ঘেউ ঘেউ ঘেউ … মিয়াঁও মিয়াঁও মিয়াঁও … কিঁউ কিঁউ কিঁউ কিচ্ কিচ্ চক্ এরকম ডাকাডাকির শব্দ। ডাক্তারের চেম্বারের সামনে বসে বেশ কয়েকজন রোগী, রোগীর সঙ্গী। অপেক্ষমাণ। সকলের সঙ্গেই শিশু আছে। কিংবা সকল শিশুর সঙ্গেই তার বাবা-মা কিংবা অভিভাবক আছেন। ডাক্তার শিশু-বিশেষজ্ঞ। এখানে কোনো কুকুর, বিড়াল কিংবা অন্য কোনো পশুপাখির চিকিৎসা করা হয় না। আর তা এখানে নেইও। কিন্তু পশুপাখির মতো ডাক শোনা যাচ্ছে বারবার। সবাই উৎসুক। দেখা গেল দুই-আড়াই বছরের একটা শিশু মুখ দিয়ে ওইরকম শব্দ করছে। তার নাম জিজ্ঞেস করলে কিংবা কিছু জিজ্ঞেস করলে বা আদর করতে গেলেও সে ঘেউ ঘেউ করে উঠছে অথবা মিয়াঁও মিয়াঁও করছে, বা পাখির মতো ডাকছে। সেখানকার সবাই বিস্মিত। অতটুকু একটা ছেলে কী চমৎকার অনুকরণ করছে। অবিকল নকল করে ডাকছে জীবজন্তুর ডাক। তবে অন্য কোনো কথা বলছে না। সবাই খুব প্রশংসা করছে। তাতে বাবা-মায়ের খুশি হওয়ার কথা। সন্তানের প্রশংসায় বাবা-মা তো খুশিই হবে। অথচ খুশির বদলে তাদের চোখে-মুখে উদ্বেগ, দুশ্চিন্তা। লজ্জা। ছেলেটা কি তাহলে অসুস্থ? দেখে অবশ্য অসুস্থ মনে হয় না। কী সুন্দর ফুটফুটে একটা বাচ্চা! খুব চটপটে। বুদ্ধিদীপ্ত। বেশ চঞ্চল। উৎসুক একজন জিজ্ঞেস করেই
ফেললেন –
– আপনারা ডাক্তারের কাছে কেন এসেছেন? বাচ্চার কিছু হয়নি তো? কী সুন্দর ছেলে? এত অল্প বয়সেই কত সুন্দর পশুপাখির ডাক নকল করতে পারে! হরবোলা।
– না না তেমন কিছু নয়। বাবুটা কথা শিখছে না। শুধু পশুপাখির ডাক অনুকরণ করে; আর সেসবই করে। কোনো কথা বলে না কারো সঙ্গে। সারাদিন পশুপাখির ভাষায় ডাকাডাকি করে। এজন্যই ডাক্তারের কাছে এসেছি।
– কখনোই কথা বলে না?
– বলে। তবে খুব কম। খুব দুশ্চিন্তায় আছি ওকে নিয়ে।
– সে কী? আশ্চর্য তো! এরকম কখনো দেখিনি বা শুনিনি!
সকলের দৃষ্টির কেন্দ্রবিন্দু এই হরবোলা শিশু। সকলের মনোযোগও তার দিকেই। আশ্চর্য এক নীরবতা নেমে এলো ঘরে। সেই নীরবতা চৌচির করে দিয়ে ডাক্তারের অ্যাসিস্ট্যান্ট ডাকল – সিরিয়াল নম্বর এগারো। চলে আসেন।
শরিফ সাহেব উঠে দাঁড়ালেন, যেন পায়ের নিচে মাটি নেই। তপ্ত বালু। পা দুটো টলছে। পেছনে স্ত্রী আয়েশা ছেলে আননকে নিয়ে উদ্বিগ্ন মুখে চেম্বারের দিকে চললেন। তারা ভেতরে ঢোকার পর দরজা বন্ধ হলো। দরজা বন্ধ হলেও পশুপাখির ডাক শোনা যায় বাইরে থেকে। অনেকেই অনেক সমস্যা নিয়ে আসেন। কিন্তু এমন সমস্যার কথা শোনা যায় না। অনেকেই শোনেননি কখনো। অদ্ভুত আচরণ শিশুটার। শিশুটাকে উদ্দেশ করে ডাক্তার বললেন –
– বসুন, বসুন। এই যে শুনছেন, কী নাম আপনার? কী সমস্যা বলুন তো?
