লোকবিদ্যার নিবিড় পর্যবেক্ষণের

সাইমন জাকারিয়া

বাংলার লোকায়ত পরিম-ল অনন্ত বৈচিত্র্যে পরিপূর্ণ। কোনো একক ব্যক্তি বা গবেষকের পক্ষে এক জীবনে সেই অনন্ত বৈচিত্র্যের লোকায়ত পরিম-লের সামগ্রিক রূপ বা পরিচয় নিয়ে গবেষণা সম্পাদন করা প্রায় অসম্ভব। তাই বুদ্ধিমান গবেষক শুরুতেই নিজের গবেষণার সীমানা নির্ধারণ করে নেন এবং সে-অনুযায়ী কার্য সাধন করেন। তবে, কোনো গবেষক যে সামগ্রিকতাকে ধারণ করতে চাননি এমন কথাও ঠিক নয়, কিছু ব্যতিক্রম নিশ্চয় আছে, যেমন – গবেষক আশুতোষ ভট্টাচার্য বাংলার লোকায়ত পরিম-লের প্রায় সবদিক নিয়ে আলোচনা-বিশেস্নষণ করেছেন। তবে, নিজের গবেষণার সীমা নির্ধারণ করে নিয়ে যাঁরা বাংলার লোকায়ত পরিম-লের কোনো দিক নিয়ে গবেষণায় বিশেষ কৃতিত্ব প্রদর্শন করেছেন তাঁদের মধ্যে অধ্যাপক শীলা বসাক (১৯৪৭-২০১৫) অগ্রগণ্য। তিনি গভীর নিষ্ঠা ও প্রজ্ঞায় বাংলার লোকায়ত পরিম-লের বিশেষ দিক তথা  – ধাঁধা, ব্রতপার্বণ, নকশিকাঁথা ও কিংবদন্তিবিষয়ক ক্ষেত্রসমীক্ষাধর্মী বিশেস্নষণী গবেষণাকর্ম সম্পাদনে ও গ্রন্থ প্রণয়নে নিজের পরিচয় প্রতিষ্ঠা করতে সমর্থ হয়েছেন।

সম্প্রতি ভারতের কলকাতার বিখ্যাত প্রকাশনা সংস্থা পুস্তক বিপণি প্রয়াত এই লোকসংস্কৃতিবিদ স্মরণে আনিসুজ্জামান, পবিত্র সরকার ও পলস্নব সেনগুপ্তের সম্মিলিত সম্পাদনায় শীলা-লিপিমালা শীর্ষক একটি দৃষ্টিনন্দন ও সমৃদ্ধ গ্রন্থ প্রকাশ করেছে। সম্পাদকত্রয় এই গ্রন্থের পূর্ববাচনে যথার্থই বলেছেন – ‘প্রয়াত অধ্যাপক শীলা বসাক ছিলেন এমন একজন বিরল গবেষক, যিনি খুব অল্প সময়ের মধ্যে নিজের অক্লান্ত নিষ্ঠা ও আন্তরিকতায় বাংলা লোক-সংস্কৃতিচর্চার নানা বিশিষ্ট ক্ষেত্রে পুরোধার ভূমিকা গ্রহণ করেছিলেন, এবং একই সঙ্গে একাধিক বহুমূল্য প্রামাণিক ও আকরপ্রতিম গ্রন্থ রচনা করে গিয়েছেন।… বাংলার ধাঁধা হোক, নকশিকাঁথা হোক, ব্রতপার্বণ হোক, প্রবাদপ্রবচন হোক, লোককথা ও কিংবদন্তি হোক, – তাঁর প্রতিটি কাজ অন্যদের কাছে এ-ধরনের গবেষণার একটি আদর্শ নির্মাণ করে – ব্যাপ্তি ও গভীরতায় সমগ্র পরিসরকে গ্রহণ করে, বিষয়ের বহুবিধ বৈচিত্র্যকে স্মরণ করে, কীভাবে তীক্ষন বিশেস্নষণের সাহায্যে তার দশদিগন্তের পরিচয় প্রকাশ করা যায়, এ বিষয়ে শীলা ছিলেন অনন্যা।’

