ভাষ্য ও ভূমিকা : সুরেশ রঞ্জন বসাক
ভাষ্য
সাহিত্যে মানচিত্র বা দেশকে রূপকথা নয়, রূপক ও রূপকল্প হিসেবে ব্যবহার ব্যাপক না হলেও দুর্লক্ষ্য নয়। গার্সিয়া মার্কেস – বিশেষজ্ঞ ক্রিস্টোফার লিটল তাঁর ঔপনিবেশিক/ উত্তর-ঔপনিবেশিক/ নব্য-উপনিবেশবাদ-বিরোধী একটি পাঠে (‘Er
endira in the Middle Ages : The Medievalness of Gabriel Garcia Marquez’১) দেখিয়েছেন কিভাবে গ্যাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেসের অসাধারণ গল্প ‘The Incredible and Sad Tale of Innocent Erendira and Her Heartless Grandmother’ বারো-বছর-বয়সী নিষ্পাপ ইরেন্দিরার নিরবচ্ছিন্ন বাণিজ্যিক ধর্ষণ/ পতিতাবৃত্তি কলম্বিয়া ও ল্যাটিন আমেরিকার স্প্যানিশভাষী দেশগুলোর সতীত্ব/ সার্বভৌমত্ব ঔপনিবেশিক ও নব্য-ঔপনিবেশিক শক্তির হাতে লুণ্ঠনের রূপক ও রূপকল্প হয়ে উঠেছে। লিটলের পর্যবেক্ষণে : ‘Erendira is the exploited land of the New World. She is young, has dark skin, and… she is violated…The geography of Erendira refers allegorically to parts of Latin America’। এই পাঠবিশ্লেষণ ইঙ্গিত করে, কোনো আখ্যানকে অগ্রাহ্য, অস্বীকার ও পুনর্নির্মাণের জন্যে রূপক, রূপকল্প, প্রতীক ইত্যাদি বেশ কার্যকর মাধ্যম হতে পারে। এ-পর্যবেক্ষণকে বর্তমান প্রবন্ধের মূল প্রতিপাদ্য বিষয় – সাহিত্যে মানচিত্রের উপনিবেশিকায়ন ও বি-উপনিবেশিকায়ন – এর একটি দূরস্থিত দৃষ্টান্ত হিসেবে বিবেচনা করা যেতে পারে।
গ্রাহাম হাগান লিডস বিশ্ববিদ্যালয়ের কমনওয়েলথ ও উত্তর-ঔপনিবেশিক সাহিত্যের অধ্যাপক। হাগান তাঁর প্রবন্ধের শুরুতে সমসাময়িক সাহিত্যে মানচিত্রের রূপক, রূপকল্প এবং প্রতীক হিসেবে ব্যবহারের প্রাসঙ্গিকতা এবং এর অভীষ্টের অবতারণা করেছেন। লেখকের অভিমত, মানচিত্রকে ভূখণ্ড, সার্বভৌমত্ব, জনগোষ্ঠীর স্বাধীনতা ইত্যাদির প্রতিস্থাপিত রূপ হিসেবে উপস্থাপন একটি প্রাচীন ঔপনিবেশিক কৌশল। অর্থাৎ উপনিবেশিতের ভৌগোলিক, সাংস্কৃতিক, রাজনৈতিক, ধর্মীয় ও জাতিতাত্তি¡ক মানচিত্র রচিত হয়েছে উপনিবেশকের ইচ্ছা, উদ্দেশ্য ও দৃষ্টিভঙ্গির আলোকে। উত্তর-ঔপনিবেশিক সময়ে এসে অনেক লেখক এই মানচিত্রকেই রূপকল্প হিসেবে বেছে নিয়েছেন, এবং তা করতে গিয়ে তাঁরা কৌশলের পাল্টা কৌশল হিসেবে পরিহাস ও প্যারোডিকে ব্যবহার করেছেন। এটাই মানচিত্রের পরিমার্জনাবাদ। গ্রাহাম হাগান ক্যারিবীয় সাংস্কৃতিক ইতিহাসের প্রেক্ষাপটে এর সাহিত্যে এই প্রবণতার প্রকৃষ্ট উদাহরণ দেখেছেন উইলসন হ্যারিসের উপন্যাসে২। তিনি দেখিয়েছেন কিভাবে হ্যারিস মানচিত্রকে একদিকে যেমন দৃষ্টিগ্রাহ্য ও পরিহাসাত্মক রূপকল্প হিসেবে তুলে ধরেছেন, এবং অন্যদিকে তাকে সাংস্কৃতিক রূপান্তর এবং কল্পনা-আশ্রিত পরিমার্জনার মাধ্যম হিসেবে ব্যবহার করেছেন। হ্যারিস উপনিবেশবাদীর অহংবাদ (‘hubris’) ও শ্রেষ্ঠত্ববাদের (‘identitarianism’) আলোকে রচিত উপনিবেশিতের দেশচিত্র ও মানচিত্রকে একেবারে খারিজ না করে তাকে সংশোধন করতে চেয়েছেন তীর্যক ব্যঙ্গ ও প্যারোডির সাহায্যে। আর এভাবে তাঁর উপন্যাসে মানচিত্রের বিউপনিবেশিকায়িত বিনির্মাণ ঘটে।
