আক্কাস নিবাড়ন। নিবাড়ন অর্থ বাড়ন নেই যার। সোজা বাংলায় আক্কাস বামন। ফরিদপুরের বিল এলাকায় জোলা মুসলমান আর নমঃশূদ্রদের গ্রামে বামনকে নিবাড়নই বলে। আক্কাসরা চারপুরুষ ধরেই নিবাড়ন আর চারপুরুষ ধরেই সুদের ব্যবসা তাদের। আর সেই সুদের ব্যবসার টাকায় আক্কাসরা গত চারপুরুষ ধরে কিনে ফেলছে গ্রামকে গ্রাম জুড়ে যত ধানী-জমি, বিল, পুকুর কি মাঠ… সবই আক্কাসদের গর্ভে চলে যায় বটে। আক্কাসরা অবশ্য এ-তল্লাটের আদি বাসিন্দা নয়। চারপুরুষ আগে আক্কাসের দাদার যে-দাদা, অদ্ভুত চেহারার গুড়গুড়িয়ে হাঁটা এক বামন, পরনে তার আঁকা ছবি কী যাত্রাদলে দেখা পাঠান মোগল বাদশাদের মতো কারুকাজ করা, কিন্তু এইটুকুনি, এইটুকুনি আকারের জরিবুটির কাজ করা মখমলের ময়লা সালোয়ার-কামিজ আর মাথার টুপি দেখে জোলা আর নমঃশূদ্র চাষারা হেসেছিল খুব।
‘কি পালা (নাটক) – নিবাড়নে মোগল বাদশার নাহান জামা গায়ে দিছে -’ টেকেরহাট, জলিরপাড়, সাতপাড়, শিবচর, ফুলবাড়ি, মহিষমারী থেকে শুরু করে ওধারে শরিয়তপুর মহকুমার গায়ে লাগানো গ্রামগুলোর মানুষেরা তাজ্জব মানে। তারা বিলের জোলা, বিলের নমঃশূদ্দুর। বিলের হেলেঞ্চা আর নাইল (শাপলা) তুলে, টাইটকিনি, খইলসা কী কই মাছ মেরে, কাপড় বুনে, জাল সারিয়ে কী জমি চষে ভালোই খেয়ে-পরে দিন চলে যায় তাদের। জেল্লাদার তেলচকচক কালো রঙে নাভির নিচে গিঁট দিয়ে একটি লুঙ্গি কী ধুতি আর মেয়েমানুষদের ব্লাউজ ছাড়া একটি শাড়ি – এই-ই কি যথেষ্ট নয়? তা দ্যাখো অমন মখমলের সালোয়ার-কামিজ পরেছে নিবাড়ন আর তার বউও অুিধারা নিবাড়ন এবং তার পরনেও অমন সালোয়ার-কামিজ আর হাতের তালুর সমান একটা ওড়না।
‘কেমুন পা-লা – নিবাড়নের বউও ঠ্যাকে যাত্রার বেগমদের মতো জামাকাপড় পরছে – দুইটা বাচ্চাও আছে সাথে! ক্যামন গুড়গুড়ায় হাঁটে -’
যে-সময়ের কথা বলা হচ্ছে সে-সময় বিল-এলাকার জোলা কী নমঃশূদ্দুর সবারই স্বাস্থ্য ছিল ভালো, মাথায় মেয়ে কী পুরুষ সবাই ছিল গাছ কী আকাশ-সমান উঁচু, খাওয়া-পরার তেমন কষ্ট এদিকে নাকি কারো ছিল না – নিবাড়ন তারা এই প্রথম দেখেছে। না-থুক্কু, বছর তিনেক আগে দ্য আসাম বেঙ্গল সার্কাস যখন টেকেরহাটে এসেছিল, হাতির পিঠে চড়া এক নিবাড়নের খেলা তারা দেখেছে। সেই নিবাড়ন অবশ্য পরেছিল সাহেবদের মতো শার্ট-প্যান্ট আর সার্কাসের ম্যানেজারও ছিল এক গোরা ইংরাজ। তবে, সেই নিবাড়নের বউ ছিল না। মেয়ে নিবাড়ন এই প্রথম তারা দেখেছে।
‘এহানে কোনো নিবাড়ন ছিল না – কোনো কানা-খোঁড়া, লুলা বোবা কেউ ছিল না – এহানে কী আসে না আসে – কী থাহে না থাহে – কবে কেরা?’
দেখা গেল নিবাড়নের হাতে পয়সা আছে বেশ। নিবাড়নের নাম আলী শেখ। তার দেশ নাকি কলকাতা ছাড়িয়ে বর্ধমানের কোথাও।
‘তোমরা ত’ সব বিলের জোলা – বর্ধমানে মুসলমান বলতে চার জাত। সৈয়দ, শেখ, মোগল আর পাঠান। আমি জাতের মুসলমান, বুঝেছ?’
