ে আসে, ‘কী রে বইন, দাদিরে একটা চুম্বা দিবা না? খালি বাপেরে দিবা? আইয়ো আইয়ো, আমার কুলে আইয়ো।’
ফুলমতি বাপের কোল ছাড়ে না। বাদুড়ের মতো গলায় ঝুলে থাকে।
আর তখন ওসমান ঈর্ষাকাতর হয়ে হামাগুড়ি দিয়ে এসে ফুলমতিকে সরিয়ে দিয়ে বাপের কোল দখল করতে চায়। কিন্তু শক্তিতে কুলোতে না পেরে কান্না মারণাস্ত্রটি ব্যবহার করে। কাজ হয় না। ফুলমতির দুর্বোধ্য ব্যূহ ভেঙে প্রবেশ করতে পারে না সে। আর তখনই দাদি এসে টেনে কোলে নিয়ে হাসতে হাসতে দুলকি চালে দৃষ্টির আড়াল হয়।
এই ফুলমতি আর ওসমানকে ফেলে রেখে একা একা বিদেশে (তাদের ভাষায় গ্রামের বাইরে গেলেই বিদেশ) কীভাবে থাকবে। গ্রামের বাইরের জগৎটা গ্রামের মানুষের কাছে বিদেশ। কথাটি মনে হলেই বুকের ভেতরে হু হু করতে থাকে।
আবার কষ্ট তো একটা নয়। দুই দুটি শিশুকে পেট ভরে যখন খেতে দিতে পারে না, তখনও তার বুকটা যেন চেপে আসে। মনে হয় দানবে পা দিয়ে চেপে ধরে আছে। ‘বাপ হয়ে কী লাভ, যদি দুটি শিশুর মুখেই আহার দিতে না পারি’ – ভাবে বারেক।
দিগন্ত প্রসারিত ফসলের মাঠ হলেও বারেকের মতো দিনমজুরদের কাজ নেই। সব কাজ কেড়ে নিয়েছে কলের লাঙল আর ধান কাটার মেশিনগুলো। জমি চাষ করতে যখন গাজির ছেলে কাজি মিয়া কলের লাঙলের ঘড়ঘড় ঘড়াৎ ঘড়াৎ শব্দ করতে করতে মাঠে নামে, তখন বারেকের মতো দিনমজুরদের বুকে যেন করাতের আঘাত লাগে। আগাছা নিড়ানির যন্ত্রও এসে গেছে। তারপর ধান কাটার সময় কাজি মিয়া আর এক আজব মেশিন নিয়ে এসেছে, যেটি ধান কাটা ও মাড়াইও করে দেয়। কী আজব গো বাবা! মেশিনগুলোর দিকে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থেকে গালিগালাজ করে বারেক। এরপর বিড়বিড় করে বলতে থাকে, ‘ঠাডা ফড়ুক ঠাডা ফড়ুক। গরিবের ফেডো লাত্থি দিছোস তরা। তরা মর।’
বারেকের কথায় কি আর কেউ মরে!
কাজ নেই। ঘরে খাবার নেই। মায়ের ওষুধ নেই। আকালির পরনে কাপড় নেই। শুধু নেই আর নেই। ফুলমতি আর ওসমানের মুখ শুকিয়ে চুন। একেক সময় বারেক ক্ষিপ্ত হয়ে নিজের ওপরই রাগ ঝাড়তে থাকে, ‘আমি মরি না ক্যায়। বাজানের মতো আমি মরি না ক্যায়।’
‘পথ তো আছে। মরতে চাস ক্যায়া?’ গ্রামের আরেক শ্রমিক হামেদ বলে। ‘ঢাকা চল। কামের ব্যবস্থা কইর্যা দিমুনে।’
‘কী কাম হামেদ ভাই?’
‘কুটি কুটি মানুষ থাহে ঢাকা। তর একটা কামের ব্যবস্থা অইতো না? আমার অয় নাইক্যা? চল আমার লগে।’
‘আমার ফুলমতিরে রাইক্যা কুনোহানে যাইতে মন চায় না।’
‘তালি পোলাপান দুইডারে না খাওয়া মার। কান্দোস ক্যায়? হাহুতাশ করোছ ক্যায়? বাদাইম্মা কোবালির।’
‘কাজ ফাওয়া যাইবো হামেদ ভাই?’