উইলসন হ্যারিস নিরীক্ষাবাদী দুর্বোধ্য লেখক। তাঁর কাছে লেখালেখির আরেক নাম ‘কোয়ান্টাম রাইটিং’, এবং রূপকল্প হচ্ছে ডিসকোর্স। পল রিকর তাঁর The Rule of Metaphor (১৯৭৮) বইয়ে রূপকল্পের সংজ্ঞা দিয়েছেন এভাবে, ‘metaphor is that strategy of discourse by which language divests itself of its function of direct description in order to reach the mythic level where its function of discovery is set free’ (২৩৯)। এই সংজ্ঞার আলোকে দেখলে, বর্ণনাত্মক না হয়ে কীভাবে রূপকল্পে ভর করে ভাষা ডিসকোর্সের কৌশল হয়ে উঠতে পারে। আর এভাবে এককালের পেশাদার সার্ভেয়ার উইলসন হ্যারিস ভৌত মানচিত্রের বিউপনিবেশিত মানবিকীকরণ করেছেন। বর্তমান প্রবন্ধে হাগান অস্ট্রেলিয়ান হজিন্স, মালুফ এবং কানাডিয়ান এরিথা ভ্যান হার্ক ও মার্গারেট অ্যাটউডের মতো উত্তর-উপনিবেশিক লেখকদের প্রসঙ্গ উল্লেখ করে দেখিয়েছেন, তাঁরা কিভাবে ‘মানচিত্রের চৌহদ্দিবেষ্টিত ধারণা এবং সে-ধারণাসঞ্জাত সাংস্কৃতিক সীমাবদ্ধতার বিরুদ্ধে প্রতিরোধ’ গড়ে তুলেছেন। হাগান সাহিত্যে মানচিত্রবিদ্যার নতুন নতুন প্রত্যক্ষজ অনুভ‚তির প্রকাশের প্রসঙ্গ টেনে আরো দেখিয়েছেন যে, কোচ ও রিভার্ডের উপন্যাসে সংস্কৃতির কেন্দ্রাতিগ বিস্তারণ যেমন দেখা যায়, বেইল ও ক্রোয়েচের অপ্রথাগত ভাঙাচোরা উপন্যাসে, তেমনি দেখা যায় বিকেন্দ্রীকরণের প্রবণতা। হাগান সবশেষে এই সিদ্ধান্তে এসেছেন, মানচিত্র উপনিবেশবাদের চিহ্নায়নের বিপরীতে বিচিহ্নায়নের গুরুত্বপূর্ণ কাজটি করে যাচ্ছে, বিশেষ করে, লেখকের দায়িত্ব যখন উপনিবেশোত্তর মানচিত্র নির্মাণ।
মূল
সমসাময়িক উত্তর-ঔপনিবেশিক সাহিত্যের টেক্সটগুলোতে প্রধান বিষয় হিসেবে মানচিত্রকে তুলে ধরা এবং সেসব টেক্সটে পরিহাস এবং/ অথবা প্যারোডির ছলে তা পৌনঃপুনিক ব্যবহার করার প্রবণতা এই ইঙ্গিত দেয় যে, মানচিত্রের বি/ নির্মিত পাঠ এবং ইউরোপীয় উপনিবেশবাদের ইতিহাসের পরিমার্জনার মধ্যে একটি সংযোগসূত্র রয়েছে। এই পরিমার্জনা প্রক্রিয়া খুব সুস্পষ্টভাবে দেখা গেছে সম্ভবত ক্যারিবীয় লেখক উইলসন হ্যারিসের উপন্যাসে, যেখানে মানচিত্রকে অনুভবসাপেক্ষ রূপান্তরের রূপকল্প হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছে, যে-রূপান্তর কেবল আকস্মিক বিপর্যয় বা জটিল অনুষঙ্গ ব্যতীত, ক্যারিবীয় সংস্কৃতির অন্যসব উপাদানকে পরিমার্জনা করার সুযোগ তৈরি করে দিয়েছে। তাঁর সব লেখালেখিতে হ্যারিস সাংস্কৃতিক উপলব্ধির