তল্লাটের মানুষ কেউই অবশ্য জানতে পেল না আলী শেখ আর তার বউ যে বর্ধমান নিউ লক্ষ্মী সার্কাসে স্বামী-স্ত্রীর পালায় অভিনয় করে দর্শক হাসিয়ে মোটামুটি দু-পয়সা আয় করেছে। আর কেমন করেই বা আচানক ক্রোধে অথবা দীর্ঘ সুযুক্তির হিসেবেই গেল শুক্লপক্ষের রাতে আলী শেখ মইয়ের উপর থেকে মদ্যপানরত সার্কাসের গোরা ম্যানেজার হান্টিংটন সাহেবের ঘাড়ের ওপর অকস্মাৎ লাফিয়ে পড়ে ছুরি দিয়ে গলায় চার-পাঁচটা পোঁচ দিয়ে খুন করে, বিশ হাজার রুপি, বউ আর দুটো বাচ্চাকে নিয়ে ধরা পড়ার আগেই, সবার চোখে ধুলো দিয়ে এক পক্ষকাল পালিয়ে পালিয়ে চলে এসেছে এই পাণ্ডব-বিবর্জিত বিল এলাকায়, যেখানে কিছু নিকষ কালো দৈত্যের মতো লম্বা ও স্বাস্থ্যবান চাষা নর-নারী ছাড়া কেউ বাস করে না। আলী মিঞা দ্রুতই সুদের ব্যবসা শুরু করে।
‘সব কেমন য্যানো। আলী মিঞাও তল্লাটে আ’লো (আসলো) আর আমাগের অভাবেরও জানি শুরু হলো। বউ-ঝিদের নাকের ফুল, একটা-দুটা রুপার মল কী কাঁচের চুড়ি পর্যন্ত যাতি শুরু করল আলীর বউ জরিনা নিবাড়নের বাক্সে। তখন সোনার গয়নাগাঁটি আমাগের যেমন বেশি ছিল না আবার অভাবও ত’ তেমন ছিল না। কিন্তু আলীও আ’লো ত’ সুদও আ’লো, নিবাড়ন আ’লো, বর্ধমান না কোথার শহুইরা কথা আ’লো, মেয়েলোকের কেরদানি জামা-কাপড় আ’লো আর আলীর মৃত্যুর দুই পুরুষের মাথায় জাপানি বোমা আ’লো – গোরা সৈন্য সত্যি সত্যিই আ’লো – বন্দুক নিয়া তারা তাড়ায় ফিরল আমাগের বউ বিটিগো -’ আক্কাস নিবাড়নের প্রসঙ্গ এলেই তার দাদার দাদা আলী নিবাড়নকে নিয়ে এভাবেই তল্লাটের মানুষজন গল্পটা শুরু করে বটে।
আলী নিবাড়নের বড় ছেলে আকবর নিবাড়ন। আকবরের ছেলে আব্বাস আর আব্বাসের ছেলে আক্কাস – চারপুরুষ ধরেই নিবাড়ন তারা আর বংশে ছেলে-সন্তান খুব কম জন্মায়। যেমন আলীর একটাই ছেলে ছিল আকবর আর এক মেয়ে মর্জিনা নিবাড়ন, আকবর যুবক-বয়সে বর্ধমান গিয়ে তার এক নিবাড়ন খালাতো বোন লুৎফুন্নেসাকে বিয়ে করে আনে আর লুৎফুন্নেসার গর্ভে একটাই ছেলে আব্বাস (আর একটা ছেলে হয়েছিল তবে সে এমন লম্বা যে লোকে ধারণা করে – ধারণা করে কী মানে নিশ্চিতই বলা যায় সে আকবর-লুৎফুন্নেসার সন্তান হতেই পারে না – আকবরের কামলা খলিলের মতো অবিকল চেহারার বালকটি মাথায় ধাঁই ধাঁই বড় হয়ে উঠতে শুরু করলে একদিন খলিল আর সেই বালক কোথায় যে উধাও হয়ে যায় কেউ জানে না) আর দুই নিবাড়ন-মেয়ে ফাতেমা ও খাদিজা যাদের বিয়ে দেওয়া সম্ভব হয়নি আর পুতুলের বাক্সের মতো ছোট-ছোট দুটো তাদের কবর আজো নিবাড়ন-বাড়ির পুকুরের পাশে সূর্যের আলোয় ঘুমায়, আকবরের দুটো ছেলের (দুটোই নিবাড়ন) বড়টি ছোটবেলায় মরে গিয়ে বেঁচে ছিল। একা আব্বাস নিবাড়ন আর তার চার বোন (আব্বাস চার বোন নাজমা-রাহেলা-আসমা-আরিফার দায়িত্ব না নিয়ে তাদের মাদারীপুর মহকুমা শহরে ভিক্ষায় নামিয়ে দিয়েছিল আর মরেছে তারা ভিক্ষুক হিসেবেই, শুধু আসমার দেহে বীজ বুনে দিয়ে যেতে পারে কোন ঠেলাঅলা যেহেতু আসমার মুখটুকু নাকি ছিল গোলাপের মতোই তবে বামনের চেহারায় আর গোলাপই কী কলমিলতাই বা কী আর সেই ভিক্ষুক বামন মা আর তার সন্তানের সম্পর্কে আর কিছুই কেউ জানে না) আর আব্বাসের একটাই ছেলে আক্কাস। শোনা যায়, বউ দ্বিতীয়বার পোয়াতি হতে সে নিজেই বউয়ের গর্ভনাশ করেছে।
‘এত ট্যাহা দিয়াও একটা নাম্বা (লম্বা) বউ কিনতে পারলাম না আইজ তিনপুরুষে, তল্লাটের কোনো লোক মাইয়া দেলো না – না খাইয়া থাকপে তবু নাম্বা মাইয়া দেবে না, নাম্বা ছল (ছেলে) দেবে না সম্বন্ধ হরতে – দাদি প্যাটে বুনছে অন্য নাম্বা পুরুষের বীজ – শালা রান্ডি কোথাকার, বংশের মেয়েগুলার বিয়া দিতে পারি নাই, কলঙ্ক সব মাদারীপুর টাউনে ভিক্ষা করতে ছাইড়া আসছি, তিনপুরুষ ধইরা বউগুলাও সব নিবাড়ন – আর ছলপল (ছেলেমেয়ে) দিয়া কাম নাই,’ বাবার মুখে এই স্বগতোক্তি আক্কাস নিবাড়ন যখন শোনে তখন তার বয়স ছয়, আক্কাস নিবাড়ন কী বুঝেছিল কে জানে তবে নিবাড়ন বংশের চারপুরুষের ইতিহাসে সে-ই প্রথম লম্বা মেয়ে বিয়ে করতে সমর্থ হয়।