‘হ। চল আমার লগে।’
ঢাকা আসার পর কাজ জুটেছে গুলশানের একটি ডুপ্লেক্স বাড়ির দারোয়ান হিসেবে। দারোয়ানের কাজের পাশাপাশি তিনটি কুকুরেরও দেখভাল করতে হবে তাকে। প্রথম দিন কুকুর তিনটি দেখার পর ভয়ে সে কুঁকড়ে গিয়েছিল বারেক। এত বড়! ভয় পেলেও যখন নিজের থাকার মতো একটি বিশাল বাড়িতে একটা রুম পাওয়া গেছে, তখন ভয় কেটে গেছে। ফুলমতি আর ওসমানের কথা মনে হওয়াতেও ভয় বলতে আর কিছুই রইল না। নিজে মরলেও সন্তান দুটির মুখে আহার দিতে হবে। ওদের বড়ো করতে হবে, মানুষ করতে হবে – তার দৃঢ় সংকল্প।
ডুপ্লেক্স বাড়ির বাসাটির আগের দারোয়ান ঈদ উদ্যাপন করতে গ্রামের বাড়ি যাওয়ার সময় সড়ক দুর্ঘটনায় মারা যায়। এই শূন্য পদে, ভাগ্যচক্রেই বলা যায়, বারেক চাকরিটি পেয়েছে। এ বাড়ির একমাত্র মেয়ে সুহানা কুকুর পুষতে ভালোবাসে। সুহানা ইংরেজি মাধ্যম স্কুলে পড়ে। সে কুকুরের নাম শিখিয়ে দিয়েছে বারেককে। বারবার ভুলে গেলেও শেষ পর্যন্ত মনে রাখতে সক্ষম হয় বারেক।
ল্যাব্রাডর রিট্রিভার, গোল্ডেন রিট্রিভার আর আইরিশ সেট্টার – এই তিন প্রজাতির তিন কুকুর – দারুণ মায়াকাড়া। বারেকের মন জয় করে ফেলে কয়েক দিনের মধ্যেই।
সুহানা শিখিয়েছে কীভাবে গোসল করাতে হবে এবং খাওয়াতে হবে। প্রতিদিন বিকেলে একটি কুকুর নিয়ে বাইরে হাঁটতে যেতে হবে। বারেককে কুকুরের দায়িত্ব দেওয়ার আগে সুহানা অবশ্যই মাসখানেক ঘামঝরানো প্রশিক্ষণ দিয়েছে। কুকুরপ্রেমী সুহানা পরিবেশ ও জীবজন্তুকে ভালোবাসা কেন প্রয়োজন, সে বিষয়ে প্রায়ই লেকচার দেয়। বারেক মনোযোগ দিয়ে শোনে, কিন্তু কিছুই মনে রাখতে পারে না। কুকুরের খাবার সুহানার বাবা শপিংমল থেকে কিনে এনে ফ্রিজে রেখে দেন। কুকুর তিনটির জন্য আলাদা ফ্রিজ আছে। ফ্রিজের খাবার বারেককে প্রসেস করে দিতে হয়। কদাচিৎ বারেককে কুকুরের খাবার আনতে বাজারে পাঠানোও হয়।
কুকুরের খাবারের চার্ট দেওয়া হয় বারেকের হাতে। চার্ট পড়তে পারে না বলে ছবি এঁকে তার জন্য স্পেশাল চার্ট বানিয়ে দিয়েছে। চার্টের সঠিক ব্যবহার যাতে করতে পারে, সে জন্য পাশের বাসার দারোয়ান শমসের তাকে অনেক সহযোগিতা করে। মাসখানেকের মধ্যে সবকিছু আত্মস্থ হলো।
কী সোন্দর নাম! ডাম্বল, টোটো, ভুক্কু – ভাবে বারেক, আপামণির জবর বুদ্ধি! আপামণিও খুব সোন্দর! ইংলিশ ম্যামের মতো দেখা যায়। অনেক বছর আগে এই রকম একজন ম্যাম ওদের এলাকায় একবার গিয়েছিল।
সত্যিই সুহানা খুব সুন্দর। যখন গোলাপি বা হালকা হলুদ রঙের জামা পরে লাউঞ্জে হাঁটে, তখন মনে হয় যেন প্রজাপতি উড়ে বেড়াচ্ছে। বড়ো চঞ্চল সুহানা। কাঠগোলাপের মতো গায়ের রং। হালকা রেশমির মতো ঘন কালো চুল, মাঝারি ভ্রু চঞ্চল ও গভীর কালো চোখ। বড়ো চঞ্চল, বড়ো মিষ্টি মেয়ে।
একদিন বিকেলে সুহানা লাউঞ্জে এসে বারেকের খোঁজখবর নেয়। তারপর জিজ্ঞেস করে, ‘বারেক, কুকুরের নামগুলো কেমন হয়েছে?’
‘খুব সোন্দর হইছে আপামণি।’
‘তা তো হবেই। দেখতে হবে না কে নাম দিয়েছে। জানো, আমি প্রথম আমি নাম ঠিক করতে পারছিলাম না। তারপর এটা দিই তো আম্মু বলে – না ভালো হয়। ওটা দিই তো আব্বু বলে – ভালো হয়নি। আরও ভাবো। তারপর আরও ভাবতে ভাবতে এক সময় পেলাম এই সুন্দর নামগুলো। সো বিউটিফুল, তাই না?’
‘খুব সোন্দর ফুল আপামণি।’
বারেক যে ইংরেজি শব্দ বুঝতে পারেনি, সেজন্য সুহানার হাসিও পায় আবার রাগও হয়। এত সহজ ইংরেজি কে না বোঝে? তারপর ভাবল, একে দোষ দিয়ে কী লাভ? সে হয়তো লেখাপড়ার সুযোগই পায়নি। লেখাপড়া করলে কি আমাদের বাসায় দারোয়ান হতো!