প্রকারভেদের আপেক্ষিকতার ওপর জোর দিয়েছেন। যদিও তিনি স্বীকার করেছেন, উত্তর-ঔপনিবেশিক ক্যারিবীয় সংস্কৃতির পুনর্নির্মাণের জন্যে পূর্বশর্ত হচ্ছে, ইউরোপীয় উপনিবেশবাদ যে-সামাজিক টেক্সট নির্মাণ করেছে তার বিনির্মাণ করা, তারপরও তিনি একটি বিষয়ের ওপর গুরুত্বারোপ করেছেন : সেটা ক্যারিবীয় হোক বা অন্যান্য উত্তর-ঔপনিবেশিক সংস্কৃতি হোক, কোনো সংস্কৃতিকে অপরিহার্যতার দৃষ্টিকোণ থেকে যেমন দেখা যেমন উচিত নয়, তেমনি ইউরোপীয় ঔপনিবেশিক ইতিহাসে সেটার/ তাদের গুরুত্বকে খাটো করে দেখা উচিত নয়। ক্যারিবীয় ও অন্যান্য উত্তর-ঔপনিবেশিক সংস্কৃতিগুলোর সংকর অবস্থা সংস্কৃতিগুলোর ক্রান্তিকালীন পর্যায় অতিক্রম করার জন্যে তেমন জোরালো ভূমিকা পালন করেনি। তাই হ্যারিসের সৃষ্টিকর্ম যখন ঔপনিবেশিক দৃষ্টিভঙ্গির অনমনীয়তা এবং ঔপনিবেশিক ডিসকোর্সের ‘সঙ্কালিক অপরিহার্যতা’র (‘synchronic essentialism’) দৃষ্টিগ্রাহ্য তুলনীয় প্রতিরূপ হিসেবে মানচিত্রের পরিহাসাত্মক রূপকল্প উপস্থাপন করে, তখন তাঁর এ-পন্থাকে সাংস্কৃতিক রূপান্তরের মাধ্যম এবং সাংস্কৃতিক ইতিহাসের কল্পনাপ্রবণ পরিমার্জনাবাদের প্রতিনিধি হিসেবে প্রশংসায় ভাসিয়ে দেওয়া হয় (দেখুন Harris 1981)।
উত্তর-ঔপনিবেশিক লেখালেখির সাম্প্রতিক অবস্থা, এবং বিশেষ করে, ক্যারিবীয় ও অস্ট্রেলিয়ার সাহিত্যের সর্বশেষ অবস্থা একটি গুরুত্বপূর্ণ পালাবদলের ইঙ্গিত দেয় : সে-পালাবদল ইউরোপীয় ঔপনিবেশিক ইতিহাসকে জেরা করার ওপর জোর না দিয়ে প্রশ্নাতীত জাতীয়তাবাদী দৃষ্টিভঙ্গির স্পষ্ট বা অস্পষ্ট সমালোচনার ওপর গুরুত্বারোপ করেছে। এই দৃষ্টিভঙ্গিকে উত্তর-ঔপনিবেশিক ‘সঙ্কালিক’ স্তরগঠনের আলোকে না দেখে, পরিহাসের বিষয়, ঔপনিবেশিক ডিসকোর্সের আলোকে দেখা হয়। সমসাময়িক কানাডিয়ান ও অস্ট্রেলিয়ান লেখালেখির একটি বৈশিষ্ট্য হলো, স্থানিক রেফারেন্সের বিপুল বৃদ্ধি। এর ফলে কেবল জাতীয় ও আন্তর্জাতিক স্থান-পরিচয়ের পরিধিই বাড়েনি, ‘রাষ্ট্রীয় ভূখণ্ড-সংশ্লিষ্ট বিবাদ’ও বেড়েছে, যা মহানাগরিক সংস্কৃতির আত্মস্বীকৃত ‘মূলধারাগুলোকে’ – পিতৃতান্ত্রিক ও জাতিকেন্দ্রিক ডিসকোর্সগুলোর আধিপত্যবাদী প্রবণতাসমূহকে – এবং আমি বলবো, উপনিবেশবাদী বাগাড়ম্বর কর্তৃক পরিবেশিত বা/ এবং আরোপিত সমসত্ত্বতাকে (homogeneity) – চ্যালেঞ্জ করেছে। সাংস্কৃতিক বি-উপনিবেশিকায়নের ইত্যাকার পরিমার্জিত রূপ আন্তর্জাতিকতাবাদী ও আঞ্চলিকতাবাদী গোষ্ঠীগুলোর মধ্যে একধরনের বিপরীতার্থক আঁতাতের জন্ম দিয়েছে, যেখানে ‘আন্তর্জাতিক’ ও ‘আঞ্চলিক’ – উভয়বিধের দখলিকৃত পরিসর – স্থানের ভাষাতাত্তি¡ক অর্থ ছাড়া নতুন কোনো সংজ্ঞা প্রণয়ন করতে পারেনি। প্রতাপশালী সংস্কৃতি বা সাংস্কৃতিক গোষ্ঠীগুলোর বেঁধে দেওয়া পরিসরের বাইরে কাজ করতে গিয়ে হজিন্স (১৯৭৭) ও