অনুবাদ : মহেবুব আহমদে
রাস্তার পাশের হাঁটাপথের ধারে দাঁড়ানো মানুষগুলো মুহূর্তের জন্য জমে স্তব্ধ হয়ে গেল। তারপরই একজন রাস্তায় নেমে দু-হাত তুলে চলমান যানবাহন থামতে বাধ্য করল। সবুজে হলুদে মেশানো যে-ভ্যানটি নাটকীয়ভাবে ব্রেক কষে রাস্তার পাশে সরে যাচ্ছিল তার চালকের দিকের দরজাটা খুলে গেল। একজন অ্যাম্বুলেন্স ডাকল, আরেকজন বলল, সেন্ট উইসটন স্ট্রিট। চলতে ইশারা করা হলো দাঁড়ানো সব যানবাহনকে।
রাস্তায় শোয়া মানুষটার পাশে হাঁটু মুড়ে বসল এক মহিলা, বলল, পালস নেই। তবুও একটি ওভারকোট গোল করে পেঁচিয়ে সেই ঝুলে পড়া মাথার নিচে দেওয়া হলো।
থেমে ছিল দোতলা একটি বাসও, চলতে শুরু করার পর দ্রুত ঘটে যাওয়া দৃশ্যের দিকে তাকিয়ে অপরিচিত যাত্রীরা সব পরস্পর কথা শুরু করল। অকারণ কিছু মানুষ বাঁধানো রাস্তায় জড়ো হয়ে ঘটনাটা কীভাবে ঘটল তা নিয়ে নিজেদের চিন্তার আদান-প্রদান করতে লাগল, শুনে হতাশ ভ্যানচালক তাদের যুক্তি দিয়ে কিছু বোঝাতেও চাইছিল। যারা কিছুই দেখেনি তারা ঘটনাটা জানতে চাইলে বিভিন্ন রকম উত্তর পাচ্ছিল।
একটা অ্যাম্বুলেন্স এলো : এত দ্রুত এলো যে, তা নিয়েও মন্তব্য হতে লাগল। শরীরটা নেওয়ার জন্য একটা স্ট্রেচার নামানো হলো। এক লোক সবাইকে ঠেলে ঢুকল, তাতে অন্যদের মনে হলো সে ডাক্তার। একটা পুলিশের গাড়ি ধীরে এসে অ্যাম্বুলেন্সের পেছনে দাঁড়াল। স্ট্রেচারে শোয়ানো শরীরটা কম্বল দিয়ে ঢেকে দেওয়া হলো। আস্তে বন্ধ হলো অ্যাম্বুলেন্সের দরজাগুলো। ঝরে গেছে একটি প্রাণ।
এ-ঘটনার কয়েকদিন পর সেই উইসটন স্ট্রিটের হ্যারিয়েট ব্যালফোর দরজায় টোকা শুনে খুলে দেখল পুরোহিতের পোশাকে রোগা, ন্যূব্জদেহী, অচেনা মানুষ দাঁড়িয়ে। তিনি মিসেস ব্যালফোরকেই চাইছিলেন এবং সম্ভব হলে কথা বলার অভিপ্রায় জানালেন। হ্যারিয়েট তাকে বসার ঘরে নিয়ে গেল। প্রতিদিনকার সকালের মতো সেদিনও ওর তাড়া ছিল; কিন্তু সে-কথা না বলে তাকে বসিয়ে কফি দেবে কিনা জানতে চাইল।
হ্যারিয়েট ব্যালফোর তরুণীবেলার রূপ হারিয়েছিল বটে, কিন্তু মধ্যবয়সের পরিণত শান্ত সৌন্দর্য তাকে ঠিক ততটাই বিশিষ্ট করেছিল। নিজের বয়স ও রূপসচেতন হ্যারিয়েট সাদা চুলে হালকা রঙের আভাস দিয়ে রাখত। ত্বক পরিচর্যা তার প্রাত্যহিক অভ্যাস ছিল, ত্বকের সামান্যতম ক্ষতিও ধৈর্যসহকারে সারিয়ে তুলত। রঙিন পোশাক পরত আর সব রংই মানাত ওকে। স্বভাবে বিনয়ী এবং নিজের অভিমত উপস্থাপনে ওর ইতস্তত ভঙ্গি যৌবনের ঔদ্ধত্যকে যেমন সংযত রেখেছিল, তেমনই বয়সে তা প্রশান্ত হয়ে আরো মনোগ্রাহী হলো।
ছেলেটি – একটিই সন্তান ওর – লেখাপড়া শেষ করে মায়ের সঙ্গেই ছিল, কিন্তু স্বামীর মৃত্যুর পর থেকেই হ্যারিয়েট জানত যে, এই বাড়ি, যার সঙ্গে ওর বন্ধন কেবল বেড়েই চলেছে, সে-বাড়িতে একদিন ওকে একাই থাকতে হবে। একটা ব্যর্থ সম্পর্ক থেকে উদ্ধার পেয়ে এ-বাড়িতে এসেছিল ও। এখানে যে সন্তোষ নিয়ে সন্তান ধারণ করেছিল তা অসময়ে স্বামীর মৃত্যু পর্যন্ত ছিল। এ-বাড়ির প্রতি ওর আসক্তির অনেকটাই স্বামীর স্মৃতির প্রতি অনুরাগের সঙ্গে বিজড়িত। এ-বাড়ি ছেড়ে সেও কোথাও যাবে না সে-কথা আগেই বলে দিয়েছিল, সময় যদি কোনো যন্ত্রণার সৃষ্টি করে বা অন্য কিছু নির্দেশ করে তাও মেনে নেবে না। এর ঘরে ঘরে যে অতীতকে ও জেনেছে তা কোনো অবস্থাতেই ম্লান হয়ে যাবে না, এর বাতাস-খেলা বাগানে প্রতি শরতে কমিস নাশপাতির ফুল ফোটে, বিবর্ণ ইটের দেয়াল সাজিয়ে তোলে লেসের মতো বেয়ে ওঠা হাইড্রেনজিয়া, ফোটে থোকা থোকা ভিক্টোরিয়ান গোলাপরাশি। হলঘরে জন পাইপার থাকবে সবসময়, বসার ঘরে মিনটন; ম্লান দেয়াল কাগজের হালকা বেগুনি আর সাদা ফুলের লতানো উইসটেরিয়া দেখে জেগে ওঠার বিশেষ অভ্যাস তো ওর সেই কবে থেকে।
হ্যারিয়েট আবার বিয়ে করতে পারত; কিন্তু কথাটা যতবার শুনেছে ততবারই হাস্যকর মনে হয়েছে। স্বামীর প্রতি ভালোবাসার স্মৃতি ছাড়াও ওর জীবনে ইতোমধ্যে অনেক কিছুই ছিল। ও গান শুনত, যতœ দিয়ে রান্না করত, বাগান করত আর বন্ধুদের সঙ্গে নিরবচ্ছিন্ন সম্পর্ক রাখত। ইতালির প্রথম ও মধ্য রেনেসাঁস ওর আনন্দের বিষয় ছিল, ঠিক তেমনি ফ্রান্সের ইমপ্রেশনিস্ট ছবির প্রতিও ওর আকর্ষণ ছিল। কালজয়ী উপন্যাস পড়ত ও আর সমকালীন গল্প-উপন্যাস নিজেই বেছে নিত।