সুহানা লাউঞ্জে টুকটুক করে হাঁটছিল আর একটানা কথাগুলো বলে যাচ্ছিল। বারেক যে হা হু করে ওর কথার সম্মতি জানাবে, সেই সুযোগটুকুও পর্যন্ত পায়নি। বড়ো অদ্ভুত মেয়ে! তবে বারেকের বেশ ভালো লাগে।
বাড়ির সামনের লাউঞ্জটি সবুজ ঘাসে ঢাকা। সীমানাপ্রাচীর ঘেঁষে নানা রকমের ফুলগাছ। লাউঞ্জের পুব দিকেও একটা কোণে বেশ কিছুটা অংশে ফুলের বাগান। এই বাগানের পরিচর্যার জন্য একজন বুড়ো মালি আসে প্রতিদিন সকালে। কিছুক্ষণ কাজ করে চলে যায়। বাসার ড্রাইভারও বৃদ্ধ মানুষ। হয়তো বয়সের কারণেই ওদের সঙ্গে বারেকের সখ্য গড়ে ওঠেনি। শমসেরের সঙ্গেই তার যত সখ্য।
বারেক স্বপাকে খায়। কী আর রান্না করবে? বাড়িতে কখনো রান্না করেনি সে, জানেও না কিছু। কয়েক দিনের প্রচেষ্টায় ভাত রান্না শিখেছে। তারপর শমসের শিখিয়েছে আলুভর্তা, ডিমভর্তা ও ভাজা, ডালভর্তা, ডাল রান্না … ব্যস, একটা সিঙ্গল মানুষের জন্য এর বেশির কী প্রয়োজন?
একটি অভিজ্ঞতা আরেকটি নতুন দক্ষতার জন্ম দেয়। অভিজ্ঞতা থেকে শেখার আনন্দ-প্রাপ্তিও কম না। শেখার আনন্দে বারেক অনেক পদ রান্না শিখে ফেলেছে। এখন ভাত রান্নার সময় চালের সঙ্গে পরিষ্কার এক টুকরা কাপড়ে সামান্য ডালের পুটলি, দুটি আলু তিন-চারটে লঙ্কা দিয়ে দেয়। একসঙ্গে সবই সেদ্ধ হয়ে যায়। বাড়তি কোনো ঝামেলা করতে হয় না। অনেক সময় একটা ডিমও চালের সঙ্গে দিয়ে দেয় … ব্যস, সব একসঙ্গে সেদ্ধ হয়ে যায়। তারপর ভর্তা করে ভাতের সঙ্গে মাখিয়ে খাও। এটিই তার কমন মেনু।
ডাম্বল, টোটো, ভুক্কুর প্রেমে পড়ে যায় বারেকও। তিনটি কুকুরকে সে এমনভাবে ভালোবাসে আর এদের সঙ্গে সময় কাটায় যে বাড়ির কথা মনেই পড়ে না। ফুলমতি আর ওসমানের কথা হঠাৎ হঠাৎ মনে পড়ে। যদিও প্রথম দিকে প্রতিদিনই রাতে ওদের জন্য নিঃশব্দে কাঁদত।
বিকেলে কুকুরকে বেল্ট দিয়ে বেঁধে হাঁটাতে নিয়ে যাওয়ার সময় শমসেরের সঙ্গে খাতির হয়েছিল। সে কিছুটা লেখাপড়া জানে। শমসের একদিন বলল – কবি কাজী নজরুল ইসলাম বলিয়াছেন, ‘জীবে দয়া করে যেজন, সেজন সেবিছে ঈশ্বর।’ কবিতার এই চরণ শোনার সময় বারেকের ছোটোবেলার পাঠশালার ছড়া পড়ার কথা মনে পড়ে। তখন মক্তব ও পাঠশালায় যেত। তারপর মাথায় আর কুলোয়নি। কয়েক বছর ঘটমটো করে আবজাব কী শিখল কী শিখল না, তার মনে নেই।
শমসের বুঝিয়ে বলল কবিতার মর্মকথা। সে পশুপ্রেমের কথাও মাঝে মাঝে বলে। দুজনের বন্ধুত্ব ক্রমে নিবিড় হতে শুরু করে। সুযোগ পেলেই দুজনে মিলে বিড়ি খায়।
সেদিন সুহানা জিজ্ঞেস করল, ‘কী বারেক, কুকুর পোষতে কেমন লাগে? ওরা কি কামড়ায়?’
খুব ভালো লাগে আপা মণি। কামড়ায় না। সব কথা শুনে, বারেক নিজের জ্ঞান ও কুকুরের প্রতি ভালোবাসার ভাব প্রকাশ করতে বলল, ‘আসলে আপামণি, হইলো কী … জীবে দয়া করে যেজন সেজন সেবিচে ঈশ্বর।’
সুহানা হাসতে হাসতে লুটিয়ে পড়ে – ‘বারেক তুমি যা বললে না, তার জবাব নেই! আচ্ছা, এই কথার মানে কী?’
