লা নুই বেঙ্গলী মির্চা এলিয়াদ

ভূমিকা

লা নুই বেঙ্গলী (LaNuit Bengali) (Bengal Nights) রোমানিয়ান লেখক, দার্শনিক ও তাত্ত্বিক মির্চা এলিয়াদ (Mircea Eliade) রচিত আধা-আত্মজীবনীমূলক উপন্যাস। এটি ১৯৩০ সালের কলকাতার পটভূমিতে লেখা। উপন্যাসের নায়ক তরুণ ফরাসি ইঞ্জিনিয়ার অ্যালেন। আর নায়িকা মৈত্রেয়ী দেবী (Maitreyi Devi)। পরবর্তী সময়ের সাহিত্য অকাদেমি পুরস্কার বিজয়ী বিখ্যাত ভারতীয় লেখিকা। লা নুই বেঙ্গলী উভয় বাংলায় একটি অত্যন্ত জনপ্রিয় উপন্যাস। এটির বহুল পঠিত হওয়ার কারণ অনুসন্ধান করতেই আমি এটি তৃতীয়বার পড়ছি। ইতোমধ্যে মৈত্রেয়ী দেবীর ন হন্যতে (It Does Not Die) উপন্যাসের আমার একটি আলোচনা (Review) উইকিপিডিয়া এবং কালি ও কলমসহ বহু লেখার রেফারেন্স হওয়ার কারণে আমার মনে একটি দায়বদ্ধতা তৈরি হয়েছে যে, লা নুই বেঙ্গলীরও একটি আলোচনা আমার থাকা দরকার। কারণ ন হন্যতের আলোচনায় লা নুই বেঙ্গলীর কথাও উল্লেখ রয়েছে। কৌতূহলী পাঠকের মনে জাগা অনেক প্রশ্নের উত্তর লা নুই বেঙ্গলীর আলোচনা থেকে মিলবে।  

কাহিনি সংক্ষেপ : ইউরোপীয় তরুণ ইঞ্জিনিয়ার অ্যালেন এসেছিলেন ভারতে চাকরি ও পড়াশোনা করার জন্য। পেইড লজিং হিসেবে থাকার জায়গা পেয়েছিলেন শিক্ষক-দার্শনিক নরেন্দ্র সেনের ভবানীপুরের বাসায়। এখানে নরেন্দ্র সেনের সুন্দরী মেয়ে কবি মৈত্রেয়ীর প্রেমে পড়েন তিনি। কিন্তু ভারতীয় কঠোর নিয়ম আর নরেন্দ্র সেনের উঁচু আত্মসম্মান বোধের কারণে তাঁদের প্রেমটি ব্যর্থ হয়। ছেলেটি কিছুদিন ভারতের পথেঘাটে ঘুরে বিফল মনোরথ হয়ে স্বদেশে ফিরে যান। সেখানে তিনি লা নুই বেঙ্গলী অথবা ‘বাংলার রাত’ নামে একটি উপন্যাস লেখেন – তাঁর ভারত জীবনের ঘটনাবলি নিয়ে। সেই বইয়ে তিনি মৈত্রেয়ীর কথা লেখেন, তাঁদের প্রেমের কথা লেখেন। মৈত্রেয়ীর সঙ্গে তাঁর শারীরিক সম্পর্কের কথাও লেখেন। রাতে মৈত্রেয়ী অ্যালেনের ঘরে চলে আসতেন। এই বইটি প্রকাশের খবর যখন ভারতে আসে, মৈত্রেয়ীর তখন অন্যত্র বিয়ে হয়ে যায়। তাঁর সংসার হয়, সন্তান হয়। লোকমুখে এই বইয়ের কাহিনি শুনে মৈত্রেয়ীর মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ে। তখন তিনি প্রকৃত চিত্র তুলে ধরার জন্য একটি কাউন্টার বই রচনা করেন। এই বইটির নাম : ন হন্যতে। এটি সাহিত্য অকাদেমি পুরস্কার পাওয়ায় ভারতীয় তরুণ-তরুণীদের কাছে অবশ্যপাঠ্য হয়ে যায়। আর এভাবেই লোকমুখে শুনে শুনে বই দুটি বাংলা ভাষাভাষী পাঠকের পাঠ ও চর্চার কেন্দ্র হয়ে ওঠে। উল্লেখ্য যে, মৈত্রেয়ীর ন হন্যতে মির্জা এলিয়াদের লা নুই বেঙ্গলীর চেয়ে গুণেমানে অনেক উন্নত। এই উপন্যাস বাংলা ভাষার বহু লেখকের লেখার প্রেরণা হয়েছে।

মূল আলোচনা : বাঙালি মধ্যবিত্ত সমাজের তরুণ-তরুণীরা, কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে যারা পড়ার সময় সহপাঠী, সিনিয়র ও জুনিয়রের প্রেমে পড়ে, তখন তারা এমনই জটিল মনস্তত্ত্বের মধ্য দিয়ে যায় – যেমনটি এ-উপন্যাসে রয়েছে। তখনকার সময়ের চেয়ে বর্তমান সময়ে ছেলেমেয়েদের মেলামেশার সুযোগ বেশি হওয়ায় অনেকেই মনের বিরুদ্ধেও যৌনতার সম্পর্কে জড়িয়ে যায়। ফলে যা হওয়ার তাই হয়। বেশিরভাগ সম্পর্কই ভেঙে যায়। লা নুই বেঙ্গলীতে মির্চা এলিয়াদের দাবি ছিল, তাঁর নায়ক অ্যালেনের সঙ্গে তাঁর নায়িকা মৈত্রেয়ীর যৌন সম্পর্ক তৈরি হয়েছিল। সেই যৌনতার কিছু আদি-রসাত্মক বর্ণনাও রয়েছে এতে। কিন্তু মৈত্রেয়ী সেটা কঠোরভাবে অস্বীকার করেন। কারণ তাঁর সংসার, স্বামী-সন্তান ও সামাজিক মর্যাদা রয়েছে। এতে অ্যালেনের কোনো সমস্যার সম্ভাবনা ছিল না, কারণ তাঁর দেশে বিবাহপূর্ব নারী-পুরুষের অবাধ মেলামেশার কোনো সামাজিক সমস্যা নেই। ফলে বইটির কারণে মৈত্রেয়ীর মানসম্মান ধুলোয় মিশে যাওয়ার উপক্রম হয়। কিন্তু মির্চার কাছে প্রতিবাদ পাঠানোরও কোনো উপায় ছিল না। কারণ তিনি লা নুই বেঙ্গলী লিখেছেন তাঁর স্বদেশ রোমানিয়ায় ফিরে গিয়ে, ফরাসি ভাষায়। রোমানিয়া ফরাসি উপনিবেশ হওয়ায় রোমানিয়ার ভাষাও তখন ফরাসি ছিল।

ভারতীয় যুবতী ‘মৈত্রেয়ী’ আর ইউরোপীয় যুবক একই বাসায় দিনরাত অবস্থান করেন। যখন-তখন তাঁদের দেখা-সাক্ষাৎ হতে পারে। তাঁরা একই ঘরের একই টেবিলে বসে পড়াশোনা করেন, দিনের পর দিন এটা সেটা নিয়ে দুজনের মধ্যে খুনসুটি চলে, সেই খুনসুটি কখনো ঝগড়ায় রূপ নেয়। তুচ্ছ বিষয়ভিত্তিক ঝগড়া বেশিক্ষণ থাকে না। যে-কোনো ছুতোয় দুজনের একজন উদ্যোগী হয়ে মিটিয়ে ফেলেন। এভাবে দিনের পর দিন চলে মনের লেনাদেনা। ফ্রি মিক্সিং দেশের একটি যুবকের কাছে ভারত কুসংস্কারাচ্ছন্ন দেশ। অন্ধবিশ্বাস আর বুজরুকিতে ভরা। বদ্ধ সংস্কৃতি, কঠোর ধর্মীয় নিয়মনীতি ইত্যাদি কারণে যুবকটি সবসময় ভেতরে ভেতরে ভীত থাকতেন। তাছাড়া আশ্রয়দাতা তাঁর গুরু। গুরুর বাড়িতে বসবাসের জন্য আলাদা ডিগনিটির প্রয়োজন হয়। যদি কোনো প্রকার বাড়াবাড়ি হয়ে যায়, ভুল হয়ে যায়, তাহলে মানসম্মান যাবে। বাড়ির সবার ভালোবাসার পাত্র তিনি। থাকা-খাওয়া কোথাও কোনো অভাব তাঁর ছিল না। আর মৈত্রেয়ী তো ছিলই, প্রতিটি বিষয়ের খোঁজ রাখতেন, তাঁর কখন কী লাগবে। দিনরাতের প্রহর তাঁরা ভুলে যেতেন পড়তে পড়তে। কিন্তু পড়ার চেয়ে এটা-সেটা নিয়ে আলাপ হতো  বেশি। কথা শেষ হতো না, যখন শেষ হতো তখন হয়তো দেখা দিত মতানৈক্য। তুচ্ছ কোনো বিষয়ের বক্তব্য থেকে ঝগড়া। মূলত এটাই বড় প্রেমের ধর্ম। আগে অন্তর আচ্ছন্ন করে পরে আচ্ছন্ন করে শরীর। আর ছোট প্রেমের ধর্ম আগে আচ্ছন্ন করে শরীর পরে অন্তর। শেষ পর্যন্ত না শরীর না অন্তর কোনোটাই আচ্ছন্ন থাকে না – স্বার্থপরতা জায়গা দখল করে নেয়। বড় প্রেম নদীর মতো। নদী যেমন সাগরে গিয়ে মিলিত হয়, উত্তপ্ত প্রেমও তেমনই শরীরে গিয়ে শীতল হয়। লা নুই বেঙ্গলীর নায়ক ২১-২২ বছরের যুবক অ্যালেনের কাছে নরেন্দ্র সেনের বাসা প্রথম প্রথম একটি জেলখানার মতো লাগত। কারণ তিনি একটি স্বাধীন দেশ ও মুক্ত সংস্কৃতির খোলামেলা আবহে বেড়ে ওঠা যুবক। আর ভারত একটি পরাধীন কলোনি, অবরুদ্ধ হিন্দু সংস্কৃতির বহু নিয়মকানুন এর পরতে পরতে ছড়ানো, যেগুলো অধিবাসীদের জীবন-যাপনকে দারুণভাবে নিয়ন্ত্রণ করে। মৈত্রেয়ী যেহেতু সেই সংস্কৃতির প্রতিনিধিত্ব করেন আর ছেলেটি যেহেতু মুক্ত সংস্কৃতির প্রতিনিধিত্ব করেন, উভয়ের মধ্যে অকথিত কিছু জটিল মনস্তাত্ত্বিক টানাপড়েন সবসময়ই লেগে থাকত। মৈত্রেয়ীর বয়স তখন মাত্র ১৬-১৭। বিশে^র সব দেশের ১৬-১৭ বছরের মেয়েরা ৩০-৩২ বছরের যুবককে সহজেই নিতে, গ্রহণ করতে পারে। কিন্তু উভয়ের মাঝে যখন জাতি-ধর্ম ও বর্ণগত এবং সভ্যতা, শিক্ষা ও সংস্কৃতিগত আপার ক্লাস লোয়ার ক্লাসগত দ্বন্দ্ব তৈরি হয়, তখন তাদের মধ্যে সত্যিকারের প্রেম হওয়াটা সহজ হয় না।

