সুচিত্রা মিত্রের কণ্ঠে রবীন্দ্রনাথের ‘তবু মনে রেখো’ গানটি শুনলে মনে হয় এটি গাইবার অধিকার যেন কেবল তাঁরই আছে। কথাটি এভাবেও বলা যায়, কখনো একান্তে যদি এ-গান শোনার ইচ্ছা হয়, তাহলে আর-সব শিল্পীকে বাদ দিয়ে কেবল সুচিত্রা মিত্রকেই শুনতে ভালো লাগে। ‘তবু’ আর ‘মনে রেখো’র মধ্যবর্তী বিরতিতে নিজের সমস্তকিছুর অনুভবই যেন পুরে দেওয়া সম্ভব আর সম্পূর্ণ পদটিই যেন একই সঙ্গে হয়ে ওঠে নিবেদনশীল আকুলতারই অন্য নাম। এভাবেই এই সুরশিল্পী পুরো গানটার উপর ভর করে ব্যক্তি থেকে বৃহত্তর পর্যায়ের দিকে চলে যান এবং সেই যাওয়াটা অন্তরঙ্গ স্থিতিকে আরো নিবিড় করে তোলে। প্রতিক্রিয়ার ক্ষেত্রে ‘যাওয়া’র কথাটা মনে হচ্ছে বটে, কিন্তু মূল সুরের দিক থেকে কথা বললে উচ্চস্বর থেকে কোমল গান্ধারের দিকে নেমে পড়ার বা ‘ঢ’লে পড়া’র মাধ্যমে আকুল মিনতির ভাবটাই যেন এতে প্রকাশ পায়। ধারণা করি, মিনতির ভাবটুকু চারিয়ে দেওয়ার জন্যই তাঁর কণ্ঠে ‘মনে’র ‘ম’য়ের ওপর সবিশেষ দ্রুতি। কণিকা বন্দ্যোপাধ্যায়ের কণ্ঠে শুনলে কারো কারো কাছে এই গানটি আরো সুরেলা মনে হতে পারে; কিন্তু এই জায়গায় এসে দেখা যাবে সেই দ্রুতিটুকু নেই, মনে হতে পারে দীর্ঘ জীবন যাপনের পর কিছুটা ক্লান্তিও যেন এসে ভর করেছে শিল্পীর কণ্ঠে। গানটি সম্পর্কে সন্জীদা খাতুন বলেছিলেন : ‘রুচিবিলাসী মানুষ অপূর্ণ এবং অপূরণীয় সাধগুলোকে ঈশ্বরের পায়ে ডালি দিয়ে নিশ্চিন্ত হতে পারে না সবসময়। গানের সুরে আপন বেদনাকে খেলিয়ে নিয়ে নিরুদ্ধ বেদনাকে বাতাসে ভাসিয়ে দিতে চায়। সুরের বেদনা লীলায়িত শিল্পে বিকশিত হয়ে, প্রথাবিরোধী রুচির মানুষের জন্যে আশ্রয় হয়ে দাঁড়ায়।’ বোঝা যায়, গীতিকার হওয়ার কারণে এই গানের স্বত্ব শুধু রবীন্দ্রনাথের থাকে না, একটা সময়ের পরে যে-সংগ্রামী জীবন বেছে নিয়েছিলেন সুচিত্রা মিত্র, তাতে এই গানই যেন তাঁর সমস্ত চাওয়া-পাওয়ার বাহন হয়ে উঠল, আর আমরা শ্রোতারাও তাঁর আকাক্সক্ষা ও আকুলতার সঙ্গে একাত্ম হয়ে পড়ি।
এভাবে বুঝতে পারি, বিষ্ণু দে-র মতো কবিকে কেন সুচিত্রা মিত্রের গান শুনে তাড়িত হয়ে কবিতা লিখতে হয়। গত শতকের তিরিশের দশকের এই কবি ছিলেন প্রাচ্য-পাশ্চাত্য সংগীতের নিবিষ্ট শ্রোতা ও সংগীতবোদ্ধা; এবং শুধু বোদ্ধাই নন, সুরসিকও। সংগীত যখন সুরের ঢেউ তোলে তখন তার ভাঁজে ভাঁজে, তার বিমূর্ত রূপে বিহার করে তাকে মূর্ত করতে পারতেন বলেই তাঁর কবিতায় প্রাচ্য-প্রতীচ্যের নানারকম সংগীত-অনুষঙ্গের উপস্থিতি ও অনুরণন। তাঁর মতো এমন সমঝদারকে আলোড়িত করার জন্য সুচিত্রা মিত্রের মতো শিল্পীরই দরকার, যাঁরা সুরের মধ্য দিয়ে নানা আসন ও বাহন তৈরি করতে পারেন এবং শ্রোতাকে শাশ্বত অনুভবের মুখোমুখি করে কখনো সবাক কখনো-বা নির্বাকও করে দিতে পারেন। বিষ্ণু দে-র ‘সুচিত্রা মিত্রের গান শুনে’ শিরোনামক কবিতাটি শুরু হয়েছে এভাবে :
