বাংলাভাষাচর্চা : পশ্চিমবঙ্গ বাংলা আকাদেমির কিছু কাজকর্ম

১. ভাষা-শহিদ দিবসের রুটিন আর কর্তব্য

শুরুটা করি পাশির্^ক প্রসঙ্গ দিয়ে – ভাষাশহিদ দিবস।  আর সেইসঙ্গে বলি যে, এ-লেখাটি কিছুটা অনাচারিক বা ‘ইনফরমাল’ ভঙ্গিতে লিখছি, কারণ এতে ইতিহাসের তথ্যের সঙ্গে কিছুটা ভাষাশহিদ দিবস নিয়ে ব্যক্তিগত উদ্‌বেগও থাকবে।  তার প্রধান কারণ, এ-লেখার লক্ষ্য বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে সাধারণ পাঠকও। ২১শে ফেব্রুয়ারি ভাষাশহিদ দিবস (পরে কানাডাপ্রবাসী বাঙালি দুই নাগরিকের উদ্যোগে এবং বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বাংলাদেশ সরকারের প্রচেষ্টায় আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস) একদিকে (দ্র. সরকার, ২০০৩ : ২০৩-২১০), অন্যদিকে ১৯শে মে আর এক ভাষাশহিদ দিবস – দুটো উপলক্ষই, ইংরেজি ক্যালেন্ডারের দুই পরিসরে আমাদের বেশ খানিকটা মনোযোগ দাবি করে। 

প্রথমটি তো বাংলাদেশে বিপুল আবেগে উদ‌্‌যাপিত হয়, পশ্চিমবঙ্গে বা অন্য বঙ্গভাষী অঞ্চলেও তার স্মরণ ব্যাপকভাবেই ঘটে।  দ্বিতীয় তারিখটা তুলনায় কিছুটা পাশির্^ক হয়ে থাকে; কিন্তু আসামের বঙ্গভাষী অঞ্চলে আর পশ্চিমবঙ্গে তার অনেকটা আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি ঘটে। বলা বাহুল্য, ইতিহাসবিদের কাছে দুটি তারিখের প্রশাসনিক-রাজনৈতিক পরিণাম এক নয়।  প্রথমটি থেকে একটি স্বাধীন গণপ্রজাতন্ত্রী দেশের জন্ম হয়েছে, ভাষার আন্দোলন থেকে স্বাধীনতার আন্দোলন আর স্বাধীনতালাভের পৃথিবীতে একমাত্র দৃষ্টান্ত সেটি।  দ্বিতীয়টির সাফল্য অত চমকপ্রদ নয়, ভারতের একটি প্রদেশের একটি অংশের বাঙালিরা তাদের মাতৃভাষার মান্য রূপের১ সরকারি স্বীকৃতি পেয়েছে। বছরের অন্যান্য দিন আমরা কী করি, বাংলাভাষা নিয়ে কতটা ব্যস্ত বা ব্যাকুল থাকি, তার পুরো আলোচনার স্থান এটা নয়।  কিন্তু অনেকেই মনে করেন সে আলোচনাও বিশেষ জরুরি, কারণ অন্তত ভারতে, যেখানে একদিকে ইংরেজি আর অন্যদিকে হিন্দির আধিপত্য বাংলাভাষার নিজস্বতা আর অধিকার রক্ষার ক্ষেত্রে সমস্যা তৈরি করছে। 

 এই শহিদ দিবস দুটিতে আয়োজিত নানা আলোচনাও সাধারণত মামুলি পথ ধরে চলে। অতিমারির সময়টাতে ব্যতিক্রম হয়েছে, কিন্তু ওই দুটি দিনে সাধারণভাবে প্রভাতফেরি, স্কুলে-কলেজে উৎসব (বাংলাদেশে যদিও শোকের দিন হিসেবে পালিত হয় সাধারণত), সন্ধেয় সভা ও আলোচনা হয়, বক্তারা সভাশেষে মিষ্টির প্যাকেট আর গলার নতুন চাদর নিয়ে বাড়ি ফেরেন। আলোচনাও চলে দুটি দিক ধরে, অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যৎকে ছুঁয়ে – ইতিহাসচর্চা, এখন বাংলাভাষার অবস্থা, এবং সকলকে ভাষাকে ভালোবাসার উপদেশদানে তার বিস্তার দেখি।  বছর বছর এর পুনরাবৃত্তি হয়, আমরাও এক কথা বলতে বলতে ক্লান্ত হয়ে যাই। দুটি দিনেরই ইতিহাস নিয়ে প্রচুর চর্চা হয়েছে, প্রথমটি সম্বন্ধে তো অজস্র বই বেরিয়েছে, কোষগ্রন্থও তৈরি হচ্ছে বাংলাদেশে। বছরের বাকি সময়ের যাপনে এই সব কথা, ভাষা নিয়ে তীব্র চেতনা আমরা কতটা বজায় রাখি তা বিতর্কিত প্রসঙ্গ। দুটি দেশেই নব্য-উদারবাদের প্রভাবে ইংরেজি-মাধ্যম শিক্ষাদানের প্রতি মধ্যবিত্তদের প্রবল আসক্তি তৈরি হয়েছে, সাম্রাজ্যবাদের স্মৃতি সেই আসক্তির গোড়ায় জলসেচন করেছে।  আমরা অন্যত্র বলেছি যে, মাতৃভাষায় সব শিক্ষার ব্যবস্থা করেও ইংরেজি শক্তপোক্তভাবে শেখানো সম্ভব (সরকার, ২০২১)। এই বিতর্ক চলছে। অবশ্যই আমি সাধারণ মধ্যবিত্ত ও উচ্চতর স্তরের নাগরিকদের প্রবণতার কথা বলছি।  তারই পরিপ্রেক্ষিতে বাঙালির নতুন প্রজন্মকে ভাষা-আন্দোলন তথা স্বাধীনতা-আন্দোলনের ইতিহাস জানানোর একটা দায় অবশ্য পূর্বসূরিদের থেকেই যায়। সে-কাজ করার একটি বাহিনী নিশ্চয়ই তৈরি হয়েছে। কিন্তু ইতিহাস জেনে, গৌরবময় ইতিহাসের পুজো করেই তো আমাদের কাজ শেষ হয়ে যায় না। অতীতের সশ্রদ্ধ স্মরণ আর উদ্‌যাপন থেকে ভবিষ্যতের সংকল্প আর কর্তব্যেও আমাদের পৌঁছাতে হবে, ভাষার প্রতি একই ভালোবাসা নিয়ে। বাংলা ভাষা নিয়ে আমরা বাঙালিরা কী করব, তাকে রক্ষা করব, না অন্য ভাষার আক্রমণে নানা বিপন্নতার মুখে ঠেলে দেব – সেসব বিষয়ে গুরুতর চিন্তা করার দায়িত্বও আমাদের ওপর বর্তায়। এই সব উদ্দেশ্য নিয়ে পশ্চিম বাংলায় কিছু সংগ্রামী সংগঠনও তৈরি হয়েছে, তারাও এই গুরুত্বপূর্ণ কাজগুলি করছে। আশা করি ঢাকাতেও এরকম সংগঠন কিছু আছে। বাংলা মুখের ভাষা, লেখার ভাষা দুই-ই আমাদের লক্ষ্য হওয়া উচিত।