‘মানে কথা হইলো … আপামণি … জীবের দয়া মানে বুঝলেন না … মানে হইলো … পশুর জিবরার, … মানে কথা অ্যাই … (তার পর সে তার জিহ্বা বের করে দেখিয়ে বলে) এর দয়া করতে হবে। মানে ভালো কইর্যা খাওয়াইতে হইবে। বুঝলেন না?’
‘বুঝবো না আবার! যা বললে বারেক মিয়া …’ সুহানা হাসতে হাসতে কুটিকুটি। ‘থাক বারেক, তোমার আর কবিতা বলতে হবে না। কুকুর তিনটার খাওয়া-দাওয়া গোসল আদরযত্ন ঠিকমতো হচ্ছে তো?’
‘জি আপামণি, খুব ভালাভাবে হইতাছে।’
কুকুরের গোসল, খাওয়া, বেড়ানো ইত্যাদি কাজ করে বারেক নিজের খাওয়ার কথা কখনো কখনো ভুলে যায়। অনেক সময় নিজের গোসলের কথাও ভুলে যায়। আর এ-ও ভাবে, কুকুরের বেশি যত্ন করলে হয়তো বেতন বাড়াবে। ফুলমতি আর ওসমানের জন্য সে বেশি বেশি টাকা পাঠাতে পারবে।
গত দুই মাসে বিকাশে টাকা পাঠিয়েছে। বিকাশে টাকা পাঠানোর সময় আকালির সঙ্গে কথা বলে। মায়ের সঙ্গে কথা বলে। কিন্তু ফুলমতির সঙ্গে কথা বলতে পারে না। আর ওসমান তো ছোটো, কী কথা বলবে। তখন ওর বুকের ভেতরটায় কেমন যেন হু হু করে। মেয়েটা যদি একবার বাবা বলে ডাকতে পারত। তার বড়ো আফসোস, একবার বাবা ডাক শোনার জন্য।
নিজের ফোন নেই। শমসেরের ফোনে কথা বলে। আর ওদিকে বাড়ির আমানের ফোন। নির্দিষ্ট সময়ে আমান ওদের ডেকে দিলে বারেক কথা বলে। ব্যস্ত সড়কগুলোও রাতে যেন ঘুমিয়ে পড়ে। চারপাশ নিস্তব্ধ হয়ে পড়ে। মাঝে মাঝে দু-একটা গাড়ি এদিক-ওদিক যায়। কোনো রাতে বারেকের ঘুম না এলে পকেট গেটটা খুলে সে রাস্তায় এসে দাঁড়ায়। শমসের কোনো রাতে এসে সঙ্গ দেয়। তারও ঘুম আসে না। বিয়ে করেছে এক বছর আগে। স্ত্রীর সঙ্গে টেলিফোনে কথা বলে রাত কাটিয়ে দেয়।
এক রাতে রাস্তার আইল্যান্ডে বসে আছে শমসেরের সঙ্গে। সিগারেট টানছে। তখন শমসের বলে, ‘একটা টাচিং ফোন কিনতে পারলে বউয়ের লগে বিডিও কল করতে ফারতাম।’
বারেক জানে না ‘টাচিং ফোন’ কী জিনিস। সে হাঁ করে অদ্ভুত অভিব্যক্তিতে তাকিয়ে থাকে শমসেরের দিকে। তখন শমসের স্মার্টফোনের বিষয়টি ব্যাখ্যা করে বুঝিয়ে দেয়। বারেকের স্বপ্ন দুইটা ফোন কেনার। একটা আকালিকে দেবে, আরেকটা নিজের কাছে রাখবে। যখন খুশি তখন কথা বলতে পারবে।
আর শমসেরের স্বপ্ন স্মার্টফোনের। দুটি ফোন কিনে একটি বাড়িতে স্ত্রীর কাছে রাখবে, আরেকটি নিজের কাছে। মাঝে মাঝে ভিডিও কল দিয়ে গ্রামের মানুষকে তাক লাগিয়ে দেবে। গ্রামের মানুষ মনে করবে, শমসের অফিসে চাকরি করে। বাসাবাড়ির দারোয়ান না। সেই স্বপ্ন পূরণের জন্য তার চেষ্টার ত্রুটি নেই। এক মোবাইল ফোন চোরের কাছেও বলে রেখেছে কম দামের দুইটা স্মার্টফোন দেওয়ার জন্য। কিন্তু ও আবার কম দামি ফোন
চুরি-ছিনতাই করে না। শিক্ষিত মানুষ। চাকরি করে। মোটরবাইক চালায়, ছিনতাইও করে মোটরবাইক নিয়ে। আগে হেঁটে হেঁটে ভিড়ের মধ্যে ছিনতাই করত, এখন ফাঁকা জায়গায় মোটরবাইক চালিয়ে ছিনতাই করে। অবশ্যই বাইকে আরেকজন থাকে। আর কোনো অনুষ্ঠানে গেলেও চুরি করে। শমসেরের ভাষায় – ‘লোকটা ভালা। ফুর্তিবাজ। হাসিখুশি। বলেছে, দুইডা কম দামি মোবাইল হাতে আইলেই দিবে। খুব ভালা মানুষ।’
তিন মাস পরে অনেক অনুরোধ করে দুদিনের ছুটি নিয়ে গ্রামের বাড়ি যায় বারেক। একজন দারোয়ান, বাসা খালি করে ছুটিতে যাবে কীভাবে? তিনটি কুকুরের দেখাশোনাসহ বাসার গেট খোলা লাগানোর কাজ কে করবে?