সঙ্গে সঙ্গে আনন ঘেউ ঘেউ, মিঁউ মিঁউ – এসব ডাকাডাকি শুরু করল।
– এ দেখি হরবোলা! সমস্যাটা জটিল। কিন্তু নিরাময়যোগ্য। সময় দিতে হবে আপনাদের।
– যেভাবে বলবেন, আমরা চেষ্টা করবো। আমাদের খুব আদরের সন্তান। কেন এরকম হলো, কে জানে?
– কয়েকটা প্রশ্ন করতে পারি আপনাদের?
– নিশ্চয়ই। সমাধানের জন্যই তো আপনার কাছে আসা?
– ও কি আপনাদের একমাত্র সন্তান?
– হ্যাঁ, একমাত্র সন্তান।
– বয়স কত?
– আড়াই বছর।
– বাসায় আর কে কে থাকে?
– একটা মেয়ে আছে। কাজের মেয়ে। আর কেউ নেই।
– আপনারা দুজনই কি চাকরি করেন?
– হ্যাঁ।
– তাহলে বাচ্চা থাকে কার কাছে?
– কাজের মেয়ের কাছে।
– বাসায় কুকুর-বিড়াল আছে?
– আছে।
– কী কী আছে?
– কুকুর, বিড়াল, অ্যাকোয়ারিয়ামে মাছ আর খাঁচায় নানা ধরনের পাখি।
– শিশুটির সর্বনাশ করে ফেলেছেন আপনারা। সর্বনাশটা ওখানেই হয়েছে। স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসতে বেশ সময় লাগবে ওর। ছোট থাকতেই বাচ্চাটা আপনাদের সান্নিধ্য কম পেয়েছে বা পায়নি বললেই চলে। আপনারা দুজনই অফিসে চলে যান সকালে। বাচ্চাটা তখন উঠেও না হয়তো ঘুম থেকে। সারাদিন গৃহপরিচারিকার কাছে থাকে। সেও সংসারের নানা কাজ করে বলে বাচ্চাকে সময় দিতে পারে না। বাচ্চার সঙ্গে খেলারও কেউ নেই। অগত্যা বাচ্চাটি কুকুর-বিড়াল নিয়েই থাকে। কুকুর ঘেউ ঘেউ করলে সেও ঘেউ ঘেউ করে। বিড়াল মিঁউ মিঁউ করলে সেও মিঁউ মিঁউ করে। সে মজা পায়। অর্থাৎ বাচ্চাটা তাদের অনুকরণ করে। কুকুর-বিড়াল তার খেলার সাথি। বাচ্চার সঙ্গে এইসব জীবজন্তু-পশুপাখির যোগাযোগ হচ্ছে। আপনাদের সঙ্গে ওর পারস্পরিক সম্পর্কই গড়ে ওঠেনি। সে-কারণেই সে-কথাও শেখেনি কিংবা কথা বলতে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করে না। বিষয়টা মনস্তাত্ত্বিক ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে।
– তাহলে জীবজন্তু-পশুপাখি সব কি বাসা থেকে বের করে দেব?
– না না। ভুলেও তা করবেন না। বাচ্চাটার ভয়ংকর ক্ষতি হয়ে যেতে পারে তাহলে।
– তাহলে, উপায় কী?