সম্পাদকত্রয়ের এ-বক্তব্যের সঙ্গে সাজুয্য খুঁজে পাওয়া যায় এই গ্রন্থে অন্তর্ভুক্ত নবনীতা দেবসেনের ‘বাংলার লোকসংস্কৃতির একনিষ্ঠ ব্রতিনী, শীলা বসাক’ শীর্ষক স্মৃতিচারণমূলক রচনায়। তিনি লিখেছেন – ব্রতকথা নিয়ে তো কম বই বের হয়নি। ১৩১৯ বঙ্গাব্দে কিরণবালা দাসীর ব্রতকথা, ১৩২০ বঙ্গাব্দে রামপ্রাণ গুপ্তের ব্রতমালা, ১৩৩৩ বঙ্গাব্দে অন্নপূর্ণা দেবীর মেয়েদের ব্রতকথা, কিংবা কমলিনী সাহিত্য মন্দিরের ব্রতদর্পণ থেকে শুরু অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর, ইন্দিরা দেবী চৌধুরানীর বাংলার ব্রতপালন সংক্রান্ত বই। সেই থেকে বাংলার ব্রত নিয়ে প্রচুর গবেষণামূলক কাজ চলছে। কিন্তু এর মধ্যে শীলা বসাকের ব্রতপার্বণ বইটি আগের গবেষণাকর্ম ও বইগুলি থেকে আলাদা। কারণ, ‘তাঁর বিষয় ব্রতকথা নয়, ব্রতপার্বণ। ব্রতপার্বণের ভিতরের কথা, আর তার আচারের কথা। প্রচ- পরিশ্রম করে সারা পৃথিবীর লোকসংস্কৃতি চর্চার প্রেক্ষিত মাথায় রেখে বাংলার ব্রতগুলি সংকলন ও বিশেস্নষণ করেছেন শীলা। বাংলার বাইরের বেশকিছু ব্রত নিয়েও আলোচনা আছে এখানে, রাজপুতনা, পাঞ্জাব, ওড়িশা, বিহার, উত্তরপ্রদেশ, গুজরাট ইত্যাদি। বইটির ক্ষেত্র বাংলার বাইরেও ছড়িয়ে পড়েছে। অন্যান্য ব্রতকথার বই এভাবে ক্ষেত্রসমীক্ষার দ্বারা পরিপুষ্ট হয়নি। শীলা আমাদের দিয়েছেন পরবর্তী গবেষকদের কাজে লাগাবার মতো অজস্র খুঁটিনাটি সহায়ক তালিকা।’ যে গবেষক পরবর্তী গবেষকদের জন্য কাজের সূত্র ও উপকরণ নিজের গবেষণার মধ্যে জিইয়ে রাখেন সে- গবেষককে দূরদর্শী গবেষক হিসেবে অভিহিত করা যায়; শীলা বসাক সে-ধরনের একজন দূরদর্শী গবেষক, যিনি গবেষণাকর্মের ভেতর ভবিষ্যতের গবেষণাসূত্র গেঁথে রেখেছেন, নিশ্চয় ভবিষ্যতের গবেষকদের কেউ শীলার গবেষণাপথের পরম্পরা আরো বহুদূর বিসত্মৃত করবেন। আমাদের বিবেচনায় শীলা-লিপিমালা শীর্ষক প্রকাশনাটির স্মৃতিচারণমূলক গদ্যসমূহ একদিকে যেমন ভবিষ্যতের গবেষকদের পরিকল্পিত গবেষণাকর্মের আকাঙক্ষাকে উস্কে দেবে, অন্যদিকে তেমনি একজন গবেষকের পারিবারিক ও সামাজিক জীবনের মানবিক চরিত্র গড়নে সহায়ক হতে সাহায্য করবে।

আনিসুজ্জামান-রচিত ‘শীলার অমলিন স্মৃতি’ শীর্ষক রচনায় এপার বাংলা ও ওপার বাংলার দুটি পরিবার তথা বাংলাদেশের আনিসুজ্জামান পরিবারের সঙ্গে ওপার বাংলার শীলা বসাকের পরিবারের গভীরতর সম্পর্কের বিবিধ সূত্র উদ্ঘাটিত হয়েছে, শুধু দেশের সীমারেখা অতিক্রম করে দুটি পরিবার পরস্পরের সকল সামাজিক
