১৯৪৭-এর দেশ-বিভাগের পর পাকিস্তান রাষ্ট্রকে সংহত করার প্রয়াসে একটি পাকিস্তানি ভাষা-সংস্কৃতি গড়ে তোলার উদ্যোগ ছিল লক্ষণীয়। এর জন্য প্রয়োজন হয়েছিল বাঙালির ভাষা ও

সংস্কৃতিকে খণ্ডিত করে ইসলামীকরণ। ১৯৪৭-৪৮ সালে বাংলাকে আরবি হরফে লেখা এবং পূর্ব বাংলার

প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শিক্ষায় আরবির প্রাধান্য আনার ঘোষণা ছিল এই উদ্যোগেরই অংশ। এসব ষড়যন্ত্রকে গ্রহণযোগ্য করার জন্য বাংলা অক্ষরে লেখাকে, বিশেষত অক্ষরের আধিক্য, ওর সঙ্গে বহুসংখ্যক যুক্ত অক্ষরের সংযুক্তি এবং স্বরবর্ণকে আকারাদি প্রভৃতি চিহ্ন দিয়ে লেখা – এসবকে বাংলা বর্ণের দুর্বলতা ও সীমাবদ্ধতা হিসেবে প্রচার করা হয়েছিল। অথচ ১৭৪০-এর দশকে শ্রীরামপুরে বাংলা মুদ্রণযন্ত্রের প্রচলনের পর ২০০ বছরে বাংলা বর্ণের বিকাশ তখন একটি সংহত রূপ লাভ করেছিল।

এসব ভাবনার সঙ্গে গভীরভাবে যুক্ত ছিল যন্ত্র, বিশেষত টাইপ-রাইটারের ব্যবহার। ১৯৫০-এর দশকেই টাইপরাইটারের ক্ষেত্রে খ্যাতিমান প্রতিষ্ঠান রেমিংটন বাজারে বাংলা টাইপরাইটার নিয়ে আসে। এর দু-রকমের কী-বোর্ডের প্রতিটিতেই ৪৬টি করে বোতাম (শবু) ছিল এবং তা দিয়ে প্রায় ১০০টি বর্ণ (পযধৎধপঃবৎ) টাইপ করা যেত। এর প্রথম কী-বোর্ডে কোনো যুক্তবর্ণ ছিল না, তবে ‘শ্রী’ টাইপ করা যেত। পরেরটিতে আটটি যুক্তবর্ণের জন্য পৃথক বোতাম ছিল – ক্ষ, ঙ্ক, দ্দ, ণ্ড, ম্প, ন্ব, ল্ব, দ্ব। এছাড়া ছিল যুক্তাক্ষর তৈরির জন্য বেশ কয়েকটি বর্ণাংশ, স্বরবর্ণের পাশাপাশি আকারাদি, ১ থেকে ১০ পর্যন্ত বাংলা গাণিতিক চিহ্ন এবং গণনার প্রাচীন চিহ্ন (/. ৯. ৯. ।.) প্রভৃতি। কিন্তু বাংলা যুক্তাক্ষরকে ধারণ করার ক্ষমতা ওই কী-বোর্ডেরও ছিল না; বিশেষত যুক্তাক্ষর টাইপে হসচিহ্নের বারংবার ব্যবহার এর গতিকে সীমিত করে দিয়েছিল।

এসব সীমাবদ্ধতা দূরীকরণে বেশ কজন পণ্ডিত নানা পরামর্শ নিয়ে এগিয়ে আসেন। এঁদের একজন আলী আহমদ খান। তিনি কিছু বর্ণ ও চিহ্ন বিলোপ করে একরকম ‘সহজ বাংলা’র প্রস্তাব করেন। যেমন শ্রোতা > শরওতা, বিস্মিত > বইসমইতঅ

প্রভৃতি। এতে কী-বোর্ড সহজ হলো, কিন্তু বাংলার প্রচলিত লিখনরীতি বিপর্যস্ত হয়ে পড়ল এবং শব্দের বোধগম্যতা হারিয়ে গেল। উচ্চপদস্থ পুলিশ কর্মকর্তা ও লেখক আবুল হাসনাত প্রস্তাব করলেন, যুক্তাক্ষর ভেঙে হসন্তনির্ভর এক নতুন লিখন পদ্ধতির; যেমন প্রকম্পিত > র্পকম্পীত, ব্রহ্মাণ্ড > র্বহ্মাণ্ড

প্রভৃতি। শিক্ষা-বিশেষজ্ঞ অধ্যক্ষ ওসমান গণী ‘অ’-এর স্থলে নতুন বর্ণ তৈরির প্রস্তাব করেন। শিক্ষাবিদ ফেরদৌস খান কয়েকটি বর্ণ (ঞ ণ য ষ ৎ ং ঃ) বিলোপের এবং ১৬টি বর্ণের (ক ঙ ল চ প্রভৃতি) প্রচলিত রূপ পরিবর্তনের প্রস্তাব করেন। কিন্তু এর কোনো প্রস্তাবের দ্বারাই বাংলা টাইপযন্ত্র একটি আদর্শে সংস্থিত হতে পারছিল না।