– উপায় আছে। শিশুকে বেশি বেশি সময় দিন। ওকে নিয়ে বেড়াতে যান। ওর সঙ্গে বেশি বেশি কথা বলুন। ওকে একা রাখবেন না। ওর খেলার সাথি দরকার। কারো সঙ্গে খেলা করার ব্যবস্থা করুন। ধীরে ধীরে জীবজন্তু-পশুপাখি থেকে ওকে সরিয়ে রাখুন। তারপর এক এক করে বাসা থেকে ওসব সরিয়ে ফেলুন। একসঙ্গে সব বিদায় করবেন না। তাহলে ওর মনের ওপর প্রচণ্ড আঘাত পড়বে। তাতে আরো বেশি ক্ষতি হয়ে যেতে পারে শিশুটির। জীবজন্তু-পশুপাখি ওর খেলার সাথি না করে মানুষ ওর খেলার সাথি করুন। একসময় সব স্বাভাবিক হয়ে যাবে। আর হ্যাঁ, বাসায় খুব কাছের কোনো আত্মীয়স্বজন এনে রাখুন। সমবয়েসি কিংবা বয়স্ক কেউ।
ডাক্তারের চেম্বার থেকে স্ত্রী-পুত্রকে নিয়ে বাসায় ফিরে আসেন শরিফ সাহেব। মুখে কোনো কথা নেই স্বামী-স্ত্রীর। ফ্রেশ হয়ে ড্রইংরুমে এসে বসেন ক্লান্তমনে। মাথার ওপর পাখা ঘুরছে। মনে হয় পাখা নয়, আকাশ ঘুরছে। গ্রহ-তারা-নক্ষত্র সব ঘুরছে। জগৎ ঘুরছে। খেতেও মন চাইছে না। মনটা কেমন বিস্বাদ হয়ে আছে। সবকিছু তেতো লাগছে। মনের ভেতর একরাশ অশান্তি আর হতাশা। অর্থের পেছনে ছুটে জীবনটাই অনর্থ হয়ে গেছে। কখনো ভাবেনই নি এ নিয়ে। খেয়ালই করেননি সন্তানের বেড়ে ওঠা। যে ভুল হয়ে গেছে হেলায়, তা শোধরানোর উপায় নেই। আয়েশাকে ডেকে পরামর্শ করেন। দুশ্চিন্তা এক জটিল বাসা বুনেছে বুকের ভেতর। এ থেকে যেন বেরুনোর যেন উপায় নেই কোনো। আননকে কাছে ডাকেন। সে ঘেউ ঘেউ করতে করতে কাছে আসে। বিড়ালের মতো মিঁউ মিঁউ করে। সমস্ত আনন্দ বিস্বাদ হয়ে যায়। ছেলের দিকে তাকিয়ে হঠাৎ তাঁর মনে হয় – ও যেন কুকুরের বাচ্চা, মনে হয় বিড়ালের বাচ্চা। স্বাভাবিকভাবে দেখতেই পারছেন না। দৃষ্টি যেন এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে। চোখ কাজ করছে না ঠিকমতো। আননের দিকে তাকালেই কখনো কুকুর মনে হচ্ছে, কখনো মনে হচ্ছে বিড়াল। ও হাসছে, মনে হয় কুকুর হাসছে। ও হাঁটছে, মনে হয় বিড়াল হাঁটছে। পাগল হয়ে যাবেন মনে হয়। দু-হাতে মাথা চেপে ধরে চিৎকার দিয়ে ওঠেন।
শরিফ সাহেবের বাবা গত হয়েছেন কয়েক বছর আগে। মা বৃদ্ধাশ্রমে। চাকরি থেকে অবসর নেওয়ার পর গ্র্যাচুইটির টাকায় এ-ফ্ল্যাটটি কিনেছিলেন তাঁর বাবা। অথচ সেই ফ্ল্যাটে তাঁর মায়ের জায়গা হলো না। এই দুঃসহ কষ্টের বোঝা সারাজীবন বইতে হবে তাঁকে। বাবা মারা যাওয়ার কিছুদিন পর মায়ের স্থান হয় বৃদ্ধাশ্রমে। স্থান হয়, মানে পাঠানো হয়। মা তখন উচ্ছিষ্ট হয়ে উঠেছেন সংসারে – পুরনো হাঁড়ি-পাতিলের মতো। মা বাসায় থাকলেও হয়তো একটা উপায় হতো। সে তো আর হওয়ার নয়। একজনকে চাকরি ছেড়ে দিতে হবে। তাতেও সমস্যা। সংসারে অর্থের প্রভাব পড়বে। অক্টোপাসের মতো জড়িয়ে ধরে দুশ্চিন্তা। জীবন কখনো ক্যাকটাসের ঝাড় হয়ে উঠবে, ভাবেননি তাঁরা। আয়েশা অনেক ভেবে একদিন বলেন –
– আচ্ছা, তোমার আম্মাকে যদি ফিরিয়ে আনি বৃদ্ধাশ্রম থেকে, তাহলে সমস্যার সমাধান হয় না?