‘না, না, কফি নয়’, ওর আতিথেয়তা ধন্যবাদসহ প্রত্যাখ্যান করলেন পুরোহিত। বিরক্ত করার জন্য ক্ষমা চেয়ে নিলেন এবং তার আসার উদ্দেশ্য বুঝিয়ে বললেন। ‘আপনার নাম আর ঠিকানা একজন গৃহকর্মীর কাজের তালিকায় ছিল।’ তার নামটিও বললেন।
শুনেই সম্মতি জানিয়ে হ্যারিয়েট বলল, ‘হ্যাঁ, এমিলি ভান্স এখানে আসত, এখন আর আসে না, সেও তো বেশ অনেকদিন : ন-দশ মাস হবে।’
‘এমিলি ভান্স মারা গেছে মিসেস ব্যালফোর; দুঃখজনকভাবে, রাস্তায় অ্যাকসিডেন্ট হয়েছিল।’
হ্যারিয়েট এতক্ষণ দাঁড়িয়েই ছিল, এবার বসে পড়ল, ‘হায় ঈশ্বর, কি ভয়ংকর!’ বলেই ও বিব্রত হলো কারণ এ-ভাষা পুরোহিতের শোনার যোগ্য নয়। তবে পুরোহিত বিচলিত হলেন না।
‘মিসেস ব্যালফোর, আমি আপনাকে এর মধ্যে জড়াতে চাইনি, ব্যাপারটা হয়েছে কি মেয়েটা সম্পর্কে কোনো কিছুই জানা যাচ্ছে না। ওই নাম আর সামান্য একটু।’
অ্যাক্সিডেন্টের কথা শুনে পুরোহিতের মনে হয়েছিল যে এই মেয়েটি মাঝে মাঝে তার গির্জায় যেত। বললেন, ‘প্রার্থনায় যেত না, তাই মনে হয় কেবল একা হবার জন্যই যেত।’ পুলিশকে জিজ্ঞাসা করে জেনেছিলেন, মেয়েটি এক বিদেশি দম্পতির সঙ্গে, ক্যামোনা স্ট্রিটে এক খাতাপত্রের দোকানের ওপরের ফ্ল্যাটে থাকত। ওর হাতব্যাগটা পড়ে ছিল, উঠিয়ে নিয়ে দেখা গেল ভেতরে একটা লাইব্রেরি কার্ড, তাতেই ঠিকানাটা লেখা ছিল।
‘ক্যামোনা স্ট্রিট আমার এলাকার মধ্যে পড়ে না; কিন্তু তবু ও তো আমার গির্জায়ই আসত, হয়তো একটু অন্যদিকে আর মানুষ কমই আসত তাই। আমি ওই বিদেশি দম্পতির সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছিলাম, মনে হয়েছিল আমার যাওয়া উচিত। চার বছর এমিলি ভান্স ওদের ওখানে ছিল; কিন্তু ওরা বলছিল এতটা সময়ে কেউ কখনো ওর কাছে যায়নি আর একবারের জন্যও ও টেলিফোন ব্যবহার করেনি, ওর নামে কোনো চিঠিও না, শুনে বুঝতে পারছিলাম এ সেই মেয়েটিই যে গির্জার এক ছায়াঘেরা কোণে নিভৃত আশ্রয় খুঁজে পেত।’
এবার পুরোহিত নিজের পরিচয় দিলেন, আগেই দেওয়া উচিত ছিল বলে ক্ষমা চাইলেন। নাম যে বললেন মনে হলো ম্যালফ্রে জাতীয় কিছু হবে। বয়স, হ্যারিয়েট প্রথমে যা ভেবেছিল তার চেয়ে বেশি; ওর দুঃখ হলো পুরোহিতের জন্য, একটা স্বীকৃতিবিহীন কাজ তার ওপর পড়েছিল কারণ আর কেউ ছিল না।
‘আশ্রয়?’ পুরোহিতের কথার পুনরাবৃত্তি করে বলল হ্যারিয়েট ও তখন শব্দটার অন্তর্গত অর্থটা ধরতে পারেনি।
‘আসলেই, আমার তাই মনে হয়। ক্যামোনা স্ট্রিটের দম্পতি জানতে চেয়েছিল ওর সৎকারের কাজটা আমিই করব কিনা। কিন্তু ওর পরিবার তো অবশ্যই কোথাও না কোথাও থাকবেই, আমি চেষ্টা করছি ও যেসব বাড়িতে কাজ করত তাদের কাছ থেকে জানতে পারি যদি।’
‘সে আমি বুঝেছি; কিন্তু এটুকু বলতে পারি যে, এমিলি ভান্স নিজের কথা বলার মানুষ ছিল না। ও কাজ ভালো করত, অধিকাংশের চেয়ে ভালো। মাঝে মাঝেই আমি ভাবতাম এ-কাজ তো ওর করার কথা নয়, আবার ভাবতাম কঠিন সময়ের ভেতর দিয়ে যাচ্ছে ও।’
‘হ্যাঁ, ওরকম ধারণাই ও দিত।’
‘আমাদের কাজটা ছেড়ে দিলো আর ওই শেষ। কিছু না বলেই একদিন সকালে আর এলো না।’
‘আমি দুঃখিত মিসেস ব্যালফোর, এসবই আপনাকে শুনতে হলো।’
যাজকসুলভ ভঙ্গিতে ধীরে কথাগুলো বলে গেলেন কিছুক্ষণ। সেন্ট জন গির্জার ঠিকানা দিলেন, তারপর শেষকৃত্যের দিন ও তারিখ বললেন।
‘কিন্তু ঘটনাটা কীভাবে ঘটল? অ্যাকসিডেন্ট?’ দুজনেই উঠে পড়ছে এমন সময় হ্যারিয়েট জিজ্ঞেস করল।
পুরোহিতকে নিয়ে হলঘরের ভেতর দিয়ে বেরিয়ে আসছিল হ্যারিয়েট, তখন তিনি শোনা কথাগুলো বললেন। ভ্যান ড্রাইভার – ফুল বিলি করছিল বলে মনে হয়েছিল – কর্তব্যে অবহেলার কথা অস্বীকার করেছিল। রাস্তা পার হতে যাচ্ছিল এক জুয়ার দোকানের মালিক কিন্তু সেই মুহূর্তেই লাল আলো জ্বলে ওঠে, সে-লোক তখন অন্য সবার সঙ্গে থেমে গিয়েছিল, মেয়েটি থামেনি। ভ্যানটা ট্রাফিক ফিল্টারে ছিল, সম্ভবত হঠাৎ আর খুবই দ্রুত এসে পড়েছিল। যদিও কেউ কেউ বলেছিল যে, চালকের নিশ্বাসে মদের গন্ধ ছিল কিন্তু সাধারণত সবার ধারণা তার কোনো দোষ ছিল না। ব্যাপারটা ইচ্ছাকৃত বলেই মনে হয়েছিল। জুয়ার দোকানের মালিক বলেছিল মেয়েটি লাল আলো বদলে যাওয়ার অপেক্ষাই করেনি।