এখানে জানিয়ে রাখা দরকার যে, দুজনেরই মন অতি স্পর্শকাতর। যখন-তখন আহতবোধ করা, সামান্য কথায়
এদিক-সেদিকে ভেঙে পড়া, বিদ্রোহ করা তরুণ বয়সেরও বিশেষ বৈশিষ্ট্য। সামান্য অপমান, তিরস্কার, অবহেলা সহ্য করতে না পেরে কাতর হওয়া। কিন্তু পরক্ষণেই আবার সব ভুলে যাওয়া। আবার অতি তুচ্ছ বিষয়াবলি নিয়ে আলাপ-আলোচনা করতে করতেই পরস্পরের চোখের মধ্যে পরস্পরকে খুঁজে ফেরা। তাঁদের দেহ-মনের ভাষার প্রতিনিধিত্ব করেছে তাঁদের চোখ। এরপরও দুজনের মাঝে বিশাল দেয়াল হয়ে বারবার দাঁড়াচ্ছিল অ্যালেনের সন্দেহপ্রবণ মন। তাঁর বারবার মনে হতো, ‘মৈত্রেয়ীর বাবা তাঁকে নিজের বাসায় আশ্রয় দিয়েছেন বিশেষ একটি উদ্দেশ্যে।  মৈত্রেয়ীকে তাঁর কাছে বিয়ে দেওয়ার জন্য। তাঁদের আদর-যত্ন আর আপ্যায়নের পেছনে মূল উদ্দেশ্য  এটাই।’ মৈত্রেয়ীদের বাসা থেকে বিতাড়িত না হওয়া পর্যন্ত এই চিন্তাই অ্যালেনকে পর্যুদস্ত করেছে। যেমন মৈত্রেয়ীদের বাসায় অ্যালেনের আশ্রয় পাওয়ার পর, মৈত্রেয়ীর সঙ্গে প্রেমভাব শুরু হওয়ার প্রথমদিকের একদিনের কিছু কথা উদ্ধৃত করছি : ‘আমাদের লেখাপড়া শেষ হলো। মৈত্রেয়ী চলে যাবার সঙ্গে সঙ্গে আমি উঠে গিয়ে বারান্দা থেকে এক গোছা ফুল তুলে নিয়ে এলাম। ফুলটাকে পাইপের গরম ছাই দিয়ে শুকিয়ে নিয়ে কাগজ চাপা দিয়ে বইয়ে রেখে দিলাম। তখন ফুলটাকে দেখে আর বোঝা যাচ্ছিল না যে, সেটা সদ্য তোলা। খাবার টেবিলে আবার দেখা ওর সঙ্গে। ওর চোখে তখন আশ্চর্য উজ্জ্বলতা। অনবরত হাসছিল মৈত্রেয়ী।

– মা বলছেন আমরা নাকি কি ছেলেমানুষি করছি। ভয়ে কাঠ হয়ে গেলাম। মিসেস সেনের দিকে তাকালাম। উনি শান্তভাবে হাসলেন। হঠাৎই আমার খুব খারাপ লাগল। আমাদের ভাবপ্রবণ ছেলেমানুষিগুলোও উৎসাহিত করা হচ্ছে দেখে মনে হলো যেন কোনো ষড়যন্ত্র চলছে আমায় নিয়ে যাতে আমি মৈত্রেয়ীর প্রেমে পড়ি। এখন বুঝতে পারছি কেন মৈত্রেয়ীকে আমার ঘরে পড়তে পাঠানো হয়েছিলো, কেন মি. সেন ডিটেকটিভ উপন্যাস পড়বার ছল করে সবসময় শোবার ঘরের দিকে রওনা দিতেন, কেনো দোতলায় কোনো লোক আমাদের ওপর গোয়েন্দাগিরি করতে নিচে নামতো না। আমার মনে হচ্ছিল, আমি তক্ষুণি ওই বাড়ি ছেড়ে পালাই।’