হ্যাঁ, লম্বা মেয়ে। যে সে লম্বা মেয়ে নয়। মেমসাহেবদের মতো লম্বা, মেমসাহেবদের মতো ধলা আর মেমসাহেবদের মতো নীল চক্ষু, সোনাবন্ন চুল। বিশ্বাস হয়? হয় না, না? সে আর এক গল্প। সেকেন্ ওয়ার্ল্ড অরের গল্প। এই যে টেকেরহাটের পশ্চিমে বিল দেখিছ, সেই বিল সেই ১৯৪০ সালে সমুদ্দুরের সমান। বিলের উত্তর পার্শ্বে খনন করে মাওলানা আকরম খান চৌধুরী (আব্বাস নিবাড়নের চেয়েও যার টাকা অনেক অনেক বেশি, রইস আদমি আর সুদের ব্যবসা করে না, কলকাতায় চাকরি করে) এক সংযোগ খাল তৈরি করেছে কুমার নদ আর মধুমতী নদীর সাথে – তা’ এক গোরা সৈন্য ভরা মার্কিনি হেলিকপ্টার আছড়ায় পড়ল বিলে। গোরা সৈন্যের লাশে ভরে উঠল বিল। ভয়ে কেউ মাছ খায় না কদিন। তা জোলা আর নমঃশূদ্দুরদের ভেতর তখনো ত পড়ালেখা কেউ তেমন জানে না। দুমাইল দূরে গোরা সৈন্যদের ক্যাম্প আছে বটে, তা সেখানে সাহস করে যায় কে? কে তাদের খবর দ্যায় যে, দ্যাখো কিছু গোরা সৈন্য মারা গেছে, তোমরা কিছু করবা নাকি তোমাদের ধর্মমতে? এ ওরে ঠ্যালে, ও এরে ঠ্যালে, শেষমেশ কেউই ভয়ে যায় না। সপ্তাহ তিনেক পরে যখন স্বাভাবিক হয়ে আসে সবকিছু, বউ-ঝিরা আবার বিলে যায় জল আনতে কী øান করতে, মানুষজন আবার মাছ খাওয়া শুরু করে, এক সন্ধ্যায় চৌদ্দজন গোরা মার্কিনি সৈন্যের এক ট্রাক এসে নামে। তাদের প্রত্যেকের হাতে রাইফেল। প্রথম রাতটা তারা টর্চ-হারিকেন-হ্যাজাক হাতে বিলের পাড়ঘেঁষে কী কী খোঁজাখুঁজি করে আর তাঁবু খাটায়। দ্বিতীয় দিন সকাল নাগাদ স্থানীয় মাঝি আর জেলেদের সাহায্যে বিলে তারা নৌকা করে ঘোরাঘুরি করে এবং জাল ফ্যালে। মানুষের লাশ আর পায় না তবে প্লেনের ভাঙা কিছু টুকরা তারা উদ্ধার করে। দুপুরে তাঁবুতে তাদের সঙ্গে আসা বাবুর্চি তাদের জন্য রান্না করে এবং তারা খাওয়া-দাওয়া করে। পড়ন্ত বিকেলে ধরা পড়ে তাদের আসল রূপ। রাইফেল কাঁধে প্রতিটি জোলা আর নমঃশূদ্দুরের বাড়িতে হামলা করে তারা, চৌদ্দটি মোটে পুরুষ তিন গ্রামের অন্তত চৌষট্টিটি শক্ত-সমর্থ পুরুষকে তাড়িয়ে নিয়ে বেড়ায় এবং তিন গ্রামের সব যুবতীকে (বিবাহিতা-অবিবাহিতা নির্বিশেষে) বের করে এনে বাছাইয়ের মাধ্যমে – বেশি না, চৌদ্দটি মাত্র মেয়েকেই (নয়জন জোলা মুসলমান মেয়ে যেহেতু জোলাদের সংখ্যা বেশি, আর পাঁচটা নমঃশূদ্দুর হিন্দু মেয়ে – চৌদ্দজনের চারজন বিবাহিতা আর দশজনই অবিয়াতো মেয়ে – এক সৈন্য-অনুপাতে একজন করে তল্লাটের ভেতরেই তাঁবুতে নিয়ে যায়। বেশি না, সপ্তাহখানেক দিন-রাত মেয়ে নিয়ে বেদম ফুর্তি করে তাঁবু-টাবু গুটিয়ে চলে যায় তারা। চলে যায় গোরা সৈন্যের দল। এখন এই চৌদ্দটা মেয়েকে কে ঘরে তুলবে? আমিন জোলা শুধু তার দ্বিতীয় পক্ষের স্ত্রীকে তওবা পড়িয়ে ফের ঘরে তোলে। বাকি তেরো জনকে আব্বাস নিবাড়নই প্রত্যেক মেয়ের বাবা বা স্বামীর কাছ থেকে সেই আমলের দশটি করে টাকা নিয়ে মাদারীপুর টাউনহল করপোরেশনের উল্টোদিকের খানকিপাড়ায় রেখে আসে।
‘আমাগের এ-তল্লাটে না চাইতেই হেলেঞ্চালতা থোক থোক জন্মে, তয় ধরো তোমার কলমিলতা, কলাই কি নাইল – আহা শ্যাখ মজিবরের প্রিয় নাইল, ওই টুঙ্গিপাড়ায় যার বাড়ি – তা বাদে ধরো পাটের ক্ষেত তোমার সমানে উঁচুই হওয়া নাগিছে। সাদা কথায় আবাদ ফলন ভালো আমাগের এলাকায় – ছেমড়িরা কি তার বাইরে কিছু? না, ওই তেরোজনা অভাগী ছেমড়ির নয়জনই কিছুকাল বাদে একটা একটা সাদা সন্তান প্রসব করল – বোঝা গেল? স-ব মার্কিনি কী ইংরাজের সন্তান, বুঝলা?’
