আত্মজীবনীর একাংশ

আমিনুর রহমান সুলতান
উঁকি দিয়ে দিগন্ত
হাসান আজিজুল হক
ইত্যাদি
ঢাকা, ২০১২
২৪০ টাকা

হাসান আজিজুল হকের উঁকি দিয়ে দিগন্ত আত্মজীবনীমূলক গ্রন্থের ফ্ল্যাপে যথার্থই বলা হয়েছে যে, বাংলা ভাষাভাষী পাঠকগোষ্ঠীর কাছে হাসান আজিজুল হককে পরিচিত করানো, অন্তত এ-সময়ে, বালখিল্যের নামান্তর হবে, এ-কথা না বললেও চলে। তাঁর অর্ধশতাব্দীব্যাপী সাহিত্যসৃষ্টির শীর্ষে রয়েছে গল্পাবলি ও তারপরই উপন্যাস। তাঁর মনস্বিতা ও ভাবুকতার স্বাক্ষর খোদাই করা আছে প্রবন্ধগ্রন্থগুলোতে।

কিন্তু আত্মজৈবনিক আলেখ্য বয়ানেও তিনি প্রায় অপ্রতিদ্বন্দ্বী। উঁকি দিয়ে দিগন্ত তো নিজের দিগন্তকে উদাস অবহেলায় দেখতে থাকা, সেইসঙ্গে অন্যকেও দেখানো। কারণ, বিষয়টি তো একজনের দেখার ব্যাপার নয়। সময়, ইতিহাস ও মানুষ নিয়ে যে-আখ্যান-ব্যাখ্যান তা শুধু ব্যষ্টির থাকে না, সমষ্টিরও মনোযোগ দাবি করে।

জিজ্ঞাসু পাঠক মাত্রই প্রশ্ন করবেন, কী সেই ইতিহাস, সময় বা কোন কোন মানুষের কথা তাঁর আত্মজীবনীজুড়ে রয়েছে? সময়টা ছেচল্লিশের দাঙ্গা ও সাতচল্লিশে ব্রিটিশদের কাছ থেকে ভারতের স্বাধীনতা অর্জনের সময়। আর ইতিহাস তো ওই সময়ের বাঁকে বাঁকেই বিম্বিত। সে-ইতিহাসে উঠে এসেছে ব্যক্তি, সমাজ, পরিবেশ, দাঙ্গা বা সব মানুষের কথা একটি বিশেষ অঞ্চলকে কেন্দ্র করে, তাকে যেন তৎকালীন জাতীয় চরিত্র ও জীবনেরই চালচিত্র বলা যায়।

আত্মজীবনীটি শুরু হয়েছে ক্লাস ফোরে পাঠশালায় পড়ার প্রারম্ভকাল থেকে আর শেষ হয়েছে ক্লাস ফোরের ফাইনাল পরীক্ষায় অংশগ্রহণের মধ্য দিয়ে নতুন ক্লাসে নতুন স্কুলে ভর্তি হওয়ার আকাঙ্ক্ষা ব্যক্ত করে। এক সময় ছিল, যখন গাঁয়ের হাইস্কুলে ক্লাস থ্রি ও ফোর পর্যন্ত পড়ানো হতো। কিন্তু এ-রীতির পরিবর্তন হয়ে ক্লাস ফোর পর্যন্ত রাখা হয় প্রাইমারি, আর পঞ্চম থেকে দশম শ্রেণি পর্যন্ত করা হয় হাইস্কুল।