লেখার ভাষার একটা সীমাবদ্ধ গণপরিসর বা পাবলিক স্ফিয়ার আছে, যেখানে দোকানের সাইনবোর্ড, বিজ্ঞপ্তি-বিজ্ঞাপন, হাতে বিলি করার প্রচারপত্র ইত্যাদি লেখা হয়। তাতে দোকানের নামপাটায় ইংরেজির আধিপত্য বেশি হচ্ছে, হয়তো রাজধানী শহরে এর প্রকোপ বেশি। এ নিয়ে কলকাতায় একসময় আন্দোলন হয়েছিল। যে-সংগঠনগুলির কথা বললাম সেগুলি তো আছেই – পশ্চিম বাংলায় ‘নবজাগরণ’ (এখন প্রায় মুমূর্ষু), ‘ভাষা ও চেতনা সমিতি’, ‘বাংলা পক্ষ’  ইত্যাদি যেমন, বা খুবই সক্রিয় নীতিশ বিশ^াসের ‘ঐকতান গবেষণা সংসদ’ ইত্যাদি সংগঠন নানা আন্দোলন, সম্মেলন প্রকাশনা ইত্যাদি করে বাংলা ও বাংলাভাষীদের বিপন্নতা সম্বন্ধে জনসাধারণের চিত্তকে সতর্ক রাখার নিরন্তর চেষ্টা করে চলেছেন।  সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের নেতৃত্বে ‘নবজাগরণ’ কলকাতায় দোকান আর কোম্পানিগুলিতে সাইনবোর্ডে বাংলাভাষার আংশিক স্থান আদায় করতে পেরেছিল, এখন তার স্মৃতিও ধূসর হয়ে আসছে।  অন্তত ভারতে এই ধরনের চেষ্টার দরকার আছে, কারণ ভারতে ইংরেজি ও হিন্দি দুটি আধিপত্যকারী ভাষা বাংলাভাষীদের ভাষিক আচরণ আর ভাষাদৃষ্টি নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা করে।  বাংলাদেশে এ-ধরনের প্রতিষ্ঠান আছে কি না বা থাকার প্রয়োজন তৈরি হয়েছে কি না, আশা করি বাংলাদেশের বন্ধুরা সে-বিষয়ে আমাকে শিক্ষিত করবেন।

২. এ-নিবন্ধের মূল লক্ষ্য

কিন্তু আমার এই প্রবন্ধ আন্দোলন, প্রতিবাদ, প্রতিরোধের কর্মকাণ্ড বিষয়ে নয়। মুখের ভাষাও প্রাথমিকভাবে এর লক্ষ্য নয়। ভাষা নিয়ে কাজ করার আরো কিছু জরুরি পরিসর আছে, একটি হলো, সাইনবোর্ড ইত্যাদির বাইরে লিখিত বাংলা ভাষার ব্যাপক ক্ষেত্র।  সেখানে এই কাজগুলি স্থায়ী এবং পরিবর্তনমুখী। যেমন, তার বর্ণমালা বা লিপিপদ্ধতিকে শেখা পড়া আর লেখার জন্য সহজ করা, বানানের জটিলতা দূর করে তাতে সমতা আনা, মুদ্রণব্যবস্থাকে বিজ্ঞানসম্মত করা ইত্যাদি।  এগুলি দীর্ঘপোষিত অভ্যাস ও সংস্কারের গায়ে হাত দেয় তাই এগুলি নিয়ে নানা বিতর্কও ওঠে। এই কাজগুলির ইংরেজি নাম language planning, বাংলায় ভাষা-পরিকল্পনা। কিন্তু মনে রাখতে হবে, এগুলিরও লক্ষ্য পুরো ভাষাটার২ পরিবর্তন বা সংস্কার নয়, মূলত লিখিত প্রমিত বাংলা, যা লেখাপড়া শিখতে গেলে আমাদের সবাইকে শিখতে হয়, পুরুলিয়া থেকে চট্টগ্রাম, কোচবিহার থেকে খুলনা বা দক্ষিণ ২৪ পরগনা – যে-উপভাষাক্ষেত্রেই জন্মাই না কেন।  আগেই বলেছি, বাঙালি দুবার প্রাণ দিয়েছে তার প্রমিত ভাষার জন্য, আর এই প্রমিত ভাষা যাতে তার লিখিত রূপে তার জন্য নির্দিষ্ট সমস্ত কাজের যোগ্য হয়ে ওঠে, তার জন্যই দরকার হয় ভাষা-পরিকল্পনা (দ্র. সরকার, ১৮৯৮ : ৩০-৪২)।  এ নিয়ে অনেকের অনেক রকম সংজ্ঞা, শ্রেণিনির্দেশ, কর্তব্যনির্ধারণ ইত্যাদি আছে। তবে আমরা ক্লস (Kloss, ১৯৬৯, দ্র. Klein, ১৯৯৭) বলে একজন বিশেষজ্ঞের সরল বিভাজন গ্রহণ করে বলি যে, ভাষা-পরিকল্পনা দুটো ধাপে চলে। এক হলো ‘স্টেটাস প্ল্যানিং’, অর্থাৎ ভাষাটির ভূমিকা (রাষ্ট্রভাষা, শিক্ষার ভাষা, আইনের ভাষা ইত্যাদি – হয়তো সব একসঙ্গে) একটা স্থির করা, আর  পরেরটা হলো ‘করপাস প্ল্যানিং’ – ওই ভূমিকার জন্য ভাষাটিকে প্রস্তুত করা।  তার জন্য যা যা দরকার তা হলো – ব্যাকরণ তৈরি, নতুন শব্দ নির্মাণ এবং দরকার হলে অন্য ভাষা থেকে ঋণগ্রহণ, অভিধান নির্মাণ, নানা বিদ্যার পরিভাষা নির্মাণ, বানানের সমতাবিধান, লিপি ও হরফ সংস্কার ইত্যাদি। বাংলা ভাষার স্টেটাস বা ভূমিকা আগেই নির্ধারিত হয়েছিল (পূর্ব পাকিস্তানে অন্যতম রাষ্ট্রভাষা, পশ্চিমবঙ্গে রাজ্যের প্রশাসনিক ভাষা, পরে বাংলাদেশ নামক স্বাধীন রাষ্ট্রের রাষ্ট্রভাষা) – এবার তাকে আরো যোগ্য করার জন্য উপাদান-পরিকল্পনার ওই কাজগুলি দরকার হলো। অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের (বিশ^বিদ্যালয়, সাহিত্য পরিষদ) গুরুত্ব কিছুটা কমিয়ে পূর্ব বাংলায় (তখনকার পূর্ব পাকিস্তানে) বাংলা একাডেমির ওপর তার মূল দায়িত্ব ন্যস্ত হলো। প্রায় তিরিশ বছর পরে, পশ্চিম বাংলায় বাংলা আকাদেমির ওপর।  বলা বাহুল্য, এই শেষের প্রতিষ্ঠানগুলির কাজ আসলে করবেন বিশেষজ্ঞরা৩, রাষ্ট্র যাঁদের আমন্ত্রণ বা নিযুক্ত করবেন। অন্যান্য প্রতিষ্ঠানও কমবেশি ওই বিশেষজ্ঞদেরই সাহায্য নিত, এ-কথাও ঠিক। 

