ঘোড়াটি ছোট-ছোট কদমে হাঁটছে। শান্তÍ স্থির শরীরে যে-কোনো আনাড়ি লোকও সওয়ার হতে পারবে। ঘোড়ার মালিক সে উদ্দেশ্যে পায়ে শিকল পরায়নি। বড় কদম যেন ফেলতে না পারে তার জন্যই বরং এ-ব্যবস্থা। কালবৈশাখীতে বিধ্বস্ত পার্ক। পার্কে ঘোড়াটির সঙ্গে তাল মিলিয়ে হাঁটছে আবিদ, অদ্ভুত রহস্যে ঘেরা জীবনের পথ।

বাসায় ফিরে দেখে অধমরা এক ইঁদুরের বাচ্চা। কুঁকড়ে পড়ে আছে দরজার সামনে। অসংখ্য বিষপিঁপড়ের দংশনে হাত-পা ছুড়ছে মাঝে মাঝে। বাড়ির বালক-বালিকারা দৃশ্যটি মনোযোগ সহকারে দেখছে। আবিদ হাতে এক টুকরো কাঠি নিয়ে নেড়েচেড়ে প্রাণবায়ু পরীক্ষা করতে বসে গেল। গ্রামের বাড়ি থেকে আসা প্রবীণ মহিলা বাজখাই গলায় হাঁকল – ‘দুনিয়াতে আর খেলা নাই, এখনই ওটাকে মেরে ফেলে দিবি।’বাচ্চারা যে যেটা পেল তা দিয়েই ইঁদুর-বধে উদ্যত হলো। পাশের রুম থেকে চেঁচিয়ে উঠল দীপালি – ‘এই কি হয়েছে ওখানে, এত হট্টগোল কেন? মনে হয় বাঘ-হাতি এসেছে!’

‘তাড়াতাড়ি এসো, তোমাকেই দরকার’, হাঁক ছাড়ে আবিদ। ‘তোমার পক্ষেই সম্ভব।’

দীপালি খোঁপা বাঁধতে বাঁধতে এসে হাজির। এসেই চিৎকার – ‘হায়রে আমার পুরুষ মানুষ রে!’ বলেই ঘরের কোনা থেকে ঝাড়ু হাতে নিল। দুটো বাড়ি দিতেই আধমরা ইঁদুরের জীবনের বাকি অংশ রোদের আলো পেরিয়ে আকাশের ওপারে চলে গেল। কেউ ইঁদুরের ওপারে যাওয়া দেখল না। দেখল শুধু বীরাঙ্গনা দীপালির একটি প্রাণ সংহার শেষে উঠান পেরিয়ে রান্নাঘরে যাওয়ার মাতঙ্গিনী রূপ।

এই কাজে আবিদের মনে জমে থাকা সমুদ্রের কুয়াশার মতো ক্ষোভ মাথায় ঘূর্ণি দিয়ে ওঠে। রক্তে কী এক অস্থিরতা। একটা জ¦লজ্যান্ত প্রাণী নির্দয়ভাবে মেরে ফেলছে অথচ দীপালির মধ্যে মায়াবোধ কিংবা করুণার আলোড়ন নেই। – ‘এমন হৃদয়হীন নির্মম পাশবিক নারীর আবর্তে আমার জীবন।’ মনের গহন-কোণে এসব ভাবনা লেগেই থাকে। তবু সংসার চলছে স্বাভাবিক গতিতে। দুজন ভালোবাসার বৃষ্টিতে ভিজে পথ হাঁটছে।

বিকেলে আবিদ-দীপালি বের হয় বাসা থেকে। উদ্দেশ্য নদীর পাড়ে সময় কাটাবে, সঙ্গে মাদুর, চা ফ্লাস্কে – বাসা থেকে তৈরি করে নিয়েছে। প্রায় শুকিয়ে যাওয়া নদী। ছোট্ট ডিঙি নৌকায় পার হচ্ছে তারা। শুধু তারা নয়, অনেকেই আসে অবসর কাটাতে। যাদের দেখা যাচ্ছে তারা অনেকেই পরিচিত। মেয়ে ও ছেলে মেশামেশি। অনেকের সঙ্গে ‘হাই হ্যালো হয়’। কথা না হলেও দূর থেকে অনেকের সঙ্গে ভাববিনিময় হয়। এসব দৃশ্যে দীপালির মনে অকারণে অস্থিরতার কাঁপন শুরু হয়। চোখ ঘুরিয়ে নেয় আবিদের দিক থেকে। মনস্তাত্ত্বিক জটিল ভস্মচাপা আগুনে পোড়া মন সামান্য কিছুতেই দোষত্রুটির কথা টগবগিয়ে ফুটতে থাকে। দীপালি ভেবে ছিল, আজ বিকেলে পরস্পর পরস্পরকে ভালোবাসায় ভরিয়ে তুলবে। ওর হ্যাংলামোর জন্য চোখে যেন বালি আর মনে আগুন।