– আম্মাকে তো তুমিই বৃদ্ধাশ্রমে পাঠানোর কথা বলেছিলে! আমি কি চেয়েছিলাম?
– সে বলেছিলাম, তখন তো আর এই সমস্যা ছিল না? কে জানত এমনটা হবে?
– বারবার তখন নিষেধ করেছিলাম। শোনোনি আমার কথা।
– সত্যি ভুল হয়ে গেছে। চলো না আম্মাকে বাসায় ফিরিয়ে নিয়ে আসি।
– তা মন্দ বলোনি। আম্মা যদি আসতে না চান?
– আসবেন না কেন? এত বড় একটা সমস্যা, উনি বুঝবেন না?
– তা বুঝবেন হয়তো। কিন্তু আমরাই তো তাঁকে জোর করে পাঠিয়েছি ওখানে। মা কি যেতে চেয়েছিলেন? কত কান্নাকাটি করেছেন যাওয়ার আগে। তখন একবারও ভাবিনি তাঁর সমস্যার কথা। আমাদের কথাই শুধু ভেবেছিলাম আমরা।
– চলো না, আমরা না হয় ক্ষমা চেয়ে নেবো। তখন তো বুঝিনি এ-সমস্যা হবে।
– কোন মুখে বলবো তাঁকে ফিরে আসার কথা?
– সে না হয় আমিই বলবো। চলো।
– আম্মা কি আর আসবেন?
– আসবেন না কেন? দেখো, আমাদের অনুরোধে ঠিকই আসবেন।
– জানি না আম্মা আসবেন কি না। গিয়ে দেখা যাক। আজ বিকেলেই চলো না হয়। কিন্তু মুখে বলবো কী করে তাঁকে এ-সমস্যার কথা? স্বার্থপরের মতো মনে হবে।
– সেটা না হয় চেপেই গেলাম। বুঝিয়ে-শুনিয়ে
ভুলিয়ে-ভালিয়ে নিয়ে আসবো। নইলে স্বার্থপর ভাববেন ঠিকই।
– বেশ। বিকেলেই চলো তাহলে।
মায়ের সঙ্গে দেখা হলো। আহা, কী প্রশান্তি। বুকের ভেতরটা কেমন মুষড়ে উঠলো। অনেকদিন পরে এলেন তাঁরা মায়ের সঙ্গে দেখা করতে। মা কেমন বুড়িয়ে গেছেন। সাদা চুল, সাদা শাড়ি। শুকনো কাশফুলে ঢাকা শীর্ণ নদী যেন। তবু কোথায় যেন পরম একটা শুভ্রতা ছড়িয়ে আছে। স্নিগ্ধ পবিত্রতা। দুজনই গদগদ হয়ে নানা কথা বলছেন। তবে একবারও সন্তানের সমস্যার কথা বলেননি তাঁরা। বলতে পারছেন না। পারা যায় না। আয়েশা এমনভাবে কথা বলছেন, যেন তাঁর নিজেরই মা। অথচ আগে কী দুর্ব্যবহারই না করেছেন। শাশুড়িকে বাসা থেকে তাড়িয়ে দিয়েছেন। একবারও কখনো আম্মা বলে ডাকেননি। শাশুড়িকে একটুও সহ্য করতে পারতেন না। তিনি ছিলেন তাঁর চক্ষুশূল। শাশুড়ির জন্য দরদ যেন ফুটন্ত দুধের মতো ফেনিয়ে উঠেছে এখন। কী মিষ্টি করে কথা বলছেন আয়েশা, কে বলবে নিজের মা নন? আসার সময় এক কৌটা হরলিক্স, কমলা, ডালিম আর সবুজ আপেল নিয়ে এসেছেন মায়ের জন্য।
সবুজ আপেল মায়ের খুব পছন্দ। পায়ে হাত দিয়ে সালাম করে বলেন –
– আম্মা, এখানে আপনার অনেক কষ্ট হচ্ছে, তাই না?