আমাদের এই নিবন্ধের মূল লক্ষ্য, পশ্চিমবঙ্গ বাংলা আকাদেমি (প্রতিষ্ঠা ১৯শে মে, ১৯৮৬) বাংলা ভাষা নিয়ে যে কিছু কাজ করতে শুরু করেছিল, সে-সম্বন্ধে বিশ^ব্যাপী বাঙালি পাঠকদের কিছু খবর জানানো। এই ইতিহাস এখন পর্যন্ত তেমনভাবে নথিবদ্ধ হয়নি। এতে প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে ব্যক্তির কথাও আসবে। ঢাকার বাংলা একাডেমির এই বিষয়ে কাজের ইতিহাসও ওদিক থেকে যুক্ত হওয়া দরকার (রহিম, ২০১৭-তে যা আছে তা পূর্ণাঙ্গ নয়)। 

৩. একাডেমি ও আকাদেমির কাজ

একাডেমিগুলির কাজের কিছু সীমানা আর সূত্র নানা দেশের একাডেমিগুলির কাজ থেকে নির্দিষ্ট হয়ে গেছে। তবে পরিবেশ অনুসারে তার হেরফের হতেই পারে। ইউরোপের জনশিক্ষার হার সেখানকার একাডেমিগুলির কাজের যে লক্ষ্য নির্দেশ করবে, আমাদের দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলিতে তা ভিন্ন হতে বাধ্য। তার ওপর আধুনিক জ্ঞানের উৎপাদন থেকে রপ্তানির গতি যেহেতু পশ্চিম দেশগুলি থেকে পুবের দেশগুলির অভিমুখে, তাই অনুবাদকর্ম আমাদের একাডেমি বা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের পক্ষে যতটা গুরুত্বপূর্ণ, পশ্চিমের একাডেমিগুলিতে ততটা নয়।  সেই হিসেবে দেখি, ঢাকার বাংলা একাডেমি প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল ভাষা-আন্দোলনের চাপে – তৎকালীন পাকিস্তান সরকার বাঙালিদের ক্ষোভ প্রশমনের জন্য ১৯৫৫ সালে এই প্রতিষ্ঠান স্থাপন করেছিল। কিন্তু সেই একাডেমি তার কাজ যোগ্যভাবেই সম্পাদন করে চলেছে। পশ্চিমবঙ্গ বাংলা আকাদেমির প্রতিষ্ঠা হয় ২০শে মে, ১৯৮৬ তারিখে। প্রয়াত লেখক ও মনীষী স্বনামধন্য অন্নদাশঙ্কর রায় (১৯০৪-২০০২) তখনকার মুখ্যমন্ত্রী জ্যোতি বসুকে (১৯১৪-২০১০) অনুরোধ করেছিলেন বাংলা ভাষা ও সাহিত্যবিষয়ক একটি একাডেমি স্থাপনের জন্য। সেটা পশ্চিম বাংলার তখনকার বুদ্ধিজীবীদের সমবেত আকাক্সক্ষার প্রতিফলন বলা যায়।  যতদূর মনে পড়ে, শঙ্খ ঘোষ (১৯৩২-২০২১), শুভেন্দুশেখর মুখোপাধ্যায় প্রমুখ একাধিক বুদ্ধিজীবী (পশ্চাতে এই লেখকও ছিলেন) শ্রী রায়কে তাঁদের হয়ে জ্যোতিবাবুকে এই প্রার্থনা জানানোর জন্য অনুরোধ করেছিলেন। অন্নদাশঙ্করের নিজের আগ্রহও কম ছিল না। প্রথমে তথ্য ও সংস্কৃতিমন্ত্রী প্রয়াত প্রভাস ফদিকারের উদ্যোগে তার প্রস্তুতি হিসেবে একাধিক সেমিনার হয়, তাঁর মৃত্যুর পরে বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য এসে সংস্থাটির সামগ্রিক রূপ দেন। প্রথম সভাপতি অন্নদাশঙ্কর রায় নির্দেশ দিয়েছিলেন আকাদেমি৪ মুখ্যভাবে লিখিত বাংলা ভাষার আদর্শায়নের (standardization) জন্য নানামুখী কাজ করবে। অর্থাৎ বানানের সমতাবিধান, অভিধান ও ব্যাকরণ প্রণয়ন, বাংলা লিপির সংস্কার, পরিভাষা প্রণয়ন ইত্যাদি।  ব্যাকরণ রচনার ক্ষেত্রে কাজ তত অগ্রসর হয়নি। সে-কাজ শামসুজ্জামান খানের নেতৃত্বে ঢাকার বাংলা একাডেমি প্রাথমিকভাবে সম্পন্ন করে। ২০১২ সালে অধ্যাপক রফিকুল ইসলাম ও পবিত্র সরকারের যুগ্ম সম্পাদনায় দু-খণ্ডে এ-প্রতিষ্ঠান প্রমিত বাংলা ভাষার ব্যাকরণ প্রকাশ করে।  তখন প্রধান নজরটি ছিল ভাষার প্রমিত লিখিত রূপটির ওপর। 