নয়টি সন্তানের পাঁচটিই মেয়ে আর চারটি ছেলে। কালের নিয়মে খানকিপাড়ার কন্যাশিশুরা যেমন হয় খানকি আর ছেলেশিশুদের হতে হয় বেশ্যার দালাল – গোরা সৈন্যদের রেখে যাওয়া পুত্র-কন্যাদেরও তা-ই হতে হলো। তাঁবুতে সেই চৌদ্দজন গোরা সৈন্যের প্রধান, ক্যাপ্টেন স্টিভ যার নাম, মোসাম্মাৎ আকাশীতুন্নেসার গর্ভে জন্ম দিয়েছিল যে-কন্যা সন্তানের আর ষোড়শী আকাশীতুন্নেসা যার বিয়ে ঠিক হয়েছিল মাদারীপুর মহকুমা কোর্টের মুহুরি মোহাম্মদ আফসারউদ্দিন প্রামাণিকের সাথে যে-কিনা ক্যাপ্টেন স্টিভের মতো রূপবান পুরুষ তার পরবর্তী উনত্রিশ বছরের বেশ্যাজীবনে দ্যাখেনি এবং প্রথম আক্রমণের ত্রাসিত মৃত্যুক্ষণ কেটে গেলে স্টিভকে যার এমনকি ভালো লেগেছিল এবং সে যাত্রাপালার রবার্ট ক্লাইভের সঙ্গে স্টিভের মিল খুঁজে পায় – মেয়ের একটি ইসলামি নাম শরিফুন্নেছার পাশাপাশি তার পক্ষে যতখানি সম্ভব একটি অ্যাংলো-স্যাক্সন নামও সে মেয়ের রেখেছিল – রোজি। রোজি তার পিতা পেনসিলভেনিয়ার যুবক স্টিভ অ্যান্ডারসনের মতোই দীর্ঘকায় ও স্বর্ণকেশী, আবার মুখে আকাশীতুন্নেসার ঢলোঢলো গ্রাম্য লাবণ্য মিলেমিশে অচিরেই তল্লাটের শ্রেষ্ঠ ও সবচেয়ে দামি বেশ্যার পরিচিতি অর্জন করে। পৃথিবীর বড় সাম্রাজ্যগুলোর মতো খানকিপাড়াগুলোরও যদি লিখিত ইতিহাস থাকত তবে নিঃসন্দেহে বলা যায়, ১৯৪০-এর ডিসেম্বর থেকে ১৯৬২ পর্যন্ত মাদারীপুর টাউনহল করপোরেশন পতিতাপল্লীর একচ্ছত্র রানি যদি হয়ে থাকে আকাশীতুন্নেছা তবে ১৯৫৫ সালে পনেরো বছর বয়সে মায়ের পেশায় যোগ দিয়ে ১৯৬২ সাল থেকে ১৯৭৪ সাল পর্যন্ত রাজত্ব করেছে শরীফুন্নেসা অথবা ম্যাডাম রোজি। ১৯৫৬ সালে ভূমিষ্ঠা শরীফুন্নেসার কন্যা আকিমন্নেসা বা রিনি চৌদ্দ বছর বয়সে রজঃস্বলা হলে পাঁজি-পুঁথি দেখে তার প্রথম বউনির তারিখ যখন ঠিক করা হলো চৌদ্দই জ্যৈষ্ঠ, ১৩৭৭ বাংলা সন, ১৩৯১ হিজরি ও ১৯৭০ ইংরেজি সাল এবং বউনির আগে কোনো কলাগাছের সাথে বিয়ের সুরা পড়া হবে যেন বিয়ের পরেই (হোক কলাগাছের সাথে) মেয়ের প্রথম কোনো পুরুষের সাথে বউনি হয়, প্রথম বউনির আগের বিকেলে ছেচল্লিশ বছর বয়স্কা আকাশীতুন্নেসা গোধূলির কনে-দেখা আলোয় ক্যাপ্টেন স্টিভের সাদাকালো বিবর্ণ একটি ফটোগ্রাফের দিকে ভ্রƒ কুঁচকে চেয়ে থাকলে ছোটবেলায় বিলে নাইলতোলার সঙ্গিনী, গোরা সৈন্যের তাঁবুতে একসাথে থাকা এবং বেশ্যালয়েও গত উনত্রিশ বছর একসঙ্গে কাটানো বান্ধবী সরলা রাণী আকাশীতুন্নেসার কাঁধে হাত রাখে।
‘ভাগ্য কইরা আসছিলি আকাশী – মাইয়ার কামাই খাচ্ছিস। নাতনির কামাইও খাবি। আমার দ্যাখ ছল, তা ছল এই খানকিপাড়াতেই ভেড়ু হইয়া আছে, দালাল হইয়া আছে, -’
‘আমি ভাবি অন্য কথা – এই শুয়ারখোরের জাইতের হাতে পইড়া জীবনডা কী হইল – তোর বিয়া ঠিক হইছে অঘ্রান মাসে আর আমার আশ্বিনে – আল্লাহ্ – বংশ ধইরা খানকি হইয়া গেলাম – মায়ে-মেয়ে-নাতিনে মিলা – রিনিরও ঘর হবে না আল্লা – ছল জন্ম দিয়াই বরং ভালো। জারজ হউক বেজাতেরতা হউক তবু ত পুত্রসন্তান -’
এহেন সব কথার ফাঁকে সরলা রাণীর ছেলে রতন দালাল ঘরে ঢোকে। রতন দালালের বয়স তিরিশের কাছাকাছি। পিতা মাইকেল হার্ডিংয়ের মতোই লম্বা তবে ঈষৎ কুঁজো শরীর। চুলগুলো তার পিতার মতোই সাদা, ভ্রƒ-ও সাদা। চোখেমুখে অসংখ্য ফ্রিকলস। পরনে সাদা ধুতির ওপর একটি নীল চেক শার্ট।
‘আমাগের রিনি ভাগ্নির পয়লা বউনির জন্য অনেক লোক হইছে। সবচেয়ে বেশি দর যে ডাক পাড়বে হেই পাবে – তারপরও আপনাগের যদি কোনো পছন্দ-অপছন্দ থাকে – হাস (হাসি) আসে, এক নিবাড়ন বেডা আইছে। লোকে কয় তার নাকি সুদের ব্যবসা, পয়সা আছে ম্যালা!’
আক্কাস নিবাড়নকে দেখে ভ্রƒ কুঁচকায় আকাশীতুন্নেসা।
‘আমি মাইয়ার নানি। কিন্তু তুমি ক্যান আইছ নিবাড়ন? নিবাড়নের হাতে বউনি হবে না – এককথা আমার!’
নিবাড়ন হাসে।
‘আমি বউনি করতে আসি নাই।’
‘তয় ক্যান আইছ? ভাঁড়ের খেল দেখাইতে আইছ?’