মালুফের (১৯৮৫) মতো লেখকেরা, কিংবা সংস্কৃতিগুলোর মধ্যবর্তী পরিসরের স্পষ্টায়ন করতে গিয়ে ভ্যান হার্ক (১৯৮৬) ও অ্যাটউডের (১৯৮৫) মতো লেখকেরা মানচিত্রের চৌহদ্দিবেষ্টিত ধারণা এবং সে-ধারণাসঞ্জাত সাংস্কৃতিক সীমাবদ্ধতার বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলেন। তা সত্ত্বেও, মানচিত্রের রূপকল্পের মাধ্যমে সমসাময়িক কানাডিয়ান ও অস্ট্রেলিয়ান সাহিত্যের ভৌগোলিক অবস্থান এবং কর্মপন্থার বিপুল বৈচিত্র্য উদ্ধৃত লেখকেরা যেভাবে তুলে ধরেছেন, তাতে এটাই নির্দেশ করে যে, এসব লেখক ক্রমবর্ধমান বহুমাত্রিক সংস্কৃতিগুলোকে তাদের স্থান-কাল-পাত্র থেকে সংস্কৃতিকে কেবল বিযুক্ত করার আকাঙ্ক্ষা ধারণ করেন না, একইসঙ্গে পুনর্সংযুক্ত করার আকাক্সক্ষাও ধারণ করেন। ভৌগোলিক কেন্দ্রাতিগ বিস্তারণ (যেমন, কোচ ও রিভার্ডের এশিয়ান উপন্যাসে) এবং সাংস্কৃতিক বিকেন্দ্রীকরণ (যেমন, বেইল ও ক্রোয়েচের অতিরঞ্জিতভাবে ভাঙাচোরা উপন্যাসে) – এই দ্বৈত প্রবণতাকে মানচিত্রের প্রতিনিধিত্বকারী ঐতিহ্যিক ‘অনুকরণাত্মক হেত্বাভাস’-এর পটভূমিতে বিবেচনা করতে হবে। মানচিত্র এখন আর জাতীয় সংস্কৃতির সংজ্ঞায়নে হতাশাজনক প্রচেষ্টা থেকে উদ্ভূত সত্তাতত্ত্বীয় উদ্বেগের (ontological anxiety) দৃষ্টিগ্রাহ্য দৃষ্টান্ত (visual paradigm) নয়। একে কার্যকর অমিলগুলোর কেন্দ্রবিন্দু বলা যেতে পারে, যেখানে মানচিত্রবিদ্যার সাময়িক সংযোগ-ক্ষেত্রগুলো একটি চলমান প্রতক্ষ্যজ অনুভূতির রূপান্তরকে নির্দেশ করে, যা উল্টো বরং উত্তর-ঔপনিবেশিক ডিসকোর্সের পরিবর্তনশীল চরিত্রের পরিচায়ক। একটি পালাবদলের পটভূমিতে এই রূপান্তরকে উপস্থাপন করা হয়েছে। সে-পালাবদল ‘ঔপনিবেশিক পরিসরে’ লেখালেখির সমস্যা নিয়ে আচ্ছন্ন ‘ঔপনিবেশিক’ কথাসাহিত্য থেকে সব সংস্কৃতির সাময়িকত্ব নিয়ে উচ্চকণ্ঠ এবং প্রাক্তন উপনিবেশিত সংস্কৃতিগুলোর বৈচিত্র্য নিয়ে প্রশংসামুখর ‘উত্তর-ঔপনিবেশিক’ কথাসাহিত্যে। শেষোক্ত সংস্কৃতিগুলোর নৃতাত্ত্বিক মিশ্রণকে তাহলে আর মিশ্র রক্ত বা সাংস্কৃতিক মনোবিকারগ্রস্ততার ঔপনিবেশিক কলংক বয়ে বেড়াতে হয় না। অবশ্য এটা ইঙ্গিত করা সংগত হবে না, সাংস্কৃতিক আত্মপরিচয় নিয়ে চিরাচরিত কানাডিয়ান ও অস্ট্রেলিয়ান দুশ্চিন্তা পুরনো হয়ে গেছে। অতি সাম্প্রতিক কথাসাহিত্যে মানচিত্রবিদ্যার পুনর্মূল্যায়নের ঝোঁক এটা বোঝায় যে, মানচিত্রের ব্যাখ্যায় প্রতিফলিত সমসত্ত্বতার জায়গায় বৈচিত্র্যের প্রতি তাদের আগ্রহ বেড়েছে। পরিসরকে সংবরণ বা সংগঠনকে নিয়মাবদ্ধ করার মাধ্যমে নয়, বরং পরিসর-বিষয়ক উপলব্ধির জাগৃতির মাধ্যমে সেই বৈচিত্র্যের প্রতিফলন ঘটাতে হবে, এবং পারিসরিক উপলব্ধিই সংস্কৃতিগুলোর ভেতরের এবং নিজেদের মধ্যে সংযোগসূত্রগুলোকে পুনর্নির্মাণ করে নেয়।