গ্রন্থের লেখক ক্লাস ফোরের ও দাশুমাস্টারের পাঠশালার ছাত্র। ক্লাস ফোরে আগে পরীক্ষা দিয়ে পাশ করার পর ক্লাস ফাইভে উঠতে হতো না। কিন্তু লেখক বর্ণনা করেছেন – ‘গত কয়েক বছর ধরে তা আর নেই। … পাঠশালা থেকেই প্রাইমারি পরীক্ষা দিয়ে পাশ করতে হবে। পরীক্ষা দিতে হবে দূরের অন্য কোনো স্কুলে, তারপর স্কুল।’ প্রাইমারি ও স্কুলের পার্থক্য এভাবেই আমরা গ্রন্থের শুরুতেই পেয়ে যাই। গ্রন্থের শেষে আছে, লেখক ভাতাড় স্কুলে প্রাইমারি পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করে বাবার সঙ্গে ট্রেনে করে, হেঁটে বাড়ি ফিরেছেন। আর এক বছর সময়ের মধ্যে গ্রন্থের আলেখ্য বয়ানের মাঝখানে আমরা জীবনের সময়ের বিভিন্ন বৈচিত্র্য খুঁজে পাই। আত্মজীবনীর প্রথম অংশেই পাচ্ছি, যেন লেখকসহ অন্যরা সন্ধ্যার পরও হারিকেন জ্বালিয়ে পাঠশালায় পড়তে আসেন। লেখকের বর্ণনা – ‘দাশুমাস্টার এতদিন ইচ্ছেমতো ছাত্রদের পাশ-ফেল করিয়ে দিতে পারতেন, এখন আর তা হওয়ার জো নেই। পাছে তাঁর পাঠশালা থেকে কেউ ফেল করে, সেই দুর্নামের ভয়ে ক্লাস ফোর থেকেই সব দায় তিনি নিজের ঘাড়ে নিয়েছেন।’ পাঠশালায় এসে পড়াকে লেখক খোঁয়াড়ের সঙ্গে তুলনা করেছেন। লেখকের বর্ণনা, ‘মনে হচ্ছে আমাদের কপালেই প্রথম এই বাইরে গিয়ে প্রাইমারী পরীক্ষা দেওয়ার নিয়ম হল। কাজেই সকাল থেকে – মাঝখানের দুপুরবেলাটা বাদ দিয়ে – বিকেল, সন্ধে, রাত পর্যন্ত পাঠশালায় খোঁয়াড়ের গরু-ছাগলের মতো আমাদের আটকে রাখা শুরু হল।’

কড়া নিয়মের মধ্যে পাঠশালায় অবস্থান করে লেখাপড়া শুরু হলেও স্কুলে যে অনেক সময় মাস্টার থাকতেন না, লেখাপড়া না করেই সময় নষ্ট হয়ে যেত, বাড়ি থেকে হারিকেনে তেল ভর্তি করে হারিকেন সঙ্গে নিয়ে সন্ধেয় পড়তে আসতে হতো – এসব বাস্তবধর্মী বিষয়ও হয়ে উঠে এসেছে গ্রন্থে।

পাঠশালায় বলার কাছে শুনতে পান, কলকাতায় রায়েদের লক্ষ্মীদা মুসলমানদের হাতে কাটা পড়েছে। দাঙ্গার সঙ্গে লেখক পরিচিত হয়ে উঠছেন। পাশাপাশি নিজের ভেতর একটা ভীতির জগৎকে আবিষ্কার করেছেন, যা থেকে লেখক নিজেকে কখনো অসহায় ভেবেছেন, কখনো বলাকে খুন করার মধ্যে দিয়ে খুনি হওয়ার ভাবনা পোষণ করেছেন।

