আবুল হাসনাত : দূরের ও কাছের মানুষ

‘আবুল হাসনাতভাই নেই। অবিশ্বাস্য মনে হচ্ছে। এই তো দেখা হলো গত ডিসেম্বর বাংলা একাডেমির সাধারণ সভায়। আমাদের সাহিত্যচর্চার পথে একজন অভিভাবক বিদায় নিলেন। দেখা হলেই বলতেন, লেখা দিয়েন। তিনি ছিলেন লেখক তৈরির কারিগর। সংবাদ সাময়িকীতে তিনি আমার প্রচুর প্রবন্ধ ছেপেছেন। রাজশাহী থেকে ঢাকায় গেলেই লেখক সম্মানী দ্রুত পরিশোধ করার ব্যবস্থা করতেন। কালি ও কলমের দক্ষ সম্পাদক, লেখক তালিকায় আমাকে স্থান দিয়েছিলেন। আমি কৃতজ্ঞ তাঁর কাছে। মহান আল্লাহ তাঁকে শান্তি দান করুন।’ – ১ নভেম্বর ২০২০ এটি ফেসবুকে পোস্ট  দিই, হাসনাতভাইকে নিয়ে তোলা একটি গ্রুপ ছবিসহ। সাহিত্যামোদী বহু বন্ধু যশস্বী কবি-সম্পাদক-চিত্রসমালোচকের প্রয়াণ সংবাদ জেনে শোক ও শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করেন। দৈনিক বাংলাদেশের খবরের সাহিত্যপাতা – ‘সাহিত্য ও সংস্কৃতির খবরে’ উল্লিখিত পোস্টটি বিশিষ্ট কবি-লেখকদের শোকগাথা হিসেবে প্রকাশিত হয়।

রাজশাহী আমার আবাসভূমি, বিশ্ববিদ্যালয়ের পাশের গ্রাম কাজলা। সদ্যস্বাধীন দেশে ভাষাপ্রীতি ও স্বদেশপ্রেমে মুগ্ধবালক, যৌবনে পা দিয়ে বিজ্ঞান ছেড়ে বাংলা ভাষা ও সাহিত্য পড়া শুরু করি। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়, বাংলাদেশ বেতার ও শহরকেন্দ্রিক বিভিন্ন সাহিত্যানুষ্ঠানে অংশগ্রহণ ও লেখালেখি হয়ে ওঠে নিত্যসাধনা। শ্রেণিকক্ষে বিশেষ কজন শিক্ষকের পাঠগ্রহণ ছাড়া পাঠাগার ও বই-পত্রিকার দোকানের প্রতি আগ্রহ ছিল বেশি। তখন সতীর্থ বন্ধু আফজাল হোসেন ছবি দৈনিক সংবাদের রাজশাহী প্রতিনিধি। তার সঙ্গে ঘনিষ্ঠতার সূত্রে সংবাদ পড়ার আগ্রহ বৃদ্ধি পায়। ভালো লাগে চারণ সাংবাদিক মোনাজাতউদ্দিনের প্রতিবেদন, শিল্প ও সংস্কৃতি বিভাগ, সংবাদ সাময়িকী – সর্বোপরি পত্রিকাটির প্রগতিশীল দৃষ্টিভঙ্গি। বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় ও লিটল ম্যাগাজিনে টুকটাক লেখালেখি করলেও সত্তরের দশকের মাঝামাঝি থেকে দৈনিক সংবাদের শিল্প ও সংস্কৃতি এবং সাহিত্য সাময়িকীর জন্যে লেখা পাঠাই। ছাপা হয়। পরে কেবল সাময়িকীর পাতায় লিখতাম। সে-লেখা চোখে দেখার জন্যে কী অধীর প্রতীক্ষা! তখন বঙ্গবন্ধু সেতু হয়নি। রাজশাহীতে পত্রিকা আসতে বিকেল গড়িয়ে প্রায় সন্ধ্যা হয়। ছুটে যাই বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রাবাস কিংবা শহরে সোনাদীঘির মোড়ে পত্রিকার সন্ধানে। মুদ্রিত লেখা হাতে পেলে মুগ্ধচিত্তে পত্রিকা নিয়ে ঘরে ফেরার পথে নতুন লেখার পরিকল্পনা আঁটতাম। এভাবে প্রায় সাত বছর কেটে যায়। আবুল হাসনাতের সঙ্গে সাক্ষাৎ, ফোনালাপ কিংবা পত্রবিনিময় হয়নি। আমি কেবল দূর থেকে সাহিত্য সম্পাদক হিসেবে তাঁর রুচি, দৃষ্টিভঙ্গি ও দক্ষতা দেখে মুগ্ধ হই। চার পৃষ্ঠার সমায়িকী কী চমৎকার শিল্পসজ্জায় ভরিয়ে তুলতেন। কবিতা, গল্প, ধারাবাহিক উপন্যাস, প্রবন্ধ, বই-আলোচনা, নির্ধারিত কলাম থাকত এবং বিশেষভাবে থাকত চিত্রকলা সম্পর্কিত প্রবন্ধ-নিবন্ধ-আলোচনা-সমালোচনা-প্রতিবেদন। চিত্রশিল্পের প্রতি হাসনাতভাইয়ের দুর্বলতা-ভালোবাসা ও অভিজ্ঞতার প্রতিফলন বরাবরই সক্রিয় ছিল। প্রগতিপন্থী ও স্বাধীনতার পক্ষের পত্রিকা সংবাদের কাটতি ছিল কম। তবে কেবল বৃহস্পতিবারের সংবাদ সাময়িকীর জন্যে আমার মতো অনেকেই ওই পত্রিকার পাঠক ছিলেন। রাজধানীর বাইরে সারাদেশে ছড়িয়ে থাকা লিখতে আগ্রহী বহু তরুণ-তরুণীকে তিনি লেখক বানিয়েছেন, দূরে থেকে কাছে টেনেছেন – যথার্থ সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেছেন। 