– না তো, আমার কোনো কষ্ট হয় না। ভালোই আছি মা।
– না, একা একা থাকেন। তাছাড়া কী খান, না খান। আপনার যত্ন নেওয়ার কেউ নেই।
– কোনো সমস্যা হচ্ছে না এখানে আমার। সব ঠিক আছে।
– না আম্মা, আপনি বাড়ি চলেন। আমরা সবাই একসঙ্গে থাকব। সেটাই ভালো হবে।
– আমাকে নিয়ে আর ভেবো না। আর কয়দিনই বা বাঁচবো? এভাবেই কেটে যাবে আমার। তোমরা সুখে থাকো, শান্তিতে থাকো। আমাকে নিয়ে আর অশান্তি বাড়িও না। আমি তো বাতিল ওষুধ।
শরিফ সাহেব কোনো কথা বলতে পারছেন না। কথাগুলো শুকনো ছাতুর মতো দলা পাকিয়ে গলায় আটকে আছে। কী এক কষ্ট, পাপবোধ তাঁকে খুঁটে খুঁটে খাচ্ছে। কী বলবেন তিনি? স্বার্থপরের মতো নিজের বিপদের সময় মায়ের শরণাপন্ন হয়েছেন। চুপ করে বসে রইলেন। একটা কথাও মুখ দিয়ে বের হলো না। উত্তাল পাহাড়ি নদীর মতো শুধু বুকের ভেতরটা ছলাৎ ছলাৎ করতে থাকলো। নিজেকে অযোগ্য সন্তান মনে হলো।
মায়ের কথা শুনে হঠাৎ কেমন ধক্ করে উঠলো বুকের ভেতর আয়েশার। সত্যিই তো ‘মা’ এখন ওষুধ, বাতিল ওষুধ। কথাটার মধ্যে যেন প্রচ্ছন্ন একটা ইঙ্গিত আছে। বল্লমের মতো কথাটা বুকে এসে বিঁধলো আয়েশার। এমন করে কখনো উপলব্ধি করেননি শাশুড়িকে। শরিফ সাহেব অপরাধবোধে ভুগছেন ভেতরে ভেতরে। মুখে নুন-পড়া জোঁকের মতো কুঁকড়ে আছেন। মাকে তেমন করে বলতেও পারছেন না। পাপের একটা প্রলেপ যেন লেগে আছে গায়ে। মায়ের মনে একটু খটকা লাগছে। ছেলে, ছেলের বউ কোনোদিন এত মমতা করে তো কথা বলেনি? আজ কী হলো তাদের? কোনো সমস্যা? ভেতরে ভেতরে একটু বিচলিত হচ্ছেন। কিন্তু জিজ্ঞেস করছেন না কিছু। আননের কথা জিজ্ঞেস করলেন। কেমন আছে, কী করে, তাকে নিয়ে এলো না কেন? ভেতরটা মায়ের খাঁখাঁ করছে। ভূমিধসের মতো তছনছ হয়ে যাচ্ছে সব। বাড়ি যাওয়ার জন্য যত পীড়াপীড়ি করছে তারা, ভেতরে ভেতরে আরো শক্ত হচ্ছেন তিনি। কিন্তু মুখ ফুটে কিছু বলছেন না তিনি। তাঁরই স্বামীর ফ্ল্যাটে তাঁর জায়গা হয়নি। স্বামী মারা যাওয়ার পর তাঁর আশ্রয় হয়েছে বৃদ্ধাশ্রমে। কবরের মতো ছোট্ট একটা ঘরের মধ্যে কাটে তাঁর দিন-মাস-বছর। এটাই তাঁর জগৎ।
কোথাও আগুন লেগেছে। দমকল বাহিনীর গাড়ি চিৎকার করতে করতে চলে যায় দূরে। কয়েকটা কুকুর ঘেউ ঘেউ করে ওঠে পাশের রাস্তায়। আঁতকে ওঠেন, কেমন যেন আনমনা হয়ে যান শরিফ সাহেব – মনে হয় আনন ঘেউ ঘেউ করে উঠছে। মনে হয়, ওটা যেন কুকুর নয়, তাঁর সন্তান ঘেউ ঘেউ করছে। ভেতরটা কুঁকড়ে যায় কেঁচোর মতো। যে-কোনো পশুপাখি ডাকলেই বুকের ভেতর ধড়্ফড়্ করে ওঠে তাঁর। মনে হয় – ওটা কোনো পশুপাখি নয়, আনন। ও কুকুর নয়, বিড়াল নয় – আনন। তাঁর অন্তরাত্মা ছটফট করতে থাকে। মা লক্ষ করেন, তাঁর ছেলে ও ছেলেবউয়ের চোখে হতাশা। কপালে দুশ্চিন্তার রেখা। বুঝতে পারেন কিছু একটা হয়েছে, প্রকাশ করছে না। তাদের অন্তরে কোনো দাবানল সৃষ্টি হয়েছে। মায়ের ভেতরটাও পুড়ে যাচ্ছে। পৃথিবীটা কেমন যেন মরুময় হয়ে ওঠে। মা বলেন –