বাগান ভরেছে, ফুলে, আলোয় আলোয়,
শাদা, লাল, নীল, হলুদ, নানান রঙে ফুলে ফুলে ফুলময়।
আর পল্লবেও, হরেক সবুজে, আলোর সরস স্পষ্টতায়
রবীন্দ্রনাথের গানে তো ফুল আলো রং বাগানের অভাব নেই, যেকোনো একটি গান শুনেই হয়তো কবিতার শুরু, কিন্তু এরপরেই কবিতাটি পৌঁছে গেছে ঋতুবৈচিত্র্যে, রঙে-ঘ্রাণে এবং শাশ্বত অনুভবে :
এমন কি চোখ যেন গান করে
পাহাড়ের কষ্টিতে, লাল পথে,
আকাশের নীল স্রোতে, শরতের অশরীরী শুভ্র মেঘে,
যেদিকে তাকাই গান, রঙে গন্ধে গান আর গান,
না শুনে থাকাই ভার, থামিয়ে রাখাই ভার।
স্পষ্ট নয় যে-‘চোখ’ গান করে সে-চোখ কবির, না শিল্পীর; তবে বোঝা যায় পাহাড়-আকাশ-মেঘ সর্বত্রই গান এবং তা এমনই এক গান যা না শুনে থাকা যায় না। নানা বর্ণনার পরে বিষ্ণু দে-র দীর্ঘ কবিতাটি তাই শেষ হচ্ছে এভাবে :
আমরাও জানি তা, ভাবিও তাই যে,
তাই মনে রং ধরে সুগন্ধে ঘনায় রবীন্দ্রসঙ্গীতে
নন্দিত জীবনে নির্ভীক অজস্র রঙে ফুল ফোটে
সার্থক জন্মের মাগো শিকড় ছড়ায় বাহিরে ও ঘরে
সর্বত্র বাস্তব
অলৌকিক বাগানে অন্দরে অন্ধকারে পাথরে কাদায় ভিজে
অন্তরে অন্তরে গানে গানে মাটিতে কাঁকরে জীবনের ভিতে।
বোঝা যায়, এ-অনুভবে তিনি পৌঁছেছেন রবীন্দ্রনাথের গানের বাণী ও শিল্পী উভয়েরই মাধ্যমে। ‘কুসুমে ও বজ্রে তীব্র যার সদা ছন্দায়িত প্রাণ’ – রবীন্দ্রনাথ সম্পর্কে এমনটিই লিখেছিলেন বিষ্ণু দে, কথাগুলিকে সুচিত্রা মিত্র সম্পর্কে প্রযোজ্য মনে করেন একজন রবীন্দ্রসমালোচক। রবীন্দ্রসংগীতের বাণীসামর্থ্যরে কারণে এমন অনুভবে পৌঁছাটাই তো স্বাভাবিক, কিন্তু গায়কিটাও যেখানে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখে সেখানে গায়িকার বিশিষ্টতাও প্রাসঙ্গিক হয়ে ওঠে। রণজিৎ দাশেরও একটি কবিতা আছে যেটি পড়লে মনে হয় যেন সেটি সুচিত্রা মিত্রের মতো কোনো শিল্পীকে কেন্দ্র করেই লেখা :
গায়িকা সুন্দরী হলে গানের মগ্নতা ভেঙে যায়
সকল গানের মূলে অনায়ত্ত রূপের বেদনা
তাকেই মানায়, যার বেদনার প্রতিদ্বন্দ্বী রূপ
আর্তিময় সুরে জাগে – নিঃসঙ্গ চুম্বনহীন ঠোঁটে
