সুতপা রোজকার মতো আজো ভোরবেলা উঠে পড়েছে। ঘুম থেকে উঠে পড়েছে বললে ভুল বলা হবে। সারারাত দু-চোখের পাতা সে এক করেনি। ক্লান্ত-অবসন্ন শরীরটাকে বিছানায় এলিয়ে দিয়েছিল ঠিকই, কিন্তু ঘুম আসার মতো মানসিক অবস্থায় সে ছিল না। সত্যি বলতে কী, বিগত তিন সপ্তাহ ধরে ঘুম বলতে আসলে যা বোঝায়, তা হয়নি সুতপার। এমনি আরো কত রাত কাটাতে হবে তা সে নিজেও জানে না। বাড়ির সামনের বাগানটাতে এসে দাঁড়াল সুতপা। করবীগাছটা ফুলে ফুলে ছেয়ে গেছে। কত স্মৃতি জড়িয়ে আছে এই গাছটার সঙ্গে। রোজ ভোরবেলা সুতপা ফুল তুলত পুজোর জন্য। কুনাল যখন ছোট ছিল, একগুচ্ছ করবী ফুল তুলে দৌড়ে গিয়ে রাজর্ষির ছবির সামনে রেখে দিত। তারপর এক ছুটে বাগানের লোহার কপাট খুলে বাইরে গিয়ে দাঁড়াত স্কুলবাসের অপেক্ষায়। মনে হয় যেন সেদিনের কথা। আজ তিন সপ্তাহ হয়ে গেল সুতপা পুজোর জন্য ফুল তোলেনি। ঠাকুরকে ফুল দিয়ে সাজিয়ে নৈবেদ্য দিতে তার ইচ্ছে হয়নি। আজ করবীগাছ থেকে কয়েকটা ফুল তুলল সে, তারপর দু-হাত ভরে রাজর্ষির ছবির সামনে মার্বেলের টেবিলে সাজিয়ে দিলো, ঠিক যেমনটি কুনাল করত।

মেজর রাজর্ষি সিংহরায় ছবির ফ্রেমের মধ্য থেকে সুতপার দিকে তাকিয়ে আছেন। বত্রিশ বছরের তরুণ, চোখের দৃষ্টি তীক্ষè, পুরু গোঁফের আড়ালে কৌতুকের হাসি। যৌবন-অতিক্রান্ত সুতপাকে তরুণ রাজর্ষি যেন ক্ষুরধার দৃষ্টি দিয়ে বিদ্ধ করছেন। সুতপা তাঁর চোখের ভাষা স্পষ্ট পড়তে পারছে। তিনি যেন বলছেন, ‘কী বলেছিলাম না, যোদ্ধার সন্তানের ধমনিতে যোদ্ধার রক্তই প্রবাহিত হয়, যতই চেষ্টা করো না কেন, যা অনিবার্য তাকে কেউ ঠেকাতে পারে না।’

সুতপা রাজর্ষির চোখের দিকে বেশিক্ষণ তাকাতে পারল না। বরাবরের মতো তাঁর চোখে বিজয়ীর দৃষ্টি, যেন তিনি হারার জন্য জন্মাননি। ওই দু-চোখের দিকে তাকিয়ে সুতপার মনে হলো, সে সম্পূর্ণ পরাজিত। তার সারাজীবনের তপস্যা আজ হার মেনেছে নিয়তির কাছে। 