‘আমি দুঃখিত মিসেস ব্যালফোর, আপনাকে কষ্ট দিলাম’; পুরোহিত ক্ষমা চাইলেন।
‘ও কিছু না, এসেছেন, ধন্যবাদ।’

হ্যারিয়েটের মনে হলো পুরোহিতের না আসাই ভালো ছিল। সেদিন সারা সকালটা অক্সফামের দোকানে বাছাইয়ের কাজ করছিল আর কথাটা ভাবছিল। সম্প্রতি আসা বইগুলো বেছে রাখার সময় Around the World in Eighty Days বইটা সরিয়ে রাখল, কোনো একসময় সেনা ও নাবিক বৃদ্ধাশ্রমের বৃদ্ধদের পড়ে শোনাবে বলে। মিস চ্যান্ট্রির বোনের স্বামীর অ্যানজাইনার মাত্র জানা খবরও শুনল। কারো কাজে লাগবে না এমনসব জুতো-কাপড়চোপড় ফেলে দেবার জন্য গুছিয়ে রাখল। এতসবের মধ্যেও পুরোহিতের চেহারার বিভিন্ন অংশ ওকে ক্রমাগত তাড়িত করতে লাগল, অথচ ওর বসার ঘরে তাঁর উপস্থিতি তো মাত্র কিছুক্ষণেরই ছিল। পুরোহিত বলেছিলেন, এমিলি ভান্স যথাসময়ে ঘরভাড়া পরিশোধ করত; আসত-যেত এত নিঃশব্দে যে খেয়াল হতো না, আর ঝামেলা তো কখনো করেইনি।
অক্সফাম থেকে বেরোনোর পরও ওর হাতে সময় ছিল, দীর্ঘপথ হেঁটে বাড়ি ফিরবে; ক্যাফে নিরোতে বসে ও কফি খেয়ে নিল। প্রায়ই ওর মনে হতো এমিলি ভান্স সাধারণ নয়, কালো চুলের বিষণœ মেয়েটির যথাযথ বর্ণনা দিয়েছিলেন পুরোহিত, ওর সহজ-স্বাভাবিকতা দিয়েই ও আকর্ষণ করত, কোমল অবয়ব জুড়েই তার প্রকাশ ছিল। এমন বিবেচনাবুদ্ধি ব্যবহার করে কাজ করত মনে হতো যেন অনেক ভাগ্যেই ওকে পাওয়া যায়। তারপরও একদিন আর এলো না, আগে-পরে কিছু জানালও না।
দুপুরের জন্য মিনিট গুণে ডিম সিদ্ধ করল, রুটি কেটে টোস্ট করল; কিন্তু সব ছাপিয়ে একটা ব্যাখ্যা খুঁজে বিভ্রান্ত হচ্ছিল হ্যারিয়েট। বুঝতে পারছিল যা মনে হচ্ছে তার একটাও ঠিক নয়। আর ধারণা করতে চাইল না কারণ ধারণা ধারণাই। কিন্তু মিস চ্যান্ট্রির কথা শুনতে শুনতে, ক্যাফে নিরোতে বসে আর এই এখন একই চিন্তা ওকে খোঁচাতে লাগল, অথচ তার উৎস আর বিষয় একটি মাত্র মুহূর্তের।
নিচে নামছিল হ্যারিয়েট। হলঘরে এমিলি ভান্স মেঝের টালি ধুয়ে পরিষ্কার করছিল। স্টিফেন পা টিপে টিপে ভেজা মেঝে পার হচ্ছিল। ওরা দৃষ্টিবিনিময় করেছিল কিনা হ্যারিয়েটের চোখে পড়েনি, কোনো শব্দও শোনেনি, কোনো ইঙ্গিতও নয়। কিন্তু এমিলি ভান্স কখনো তো তেমন হাসে না, সে নিজেকে গুছিয়ে নিয়ে একটুখানি হেসেছিল, সে হাসি যেন কোনো আনন্দমুহূর্তের স্মরণে। আর কিছুই হয়নি; কিন্তু তবু হ্যারিয়েট তখনো বিস্মিত হয়েছিল আর এখন আগের চেয়ে আরো বেশি হচ্ছে। মাত্র কয়েক সপ্তাহ পর থেকেই এমিলি ভান্স আর আসতে পারেনি।
হ্যারিয়েট তখন যেমন করেছিল এখনো তেমনই নিজেকে বোঝাতে চাইল যে, ও অবাস্তব কল্পনা করছে। স্টিফেনের স্বভাবে প্রবঞ্চনা নেই এবং নিশ্চিতই হ্যারিয়েট টেনেহিঁচড়ে বার করছিল ও-ধরনের চিন্তা। ঠিক তেমনি ওদের গোপন সম্পর্ক ছিল, কলহে শেষ হয়ে গেছে; ছেলে ওর মতো নয়, অসতর্কভাবে কিছু বলেছিল এমনও ভেবে নেওয়া ঠিক হবে না। নিজেকে সচেতনভাবে মনে করিয়ে দিলো, উদ্বেগ নিষ্ঠুর প্রতারণা করে।
তখনো সময় ছিল, তিনটে বেজেছিল মাত্র; সেনা ও নাবিক আশ্রমের বৃদ্ধদের জন্য আরেকটি অধ্যায় পড়তে শুরু করল হ্যারিয়েট। তারপরও তাদের সঙ্গে আরো কিছুক্ষণ বসল। যা শুনেছে তা নিয়ে কথা বলতে চাইল তারা বা হয়তো শুধুই কথা বলতে এবং স্মৃতিচারণ করতে চাইছিল।
তাদের স্মৃতিকথা শুনতে শুনতে আবার ওর ভেতরে সেই অস্থিরতা শুরু হলো। ভেবেছিল চলে যাবে, কিন্তু গেল না, যখন বিদায় নিচ্ছিল তাদের কাছ থেকে তখনো গেল না।
বিকেলটা সুন্দর ছিল, এপ্রিলের ম্লান সূর্যালোক দোকানের কাচের জানালা আর বাড়ির সদর থেকে ঠিকরে পড়ে ধুয়ে দিচ্ছিল পরিচর্যিত বাগানগুলো। কিন্তু যেখানে হাঁটতে সবচেয়ে ভালো লাগে – কমন – সেখানে পৌঁছবার আগেই মন বদলে তখুনি আর বাড়ি ফিরতে চাইল না এবং বিপরীতমুখী বাসের অপেক্ষায় দাঁড়াল।