গল্প-উপন্যাসের ঐশ্বর্য হলো, এর পরতে পরতে যে-ঈর্ষা লুকোনো থাকে – সেটা। সেই ঈর্ষা বিষাক্ত সাপের মতো যত বেশি ফণা তুলবে – সেটা তত পাঠককে আকৃষ্ট করবে। কারণ মানুষ কখনো কখনো বিষ পান করে – বিষে আত্মহুতি দিয়ে আনন্দ পায়। তবে সে বিষাক্ত ঈর্ষা কিছুতেই স্থূল হতে পারবে না – হতে হবে সূক্ষ্ম। যেমন মৈত্রেয়ী ও রবীন্দ্রনাথের সম্পর্ক নিয়ে অ্যালেনের মধ্যে যে-ঈর্ষা। কিন্তু মৈত্রেয়ী মূলত রবীন্দ্রনাথের ভক্ত। তাঁর একগুচ্ছ দাড়ি রয়েছে তাঁর সংগ্রহে। রবীন্দ্রনাথও তাঁকে অসম্ভব স্নেহ করতেন। কিন্তু অ্যালেন সেই সম্পর্ককে কখনো স্বাভাবিক চোখে দেখেনি। রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে মৈত্রেয়ীর সম্পর্কের জটিল রসায়ন চিন্তা করে বহু রাত পার করে দিয়েছে অ্যালেন। খোকা মৈত্রেয়ীদের দূরসম্পর্কের গরিব আত্মীয়। খোকার সঙ্গে মৈত্রেয়ীর ঠাট্টা-ইয়ার্কি, হাসাহাসির শব্দে ঈর্ষায়, রাগে অ্যালেনের শ্বাস বন্ধ হওয়ার উপক্রম হতো। একদিন যখন মজা করার জন্য মৈত্রেয়ী খোকার পায়ের সঙ্গে তাঁর পা ঘষেছিল – রাগে অ্যালনের মাথার চুল ছিঁড়তে ইচ্ছে করছিল। খোকার সঙ্গে মৈত্রেয়ীর সম্পর্কের ধরন চিন্তা করে অনেক রাত তিনি না ঘুমিয়ে পার করেছেন। আর এটাই স্বাভাবিক। একটা খারাপ লোকও তার প্রেমাস্পদকে বুক দিয়ে আগলে রাখতে চায় – যাতে তার গায়ে এতটুকু দূষিত বাতাসও না লাগে। কিন্তু অ্যালেন বহু নারীর সঙ্গ উপভোগ করা যুবক জেনেও মৈত্রেয়ী এটা চিন্তা করে রাত পার করেননি। তিনি জেনেশুনেই সর্বান্তঃকরণে প্রেমের বিষ পান করতে চেয়েছেন। অ্যালেনের সঙ্গে চলে যেতে চেয়েছেন তাঁর দেশে। নারীর প্রেম ও দাম্পত্যের একটি বড় রহস্য বোধহয় এই যে, তারা স্বামীর সঙ্গে অতি আদরের পিতৃগৃহ ত্যাগ করতে চায়। আমি উদ্ধৃত করছি : ‘লুকিয়ে দুজনে দুজনকে আলিঙ্গন করে চুম্বন করতাম। আচ্ছন্ন হয়ে মৈত্রেয়ী তখন বলতো : ‘একদিন তুমি আমাকে নিয়ে যাবে। আমাকে সারা পৃথিবী ঘুরিয়ে দেখাবে।’ শরৎচন্দ্র হয়তো এজন্যই বলেছিলেন : ‘নারী প্রেমে বিশ্বাস করে ঠকাও ভালো।’ অ্যালেনের প্রতি মৈত্রেয়ীর প্রেম অনেক ত্যাগের – অতুল ঐশ্বর্যে ভরা। এ-সম্পর্কে অ্যালেনের স্বীকারোক্তি : ‘মৈত্রেয়ীর প্রতি আমার আসক্তি গভীর থেকে গভীরতর হচ্ছিল। গ্রাম্য কবিতার মতো সরলতা, সহযোগীর আন্তরিকতা, এবং এও স্বীকার্য যে, এক শারীরিক টানেরও সংমিশ্রণ ছিল সেটা। কার্পেটে বসে পড়াশোনা করার সময় কখনো কখনো ওর আলতো স্পর্শই আমাকে ভীষণ বিচলিত করতো। অনুভব করতে পারতাম ওর মধ্যে চঞ্চলতা ছড়িয়ে পড়েছে।’

তাঁদের প্রেম পর্বের মাঝমাঝি সময়ে কোনো এক রাতের কথা এখানে উদ্ধৃত করছি : ‘খাওয়ার পর মৈত্রেয়ী বারান্দায় শেষ অবধি আমার সঙ্গে এলো। এর আগে রাত্রে আমার শোবার ঘরের কাছে কখনো ও আসেনি।

– দয়া করে আমার ফুলটা ফেরত দিন।

আমি বুঝতে পারছিলাম ও অত্যন্ত চঞ্চল হয়ে উঠছে। কথা বলতে গিয়ে ইংরেজি ভুল করলো। আমি ওকে ঘরে ঢুকতে বলতে সাহস পাইনি, কিন্তু ওই-ই চৌকাঠ পেরিয়ে প্রথম আসার সুযোগেই ঘরে চলে এলো। আমি ওকে শুকনো ফুলটা দেখালাম।

– এই যে ফুলটা। আমার কাছে রাখি? আমি চাই এটা আমার কাছেই থাকুক।

হয়তো কথাগুলো ঠিক এরকমই ছিল না। রহস্যময় অস্পষ্ট এক অনুভূতি তখন আমায় আচ্ছন্ন করেছিল। সে ফুলটা হাতে তুলে নিলো, দেখলো, তারপর দরজায় ঠেস দিয়ে দাঁড়িয়ে হেসে ফেললো। হাসতে হাসতেই বললো :

– এটা সেই ফুল নয়।

– কেন?