– আমাকে নিয়ে আর চিন্তা করো না তোমরা। এখানে আমার শেকড় গজিয়ে গেছে। তার মূল তুলে ফেললে আমার আর অস্তিত্বই থাকবে না। মাঝেমধ্যে দু-একজন মারা যায়। তেমন শোক প্রকাশেরও কেউ থাকে না। ক্ষণিকের জন্য একটু কষ্ট হয়। তারপর সব স্বাভাবিক। এখন মৃত্যুশোকটাও কেমন যেন সয়ে গেছে আমার। এখানের বুড়োবুড়িরাই আমার
আত্মীয়-পরিজন এখন। তোমরা দূরের পড়শী। তাই এদের ছেড়ে যাওয়াটাও সম্ভব নয় আমার। ঘর ছেড়ে যে নতুন ঘরের সন্ধান পেয়েছে, তাকে আর ঘরহারা করতে চেয়ো না। তোমরা সুখে থাকলেই আমার শান্তি।
ভাঙনের শব্দ শোনেন তাঁরা। স্রোতস্বিনী নদীর দু-পাড় ভাঙার শব্দ। সংসার ভাঙার শব্দ। মমতা ভাঙার শব্দ। কান্নার শব্দ। যেটুকু বন্ধন ছিল, তাও যেন ছিন্ন হয়ে গেল আজ। ছেঁড়া তার আর জোড়া লাগবে না কখনো। চিরতরে ছিঁড়ে গেল। বিফল মনোরথ নিয়ে ফিরে এলেন তারা। চোখে একরাশ অন্ধকার। কোথাও যেন কোনো আলো নেই। হাওয়া নেই। শ্বাস নেওয়ার জায়গা নেই। এরপর দরজা বন্ধ করে কাঁদতে বসলেন মা। অনেকদিন ধরে জমে থাকা যন্ত্রণা-কষ্ট যেন বন্যার বেগে দু-কূল ছাপিয়ে তাঁর চোখ ভাসিয়ে গেল। অনেক হালকা লাগছে তাঁর এখন। এবার শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করা যায়। কাঁদতে কাঁদতে ঘুমিয়ে পড়েন তিনি।
একরাশ কষ্ট আর হতাশা নিয়ে বৃদ্ধাশ্রম থেকে বেরিয়ে এলেন শরিফ সাহেব ও তার স্ত্রী। এত অনুনয়-বিনয় করলেন, অথচ পাষাণ গললো না। মা রাজি হলেন না কোনোভাবেই। মায়ের ভেতরের বরফগলা নদী তাঁরা দেখতে পেলেন না, শুধু পাথরটাই দেখতে পেলেন। মায়ের অন্তর চিরে যে বেরিয়ে যাচ্ছে গলিত ফুটন্ত লাভা, তা তাঁদের দৃষ্টির অন্তরালেই থেকে গেল। বাড়ির লিফট থেকে নেমে ফ্ল্যাটের দরজা পর্যন্ত হেঁটে আসতে কষ্ট হচ্ছিল। শ্লথ পা একেবারে চলছিল না। অসম্ভব ভারি মনে হচ্ছিল। কলিংবেল বাজালেন। কলিংবেলটা মনে হয় ঘেউ ঘেউ করে উঠলো। চমকে উঠলেন। নাকি ভুল শুনছেন। ঘরের কুকুর ঘেউ ঘেউ করে উঠেছে হয়তো। নাকি আনন ঘেউ ঘেউ করছে? আবার কলিংবেল বাজালেন। আবার ঘেউ ঘেউ করে উঠলো। বুঝতে পারছেন না যে, কলিংবেল ঘেউঘেউ করছে, নাকি কলিংবেল শুনে ঘরের কুকুর ঘেউ ঘেউ করে উঠছে। নাকি তাঁর ভেতরটা ঘেউ ঘেউ করে উঠছে? তৃতীয়বার বেল বাজাতে আতঙ্কগ্রস্ত হচ্ছেন। এ কি সত্যি, নাকি হ্যালুসিনেশন?