দাশুমাস্টারের ভেতরজ্ঞানের আলো যতটুকু আছে তা দিয়েই শিক্ষালয় খুলে বসে গেছেন। তাঁর পাঠশালায় ক্লাস ফোর পর্যন্ত পড়ার সুযোগ রয়েছে। শিক্ষার আলো জ্বেলে জ্বেলে যাঁরা পথ হাঁটেন, তাঁদের ব্যক্তিচরিত্রে কোনো না কোনো ত্রুটি থাকলেও মানবিকতা যে সমস্ত ত্রুটিকে ছাড়িয়ে যায়, তার প্রমাণ সেকালে পাঠশালার মাস্টার দাশুবাবু। কলকাতায় হিন্দু-মুসলমানের দাঙ্গা চলছে। তারই খারাপ হাওয়া গ্রাম এলাকাকেও গ্রাস করছে। কিশোর আজুল ও তার বড়ভাই শহিদুল পাঠশালা থেকে ফেরার পথে দাঙ্গায় অংশ নেওয়া হিন্দুপাড়ার লোকজন যখন পাঁঠা কাটার টাঙি, লাঠি, হুড়কো, বগি প্রভৃতি নিয়ে মুসলমান হওয়ার কারণে তাদের আক্রমণ করতে উদ্যত হয়, তখন দাশুমাস্টারই হংকার দিয়ে ওঠেন – ‘আমার ছাত্তর ওরা’। লেখকের বর্ণনার উদ্ধৃতি তুলে ধরছি দাশুমাস্টারের মানবিকতাকে বোঝার জন্য। ‘একজন হঠাৎ চেঁচিয়ে উঠল, কে যায়, মোল্লাদের ছেলে দুটি? দাশুমাস্টার কথা বলে উঠলেন। গলা নয় যেন শানানো ইস্পাত, খবরদার, আমার ছাত্তর ওরা। আমি ওদের বাড়িতে পৌঁছে দিয়ে আসি। … এইখানেই ওদের ছেড়ে দাও মাস্টার। আর এগিয়ো না। মোচনরা সব ওদের আস্তানায় জড়ো হয়েছে। … সে আমি দেখছি, দাশুমাস্টার বললেন।’

দাঙ্গার সুযোগ নেয় হিন্দু ও মুসলমান উভয় সম্প্রদায়ের মানুষ। যেমন ওবেদ শেখ মুসলমানপাড়া থেকে হিন্দুপাড়ার দিকে গরুগাড়ি যাওয়ার রাস্তা বন্ধ করে দেয়। বন্ধ করার বড় কোনো কারণ নেই। তার গোয়ালের একদিকের কোনার দেয়াল গাড়ির চাকার ধাক্কা লেগে বারবার ভাঙে এই কারণ। রামযুক্ত হাজরা হিন্দুপাড়ার রাস্তায় কাদা দেখে মুসলমানপাড়ার রাস্তা দিয়ে যাওয়ার সময় ওবেদ ও রামযুক্তের গোঁয়ার্তুমির কারণে উভয় পক্ষের মধ্যে উত্তেজনা সৃষ্টি হয়।  মারমুখী হয়ে দুই জায়গায় দাঁড়িয়ে দুই পক্ষেরই চলে চিৎকার, হইহল্লা। এমন পরিস্থিতিতে লেখকের বাবা দাঙ্গায় অংশ না নিয়ে বাড়িতেই থেকে যান। তিনি আবার ইউনিয়নের প্রেসিডেন্ট। কিন্তু ননু যে-কোনো কারণেই হোক তার ঘনিষ্ঠজন হলেও শত্রুপক্ষও। ননু দাঙ্গার সুযোগটা গ্রহণ করে কৌশলী হয়ে ওঠে। ননু লেখকের বাবাকে কৌশলে বাইরে আনতে চায়। ননুর উক্তি – ‘বোনধা, বেরিয়ে আসুন। গাঁয়ে এত বড় সর্বনাশ হতে যাচ্ছে, আপনি ঘরে বসে থাকবেন? গাঁয়ের মাথা আপনে। আপনে চলুন।’ কিন্তু লেখকের বাবা বাইরে বের হননি। লেখকের সহানুভূতি নিয়ে যখন বললেন, ‘এত করে ডাকছে, দাঙ্গায় রক্তারক্তি হবে, একবার গেলেই পারতে।’ তখন আমরা ননুর অভিসন্ধির কথা জানতে পারি লেখকের বাবার মন্তব্যের মধ্য দিয়ে। লেখকের উদ্ধৃতি, ‘আস্তে আস্তে বাবা বললেন, তুমি জানো না ননুর সঙ্গে দু-জন লোক ছিল, কংস বাউরি আর ছিপিধর পাল। ওদের কাছে দাঁড়ানোর সাথে সাথে আমার ঘাড়ে টাঙি বসানোর কথা বলে এনেছে ননু। … বিশ্বেস হচ্ছে না-তো? কি করে বিশ্বেস হবে? শুধু তাই নয়, এখানে যদি কিছু করতে নাই-ই পারে, তাইলে ওদের সাথে নিয়ে যেতে পারলে ওবেদের গোয়ালের আড়ালে লুকিয়ে থাকা দাশু বাউড়ি আর দুগো মুচি বেরিয়ে এসেই খাঁড়া চালাবে। এই দুটি খবরই আমি পেয়েছি।’