আমার ধরাপড়া ফ্যাকাশে মুখ সে বিজয়িনীর দৃষ্টি দিয়ে দেখলো।

– ওটাতে আমার একটা চুল জড়ানো ছিল।

সেদিন মধ্যরাত্রিতে ঘুম ভেঙে গেলে শুনতে পাচ্ছিলাম মৈত্রেয়ীর ঘর থেকে গুন-গুন করে গানের সুর ভেসে আসছে।’

সামান্য শুকনো ফুল, একটু কাছে যাওয়া, হাতের একটু আলতো ছোঁয়া পাওয়া অনেক বড় বিষয়ে পরিণত হয়। অ্যালেনের মতো বহু নারীর সংস্পর্শ পাওয়া যুবকও মৈত্রেয়ীর নিষ্কুলষ প্রেমের দাবিকে উপেক্ষা করতে পারেননি। কারণ তিনি সহজলভ্য নন, কারণ তিনি মোহময়ী, রহস্যময়ী।

অপরদিকে, মানে মৈত্রেয়ীর পরিবার তাঁকে এত বেশি আগলে রাখত যে, তাঁর দম বন্ধ হওয়ার উপক্রম হতো। সকল প্রকার সুখের আবাসস্থল হওয়া সত্ত্বেও এখানে অবস্থানের কারণে নিজেকে তিনি একজন পরাধীন পরগাছা মনে করতেন। তাঁর বারবার মনে হতো, মৈত্রেয়ীকে তাঁর কাছে গছিয়ে দেওয়ার জন্য মিস্টার ও মিসেস সেন এমন চালাকির আশ্রয় নিয়েছেন। তাঁকে তাঁদের পরিবারের একজন করে নেওয়াটা তাঁদের ভান। একটি আলাদা ঘর দিয়েছেন – সেই ঘরে আবার মৈত্রেয়ীর পড়ার ব্যবস্থাও করেছেন – যাতে তাঁদের মধ্যে একটি অবিচ্ছেদ্য সম্পর্ক গড়ে উঠতে পারে। অর্ধেকের বেশি উপন্যাসে অ্যালেন এ-অন্তর্দ¦ন্দ্বে ভুগেছেন। তাঁর বারবার মনে হয়েছে, এটি তাঁর বিরুদ্ধে তাঁদের একটি ষড়যন্ত্রমূলক ফাঁদ। আর তিনি তাঁদের পাতা ফাঁদে একটু একটু করে পা দিচ্ছেন। এজন্য প্রায়শই তিনি বন্দি পাখির মতো ছটফট করতেন। কিন্তু খাঁচা আর শিকলের প্রতি মায়া পড়ে যাওয়ার কারণে খাঁচা ছেড়ে পালাতেও পারেননি।

আসলে সবই ছিল অ্যালেনের ব্যক্তিগত কল্পনা। আমরা একবারও মিস্টার কিংবা মিসেস সেনের মধ্যে এমন চিন্তা জাগতে দেখিনি। এমনকি মৈয়েত্রীর মধ্যেও, উপন্যাসের দুই-তৃতীয়াংশ পর্যন্ত। তাঁরা কেউই একান্ত নিজের মনে কিংবা পারিবারিক আলাপে এ-বিষয় নিয়ে কথা বলেননি। সবই অ্যালেনের দুর্বলচিত্তের অস্থির কল্পনা। বিস্ময়ের ব্যাপার, অ্যালেনের এমন অস্থিরচিত্ততা আমাদের অবাক করে না। আমরা বরং তাঁর প্রতি সহানুভূতিশীল হই, একমাত্র বিদেশি হওয়ার কারণে। একজন ভিনদেশি হিসেবে এসব চিন্তা তাঁর মধ্যে জাগা স্বাভাবিক। ভিন্ন আবহাওয়া পরিবেশ, পরিস্থিতি ও সংস্কৃতিতে ভিনদেশের একটি অতি সচেতন যুবকের নিজেকে হারিয়ে ফেলা কঠিন বইকি। একটি অনাত্মীয় পরিবারের সঙ্গে মানসিকভাব মিশে যাওয়াও কঠিন। মিস্টার সেনের পরিবার তাঁকে যত আপন করে নিয়েছে, সেনের পরিবারকে তিনি তত আপন করে নিতে পারেননি। এজন্যই আদর-আপ্যায়ন, সুখ-শান্তি তাঁর কাছে বন্দিত্বের মতো মনে হয়েছে। কারণ যে পাখি বনবাঁদাড়ে বড় হয়েছে, স্বাধীনভাবে পাহাড়-পর্বতে বিচরণ করেছে – তাকে সোনার শিকল দিয়ে বাঁধলেও সে বন্দি থাকতে পছন্দ করে না। যদি বলি, সেনের পরিবারে অ্যালেন বন্দিত্ব মেনে নিয়েছিলেন শুধু সুন্দরী, বিদুষী মৈত্রেয়ীর মোহে অন্ধ হয়ে, তাহলে কি ভুল হবে? উপন্যাসের অর্ধেক পর্যন্ত মৈত্রেয়ীর শরীরের প্রতিও তেমন কোনো টান অনুভব করেননি অ্যালেন। কারণ তিনি মনে করতেন, মৈত্রেয়ী ভারতীয় নিগার। এর আরেকটা কারণও হতে পারে, আশ্রয়দাতা গুরু নরেন্দ্র সেনের ভয়। যা হোক, ধীরে ধীরে ভারতীয় অধ্যাত্মবাদের দিকে ঝুঁকে পড়েন তিনি। মৈত্রেয়ীর সততা, নিষ্কলুষ জীবনযাপনের ধরন তাঁকে চুম্বকের মতো টেনে নিয়েছে। নারীসঙ্গ লাভের বাসনা ভালোবাসার বাসনায় পরিণত হয়েছে। এছাড়া নরেন্দ্র সেনের অতিথি হিসেবে তাঁর ছিল প্রভূত সম্মান। অন্তত উপন্যাসের অর্ধেকের বেশি জুড়ে সেটা অটুট ছিল। এসব কারণে এক ধরনের কৃতজ্ঞতা বোধ তাঁর অন্তরকে ভারত ও মৈত্রেয়ীর পরিবারের প্রতি বিগলিত করে রেখেছিল। পরে মৈত্রেয়ীর সঙ্গে নিবিড় সম্পর্কে জড়িয়ে গেলে তাঁর মনে হয়েছে : ‘ধর্মকে আমি নতুন করে জেনেছি এখানে, এই ভারতের মাটিতে, যে মাটির সঙ্গে ঈশ্বরের সম্পর্ক ঘনিষ্ঠ। যেখানকার মানুষ ক্ষুধার্ত, কিন্তু ভালোবাসার জন্য, স্বাধীনতার জন্য, জ্ঞানের জন্য, সত্তার মুক্তির জন সতত নিরত। এদের এই সান্নিধ্য ছাড়া খ্রিষ্টান ধর্মকেও আমি বুঝতে পারতাম না।’