ঘরে ঢুকে কুকুরগুলোর দিকে নজর পড়ার সঙ্গে সঙ্গে মেজাজ বিগড়ে গেল শরিফ সাহেবের। ক্ষোভে-দুঃখে ফেটে পড়লেন। হিতাহিত জ্ঞানশূন্য হয়ে পড়লেন। পাশেই পড়ে ছিল মশামারা একটা ইলেকট্রিক ব্যাট। কোনো কিছু না ভেবেই ব্যাটটা তুলে নিলেন হাতে। সপাৎ সপাৎ করে পিটুনি শুরু করলেন সামনে থাকা অ্যাকোরিয়ামের গায়ে। মুহূর্তে ফেটে চৌচির হয়ে গেল অ্যাকোরিয়াম দুটো। ঝনঝন শব্দে ভেঙে পড়লো কাচ। সারা ঘরে ছড়িয়ে পড়ল পানি। লাল-নীল নানা রঙের মাছগুলো দাপাদাপি শুরু করলো ড্রইংরুমের কার্পেটে। এরপর ছুটে গিয়ে পিটুনি শুরু করলেন কুকুরের খাঁচায়। কুকুরগুলো আরো জোরে ঘেউ ঘেউ শুরু করে দিলো। আয়েশা কিংকর্তব্যবিমূঢ়। ছুটে গিয়ে জাপটে ধরলেন শরিফ সাহেবকে – ‘কী করছো তুমি? পাগল হয়ে গেলে নাকি? শান্ত হও, শান্ত হও।’ ধরে এনে সোফায় বসিয়ে দিলেন। মাছগুলো তার পায়ের কাছে দাপাদাপি করছে। যেন পা ধরে বাঁচার আকুতি জানাচ্ছে। সমস্ত বোধ রহিত শরিফ সাহেব নির্বাক তাকিয়ে থাকেন মাছগুলোর দিকে। নদীর সমস্ত পানি শুকিয়ে গেলে মাছেরা যেমন ছটফট করে, তেমনি এই মাছগুলোও ছটফট করছে। পায়ের কাছে রঙিন জীবন। সংবিৎ ফিরে এলে কষ্ট হচ্ছিল এই ভেবে, মাছগুলোর কী দোষ? কী দোষ করেছে কুকুরগুলো? তিনি উন্মাদ হয়ে গেছেন। হঠাৎ হাউমাউ করে কেঁদে ওঠেন শরিফ সাহেব। এ কান্নার শব্দে কুকুরগুলো হতভম্ব হয়ে তাদের চিৎকার থামিয়ে নির্বাক তাকিয়ে থাকে তার দিকে।
স্নান নেই, খাওয়া নেই, ঘুম নেই। জীবনটা যেন নিমের পাচন হয়ে গেছে। হঠাৎ খেয়াল হলো, তিনিও হরবোলা হয়ে গেছেন। কুকুরের মতো, বিড়ালের মতো, পাখির মতো ডাকছেন। কী অদ্ভুত! আয়েশার কাছে গেলেন বিষয়টা জানাতে। দেখেন, আয়েশাও হরবোলা হয়ে গেছে। শরিফ সাহেবকে দেখেই আয়েশা ঘেউ ঘেউ করে উঠল। কাজের মেয়ে জরিনাও ঘেউ ঘেউ করে কথা বলছে। বাইরে এসে দেখেন, সেখানেও সবাই হরবোলা। বাড়িওয়ালা ঘেউ ঘেউ করছে। দারোয়ান কা-কা করছে। দোকানি মিঁউমিঁউ করছে। অবাক করা বিষয়, সবাই