আবিদ দীপালির মুখের পৃষ্ঠা ওল্টায়। পাঠ করে চিরচেনা মুখের ভাষা। এ কোনো নারী নয়। এ ভালোবাসার কোনো পুষ্প নয়। এতে রোমান্টিকভাবে কোনো প্রজাপতি এসে বসা অসম্ভব। একদম আলাদা প্রজাতির। তাকে তৈরির সময় বিধাতা মনে হয় কোনো কারণে ক্রুদ্ধ ছিলেন। ‘নারীসুলভ ভালোবাসার আবেগ থেকে আমি চিরকালই বঞ্চিত।’ ভাবে আবিদ।

পানি ধরার ছল করে মুখ ফেরালো দীপালি। অন্য আর একটি ডিঙিতে নিবিষ্ট হয়ে হৃদয়-দুয়ার খুলে হাসছে, কথার পর কথা বলছে দুজন। মনে হয় স্বামী-স্ত্রী। দেখেই বোঝা যায় যেন ভালোবাসার স্বপ্নের জলে ভাসছে। এই তো হৃৎকমলে হৃদয় বেঁধে পথ চলা। আসলে ভাগ্য লাগে। নয়তো আমার এমন হবে কেন!

বর্ষার জল সরে গেছে। কচ্ছপের পিঠের মতো নদীর বুকে জেগে উঠছে চরাভূমি। চরাভূমি জুড়ে ছোপ-ছোপ ঘাস। আর স্বমহিমায় জন্ম নেওয়া নাম-না-জানা বিচিত্র তৃণপল্ল­ব। ওরা যেন বেড়ে উঠছে জোর প্রতিযোগিতায়। শীতে শান্ত নদীর জলে খেলা করছে একঝাঁক হংসমিথুন। অদূরে ছোট এক নৌকা অর্ধেক জলে আর অর্ধেক তীরে একলা পড়ে আছে। আরো একটু বাঁয়ে গেলে কাশবন। কাশবনের হৃদয় বিদীর্ণ করে চলে গেছে এঁকেবেঁকে পায়ে চলা নির্জন-নিস্তব্ধ পথ। এই পথ পেরিয়ে কিছুটা দূরে এক ভূমিপুত্র স্বপ্নের বীজ বুনছে তার মাতৃসম ভূমিতে। সঙ্গে স্বপ্নের সঙ্গিনী প্রিয়তমা স্ত্রী ও সন্তানেরা। সমস্ত ঘাসের ঠোঁটে ঠোঁটে শিশিরের

তৃষ্ণা। তবু শিশির জমেনি তখনো। আবিদ আর দীপালি নদীর নির্জন বাঁকে মাদুর বিছিয়ে আসন পেতে বসে পড়ে। দুজনে দুজনার যত

বাক্য-বলাকা আজ উজাড় করে উড়িয়ে   দেবে আকাশে। 

দীপালি চায়ের সাজসরঞ্জাম সাজানোর কাজে ব্যস্ত। কাশবনের ফাঁক দিয়ে আবিদের চোখ পড়ে অদূরে ফসল ফলানোর আয়োজনে ব্যস্ত কৃষক পরিবারের দিকে। ভূমিপুত্র

কৃষক কবিতার পঙ্ক্তি রচনার মতো কর্ষিত ক্ষেতের সারিতে বীজ বপন করে চলেছে। বীজপাত্রে বীজ তুলে হাঁটুতে হাত রেখে বাঁকা হয়ে সঙ্গ দিচ্ছে প্রিয়তমা কৃষাণী। বাক্যালাপ নেই। কৃষিকাজের  মধ্যেই  ভালোবাসার  নিশ^াসের আদান-প্রদান। সভ্যতার সূচনাকাল তো এভাবেই রচিত হয়েছিল। সমাজ-সভ্যতার এগিয়ে চলার যে ইতিহাস, তা তো নারী-পুরুষের যূথবদ্ধ ভালোবাসা আর শ্রমের ইতিহাস। এই তো সুন্দর! দৃশ্যটি আবিদ দেখছে আর মুগ্ধ হচ্ছে।