তার আগে ঢাকার একাডেমি প্রচুর পরিভাষা-সংকলন আর অভিধানও প্রকাশ করে, আর উচ্চশিক্ষার প্রয়োজনে ইউরোপীয় ক্লাসিক পাঠ্যের অনুবাদ করেও বাংলায় উচ্চশিক্ষা-প্রকল্পকে সহায়তা করতে অগ্রসর হয়।  পশ্চিমবঙ্গে সেই কাজ পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য পুস্তক পর্ষদ কিছুটা করেছে, উচ্চশিক্ষার জন্য মৌলিক গ্রন্থের সঙ্গে অনুবাদ প্রকাশ করে।  আবারও বলি, একাডেমির নানাবিধ কাজের একটি পূর্ণাঙ্গ বিবরণ তৈরি হওয়া দরকার। পশ্চিমবঙ্গের আকাদেমি ঢাকার একাডেমির তুলনায় নতুন বলে তুলনীয় কাজ করতে পারেনি, আর পরে ২০১২-এর পর তার ভাষা-সংক্রান্ত প্রধান মনোযোগটিও আর বজায় থাকেনি। তবু ১৯৮৬ থেকে ২০১২-র মধ্যে আকাদেমি অন্তত পাঁচটি অভিধান প্রকাশ করেছিল – বাংলা আকাদেমি বানান অভিধান (প্রাথমিক সংকলন পবিত্র সরকার, অমিতাভ মুখোপাধ্যায়, প্রশান্তকুমার দাশগুপ্ত), আকাদেমি বিদ্যার্থী অভিধান, ক্ষুদিরাম দাস-সংকলিত সাঁওতালি বাংলা সমশব্দ কোষ, অধ্যাপক সুকুমার সেনের ব্যুৎপত্তি সিদ্ধার্থ বাংলা-কোষ (বাংলা শব্দের ব্যুৎপত্তির অভিধান)৫, বাংলা ধ্বনিপ্রতীক : স্বরূপ ও অভিধান।  পরিভাষা সমিতি তৈরি করেছিলেন প্রশাসনিক পরিভাষার একটি জরুরি বই, আর তাছাড়াও সুরভি বন্দ্যোপাধ্যায়ের সাহিত্যের শব্দার্থকোষ, সুভাষ ভট্টাচার্যের ভাষাতত্ত্বের পরিভাষা, গোকুলানন্দ মুখোপাধ্যায়ের ধাতুবিদ্যার পরিভাষা – এরকম অনেক বই, তা আকাদেমির গ্রন্থতালিকায় পাওয়া যাবে। যদিও মুদ্রণে আছে কি না জানি না। আগেই ইঙ্গিত করেছি যে, ২০১২-তে আকাদেমির পরিচালনায় রদবদলের পরে তার দৃষ্টিভঙ্গিতে পরিবর্তন ঘটেছে এবং বাংলাভাষাচর্চার ওপর গুরুত্ব প্রত্যাহৃত হয়েছে। আকাদেমি বানান অভিধান (প্রথম প্রকাশ ১৯৯৭)-ও আর মুদ্রিত হয় না, অথচ তার জন্য চাহিদা প্রচুর। কারণ বাংলা বানানের হালহকিকত এখনো, অন্তত পশ্চিমবঙ্গে, শেষবারের মতো আকাদেমির হয়ে যে নির্ধারণ করে দিয়েছিলেন জ্যোতিভূষণ চাকি, অমিতাভ চৌধুরী, নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী, শঙ্খ ঘোষ, শুভেন্দুশেখর মুখোপাধ্যায়, সুবীর রায়চৌধুরী (১৯৩৪-১৯৯৩), সুভাষ ভট্টাচার্য প্রমুখ অনেকের সঙ্গে এই অধমের মতো মানুষেরা – তার দৃষ্টান্ত এই অভিধানেই নিহিত আছে।  সেই বানান-নীতি বাংলা প্রকাশনা আর মুদ্রণের ব্যাপক ক্ষেত্রে গৃহীত হয়েছে, স্কুলের পাঠ্যপুস্তকে প্রায় পুরোটাই।  বাংলাদেশের বাংলা একাডেমিও স্বাধীনভাবে (পশ্চিমবঙ্গের কোনো কোনো বিশেষজ্ঞের সঙ্গে আলোচনা করে) যে বানান-নীতি গ্রহণ করেছে (১৯৯৪, ২০১২) তার সঙ্গে পশ্চিমবঙ্গের আকাদেমির নীতির পার্থক্য যৎসামান্য, শুধু ‘হলো’ আর ‘হতো’ এই রকম দু-একটি বানান বাদে। এমনকি পশ্চিমবাংলার বাংলার যে জনপ্রিয় প্রধান দৈনিক আনন্দবাজার পত্রিকা, যার বাংলাভাষার মুদ্রণ-পরিকল্পনাসংক্রান্ত অনেক কাজ আমাদের সাংস্কৃতিক ইতিহাসে স্মরণীয় হয়ে থাকবে, সেও ‘শ্রেণি’, ‘কাহিনি’, ‘মফস্সল’ ইত্যাদি গ্রহণ করেছে, শুধু অবাঙালি ও ভারতীয় নামের ক্ষেত্রে একটি, আমার মতে অকারণ, নিজস্বতা নির্মাণ করেছে। আর আমি মনে করি, ‘এমনকি’ বানান এটাই হওয়া উচিত, তার যুক্তি আমি নানা প্রবন্ধে আর আমার ব্যবহারিক বাংলা বানান অভিধান-এর পরিশিষ্টে (পৃ ৭৭৪-৭৮০) দিয়েছি, কিন্তু সে-কাগজ এবং তার নির্বিচার অনুসারী অন্যেরা, ‘এমনকী’ লিখে চলেছে। ওদিকে গণশক্তি দৈনিক কী যুক্তিতে ‘করলো’, ‘দেখবো’ ইত্যাদিতে ও-কার দেয় তাও আমাদের কাছে অস্পষ্ট। এটা পুরোপুরি উচ্চারণ-অনুসারীও হয় না, তা হলে ‘করলো’কে ‘কোর্লো’ লিখতে হতো। আমাদের মতে, এর কোনও দরকার নেই। আর ক্রিয়াপদে ‘এগনো’, ‘এগবে’ ইত্যাদিরও কোনও অর্থ হয় না, মাঝখানে একটা ও-কার দেওয়া উচিত বলে আমি মনে করি।  ‘ভিড়বে’ আর ‘ভিড়োবে’র বা ‘ভিজব’ আর ‘ভিজোব’র তফাৎ নইলে কেমন করে করব? এরকম অনেক জায়গাতে এখনো স্পষ্ট বিভিন্নতা পশ্চিমবঙ্গের মুদ্রণবিশে^ নজরে পড়ে। 