রাজর্ষির সঙ্গে সুতপার আলাপ কলেজে পড়ার সময়। বান্ধবী আল্পনার বাড়িতে তার মাসতুতো দাদা রাজর্ষি সিংহরায়ের সঙ্গে হঠাৎ দেখা, পরিচয় ও অবশেষে প্রেম – সবই খুব অল্প দিনের মধ্যে। তার আগে সেনাবাহিনীতে কাজ করা বাঙালি ছেলে সুতপা দেখেনি কোনোদিন। দীর্ঘাকৃতি সুঠাম চেহারা, স্মার্ট অথচ ভদ্র আর বিনয়ী রাজর্ষি সহজেই সুতপার মন জয় করে নিয়েছিলেন। দুই পরিবারে কারো আপত্তি না থাকায় প্রেম বিবাহে পরিণতি পেতে দেরি হয়নি। প্রথম কিছুদিন বেশ ভালোই কাটল, রাজর্ষির সঙ্গ সবসময় না পেলেও স্বামীগর্বে গরবিনী ছিল সুতপা। সে জানত, রাজর্ষি আর পাঁচজনের মতো নয় যে, তাঁর সঙ্গে রোজ সংসারের সাতকাহন আলোচনা করবে বা তাঁকে রোজ সিনেমা, থিয়েটার, শপিংমলে নিয়ে যাবে। দেশরক্ষার জন্য যে কঠিন সংকল্প তিনি নিয়েছেন তাতে সংসারের ক্ষুদ্রস্বার্থকে যে বলিদান করতে হবে তা বুঝত সুতপা; কিন্তু ক্রমে যেন সেই সুখমিশ্রিত অহমিকাকে অপসারণ করে স্থান নিল এক অদ্ভুত ভয়, সংশয়, বিশেষত যখন তাদের দুজনের মাঝে কুনাল এলো।

কুনালের জন্মের মুহূর্তটা এখনো ছবির মতো মনে পড়ে সুতপার। রাজর্ষির তখন পাঞ্জাবে পোস্টিং। কলকাতার বাড়িতে ছুটি কাটিয়ে ফিরে যাওয়ার কিছুদিন পর সুতপা সুখবরটা চিঠিতে জানায়। রাজর্ষি খুব খুশি হয়েছিলেন; কিন্তু গর্ভাবস্থা থেকে প্রসব বেদনা – কোনো সময়েই রাজর্ষিকে সে কাছে পায়নি। সুতপার তাতে দুঃখ বা অভিযোগ ছিল না কোনোদিন। বরং সদ্যজাত দেবশিশুর দিকে চেয়ে সে সব দুঃখ ভুলে গিয়েছিল, পেয়েছিল বাঁচার এক নতুন অবলম্বন। কুনাল মায়ের আদরে বড় হতে লাগল; কিন্তু বাবার প্রতি ছিল তার অদ্ভুত আকর্ষণ। কতদিন বাদে বাদে রাজর্ষি আসতেন; কিন্তু কুনালকে কোলে তুলে তিনি যখন আদর করতেন, কুনাল এতো খুশি হতো! একেই বোধহয় বলে রক্তের টান। অন্য কোনো অচেনা লোকের কোলে কুনাল কোনোদিন যেতেই চাইত না, অথচ বাবা বহুদিন বাদে এলেও যেন সে কুনালের কতদিনের চেনা! রাজর্ষি তাকে কী মন্ত্র পড়িয়েছিল কে জানে? কুনাল সবসময় পিস্তল নিয়ে খেলা করতে ভালোবাসত। রাজর্ষি প্রতিবার বাড়ি আসার সময় কুনালের জন্য খেলনার বন্দুক-পিস্তল নিয়ে আসতেন, তারপর শুরু হতো যুদ্ধ-যুদ্ধ খেলা। কুনালের এই খেলাটার প্রতি আকর্ষণ দেখে সুতপার কেমন যেন অস্বস্তি হতো – একরত্তি শিশুকে মারণক্রীড়ায় না মাতালেই কি নয়? তার ছেলের শৈশব ভরে উঠুক না হাসি-গানে, কোমল প্রাণে না-ই বা লাগল রক্তাক্ত আঁচড়! দু-একবার রাজর্ষিকে কথাটা বলেওছে সুতপা। প্রত্যুত্তরে রাজর্ষি অট্টহাসি দিয়ে বলেছেন, ‘আরে যোদ্ধার ছেলে কি শেষ অবধি পুতুল নিয়ে খেলবে? তুমি হলে চিরকালীন বঙ্গজননী, সুতপা, ছেলেকে আঁচলের নিচে লুকিয়ে রাখতে চাও, যাতে সে কোনোদিন সৈনিক হওয়ার ঝুঁকি না নেয়।’ সুতপা রেগে ঠোঁট ফুলিয়ে বলতো, ‘তোমার সবেতে মশকরা! বাবা তো যুদ্ধে মেতে আছেন, মায়ের আঁচল ছাড়া ওইটুকু ছেলে কোথায় আশ্রয় নেবে শুনি?’ সৈনিকের চোখের পাতা একটু যেন ভিজে উঠত, গলার স্বরে ফুটে উঠত আবছা আবেগ, ‘সুতপা, তোমাকে একা একা অনেক দায়িত্ব সামলাতে হয়, না? আমি কোনোদিন কোনো প্রয়োজনে তোমার পাশে দাঁড়াতে পারি না, তোমার দুঃখ হয় না?’ সুতপা হাসত, ‘আমাকে বুঝি তোমার খুব দুঃখী মনে হয়? তবে জানো আমি ছোটবেলায় স্বপ্ন দেখতাম সারাদেশ ঘুরব। দেশপ্রেমিকের ঘরণী হয়ে দেশভ্রমণের স্বপ্নটা আপাতত শিকেয় তুলে রাখতে হয়েছে, এই যা দুঃখ।’ রাজর্ষি উৎসাহ নিয়ে জিজ্ঞাসা করেছিলেন, ‘কোথায় বেড়াতে যেতে ইচ্ছে হয় শুনি?’ সুতপা সঙ্গে সঙ্গে বলে উঠেছে, ‘ভূস্বর্গ কাশ্মির!’ রাজর্ষি উচ্ছ্বসিত হয়ে বলেছিলেন, ‘যাবই যাব পরেরবার, তোমার স্বপ্ন সত্যি হবে।’