অকথিত যৌন-আকর্ষণ অগ্নিসমান। এমন বাসনা মানুষের মগজে নেশার উদ্রেক করে। তখন সে নেশার টানে বহুদূর পর্যন্ত কলকির পেছনে চলে যায়। যদি কলকিতে টান দেওয়ার নিশ্চয়তা না-ও থাকে। চাইবার আগেই যারা দেহ-মন উজাড় করে দিয়ে দেয়, তাদের প্রতি কখনো কেউ এমন নেশাসক্ত হয় না। হলেও সে-আসক্তি হয় ক্ষণস্থায়ী। আর মৈত্রেয়ীর জন্য অ্যালেনের ভেতরে যে-নেশাসক্তি তৈরি হয়েছিল, সেটা নির্ভরতার, শ্রদ্ধার ও ভক্তির। মৈত্রেয়ী প্রচণ্ড শিক্ষানুরাগী, জ্ঞানী, অতুলনীয় সুন্দরী, বুদ্ধিদীপ্ত। তাঁর সাহচার্য প্রতিমুহূর্তে অ্যালেনকে উন্নত করেছে। অবচেতনে হলেও অ্যালেন সেটি বুঝতে পেরেছে। মৈত্রেয়ীর সৌন্দর্য সম্পর্কে অ্যালেনের মূল্যায়ন : ‘ওকে যে আমার প্রত্যেক দিনই ভালো লাগে তা নয়। ওর সৌন্দর্য ক্যাসিক্যাল সঙ্গীতের মত। ওর মুখ দেখে মাঝে মাঝে মনে হয় যে কোনো মুহূর্তে ও বিদ্রোহী হয়ে উঠতে পারে। ভাষার যাদুতে ও মুগ্ধ হয় সবচেয়ে বেশি। মনে পড়ে কতদিন সারারাত্রি ওর কথা ভেবেছি।’

অ্যালেন এটা বুঝতে পেরেছিল তাঁর বহুগামী কলঙ্কিত চরিত্রের ওপর মৈত্রেয়ী হলো পবিত্র ঝর্ণাধারা। এক নারীতে তুষ্ট থাকার অভাবনীয় মনোভূমি তাঁর ভেতরে তৈরি হয়েছিল তখন।

এজন্য মনস্তাত্ত্বিক যে-প্রশ্নটি আমাদের সামনে আসে সেটি হলো : মানুষ কী চায় সে জানে না। যখন জানতে পারে তখন হয়তো চাওয়ার সময় থাকে না। বহু নর-নারীর জীবনে প্রতিদিন এমন ঘটনা ঘটে চলছে। আসলে মানুষ কী চায় – সে জানতে পারে না যতক্ষণ না আকাক্সক্ষার বন্দরে পৌঁছে। কখনো তার সবকিছু পছন্দ হয়, ভালো লাগে, তুলে নিতে ইচ্ছে হয়। কখনো একটি কি দুটি। প্রথম দর্শনে যা ভালো লাগে। তবে দেখে-শুনে, জেনে-বুঝে, সাহচার্যে থেকে যা ভালো লাগে সেটাই হলো প্রকৃত ও যাচাইকৃত ভালো লাগা। মৈত্রেয়ীকে প্রথম দর্শনে নায়ক অ্যালেনের কিংবা তাঁর ইউরোপীয়
বন্ধু-বান্ধবীদের ভালো লাগেনি। কারণ ভারতীয় কৃষ্ণকায়াদের সৌন্দর্যের সংজ্ঞার সঙ্গে ইউরোপীয় শ্বেতাঙ্গদের সৌন্দর্যের সংজ্ঞার বিস্তর পার্থক্য। কিতাবাদিতে না থাকলেও বাস্তবে আছে। বক্তৃতায় না থাকলেও অন্তরে আছে। এজন্যই মৈত্রেয়ীর সৌন্দর্য নিয়ে অ্যালেন প্রথমে দ্বিধান্বিত ছিল। তারা শুধু চাকরির প্রয়োজনে ভারতকে বেছে নিয়েছিল কর্মক্ষেত্র হিসেবে। আর যৌনতার আকর্ষণ অ্যালেনের কাছে ব্যাপারই না। ইতোমধ্যে তিনি অনেক নারীসঙ্গী লাভ করেছেন। তাঁদের কালচারে হাত বাড়ালেই নারী পাওয়া যায় – যত ইচ্ছে। কিন্তু ভারতের বদ্ধ সংস্কৃতিতে, বিশেষ করে, নরেন্দ্র সেনের বাড়িতে এটা অকল্পনীয় ব্যাপার।