‘না, নানিজান, তা-ও না।’ বলে নিবাড়ন হাসে। হাতের বিড়িতে টান দিয়ে সে বলে, ‘মায়ে-মেয়েতে মিলা ত দুই পুরুষ না কী কয় বেশ্যা হইছেন। অজাত গোরা সৈন্যের বীজে নাতিনের চোখ সবুজ, লাল চুল, নাম্বা শরীর আর ধলা রঙের গৌরব করেন। যত সুন্দরীই হউক, তারে কেউ বিয়া হরবে? হরবে না, হরবে না – তয় আমি হরব – হ, হরব। ট্যাকাও দেবো। চাইর হাজার ট্যাকা – রাজি?’
এভাবেই হিড়িকের (একাত্তরের যুদ্ধের) আগের বছর জ্যৈষ্ঠ মাসে আক্কাস নিবাড়ন নিবাড়ন-বংশের প্রথম স্বাভাবিক অর্থাৎ দীর্ঘ উচ্চতার বধূকে বিয়ে করে নিয়ে আসে। এমন সুন্দরী বউ তল্লাটের মানুষ অনেকদিন দ্যাখেনি। আর লম্বা বলে লম্বা। মাদারীপুর টাউনহল করপোরেশনের প্রথম শ্রেণির নোটারি ম্যাজিস্ট্রেট একটি হালকা দীর্ঘশ্বাস-সহযোগে পতিতাপল্লীর সদস্যা ও সদস্যাদের সন্তান-তালিকা থেকে একটি নাম কেটে দ্যান।
নেম : আকিমুন্নেছা এলায়াস রিনি, এজ : ফোরটিন, সেক্স : ফিমেল, হাইট : ফাইভ ফিট সেভেন অ্যান্ড হাফ, কমপ্লেক্সন : হোয়াইট। কালার অব আইজ : গ্রিন, কালার অব হেয়ার : রেডিশ ব্রাউন, আইডেন্টিফাইং মার্কস : মৌল অন দ্য আপার লিপ্ ।
আক্কাস নিবাড়ন বউ ঘরে নিয়ে আসার পরদিন প্রথম সকালেই তল্লাটের মানুষের ঘুম ভেঙে গেল প্রচণ্ড চিৎকারে। চিৎকারটা নিবাড়ন-বাড়ি থেকেই আসছে বটে। ব্যাপার তেমন কিছু না আবার কিছুও। নিবাড়ন-বাড়ির উঠানে একটি মইয়ের ওপর হাতে বেতের কঞ্চি নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে আক্কাস নিবাড়ন আর মই শক্ত করে চেপে ধরে দাঁড়িয়ে আছে ঘোমটা টানা তালগাছের মতো ঢ্যাঙা লম্বা বউটা। আক্কাস সপাৎ সপাৎ কঞ্চির বাড়ি মারছে বউয়ের পিঠে আর বউ থেকে থেকে আর্তচিৎকার করে উঠছে। চিৎকার
করছে তবে পালিয়ে যাচ্ছে না। উলটা হাত দিয়ে মইটা ধরে রেখেছে।
মানুষজন বিস্ময়ে এমনিতেই নাস্তানাবুদ অবস্থা! প্রথমত, বামনের এত লম্বা আর রাজকন্যার মতো সুন্দরী বউ তারা এর আগে দ্যাখেনি। দ্বিতীয়ত, সেই বামন আবার এত সুন্দরী বউকে বিয়ের পরের প্রথম সকালেই পিটাচ্ছে মইয়ে চড়ে আর তৃতীয়ত, সেই মই হাতে ধরে রেখেছে কিনা বউ খোদ নিজেই।
‘আক্কাস কি হরো? আক্কাস – নতুন বউরে কেউ পিডায়?’
আক্কাস জবাব করে না। উঠানভর্তি মানুষের সামনে ঝাড়া একটি ঘণ্টা খুব ধৈর্য ধরে নিষ্ঠার সঙ্গে বউ পিটিয়ে কঞ্চিটা উঠানের এককোণে ছুড়ে ফ্যালে। ঘামে ভেজা মুখ গামছায় মুছে টিনের জগ থেকে এক গ্লাস পানি ঢেলে খায়। তারপর উপস্থিত চিত্রার্পিত জনতার সামনে হাত নেড়ে বয়ান করে, ‘যদিও পয়লা বউনির আগেই বিয়া হরছি – এই দ্যাহেন রক্তমাখা চাদর – বউ আমার কুমারীই – এইটুকু বলে ঘরের ভেতর থেকে রক্তমাখা চাদর নিয়ে এসে বিজয়গর্বে সম্মিলিত জনতাকে সে দ্যাখায়, ‘তবু ত বেশ্যার মাইয়া। কবরে না যাওয়া থন পিটানের ওপর রাখতে হইব, বোঝছেন? প্রেত্যেকদিন নিয়ম কইরা সকালে অ্যাক ঘণ্টা পিটাইতে হইব, কী কন আপনারা? নইলে অর কত বড় উবগার আমি হরলাম – বেশ্যার মাইয়ারে বিয়া হইরা সংসার দেলাম – এই উবগার শুদু সোহাগ হরলে ও টেরডা পাবেনানে -।’