বর্তমান প্রেক্ষাপটে, কানাডা ও অস্ট্রেলিয়ার উত্তর-ঔপনিবেশিক লেখালেখিতে ‘নতুন পরিসরগুলো’, বলা যায়, একধরনের মানচিত্রিক ডিসকোর্সকে প্রতিরোধ করছে, যার বল প্রয়োগ ও নিয়ন্ত্রণকৌশল ঔপনিবেশিক উদ্যোগের ইতিহাসের সঙ্গে জড়িত। কিন্তু এর অন্য আরেক রূপকে যদি আরাধ্য করা হয়, তখন নমনশীল আন্তঃসাংস্কৃতিক ছক কেবল পশ্চিমের অনড় প্রথাগুলোকে ব্যর্থ করার মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকে না, পুরো মানচিত্রকেই পরিমার্জনা করে বদলে দেয়। এই পরিমার্জনা ‘আক্ষরিক সত্যের’ চেয়ে বিকল্প রূপকল্পের দিকে বাঁকবদলের বহিঃপ্রকাশ। ‘পরিবর্তনশীল ক্ষেত্র’ হিসেবে মানচিত্রের আপাতবিরোধী গতিময়তা নিয়ে বিশদভাবে আলোচনা করেছেন ফরাসি উত্তর-কাঠামোবাদী তাত্ত্বিক জিল দুলুজ ও ফিলিক্স গেতারি। দুলুজ ও গেতারির মতে, পরিচিতির স্বার্থে মানচিত্র নিরীক্ষামূলক বই কিছু নয় :
মানচিত্র উন্মুক্ত এবং সবকটি দিক থেকে মানচিত্রের সঙ্গে যুক্ত হওয়া যায়। এটাকে আলাদা করা যায়, উল্টে দেওয়া যায়, নিয়ত পরিবর্তন করা যায়। এটাকে ছেঁড়া যায়, বিপরীত দিকে ঘোরানো যায়, দেয়ালে প্রয়োজনমতো সেঁটে দেওয়া যায়, নতুন করে বানানো যায়; এর সবই করতে পারে ব্যক্তি, গোষ্ঠী বা কোনো সামাজিক শ্রেণি। চাইলে এই মানচিত্রকে দেয়ালে আঁকা যায়, শিল্পকর্ম হিসেবে বিবেচনা করা যায়, রাজনৈতিক কৃতি হিসেবে, বা মগ্নচিন্তন হিসেবে প্রতিষ্ঠা দেওয়া যায়।
( Deleuze and Guattari 1987:12)
মানচিত্রের নমনশীল নকশাকে দুলুজ ও গেতারি গাছের আনুভ‚মিক মৌলকাণ্ডের সঙ্গে তুলনা করেছেন যার ‘সীমানা-ভাঙা পথরেখা’ (২২২) ‘চলার পথে অতি-অর্থবোধক বিরতির বিপরীতে অর্থবিনাশক ফাটল সৃষ্টি করে হয় পূর্বে গঠিত বিন্যাসগুলোকে ভেঙে ফেলে, নয় তো সরাসরি নতুন বিন্যাস তৈরি করে’ (৭-৯)।
ডায়ানা ব্রাইডন দেখিয়েছেন, দুলুজ ও গেতারির – আনুভূমিক মৌলকাণ্ডের একাধিক সংযোগ-সংযোগহীনতার সঙ্গে মানচিত্রের রূপান্তর চিত্রের তুলনা – সমস্যামুক্ত না হওয়া সত্তে¡ও, উত্তর-ঔপনিবেশিক সংস্কৃতিগুলোকে বর্ণনা করার জন্যে এবং উত্তর-ঔপনিবেশিক ডিসকোর্সের বিচিত্র চলচ্ছবির অবস্থান্তরকে গভীরভাবে পর্যবেক্ষণের জন্যে একটি কার্যকর মডেল (Brydon 1988)। অধিকন্তু কানাডা ও অস্ট্রেলিয়ার বেশ কিছু সমসাময়িক নারী লেখক, এঁদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য যেমন নিকল ব্রোসার্ড ও ম্যারিয়ন ক্যাম্পবেল, নারীবাদী মানচিত্রবিদ্যার রূপকল্প গ্রহণ করতে গিয়ে দুলুজ ও গেতারির মডেল ব্যবহার করেছেন এবং পিতৃতান্ত্রিকতার প্রতিনিধিত্বকারী ‘অতি অর্থবোধকতার’ পরিসর থেকে সরে এসেছেন। এবং ‘সীমানা-ভাঙা পথরেখা’র মাধ্যমে একটি বিকল্প মানচিত্র তৈরি করতে চেয়েছেন, যার বৈশিষ্ট্য পরিসরের নিয়ন্ত্রণ বা বিধিনিষেধের নাগপাশ নয়, বরং ধারাবাহিক কেন্দ্রাতিগ স্থানচ্যুতি (দেখুন Godard 1987)। উহ্যত, আনুভ‚মিক মৌলকাণ্ডবিশিষ্ট মানচিত্রের প্রকাশ দেখি কানাডার ক্রাউচ (১৯৭৫) ও বেইলির (১৯৮৬) এবং অস্ট্রেলিয়ার বেইল (১৯৮০) ও মার্নেইনের (১৯৮৪) নিরীক্ষাধর্মী উপন্যাসে, যেখানে দুলিজ ও গেতারির মডেল অবলম্বনে পরিসরকে সারি সারি সংযোগকারী রেখা পরস্পরচ্ছেদ করে আঞ্চলিক সীমানার ধারণাকে যেমন অতিক্রম করে, তেমনি সীমানায় প্রত্যাবর্তন করে। ‘নব্য ঔপন্যাসিকদের’ অনেক উপন্যাসে মানচিত্রকে প্রথমে চিহ্নিত করে, পরে প্যারোডি এবং/ অথবা পরিহাস করে একটি কৃত্রিম সংজ্ঞানির্ভর নির্মিতিতে পৌঁছাতে দেখা যাচ্ছে। এর ফলে একজন লেখক পশ্চিমা অর্থবাচকতার চক্রব্যুহ থেকে বেরিয়ে ব্যাপকভিত্তিক বিনির্মাণে নিয়োজিত হতে পারে… । দুলিজ ও গেতারির মানচিত্রকে ত্রুটিপূর্ণভাবে সমসত্ত্ব (‘আবদ্ধ’) হিসেবে না ধরে যদি মৌলকাণ্ডসদৃশ (‘উন্মুক্ত’) ভাবা হয়, গুরুত্ব তখন বিনির্মাণ থেকে পুনর্নির্মাণ, মানচিত্রের ভাঙন থেকে মানচিত্রের গঠনের দিকে জায়গা বদল করে। দুলিজ ও গেতারির মডেলের ভালো দিক হলো, এটি অন্তর্নিহিতভাবে আধিপত্যবাদী (এবং ঐতিহাসিকভাবে উপনিবেশবাদী) মানচিত্রিক ডিসকোর্সের একটি টেকসই বিকল্প উপহার দিয়েছে। পশ্চিমা সংস্কৃতির ভিত্তিমূলকে স্থিতিশীল করে এবং অন্যান্য সংস্কৃতির পরিপ্রেক্ষিতে তার নিজস্ব সংস্কৃতির অবস্থান ‘স্থির’ করা সাপেক্ষে (আর এভাবে ক্ষমতা নিশ্ছিদ্র রেখে) মডেলটি আনুকরণিক প্রতিনিধিত্ব এবং কাঠামোবাদী পুনর্গঠনের পদ্ধতিগুলোর অনুকরণকৌশলকে কাজে লাগিয়েছে। যখন দেরিদার বিনির্মাণবাদী বিশ্লেষণে ‘কেন্দ্রমুখী’ কাঠামো এবং ‘আগ্রহী’ প্রতিচ্ছবির ধারণা (simulacrum) একটি চ্যুতির প্রক্রিয়ার উদ্ভব ঘটায়, যা ঔপনিবেশিক ডিসকোর্সের কথিত সমসত্ত্বকে অকেজো করে দেয়, তখন দুলিজ ও গেতারির মানচিত্রিক আনুভূমিক মৌলকাণ্ড এই প্রক্রিয়াকে শুধু উত্তর-ঔপনিবেশিক ডিসকোর্সের সহায়ক প্রক্রিয়াগত রূপান্তরের আলোকে দেখে না, উত্তর-ঔপনিবেশিক বিশ্বে বহুসাংস্কৃতিক সমাজগুলোর মধ্যে সীমানা ভাঙার ও সীমানা পুনর্গঠনের জটিল বিন্যাসের আলোকেও দেখে।
স্টিফেন স্তেমন দেখিয়েছেন, উত্তর-ঔপনিবেশিক ডিসকোর্সের অন্যতম কুটপন্থা – সৃজনশীল পরিমার্জনাবাদ (creative revisionism) কীভাবে প্রধান ডিসকোর্সগুলোর পাশা উলটে দেয় বা তাদের স্থানচ্যুত করে (Slemon 1988b)। কিন্তু এই পরিমার্জনার প্রক্রিয়ায় অন্তর্নিহিত রয়েছে উত্তর-ঔপনিবেশিক সংস্কৃতির (বা সংস্কৃতিগুলোর) আত্মসমালোচনা, যা উত্তর-ঔপনিবেশিক সমাজগুলোর ক্রান্তিকালীন পর্যায়কে বিবেচনায় নেয়। একইসঙ্গে এই প্রক্রিয়া আঞ্চলিক পার্থক্যগুলোকে মহত্ব আরোপকারী বা উপেক্ষাকারী অপরিহার্যতাবাদী জাতীয়তাবাদী (essentialist nationalism) মতবাদ এবং সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্যের