সংবাদ-সাময়িকপত্রে উনিশ শতকের বাঙালি মুসলমান সমাজ
স্বপন বসু সংকলিত ও সম্পাদিত – বুকস স্পেস – কলকাতা, ২০১৯ – ১০০০ টাকা
উনিশ শতক বিশেষজ্ঞ হিসেবে কীর্তিমান গবেষক স্বপন বসু মৌলিক গ্রন্থ রচনা ছাড়াও সম্পাদনা করেছেন একাধিক গুরুত্বপূর্ণ বই। সেগুলোর মধ্যে উনিশ শতকের কেবল সংবাদ-সাময়িকপত্রভিত্তিক চারটি গ্রন্থ বাংলার সমাজেতিহাস বিষয়ে আগ্রহী পাঠক ও গবেষকের কাছে আকরগ্রন্থ হিসেবে বিবেচিত। কেননা যথার্থ জাতীয় ইতিহাস নির্মাণ ও পুনর্নির্মাণের ক্ষেত্রে সংবাদ-সাময়িকপত্র গুরুত্বপূর্ণ অন্যতম প্রাথমিক উৎস হিসেবে স্বীকৃত।
বাংলা সংবাদ-সাময়িকপত্রের ইতিহাস রচনার ক্ষেত্রে পশ্চিমবঙ্গের কেদারনাথ মজুমদার, ব্রজেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়, গীতা চট্টোপাধ্যায় এবং বাংলাদেশের আনিসুজ্জামান ও মুনতাসীর মামুন স্মরণীয় নাম। পরিকল্পনাগত দিক থেকে ও অনুসন্ধানের সীমাবদ্ধতার কারণে এঁদের কাজ ভিন্নধর্মী ও কোনো কোনো দিক থেকে অপূর্ণ। এই অপূর্ণতাকে যথাসম্ভব পূর্ণতা দেওয়ার প্রয়াস পেয়েছেন স্বপন বসু তাঁর উনিশ শতকের বাংলা সংবাদ-সাময়িকপত্র গ্রন্থে (পুস্তক বিপণি, কলকাতা ২০১৮)। অবশ্য সময়-পরিসরের দিক থেকে এটিরও সীমাবদ্ধতা আছে।
একাধিক খণ্ডে কৃত বিনয় ঘোষের সাময়িকপত্রে বাংলার সমাজচিত্র গ্রন্থের প্রায়-অনুরূপ কাজের পরিকল্পনা করেছিলেন স্বপন বসু সংবাদ-সাময়িকপত্রে উনিশ শতকের বাঙালি সমাজ নামে। জানামতে, বিষয়ভিত্তিকভাবে পাঁচ খণ্ডে পরিকল্পিত কাজটি ছিল পশ্চিমবঙ্গ বাংলা আকাদেমির একটি প্রকল্প। প্রকল্পের প্রথম দুটি খণ্ড প্রকাশিত হয়েছিল ২০০০ ও ২০০৩ সালে। তৃতীয় খণ্ডের পাণ্ডুলিপি প্রস্তুত হয়ে যাওয়ার পর যদ্দুর জানি, পশ্চিমবঙ্গে সরকার পরিবর্তন হওয়ায় প্রকল্পটি বাতিল হয়। ফলে আকাদেমি তৃতীয় খণ্ড আর প্রকাশ করেনি। নানা কারণে বহু বিলম্বে ২০১৯ সালে বুকস স্পেস পাণ্ডুলিপিটি প্রকাশ করে। সেটিই আমাদের আলোচ্য।
ক্রাউন সাইজের ৬৮৮ পৃষ্ঠার সংবাদ-সাময়িকপত্রে উনিশ শতকের বাঙালি মুসলমান সমাজ এক বিশাল কাজ। সম্পাদকের কথায় স্বপন বসু জানিয়েছেন, ‘সংবাদ-সাময়িকপত্র অবলম্বনে উনিশ শতকের বাঙালি মুসলমান সমাজের সামগ্রিক পরিচয় ফুটিয়ে তোলার চেষ্টা এর আগে কেউ করেছেন বলে আমাদের জানা নেই। এইকালে বাঙালি হিন্দু-ব্রাহ্মণরা মুসলমান সমাজকে কি দৃষ্টিতে দেখতেন, তারও আভাস এখানে মিলবে।’ এই দাবি কেবল যথার্থ নয়, আরো বলার কথা এই যে, স্বপন বসু তাঁর উদ্দিষ্ট সাধনে কেবল মুসলমান-সম্পাদিত পত্রিকার আশ্রয় করেননি, হিন্দু-ব্রাহ্মণ-ব্রিটিশ সম্পাদিত বাংলা-ইংরেজি উভয় ভাষার শতাধিক পত্রিকাকে অবলম্বন করেছেন। এখানে একটি কথা বলে রাখা দরকার। উনিশ শতকের বহু পত্রিকা কালের গর্ভে হারিয়ে গেছে। সে-কারণে সংকলিত সকল লেখা সম্পাদকের পক্ষে চাক্ষুষ করা করা সম্ভব হয়নি, সাহায্য নিতে হয়েছে রিপোর্ট অন নেটিভ পেপারস-এর। ১৮৬৩ সাল থেকে সরকারি উদ্যোগে বিভিন্ন বাংলা পত্রিকার গুরুত্বপূর্ণ অংশের অনুবাদ রিপোর্ট অন নেটিভ পেপারস নামে প্রতি সপ্তাহে ছাপা হতে শুরু করে। এর সাহায্য না নিলে উনিশ শতকের বাঙালি মুসলমান সমাজের সামগ্রিক পরিচয় প্রদানে বহুলাংশে ঘাটতি থেকে যেত।
গ্রন্থের প্রথমে আছে পৃষ্ঠাঙ্কসহ সূচি, তারপর বিষয়সূচি। সূচিতে মুসলমানের সমাজ-জীবনের বিভিন্ন দিকের শ্রেণিকরণ করা হয়েছে; যেমন সমাজের অবস্থা-রীতিনীতি, শিক্ষা, সমাজসচেতনতা – সংস্কারপ্রয়াস, শাসক সম্প্রদায় ও মুসলমান সমাজ, হিন্দু-মুসলমান সম্পর্ক, প্রসঙ্গ গোহত্যা ইত্যাদি। বিষয়সূচিতে ওই শ্রেণি বা বিভাগে যে-সকল পত্রিকার প্রয়োজনানুগ যে-যে অংশ এই গ্রন্থে সংকলিত হয়েছে, প্রথমে সে-সকল পত্রিকার প্রকাশকাল, তারপর পত্রিকার নাম, রচনার শিরোনাম ও বিষয়বস্তু উল্লেখ করা হয়েছে। শিরোনামহীন রচনার ক্ষেত্রে ‘-’ চিহ্ন ব্যবহার করা হয়েছে। কিন্তু তারও বিষয়বস্তু সম্পাদক বলে দিয়েছেন। বলা হয়েছে যে, নেটিভ পেপারস থেকে গৃহীত বিষয়গুলো তারকাচিহ্নিত করা হয়েছে। কিন্তু কার্যত তা করা হয়নি। কম্পোজিটর ও প্রুফ-রিডারের অনবধানের কারণে এটা ঘটেছে বলে ধারণা হয়। এর ফলে ইংরেজি ভাষার শিরোনামগুলোর কোনটি নেটিভ পেপারস, আর কোনটি মূল ইংরেজি পত্রিকা থেকে চয়ন করা হয়েছে, তা চট করে অনুধাবন করা মুশকিল হয়ে দাঁড়ায়।
একটা বহুল প্রচলিত ধারণা এই যে, ব্রিটিশ কর্তৃক বাংলার শাসনক্ষমতা হারানোর ফলে নানা কারণে, বিশেষত প্রতিবেশী হিন্দু সমাজের অনেকের মতো ইংরেজি শিক্ষা গ্রহণ না করায় মুসলমান সমাজে সর্বব্যাপী দুর্দশা নেমে আসে। প্রশ্ন না উঠে পারে না যে, কারা এই মুসলমান সমাজ? কী তাদের জাতি ও শ্রেণিগত পরিচয়? এই প্রশ্নের সুলুক সন্ধান স্বপন বসুর উদ্দেশ্য নয়। বাঙালি মুসলমান সমাজবর্গটিকে তিনি সাধারণভাবে গ্রহণ করে উনিশ শতকে সংবাদ-সাময়িকপত্রের সাক্ষ্যে তাঁদের জীবনচিত্র তুলে ধরার শ্রমসাধ্য প্রয়াস