আরেকটা ব্যাপার, নরেন্দ্র সেনের বাড়ির ভাবগম্ভীর পারিবারিক পরিবেশে একটি প্রেম পরিণতি পেতে যে-সময় নিয়েছে – এই সময়ে দুজনের মধ্যে এবং পারিপার্শ্বিকতার কারণে যে ধরনের খুনসুটি, দুষ্টুমি হয়েছে, এগুলো সবই মধ্যবিত্ত বাঙালি পরিবারে স্বাভাবিক ব্যাপার। অতি তুচ্ছ ঘটনাগুলোও এখানে জীবন্ত হয়ে উঠেছে – লেখার সরল উপস্থাপনের কারণে। সরাসরি লেখকের নিজের জীবনের ঘটনা হওয়ার কারণে এসব তুচ্ছাতিতুচ্ছ ঘটনাও সুপাঠ্য হয়ে উঠেছে।

প্রেম যতদিন পবিত্র থাকে ততদিন সেটা কানাঘুষার কারণ হয় না। যখন তা যৌনতায় গড়ায় – পাড়া-প্রতিবেশীর সরস আলোচনার বিষয়ে পরিণত হয়। হিতাকাঙ্ক্ষী বন্ধুও শত্রুতে পরিণত হয়। অ্যালেন-মৈত্রেয়ীর ক্ষেত্রেও তাই ঘটল। পরিণতি হিসেবে অ্যালেনকেও মিস্টার সেনের বাসা ছাড়তে হলো। কিন্তু অ্যালেন-মৈত্রেয়ী ততদিনে লাইলি-মজনু, শিরি-ফরহাদ, রোমিও-জুলিয়েটের পরিণত বরণ করে নিয়েছেন। একজনের পক্ষে আরেকজনের সাহচার্য ছাড়া বেঁচে থাকাই দায়।

একটি উপন্যাসের জনপ্রিয় হওয়ার জন্য যা যা প্রয়োজন সবই রয়েছে লা নুই বেঙ্গলীতে। লেখকের সরল বর্ণনা সেটাকে সব ধরনের পাঠকের উপযোগী করে দিয়েছে।

সম্পর্ক কখন কীভাবে ভেঙে যাবে বলা কঠিন। আমরা সেটাকে অমোঘ পরিণতি বলতে পারি। এ ব্যাপারে কোনো সন্দেহ নেই যে, নরেন্দ্র সেন অ্যালেন-মৈত্রেয়ীর একটি মাত্র হঠকারী আচরণেই এত বেশি ক্ষুব্ধ হয়েছিলেন। অন্তত ন হন্যতে উপন্যাসে সে-ইঙ্গিতই রয়েছে। সেটি হলো : অ্যালেনের ঘরে মৈত্রেয়ীর রাত্রিযাপন। তাঁদের দুজনের প্রতি মিস্টার ও মিসেস সেনের পাহাড়সমান বিশ্বাস ভেঙে যাওয়াতেই এ-সম্পর্ককে করুণ পরিণতি বরণ করতে হয়েছে। না হলে যে নরেন্দ্র সেন অ্যালেনকে নিজ বাড়িতে আশ্রয় দেওয়ার সময় বলেছিলেন : ‘অ্যালেন, আমি ও আমার স্ত্রী আমরা সবাই তোমাকে খুব ভালোবাসি। তোমার কথা প্রায়শই আমাদের মধ্যে আলোচনা হয়। তুমি বাংলা জানলে দারুণ ভালো হত।’ সেই অ্যালেনকে শেষে কি না কোনো পূর্বনোটিশ না দিয়ে হাসতে হাসতে একদিনের মধ্যে বাড়ি থেকে বের হয়ে যেতে বলেছিলেন মিস্টার সেন। মূলত বড় ধরনের আশাভঙ্গের কারণেই মানুষ এমন করে।

– কখন যাব আমি? অ্যালেন জানতে চেয়েছিল।

– আজকেই। … তোমার মতো একটা উদ্যমী ছেলে সব সময়েই অসুবিধা কাটিয়ে উঠতে পারবে। তুমি যদি এক্ষুনি বেরিয়ে পড়ো তো দুপুরের খাবারের আগেই একটা আস্তানা খুঁজে বার করতে পারবে। খোকা ট্রাকে করে তোমার সব জিনিসপত্র পৌঁছে দিয়ে আসবে।

মিস্টার সেন নরম কণ্ঠে বললেন : “আমি তোমাকে অনুরোধ করব এখনই চলে যেতে।’ তাঁর ঠোঁটে লেগেছিল বিদ্রূপ মেশানো হাসি। তিনি হাত বাড়িয়ে বললেন : ‘গুড বাই অ্যালেন।’ লক্ষণীয় যে, জিনিসপত্র নিয়ে যাওয়ার জন্যও আর তাঁকে ও-বাড়িতে যেতে বলা হয়নি।

ওই সময় অ্যালেনের মনে একটি প্রশ্ন জেগেছিল, তিনি তো আমায় মারধর করতে পারতেন, করলেন না কেন?