শমসেরের কাছে ছুটির কথা বললে সে একজন লোককে দুদিনের জন্য ব্যবস্থা করে দিলে বারেক গ্রামের বাড়ি যায়। ফুলমতি আর ওসমানের জন্য চকলেট আর চিপস কিনেছে। আর সবার জন্য এক কেজি জিলাপি কিনে নিয়েছে। সুখের বিষয় একটাই যে বাড়িতে এখন আর কেউ না খেয়ে থাকে না।
বাড়ি যাওয়ার সময় কুকুরের মাথায় হাত বোলায়, ওদের জন্য বুকের ভেতর চিনচিন ব্যথা অনুভব করে বারেক।
নাইটকোচে গিয়ে সকাল ছয়টায় বাড়ি গিয়ে পৌঁছায়। মা আর আকালি যেন সূর্য ওঠার আগে ব্যাকুল হয়ে বসে আছে বারেককে দেখার জন্য। বারেক উঠোনে পা দিতেই আকালি আর মা ঘর থেকে লাফিয়ে পড়ে। মায়ের চোখে পানি এসে গেছে আনন্দে – ‘আহা রে, আমার বাজানের মুখটা হুগায়া রইছে। শইলডা তো হুগায়া কাডি অইয়্যা গ্যাছে, কিরে বাজান। তুই খাস না।’
এই তো বাংলাদেশের মাতৃত্বের অভিব্যক্তি। খেয়েদেয়ে হাতি হলেও মায়ের কাছে শুকনো কাঠি। বারেকের ওজন তো কমেনি, বরং শহরের হালকা কাজের জন্য একটু মুটিয়ে গেছে। তবু মায়ের চোখে শুকনো কাঠি।
ভোরের পাখির মতো ফুলমতি আর ওসমানও জেগে উঠেছে। গ্রামের শিশুরা বড়দের আগে জেগে ওঠে। পাখিদের সঙ্গে যেন ওদের ঘুম ভাঙে। দুজন বাবার দুই কোল দখলে নিয়ে গেছে।
বারেকের আক্ষেপ, ছেলেমেয়েরা শুকিয়ে গেছে। স্বাস্থ্য নেই, যেন পাখির মতো পলকা।
তিন মাস স্বপাকে খেয়ে নিজের খাবারের প্রতি বড়ো অরুচি হচ্ছিল। বাড়িতে মায়ের রান্না কচুর লতির আর চ্যাপা শুঁটকি, ছোটো মাছের চচ্চড়ি আর ডাল দিয়ে যেন গলা ডুবিয়ে খেল। পাশের বাড়ি থেকে ব্রয়লার আনা হলেও ফুলমতি আর ওসমানের পাতে তুলে দিয়েছে। ওরা যখন খুব মজা করে মাংস খাচ্ছিল, তখন বারেক তাকিয়ে দেখেছে আর বারবার আর ঢাকার তিনটি কুকুরের কথা মনে হয়েছে। দু-তিন টুকরো মুরগির মাংস ওরা তিন মাসে খাচ্ছে। আর কুকুর তিনটি প্রতিদিন এক কেজি মাংস ফল শাকসবজি খায়। কুকুরগুলোর জন্য মায়া লাগছে। ওই লোকটা কি ঠিকমতো খাওয়াবে?
ওসমানের জ¦র হয়েছিল, কিন্তু ডাক্তার দেখাতে পারেনি। কুকুর তিনটিকে প্রতি মাসে একবার পশু হাসপাতালে নিয়ে ডাক্তার দেখিয়ে আনে। হঠাৎ বারেক অন্যমনস্ক হয়ে পড়ে – তাকে চিন্তিত দেখে মা জিজ্ঞেস করে, ‘কী হইছে রে ফুত? কিতা চিন্তা করোস?’