কত যুগ যে পার হয়ে গেল ক্যামোনা স্ট্রিট খুঁজে পেতে; কিন্তু পেয়ে প্রথমেই চোখে পড়ল খাতাপত্রের দোকানটা। দোকানের একজন বলেছিল, পেছনের গুদামের ভেতর দিয়ে ওপরের ফ্ল্যাটে যাবার সিঁড়ি আছে। স্তূপীকৃত কাগজের প্যাকেট, ঠেসে রাখা কার্ডবোর্ডের সব বাক্স, আঠার বয়াম, চক, বলপয়েন্ট পেন, আবর্জনার বাঁধা ব্যাগ এসবের মধ্য দিয়ে যেতে ও ইতস্তত করছিল। লোকে কথা বলছে, আপনমনে বলল হ্যারিয়েট; কি আর, এতদিন যা বলেছে তাই, যা ইচ্ছে বলতে পারে মানুষ, তবে হঠাৎ ঘটে যাওয়া নাটকে হয়তো আরো কিছু যোগ করে বলছে। পুরোহিত সাবধানী মানুষ, কখনো নিশ্চিত করে বলেননি যে এমিলি ভান্স আত্মহত্যা করেছিল।
‘ওপরে যান, পাবেন’, দোকানের যে-লোকটা পেছনে আসতে বলে দিয়েছিল সে হঠাৎ সামনে এসে কার্পেটবিহীন সিঁড়িটা দেখিয়ে দিলো। মাত্র রান্না-করা খাবারের গন্ধ ভেসে আসছিল। হ্যারিয়েট মাথা নেড়ে নির্দেশমতোই ওপরে উঠে গেল।
ওরা বসল না। রোগা, ছোটখাটো, ফ্যাকাশে চেহারার লোকটি তারের মতো ঝাঁকি দিয়ে দিয়ে কেবল ঘুরতেই লাগল। মহিলাও ছোটখাটো, তার সাদায়-কালোয় মেশানো ঝাঁকড়া চুল ঘাড় অবধি নেমেছে।
মহিলা বলল, ‘এই ঘরগুলোতে ও থাকত। দুটো ঘর, মাঝখানে দরজা, বাথরুমটা ব্যবহার করত।’
হ্যারিয়েটকে ওরা টেবিলটা দেখাল। টেবিলের ওপর এমিলি ভান্সের হাতব্যাগটা অ্যাকসিডেন্টের পর লোকজন এসে খুঁজে দেখেছে। ওখানে রেখেই পুলিশ ব্যাগটা খালি করে নিয়েছিল।
‘ওসব করার কোনো দরকার ছিল না ওদের’, মহিলা বলল। লোকটি বলল, ‘ঘর খুঁজতে এসে এমিলি ভান্স বলেছিল ও ঘর পরিষ্কারের কাজ করে।’ তথ্যগুলো দিয়ে ওরা চুপ করে রইল, তখন হ্যারিয়েট বলল, ‘শুনেছেন তো লোকে বলাবলি করছে আপনাদের ভাড়াটে আত্মহত্যা করেছে। আপনাদের কি মনে হয় ওরকম কিছুই ঘটেছে সম্ভবত?’
কেউ মন্তব্য করল না, কেবল বলল, তারা জানে না, ঘটনার ওখানে ছিল না, তারা তো কিছু দেখেনি। একজনের পর আর একজন একই কথা বলে গেল। কিন্তু চলে আসার সময়টাতে দরজা খুলে দাঁড়িয়ে বলল, ‘এই যে এতদিন ও ছিল এখানে, অথচ কোনো এক সন্ধ্যায়, একবারের জন্যও ওদের সঙ্গে বসেনি।’ এমিলি ভান্সের এই অসম্পূর্ণতার কথাটা একজনের পর একজন বলে ওদের হতাশা ভাগ করে নিল।
‘রাস্তায় এরকম একটা ব্যাপার’, মহিলাটি বলল।

রান্নাঘরে হ্যারিয়েট ওপর থেকে দুটো প্লেট নামাল, পরে গরম করে নেবে, আর নীল ক্যাসারোল ডিশটাও। রান্নার জন্য যা যা দরকার সব গুছিয়ে নিল আর একটি ওয়াইন বোতল খুলে রাখল। পার্সলি পাতা কুঁচিয়ে নিল, সেলারি আর মাশরুম ধুয়ে নিল, এক কাপ চাল মেপে রাখল। গরম তেল থেকে ধোঁয়া পাকিয়ে উঠেছিল মুহূর্তের জন্য, পাতলা করে কেটে রাখা মাংসটা ওই তেলেই ভেজে নিল। মেশিনে ক্রিম ফেটে রাখল। আগেই অ্যাপ্রিকট আর কোয়িনট্যুর মিশ্রণ করে রেখেছিল।
ও ভাবছিল, যাই ঘটুক, যদিবা কিছু ঘটেও থাকে, তবে অবশ্যই তা তেমন কিছু নয়। কেবল আজকের ওপর ভিত্তি করে অন্যভাবে চিন্তা করার তো কোনো কারণ নেই। সৎকারে ওর উপস্থিতিটা পুরোহিত চেয়েছিলেন এবং ও যাবে। বেশ দীর্ঘ পথ হেঁটে এসেছিলেন, যথাসাধ্য চেষ্টা করেছিলেন কাজটা ভালোভাবে করার, তার জন্যই ও যাবে। কিন্তু তবু হ্যারিয়েটের মনে হচ্ছিল তাকে বসার ঘরে নিয়ে যাওয়া ঠিক হয়নি, হলঘর পার হয়ে এগিয়ে নেওয়া উচিত ছিল না। জেহোভার-সাক্ষীদের যেমন করা হতো পুরোহিতকেও তেমন দরজার বাইরেই রাখা উচিত ছিল। তাই যদি করতে পারত ভালো হতো।
রেডিও চালিয়ে দিলো হ্যারিয়েট, সব কাজই সময়মতো শেষ করে সময় ছিল হাতে, বসে রেডিও শুনতে লাগল। প্রোগ্রামটা শেষ হতেই হলঘর থেকে ছেলে ডেকে বলল, সে ফিরেছে।
‘কেমন গেল তোমার আজকের দিন?’ লম্বা রোগা স্টিফেনের চুলটা সাদা; ক্যাসারোলসহ দুজনের দুটো গরম প্লেট খাবার ঘরে নিয়ে গেল ও। পেছনে হ্যারিয়েটের হাতে ছিল ভাত আর ব্রোকোলি।
বলল, ‘না, তেমন কিছু না; বাজার করলাম, বৃদ্ধাশ্রমে গেলাম, তারপর সন্ধ্যায় ক্যামোনা হয়ে বাড়ি ফিরলাম।’ আর কিছুই হ্যারিয়েট উল্লেখ করল না।