উত্তরটা উপন্যাসে উহ্য রয়েছে। আমার মনে হয় : তাঁকে মিস্টার সেনের পরিবার অত্যন্ত ভালোবেসেছিল। মনে মনে পুত্র হিসেবে দত্তক নিয়েছিল। এত ভালোবাসার মানুষের সঙ্গে শেষমেশ খারাপ ব্যবহার তিনি করতে পারেননি। ভদ্রলোকেরা তাই করে। ভেতরে কষ্ট চাপা দিয়ে বাইরে হাসে। আরেকটা কারণকেও একেবারে উড়িয়ে দেওয়া যায় না। যেমন, বেশি ঘাঁটাঘাঁটি করলে মৈত্রেয়ীর নামে কলঙ্ক রটে যেতে পারে। সেটা তাঁর বিয়ের পক্ষে বড় অন্তরায় হতে পারে। অ্যালেনকে মারধর বা অতি মানসিক আঘাতে মৈত্রেয়ী আত্মহত্যা করতে পারেন – এইসব ভয়ও হয়তো অসুস্থ মিস্টার সেনের মধ্যে কাজ করছিল।

একটি সামাজিক উপন্যাসের সফল হওয়ার জন্য সবচেয়ে বেশি যা যা থাকা দরকার যেমন টানাপড়েন, ঈর্ষাকাতরতা, দ্বিধা, সংকোচ, প্রতিমুহূর্তের অন্তর্দ্বন্দ্ব – সবই এতে আছে, তবে অতি সরল বর্ণনায়। ন হন্যতে লেখার ক্ষেত্রে মৈত্রেয়ী দেবী একটি সুবিধাজনক অবস্থানে ছিলেন। সেটি হলো, মির্চার বক্তব্য খণ্ডন করা এবং কাউন্টার বক্তব্য দিয়ে তাঁর মিথ্যাচারকে সকলের সামনে তুলে ধরা। কিন্তু তা করতে গিয়ে যে-স্টাইল তিনি অনুসরণ করলেন সেটি হলো অতি আকর্ষণীয় কিছু। যা পাঠককে চুম্বকের মতো টানল। মূলত মৈত্রেয়ীর ন হন্যতে পড়ার পরই পাঠক অনুসন্ধিৎসু হয়ে লা নুই বেঙ্গলী পড়েন। ন হন্যতের সব পাঠকের ভেতরে অদম্য আগ্রহ তৈরি হয় লা নুই বেঙ্গলীতে কী আছে তা দেখার জন্য। আমার ক্ষেত্রেও সেই একই অবস্থা তৈরি হয়েছিল।

আসলে, আমি যেমন ধারণা করি, প্রেম বিষয়টা আধা-মানসিক আধা-শারীরিক। দুটোর একটি জীবনের কোনো কোনো সময় থাকে না। শিশু-কিশোর-তরুণ-যুবক, ভারতীয় উপমহাদেশে বিবাহের পূর্ব পর্যন্ত, আবার বার্ধক্যে। কিন্তু মানসিক প্রেম সারাজীবন থাকে। এজন্য স্বামী-স্ত্রীর বন্ধন চিরকালীন, বিশেষ করে আরব, মধ্যপ্রাচ্যের অনেক দেশ ও ভারতীয় উপমহাদেশে। আর এ-উপমহাদেশে ধর্মীয় ও সামাজিক নিয়মনিষ্ঠা যতটা কঠোর, ততটাই আধ্যাত্মিক। এই একবিংশ শতাব্দী পর্যন্ত এটিই চলে আসছে। বৈবাহিক সম্পর্কের এমন আধ্যাত্মিকতা আফ্রিকা-অস্ট্রেলিয়া মহাদেশে কিংবা ইউরোপে আছে কি না আমার জানা নেই। অ্যালেন-মৈত্রেয়ী বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ না হয়েও সেই আধ্যাত্মিকতার স্তরে পৌঁছে গিয়েছিলেন। এই আধ্যাত্মিকতার বার্তা রয়েছে অ্যালেনকে লেখা মৈত্রেয়ীর শেষ চিঠিতে : ‘… আমি তোমাকে হারিয়ে কী নিয়ে বাঁচব? তুমি যে আমার সূর্য, তোমার কিরণধারাই যে আমার প্রাণসত্তা। … প্রতি রাতেই তুমি আমার কাছে আসো, যেমন করে তোমাকে আমাদের ভবানীপুরের বাড়িতে পেতাম আর আমি তোমার কাছে কনে-বউ সেজে যেতাম। তুমি আমাকে নারীত্বে উত্তীর্ণ করে দিয়েছিলে। আর তুমি, তুমি আসো অজস্র মণিমুক্তা সজ্জিত সুবর্ণ দেবতার মতো, অসীম অপার সুষমায় আমি তোমার সামনে সাষ্টাঙ্গে প্রণত হই।’

মৈত্রেয়ী দেবী তাঁর উপন্যাস ন হন্যতেতে যা-ই বলুন না কেন, লা নুই বেঙ্গলীতে অ্যালেনের এই প্রেম মানব-মানবীর অবিনশ্বর ভালোবাসার কথাই বলে।