‘কিছু না মা। রাইত জাইগ্যা আইছি তো। এই লাইগ্যা ঘুম ঘুম লাগতাছে।’
মায়ের কাছে মনের কথাটি বলতে ভালো লাগেনি বারেকের। যদিও দুপুরে ঘুমানোর অভ্যাস নেই, তবু আজকে খাওয়ার পর একটু ঘুমিয়ে নিলো সে।
ঢাকায় ফিরে প্রথমে কুকুর তিনটির মাথায় হাত বুলিয়ে আদর করল বারেক। তারপর বদলি দারোয়ানকে বিদায় দিয়ে স্বপদে বহাল হলো এবং নিষ্ঠার সঙ্গে নিজ দায়িত্ব পালনে ব্রত হলো।
ডাম্বল, টোটো, ভুক্কুর খাবারের ব্যবস্থা করে বারেক। ওরা যেন বারেককে অনেক দিন পর দেখে কাছছাড়া হতে চায় না। গা ঘেঁষে দাঁড়িয়ে থাকে। ডাম্বলটা বেশি আদুরে। সে বারেকের সামনে পা দুটি সামনে দিয়ে শুয়ে থেকে বারবার দেখছে, অভিমানী দৃষ্টিতে তাকাচ্ছে। ভাবটা এমন যেন আমাকে একটু আদর করছ না কেন? বারেক ওদের মনের ভাব বুঝতে পারে। সে মাথায় হাত বুলিয়ে আদর করে। ভুক্কুটা আবার দারুণ ঈর্ষাকাতর। ডাম্বলটাকে আদর করতে দেখে সে এসে বারেকের পিঠে মুখ ঘষতে শুরু করেছে। ও যেন বোঝাতে চাচ্ছে, আদর কি সে একাই পাবে? তুমি আমাকে আদর করছ না কেন? বারেক এবার ভুক্কুর শরীরে হাত বুলিয়ে আদর করে।
আর টোটো যেন টোটো কোম্পানির ম্যানেজার। সে কোনো কিছুতে গা করে না। একটু দূরে বসে এমন ভাব ধরে তাকালো যেন মনে হচ্ছে, ওরা যা ইচ্ছে করুক তাতে আমার কী? আমার একেবারে বয়েই গেছে। বারেক ওর ভাবসাব দেখে হাসে। তারপর ডাক দেয়, টোটো। টোটো অভিমান ভেঙে বারেকের কাছে এসে গা ঘেঁষে দাঁড়ায়। তাকেও আদর করে।
বিকেলে সুহানা লাউঞ্জে দেখা করে বারেকের সঙ্গে। তোমার বেড়ানো হলো?
জি আপামণি।
তোমার বাড়িতে কে আছে? সুহানা ভাবছে, এত দিন ধরে থাকলেও ওর বাড়িতে কে আছে কিছুই জিজ্ঞেস করেনি। নিজেই অবাক হয়।
বারেক বলে, মা আছে, বউ। একটা মেয়ে ফুলমতি আর একটা ছেলে ওসমান। ওরা ছোটো। ফুলমতি কথা কইতে পারে না।
ফুলমতির কথা শুনে সুহানার মন খারাপ হয়ে পড়ে। সে আরো কিছু জানতে চেয়েছিল, কিন্তু কথা যেন গলায় আটকে গেছে। আস্তে আস্তে হেঁটে বাগানের দিকে চলে যায় সে।
সুহানার বাবা-মায়ের সঙ্গে বারেকের কদাচিৎ দেখা হয়। গত তিন মাসে তিন-চার দিন দেখা হয়েছে মাত্র। যেদিন বারেক প্রথম দিন আসে, সেদিন কথা বলে চাকরি দিয়েছিল। তারপর অফিসে যেতে আসতে দু-একবার। ওর মায়েরও সঙ্গে একই প্রকারের দেখা হয়েছে।
এবার বাড়ি থেকে ফিরে বারেক লক্ষ করেছে, একটি করে কুকুরকে নিয়ে হাঁটতে গেলে অন্য দুটি বাদ সাধে। বাধ্য হয়ে ওদেরও নিয়ে যেতে হয়। এখন তিনটিকেই গলায় বেল্ট বেঁধে বিকেল পাঁচটায় বের হয়ে যায় এবং ঘণ্টাখানেক হেঁটে বাসায় ফেরে। ওরা আদায় করে নিতে শিখেছে।
এক রাতে বাসার সামনে ফুটপাতে শমসেরের সঙ্গে বিড়ি খেতে খেতে আড্ডা দেয় বারেক। শমসেরের মন খারাপ এবং তাকে খুব উদাস দেখাচ্ছে। অন্যদিন দুজন একসঙ্গে হলে বউয়ের কথাই বেশি বলে। আজ শমসের নিস্পৃহ, কিছুক্ষণ পর সে বারেককে জিজ্ঞেস করে, ‘কী খাইছোস?’
বারেক বয়সে বড়ো হলেও দুজনের আন্তরিকতা বেড়ে যাওয়ার পর আপনি থেকে ‘তুমি’, ‘তুমি’ থেকে ‘তুই’ সম্বোধনে নেমে আসে। বারেক বলে, ‘খাওয়ার কথা আবার হুইচ করন লাগে? আলুভর্তা আর ডাইলই তো খাই।’
শমসের রুষ্ট হয়ে বলে, ‘তুই শালা একটা আহাম্মক। তিনডা কুত্তারে এক কেজি গোস্তু খাওয়াছ পরতেক দিন। ক্যান, এক কেজি থেইকা মাইঝে মাইঝে কয়েক টুকরা রাইন্দ্যা খাইতে ফারিস না? আরো খাওয়াছ ফল শাকসবজি। এগুলো তো তুইও খাইতে ফারোস। নাকি ফারোস না?’
‘আরে এইডা কী কইলি? কুত্তার খাওন আমি খাইতাম ক্যান?’