‘সবার সঙ্গে কত ভালো চলতে পারো তুমি।’ মৃদুভাষী স্টিফেনের কথাটা ওর বাবার মতো শোনাল, বাবা প্রায়ই বলতেন হ্যারিয়েট ভালো মানুষ। কথাটা ওদের দুজনেরই মনে পড়ল এবং স্টিফেন তাই হাসল। আগের মতোই এবারো হ্যারিয়েট মাথা নেড়ে এ-প্রশংসার স্বীকৃতি দিলো।
‘বিকেলের এই রান্নাটা আমার ভালো লাগে’, দুজনের জন্য আরো ওয়াইন ঢালতে ঢালতে স্টিফেন বলল।
পুরোহিতের আসার কথাটা বলবে কিনা সারাদিনে কয়েকবার ভেবেছে হ্যারিয়েট। অক্সফামের দোকানে কাজ শেষ করার আগে থেকেই ভাবছিল বলবে না, পরেও আবার তাই ভেবেছে, ক্যামোনা স্ট্রিট থেকে ফিরেও তাই। ও জানত, সারাদিনের কাজের সবটা বললেই ভালো লাগে, সাধারণত তাই করে, কোনো দুঃসংবাদ পেলেও বলে। ক্যামোনা স্ট্রিটের মহিলাটি বলেছিল, ‘একটা ড্রয়ারে টাকা আছে, শেষ কাজটা এতেই হয়ে যাবে।’
কিন্তু খাবার টেবিলে ওরা অন্যান্য বিষয়ে সহজে, হালকাভাবে কথা বলতে লাগল। মা-ছেলের কথা বলা কখনো কঠিন ছিল না। একের জন্য অপরের দাবিহীন স্নেহের অভাব হয়নি। সেই জন্যই সম্পর্কটা যা হতে পারত তার চেয়ে বেশি ছিল। কোনো দায়বদ্ধতা ছিল না এবং সংবেদনশীলতা ছাড়া অন্য কোনো অনুভূতিরও স্থান ছিল না, আর তাই ঘনিষ্ঠতাও স্বাভাবিক ছিল। একটা কথা অনুচ্চারিত থাকলেও ওরা জানত যে, অবস্থাগত পরিবর্তন স্বাভাবিকভাবেই আসবে আর তখন সবই বদলে যাবে। জানত, এ-সময়টা নির্ধারিত এবং মেনে নিয়েছিল।
রান্নাঘরে দুজনে মিলে বাসনপত্র ধুয়ে নিল। স্টিফেন সকালের নাশতার জন্য টেবিল গুছিয়ে রাখল। বলল, রাতে টেলিভিশন ইত্যাদি না দেখে অ্যাকোনড্রোপ্লাসিয়ার ওপর পড়বে। ওর বাবা শিশুরোগ বিশেষজ্ঞ ছিলেন। ও নিজেও তাই হতে যাচ্ছে।
‘স্যার ফেলিক্সের কাজ ছিল এবং তার করার ইচ্ছাও ছিল – ইচ্ছা যতদূর তাকে নিয়ে যেতে পারে অতদূরই …’ – এ পর্যন্ত পড়ার পর স্যার ফেলিক্স আর তার কাজ সঙ্গে নিয়ে হ্যারিয়েট ঘুমিয়ে পড়ল, পাতাটা খোলা পড়ে রইল বালিশের ওপর। মুহূর্তখানেক পর বইটা পড়ে গিয়ে হ্যারিয়েটকে জাগিয়ে দিলো। বই যেখানে ছিল সেখানেই রইল, আলো নিভিয়ে দিলো ও।
ঘণ্টাখানেক পর স্টিফেন অ্যাকোনড্রোপ্লাসিয়া শেষ করে হাত-পা টান টান করে হাই তুলল। তারপর কাপড় বদলে বাথরুম থেকে ফিরে বিছানায় গিয়ে সঙ্গে সঙ্গে ঘুমিয়ে গেল।
এমিলি ভান্সের হাতে একসময় পরিষ্কার করা বাড়িটা তখন নিস্তব্ধ হয়ে গেল। চুপিসারে কোনো ইঁদুরেরও গতিবিধি ছিল না, ওদের জন্য রাখা খাবার বোকার মতো খেয়ে সব ইঁদুর মারা গেছে। জানালা ভাঙার চেষ্টা করবে এমন কোনো কাঁচা হাতের ডাকাতও ছিল না। বাগানের উঁচু দেয়ালের ওপরে গাঁথা ভাঙা কাঁচ উপেক্ষা করে একটা বেড়াল, কখনো এলো না। এমনকি বাগানে বা ঘরে কোথাও এমিলি ভান্সের ছায়াটুকুও ছিল না। প্রায়ই তো বাগানে ও কফি নিয়ে রোদে গিয়ে বসত। ভ্যালি লিলি প্রচুর ফুটলে তুলে নিত, নুয়ে পড়ার আগেই তুলত ড্যাফোডিল। স্বপ্নে আসেনি এমিলি ভান্স, এসেছিল ভোরের আলোর সঙ্গে গতকালের মতো জীবন্ত হয়ে, কিন্তু গতকাল যে সন্দেহ আর অস্বস্তি নিয়ে এসেছিল আজ তার উপস্থাপন হলো শান্তভাবে। হ্যারিয়েট নিজেও প্রশান্ত ছিল, আর অস্থির হলো না। আশঙ্কামুক্তমনে যথাযথভাবে ভেবে দেখতে লাগল, এমিলি ভান্স হলঘরে হাঁটু গেড়ে বসে ভেজা কাপড় দিয়ে লাল-কালো টালি ধোয়া শেষ করছে, স্টিফেন বাড়ি থেকে বেরোল, সশব্দে বন্ধ হলো সামনের দরজা। এবার হ্যারিয়েটের মনে হলো ও যা দেখেছিল সেটা অপ্রকাশিত প্রেমের সংকোচ থেকে; গোপন কিছু লুকোবার জন্য নয়। আরো ভাবছিল স্টিফেনের দেয়ালের ছবি, বিছানার পাশের টেবিলে রাখা বই, স্টিফেনের নিজের বাঁধানো বোনার্ডের নৌকোর প্রতিলিপি, পোস্টকার্ডে আন্না আখমাখোভার প্রতিকৃতি, ওর পপ সিঙ্গারের গান – সবই আনন্দের ছিল এমিলি ভান্সের জন্য। স্টিফেনের টাই আর শার্টে ও হাত বুলিয়ে দিত, বালিশ সোজা করে রাখত, ওভারকোটটা হ্যাঙ্গারে তুলে দিত। দিনে কতবার বাড়ির কোনো এক দিক থেকে ভেসে আসা স্টিফেনের গলার স্বর বা হাসিতে জাগানো শিহরণ ওর জন্য স্মরণীয় মুহূর্ত হয়ে থাকত? দিনে কতবার ওর ঠোঁটের চিহ্নহীন স্পর্শযুক্ত চায়ের কাপটা এতই মূল্যবান ছিল যে সবার শেষে ধোয়া হতো?