আবুল হাসনাতের আরেক কীর্তি গণসাহিত্য পত্রিকা সম্পাদনা ও প্রকাশন। বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় তাঁর সক্রিয় বামপন্থী রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডজনিত বোধ-বিবেচনা এ-পত্রিকায় প্রতিফলিত। সাহিত্যকে তিনি গণমানুষমুখীন করতে চেয়েছিলেন।  লেখা-সংক্রান্ত আহ্বান ছিল – ‘জীবনমুখীন নবীন ও প্রবীণদের লেখা গ্রহণযোগ্য।’ ৭ আগস্ট ১৯৭২ সালে প্রকাশিত প্রথম বর্ষ প্রথম সংখ্যা গণসাহিত্য পত্রিকার ভূমিকায় সম্পাদক বলেন, ‘বাংলাদেশের মানুষ অপরিমেয় রক্ত দিয়ে শুধু স্বাধীনতাকে প্রতিষ্ঠা করেনি, সূচনা করে গেছে গণসংস্কৃতি ও গণসাহিত্য সৃষ্টির সম্ভাবনাময় ভবিষ্যতের। একে আজ সংহত করার প্রয়োজন বড় বেশি। যেমন প্রয়োজন রয়েছে সমাজতান্ত্রিক আদর্শে সমাজ পুনর্বিন্যাসের, তেমনি মানবাত্মার উপাদান শিল্প ও সংস্কৃতি তথা সাহিত্যের গণমুখী ধারাকেই সচেতন প্রয়াসে এগিয়ে নিতে হবে সাধারাণ মানুষের সর্বাঙ্গীণ কল্যাণে। মাঠের মানুষের কাছাকাছি হওয়া শুধু নয়, তার আশা আকাঙ্ক্ষার হৃদস্পন্দন ধ্বনিত হওয়া চাই সাহিত্যে। সাহিত্য তখনই হয়ে ওঠে গণমুখী। এবার নবজীবনের শুরু। বন্ধত্ব দশা ঘুচিয়ে শিল্প-সংস্কৃতিকে জীবনের দিকে দাঁড় করাতে হবে। … মানব মুক্তির মহৎ ব্রত নিয়ে গণসাহিত্য আত্মপ্রকাশ করছে।’ সারাদেশের প্রগতিশীল নবীন-প্রবীণ লেখকদের তিনি কাছে টেনেছেন – সাহিত্য পত্রিকার দিয়েছেন নতুন মাত্রা। লেখা সংগ্রহ ও লেখক নির্বাচনের ক্ষেত্রে আবুল হাসনাত ছিলেন অপ্রতিদ্বন্দ্বী। গণসাহিত্যের লেখক-তালিকা দেখলে বিস্মিত হতে হয়। গণসাহিত্যের সেই বাহাত্তর সালের লেখকবৃন্দই আজো বাংলাদেশের সাহিত্যকে প্রতিনিধিত্ব করছেন – যদিও তিনিসহ কেউ কেউ প্রয়াত। গণসাহিত্যে প্রকাশিত তাঁর (মাহমুদ আল জামান) একটি কবিতার শেষাংশ –