আচার-অনুষ্ঠানে যোগ দিয়ে প্রতিষ্ঠা করতে পেরেছে ধর্মীয় পরিচয়ের বাইরে একটি মানবিক ও সামাজিক পরিচয়। আনিসুজ্জামানের রচনা থেকে যেমন জানা গেল – তাঁর পুত্রবধূ ‘ইলোরা সমত্মানসম্ভবা হলে শীলা তাঁকে সাধ খাওয়াবে বলে নিজে থেকেই এল, সঙ্গে করে নিয়ে এল তার সকল উপকরণ, তারপর এখানেই রান্না করে খাওয়াল। আমাদের বাড়িতে এই সংস্কারের চল ছিল না।’ সেই সঙ্গে এও জানা গেল, শীলা বসাকের মেয়ে মিলির বিয়েতে আনিসুজ্জামান সপরিবারে গিয়েছিলেন কলকাতায়; শুধু তাই নয়, শীলা-লিপিমালা শীর্ষক গ্রন্থে অন্তর্ভুক্ত একটি রঙিন আলোকচিত্র ও তার ক্যাপশন থেকে জানা গেল – শীলা বসাকের ‘কন্যা মিলির বিয়ের অনুষ্ঠানে সাক্ষীরূপে স্বাক্ষর করছেন’ আনিসুজ্জামান। এ ধরনের পারস্পরিক পারিবারিক মিথস্ক্রিয়ার নিদর্শন ও মানবিক সম্পর্ক উন্নয়নের নানান ঘটনা শীলা-লিপিমালা গ্রন্থের স্মৃতিচারণ অংশের বেশকিছু রচনায় রয়েছে। তবে, স্মৃতিচারণ অংশে শুধু যে ব্যক্তিগত স্মৃতি প্রাধান্য পেয়েছে তা নয়, সেই সঙ্গে শীলা বসাকের গবেষণা-পদ্ধতি, গবেষণার মৌলিকত্ব ইত্যাদি নিয়েও দৃষ্টিপাত করা হয়েছে, যেমন – আনিসুজ্জামানের রচনাতেও ব্যক্তিগত পারিবারিক জীবনের স্মৃতির পাশাপাশি শীলার গবেষণাকর্মের চমৎকার মূল্যায়ন পাওয়া যায় এভাবে – ‘ধাঁধা-ব্রত-কিংবদন্তি-নকশিকাঁথা – যে-বিষয়েই শীলা গবেষণা করে থাকুক না কেন, তার লক্ষ্য ছিল সে-বিষয়ের সামাজিক দিকটি অধ্যয়ন করা। তার জন্যে সে স্থান-স্থানান্তরে ঘুরে বেড়িয়েছে কষ্ট স্বীকার করে। খুব কম গবেষকই নিজে এত শ্রম দিয়ে ক্ষেত্রসমীক্ষা করেন। তার অধীত বিষয়ের সঙ্গে নাড়ির যোগ রয়েছে সাধারণ মানুষের। তাদের প্রতি সে সর্বদা শ্রদ্ধার ভাব পোষণ করেছে। তাদের সংস্কার, বিশ্বাস, আচরণ এবং সৃজনশীলতা সে চমৎকারভাবে ধরে রেখেছে তার কাজে। তত্ত্বপ্রতিষ্ঠার দিকে সে যায়নি, জীবনের সরল সত্যকে পুনরাবিষ্কার করতে চেয়েছে এবং তাতে সফল হয়েছে।’ আনিসুজ্জামানের এ-ধরনের মন্তব্যের ভেতর দিয়ে শীলা বসাকের গবেষণার বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে সহজেই ধারণা পাওয়া যায়, বাংলার লোকায়ত পরিম-লের বিচিত্র আচার-সংস্কৃতি-সৃষ্টিশীল কাজের ব্যাখ্যায় সাধারণত তত্ত্বপ্রতিষ্ঠার কৃত্রিম চর্চা পরিত্যাগ করে তিনি ক্ষেত্রসমীক্ষাধর্মী গবেষণায় ‘জীবনের সরল সত্যকে পুনরাবিষ্কারে’ ব্রতী ছিলেন।