প্রচার-প্রসারের পরিবর্তে জবরদস্তিমূলক আত্তীকরণে বিশ^াসী, অবিবেচনাপ্রসূত ও (অপ) ব্যবহৃত বহুসংস্কৃতিবাদকে চ্যালেঞ্জ জানায়। উত্তর ঔপনিবেশিক লেখকদের, বিশেষ করে কানাডিয়ান ও অস্ট্রেলিয়ান লেখকদের, মানচিত্রের আদর্শিক রূপের প্রতি প্রবল আকর্ষণ দেখা যায় এবং সেটা দেখা গেছে সৃজনশীল পরিমার্জনাবাদের প্রেক্ষাপটে, যেখানে সংকীর্ণ ও সীমানা-নির্ধারিত ‘মানচিত্রিক’ পরিসরের বিসংগঠনায়ন (desystemization) ঘটে। এর ফলে ঔপনিবেশিক ডিসকোর্সের সাংস্কৃতিক ও ঐতিহাসিক ক্ষেত্রগুলোর সমালোচনার পথ উন্মুক্ত হয়। আবার একই সময়ে, প্রধান ডিসকোর্সগুলো কর্তৃক ইতোপূর্বে নিষিদ্ধ বা অবহেলিত ‘নতুন ভূ-সীমানার’ অন্বেষণ ও উন্মোচন করার কাজে গতি আসে। এখানে স্মরণ করা যেতে পারে, এভাবেই প্রধান ডিসকোর্সগুলো ঔপনিবেশিককালে তাদের কার্যক্রম চালাতো, এবং উত্তর-ঔপনিবেশিক সংস্কৃতিতেও কিছুটা পরিবর্তিত ও পক্ষান্তরিত রূপে তা অব্যাহত রেখেছে। আমি আরো পর্যবেক্ষণ করতে চাই, সমসাময়িক কানাডিয়ান ও অস্ট্রেলিয়ান সাহিত্যে এসব নতুন নতুন ভখণ্ড, যেমন, নারীবাদ, আঞ্চলিকতাবাদ ও জাতিতত্ত্বের নতুন বা পরিমার্জিত বাগাড়ম্বরপূর্ণ পরিসরের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ। প্রাগুক্ত তত্ত্বগুলোর প্রতিটি অন্যান্য তত্তে¡র সাংস্কৃতিক সমালোচনার নিজস্ব দাবি ও নির্ধারিত সীমানাকে অগ্রাহ্য করে মূলত কিছু প্রতি-আখ্যানের প্রতি মনোযোগী হয়েছে। যা হোক, এসব মানচিত্রিক সীমানা/ পরিসরকে পরিবর্তনশীল ক্ষেত্র হিসেবেও বিবেচনা করা যেতে পারে, কারণ এসব ক্ষেত্র নিজেরাই মানচিত্রিক সীমানার ভাঙন ও পুনর্নির্মাণের রূপান্তর প্রক্রিয়ার শিকার। সমসাময়িক অধিকাংশ কানাডিয়ান ও অস্ট্রেলিয়ান সাহিত্যে বাস্তব এবং/ অথবা অনুভূত সীমানা অতিক্রম করে এবং ভৌগোলিক স্থানাংকগুলোকে পুনর্বার সাজিয়ে উপস্থাপন করার ফলে স্থানিক রেফারেন্সের ব্যাপক বিস্তৃতি ঘটেছে। এতে দুটো ফলাফল দৃশ্যমান : প্রথমত, মানচিত্রিক সংযোগ ও স্থানের সাময়িকত্বের ওপর গুরুত্বারোপ করা হয়েছে, এবং দ্বিতীয়ত, ঔপনিবেশিক আখ্যান যে সত্তাতাত্ত্বিক ও জ্ঞানতাত্ত্বিক ‘স্থিতিশীলতা’কে এগিয়ে নিতে এবং নিরাপদ রাখতে চায়, তার উত্তর-ঔপনিবেশিক প্রত্যুত্তরে এবং/ অথবা প্রতিক্রিয়ার প্রেক্ষাপটে উপর্যুক্ত সাহিত্যগুলো ক্রমবর্ধমান বৈচিত্র্যের ওপর মনোনিবেশ করেছে। অতএব, আমি এ-সিদ্ধান্তে আসতে চাই, বিশেষত সমকালীন কানাডিয়ান ও অস্ট্রেলিয়ান সাহিত্যে এবং সাধারণত, উত্তর-ঔপনিবেশিক সাহিত্যে মানচিত্রবিদ্যাকে সম্পূর্ণরূপে একটি বিশেষ স্থানিক দৃষ্টান্তের পুনঃপরিমার্জিত রূপ হিসেবে না দেখাই ভালো, বরং একে গুচ্ছ গুচ্ছ সৃজনশীল পরিমার্জনাচর্চার ফসল বলা ভালো, যা একটি উপনিবেশবাদী কাঠামো থেকে উত্তরণ বোঝায়, যার মধ্যে থেকে একজন লেখককে