রাজর্ষির ছবির দিকে তাকিয়ে সুতপা নিজের অজান্তেই চলে গিয়েছিল কোন অতীতে। প্রেসার কুকারের সিটি শুনে সম্বিৎ ফিরে এলো। না, রাজর্ষি কথা রাখেননি। সুতপার আর দেখা হয়নি ভূস্বর্গ কাশ্মির। রাজর্ষিকে একাই যেতে হলো কাশ্মির। সেবার রাজর্ষি সেনাবাহিনীতে ফিরে যাওয়ার পরই দ্রুত দেশের পরিস্থিতি বদলে গেল। সালটা ১৯৯৯। অপ্রত্যাশিতভাবে পাকিস্তানি ফৌজ আর কাশ্মিরি বিচ্ছিন্নতাবাদীরা ভারত-পাকিস্তান সীমারেখা পার হয়ে ঢুকে পড়ল ভারতে। কাশ্মিরের কারগিল জেলায় শুরু হলো দুদিকের সশস্ত্র সেনাবাহিনীর প্রবল সংঘর্ষ। সব সংবাদমাধ্যমে একই খবর  – কারগিল আর কারগিল। সবার কাছে যা শুধুই খবর, সুতপার কাছে তা ছিল জীবন-মরণ সমস্যা। একরত্তি ছেলেটার মুখের দিকে তাকিয়ে সে শুধু একটাই প্রার্থনা করেছে – সমস্ত উত্তেজনা প্রশমিত হোক, শান্তি নেমে আসুক পৃথিবীর বুকে, রাজর্ষি যেন বিজয়ীর হাসি নিয়ে ফিরে এসে দাঁড়ান তার সামনে। রাজর্ষি ফিরে এসেছিলেন ঠিকই, কিন্তু কফিনবন্দি হয়ে ত্রিরঙ্গা পতাকায় মুড়ে। সবচেয়ে প্রিয় মানুষটাকে নিয়ে যত উদ্বেগ, যত সংশয় এক নিমেষে শেষ হয়ে গেল। জীবনের অর্থটাই বদলে গেল মুহূর্তে।