শীলা বসাকের কাজের বিশেষ দিক সম্পর্কে মূল্যায়ন করতে গিয়ে নবনীতা দেবসেন বাংলাদেশের সঙ্গে শীলা ও তাঁর কর্মসূত্রের নিবিড় সম্পর্ক বর্ণনা করেছেন। বলেছেন, চন্দ্রাবতীর রামায়ণনির্ভর ‘মেয়েদের মৌখিক গানে’র উৎস অনুসন্ধান করতে তিনি শীলার আগেই একবার ময়মনসিংহের পাতুয়ারী গ্রামে গিয়েছিলেন। কিন্তু শীলার বই পড়ে জানান – ‘সবচেয়ে মজার কথা, এবং খুশির কথাও, যিনি আমাকে নিয়ে মৈমনসিংহের গ্রামে গ্রামে ঘুরেছিলেন, কিশোরগঞ্জের, কেন্দুয়ার ও নেত্রকোনার বয়স্কা গাইয়ে মহিলাদের সঙ্গে, গ্রামের গাইয়ে মেয়েদের দলের সঙ্গে আলাপ পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলেন, গান শোনার ব্যবস্থা করে দিয়েছিলেন, শীলার বইটি খুলে দেখি, বাহ্! বাংলাদেশের গ্রামে গ্রামে ব্রত বিষয়ে জানবার জন্যে মেয়েদের কাছে শীলাকেও পথ দেখিয়ে নিয়ে গিয়েছেন তিনিই। ঢাকা বাংলা একাডেমি থেকে জনাব শামসুজ্জামান খান সাহেব যে-ভদ্রলোকের হাতে আমাকে, এবং শীলাকে সমর্পণ করেছিলেন ক্ষেত্রসমীক্ষার কাজে পথপ্রদর্শক-সঙ্গী হিসেবে সেই অসামান্য মানুষটি মোহাম্মদ সাইদুর। তাঁকে শীলা বর্ণনা করেছেন, ‘আজকের চন্দ্রকুমার দে’ বলে। অসাধারণ সুষ্ঠু বর্ণনা, আমিও তাই বলি। তিনি গ্রামে গ্রামে ঘুরে শুধু যে গান, ছড়া, কথা সংগ্রহ করেন তা নয়, প্রায় লুপ্ত হতে বসা বিবিধ গ্রামীণ হস্তশিল্পের নমুনাও সাইদুরের সংগ্রহে আছে। তিনি নিজের চেষ্টায়, নিজস্ব সংগ্রহের একটি ছোট সংগ্রহশালাও তৈরি করেছিলেন ওই অঞ্চলের একটি গ্রামে, দিগন্তছোঁয়া শান্ত ধানক্ষেতের মধ্যে এক মাটির বাড়িতে। আমার সৌভাগ্য হয়েছিল সাইদুরের সঙ্গে সেই অমূল্য সংগ্রহশালাটিতে চোখ বোলাবার। কতরকমের গ্রামীণ শিল্পকর্ম, হাতপাখা, নকশিকাঁথা, মাটির তৈরি বাসনপত্র, আলপনা আঁকা পাত্র, বোনা আসন, আর অনেক কিছু ছোটোখাট, কিন্তু গ্রামীণ জীবনের জন্য জরুরি শিল্পময় জিনিসপত্র সেইখানে দেখিয়েছিলেন সাইদুর। গ্রামবাংলার হাতের কাজ। সময়টা বোধহয় ১৯৯৩ কি ৯৪ হবে।’ নবনীতা দেবসেনের এই স্মৃতিচারণের মাধ্যমে শীলার গবেষণাপদ্ধতির সঙ্গে উঠেছে বাংলাদেশের লোকায়ত পরিম-লের সমৃদ্ধ ইতিহাসের কথা, যে-কারণে আগে ও পরে দুজন নারী-গবেষককে সীমান্ত পাড়ি দিয়ে বাংলাদেশে ক্ষেত্রসমীক্ষা করতে আসতে হয়েছে; পাশাপাশি বাংলাদেশের লোকায়ত পর্যায়ে গবেষণা সহায়ক প্রতিষ্ঠান ও ব্যক্তি হিসেবে বাংলা একাডেমির সঙ্গে যুক্তভাবে শামসুজ্জামান খান ও মোহাম্মদ সাইদুরের কথা উঠে এসেছে। শুধু তাই নয়, বাংলাদেশের গ্রামীণ সংস্কৃতির নানন্দিক সৃষ্টিভাণ্ডারের নিবিড় পর্যবেক্ষক ও সংগ্রাহক হিসেবে মোহাম্মদ সাইদুরের অবদানের কথা স্বীকৃত হয়েছে।