কল্পনাপ্রসূত এসব টুকরো ছবি হ্যারিয়েটের চেতনাজুড়ে ছিল তবে মৃত্যুর ছোঁয়া নিয়েই ছিল, কারণ মৃত্যু তো ঘটেই গিয়েছিল আর তাতেই সান্ত¡না পাচ্ছিল ও। কিছু না বলে ঠিকই করেছে, যে বোঝা স্টিফেনের বইবার নয় কেন তা ও বয়ে বেড়াবে। আবার ও ঘুমিয়ে পড়ল, আগের চেয়ে গভীরতর হলো এবারের ঘুম এবং সকাল সাতটায় ঘুম ভাঙল।
হ্যারিয়েট বাগানে হাঁটছিল, বাতাস তখন ঠান্ডা। (প্রথম সকালের শহুরে কোলাহল চাপা শব্দে কানে আসছিল। এক বৃন্তে দুটি ফুলের শেষ নারসিসিটা তুলে রান্নাঘরে গেল ও। মৃতের সৎকার হবে। ওখানেই শেষ হয়ে যাবে এ-কাহিনি।

একজন অর্গানবাদক বাখের একটি কম্পোজিশন বাজিয়ে থেমে গেল। যে পুরোহিত হ্যারিয়েটকে মৃত্যুর খবর দিয়েছিলেন তিনি সেকেলে ধাঁচের কিছু কথা বললেন, তবে কথাগুলো সুন্দর আর ও জানত, এই কারণেই তারা এই বিশেষ পদের জন্য যোগ্য বিবেচিত হন।
হ্যারিয়েটের উপস্থিতি পুরোহিত আশা করেছিলেন কেবল সেই জন্যই নয়, ও নিজেও আসতেই চেয়েছিল। গির্জায় আরো দুজন মহিলা ছিল, তারা আলাদাই এসেছিল। এদেরও সন্দেহ নেই ওর মতো করেই খুঁজে পাওয়া। ক্যামোনা স্ট্রিটের দম্পতিও ছিল।
‘তোমার দৃষ্টিতে হাজার বছর যেন একটি দিন … যে-মুহূর্তে তুমি তাদের ছড়িয়ে দাও তারা যেন নিদ্রামগ্ন থাকে : আর হঠাৎ ঘাসের মতো হারিয়ে যায়।’
সুন্দর শব্দাবলি, কিন্তু কোথায় তাদের অবস্থান! পুরোহিত ওর বাড়িতে এসেছিলেন এক সপ্তাহ হয়েছে অথচ এই এতটা সময় যুক্ত হয়েও কোনো অবদান রাখেনি। যে-জীবনটা ছিল তাতেও না, যে-মৃত্যুটা ঘটেছে তাতেও না এবং এই স্থানটিতে যে আত্মাকে বিযুক্ত করে নিয়ে সম্মান জানানো হয় তা থেকেও কোনো সত্যের শুরু নেই।
‘সকালে সবুজ থাকে এবং বৃদ্ধি পায় : কিন্তু সন্ধ্যায় কেটে ফেলা হয়, শুকিয়ে যায়, প্রাণশক্তি হারায়, ফুরিয়ে যায় আমাদের দিন, আমাদের সময় আমরা শেষ করে আনি ঠিক পুনরাবৃত্ত গল্পের মতো।’
প্রতিধ্বনিত হচ্ছিল গলার স্বর, শেষে নামটা উল্লেখ করা হলো। গির্জায় ঢোকার সময় হ্যারিয়েটকে ফিসফিসিয়ে জিজ্ঞেস করা হয়েছিল এমিলি ছাড়া আর কোনো প্রদত্ত নাম ওর জানা ছিল কিনা, কিন্তু ও কেবল এমিলি নামটাই জানত আর তাই একটিই বলা হলো।
‘জীবনের মধ্যেই মৃত্যুর সঙ্গে আমাদের বসবাস। প্রভু, তুমিই জানো আমাদের অন্তরের সব গোপন কথা …’
কোনো স্তবগান হলো না। কোনো প্রশংসা উক্তিও নয়। সৎকারের কাজ শেষ হওয়ার পর সমাধিক্ষেত্রে পৌঁছে দেওয়ার জন্য কফিন ওখানেই ছিল।
বিব্রতকর বিরতির সময় বৃদ্ধ পুরোহিত একে একে সবাইকে তাদের উপস্থিতির জন্য ধন্যবাদ জানালেন। ‘আমার সঙ্গে একটু চা খাবেন আপনারা।’ নিমন্ত্রণটা তেমন আন্তরিকতা নিয়ে করলেন না অবশ্য।
যে দুজন মহিলা আলাদা এসেছিল তারা চায়ের জন্য থাকবে না বলে ক্ষমা চেয়ে নিয়ে একে একে মৃদুস্বরে দুজনেই আত্মার উদ্দেশে নিবেদিত কাজটির প্রশংসা করল। দ্রুত চলে গেল ক্যামোনা স্ট্রিটের দম্পতি। গির্জার এক কর্মচারী পা টেনে টেনে একগুচ্ছ ফুল নিয়ে এলো।
‘খুবই ছোট্ট হলো’, পুরোহিত বললেন। তার নাম গির্জার সামনের একটা বোর্ডে, কালোর ওপর সোনালি অক্ষরে লেখা ছিল। The reverend C.R. Malfrey । ‘খুবই সামান্য, একেবারে সারশূন্য ‘না, না, মোটেই তা নয়,’ হ্যারিয়েট তাকে আশ্বস্ত করে বলল। ‘ওর পরিবারকে যদি পেতাম ভালো হতো!’