উত্তর কলকাতার পুরনো পাড়া – রাজর্ষির শৈশব, কৈশোর, যৌবন কেটেছে এখানে। হাসিখুশি প্রাণবন্ত মুখটা আজ  বিকৃত, চওড়া কাঁধ আর বলিষ্ঠ বাহু একতাল রক্তাক্ত মাংসপিণ্ডে পরিণত, কিছু সময়ের মধ্যে যা ভস্মীভূত হতে চলেছে। প্রতিটি বারান্দা আর উঠান ছাপিয়ে লোকের ভিড়, চোখের জল বাঁধ মানে না কারো। জল ছিল না শুধু সুতপার চোখে। পাথরপ্রতিমার  মতো নিষ্পলক ভাবলেশহীন দৃষ্টিতে সে তাকিয়ে ছিল রক্তরঞ্জিত ত্রিবর্ণ পতাকায় মোড়া বীর সৈনিকের দেহাবশেষের দিকে। এর মধ্যে কোথাও সে রাজর্ষিকে খুঁজে পায়নি, আর পেতেও চায়নি। রাজর্ষি বেঁচে থাক তার অন্তরে অমøান হয়ে, যেমনটি সে তাঁকে দেখেছে চিরকাল। রাজর্ষির বাবা-মা জীবিত ছিলেন না, ভাই-বোন ছিল না তাঁর। কিন্তু পাড়ার মাসি-কাকিরাই আগলে রেখেছিল সুতপাকে। রাজর্ষির ছেলেবেলার খেলার সাথিরা মৃত বন্ধুর সম্মানে সব বিপদ-আপদে সুতপার পাশে এসে দাঁড়িয়েছেন। রাজর্ষির স্মৃতিবিজড়িত বাড়িটা ছেড়ে সুতপা কোথাও যায়নি। স্কুলের চাকরিটা বজায় রেখে যথাসম্ভব নিরাম্বড়ভাবে কুনালকে মানুষ করার চেষ্টা করেছে। বহুদিনের পুরনো কাজের লোক মানদামাসি কবে অজান্তে সুতপা আর কুনালের অভিভাবিকা হয়ে উঠেছে। আর পাশে ছিল আল্পনা। রাজর্ষির মাসতুতো বোন আর সুতপার প্রাণের বন্ধু। আল্পনার সূত্রেই রাজর্ষির সঙ্গে আলাপ হয়েছিল, রাজর্ষির অবর্তমানে সে ছায়ার মতো সুতপার সঙ্গে থেকেছে, রাজর্ষির অভাব বুঝতে দেয়নি তাকে।

সকাল গড়িয়ে দুপুর হয়েছে, সুতপা অবসন্ন শরীর নিয়ে এসে বিছানায় বসলো। আজ কদিন হলো দিনগুলো বড্ড লম্বা লাগছে। এই দীর্ঘ দিনগুলো কবে শেষ হবে কে জানে? সব ব্যস্ততা, হইচই, দৌড়ঝাঁপ কেমন যেন থিতিয়ে পড়েছে। পৃথিবীটা ঘুরছে তো তার অক্ষপথে? না কি সেও থেমে গেছে? সুতপার সামনে এখন একটা বিশাল কালো দেয়াল। দেয়ালের ওপারে কী আছে সে জানে না। পেছন ফিরলে অনেক রঙিন স্মৃতি। ঠিক যেমন সিনেমাতে ফ্ল্যাশব্যাক হয়। চোখ বন্ধ করে সুতপা অতীতে ডুব দিলো।

এখনো চোখ বুজলে সুতপা স্পষ্ট দেখতে পায় ছোট্ট কুনাল বাড়ির এই প্রান্ত থেকে ওই প্রান্ত ছুটে বেড়াচ্ছে। মানদামাসি রাম-রাবণের যুদ্ধ, কুরুক্ষেত্র যুদ্ধের গল্প বলত, এক লাফে উঠে  কুনাল ধাঁই ধাঁই করে নকল বন্দুকের গুলি ছোটাত আর বলত – কুরুক্ষেত্র নয়, আমি ভারতের হয়ে যুদ্ধ করছি পাকিস্তানের সঙ্গে। সুতপার এই যুদ্ধ-যুদ্ধ খেলা সব থেকে অপছন্দ ছিল। মানদামাসি বকুনি খেত, ‘মাসি, যুদ্ধ ছাড়া কি আর কোনো গল্প হয় না?’ আল্পনা বলত, ‘সুতপা, তোর সবেতে বাড়াবাড়ি, বাচ্চারা বীরত্বের কাহিনি শুনতে ভালোবাসে। এটাই স্বাভাবিক।’