সেই থেকেই চলছে। সন্তানপ্রসবের মাসগুলো ও প্রসবের পরেও আরো একটি মাস ব্যতীত ঝড়-ঝঞ্ঝা, শীত কী গ্রীষ্ম প্রতি সকালে আক্কাস নিবাড়ন মইয়ের উপর উঠে ঘণ্টাখানেক বউকে পিটাবেই পিটাবে। এর কোনো ব্যত্যয় নেই। আর দৃশ্যটা গত এগারো বছর ধরে দেখলেও এর মজা যেন ফুরায় না। পাঁচজন মানুষ হলেও দৃশ্যটা দেখতে আসবেই। এর ভেতর আক্কাসের তিন ছেলে দুই মেয়ে হয়েছে। বড় ছেলের বয়স দশ, মেজটির আট, সেজটি ছয় আর পরের দুটোর পাঁচ ও একবছর বয়স। দুর্ভাগ্যের বিষয় হলো, পাঁচটা ছেলে-মেয়েই সম্ভবত বাপের মতোই নিবাড়ন হতে যাচ্ছে। মায়ের ধাত একজনও পায়নি। গেল এগারো বছরে আক্কাসের প্রায় চল্লিশ বিঘা জায়গা-জমি প্রতিবেশীদের অনেকের সাথে মামলা লড়ে কোর্টে ইনজাংশনের নিষেধের মুখোমুখি পড়েছে। সেটাও বড় সমস্যা হতো না। কিন্তু গত চারপুরুষ ধরে এ-তল্লাটের দক্ষিণে বিল বরাবর এক হাজার পাখি (একশ বিঘা) জমি যেটা তারা বাড়াতে পেরেছে, গেল দশ বছরে বিল সম্পূর্ণ শুকিয়ে আসায় সরকারের রোডস অ্যান্ড হাইওয়ে ডিপার্টমেন্ট সেই জমিটি তাদের সম্প্রসারিত জনপথ ও সড়ক প্রকল্পের আওতায় অধিগ্রহণ করেছে। আক্কাসের জমির ওপর দিয়ে বাস চলবে আর দু-তিন বছরের মাথায়। আপিলের জন্য প্রতি মাসে এখন ঢাকায় দুবার দৌড়াচ্ছে আক্কাস। উকিলের পেছনে টাকা ঢেলে সর্বস্বান্ত হওয়ার দশা! সুদের ব্যবসাতেও মন দিতে পারছে না এইসব ঝুট-ঝামেলায়। তারপর বাচ্চাগুলা সব পয়দা হচ্ছে কিনা তারই মতো নিবাড়ন! এই জন্য কি বেশ্যার মেয়ে ঘরে এনেছিল সে? আক্কাসের ঘরে অভাবের হাঁ-দাঁত ঢুকতে এল বলে। এমন অবস্থায় দাপিয়ে-কাঁপিয়ে, হাহাকার করা ছাড়া আক্কাসের উপায় থাকে না কোনো। বউকে চড় মারে সে, আঁচড়ায় মাতালের মতো, কখনো কখনো ঘেন্নাভরে সোহাগ করে, ‘এইফির (এবার) তোর প্যাটে ছল কী মাইয়া যে আসপেআনে তারে আর বাঁচায় থোব না। ঘেন্না ধইরা গ্যাছে নিবাড়নের জীবনে। খুন করপ নতুন বাচ্চাডা – খোদার কসম!’
বউ কিছু বলে না। ফিরে চৈত্র মাস এসেছে। মাদারীপুরে খানকিপাড়ার পেছনটার আমগাছে নতুন বোল ধরেছে। আরো পরে যখন কাঁচা আম আসবে, তখন রওশন নানির নাতি আরিফ আর সরলা দিদিমার নাতি সত্য মিলে তাকে আম পেড়ে দেবে। ওরা দুজন পাল্লা দেবে। কে বেশি আম পেড়ে রিনিকে দিতে পারে? মায়েদের বাবুদের দিয়ে যাওয়া পয়সা দিয়ে ঘুড়ি আর লজেন্স কেনার ফাঁকে ওরা দুজন লুকিয়ে রিনির জন্য চুড়ি আনবে না? ফিতা আনবে না? ‘রিনিরে, আমরা নাকি সব গোরা সৈন্যের জারুয়া নাতি, হের জন্য আমাগের চেহারা কী ফাইন!’ আরিফ আর সত্যর চোখ-চুলও রিনির মতো কটা, সাদাটে মুখে আর হাতে লাল লাল ফুটকি। নিবাড়ন বৈশাখের পনেরো তারিখে ঢাকা যাবে কোর্টের মামলায় আর নূরজাহান ধাই বলেছে বৈশাখের দ্বিতীয় সপ্তাহেই তার এই চতুর্থ সন্তান ভূমিষ্ঠ হবে। নিবাড়ন না থাকার সময়ে বাচ্চাটা যদি তার হয়, সে লুকিয়ে বাচ্চাটাকে অন্য কোথাও দিয়ে দিতে পারে। নূরজাহান ধাই আরো বলেছে পাশের গ্রামের মাওলানা আকরাম খান চৌধুরী না কার জানি নাতবউ, বাঁজা মেয়েমানুষ, এখন সন্তান পালতে চাইছে।
‘যদি জানে নিবাড়নের বাচ্চা? কোনোদিন বাড়বে না?’
‘চুপচুপ – তোর অত দিয়া কাম কী? একডা বাচ্চার জইন্য চল্লিশ হাজার টাকা দেবে। এহান বাদে (এছাড়া) নিবাড়নরে লুকানোরও কিছু নাই। তারও ত অবস্থা পড়ছে, টাকা-পয়সার টানাটানি! বরং একডার পর একডা এই নিবাড়ন না পাইলা লুকায়-চুরায় বাচ্চা দিয়া দে!’
‘লোকে যদি ঠিক পায় (জানে)?’
‘ঠিক পাবে না! চৌধুরীর নাতবউ বোঝবে তুই নাম্বা-চৌড়া সুন্দরী মাইয়ামানুষ – তোর জামাই যে নিবাড়ন তা বোঝবে না। আমার উপর ছাইড়া দে। দুইদিনের জন্য দ্যাশে আইছে। বাচ্চা লইয়াই ঢাকা যাইয়া উড়াজাহাজে স্বামী-স্ত্রী বৈদ্যাশ যাইবো। তাগোও লোকলজ্জা আছে। বাঁজা মাইয়ালোক আর আটকুঁইড়া পুরুষ বুঝি জনে জনে জানান দেবো যে পরের বাচ্চা তারা লইয়া যাইতেছে পালতে?’
‘বিডিরা (মহিলারা) যদি আঁতুড়ে আইসা দ্যাখতে চায়!’