এ থেকে বোধগম্য হবে যে, কেন বানানের সমতাবিধান পশ্চিমবঙ্গ বাংলা আকাদেমি একটি জরুরি কর্তব্য হিসেবে গ্রহণ করেছিল। এবং এখনো কেন তার সংগত প্রতিষ্ঠা, অন্তত পশ্চিমবঙ্গে, হয়নি। বিতর্ক তৈরি হয়েছে, কিন্তু তা তো প্রত্যাশিতই ছিল। একটি বানান-নীতি নির্ধারণের ক্ষেত্রে সেই ঊনবিংশ শতাব্দী থেকে নানা বিতর্ক হয়ে আসছে। সেগুলির একটা হলো এর ‘ঔচিত্য’ নিয়ে – এটা উচিত কি না।  বানানে যে যেমন-খুশি লিখবেন এই গণতন্ত্রের পক্ষে কেউ কেউ ছিলেন, তাঁরা গ্রামশির ‘হিগেমনি’র আশঙ্কা দেখেছেন। ওদিকে অভিন্ন নীতিপক্ষীয়রা বলেছেন, এক শব্দের এক বানান হওয়া অবশ্যই উচিত, কারণ এটা দেশের মানুষদের শিক্ষার সঙ্গে জড়িত।  অজস্র শিশু প্রথম লেখাপড়া শিখতে এসে একটা অরাজক বানানব্যবস্থার শিকার হবে, এমন হওয়া কখনও বাঞ্ছনীয় নয়।  সাধারণ পাঠকদের কথাও মনে রাখা দরকার। দ্বিতীয়ত তর্কটা উঠেছিল অধিকার নিয়ে, ‘কারা ঠিক করবেন?’ পশ্চিমবঙ্গে কেউ কেউ বলেছিলেন, বিশ^বিদ্যালয় বা তার ভাষাতত্ত্ব বিভাগকে দায়িত্ব দেওয়া নয় কেন? উত্তর ছিল, বিশ^বিদ্যালয় বা তার সংশ্লিষ্ট বিভাগ এতদিন উদ্যোগী হয়নি বলেই আকাদেমির কথা ভাবা হয়েছে। তারা উদ্যোগী হলে সরকার ভাবতেই পারত অন্যভাবে। তৃতীয় আপত্তি ছিল, এখনই কেন?  অর্থাৎ মুহূর্তটি নিয়ে।  উত্তরে যুক্তি ছিল, এখন নয় কেন? পঞ্জিকা ইত্যাদিতে বানান-নীতি নির্ধারণের কোনও শুভলগ্ন নির্দেশ করা আছে কি?  চতুর্থ একটা প্রশ্ন ছিল, বৃহত্তর বাঙালি সমাজের কাদের পরামর্শ নিয়েছেন? আকাদেমি বলেছিল যে, বাংলাদেশে, অসমে ও ত্রিপুরার একাধিক বাঙালি বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নেওয়া হয়েছে।  পঞ্চম একটা বিরোধিতা ছিল যেটা তখনকার বামফ্রন্ট সরকারের বিরোধিতার উৎস থেকে জাত, সেটা নিয়ে বেশি কথা বলার দরকার নেই।  এই লেখক (সরকার ২০০৪-এ) এই বিতর্কগুলির একটি বিশদতর বিবরণ লিপিবদ্ধ করেছেন।

আমি জানি না, ঢাকার বাংলা একাডেমিও যখন এই ধরনের কাজ করতে শুরু করে তখন তাকে কোন ধরনের তর্ক ও আপত্তির সামনে পড়তে হয়েছিল। তার ইতিহাসও জানা থাকলে, এ-ধরনের সংস্কারের চারপাশে যে একটি মননের সমাজতত্ত্ব নির্মিত হয় তার একটা হদিস পাওয়া যেতে পারে।  সব দেশেই তার বিশেষ মূল্য তৈরি হয়ে যায়। তবে পশ্চিমবঙ্গের বাংলা আকাদেমির তুলনায় ঢাকার একাডেমির মান্যতা মনে হয় প্রথম থেকেই অনেক বেশি ছিল, তাই পশ্চিমবঙ্গে বানানের ক্ষেত্রে যত প্রাতিষ্ঠানিক ও ব্যক্তিগত স্বাধীনতা লক্ষ করা যায় ঢাকায় ততটা প্রকট হয়নি বলেই মনে হয়। সেখানকার দু-একটি সংবাদপত্র নিজস্ব বানানরীতি তৈরি করলেও বৃহত্তর বাংলাদেশে একাডেমির বানানই অধিকাংশত গ্রাহ্য হয়েছে বলে আমাদের ধারণা। 

৪. লিপি ও হরফ সংস্কার

পশ্চিমবঙ্গের বাংলা আকাদেমি যেখানে সবচেয়ে মৌলিক কাজ করেছে তা হলো, বাংলা লিখনপদ্ধতির মধ্যে কিছু দর্শনীয় (কারও কারও ভাষায় ‘বৈপ্লবিক’) পরিবর্তন, যা নিয়েও একসময় বেশ বিপুল বিতর্ক ও বিরোধ তৈরি হয়েছিল। এই পরিবর্তন বাংলা মুদ্রণে হরফে ও গৌণচিহ্নে বা হরফে হরফে সংযুক্তির ক্ষেত্রে। বাঙালি পাঠকেরা জানেন যে, বাংলা লিপি সব সময় linear নয়, অর্থাৎ পরপর হরফ বসিয়ে আমরা বাংলা বা ভারতীয় কোনো ভাষা লিখি না। কারণ যাকে পারিভাষিকভাবে ‘অ্যালফাবেট’ বলে ভারতীয় কোনো বর্ণমালাই তা নয়। পৃথিবীতে সবচেয়ে পরিচিত অ্যালফাবেট রোমক বর্ণমালা, যাতে ইংরেজি, ফরাসি, ইতালীয় ইত্যাদি ইউরোপীয় ভাষা লেখা হয়, এখন খ্রিষ্টীয় পাদরিদের এবং সাম্রাজ্যবাদের প্রভাবে পৃথিবীর অন্যত্রও প্রচুর ভাষায় তার ব্যবহার। গ্রিক, রুশ ইত্যাদি বর্ণমালাও কমবেশি ওই অ্যালফাবেট। কিন্তু আমাদের বর্ণমালা   অ্যালফাবেট নয় (দ্র. সরকার, ২০২২)। পণ্ডিতদের মতে, আমাদের বর্ণমালা ‘আলফা-সিলেবিক’, অর্থাৎ বিলিতি বর্ণমালা আর দল বা সিলেবল পদ্ধতির মিশ্রণ, যদিও তাতেও কথাটা খুব পরিষ্কার হয় না। আর তাতে অনেক বর্ণের একাধিক চেহারা আছে। স্বরবর্ণের ক্ষেত্রে সেগুলিকে আমরা ‘কার’ (হিন্দিতে ‘মাত্রা’) বলি – আ-কার, হ্রস্ব উ-কার ইত্যাদি। ব্যঞ্জনবর্ণের ক্ষেত্রে সাধারণভাবে ‘ফলা’।  এসব যোগ করার সময় আমাদের লেখায় আর প্রচলিত মুদ্রণে অনেক সময় বর্ণগুলির চেহারা বদলে যায়। তাতে ছোটদের দু-ধাপে শিখতে হয়। যেমন, তারা ঙ জানে, গ-ও জানে, কিন্তু ঙ্গ যে ঙ্ আর গ্-এর যোগ তা তাদের আলাদা করে বলে দিতে হয়। হ্ম-এর ক্ষেত্রেও তাই।  আমাদের উল্লিখিত হরফের পরিবর্তনে, সবিনয়ে বলি, বর্তমান লেখকের কিছু ভূমিকা ছিল। এই ভূমিকার পশ্চাদ্‌বর্তী ইতিহাস একটু বলি।  