হ্যারিয়েটকে নিয়ে তিনি ধীরে ধীরে সমাধিক্ষেত্রের দিকে যেতে লাগলেন। তাকে দেখে হ্যারিয়েটের মনে হলো তার স্ত্রী-বিয়োগ হয়েছে, ‘ওই ধরনের চিহ্ন ছিল, একটা দীনহীন যাজক এলাকায় যথাসম্ভব ভালোভাবে চালিয়ে নিচ্ছিলেন একাই।
‘কিছু বই রেখে গেছে মেয়েটি’, তিনি বললেন। ওর কাপড়-চোপড় আগেই দান করে দেওয়া হয়েছে, কিন্তু বইগুলো তো আছে। বলেছি আমি নিয়ে নেব, আমাদের এখানে প্রতি শরতে পুরোনো বই বিক্রি করা হয়।’
হ্যারিয়েট বুঝেছিল কফিনটা গির্জা থেকে সরিয়ে নেবার সময় পুরোহিত ওকে নিয়ে এগোচ্ছিলেন সমাধিক্ষেত্রের দিকে। ওর চোখের সামনে ওই দৃশ্যটা … না। ওরা যে পথে হাঁটছিল সেখানে কারো গলার স্বর ভেসে এলো না। কি জানি কি গাড়ি, আস্তে বন্ধ হলো তার একটি দরজা, তারপর আরো একটি।

সুন্দর গ্রীষ্ম সে-বছর, উষ্ণও ছিল। সেপ্টেম্বরের শুরুটাও ভালোই কেটেছিল, পরে স্যাঁতসেঁতে হয়ে উঠল, আর অক্টোবরে তো শীতই পড়ে গেল। নভেম্বরের শেষদিকে স্টিফেনের জন্মদিনে হ্যারিয়েট পার্টি দিলো; অতিথিরা যেতে যেতে অনেক রাত হলো, তারপর সেই গভীর রাতে, পরদিনের প্রথম প্রহর শুরু হয়ে গেছে তখন, হ্যারিয়েট আর স্টিফেন একশর বেশি অতিথির অগোছালো করা ঘর – সব গুছিয়ে তুলতে শুরু করল। কাজ করতে করতে অতিথিদের কথা বলছিল ওরা, তাদের অধিকাংশই স্টিফেনের সমসাময়িক। রান্নাঘরে হ্যারিয়েট ছুরি-কাঁটাচামচ আর গ্লাস ধুয়ে ওঠাল আর সেসব মুছে সরিয়ে রাখল স্টিফেন। পরে আবার ওরা বসার ঘরে গেল; কুশনগুলো পিটিয়ে সোজা করে রাখল আর আগে যা লক্ষ করেনি এবার তাই চোখে পড়ছিল। ‘এমিলি ভান্সকে মনে আছে তোমার? ঘর পরিষ্কার করতে আসত…’
এমিলি ভান্সের সৎকারের পর যে-কটা মাস পেরিয়ে গেছে ওর কথা মনে পড়েনি এমন দিন প্রায় যায়নি হ্যারিয়েটের। সেই যে ওকে নিয়ে সমাধিক্ষেত্রে চলেছেন পুরোহিত, বৃষ্টির প্রথম ফোঁটাগুলো সমাধিফলকে পড়তে শুরু করল! পুরোহিত তেমন কিছু করতে পারেননি, বলেছিলেন, কথাটা তার সবসময়ই মনে থাকবে। ওদের দুজনের চোখের আড়ালে অচেনা মেয়েটিকে গির্জা থেকে সরিয়ে নেওয়া হয়েছিল। ওই গির্জায় একটু শান্তির খোঁজে ও যেত। তখন হ্যারিয়েটের মনে হয়েছিল তারও কিছু করা হয়নি।
বসার ঘরের আগুন অনেক আগেই নিভে গিয়েছিল, তবু হ্যারিয়েট চুলোর আবরণটা যথাস্থানে রেখে দিলো। ওদের শুয়ে পড়া উচিত, তখন রাতের বেশি বাকি ছিল না।
‘তুমি বাইরে গেলে এমিলি ভান্স আর আমি, দুজনে তো একাই থেকেছি’; স্টিফেন বলল।
দ- ভাঙা অবস্থায় একটা গ্লাস পড়ে ছিল, হ্যারিয়েট দেখছিল ওখানে কার্পেটটা ভেজা কিনা, হাত দিয়ে বুঝতে চেষ্টা করছিল স্টিফেন, পরিষ্কার না করলে কার্পেটে দাগ পড়ে যাবে, ভেজা না পেয়ে বলল, ‘গ্লাসটা নিশ্চয়ই খালি ছিল।’
‘আবহাওয়া ভালো থাকলে কফি নিয়ে ও বাগানে বসত, তুমিই অনুমতি দিয়েছিলে, কৃতজ্ঞ বোধ করত ও। মাঝে মাঝে আমার কফিটা নিয়ে আমিও বসতাম। নিঃসঙ্গ একটা মানুষ।’
রান্নাঘরে গিয়ে সিঙ্কের নিচে রাখা ময়লার বালতিতে ভাঙা গ্লাসটা ফেলে দিলো স্টিফেন। খালি বোতলে সিঙ্কের পাশের জায়গাটা ভরে গিয়েছিল। চেয়ারের পিঠটা জুড়ে রাখা ছিল কার যেন এক নীল কার্ডিগান।
‘ফুলের নাম জানে না ও, একটা ফুলেরও না’, স্টিফেন বলল। ‘আমরা বাগানটা ঘুরে হাঁটতাম, ও জিজ্ঞেস করত, আমি বলতাম।’
সিঙ্কের চারদিকটা গরম পানি ছড়িয়ে পাশগুলো ব্রাশ করে পরিষ্কার করে ফেলল। হ্যারিয়েট বলল, ‘একরাতে যথেষ্টই করা হলো।’ হলঘরে একটা স্কার্ফও কে যেন ফেলে গেছে, আগে চোখে পড়েনি; টেলিফোনটা হুক থেকে পড়ে গিয়েছিল, স্টিফেন জায়গামতো বসিয়ে দিলো।
‘এমিলি ভান্স মারা গেছে’, সিঁড়িতে কথাটা বলল হ্যারিয়েট, কারণ তখন বলতেই হতো। ‘তোমাকে আগেই বলা উচিত ছিল, আমি দুঃখিত।’
মাথা নাড়ল স্টিফেন। জানতে চাইল কীভাবে কী হলো, শুনে চমকে গেল না, বিস্মিত হলো না। বলল, ‘আমার সঙ্গে কিছু কিছু কথা বলত, এমিলি ভান্স কিন্তু সহজে কারো সঙ্গে কথা বলতে পারত না।’
‘ও তোমাকে ভালোবাসত।’
নিজের শোবার ঘরের দরজা খুলে আলো জ্বালালো স্টিফেন। ঘরটা সবসময়ই একরকম থাকে। সবই ওর যতেœ বাছাই করা; কিছু সরায় না, কিছু যোগও করে না। হ্যারিয়েট জানত স্টিফেন ওই রকমই, স্টিফেন জানত না।
খোলা দরজার সামনে ওর সঙ্গে দাঁড়িয়েছিল হ্যারিয়েট; ওর কথাটা মেনে নিল না স্টিফেন। আবেগশূন্য ওর গলার স্বর; যেন ইতোমধ্যেই ও হাসপাতালের কনসালট্যান্ট। ভয়ে পালিয়ে গেল একটি শিশু। বাবা প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল। মাও নীরব প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল। তবু শক্তির খোঁজে আত্মগোপন করে শিশুটি পালিয়ে গেল, আর কখনো সে ফিরে আসে না, আর কখনো পাওয়া যায় না তাকে।