ওই প্রেক্ষাপটেই কেন্দ্রীয় বাংলা উন্নয়ন বোর্ড বাংলা টাইপরাইটারের একটি ব্যবহারকারীবান্ধব সংস্করণ তৈরির উদ্যোগ নেয়। বোর্ডের তৎকালীন পরিচালক অধ্যাপক মুহম্মদ এনামুল হকের আগ্রহে ১৯৬৩ সালে মুনীর চৌধুরীকে এই দায়িত্ব অর্পণ করা হয়। এর কারণ হিসেবে এনামুল হক বলেন যে, মুনীর চৌধুরী ‘… possesses not only a systematic training in Bengali, English and Linguistics, but also have fine skill in both English and Bengali typing’। এনামুল হক স্পষ্ট করেই বলেছিলেন যে, বাংলা টাইপরাইটারের সুবিধার কথা বলে অনেকে বাংলা বর্ণমালাকেই বদলে ফেলতে চাইছে; কেননা বাংলা ভাষার প্রতিভা (genious) সম্পর্কে তারা অজ্ঞ।

মুনীর চৌধুরী প্রথমে বাংলা বর্ণমালার বৈচিত্র্য উদ্ঘাটনের প্রয়াস নেন। তাঁর তালিকা অনুসারে বাংলায় ১১টি স্বর ও ৪০টি ব্যঞ্জনবর্ণের ব্যবহার রয়েছে। এখানে ‘ক্ষ’-কে তিনি একটি পৃথক বর্ণরূপে বিবেচনা করেছেন। কিন্তু এসব বর্ণ যখন যুক্তাক্ষরের অংশ হয় তখন এর দৃষ্টিগ্রাহ্য রূপ বহুমাত্রিক। এর মধ্যে উ, ক, ত এবং ম-এর পাঁচটি করে রূপ এবং গ এবং ন-এর চারটি করে রূপ আছে। আরো অনেক বর্ণেরই যুক্তাক্ষরের অংশ হিসেবে এরকম বহুরূপ পাওয়া যায়। তবে খ, ঘ, ঠ, ঢ, ড়, ঢ়, ফ, য়-র যুক্তাক্ষরে কোনো পৃথক রূপ নেই। এই যুক্তাক্ষরের বহুমুখী চেহারাকে মূর্ত করে তোলাই বাংলা টাইপরাইটারের মূল চ্যালেঞ্জ। কেননা মোট ৯২টা (৪৬ী২) চিহ্নের মধ্যে সমস্ত অক্ষর ও যুক্তাক্ষরকে ধারণ করতে হবে।

একটি গতিশীল যন্ত্রের জন্য অক্ষর ও যুক্তাক্ষর ব্যবহারের পৌনঃপুনিকতা (frequency) নির্ধারণ অপরিহার্য। এই কাজের জন্য মুনীর চৌধুরী সহযোগী হিসেবে নেন সোহ্রাওয়ার্দী কলেজ (তৎকালীন কায়দে আজম কলেজ)-এর গণিতের প্রভাষক আবদুল হালিম (পরবর্তীকালে ইতিহাসবিদ রূপে খ্যাতনামা) এবং বাংলা একাডেমির রিসার্চ-স্কলার মমতাজ বেগমকে (পরে সরকারি কলেজে বাংলার অধ্যাপক)। এই পরিসংখ্যান তৈরির জন্য তাঁদেরকে নিম্নোক্ত আটটি পাঠ দেওয়া হয় :

প্রমথ চৌধুরী : ‘সাহিত্যে খেলা’,

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর : ‘কৌতুকহাস্য’,

মুহম্মদ আবদুল হাই : ‘আমাদের

বাংলা উচ্চারণ’,

ইব্রাহীম খাঁ : ‘পত্রালাপ’, এবং

ইত্তেফাক-এর একটি সম্পাদকীয়, একটি কলাম (রাজনৈতিক মঞ্চ) ও দুটি চিঠি।

এই তালিকা থেকে স্পষ্ট যে, মুনীর চৌধুরী বাংলা ভাষার মূল প্রবণতাগুলির বর্ণবৈশিষ্ট্যও দেখতে চেয়েছিলেন। এর মধ্যে রয়েছে বাংলা ভাষার শ্রেষ্ঠ লেখক, চলতি বাংলার অনুশীলনকারী, পূর্ব বাংলার প্রমিত ভাষা ব্যবহারকারী ও আরবি-ফারসিবহুল বাক্য ব্যবহারকারী, সংবাদপত্রের সম্পাদকীয়ের গম্ভীর ভাষা ও জনপ্রিয় কলাম এবং সাধারণ লোকের প্রাত্যহিক ভাষায় চিঠি।