আবিদের দিকে তাকিয়ে দীপালি ভাবছে অন্যকিছু। নিশ্চয়ই সে দেখছে বুনোফুলের মতো ফুটে থাকা কৃষাণীর শরীর-ছন্দ। ভাবছে আবিদের হ্যাংলামো গেল না। দীপালি ফ্লাস্ক থেকে চা ঢেলে নিচু স্বরে বলে – তোমার চা নাও।

আবিদের চোখ এবার আটকে গেল কৃষাণীর অন্তর্বাসহীন শরীরের দৃশ্যে। বিভোর ঘোরে চায়ে চুমুক দিতে দিতে  দীপালিকে উদ্দেশ করে বলে – ‘আজ তোমাকে অনেক সুন্দর লাগছে।’

রাইস কুকারের উত্তপ্ত শিসের মতো নিশ^াস ছেড়ে – ‘আমার দিকে তাকিয়ে বলো।’

একটা মিষ্টি হাসি দিয়ে আবিদ বলে – ‘তোমার সঙ্গে প্রকৃতিকে মেলাতে চাচ্ছি, তুমিও সুন্দর, প্রকৃতিও সুন্দর।’

‘হয়েছে, ও তো বিয়ের রাত থেকেই শুনছি। ভাঙা রেকর্ড আর কতবার বাজাবে। তাও আবার অন্যদিকে তাকিয়ে। মনে করেছো আমি কিছু বুঝি না। সারাজীবন একসঙ্গে চলছি। আমাকে মনের কোন জায়গায় রেখেছো, তা ভালোভাবেই জানি।’

‘আমি আবার তোমার কোন চুলায় ঘি ঢাললাম। কেটে গেল তো জীবনের দুই ভাগ। আর এক ভাগ বাকি। তবু বুঝলে না …।’

আবিদের কথা চলছে। দীপালি মুখ ফিরিয়ে থাকে। শান্ত নদীর তীরে দুটো সাদা বক ঘরে ফেরার আগে ঠোঁটে ঠোঁটে হৃদয় উজাড় করা ভালোবাসায় ভরিয়ে দেওয়ার আয়োজনে মেতে আছে। ঢেলে দিচ্ছে পরস্পর পরস্পরের ভালোবাসার অমিয় অমৃত। নির্জন আলতো স্পর্শের মমার্থই হয়তোবা ভালোবাসা, যা ওই বক-দুটো কোনোরকম ভাবনা ছাড়াই উপভোগ করছে। নীরব-নিষ্পলক চোখে মুগ্ধ হয়ে দেখছে দীপালি।

দূর কুয়াশায় ভর করে আকাশ মিলছে মৃত্তিকার সঙ্গে। ঘাসে ঘাসে কুয়াশার ছোঁয়া। সূর্য চলে গেছে অস্তাচলে। তবু রয়ে গেছে রাঙা রোদের আভা। একটু পরেই আপন অন্ধকারে আলো ছড়াবে কৃষ্ণপক্ষের চাঁদ। হয়তো জোনাকির ঝাঁক এসে মুখর হবে বাঁশবনের ফাঁকে ফাঁকে, সমগ্র ধরিত্রীতে রাতের রূপসজ্জার আয়োজনে।

এবার বাড়ি ফেরার পালা। ফেরার পথে পায়ে-পায়ে দুজনের মনেই এই সময়টুকুতে পাওয়া-না-পাওয়ার হিসাব। হিসাবের খাতায় যোগ হলো প্রকৃতির অপরূপ রূপময় একটি দিন। সম্পর্কের ঘরটায় রয়ে গেল সাদা। শুধু যে সাদা শূন্য তা-ও নয়। মাঝে মাঝে বেদনার ছোপ-ছোপ কালো দাগ। বৃথা সব।

নতুন অফিসার। সময়মতো অফিসে পৌঁছার তীব্র তাড়া আবিদের। নিষ্প্রাণ মুখে দীপালি। রোবটের মতো জামাকাপড় এগিয়ে দিচ্ছে। গম্ভীর মুখ দেখে কর্কশ কণ্ঠে আবিদ বলে ওঠে – ‘তোমার সমস্যাটা কোথায়? কিছু বলার থাকলে খুলে বলতে পারো।’