ওইদিনের হিন্দু-মুসলমানের মুখোমুখি অবস্থান নিরসনে দাশুমাস্টারই অনন্য ভূমিকা রাখেন। দাশুবাবু মানবিকতাকে সাহসী করে তোলেন। লেখকের বর্ণনা – ‘দু-দিকে দু-হাত বাড়িয়ে দু-দলকেই থামিয়ে দাশুমাস্টার বাজখাই গলায় চেঁচাচ্ছেন, থামো, থামো – কে কাকে মারতে যাচ্ছ? কার সঙ্গে কার শত্রুতা, অ্যাঁ, যে মারতে ছুটেছ? ওবেদ শেখ রামযুক্তর গাড়ি আটকেছে, তিলিপাড়ার বিষ্টুপদও তো আটকাতে পারত! এই তো ক-টা লোক তোমরা, কে কাকে মারবে ঠিক করো। এই লতিফ জববার, ইদিকে আয়, আমাকে কাটবি আয়, শুকনো শরীরে ছটাকখানেক রক্ত আছে নিয়ে যা। দেখ কী কাজে লাগে।’

আর তখনি মারমুখো অবস্থান থেকে সরে যায় সবাই। লেখকের বর্ণনা – ‘সঙ্গে সঙ্গে শোনা গেল ন-চাচার গলা, রামযুক্ত, এই হতচ্ছাড়া, গাড়ি নিয়ে যা। ওবেদ ভাই, আর একটিও কথা বোলো না।’ দাঙ্গা যে কেবল সম্প্রদায়ে সম্প্রদায়ে ঘটে থাকে এমন নয়। একই সম্প্রদায়ের মধ্যেও ঘটে থাকে। তারও একাধিক ঘটনা ও চিত্রের বর্ণনা দিয়েছেন লেখক। দাঙ্গা যে দলবদ্ধ হয়ে মারামারি, কাটাকাটি তার  যথার্থ রূপটিকে লেখক কৈশোরে প্রত্যক্ষ করেছেন। যেমন মুসলমানপাড়া দুটি ভাগে বিভক্ত ছিল, একটি মোল্লাপাড়া ও আরেকটি শেখপাড়া। টাকার লেন, শেখপাড়ার গরু মোল্লাপাড়ার ধানের জমিতে মুখ দিয়েছে – এমন ঘটনা নিয়েও দারুণ দাঙ্গা বেঁধে গেছে। দাঙ্গা বেধেছে জমিদারে জমিদারে। আর এক্ষেত্রে গাঁ ধারসোনার পেশাদার লাঠিয়ালরা দাঙ্গায় অংশ নিয়েছে।

কলকাতার হিন্দু-মুসলমানের দাঙ্গা এক সময় লেখকের গ্রামেও প্রভাব ফেলে। তাদের গ্রামে ঘরজামাই হিসেবে বসবাসরত দাদ আলী হিন্দুপাড়ার লোকদের হাতে খুন হয়। এ নিয়ে মুসলমানদের পাড়াও সংগঠিত হতে দেখা যায়। আর এর পেছনে যত না মূল্যবোধের স্থান রয়েছে, তার চেয়ে বেশি কাজ করেছে ইজ্জতের, মানসম্মানের প্রশ্ন। লেখকের বর্ণনা স্মর্তব্য – ‘বাবা আস্তে আস্তে বললেন, ঠিক আছে মোবাই ভাই। তুমি আমারও বয়েসে বড়। তোমার কথা শুনতে হবে বৈকি! তাইলে চলো, দাদ নিতে সবাই ক্ষীরগাঁয়ে যাই। এই তো কটা লোক আমরা। ওই অত বড় হিন্দু গাঁয়ে গিয়ে একজনও ফিরতে পারব না, জানি। তা হোকগে, ইজ্জত বাঁচাতে না হয় মরলামই সবাই।’