শীলা-লিপিমালা শীর্ষক গ্রন্থের শুরুতে সম্পাদকত্রয়ের ‘পূর্ববাচন’ ও শীলা বসাকের স্বামী জগদীশ বসাকের ‘এই গ্রন্থের নেপথ্যে’ শীর্ষক নাতিদীর্ঘ বিবরণ মুদ্রিত হয়েছে। গ্রন্থটি মোট সাতটি পর্বে বিভক্ত, যথা – ‘স্মৃতিচারণ’, ‘গ্রন্থ আলোচনা’, ‘মৌলিক রচনা’, ‘পত্র-পত্রিকায় শীলা’, ‘চিঠিপত্র’, ‘জীবনপঞ্জি’ ও ‘লেখক পরিচিতি’। এছাড়া কয়েকটি স্তরে বেশকিছু আলোকচিত্র অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। এর মধ্যে ‘স্মৃতিচারণ’ অংশে আনিসুজ্জামান থেকে শুরু করে দুলাল চৌধুরী, নবনীতা দেবসেন, আনোয়ারুল করীম, ওয়াকিল আহমদ, বারিদবরণ ঘোষ, তপোধীর ভট্টাচার্য, বরুণকুমার চক্রবর্তী, সত্যবতী গিরি, বিশ্বনাথ রায়, সুদেষ্ণা বসাক (মিলি) প্রমুখ ৫৫ জনের রচনা সংকলিত হয়েছে। স্মৃতিচারণমূলক রচনায় বহুকৌণিক দিক থেকে শীলা বসাক ও তাঁর কাজকে মূল্যায়ন করা হয়েছে।

গ্রন্থ আলোচনা পর্বে শীলা বসাকের রচিত গ্রন্থ সম্পর্কে সুধীর চক্রবর্তী থেকে শুরু করে আবদুল খালেক, শামসুজ্জামান খান, তারাপদ সাঁতরা ও নিয়াজ জামানের বিশেস্নষণী প্রবন্ধ সংকলিত হয়েছে। এই অংশে অন্তর্ভুক্ত ‘নকশি কাঁথার আকরগ্রন্থ’ শীর্ষক প্রবন্ধে শামসুজ্জামান খানের মন্তব্যের ভেতর দিয়ে শীলা বসাকের গবেষণার সামগ্রিক মূল্যায়ন ফুটে উঠেছে, তিনি লিখেছেন – ‘ফোকলোর পণ্ডিতরা লোকশিল্পবিষয়ক কাজকে তিনটি ভাগে বিভক্ত করে দেখেন : এক. বিচ্ছিন্ন (স্ক্যাটারড) কিন্তু কোনো-না-কোনো মাত্রিকতামুক্ত (ডাইমেনশন) – জসীমউদ্দীন, তোফায়েল আহমেদ ও মোহাম্মদ সাইদুরের কাজ এ-পর্যায়ের; দুই. ডেসক্রিপটিভ স্পেড – শীলা বসাকের কাজটিতে এ-পর্যায়ের কাজে যে-পূর্ণতা প্রত্যাশিত তা পরিপূর্ণভাবে আছে; তিন. অ্যানলিটিক্যাল ডেপথ – ক্রামরিশ, হেনজ মোডে, দীনেশ সেন, গুরুসদয়, কমলা দেবী, নিয়াজ, পারভীন ও শীলার কাজে এদিকেরও কিছু প্রতিফলন আছে। তবে এ-ধারায় পূর্ণাঙ্গ কাজ এখনো হয়নি। শীলার বর্তমান কাজটি এই শেষোক্ত ধারার কাজের চমৎকার ভিত্তি নির্মাণ করেছে। কারণ, এর আগে দুই বাংলার নকশিকাঁথা বিষয়ে এত বিশাল তথ্যপূর্ণ, বাংলা ভারত ও বাংলাদেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে ক্ষেত্র অনুসন্ধাননির্ভর ও আর্কাইভস-জাদুঘর-সংগ্রহশালা চষে এত অনুপুঙ্খভাবে এ-কাজ কেউ করেননি। শ্রমে-নিষ্ঠার-অঙ্গীকারে শীলার কাজটি হয়েছে এনসাইক্লোপিডিক বা আকরগ্রন্থধর্মী।’ আন্তর্জাতিক পরিম-লে চর্চিত গবেষণাধারার প্রকৃতি উলেস্নখ করে তার সঙ্গে তুলনামূলক পদ্ধতিতে শীলার কাজের এই মূল্যায়ন আমাদের নতুনভাবে শীলা বসাকের গবেষণাকর্মের বিষয়ে আগ্রহী করে তোলে। অন্যদিকে সুধীর চক্রবর্তী ‘তর্পণ’ শিরোনামে শীলার অন্য কাজের আলোচনায় লিখেছেন – ‘শীলা বসাকের জন্মসাল ১৯৪৭। শীলা বাংলার অধ্যাপিকা, লোকসংস্কৃতি চর্চায় বহু দিন ধরে তৎপর। বাংলা ধাঁধা ও বাংলার ব্রতপার্বণ বিষয়ে শীলার বই প্রণিধানযোগ্য।’ গ্রন্থালোচনার পরের পর্বে পবিত্র সরকার থেকে শুরু করে সোমেন সেন, অচিমত্ম্য বিশ্বাস, পলস্নব সেনগুপ্ত, মালেকা বেগম, আবুল আহসান চৌধুরী, সেলিনা হোসেন, সৈয়দ মোহাম্মদ শাহেদ প্রমুখের রচিত সাহিত্য, সংস্কৃতি, শিল্প, নাটক, পুরাণ, নগরায়ণ, লোকসংগীত, সমাজ, নারী, লোককথা, লোকগল্প ইত্যাদি বিচিত্র বিষয় নিয়ে ২১টি মৌলিক রচনা স্থান পেয়েছে, যা গবেষক শীলা বসাকের গবেষণাকর্মের সঙ্গে সঙ্গতি রেখে বিচিত্র ধারার গবেষণাকর্ম সম্পর্কে তথ্য প্রদানের মাধ্যমে এই গ্রন্থের গবেষণামূল্য অনেকাংশে বৃদ্ধি করেছে।

পর্যায়ক্রমে এই গ্রন্থে অন্তর্ভুক্ত ‘পত্রপত্রিকায় শীলা’, ‘চিঠিপত্র’ ও ‘জীবনপঞ্জি’ পাঠে শীলা বসাকের বিচিত্র কর্মজীবন ও আগ্রহের কথা জানা যায়। অনুধাবন করা যায়, একজন শীলা বসাক বাঙালি নারীর নানাবিধ সীমাবদ্ধতাকে অতিক্রম করে তিনি নিজস্ব সাধনার বলে দিনের পর দিন গভীর অধ্যয়ন, অনুসন্ধান, অভিনিবেশ, অনুরাগে তাঁর যাবতীয় কাজ সম্পাদন করেছেন। ক্ষেত্রসমীক্ষা বা সরেজমিন অনুসন্ধানে ছুটে গেছেন গ্রাম-গ্রামান্তরে। এর ফলে তাঁর প্রতিটি উদ্যোগ পেয়েছে উৎকর্ষ ও অভিনন্দন, যার তুলনা দুর্লভ। তাঁর কাজের পরিচয় রয়ে গেছে প্রকাশিত গ্রন্থ বাংলার ধাঁধা বিষয়বৈচিত্র্য ও সামাজিক পরিচয়, বাংলার ব্রতপার্বণ, বাংলার নকশিকাঁথা, বাংলার কিংবদন্তি, আমি তোমাদেরই লোক, Nakshi Kantha of Bengal, Bengali Culture & Society, through its Riddles, Women’s Brata Rituals শীর্ষক গ্রন্থসমূহের মধ্যে। শীলার এই গ্রন্থটি বাংলার সংস্কৃতির গভীরতর ব্যঞ্জনাকে এমনভাবে ধারণ করেছে, যা নতুন প্রজন্মের গবেষককে পুনর্বার আকৃষ্ট করে লোকায়ত পরিম-লের সৃষ্টিশীলতার বিচারকার্যে। আমাদের বিশ্বাস, শীলা বসাকের জীবনাবসানের পর তাঁর স্মৃতিকে ধরে রাখার উদ্দেশ্যে শীলা-লিপিমালা শীর্ষক গ্রন্থের পরিকল্পনা সফল হয়েছে। কেননা, এই গ্রন্থের মাধ্যমে যথার্থই ধরা পড়েছে এমন একজন সংস্কৃতিকর্মীর পরিচয়, যাঁর জাগতিক নাম শীলা বসাক, আর যিনি লোকসংস্কৃতিচর্চার ক্ষেত্রে ছিলেন নিবেদিত সেবক। ধারাবাহিক কাজই তাঁর জীবনের পূর্ণ সৌরভ এবং গৌরব। সত্যিকার অর্থেই এই গ্রন্থভুক্ত ৮১ জন প্রবন্ধকারের কলমে শীলা বসাকের জীবন ও কাজের প্রাণবন্ত ছবি ফুটে উঠেছে। শীলা বসাকের আত্মার প্রশান্তি কামনা করি। r