দীপালি কোনো উত্তর করে না। আবিদ বডি স্প্রে দিয়ে বের হয়ে পড়ে। যাওয়ার আগে দীপালিকে জড়িয়ে ধরে চুমু দিতে ভুল করে না। এমনটা শুরু থেকেই চলছে। এখন প্রথায় পরিণত হয়েছে।

দীপালি বাচ্চাদের স্কুলে রেখে আসে। বুয়া এখনো আসেনি। এই মুহূর্তে জরুরি কাজ নেই। মোবাইল হাতে ফেসবুক ওপেন করতে গিয়ে থেমে যায়। সোফায় বসে ভাবছে, জীবনের জল গড়িয়ে চলছে। রূপের দীপ্তিতে প্রায় অপরাহ্ণ। জানালার দিকে তাকাতেই চোখ পড়ে এক জোড়া চড়ুইপাখি মনের আনন্দে কামিনী গাছের ডালে কিচিরমিচির করছে। ভালোই লাগছে দেখতে, হঠাৎ ফুরুত করে উড়ে যায়।

দীপালি উঠে যায় বইয়ের আলমারিতে, গীতাঞ্জলিটা বের করে ‘আমার বেলা যে যায়’ গানটি খুঁজতেই শুকনো কিছু গোলাপের পাপড়ি চোখে পড়ে। পাপড়িগুলি শুকিয়ে মমি হয়ে আছে। তাতে হাত বোলাতেই মমির জীবন্ত জীবনের গল্প এসে হৃদয়ে আছড়ে পড়ছে সমুদ্রের ঢেউয়ের মতো। সমস্ত দেহমনে লাগে কী এক কাঁপন। রসে টইটম্বুর হয়ে যায় মন।

এই তো সেদিন বাবলা এসেছিল এই গোলাপ নিয়ে। আবিদ চাকরিসূত্রে তখন চট্টগ্রাম। সংসারে অল্প কাজ। বুয়াকে বলেছে বিকেলে আসতে। পুরো বাড়িটা তার জন্য একেবারে স্বাধীন-সার্বভৌম। বাবলাকে ফোন করতেই সাড়া দিয়েছিল। জানালা খুলে পথের পারে কৃষ্ণচূড়া গাছের তুমুল আগুনের উৎসব দেখতে ভালো লাগছিল। এমন সময় কলিংবেল বেজে উঠল। দরজা খুলতেই দেখে বাবলা যেন আকাশ থেকে নেমে এসেছে হাজারও নক্ষত্র হয়ে। ভোরের গোলাপের চেয়েও সতেজ-সপ্রাণ ছিল সে, ছিল হিউমারের ওস্তাদ। রসে রসে রসের রাজা। ওর অমন কথার ঝর্ণায় দীপালির সমস্ত শরীর বিদ্যুৎ খেলে যাচ্ছিল। টুকরো টুকরো গান, কবিতা আর কথায় একেবারে সম্মোহিত। কখন বুকের আঁচল সরে গেছে টেরও পাইনি। পকেট থেকে একটি লাল গোলাপ বের করে অর্ধোন্মোচিত স্তনের ভাঁজে গুঁজে দিয়ে বাবলা মিষ্টি করে বলেছিল, ‘গোলাপের গায়ে গোলাপ লেগে থাক।’ হাঁটুতে হাত চোখে চোখ রেখে মন্ত্রের মতো উচ্চারণ করতে লাগল, ‘শান্তি দাও দেবী, দু-দণ্ড শান্তি দাও।’ দিশেহারা দীপালি, ওর আহ্বানে সে-ও গোলাপের মতো গোলাপি হয়ে উঠল। দীপালির গ্রীবা-চিবুকে পাগলের মতো চুমু দিতে শুরু করলো বাবলা। ড্রয়িংরুম থেকে তারা চলে গেল বেডরুমে। দীপালি ভাবে, সে কী অনির্বচনীয় অনুভবের সময় ছিল! এখন সে কোথায় কে জানে? ফোনটাও বন্ধ থাকে।

এসব ভাবনায় মোবাইলটা হাতে নিয়ে আজো চেষ্টা করে পেল না। আসলে এমনই হয়। এ-জগতে কে কাকে কদিন মনে রাখে? কাজ শেষ তো সব শেষ। জীবনের পথে কতজনই এলো-গেল। আজ সব উধাও। মুক্তা, শফিক, রতন, অপু এরা সবাই স্মৃতি। শুধু স্মৃতি। দীপালিরই বা ওসব ভাবার কী প্রয়োজন? বরং জীবনের ফুল খুবই অল্প, যেটুকু আছে তাকেই নতুন করে ফুটিয়ে তুলতে হবে। এমন সময় বুয়া এসে ঘরে ঢোকে। সব ভাবনা উধাও হয়ে যায়। দাঁড়িয়ে পড়ে সংসারের কাজে।