শৈশব থেকে কৈশোরে পা রাখল কুনাল। ইতিহাসের পাতায় স্বাধীনতা সংগ্রামের কাহিনি পড়তে পড়তে ওর চোখদুটো কেমন উজ্জ্বল হয়ে উঠত। ‘মা, আমি দেশের জন্য লড়াই করব। বড় হয়ে আমি সৈনিক হবো। বাবার মতো।’ সুতপার বুকের ভেতরটা মোচড় দিয়ে উঠত, কোনোরকমে বলত, ‘দেশের কাজ করতে গেলে যুদ্ধক্ষেত্রে যাওয়ার প্রয়োজন হয় না রে, রক্ত ঝরানোরও দরকার হয় না। দেশের মানুষের সেবা করলেই দেশের জন্য লড়াই করা হয়। যুদ্ধ মানে তো কেবল ধ্বংস। যুদ্ধ কোনোদিন মানুষের মঙ্গল করে না।’ সাদামাটা আদর্শের বুলি কিশোরমনে আঁচড় কাটত না। তরুণ রক্ত উদ্বেল হয়ে উঠত, অভিমানী সুরে বলত কুনাল, ‘বাবা যে দেশের জন্য প্রাণ দিলো সেটা মহৎ কাজ নয়? বাবার প্রতি তোমার শ্রদ্ধা নেই?’ সুতপা বুঝত কুনালের আবেগটা। তাই সরাসরি তর্কে যেত না। তার মাথায় হাত বুলিয়ে কপালে চুমো খেয়ে বলত, ‘তোর বাবার প্রতি শ্রদ্ধা রেখেই বলছি সোনা, বাবা দেশের জন্য জীবন দান করেছেন, তুই দেশের মানুষকে জীবন দান করবি। অসুস্থ দুস্থ মানুষের সেবা করবি, সেটাই তো আসল দেশপ্রেম।’ পেরেছিল সুতপা। ছেলেমানুষ কুনাল ছিল একতাল মাটির মতো। ধীরে ধীরে তার মনে ‘যুদ্ধ নয় শান্তি’র মন্ত্র আরোপ করতে পেরেছিল সুতপা। কুনাল বরাবরই পড়াশোনায় ভালো ছিল। ক্রমশ বন্দুক ছেড়ে স্টেথোস্কোপের দিকে ঝুঁকল সে। যেদিন কুনালের জয়েন্ট এন্ট্রান্স পরীক্ষার রেজাল্ট বেরোল সেদিনটা এখনো মনে পড়ে সুতপার। মা-ছেলে দুজনে একসঙ্গে আশা-নিরাশার ছন্দে দুলছে। তারপর একসঙ্গে খুশিতে ভাসা। আর যেদিন  কুনাল ডাক্তার হয়ে এসে সুতপাকে প্রণাম করল সেদিন সুতপা চোখের জলে ভেসেছিল। আল্পনা এসেছিল ছুটতে ছুটতে, সুতপাকে জড়িয়ে ধরে বলেছিল, ‘তোর স্বপ্ন সফল হলো রে!’ আত্মীয়স্বজন, পাড়া-পড়শি সবাই খুশি, সবার মুখে এক কথা, ‘সুতপা ছেলেকে মানুষের মতো মানুষ করেছ, ওর বাবার অভাব বুঝতে দাওনি ওকে।’ কেউবা  কুনালকে বলেছিল, ‘আমাদের বুড়ো বয়সে তো তুমিই দেখবে, তুমিই আমাদের ভরসা বাবা!’ সুতপা বলেছে, ‘নিশ্চয়ই দেখবে, আপনারা ওকে আশীর্বাদ করুন।’