দাঙ্গার ভেতরেও মনুষ্যবোধ উঁকি দিয়ে যে মানবিক দিগন্তকে ছুঁতে চায়, তারও দৃষ্টান্ত মিলে এ-গ্রন্থে। লেখকের বাবার উক্তি থেকে তা স্পষ্ট হয়ে ওঠে – ‘ক্ষীরগাঁয়ে ঢুকে কাকে আগে মারবে। সেই মানুষটা কে আর তাকে পাবেই বা কি করে? জামাইকে মেরেছে হয়তো বারো-চোদ্দো জনায় মিলে। এদিকে ক্ষীরগাঁয়ে হাজার লোক। কাকে কি করে মারবে বলো দিকিনি? ধরো, প্রথমেই তোমার সামনে এসে দাঁড়াবে আমাদের গাঁয়ের স্কুলের দুগগাশঙ্কর মাস্টারের জামাই গোপাল বাড়ুজ্জে। চেনো তো তাকে, নবদ্বীপ কলেজে মাস্টারি করে? মুখটা একবার মনে করে দ্যাখো দিকিনি। খালিগায়ে ধুতির খুঁটটা গলায় জড়িয়ে কি যেন শুধুবে, এমনি মুখ করে মানুষটা তোমার সামনে এসে দাঁড়াইলে। ওকে মারতে পারবে?’

ওই দাঙ্গায় হিন্দুদের মালাউন আর মুলমানদের নেড়ে বলে গালি বা পরিচয় দেওয়ার একটা খারাপ সংস্কৃতিও চালু হয়েছিল। শুধু তাই নয়, যার যার ধর্মের ব্যবহার অনুযায়ী কিছু অস্ত্রও উভয় সম্প্রদায়ের হাতে হাতে থাকত। যেমন : হিন্দু দাঙ্গাকারীদের হাতে থাকত, খাঁড়া টাঙি, বগি আর মুসলমান দাঙ্গাকারীদের হাতে থাকত, তলোয়ার, লাঠি, সড়কি, বল্লম, কিরিচ প্রভৃতি।

প্রসঙ্গ এসেছে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে রেশন চালুর। লেখকের এক চাচা রেশনের মালিক ছিলেন। প্রসঙ্গ এসেছে বঙ্গবাসী পত্রিকার। বঙ্গবাসী তাঁদের বাড়িতে ডাকে আসত। পিয়ন দিয়ে যেত। বঙ্গবাসীর সূত্রে তাঁরা ‘জাপানীরা বোমা ফেলবে কি, তাদেরই দুটো শহরে মার্কিনি গোরা-রা এমন দুটো বোমা ফেলেছে যে, পাঁচ মিনিটের মধ্যেই দু-লাখ মানুষ সাবাড়। ব্যস, যুদ্ধ শেষ। একদম শেষ।’ যুদ্ধের কারণে যে-আকাল সৃষ্টি হয়, তার ইতিহাস ও সময়ের কথা লেখক জানতে পারেন তাঁর কৈশোরকালেই। যুদ্ধে যত না মানুষ মরেছে, তার চেয়ে অধিক মরেছিল আকালে বা দুর্ভিক্ষে। ভারত স্বাধীন হয়েছে, লেখক সে-স্বাধীনতা থেকে প্রাপ্তির কথা ভেবেছেন। তাই তো তিনি বলছিলেন, ‘স্বাধীন কি কোনোদিনই ভালো বুঝতে পারিনি। … হিন্দু-মোসলমান দাঙ্গা তেমন দেখিনি, কেন কি জন্য দাঙ্গা, তাও ভালো করে বুঝতে পারিনি। লড়কে লেঙ্গে পাকিস্তান, বন্দে মাতরম, ভারতমাতা কি জয় – এসব খুব শুনেছি। আর কিরকম দিনরাত ভয়ে কাঁটা হয়ে থাকা। একদিন নয়, দুদিন নয়, কতদিন কতদিন, বাবা রে বাবা! এত ভয় এত কষ্ট এত অভাব তবু আবার প্রত্যেক দিন কত মজা! মজাই বেশি, খেতে মজা, ঘুরতে মজা, একা থাকতে মজা! মানুষের তেমন তাপ উত্তাপ নেই। হিন্দু- মোসলমানদের মধ্যে খেয়েদেয়ে কাজ নেই যাদের, তাদেরই বেশি হিংসে-হিংসে কথা; হাড়ি বাগদি মুচি বাউরি ডোম, গাঁয়ের বেশিরভাগ তিলি, আগুরি, বামুন – কই তারা তো খুব নেচে-কুঁদে বেড়ায়নি। এখন এই যে, স্বাধীন হয়ে গেল দেশ, আমাদের এখন কি হবে, করতে হবেই বা কি?’