এই লেখক বিদেশে ভাষাবিজ্ঞান পড়ার সময়ে শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয়ে খ্যাতিমান লিপিতাত্ত্বিক আই জে গেল্‌ব৬-এর কাছে লিপিতত্ত্ব বা graphology/graphemics-এর পাঠ নিয়েছিল। দেশে ফেরার পরে তার মনে হয়েছিল, তার ভিত্তিতে বাংলা লিপিপদ্ধতির একটু সংস্কার দরকার। কারণ ছাত্রছাত্রীদের বাংলা পড়তে আর লিখতে অনেক বেশি প্রতীক শিখতে হয়। বাংলা লিপির চরিত্র বিষয়ে সে প্রথমে ১৯৭৮-এর অধুনালুপ্ত যুগান্তর দৈনিকের শারদ সংখ্যায় একটি প্রবন্ধ লেখে, পরে তা তার বাংলা বানান সংস্কার : সমস্যা ও সম্ভাবনা বইয়ের (১৯৮৭ : ৩ অধ্যায়ে) অন্তর্ভুক্ত হয়। তাতে সে স্বরচিহ্নযুক্ত হরফ আর যুক্তব্যঞ্জন সরল করে সেগুলিকে ‘স্বচ্ছ’৭ বা দেখেই পুরোটা বা খানিকটা চেনা যায় এরকম করার প্রস্তাব দিয়েছিল। বাংলা বর্ণমালা আর লিপি সম্বন্ধে সেটিই প্রথম Graphology-নির্ভর তাত্ত্বিক আলোচনা বলে এই লেখকের দাবি।  তার প্রস্তাবগুলির মূল কথা ছিল, নিচের নির্দেশমতো হরফ ও লিপির পরিবর্তন –

স্বরচিহ্নের ক্ষেত্রে

যুক্তব্যঞ্জনের ক্ষেত্রে (কখনও স্বরচিহ্নও) –

পাঠকেরা লক্ষ করবেন যে, সব যুক্তব্যঞ্জন ভাঙা হয়নি।  তার আলাদা-আলাদা কারণ আছে। ক্ষ, জ্ঞ স্বচ্ছ করা হয়নি, কারণ তাদের উচ্চরণে যুক্ত দুটি ধ্বনির উচ্চারণ আর বজায় নেই।  য-ফলার ক্ষেত্রেও একই কথা।  ‘রেফ’, ‘র-ফলা’, ‘ট-এ ট-এ’ ইত্যাদিকে রাখা হয়েছে, কারণ, আমরা পরীক্ষা করে দেখেছি, এগুলির পরিবর্তনের ফলে জটিলতা বৃদ্ধি পাবে।  

এগুলির প্রথম পরীক্ষা হয় পশ্চিমবঙ্গ সরকারের তৈরি প্রাথমিক বাংলার পাঠ্যপুস্তক কিশলয়-এর প্রথম, দ্বিতীয় ইত্যাদি ভাগে, যা ১৯৮৪ থেকে নতুন পাঠ্যক্রমে গৃহীত হয়। কিন্তু তখন কম্পিউটারে সুশ্রী বা সুসমঞ্জস টাইপ করা যায়নি, তাতে প্রথম প্রয়াসের চিহ্ন ছিল। দু-বছর পরে বাংলা আকাদেমির প্রতিষ্ঠা হলে এই বিষয়ে উদ্যোগ নেওয়া হয়, এবং এই লেখকের প্রস্তাবিত ছাঁচ দেখে সফটওয়্যার প্রযুক্তিবিদ বিশ^রূপ ভৌমিক মোটামুটি নিখুঁত একটি ফন্ট তৈরি করেন। এখন অভ্র আর পশ্চিমবঙ্গ সরকারের ভাষাপ্রযুক্তি গবেষণা ও প্রশিক্ষণ কেন্দ্রের (SNLTR ev Society for Natural Language Training and Research, ২০০৯-এ প্রতিষ্ঠিত) উদ্ভাবিত ‘বৈশাখী’ কি-বোর্ডগুলিতে (দুটিই বিনামূল্যে আপনার কম্পিউটারে নামিয়ে রাখা সম্ভব) পাওয়া যায়, আমাদের আকাদেমির ইংরেজি বানান Bangla Akademi বানানেই। অভ্রের আবিষ্কর্তারা প্রথম তাঁদের পোর্টালে সৌজন্যবশত Akademi বানান রেখে এই ফন্টকে প্রচার করেন। বৈশাখীতেও তাই আছে। পরে এটি ইউনিকোডের দ্বারা গৃহীত হয়েছে। 