হরবোলা! সবাই যেন পশুপাখি। কুকুর, বিড়াল, ভেড়া, ছাগল। এমন কেন হলো? এমন হলো কী করে? কেন এমন হয়? নানা প্রশ্ন জাগছে মনে। কিন্তু প্রশ্ন করতে পারছেন না। কুকুর-বিড়াল কীভাবে প্রশ্ন করে, তাঁর জানা নেই। কুকুর-বিড়ালের ভাষা তাঁর জানা নেই। তিনি রাস্তায় নেমে এলেন। ফুটপাত দিয়ে কুকুরের মতো দৌড়াচ্ছেন, আর ঘেউ ঘেউ করছেন। তিনি একা নন, সব মানুষ – কুকুর, বিড়াল, পশুপাখির মতো ডাকছে। সবাই যেন কুকুর, বিড়াল, পশুপাখি হয়ে গেছে। মানুষের মতো কেউ কথা বলছে না। হরবোলার শহর। আজব শহর! আজব কাণ্ড! আয়েশার ধাক্কায় লাফিয়ে উঠলেন –
– শুনছো। শিগগির ওঠো। দেখো, ছেলে কী করছে। মাঝরাতে না ঘুমিয়ে ঘেউ ঘেউ করছে। তার সঙ্গে তুমিও পাল্লা দিয়ে ঘেউ ঘেউ করছো। আমার ঘুম ভেঙে গেল। তোমরা কী শুরু করছো? ওঠো। আমার খুব ভয় করছে।
ভাবনারা নিয়ত মস্তিষ্কে মাকড়সার মতো জাল বোনে। নিজের বোনা জালে নিজেই জড়িয়ে থাকে। সেখানে দিন-রাত একাকার। ঠোঁট থেকে হাসি উধাও। মন থেকে আনন্দ নিরুদ্দেশ। কোনো উপায় খুঁজে পায় না। কী এক আতঙ্ক জাপটে থাকে সারাক্ষণ জলাতঙ্ক রোগীর মতো। বন্ধ টিভির পর্দায় তাকিয়ে থাকেন। টিভি দেখতেও ইচ্ছে করে না। সময় যেন দুরন্ত সরীসৃপ হয়ে গিলে খায় তাদের। শরিফ সাহেবের বাসার কলিংবেল বেজে ওঠে এক সন্ধ্যায়। স্বামী-স্ত্রী বসে ছিলেন ড্রইংরুমেই। মুখ ভার। কারো মুখে কোনো কথা নেই। যেন নিজের ফাঁসির রায় শুনেছেন এইমাত্র। অকূল পাথার। কোনো কিনারা নেই। জরিনা দরজা খুলে দেয়। তাকিয়ে অবাক হয়ে যান স্বামী-স্ত্রী। আকাশ ভেঙে পড়লেও হয়তো তাঁরা এতটা বিস্মিত হতেন না। বাঁধ না মানা জোয়ারের পানির মতো দু-চোখ ভেঙে নেমে এলো অশ্রু। এ কি স্বপ্ন, নাকি সত্যি?
ব্যাগ নিয়ে ঘরে ঢোকেন মা। টের পেয়ে ছুটে আসে আনন। দৌড়ে গিয়ে জড়িয়ে ধরে। স্পষ্ট ভাষায় চিৎকার করে বলে ওঠে – দিদু, আমাকে ফেলে কোথায় ছিলে তুমি?
Leave a Reply
You must be logged in to post a comment.