প্রতি বছরেই কলেরা, ম্যালেরিয়া ও বসন্ত রোগ পাড়াসুদ্ধ হয়ে যাওয়াই ছিল স্বাভাবিক। লেখকের কৈশোরের ওই কালটায় ম্যালেরিয়া থেকে যে লেখকও রেহাই পাননি তাও নিখুঁত বর্ণনার মধ্য দিয়ে প্রতিফলিত হয়েছে। লেখকের বর্ণনা – ‘বসন্ত আর কলেরা কোনো কোনো বছর মাফ করলেও ম্যালেরিয়া থেকে কিন্তু মাফ নেই। বোধহয় কারো মাফ নেই। ও হবেই। মোসলমানেরা বলে ম্যালেরিয়া, হিন্দুরা মেলিরিয়া। দুটোরই ওষুধ কিন্তু একটাই – কুইনাইন বড়ি।’

ম্যালেরিয়া হয় আবার দুই ধরনের। পুরনো ম্যালেরিয়ার সময় ফাল্গুন-চোত মাস। আর নতুন ম্যালেরিয়ার সময় আশ্বিন মাস। নতুন ম্যালেরিয়াজ্বরে লেখক ফোরে পড়াকালীন ভোগেন। এই জ্বরে তিনি যে কতটুক কাহিল হয়েছিলেন তার পুঙ্খানুপুঙ্খ বর্ণনা রয়েছে গ্রন্থে। সমাজ মানুষের পাশাপাশি লেখকের শৈশবের অঞ্চলের সংস্কৃতির কথাও বাদ যায়নি। কথাসাহিত্যের শিল্পনৈপুণ্যেই উঁকি দিয়ে যায় দিগন্ত। লেখকের অসামান্য শিল্পনৈপুণ্যের পরিচয় ফুটে উঠেছে চিত্রকলাময় বর্ণনার মাধ্যমে। সমাজ, সংস্কৃতি, পরিবেশ, চরিত্র অনুযায়ী প্রাণবন্ত ভাষায় হাসান আজিজুল হকের শিল্পীসত্তাকে নতুনভাবে আবিষ্কার করি আমরা; তাঁর কৈশোরক মফস্বলকে নতুনভাবে উপলব্ধি করি আমরা।

চিত্রকলাময় শিল্পনৈপুণ্যের কয়েকটি উদাহরণ তুলে ধরা হলো :

১. আলোচালের মতোই জ্যোৎস্নাটাও সাদা, রাত সাদা, রাস্তা সাদা, ধুলো সাদা, ঘরবাড়ি সাদা, নিমগাছের পাতাও ঝিকমিকে সাদা। পৃ ১৭

২. পাকা ছোট, কালো-কালো দুটো তাল যেন। পৃ ৪০

৩. নিঃশ্বাসের শব্দে মনে হয় ভিতরে হারমোনিয়াম বাজছে। পৃ ৪৯

৪. সন্ধে-রাতটা এমন করে চুপিসারে এগোচ্ছে যেন কার বাড়িতে ঢুকে কিছু চুরি করবে।