প্রথম দিকে পশ্চিমবাংলার দৈনিক কাগজগুলি এ নিয়ে প্রচুর হট্টগোল করেছিল, ২০০৪ সালে জনপ্রিয় দৈনিকে শিরোনাম হয়েছিল, ‘বাংলা যুক্তাক্ষরের রূপ পালটে দিয়ে চমক রাজ্যের’।  তাতে ‘কাহার পরামর্শ লইয়াছেন’ বলে সম্পাদকীয়ও লেখা হয়েছিল। এই লেখকের পক্ষ-বিপক্ষ (সরকার, ২০০৪খ, পুনশ্চ) বইয়ে তার বিবরণ আছে, উত্তরও আছে। কেউ কেউ বিরোধিতার অতিউৎসাহে ভেবেছিলেন বাংলা যুক্তাক্ষর ভাঙা হয়েছে, তাতে ‘ঐতিহ্য গেল!’ বলে হাহাকার শুরু হয়েছিল।  এই লেখকের প্রতি ব্যক্তিগত কটুকাটব্য প্রচুর হয়েছিল।  কৌতুককর উপাখ্যানও তৈরি হয়েছিল। কবি বিষ্ণু দে-র জ্যেষ্ঠ কন্যা, বন্ধু রুচিরা প্রশ্ন করেছিলেন, ‘আমার বাবার নাম তোমরা পালটে দিলে?’ তখন প্রাণপণ বোঝানোর চেষ্টা করেছি যে, বাংলার একটা যুক্তব্যঞ্জনও আমরা ভাঙিনি, বরং তার চেহারা ‘স্বচ্ছ’ করার চেষ্টা করেছি। বাংলা লিখতে-পড়তে শেখাতে তার সাহায্য হবে। প্রথম ভাষাশিক্ষার্থীরা আমাদের লক্ষ্য, তাদের বাড়তি পরিশ্রম আমরা একটু বাঁচাতে চাই। এত দিন চলেছে কোনো যুক্তি নয়। আর যে বলা হয়েছিল ‘অসুবিধা হয়নি’ সে কথাটাও ঠিক নয়। দেশভাগের বছরে ভারতের সাক্ষরতার পরিমাণ ছিল ১৭ শতাংশ, সে-কথা মনে রাখতে হবে।  বঙ্গভাষী অঞ্চলও ভারতের সাক্ষরতায় তত এগিয়ে ছিল না।  লিখনপদ্ধতির জটিলতা সাক্ষরতায় কোনো বাধা সৃষ্টি করেনি তা যদি ভাবি তাহলে আমরা ভুল ভাবব।

সুখের বিষয়, এই ‘স্বচ্ছ’ হরফে মুদ্রণ এখন পশ্চিমবঙ্গে আর বাংলাদেশে ব্যাপকভাবে গৃহীত হয়েছে। বিতর্ক পশ্চিমবঙ্গে যেমন চলেছে বাংলাদেশেও তা প্রবাহিত হয়েছে। বাংলাদেশের কম্পিউটার প্রযুক্তিতে বাংলা লেখা ও মুদ্রণের এক শ্রদ্ধেয় পথপ্রদর্শক, গুরুত্বপূর্ণ ও জনপ্রিয় ‘বিজয়’ কি-বোর্ডের রচয়িতা মোস্তাফা জব্বার (বর্তমানে মন্ত্রী, গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার) এই স্বচ্ছ হরফ সম্বন্ধে বেশ আপত্তি করেছিলেন এই বলে যে, এতে আবহমান কালের বাংলা হরফের ‘বিকৃতি’ ঘটেছে (প জব্বার, ২০১৮ : ২০৭-২২০)। ‘বিকৃতি’র একটা অর্থ রূপান্তর – তা নিশ্চয়ই ঘটেছে।  তবে তা দেখতে আরো নিকৃষ্ট হয়েছে কি না সে-বিচার বিদ্বজ্জন করবেন। আমাদের বিনীত মতে, তা যদি মানুষের বর্ণমালা ও লিখনপদ্ধতি শিক্ষার এতটুকু সহায়ক হয়ে থাকে তা হলে সৌন্দর্যের হেরফের, যদি আদৌ ঘটে থাকে, ক্ষমার্হ। আনন্দের কথা, এখন দুই বাংলাতেই স্কুলশিক্ষার সমস্ত বই-ই এই স্বচ্ছ হরফে ছাপা হয়। বয়স্কদের পাঠ্য প্রচুর বই আর পত্রপত্রিকাও ছাপা হয়। ঢাকার বাংলা একাডেমির অভিধানগুলিও এই হরফে ছাপা হচ্ছে, এখানেও প্রচুর বই এই হরফেই মুদ্রিত রূপ পাচ্ছে। 

তবে দু-বাংলাতেই সংবাদপত্রগুলি এ-বিষয়ে খুব একটা উদ্যোগ নেয়নি, তারা তাদের প্রাতিষ্ঠানিক অহং নিয়ে আনন্দে আছে, বরং আরো রক্ষণশীল হরফ নির্মাণ করছে – যেমন ‘গ্লু’ ‘প্লু’ ইত্যাদি যুক্ত-হরফে তারা পুরোনো দেয়ালের গায়ে হুক-এর মতো র-এ হ্রস্ব উ-কার লাগিয়েছে। আমরা মনে হয় পেছনের দিকে এগিয়ে চলেছি। 

একুশে ফেব্রুয়ারির ঘটনা আর তাৎপর্য আর ভবিতব্য নিয়ে ইতিহাসচর্চা আর ব্যাখ্যাবিশ্লেষণ চলুক। কিন্তু লেখার বাংলাভাষার ভাষাপরিকল্পনা আর ভাষাপরিচর্যার ক্ষেত্রে যে কাজগুলি হয়েছে তাও আমাদের কিছু কিছু জানা দরকার, সেই জন্যই এই লেখার দায় স্বীকার।  

টীকা

১. ভাষা নিয়ে আমাদের ধারণায় কিছুটা বিভ্রান্তি আছে, মাতৃভাষা নিয়েও। আমরা যখন মাতৃভাষার স্বার্থ বা মর্যাদা রক্ষার জন্য আন্দোলন করি, এমনকি প্রাণও দিই, তখন সেটা করি আমাদের ভাষার যেটা মান্য রূপ ও লিখিত রূপ, যাতে আমাদের শিক্ষা চলে, সাহিত্য রচিত হয়েছে, সেই রূপের জন্য। আমাদের আসল ‘মাতৃভাষা’ আমাদের ঘরের ভাষা যেটা আমরা মা বা পালয়িত্রীর কাছ থেকে প্রথম শিখি, ভাষাবিজ্ঞানে যাকে বলে language1. তার জন্য প্রাণ দেওয়ার উপলক্ষ আমাদের ক্ষেত্রে এখনো আসেনি। ‘ভাষা’, এমনকি বাংলা ভাষাও যে অনেকগুলি উপভাষা ও শ্রেণিভাষার একটি গুচ্ছমাত্র, একটি সংহত, সর্বব্যাপ্ত ভাষা নয়, সে-কথা আমরা অন্যত্র বলার চেষ্টা করেছি।  তার মধ্যে যে একটি ‘প্রমিত’ রূপ, সেটিই আমাদের পুরো ভাষার মুখ্য প্রতিনিধি, আমাদের গর্বের ও ভালোবাসার লক্ষ্য। আবার সেই ‘প্রমিত রূপ’-এর লিখিত অবয়বটির জন্য উপাদান পরিকল্পনা বিশেষভবে দরকার হয় (পরে দেখুন)।