আবিদ অফিসে পৌঁছে যথাসময়ে। হাতের কাজ ঝটপট শেষ করে ফেলে। হঠাৎ বেজে ওঠে সেলফোন। ধরেই বলে ওঠে – ‘আরে কি টেলিপ্যাথি, আমি তোমাকেই ভাবছিলাম।’

তাহমিমা কেবলই ধরা পড়েছে আবিদের প্রেমের জালে। এখন পর্যন্ত রসের সীমা কথার জাদুর মধ্যেই আছে। যোগ্য সময় ও স্থানের সন্ধান মেলেনি। মনের ফুল মনেই ফুটছে আর ঝরছে। শুধু কথার কামনানলে সেরে নিচ্ছে মনের কামানল নির্বাপণ। তাহমিমার সঙ্গে পরিচয়ের পর থেকে সন্ধ্যা, রিতু, নাদিয়ারা যেন শুষ্ক ফুলের পাপড়ি হয়ে গেছে, যা আর রূপ-গন্ধ-বর্ণ ছড়ায় না।

বেলাশেষে ক্লান্ত ভাঙা হৃদয়ে বাসায় ফিরল আবিদ। হাতে দামি পারফিউম, যা কিনেছিল তাহমিমার সঙ্গে মিট করার সময় তাকে গিফট দেওয়ার জন্য। হঠাৎ তাহমিমা প্রোগ্রাম বাতিল করায় উদ্দেশ্য সফল হয়নি। অবশেষে দীপালির হাতে তুলে দিয়ে বলে – ‘তোমাকে খুব মিস করছিলাম অফিসে বসে। আজ হবে কিন্তু।’ দীপালি পারফিউমটা হাতে নিয়ে অযত্নে রেখে দেয়। আবিদ তা দেখে আড়চোখে। আবিদ বাচ্চাদের রুমে গিয়ে বাচ্চাদের পড়াশোনার খোঁজখবর করতে থাকে।

সংসারের কাজকর্মও যথানিয়মে এগোচ্ছে। আবিদ-দীপালি বিছানায়। রাত এগারোটা। বাচ্চারা ঘুমিয়ে পড়েছে। ধীরে ধীরে নিস্তব্ধতায় জমছে রাত। ঘড়ির টিকটিক শব্দটা ক্রমেই যেন কর্কশ লাগছে। আবিদ রোমান্টিক মুডে কথা বলছে। একপর্যায়ে দীপালিকে কাছে টানে। আবিদের হাতটা সরিয়ে দিয়ে কোলবালিশটা মাঝখানে দিয়ে বিভেদ সীমানা টানে দীপালি, বিপরীত মুখ করে শুয়ে পড়ে। হোঁচট খায় আবিদের পিপাসার জল। আবিদ ভাবতে থাকে, কী এমন চেয়েছে যে, ও এত মুড দেখাচ্ছে। দীপালির এই একভাব। কী আর দিতে পারে সে? ভালোবাসা! সে তো এক অন্য জিনিস। খামোকা আমাকে প্রত্যাখ্যান করা ওর স্বভাব। একসঙ্গে আছি একসঙ্গেই বাঁচি। বাঁচার যা কিছু আয়োজন তার মধ্যে এ-কাজটা অলঙ্ঘনীয় ব্যাপার। বোঝে, অথচ ঝামেলা করবেই। আজ যদি রিতু, সন্ধ্যা কিংবা নাদিয়া তাদের কেউ আমার জীবনসঙ্গিনী হতো, আমার জীবনটা রং-রসে ভরে উঠত হয়তো।

আবেগ-উচ্ছ্বাসহীন দীপালি ভাবে, এভাবে কি কেউ কাছে ডাকে। বাবলা হাত ধরলেই শরীরে শিহরণ জাগে। মনপ্রাণ ব্যাকুল হয়ে ওঠে। তার স্পর্শেই ভালোবাসার ঢেউ ওঠে হৃদয়ে। সেসব সীমাহীন রোমাঞ্চকর অনুভব ভাবতেই ভালো লাগে। আর আবিদের নীরস উদাস আহ্বানে কোনো রোমান্স নেই। শুধু সংঘর্ষে বস্তুতে বস্তুতে অগ্নিজ্বলা। সেখানে নেই কোনো প্রাণের উল্লাস। নেই কোনো ব্যঞ্জনাময় আবেদন।