আবদুল হালিম ও মমতাজ বেগম আটটি পাঠেরই পৌনঃপুনিকতা অনুসারে বর্ণ-বিন্যাস করেন। সজ্জার ক্রম ছিল বেশি ব্যবহার থেকে অল্প ব্যবহারের নিরিখে। পাঠগুলোকে পৃথকভাবে বিবেচনা করলে  প্রতিটি ক্ষেত্রেই দেখা যায় যে, সর্বাধিক ব্যবহৃত চিহ্ন হচ্ছে ‘ া ’ (আকার)। পাঁচটি পাঠে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ব্যবহার ‘ ে ’ (একার)-এর; এরপরই বেশি ব্যবহৃত হয়েছে ‘র’। কম ব্যবহারের দিকে রয়েছে ঢ়/ ঢ, ঠ, ড, খ, ঝ। এই আটটি পাঠে মোট ব্যবহৃত বর্ণ ও চিহ্নের সংখ্যা ছিল ৬৩৯১টি। সামগ্রিক বিচারে এর সর্বোচ্চ ব্যবহৃত আটটি বর্ণের অবস্থান নিম্নরূপ :

া = ৩৫৩৮ বার

ে = ২৪২১ বার

র = ২১২৩ বার

ি = ১৬৮৯ বার

ক = ১৫২৪ বার

ন = ১৩৯২ বার

ব = ১০৮৮ বার

ত = ১৩৮০ বার।

অন্যদিকে সর্বনিম্ন ব্যবহৃত চারটি বর্ণ হচ্ছে –

ঋ = ২ বার

ঈ = ৩ বার

ঢ় = ৩ বার

ট = ৩ বার।

যুক্তাক্ষরের ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ ব্যবহার ‘ক্ষ’- এর (৯৩ বার); এরপর যথাক্রমে ক্ত (৪৭ বার), ষ্ট (৪৬ বার), ত্ত (৩৭ বার), ন্তু (৩৭ বার) ও ঙ্গ (৩৬ বার)। অন্যদিকে ১৬টি যুক্তাক্ষর ব্যবহৃত হয়েছে মাত্র একবার করে (ক্ব, ক্ক, গ্ন, জ্জ, দ্দ, ব্ব, ল্ম, স্ম, হ্র, ঙ্গ, ঙ্ঘ, ণ্ড, ণ্ঠ, ঞ্চ, স্থ, সø)।

এসব পরিসংখ্যানের ভিত্তিতে মুনীর চৌধুরী ৪২টি বোতাম (key) সম্পন্ন একটি বাংলা টাইপরাইটারের প্রস্তাব করেন। এর স্তর বা চরণসংখ্যা হবে চারটি; চার চরণে মোট বর্ণ বা চিহ্ন থাকবে ৪২টি। তবে বিশেষ বোতাম ব্যবহার করে এর দ্বারা মোট  ৮৪টি বর্ণ বা চিহ্ন টাইপ করা যাবে। ওর মধ্যে রয়েছে ১ থেকে ০ পর্যন্ত বাংলা গাণিতিক সংখ্যা, ছয়টি স্বরবর্ণ এবং ক্ষ-সহ ৩৫টি ব্যাঞ্জনবর্ণ। লক্ষণীয়, স্বরবর্ণের মধ্যে আ, ই, উ, ঐ এবং ঔ-র জন্য পৃথক বোতাম নেই। অ, হ, ড, এ এবং ও-র সঙ্গে চিহ্ন যুক্ত করে ওই বর্ণগুলো টাইপ করা হবে। আবার ব্যঞ্জনবর্ণের মধ্যে ক, ট, ড় এবং ঢ়-এর জন্যও পৃথক বোতাম নেই। এগুলিও একইভাবে টাইপ করা হবে। ঊর্ধ্বকমা, কমা, ফুলস্টপ বা বিন্দু, রেফ, হসন্ত, ড্যাশ, ব্রাকেট, র-ফলা এবং আকারাদির জন্য পৃথক বিকল্প বোতাম রয়েছে। এছাড়াও যুক্তাক্ষর তৈরির জন্য রয়েছে ক্ষুদ্রাকৃতির ল, ন, ব, ত, স, ষ, ম প্রভৃতি। এর সঙ্গে রয়েছে গণিতের চার/ আটটি চিহ্ন। সব ক্ষেত্রেই বেশি ব্যবহৃত বর্ণগুলিকে রাখা হয়েছে নিচের দিকে (lower case) এবং কম ব্যবহৃতগুলি ওপর দিকে (upper case)। এর ফলে পৌনঃপুনিকতা বিবেচনায় টাইপের গতি অনেক বাড়বে। এছাড়া তুলনামূলকভাবে কম বোতাম টিপে যুক্তাক্ষর টাইপ করা যাবে। এসব সিদ্ধান্তকে বিবেচনায় নিয়ে কী-বোর্ডের একটি মডেল তৈরি করেন তৎকালীন ডিজাইন সেন্টারের শিল্পী আবদুল মুকতাদির (পরে খ্যাতনামা চিত্রকর)। এইভাবে তৈরি হলো মুনীর অপটিমার কী-বোর্ড। সেই কী-বোর্ড ধারণ করে চালু হলো নতুন বাংলা টাইপযন্ত্র।

Leave a Reply