২. ‘পুরো ভাষা’ বলতে কী বোঝায় তার ব্যাখ্যা ওপরের পাদটীকায় আছে। 

৩. এই সিদ্ধান্ত আমরা পাঠকদের দিতে চাই না যে শুধু প্রতিষ্ঠান আর তার সঙ্গে যুক্ত বিশেষজ্ঞরাই ভাষার উপাদানকে সমৃদ্ধ করেন। সৃষ্টিশীল কবি আর লেখকেরাও নানা নতুন শব্দের ব্যবহার এবং শব্দের নতুন ব্যবহার করে ভাষার শব্দভাণ্ডার আর প্রকাশের ক্ষমতা বাড়ান। তা উপাদান পরিকল্পনারই অঙ্গ।  সেইসঙ্গে প্রতিষ্ঠানের জন্ম হওয়ার আগে, বা প্রতিষ্ঠান থেকে বিচ্ছিন্নভাবেও অনেক বিশেষজ্ঞ (যেমন রামমোহন রায়, বিদ্যাসাগর, বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, মীর মশাররফ হোসেন, ইসমাইল হোসেন সিরাজী, বা জ্ঞানেন্দ্রমোহন দাস, হরিচরণ বন্দ্যোপাধ্যায় প্রমুখ) বাংলাভাষার উপাদান-পরিকল্পনায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিয়েছিলেন। অবশ্যই ব্যাপকতর অর্থে যা কিছু ভাষায় মুদ্রিত হয় তারই ভাষা-পরিকল্পনায় কোনো না কোনো, কম বা বেশি, ভূমিকা থাকতে পারে। 

তেমনি ভাষার ভূমিকা বা স্টেটাস রাষ্ট্রের সিদ্ধান্তের আগেই সমাজ একভাবে নির্ধারণ করে, শিক্ষায়, সাহিত্যে তার ব্যবহার করে। 

৪. অন্নদাশঙ্করই প্রস্তাব করেছিলেন যে, গ্রিক বা ফরাসি উচ্চারণের অনুসরণে নাম হোক আকাদেমি, ইংরেজি  ‘একাডেমি’ নয়।  তাঁর ইচ্ছাকে সম্মান জানানো হয়েছিল।

৫. অধ্যাপক সেনের ১৯৭১-এ প্রকাশিত Etymological Dictionary of Bengali, Calcutta, Eastern Publishers বইয়ের সংশোধিত ও সংযোজিত বাংলা সংস্করণ।

৬. Ignace Jay Gelb (1907-1985). A Study of Writing (1963, Second Edition, University of Chicago Press) বইটির লেখক এবং আসিরীয় সভ্যতা সম্বন্ধে বিশেষজ্ঞ।

৭. বাংলা যুক্তবর্ণ ও হরফ সম্বন্ধে ‘স্বচ্ছ’, ‘অর্ধস্বচ্ছ’, ‘অনচ্ছ’ ইত্যাদি কথা, যতদূর মনে হয়, এই লেখকই প্রথম তার লেখায় (১৯৭৮) ব্যবহার করে। সরকার, ১৯৮৭-র গ্রন্থে, প্রথম সংস্করণে, এভাবে আছে কথাগুলি – ‘এই মুহূর্তে মনে করি, বাংলা বর্ণমালায় হ্রস্ব ই-কার, এ-কার ইত্যাদি চিহ্ন ব্যঞ্জনের পরে লেখার ব্যবস্থা করলে (যোগেশচন্দ্র রায় বিদ্যানিধি থেকে অনেকেই এ-প্রস্তাব দিয়েছেন), বর্ণের রূপভেদ বা অ্যালোগ্রাফের সংখ্যা কমালে (এখনই ত্রুটি, ক্রম, ভ্রম ইত্যাদি বানানে এই ব্যাপারটি খানিকটা এগিয়েছে), এবং ‘অস্বচ্ছ’ যুক্তব্যঞ্জনকে ‘স্বচ্ছ’ করে আনলে, অর্থাৎ ‘ঙ্গ’ না লিখে ‘ঙ্গ’ লিখলে – বাংলা বর্ণমালা ও লিখন পদ্ধতির সংস্কারে কয়েকটা বড় ধাপ অগ্রসর হওয়া যাবেই।’ (২৮ পৃ)

এ সম্বন্ধে কোনো বিকল্প ইতিহাসের অস্তিত্ব আমি জানি না।  সে-বিষয়ে কেউ কিছু জানালে বাধিত হব।

সূত্রপঞ্জি 

১. জব্বার, মোস্তাফা, ২০১৮, ডিজিটাল বাংলা, সময় প্রকাশন, ঢাকা।

২. রহিম, ড. আব্দুর, ২০১৭, বাংলাদেশের ভাষা-পরিকল্পনা, ঢাকা, অবসর।

৩. সরকার, পবিত্র, ১৯৮৭, বাংলা বানান সংস্কার : সমস্যা ও সম্ভাবনা, কলকাতা, চিরায়ত।   

৪.  সরকার, পবিত্র, ১৯৯৮, ভাষা দেশ কাল, কলকাতা, মিত্র ও ঘোষ।

৫. সরকার, পবিত্র, ২০০৩, ভাষাপ্রেম ভাষাবিরোধ, কলকাতা, দে’জ পাবলিশিং।

৬. সরকার, পবিত্র, ২০০৪খ, পক্ষ-বিপক্ষ, কলকাতা, পুনশ্চ।

৭. সরকার, পবিত্র, ২০২২, লিপি, ইতিহাস ও নির্মাণ, স্পার্ক, কলকাতা।

৮. সরকার, পবিত্র, ২০২৩, ভাষা : ব্যাকরণের বাইরে, কলকাতা, দে’জ পাবলিশিং।

৯. Klein, Michael, 1997, On the Undoing and Redoing of Corpus Planning, Berlin etc. Mouton de Gruyter.  (এ গ্রন্থেই Kloss-এর সূত্রগুলি পাওয়া যাবে।  তাঁর মূল প্রবন্ধটি আমরা দেখিনি।)