‘আরে বেডা, কুত্তার খাওন কি মার্কামারা আছে? যখন দোকানদারে বেচে, তখন কি কুত্তার লাইগ্যা আলাদা বেচে? একই মাংস সবাই কিনে। কে কুত্তারে খাওয়াইলো আর কে মুরগিরে খাওয়াইলো আর কে নিজে খাইলো, এইডা তাগো ব্যাপার। বাজার থাইক্যা যখন মাংস আনোছ, তহন তুই কয়েক টুকরা আলাদা কইর্যা রাইক্যা রাইন্দ্যা খাইবি, বুঝলি? ফলও খাইবি। তোরে ওরা কোনো দিন খাইতে দিবো না। দুনিয়ার বড়লোকরটা হইলো বজ্জাতের হাড্ডি। কুত্তারে খাওয়াইবো, তবু মাইনসেরে খাওয়াইবো না।’
‘আরে, তুই কী কছ? অবলা প্রাণীর খাওন চুরি করবাম আমি? এটা কিন্তু ঠিক না। এই পাপ আল্লাহও মাফ করত না।’
‘শালা শোন, কবি কাজী নজরুল ইসলাম কইছে, সবার উপ্রে মানুষ সইত্য, তাহার উপ্রে নাই। এই কথার মানে জানোস?’
‘না। জানি না।’
‘জানোস না। কালো হরফ ঘটে থাকলে তো জানবে। এই কথার মানে অইলো মানুষের চেয়ে বড়ো পারনি আর নাই। মানে সব পারনির উপ্রে অইলো মানুষ। কবি নজরুল তো আর যেই সেই কবি আছিলো না। তার সব কবিতা সইত্য। তালি বিষয়ডা কী অইলো? তুই পরতেক দিন খাইবি আলুভত্তা আর ডাইল। আর তিন কুত্তায় খাইবো মাংস ফল সবজি ভাত। কুত্তা কি মাইনসের উপ্রে অইয়া গেল?’
‘না ভাই, অবলা জিবের খাওন চুরি করতাম না। খোদা নারাজ অইবো।’
‘যাছ শালা। মাইনসে কয় না, বেক্কলরে বুদ্ধি দেওনের থাইক্যা এক বেলা খাওয়ায়া দেওন ভালা। তোরে বুদ্ধি দিয়া কুনো লাভ নাই। তুই শালা একটা আহাম্মক।’
‘আচ্ছা, থাউক। আহাম্মকই থাকি। তবু চুরি করতাম না।’
‘হুন, তুই যদি রানতে না ফারোছ, তালি আমারে দিস। আমি রাইন্দা তোরেও দিমুনে, আমিও দুয়েক টুকরা খাইমুনে।’
‘আচ্ছা, বুইজ্জা দ্যাহি।’
‘অহন গিয়া ঘুম দে। চিন্তা কইর্যা দ্যাহিস। শুধু শুধু কষ্ট কইর্যা কুনো লাভ নাই।’
‘আচ্ছা।’
শমসের বুদ্ধি দেওয়ার পর বারেকের মনেও প্রশ্ন দেখা দিয়েছে যে তিন কুকুরের জন্য এত খাবার, অথচ সে মানুষ হয়েও ভালোমন্দ কিছু খেতে পারে না। কিছু খাবার সরিয়ে নিজে খেলে তো ওরা টেরও পাবে না। নিজের টাকাও বেঁচে যায় আর শরীরটাও ভালো থাকে। তার মনে পড়ে সেদিন খাওয়ার সময় ফুলমতি আর ওসমান দুই টুকরা মুরগির মাংস কত যত্ন করে ইঁদুরের মতো খুঁটে খুঁটে খেয়েছে। আর এই তিন কুকুরের কত খাবার নষ্ট করে। খোদার দুনিয়াতে এটা কেমন বিচার?
তার মনে নানাভাবে এই প্রশ্নগুলো প্রতিদিন খোঁচায়। আবার যখন কুকুরগুলোর দিকে তাকায়, এক প্রকার মায়ার জালে আটকে যায়। এত মায়া লাগে যে এদের খাবার থেকে চুরি করতে মন কোনোভাবেই সায় দেয় না। অবুঝ অবলা প্রাণীগুলোর প্রতি তার দরদ আর মায়া তো কম না। কুকুর তিনটাও যে ওকে কত ভালোবাসে, তা সে বুঝতে পারবে না। কী যে মায়াভরা চোখে তাকিয়ে থাকে! দ্বিধাদ্বন্দ্বে ও মনস্তাত্ত্বিক সংকট কাটিয়ে উঠতে পারত হয়তো এবং কুকুরের খাবারের প্রতি লোভও হতো না। কিন্তু শমসেরও প্রতিদিন খোঁচায়। বারেক এখন কোন দিকে যাবে? শমসেরের খোঁচায় খাবারের প্রতি লোভও জাগে, আবার কুকুর তিনটির ভালোবাসার কাছে সে বারবার হেরে যায়।
একদিন ঠান্ডা স্নায়ুযুদ্ধে বারেক বিবেকের কাছে হেরে যায় এবং বাজার থেকে মাংস এনে ব্যাগটা রেখে কিছু মাংস নিয়ে শমসেরকে দিয়ে আসে। শমসেরও গ্যারেজের পাশে দারোয়ানের রুমে থাকে। সেখানেই রান্নার ব্যবস্থা যেমনটা শমসেরের এখানে। বারেক যখন মাংস নিয়ে যায়, তখন কুকুর তিনটা ওর দিকে নীরব দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে। কুকুরের চোখ রহস্যময়।