ঔপনিবেশিক পরিসরের বিধিনিষেধগুলোকে পুনঃসৃজন করতে হয় এবং ভাবতে হয় তাবৎ বিধিনিষেধ নিয়ে। তার অভীষ্ট গন্তব্য হলো সেই উত্তর ঔপনিবেশিক পরিসর; সেখান থেকে লেখক/ লেখিকা ‘রাষ্ট্রীয় ভূখণ্ডসংক্রান্ত বিবাদগুলোকে’ মোকাবিলা করার স্বাধীনতা অর্জন করেন। বিবাদগুলোই প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে স্বীকার করে নেয়, স্থানিক (এবং অনুরূপ যুক্তিতে, সাংস্কৃতিক) বোধের প্রকরণ একান্তভাবে আপেক্ষিক।
তাই মানচিত্র যেমন এক অর্থে ঔপনিবেশিক ডিসকোর্সের একটি উদাহরণ হিসেবে কাজ চালিয়ে যেতে থাকে, তেমনি এর বিনির্মাণ এবং/ অথবা পুনর্দৃশ্যায়ন ঔপনিবেশিক (এবং অন্যান্য আদিপত্যবাদী ডিসকোর্সের) প্রক্রিয়াগুলোর ‘বিচিহ্নায়ন’ (disidentification) করার পথ উন্মুক্ত করে দেয়। তাছাড়া মানচিত্র সাংস্কৃতিক বি-উপনিবেশিকায়নের চলমান প্রক্রিয়ার সঙ্গে পুনঃসংযোগ ঘটিয়ে দেয়। অতএব বলা যায়, ‘মানচিত্রিক সংযোগ’ সামাজিক ও সাংস্কৃতিক পরিবর্তনের জন্য উত্তর-কাঠামোবাদ ও উত্তর-ঔপনিবেশিক – এই দুই প্রতিদ্বন্দ্বী তত্ত্বের মধ্যে একটি ‘সাময়িক সংযোগসূত্র’ হিসেবে ভূমিকা রাখতে পারে।
ভাষ্যর টীকা
১. Garcia Marquez, Edited and Introduced by Robin Fiddian, London; New York; Longman, 1955.
২. উইলিয়াম হ্যারিস, গায়ানিজ কবি ও ঔপন্যাসিক। তাঁর বিখ্যাত উপন্যাসগুলোর মধ্যে রয়েছে The Carnival Trilogy (Carnival, The Infinite Rehearsal, The Four Banks of the River of Space), The Guyana Quartet, The Ghost Memory ইত্যাদি।
তথ্যসূত্র
1. Wilson Harris (1981), Explorations : A Selection of Talks and Articles 1966- 1981, ed. Hena Maes-Jelinek, Mundelstrup : Dangaroo Press.
2. Jack Hodgins (1977), The Invention of the World, Toronto : Macmillan.
3. David Malouf (1985), 12 Edmonstone Street, London : Chatto & Windus.
4. Aritha Van Herk (1986), No Fixed Address, Toronto : McClelland & Stewart.
5. Margaret Atwood (1985), The Handmaid’s Tale, Toronto : McClelland & Stewart.
6. Gilles Deleuze and Felix Guattari (1987), A Thousand Plateaus : Capitalism and Schizophrenia, trans. B. Massumi, Minneapolis: University of Minnesota Press.
7. Diana Brydon (1988), ‘Tropo Agitato : Reading and Writing Cultures in Randolph’s Stow’s Visitants and Rudy Wiebe’s The Temptations of Big Bear’, Ariel 19(1) :13-32.
8. Barbara Godard (1987), ‘Mapmaking’, in B. Godard (ed.) Gynocritics: Feminist Approaches to writing by Canadian and Quebecoise Women’s Writing, Toronto: ECW Press.
Leave a Reply
You must be logged in to post a comment.