কার গান শুনে তিনি এ-কবিতাটি লিখেছিলেন জানি না, তবে একথা তো ঠিক একসময় স্বামী-সংসার ছেড়ে, সন্তানের হাত ধরে এক কাপড়ে ঘর থেকে বের হয়ে এসেছিলেন সুচিত্রা, এরপর ‘নিঃসঙ্গ’ অবস্থায় রবীন্দ্রনাথ আর গীতবিতানকেই আশ্রয় করে নিয়েছিলেন। গুজরাট যখন বন্যায় প্লাবিত, তখন, তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী প্রিয়দর্শিনী ইন্দিরা গান্ধীকে নিয়ে লেখা কবিতায় সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় অনুমান করেছিলেন তাঁর ঠোঁটে কতদিন কারো চুম্বন পড়েনি, আর এখানে জানি না কাকে দেখে রণজিৎ দাশ তাঁর নিঃসঙ্গ চুম্বনহীন ঠোঁটে আর্তিময় সুরের বিচরণ দেখেছিলেন। কবিতার সেই নারী যে-ই হোন না কেন, বাস্তবে সুচিত্রা মিত্র যেন তার চেয়েও বেশি বাক্সময় : সৌন্দর্যে অনন্যা তো বটেই, ব্যক্তিত্বের দ্যুতিতেও স্বতঃপ্রভ – এভাবেই বাণী ও গায়কির সম্বন্ধে তাঁর গান অপূর্ব সংগীতে পরিণত হয়।
সুচিত্রা মিত্রের গায়কির এমন বিশিষ্টতা তৈরি হওয়ার পেছনে বিভিন্ন সময়ে নানা কথাপ্রধান গান গাওয়ার অভ্যাসটুকু কাজে লেগেছে। তুলনায় অধিক মূর্ত ও বাণীপ্রধান গান গাইবার বিষয়ে শুধু একথা বলছি না, বলছি গণসংগীত আর গণনাট্যের সঙ্গে সুচিত্রা মিত্রের সুনিবিড় যুক্ততার কথাও। গণনাট্যের সঙ্গে যুক্ত হওয়ার পর যে তিনি রবীন্দ্রসংগীত গাইতে এসেছেন তা নয়, আগে থেকেই রবীন্দ্রসংগীত গাইতেন এবং শান্তিনিকেতনে গান শেখার পরই গণনাট্যের সঙ্গে যুক্ত হয়েছিলেন। সে-সময় দৃষ্টিভঙ্গিগত কারণে যে-সকল গান নির্বাচন করে গাইতেন, তার জন্যই তাঁর গায়কিতে এসেছিল এই ধীরোদাত্ত পরিবর্তন।
কিন্তু এই কথাটিও লক্ষযোগ্য যে, একদম শুরু থেকেই তাঁর কণ্ঠ ততটা ‘পেলব’ ও ‘এলানো’ ছিল না, ‘মিনমিনে’ও ছিল না, যতটা তাঁর সমকালের কারো কারো ছিল। দেবব্রত বিশ্বাস লিখেছিলেন : ‘তখনকার দিনে সংগীতরসিকরা এবং সাধারণ শ্রোতারাও রবীন্দ্রনাথের প্রেমপর্যায়ের গান এবং ঋতু-সংগীতগুলিকেও যথেষ্ট মর্যাদা দিতেন না। এইসব গানগুলির প্রতি তাদের রীতিমতো অশ্রদ্ধাই ছিল।’ ‘এইসব গান’কেই পরবর্তী সময়ে সুচিত্রা তাঁর নিজস্ব গায়কিতে, সাদরে গেয়ে শ্রোতাদের মনে স্থায়ী আসন গড়ে নিয়েছিলেন। তাঁর মৃত্যুর পর শ্রদ্ধাঞ্জলি জানাতে গিয়ে এক সংগীতবোদ্ধা সুচিত্রার স্বদেশ ও কাব্যপর্যায়ের গানের ‘দীপ্ত ভঙ্গি’ আর ‘অসাধারণ গায়কি’র উল্লেখ করে বলেছিলেন, ‘সুচিত্রা মিত্র তাঁর দীপ্ত গায়কিতে, ভঙ্গিতে, জোরালো উচ্চারণে তৈরি করেছেন রবীন্দ্রসংগীতের একটা নিজস্ব বলয়’; অন্যরাও তাঁর ‘বলিষ্ঠ’ ভঙ্গির উল্লেখ করেন। সুচিত্রা মিত্রের সঙ্গে অন্যান্য শিল্পীর গায়কির স্বাতন্ত্র্যও সেখানে। একথার পরিচয় পাওয়া যাবে এইচএমভি থেকে বেরোনো সুচিত্রা মিত্র ও রাজেশ্বরী দত্তের যুগলকণ্ঠ রেকর্ডটি শুনে। শ্রোতাদের মধ্যে তখন যাঁরা ছিলেন অব্যক্তভাব তরুণ; কবিতাগ্রস্ত, সুধীন্দ্রবুঁদ, আর রাজেশ^রী দত্ত কি না তাঁরই স্ত্রী, যাঁর কণ্ঠ শুনে মনে হবে সুদূরাগত কোনো বিষণ্ন ঈশ্বরীর আততি, আর ঠিক এই কারণেই, বৈপরীত্যের সূত্রে, ওই রেকর্ডে সুচিত্রা মিত্রের কণ্ঠ যেন আরো দৃঢ় হয়ে বেজেছিল।