শুধু মাংস নয়, প্রতিদিন সে ফলও দু-একটা খেয়ে ফেলে। দিন কেমন যেন বদলে গেল। শমসের আর বারেকের বন্ধুত্ব আরো গাঢ় হতে লাগল।
একদিন দুপুরে শমসেরের গ্যাসস্টোভে মাংস রান্না হয়েছে। দুপুরের দিকে তিনটি কুকুরই দেয়াল টপকে শমসেরের গ্যারেজে ঢুকে মাংসের হাঁড়ি নিয়ে পালিয়ে আসে। পালিয়ে আসা পর্যন্ত যদি হতো, তাহলে কোনো সমস্যা ছিল না। হাঁড়ির এক প্রান্তে কামড়ে ধরে ডাম্বল দৌড় গেল সুহানার রুমে। তার সঙ্গে টোটো ও ভুক্কুও। ডাম্বল মাংসের হাঁড়িটি মেঝেতে রাখে। তারপর ওরা জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল সুহানার দিকে। হাঁড়ি নিয়ে কুকুরের আকস্মিক আগমনের হেতু বোঝার চেষ্টা করে সুহানা। অনেকক্ষণ চিন্তা করে কিছুই উদ্ধার করতে না পেরে সে নিচে নেমে আসে এবং বারেককে ডাকে।
অন্য দিনের মতো স্বাভাবিকভাবেই বারেক সুহানার সামনে দাঁড়ায়।
সুহানার নিচে নামার সময় ডাম্বল মুখে করে হাঁড়িটি নিয়ে ওর পেছনে পেছনে নামে। টোটো আর ভুক্কুও নামে। মনে হলো চোর ধরতে ওরা এগিয়ে যাচ্ছে দৃপ্ত পদক্ষেপে। হঠাৎ টোটো বারেকের রুম থেকে কয়েকটি ফলের উচ্ছিষ্টাংশ এনে সুহানার সামনে রাখে। মাংসের হাঁড়ির সঙ্গে যুক্ত হলো ফলও।
ভুক্কু আর টোটো বারেকের প্যান্ট ধরে রাখে। বিষয়টা এমন দাঁড়াল যে, মনে হচ্ছে কুকুর তিনটি বলছে – এই যে চোর ধরলাম, সে আমাদের মাংস ও ফল চুরি করে খায়। সুহানা এখন তুমি এর বিচার করো।
হতভম্ব সুহানা বারেককে জিজ্ঞেস করে, ‘কী ব্যাপার বারেক? ওরা এমন করছে কেন? তুমি কি মাংস চুরি করেছো?’
বারেক বুঝতে পারে, কুকুরের হাত থেকে বাঁচার কোনো উপায় নেই। তাই অযথা কোনো ছলনার আশ্রয় নেওয়াও ঠিক হবে না। তার শরীর কাঁপতে থাকে ভয়ে এবং অন্তরাত্মা শুকিয়ে যায়। শরীর ঘামতে থাকে। অবাক ভাবতে থাকে কুকুর তিনটা কীভাবে বুঝতে পারল চৌর্যবৃত্তির কথা? তখন শমসেরের ওপর সে এতটাই ক্রুদ্ধ হয়ে যেন মনে হচ্ছে, এখনই ওকে খুন করে প্রতিশোধ নেয়।
বারেক মাথা নিচু করে নিঃশব্দে দাঁড়িয়ে থাকে। লজ্জা আর ঘৃণায় তার মরে যেতে ইচ্ছে করছে।
অনভিপ্রেত এই ঘটনার সুহানাও ব্রীড়ানত। বাক্রুদ্ধ। তার চোখ দুটি খুব করুণ দেখাচ্ছে। কিছুক্ষণ এ রকম বিমূঢ়তায় কেটে যাওয়ার পর সে মাটির দিকে তাকিয়ে বলে, ‘বারেক তুমি এখনই এই বাসা থেকে চলে যাও। তুমি আমার অবুঝ প্রাণীদের খাবার চুরি করে খেয়ে অনেক বড়ো অন্যায় করেছো, যার ক্ষমা নেই। তুমি মানুষ হয়ে জন্ম নিয়েছো ঠিকই, কিন্তু আমার কুকুরগুলোর মতোও সৎ হতে পারলে না। ধিক্ তোমাকে। ধিক্।’
বারেক নিঃশব্দে বাসা থেকে বের হয়ে রাস্তায় গিয়ে দাঁড়ায়। দ্বিধা-সংকোচ মনে নিয়ে বাসার গেটের দিকে তাকিয়ে দেখে সুহানা নেই। কুকুর তিনটি বারেকের দিকে রহস্যময় দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে।
রাস্তায় এত গাড়ি, এত মানুষ, তবু কেন মনে হচ্ছে কোনো শব্দ নেই। সে সামনের দিকে তাকায় এবং অনুভব করে তার চারপাশে শূন্যতার বৃত্তটি কেবল বড়ো হচ্ছে।
Leave a Reply
You must be logged in to post a comment.