‘ঢঙের কথা! আইজ দশ-এগারো বচ্ছর ধইরা বিয়াচ্ছোস, কার অত সাধ আর দ্যাখতে আইব? পয়লাবার পোয়াতি ত না। আর আমি আঁতুড় দিয়া বাইর হইয়া কবআনে (বলব) কী হঠাৎ রক্ত পইড়া আর কি য্যান চোট খাইছিস তুই, স-ব শ্যাষ। তয় নিবাড়নরে জানায় কাজ করবি – লুকানোর কিছু নাই। নিবাড়ন অমত হরব না – দশ হাজার আমার কমিশন!’
নিবাড়ন সব শোনে। শুনে অমত করে না। এই অভিশপ্ত বংশে কোনোদিন আর কোনো সুস্থ স্বাভাবিক শিশু জন্ম নেবে না। তার চেয়ে এই দুঃসময়ে ত্রিশ হাজার টাকা কম নয়।
দুই
ফারিয়া নিগার খান চৌধুরী জিতে নিলেন মর্নিং ডিউ লিপজেল মিস বাংলাদেশ-২০০৪ শিরোপা!
বিনোদন প্রতিবেদক। গতরাতে রাজধানীর অভিজাত হোটেল শেরাটন উইন্টার গার্ডেনে এক মনোরম উৎসবমুখর পরিবেশে অনুষ্ঠিত হলো ‘মর্নিং ডিউ লিপজেল মিস বাংলাদেশ-২০০৪’ প্রতিযোগিতা। ইস্ট-ওয়েস্ট প্রাইভেট ইউনিভার্সিটির বিজনেস ম্যানেজমেন্ট বিভাগের তৃতীয় বর্ষের ছাত্রী তেইশ বছর বয়সী ফারিয়া নিগার খান চৌধুরী কৃতিত্বের সাথে অর্জন করেন এ-বিজয় মুকুট। সবুজাভ চোখ, হালকা বাদামি আভাযুক্ত কালো চুল, পাঁচ ফুট সাত ইঞ্চি লম্বা ও আকর্ষণীয় দেহবল্লরীর অধিকারিণী ফারিয়ার রূপে যেন প্রাচ্য ও পাশ্চাত্য-সৌন্দর্যের মেলবন্ধন ঘটেছে। প্রতিযোগিতায় যথাক্রমে প্রথম ও দ্বিতীয় রানারআপ হন মেপললিফ ইন্টারন্যাশনাল স্কুলের এ-লেভেল ক্লাসের ছাত্রী অষ্টাদশী সাগুফতা ইয়াসমীন জুঁই ও নর্থ অ্যান্ড সাউথ প্রাইভেট ইউনিভার্সিটির বিংশতি বর্ষীয়া ছাত্রী এমিলি তাসনুভা। বিজয়ীদের অভিনন্দন জানান মর্নিং ডিউ বিউটি কসমেটিকস অ্যান্ড টয়লেট্রিজ লিমিটেড কোম্পানির নির্বাহী পরিচালক এ. কে. এম আদনান খাস্তগীর। মিস বাংলাদেশ ২০০৪-কে সুন্দরীর মুকুট পরিয়ে দেন গতবারের সুন্দরী নায়লা ফারজানা শম্পা। বিজয়ীদের নাম ঘোষণা করেন দৈনিক প্রতিদিনের খবর পত্রিকার সম্পাদক ও বিশিষ্ট সাংবাদিক আবু রায়হান। জুরিবোর্ডের সদস্য ছিলেন যথাক্রমে বিশিষ্ট টেলিভিশন অভিনেত্রী ঝুম্পা হাসান, ক্রিকেট তারকা শাহরিয়ার এস. এ. সালাউদ্দিন, লাকি ফার্মাসিউটিক্যালসের স্বত্বাধিকারী রব্বানী গোলাম জোয়ার্দ্দার ও ক্রেজি ফ্যাশন হাউজের পোশাক ডিজাইনার শহীদ আকবর। অনুষ্ঠানে সংগীত পরিবেশন করেন এই প্রজন্মের জনপ্রিয় পপ ধারার সংগীতশিল্পী নওরীন ও ব্যান্ড সংগীতদল শাইনিং পাথ। দেশের নাট্যাঙ্গন ও চলচ্চিত্রাঙ্গনের জনপ্রিয় প্রায় সকল তারকাই উপস্থিত হয়েছিলেন মনমাতানো সাজে ও আধুনিক, রুচিশীল পোশাকে। শাইনিং পাথের পপ ও ফোকলোর মিশ্রিত গান ‘মোর কমলা হাঁইটা যায় বাদামতলা দিয়া’ গানের সাথে পুরো অডিয়েন্স মেতে ওঠে নাচে। অনুষ্ঠানটি উপস্থাপনা করেন বেসরকারি টিভি চ্যানেল ওয়াইয়ের জনপ্রিয় দুই সংবাদ পাঠক ও পাঠিকা সারোয়ার বিপ্লব ও নাসরীন নয়না।
প্রতিযোগিতাশেষে বিজয়ীর অনুভূতি জানতে চাওয়া হলে এবারের মিস বাংলাদেশ ফারিয়া মধুর হেসে জানালেন, ‘এ-অনুভূতি অনির্বচনীয়। ভাষায় প্রকাশ করতে পারছি না।’ প্রকৌশলী বাবা শমসের খান চৌধুরী ও বিশিষ্ট সমাজসেবিকা মা দিলারা চৌধুরীর একমাত্র কন্যা ফারিয়ার শৈশব কেটেছে লিবিয়ায় ও আগাগোড়া পড়াশোনা করেছেন ইংরেজি মাধ্যমে। বাংলার থেকে ইংরেজি কথোপকথনেই বেশি সচ্ছন্দ তিনি। আগামী জুনে ম্যানিলায় অনুষ্ঠিতব্য মিস ইউনিভার্স প্রতিযোগিতায় বাংলাদেশের পক্ষে প্রতিনিধিত্ব করতে যাচ্ছেন ফারিয়া। ইতোমধ্যে মর্নিং ডিউ কসমেটিকস অ্যান্ড টয়লেট্রিজ কোম্পানির সাথে একটি লিপজেলের এবং ওয়াটার ফল শ্যাম্পু কোম্পানির সাথে একটি শ্যাম্পুর অ্যাড করার জন্য চুক্তিবদ্ধ হয়েছেন