ধারণা করি, তাঁর কণ্ঠের এই দৃঢ়তা এমনি এমনি তৈরি হয়নি, এর নেপথ্যে দীর্ঘদিনের সাধনা তো ছিলই, এর সঙ্গে সাবধানতাও ছিল। কথাটা মনে হলো, শঙ্করলাল ভট্টাচার্যের নেওয়া সাক্ষাৎকারের স্মৃতিলেখা পড়ে। তিনি সুচিত্রা মিত্রকে প্রশ্ন করেছিলেন : ‘আপনি বলছেন জীবনের সমস্ত ঘাত-প্রতিঘাতে, আপদে-বিপদে গীতবিতান আপনার সহায়, সম্বল হয়েছে, রবীন্দ্রসংগীত বা রবীন্দ্রনাথও পাশে দাঁড়াতে পারেননি, এমন কোনো দিন কি কখনও গেছে?’ প্রশ্নের উত্তর দিতে গিয়ে চোখের অশ্রু ঝরতে লাগল, তিনি তাঁর ঘনিষ্ঠ একজনের মৃত্যুর কথাটি বললেন। সাক্ষাৎকার ছাপা হওয়ায় মনঃক্ষুণ্ন হলেন সুচিত্রা, অনেকদিন কথা না বলে তাঁকে এড়িয়ে গেলেন, পরে বিমান ঘোষের কাছে জানতে পারলেন প্রকাশিত সাক্ষাৎকার বিষয়ে সুচিত্রা মিত্রের প্রতিক্রিয়া : ‘লিখেছে তো ভালো। তা বলে আমার কান্নাকাটি নিয়ে লেখার কী দরকার ছিল? আমি কি ন্যাকা, প্যানপেনে?’ বোঝা যায়, রবীন্দ্রসংগীতের গায়নভঙ্গি থেকে এই প্রবণতা দূর করার জন্যই নিজের ব্যক্তিত্বেও সেই দৃঢ় মেজাজটা ধারণ করতে চেয়েছিলেন সুচিত্রা।
তবে গানের শ্রোতাকে এ-কথা নিশ্চয়ই বলতে হয় না যে, তাঁর এই দৃঢ়তাও গানের প্রবণতা অনুযায়ী পাল্টায়। তাই দৃঢ়তার জায়গায় এখানে ‘ঋজুতা’ বলাই সংগত। সুচিত্রা যখন মিশ্র-কেদারা রাগের ‘আকাশভরা সূর্যতারা’ বা বর্ষার গান বলে পরিচিত ঝিঁঝিট রাগের ‘বজ্রমাণিক দিয়ে গাঁথা’ গেয়েছেন, তখন সেটা কীর্তনাঙ্গের ‘তবু মনে রেখো’ বা দেশ-কেদারা রাগের ‘কাঁদালে তুমি মোরে’র সঙ্গে মিলবে না। সুচিত্রা যেভাবে ‘আকাশভরা সূর্যতারা’ গেয়েছেন তার সঙ্গে একমাত্র দেবব্রত বিশ্বাসের গায়কির তুলনা হতে পারে, কারণ এই দুজনের সতর্ক ও সাবধানতার বীজাধার এক। আর প্রায়-শেষ বয়সে পৌঁছেও ‘বজ্রমাণিক দিয়ে গাঁথা’ গানটি যেভাবে গেয়েছেন তাতে তাঁর ঋজু ব্যক্তিত্বের দৃঢ়তাই স্পষ্ট।