স্মৃতির সফরে বাধা পড়ল মোবাইলের ক্রিং ক্রিং শব্দে। আল্পনার ফোন। সুতপা কি ফোনটা ধরবে? সে তো জানে আল্পনা কী বলবে। তাকে শরীরের যত্ন নিতে বলবে, সময়মতো খাওয়া-দাওয়া করতে বলবে, মন শক্ত রাখতে বলবে। এই কদিনে যে-কটা ফোন এসেছে, তাতে সকলের বক্তব্য মোটামুটি একই। সুতপা ফোনটা কেটে দিলো। বিগত কয়েকদিনে ফোন বেজেছে মাঝেমধ্যে, কিন্তু কলিংবেল বাজেনি একবারও। এখন কারো বাড়িতে কলিংবেল বাজে না। সবাই নিজের চারদিকে এক অদৃশ্য প্রাচীর তৈরি করে নিজ ঘরে বন্দি, ঠিক যেমন মুককীট নিজেকে বদ্ধ রাখে কোকুনের ভেতর। শুধু সে সব দেয়াল ভেঙে বেরিয়ে গিয়েছিল, দিন-রাত এক করে রোগীদের সেবায় নিজেকে সমর্পণ করেছিল, সে এবং তার মতো আরো অনেকে, যাদের শুধু কর্ম নয়, ধর্ম ছিল চিকিৎসা। মারণ-অসুখকে পৃথিবী থেকে বিতাড়িত করার ব্রত নিয়ে একদল তরুণ-তাজা প্রাণ ঝাঁপিয়ে পড়েছিল। মেডিসিনের পিজিটি কুনাল বাড়ি আসার সময় পেত না, সারাসপ্তাহ কোভিড সিসিইউতে ডিউটি দিয়ে সপ্তাহান্তে কখনো বা বাড়ি ফিরত। সেবার বাড়ি ফিরল কাশি নিয়ে, পরের দিনই আবার হাসপাতাল। মায়ের মনে কেমন যেন কুচিন্তা এলো। ছেলে হেসে বললো, ‘মিথ্যে চিন্তা করছ মা! আমি তো সবরকম সাবধানতা অবলম্বন করি। বরং তুমি আমার থেকে দূরে থাকো।’

দুদিন বাদে কুনাল হাসপাতাল থেকে ফোন করল, ‘মা, আমার কোভিড পজিটিভ এসেছে। অক্সিজেন স্যাচুরেশন কমে যাচ্ছে বলে ভর্তি রেখেছে। তুমি চিন্তা করো না, আমি ঠিক হয়ে যাব। পারলে তোমার টেস্টটা করে নিও, তুমি আমার কন্ট্যাক্টে এসেছিলে।’ সুতপার শরীরে কোভিডের কোনো লক্ষণ ছিল না, তাও ছেলের কথামতো টেস্ট করাল, পজিটিভ বেরোলো। কুনাল অবশ্য এ-খবরটা পায়নি। কয়েকদিন বাদে হাসপাতাল থেকে কেউ ফোন করে জানাল, কুনালকে ভেন্টিলেটরে দিতে হবে, কনসেন্ট লাগবে। পৃথিবী ছেড়ে চলে যাওয়ার আগে কুনাল অবশ্য সুতপার কনসেন্ট নেয়নি।

কুনালের দেহ ত্রিরঙ্গায় মোড়া হয়নি। কালো প্লাস্টিক জড়িয়ে করপোরেশনের লোক শেষকৃত্য করেছে। স্বজন-বন্ধুরা কেউ তাকে বীরের সম্মান দিতে আসেনি, সুতপাকে প্রবোধবাক্য দিতেও কেউ আসেনি ত্রিসীমানায়। টেলিফোনও করেছে লোকে সন্তর্পণে, যদি এসে দেখা করতে হয়! রক্ত ঝরিয়ে জীবন কেড়ে নিয়ে দেশসেবা নয়, রক্ত মুছিয়ে জীবনদান করে দেশের মানুষকে বাঁচানোর ব্রত নিয়েছিল যে-যোদ্ধা সে কোনো মরণোত্তর পুরস্কারও পায়নি, সে শুধু একজন অভাগিনী মায়ের চোখের জলের মধ্যে বেঁচে থেকেছে।