তিনি। ‘আমার মূল আগ্রহ অবশ্য একজন অভিনেত্রী হিসেবে নিজেকে তুলে ধরা,’ কথাচ্ছলে সাংবাদিকদের জানালেন তিনি। তবে, অভিনয় ও মডেলিংয়ের পাশাপাশি আপাতত পড়াশোনাটাও চালিয়ে যেতে চাচ্ছেন। নিজেকে একজন সফল অভিনেত্রী ও মডেল তারকা হিসেবে গড়ে তোলার মাধ্যমে দেশ ও সমাজের স্বার্থে জনকল্যাণমূলক কাজে অবদান রাখতে পারবেন বলে তিনি মনে করেন। বৈশাখ অডিও ভিস্যুয়াল প্রোডাকশন্স হাউজের ব্যানারে নির্মিতব্য ‘আমাদের হাসি-কান্না’ নামক একটি প্যাকেজ নাটক ও ঝড় প্রোডাকশন্স হাউজের ব্যানারে নির্মিতব্য চৌদ্দ পর্বের ধারাবাহিক নাটক ‘নগরের মেলা’য় তিনি দুটো প্রধান চরিত্রে অভিনয়ের সুযোগ পেয়েছেন বলেও জানালেন।
অনুষ্ঠানশেষে র্যাফেল কুপন ড্র অনুষ্ঠিত হয়। প্রথম, দ্বিতীয় ও তৃতীয় পুরস্কার বিজয়ীরা পান যথাক্রমে একটি মারুতি মোটরগাড়ি (লটারি নং-০১৩৭৪৮৬৩), একটি বিশ ইঞ্চি সনি রঙিন টেলিভিশন (লটারি নং-০১৩৭৪৮৫১) ও একটি সিঙ্গার ফ্রিজ (লটারি নং-০১৩৭৪৮৫৮)।
তিন
ধানমন্ডি সাতে ইদানীং যে-প্লাজাগুলো গড়ে উঠছে আসলেই বেশ সুন্দর। গত কদিনের টানা শ্যুটিং, ক্লাসের একগাদা টিউটোরিয়াল আর তিন-চারটা স্টেজ ক্যাটওয়াক প্রোগ্রামের পর ভয়ংকর হাঁপিয়ে উঠেছিল ফারিয়া। আজ তাই সে আদিব আর সামি দুজনকেই বলেছে, আর কোথাও না এসে দুপুর বারোটা নাগাদ যেন এই সুগন্ধা প্লাজার থার্ডফ্লোরে পিজা অর্কিডে আসে ওরা দুজন। এর থেকে দামি কী ফ্যাশনেবল রেস্তোরাঁর অভাব ঢাকায় নেই নিশ্চিত। কিন্তু, তাদের তিনজনের আড্ডার কেমিস্ট্রি এর থেকে ভালো কোথাও জমে না। লিফটে তিনতলায় উঠতেই দেখা গেল ওরা দুজনেই দাঁড়িয়ে আছে। কিন্তু, ক্যাফের কাচের দরজার পাল্লা ধরে টানতেই ওমা চটপট স্যালুট দিল একটি বামন। এম্মা, সকালটাই নষ্ট হয়ে যাবে দেখি আজ!
‘এই বামনটাকে রেখেছে কেন?’ সামি চিকেন চিজ পিজার একটি টুকরো মুখে চালান করতে করতে বলে।
‘বেশ ফানি কিন্তু, না?’ আদিব সহাস্যে মাথা নাড়ে।
‘ফানির কী দেখলি? বামনটাকে দেখে আমার বমি আসছে। খেতেই ইচ্ছা হচ্ছে না -’ ফারিয়া মাথা নাড়ে।
আলমগীরের ডিউটি আওয়ার শেষ হয়ে আসছে। নিবাড়নদের কেউ পছন্দ করে না। ওই যে সামনের টেবিলের সব থেকে সুন্দরী আপাটা তার দিকে চোখ পড়লেই মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছে ঘৃণায়। আব্বার মৃত্যুর পর এতগুলো ভাই-বোনের সংসার তাকেই এখন দেখতে হবে বৈকি। মা’র ছোটবেলার কোন সরলা নানির ছেলে সত্য মামা আর রওশন নানির নাতি আরিফ মামা এই প্লাজারই নিচতলার দুই দোকানে সেলসম্যানের কাজ করে। তাদের সুপারিশেই এই চাকরিটা হয়েছে তার। এখন সে টয়লেটে ঢুকে ডিউটির ড্রেস খুলতে খুলতে একতলার দুই মামা উপরে উঠে আসবে। মা’র আপন রক্তের কেউ না তবু যেন আপনের চেয়েও বেশি। উপরে এসে বলবে, ‘চলো’, আমাদের সাথে লাঞ্চ করবা ভাগিনা -।’ কত গল্প করে এই দুই মা’র পাতানো ভাই বা পাতানো মামা। মা’র কীভাবে বিয়ে হলো, কেমন তারা একসাথে বড় হয়েছিল এমন এক জায়গায় যেখানে বাবারা কেউ নয় বরং মায়েরাই সব।
‘থ্যাংকস গড – বামনটার ডিউটি শেষ! এখন কিছু পেটে দেওয়া যাবে। আদিব এক কাপ কফির অর্ডার দে ত – ফারিয়া টিস্যুতে নাক মোছে।
কাচের পাল্লা খুলে আলমগীর বের হতেই দুই মামার মুখোমুখি।
‘মাইয়াডা কেরারে? ওই যে সাদা ওড়না গোলাপি কামিজ মাইয়াডা? মনে কয় তোর মায়েরে জুয়ান কালে হেই নাহানই (সেরকমই) দেহাইতো -’
‘কি চেহারা ছিল আর কি হইছে – বুড়া চিনায় – কোঙ্কালের নাহান চিনায় -’ ফারিয়া ততক্ষণে কফিতে চুমুক দিয়েছে।


Leave a Reply
You must be logged in to post a comment.