ঠিক এ-ই যখন অভিজ্ঞতা, তখন দেবেশ রায়ের মতো প্রাজ্ঞ শ্রোতা শোনালেন অন্য আরেক শ্রুতি-অভিজ্ঞতার বর্ণনা। তিনি বললেন, কখনো কখনো কোনো কণ্ঠে ইতিহাস ভর করে, যেমন পল রোবসন, জোয়ান বায়েজ এবং মুকুন্দ দাস, তেমনি ‘আমাদের স্বাধীনতা আন্দোলনের শেষ উত্তালতা সুচিত্রার গলায় কী এক বিষাদে ভর করেছিল।’ শুধু ‘বিষাদ’ই নয়, অন্যত্র ‘বিষণ্ন’তার উল্লেখ করেছেন দেবেশ, তবে বলছেন, ‘বিষণ্ন সমবেত সংগীত’ যা দেশকালের দ্বারা সবসময় চিহ্নিত না হলেও অনেক সময়ই চিহ্নিত। এই মূল্যায়ন রবীন্দ্রনাথের সকল পর্যায়ের গান গাওয়ার ক্ষেত্রে সুচিত্রা যে সক্ষমতার পরিচয় দিয়েছিলেন তা স্মরণ করিয়ে দেয়। দূরতর প্রসঙ্গে চণ্ডালিকা আর চিত্রাঙ্গদার কথাও এখানে তোলা যেতে পারে, যেখানে রয়েছে সুচিত্রা-কণ্ঠের অনন্য দৃষ্টান্ত।
২০১১ সালে লিখিত ‘ছন্দায়িত প্রাণ’ শিরোনামের একটি গদ্যে শঙ্খ ঘোষ লিখেছেন, প্রথম যৌবন থেকে শুরু করে সেই সময় পর্যন্ত তাঁদের ‘অনেকেরই জীবন গাঁথা হয়ে আছে সুচিত্রা মিত্রের গানে’। চণ্ডালিকার প্রকৃতিপর্যায়ের গান, মিছিলে আর জনসভায় গাওয়া ‘স্বতঃপ্রণোদিত’ গান তাঁদের আপ্লুত তো করতই, সেইসব গান থেকে তাঁরা জেনেছিলেন কীভাবে সহাবস্থান করে ‘লাবণ্য’ আর ‘শক্তি’ এবং ‘সচ্ছলতা’র সঙ্গে কীভাবে মিলিয়ে দেওয়া যায় ‘উদাত্ততা’। সেই লেখায়, সকলের সঙ্গে অনায়াস স্বাচ্ছন্দ্যে মিলে যেতে পারার গুণের উল্লেখ করতে গিয়ে তিনি বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময়কার কথা স্মরণ করেছেন :
কলকাতায় পাকিস্তানের দূতাবাস থেকে উড়তে শুরু করেছে নতুন দেশের পতাকা। কলকাতার মানুষ মিছিল করে গিয়ে অভিবাদন জানাচ্ছেন সেই পতাকাকে, সমবেতভাবে গাইছেন ‘আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালবাসি।’ ছোটো সেই জমায়েতের গানে সেদিন নেতৃত্ব দিচ্ছিলেন সুচিত্রা মিত্র। তাঁর সেদিনকার মুখের সেই দীপ্তি কখনো ভুলবার নয়।
দেবব্রত বিশ্বাস আর সুচিত্রা মিত্রের অনন্য গায়কির মাধ্যমে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ আরেকটি ঘটনা ঘটেছিল সে-সময়ে। একসময়ের অনেক বামপন্থী বোদ্ধা রবীন্দ্রসংগীতশিল্পীদের প্রচলিত গায়কির কারণে তার রস গ্রহণ করতে পারছিলেন না। হেমাঙ্গ বিশ^াসসহ অনেকেই সেই গায়নভঙ্গিকে ‘ইনিয়ে-বিনিয়ে’ গাওয়া বলতেন, তখন এই দুজনই তাঁদের অনেককেই রবীন্দ্র-ভক্তে পরিণত করেছিলেন। এক্ষেত্রে এঁরা রবীন্দ্রসংগীতের নানামুখী প্রবণতার মধ্য থেকে প্রতিবাদের গানগুলিকে বিভিন্ন সময় কাজে লাগিয়েছিলেন, আর এতে এই বিষয়টিও স্পষ্ট হয়ে ওঠে যে, রবীন্দ্রসংগীত সর্বময় বিস্তারের ক্ষেত্রে গায়কি আর দৃষ্টিভঙ্গিতে যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা আনার দরকার ছিল তার অনেকটাই পূরণ করেছিলেন সুচিত্রা মিত্র। একজন শিল্পীর জন্যে এর চেয়ে বড়ো কৃতিত্ব আর কী হতে পারে।
Leave a Reply
You must be logged in to post a comment.