এরপর মাস দেড়েক কেটে গেছে। শরতের সোনালি রোদ্দুরে আকাশ ভরেছে। এবার নাকি পুজোয় কোনো হইচই হবে না। প্যান্ডেলে প্যান্ডেলে লোকজনের ভিড় হবে না। কিন্তু প্রকৃতি তো নিজের খেয়ালে চলে। সব পাট বন্ধ হলেও তার দেওয়া সোনা রোদ, তুলো মেঘ, কাশফুলের বাহার বন্ধ হয় না। এমনি এক শরতের সকালে সুতপার বাড়ির কলিংবেলটা বেজে উঠল। কে এলো তার বাড়িতে? আত্মীয়দের মনে পড়েছে হয়তো তাকে, এতোদিনে ভয় কাটিয়ে উঠেছে হয়তো। কিছুটা বিস্ময়, কিছুটা বিরক্তি নিয়ে সুতপা দরজা খুলল। দরজার বাইরে যারা দাঁড়িয়ে আছে, সুতপা তাদের কখনো দেখেনি। বছর পঁয়ত্রিশের একজন মহিলা, তার সঙ্গে বছর দশেকের একটি মেয়ে। সুতপার জিজ্ঞাসু দৃষ্টি দেখে মহিলা বলল, ‘আপনি কি ডা. কুনাল সিংহরায়ের মা?’

‘হ্যাঁ! কিন্তু … আপনারা কারা? কী চান?’ সুতপা কী বলবে ভেবে পায় না।

ইতস্তত করে মহিলাটি বলল, ‘আমি  মেডিক্যাল কলেজে কোভিড সিসিইউতে ভর্তি ছিলাম। বেঁচে ফিরব কেউ ভাবেনি। ডাক্তারবাবু অনেক করেছেন আমার জন্য। তাই যখন শুনলাম উনি আর নেই, আমি স্থির থাকতে পারলাম না। আমার মেয়ে আপনার ছেলের ছবিতে ফুল দিয়ে একবার প্রণাম করবে শুধু।’

মেয়েটির দিকে সুতপার নজর পড়ল। কৃতজ্ঞতা ভরা সরল শিশুর মুখ, হাতে একগুচ্ছ শিউলি ফুল। ইশারায় ওদের ডেকে ভেতরে নিয়ে এলো সুতপা। রাজর্ষির ছবির পাশে কুনালের স্থান হয়েছে। ছোট্ট মেয়েটা একরাশ শিউলি ফুল-পাতা ছড়িয়ে দিলো ছবির সামনে। তারপর হাত জোড় করে প্রণাম করল। ঈশ্বর কাউকে জীবন দেন, কারো নেন। কিন্তু শিশুমন কুনালকে তার মায়ের জীবনদাতা বলে গ্রহণ করেছে। সুতপার দৃষ্টি হঠাৎ শ্বেতপাথরের টেবিলে পড়ে থাকা ফুলগুলোর দিকে পড়ল। গৈরিক বৃন্ত, শ্বেত পুষ্প, সবুজ পাতা – ঠিক যেন ত্রিরঙা পতাকা। সুতপা মেয়েটির মাথায় হাত রেখে আশীর্বাদ করল।

মেয়েটির মা বলে উঠল, ‘আশীর্বাদ করুন যেন ডাক্তার হয়, সবার প্রাণ বাঁচায়। আমার মতো কত রোগী আপনার ছেলের কাছে ঋণী।’  সুতপার চোখে এই প্রথম জল এলো। কুনাল বেঁচে থাকবে এই সব মৃত্যুমুখ থেকে ফিরে আসা মানুষগুলোর হাসি-কান্না, সুখ-দুঃখের মধ্যে। আজ তার আর রাজর্ষির স্বপ্ন একসঙ্গে সাকার হলো। বীর সৈনিকের ছেলে দেশের মানুষের সেবায় জীবন আহুতি দিয়েছে, কিন্তু বাঁচিয়ে রেখে গেছে কয়েকটি অমূল্য প্রাণ। সে পায়নি পরমবীর বা মহাবীর চক্র ঠিকই, কিন্তু তার জীবন-পারাবার পার হওয়ার খেয়া ভরেছে মানুষের অকুণ্ঠ ভালোবাসায়!