‘বাগানে বসে বলেছিল ও, তোমার ঘরের কাজ করত, ওই রকম সাধারণ মানুষের মতোই সাধারণভাবে কথাগুলো বলেছিল।’
‘আমি আশাবাদী, ও শুনত আমার কথা; কিন্তু এ সবই যে চিরকালের মতো শেষ হয়ে গেল। আমরা ভালোবাসার কথা বলতাম। ও হাসত একটু একটু, ওর নম্র, বিষণœ এক হাসি। কিছু বলত না, তবু বলা হয়েই যেত, নিস্তব্ধ বাড়িটাতে ভালোবাসতে চেষ্টা করেও পারত না, আশা করার চেষ্টা করত, কিন্তু ব্যর্থ হতো সে-চেষ্টা। বাগানে আমরা একসঙ্গে হাঁটতাম, চুপচাপ, আর তারপর ও চলে যেত।’

নিজের শোবার ঘরে জানালার কাছে বসল হ্যারিয়েট – জানালাটা দিয়ে বাগান দেখা যায় – ওর মনে হলো না জানাই ভালো ছিল। মনে হলো যে ভয় ওর ছিল তা বরং হলেই ভালো হতো, সাধারণ এবং না বোঝার কিছু নয়।
শেষরাতটুকু যেন চেপে বসে, কুয়াশাচ্ছন্ন আলোয় রং আর আকার স্পষ্ট হয় না, চোখে আসে না নাশপাতি গাছের ফুল, টিউলিপের রাজসিক ভঙ্গিমা আর একিলেজিয়া তো এখনো ফোটেনি। সূর্য কিরণে সিনোথাস জাগবে, বাগানের কোণের লাইলাকও, সঙ্গে দেয়াল-ফুল আর ডোরোনিকাম।
বাগানে নয়, চোখের সামনে তিনটি ছায়া নড়ে, তার একটি শিশু। বাড়িতে ঘরগুলি সব স্বস্তির জন্য সাজানো, লোক-দেখানো কিছু ছিল না, বইয়ের কেসে বই, হলঘরে টেলিফোন, খাবার রান্না হয়, সর্বত্র পরিচ্ছন্নতা আর আছে হৃদয়ের উষ্ণতা। ‘রাগ করে কি হয়?’ শোবার ঘরের দরজা বন্ধ করতে করতে বলেছিল স্টিফেন; এইমাত্র মুখোমুখি হলো যে বেদনার তাতে শেষ পর্যন্ত পরাজিত হয়েছে ওর পেশাদারি ভঙ্গি। শৈশব থেকে মৃত্যু অবধি একটা জীবনে বেঁচে থাকার মতো কিছু ছিল না।
হঠাৎ চোখে এলো সময়ের আগে ফোটা পিত্তনির রক্তাভা, হলুদ ঔজ্জ্বল্যে ঝলমলে ব্রুম ফুলগুলো, গোলাপি ক্লেমেটিস, গুচ্ছ গুচ্ছ রোজমেরি। একটি শোফিঞ্জ ডালে বসে অপেক্ষায় ছিল। এদিক-ওদিক তাকাচ্ছিল একটি ব্ল্যাকবার্ড।
কাঁদতে লাগল হ্যারিয়েট। বাগানজুড়ে ক্রমাগত ছড়িয়েপড়া রূপরাশি চোখের জলে অস্পষ্ট হয়ে এলো, এঁকেবেঁকে হারিয়ে যেতে লাগল। তবু তাকিয়েই রইল হ্যারিয়েট, আবার ফিরে এলো সেই অতুল রূপ, আবার ঝলমল করে উঠল বাগান, ফিরে এলো আগের চেয়ে উজ্জ্বলতর হয়ে। কিন্তু যে-পৃথিবীতে সবই ভুল, এই সকাল মনে হলো যেন এক ছলনা মাত্র।

লেখক-পরিচিতি
১৯২৮ সালে আয়ারল্যান্ডে উইলিয়াম ট্রেভরের জন্ম। তিনি ডাবলিনের ট্রিনিটি কলেজে অধ্যয়ন করেন। বেশকিছু উপন্যাস তিনি লিখেছেন এবং প্রচুর তাঁর ছোটগল্পসম্ভার। উইলিয়াম ট্রেভর বেশকিছু পুরস্কার লাভ করেছেন। এই সুদক্ষ সংবেদনশীল লেখক অপূর্ব নির্মাণকৌশলে উপস্থাপন করেন তাঁর বিষয়। তাঁর রচনা পড়া শেষে বহুক্ষণ পর্যন্ত আমাদের মননকে আলোড়িত করে। ২০১৬ সালে তাঁর মৃত্যু হয়। এখানে উইলিয়াম ট্রেভরের Last Stories গল্পসংগ্রহের ‘ÔAn Unknown GirlÕ গল্পটি ‘অপরিচিতা’ নামে অনূদিত হয়েছে।

টীকা
১. কমিস নাশপাতি : নাশপাতি বা Pear বিভিন্ন প্রজাতির আছে। এক জাতীয় নাশপাতির নাম কমিস।
২. জন পাইপার (John Piper): একজন বিখ্যাত আমেরিকান ধর্মতত্ত্ববিদ। জন্ম ১৯৪৬-এ। তিনি বেথলেহেম কলেজে চ্যান্সেলর এবং মিনিয়াপোলিস কলেজের পুরোহিত প্রশিক্ষক। মিনিয়াপোলিস ব্যাপ্টিস্ট চার্চে তিনি যাজক ও প্রচারক হিসেবে ৩৩ বছর কাজ করেছেন। তাঁর রচিত বহু ধর্মতত্ত্ববিষয়ক গ্রন্থ আছে।
৩. মিনটন (Minton) : ১৭৯৩ সাল থেকে স্ট্যাটফোর্ডশায়ারে অবস্থিত এই সিরামিক কারখানা ইউরোপে বিশেষত ভিক্টোরীয় যুগে প্রধানতম ছিল। মিনটন সিরামিক ডিজাইনের পথপ্রদর্শক। এদের কাজে বহু যুগ, বহুকাল, বহুজাতিক মিশ্রণ ঘটেছে। গৃহসজ্জার উপকরণ ইত্যাদি ছাড়াও টালি প্রস্তুতকারক হিসেবেও এরা বিখ্যাত ছিল। পার্লামেন্ট হাউজ এবং আমেরিকার ক্যাপিটল ভবনের স্থাপত্যগুণ-সংবলিত সিরামিক এদেরই তৈরি।
৪. কোয়িনট্যু বা (Cointoue) : ফ্রান্সে প্রস্তত ব্র্যান্ডি, বিয়ার সহযোগে কমলাগন্ধি এক ধরনের পানীয়; এটি রুচি বৃদ্ধি করে ও হজমে সাহায্য করে।
৫. অ্যাকোনড্রোপ্লাসিয়া (Achondroplasia) : সে-বিষয়টিতে অস্থির অসম বৃদ্ধিতে মানবশরীরের স্বাভাবিকতা লোপ পাওয়া এবং বামনাকৃতির মানুষ হওয়া সম্পর্কে ঘোষণা থাকে তাকেই বলা হয়।
৬. জেহোভার-সাক্ষী বা (JehavaÕs Witess) : জেহোভা, ওল্ড টেস্টামেটে উল্লিখিত ঈশ্বরের এক নাম। এক ধর্মীয় সম্প্রদায়ের সদস্যকে জেহোভার সাক্ষী বলা হয়। এরা বিশ্বাস করে, পৃথিবীর শেষদিন খুবই নিকটে এবং সেদিন এই সম্প্রদায়ের সদস্য ছাড়া আর সকলেই ধ্বংস হয়ে যাবে।