যাচ্ছি প্রতিদিন বহু দূরে, চলে যাচ্ছি

প্রতিদিন দূর ফেরারের গানে

যেখানে রক্তাক্ত স্বাধীনতা, জীবনের গান

লোকালয়ে, জনপদে, সারিতে সারিতে

আমাদেরই বীজ উঠছে থরো থরো।

ছাত্রজীবন শেষ করে রংপুর ক্যাডেট কলেজে প্রভাষক পদে নিয়োগ পাই। তখন আশির দশক। কলেজের বিশেষ কাজে ঢাকা যেতে হলো। কাজের ফাঁকে সংবাদ অফিসে গেলাম। একজনকে জিজ্ঞেস করলে সাহিত্য সম্পাদকের টেবিল দেখিয়ে দিলেন। কাছে গিয়ে দেখলাম, গুরুগম্ভীর সুদর্শন এক ভদ্রলোক নিবিষ্টমনে কোনো এক লেখকের পাঠানো লেখা পড়ছেন। সালাম দিয়ে নাম বললাম। বড় মায়াবী দুটো চোখ তুলে বললেন, ‘রংপুর থেকে এসেছেন, বসুন।’ দেখলাম তাঁর টেবিলের সামনে একটিই চেয়ার, ফাঁকা। বসলাম। তিনি সংবাদ সাময়িকীর বাঁধানো একটি ফাইল বের করে আমার নাম ও কোন তারিখে কোন লেখা প্রকাশিত হয়েছে তার তালিকা করে হাতে দিয়ে বললেন, ‘হিসাব শাখায় গিয়ে আমার  কথা বলুন, সম্মানীর টাকা দিয়ে দেবেন – ঠিক আছে।’ পুনরায় সালাম দিয়ে হিসাব শাখায় যাই।

এরপর বহুবার হাসনাতভাইয়ের সঙ্গে সংবাদ অফিসে ও বাংলা একাডেমি চত্বরে দেখা হয়েছে। দেখেছি তাঁর পরিমিতিবোধ ও কাজের প্রতি প্রবল মনোযোগ। প্রায়ই বলতেন, ‘লেখা দিয়েন, বড় লেখা, ছোটলেখা মেকআপ দিতে অসুবিধা হয়।’ আপাতভাবে তাঁকে রাশভারী মনে হলেও তিনি ছিলেন উদারমনের মানুষ। সুধীজনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল, নবীনদের প্রতি স্নেহপ্রবণের প্রকাশভঙ্গিতে প্রাবল্য নেই, আছে মার্জিতবোধ। কোনো এক বৃহস্পতিবারের সংবাদ রংপুর যায়নি। সে-সংখ্যায় আমার একটি প্রবন্ধ মুদ্রিত হয়। হাসনাতভাই জানতে পেরে লেখাটি ফটোকপি করে আমাকে পাঠান। আমি মুগ্ধ হই। 