পেয়েছেন। এই কাজটি করতে গিয়ে আবশ্যকীয়ভাবে সংকলক-সম্পাদককে দীর্ঘ একটি ভূমিকা রচনা করতে হয়েছে। ৭২ পৃষ্ঠাব্যাপী ভূমিকাটির প্রথমাংশ (পৃষ্ঠা সংখ্যা ৩২) আমাদের বিবেচনায় অনাবশ্যক। এই অংশে বেশ কিছু পত্রিকার পরিচয় প্রদানপূর্বক বলা হয়েছে, পত্রিকাটি থেকে অমুক বিষয় বা বিষয়াবলি গ্রন্থটিতে গ্রহণ করা হয়েছে। কোন পত্রিকা থেকে কোন লেখা সংকলিত হয়েছে সে তো বিষয়সূচিতেই আছে। তাছাড়া বাংলা পত্রিকার পরিচিতি তাঁর উনিশ শতকের বাংলা সংবাদ-সাময়িকপত্র গ্রন্থে রয়েছে। তবে ব্যবহৃত ইংরেজি পত্রিকাগুলোর পরিচিতি দেওয়া নিয়ে আপত্তি নেই। কেননা, এগুলোর পরিচিতি পাঠকের কাছে সহজলভ্য নয়।
ভূমিকার পরবর্তী অংশটি গুরুত্বপূর্ণ। গ্রন্থের লক্ষ্যের দিক থেকে অংশটি কেবল সংগতিপূর্ণ নয়, আবশ্যকীয়ও বটে। সরকারি পৃষ্ঠপোষকতায় প্রকাশিত কিন্তু পরে ভূদেব মুখোপাধ্যায়ের মালিকানাধীন ও তাঁরই সম্পাদিত সাপ্তাহিক এডুকেশন গেজেট সম্পর্কে স্বপন বসু লিখেছেন, এডুকেশন গেজেট-এর মতো আর কোনও হিন্দু সম্পাদিত পত্রিকা মুসলমানসমাজের বিভিন্ন দিক নিয়ে এত খবর প্রকাশ করেনি। মুসলমানদের শিক্ষা, বিবাহপদ্ধতি, সমাজ সংস্কারে অনাগ্রহ, স্ত্রীশিক্ষা প্রচলনের প্রয়াস, শাসক সম্প্রদায়ের সঙ্গে সম্পর্ক, হিন্দু-মুসলমান মিলনের প্রয়োজনীয়তা নিয়ে পত্রিকাটি বারবার কলম ধরে। মুসলমানদের সম্পর্কে হিন্দু লেখকের অনীহা, মুসলমানদের লেখা বই, পত্র-পত্রিকার আলোচনা ছাড়াও, তাঁরাও যে বাঙালি এবং বাংলা যে তাঁদের মাতৃভাষা এ-কথা উচ্চারণ করতেও পত্রিকাটি দ্বিধা করেনি।
একটা জনগোষ্ঠী বা ধর্মসম্প্রদায়ের জীবনে যে কত দিক ও সমস্যা থাকে তা বোঝানোর জন্য উদ্ধৃতিটি আমরা দিয়েছি। আবার একটা সমস্যার থাকে নানা প্রকৃতির বিচিত্র দিক। সবকিছু মিলিয়ে তার বিশালতা প্রায় মহাসমুদ্রের মতো। স্বপন বসু সংক্ষেপে মুসলমান সমাজজীবনের এই বিভিন্ন দিককে ধরতে চেয়েছেন ভূমিকায়। আর তার বিশালতা পাঠক পাবেন
সংবাদ-সাময়িকপত্র থেকে বিষয়ভিত্তিকভাবে চয়িত অংশগুলোর সমাহারে। কেউ ইচ্ছে করলে কেবল এই গ্রন্থটির ওপর নির্ভর করে উনিশ শতকের বাঙালি মুসলমানের একখানি সামাজিক ইতিহাস রচনা করতে পারেন। কিন্তু মাত্র একজন লেখকের কথা বলি কেন, ব্রিটিশ-বাংলার সামাজিক ইতিহাস নিয়ে যাঁরা গবেষণা করতে চান, তাঁদের সকলের কাছে এটি একটি আকর গ্রন্থ হিসেবে সহায়ক হবে।
Leave a Reply
You must be logged in to post a comment.