রাত তার নির্দিষ্ট গতিপথে চলতে থাকে। দুজন একই ছাদের নিচে একই বিছানায় কাছাকাছি। আসলে কি কাছাকাছি? কে জানে কত রাত এভাবে কেটেছে। দুজনই ঘুমের ভান করছে। আবিদ উঠে বাথরুমে যায়। টেবিল থেকে পানি পান করে। দীপালি চোখ বন্ধ করে ঘুমের ভান করতে থাকে। যতটা সম্ভব নিঃশব্দে কাজ করছে আবিদ, যাতে দীপালির ঘুমের কোনো ব্যাঘাত না ঘটে। একটু ঠান্ডাও পড়েছে। শোয়ার সময় কাঁথাটা দীপালির শরীরে জড়িয়ে দেয়। দীপালি কোনো নড়াচড়া করে না। কিছুক্ষণ পর দীপালি আবিদের মুখোমুখি হয়। তখন আবিদের চোখ বন্ধ। তাদের এই লেজে খেলা চলতেই থাকে। একসময় দুজনের চোখে চোখ পড়ে। ঘুমের  ভান করা কণ্ঠে দীপালি বলে – ‘এখনো ঘুমাও নাই? সকালে বাচ্চাদের স্কুল আছে।’ ‘ঘুমিয়ে ছিলাম। হঠাৎ একটা স্বপ্ন দেখে জেগে উঠলাম। তুমিও ঘুমিয়ে যাও।’ বলে আবিদ কাঁথাটা গলা পর্যন্ত জড়িয়ে নেয়। কিছুক্ষণ পর দীপালি উঠে বাথরুমে যায়। পায়চারি করে। আবার এসে শুয়ে পড়ে।

রাত তিন প্রহর। প্রথমদিকে নৈশপ্রহরীর বাঁশির শব্দ কানে এলেও এখন তা কমে এসেছে। গভীর রাত, নিঃশব্দ চারদিক। কোথা থেকে পেঁচা ডেকে ওঠে। ভেন্টিলেটরের ফাঁক গলিয়ে কৃষ্ণপক্ষের চাঁদ, জ্যোৎস্নার স্পর্শ দিচ্ছে দেহমনে। এর মধ্যে দুজন এক আত্মায় যুগলবন্দি থাকার কথা। কিন্তু তারা যে মনের দিক থেকে যোজন যোজন দূরে অবস্থান করছে। তাই বুকের শূন্যতা সন্তর্পণে ছড়িয়ে পড়ছে জীবনব্যাপী। এর অবসান নেই। আবিদ এবার আলতো করে দীপালিকে আদর করতে থাকে। দীপালি তা ঘুমের ভান করেই গ্রহণ করছে। আস্তে আস্তে ফিরতে থাকে দুজন দুজনের ভুবন থেকে এক ভুবনে। মাঝখান থেকে সরে যায় কোলবালিশ। শরীরে শরীরে জেগে ওঠে থইথই বান, উত্তাল ঢেউ। শুরু হয় জেগে ওঠা জোয়ারের জল রোমন্থ’ন। রোমন্থনে রোমন্থনে হয় অমৃতের অভিসার।

আবিদ-দীপালির এভাবেই চলছে বিশ বছর। একসঙ্গে আছে। একসঙ্গে বাঁচে। দুজন দুজনের দায় মিটিয়ে চলে। বলতে গেলে দুজনের ভাগ্যের তরীও এক ঘাটে এক রশিতে বাঁধা। সংসার নদীর এক স্রোতে বহমান। এ যেন সব শুধুই দৃশ্যপট। অদৃশ্য অন্তর্গত রূপের সঙ্গে এর কোনো মিল নেই। ভেতরে যেন এক অবিচ্ছেদ্য রূপ রচনার কোনো আভাস নেই। এত কাছাকাছি, এত মেশামেশি, এত যূথবদ্ধ জীবন, এক বৃন্তেই দুটি ফুল;  তবু এক নয়। দুজনের মনের বনে ভিন্ন ভিন্ন ফুল ফোটে, ভিন্ন ভিন্ন পাখি ডেকে যায়। এই কি সত্য? জীবনের আর কি কোনো সত্য আছে? আছে কি অন্য কোনো মানে? হয়তো আছে। হয়তো সে-অধরাই থেকে গেছে।