সংবাদের আর্থিক অবস্থা সবসময় সন্তোষজনক ছিল না। হাসনাতভাইকে  দেখলেই চিন্তিত মনে হতো। তাঁর ব্যক্তিগত সংকট-সমস্যার কথা কাউকে বলতেন কি না, আমার জানা নেই। তবে সংবাদ অফিসে দেখেছি – কাইয়ুম চৌধুরী, সৈয়দ শামসুল হক ও আবদুল মান্নান সৈয়দের সঙ্গে মন খুলে ধীরলয়ে দীর্ঘ সময় নিয়ে কথা বলতেন। তাঁর উচ্চারণ শুদ্ধ এবং কণ্ঠস্বর ছিল মাধুর্যমণ্ডিত।

আমার প্রথম গবেষণাগ্রন্থ প্রকাশ করে মুক্তধারা (১৯৯০)। প্রকাশের জন্যে প্রদত্ত পাণ্ডুলিপি প্রকাশযোগ্য কি না তার মূল্যায়ন বা মতামতের জন্যে চিত্তরঞ্জন সাহা দুজন রিভিউয়ারের কাছে পাঠাতেন। আমার উল্লিখিত  বইয়ের রিভিউয়ার ছিলেন নাজমা জেসমিন চৌধুরী ও আবুল হাসনাত। দুজনই বইটি প্রকাশের সপক্ষে মতামত দেন। একদিন হাসনাতভাই বলেন, ‘আপনার মুনীর চৌধুরীর ওপর কাজটি ভালো হয়েছে (মুনীর চৌধুরী সাহিত্যকর্ম, পিএইচ.ডি অভিসন্দর্ভ, বাংলা একাডেমি)।’ এমন মন্তব্য হাসনাতভাইয়ের কাছ থেকে পাওয়া অপ্রত্যাশিত। তিনি আরো বলেন, ‘মুনীর স্যারের কয়েকটি নাটক সম্পর্কিত আলোচনা তথ্যনির্দেশিকা বাদ দিয়ে, কিছুটা কেটেছেঁটে সংবাদ সাময়িকীর জন্যে দিতে পারেন।’ আমি কবর, রক্তাক্ত প্রান্তর ও চিঠি নাটক তাঁর চাহিদামতো জমা দিই। তিনি যত্ন নিয়ে নাট্যপ্রবন্ধের শিরোনাম সুন্দর লেটার ইলাস্ট্রেশন করে ছাপেন। শেষোক্ত নাটক দুটি আলোচনা বড় হওয়ায় পরপর দুই সপ্তাহ ছাপতে হয়। তিনি আমাকে দিয়ে কিছু ব্যতিক্রমী প্রবন্ধ লিখিয়েছেন। একজন লেখকের যে মূল লেখা, তার বাইরেও তিনি কিছু ভিন্নধর্মী লেখা লেখেন। সে-বিষয় নিয়েই তিনি আমাকে লিখতে বলেন। যেমন, সংবাদ সাময়িকীতে প্রকাশিত আমার কয়েকটি প্রবন্ধ – ‘কাজী হাসান হাবীবের কবিতা’, ‘রণেশ দাশগুপ্তের নাটক : ফেরী আসছে’, ‘আবুল হাসানের নাটক’, ‘ঋত্বিক ঘটকের গল্পে নিসর্গজীবন’, ‘মোতাহার  হোসেন চৌধুরীর কবিতায় সত্য ও সুন্দরের রূপায়ণ’ প্রভৃতি।

হাসনাতভাই অন্যের লেখা ছেপে তৃপ্তি পেতেন। নিজের লেখা ছাপার আগ্রহ খুব একটা দেখাতেন না। অথচ যে-কোনো সম্পাদক-প্রকাশক তাঁর লেখা ছাপতে অনীহা প্রকাশ করার কথা নয়। কারণ, মাহমুদ আল জামান নামে লেখা তাঁর কবিতা এবং আবুল হাসনাত নামে লেখা গদ্যপ্রবন্ধ, স্মৃতিকথা ও চিত্র-আলোচনাকর্ম শিল্পসম্পন্ন হয়। তাঁর নির্বাচিত কবিতা, প্রত্যয়ী স্মৃতি অন্যান্য এবং হারানো সিঁড়ির চাবির খোঁজে গ্রন্থ তিনটি সে-সত্যের প্রমাণ দেয়।

ছাত্রজীবনে হাসনাতভাই দাপটের সঙ্গে প্রগতিশীল রাজনীতি করতেন। উচ্চপদে দায়িত্ব পালন করেন। কর্মজীবনে এসে সাহিত্য সম্পাদকের কাজ করতে গিয়ে সেই প্রগতিপন্থী চেতনা ম্রিয়মাণ হয়নি, বরং জহুর হোসেন চৌধুরী, আহমেদুল কবির, শহীদুল্লা কায়সার, রণেশ দাশগুপ্ত, বজলুর রহমান, সন্তোষ গুপ্ত প্রমুখ মনীষীর সাহচর্য তাঁকে সর্বদা মানবিক কল্যাণ ও সততার পক্ষে জাগ্রত রেখেছে।

তিনি যেমন সব পত্রপত্রিকায় লিখতেন না, তেমনি সব সাহিত্যানুষ্ঠান কিংবা প্রাতিষ্ঠানিক উৎসব-আয়োজনে যেতেনও না। বাংলা একাডেমির সাধারণ সভায় মাঝেমধ্যে গেলেও আনমনে ঘুরেফিরে  দেখতেন – অন্যরা আগ্রহ নিয়ে তাঁর কাছে গিয়ে আলাপ করার চেষ্টা করতেন। কখনো দেখতাম, সভা-প্যান্ডেলের একেবারে পিছনে গিয়ে বসতেন, সামনের সারিতে জায়গা দখলের বাসনা তাঁর কখনোই ছিল না। একবার কুমিল্লা ক্যাডেট কলেজে আন্তঃক্যাডেট কলেজে সাহিত্য প্রতিযোগিতায় তাঁকে বিচারক হিসেবে আমন্ত্রণ জানালে তিনি সরাসরি বলেন, ‘বিশ্ববিদ্যালয় থেকে শিক্ষক নিয়ে যান।’ এটা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতি তাঁর শ্রদ্ধা বা অশ্রদ্ধা প্রদর্শন নয়, নিজ চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য ও আস্থা-বিশ্বাসের সহজাত প্রকাশ। আবুল হাসনাত সংবাদ ছেড়ে কালি ও কলম পত্রিকার সম্পাদক হলেন। নতুন মাসিক শিল্প সাহিত্যবিষয়ক পত্রিকা। প্রকাশক শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতিপ্রিয় আবুল খায়ের। ২০০৪ সাল, আমি তখন কুমিল্লা ক্যাডেট কলেজে। সাহস করে ফোনে হাসনাতভাইকে বললাম, ‘ঠিক আছেন তো? চিন্তা করবেন না। শিল্পরসিক প্রকাশক আবুল খায়ের ও সভাপতি আনিসুজ্জামান স্যার আছেন।’ তিনি শুধু বললেন, ‘পত্রিকার গ্রাহক সংগ্রহ করে দেন।’ কুমিল্লা থেকে ফেনী, ঝিনাইদহ, জয়পুরহাট হয়ে পাবনা ক্যাডেট কলেজের অধ্যক্ষ, অতঃপর অবসর নিই। যেখানেই গেছি বা আছি উপযুক্ত কাউকে পেলেই কালি ও কলম পত্রিকার গ্রাহক করে দিয়েছি। এখন এটা দেশের সেরা সাহিত্য পত্রিকা। হাসনাতভাইয়ের মৃত্যুর পর বুক সেলফ থেকে কালি ও কলম নামিয়ে নেড়েচেড়ে দেখলাম, প্রথম ও দ্বিতীয় সংখ্যা ছাড়া সতেরো বছরের পত্রিকা আমার কাছে আছে। সংবাদ সাময়িকীর অভিজ্ঞতা আবুল হাসনাত এখানে প্রয়োগ ও নবতর চেতনা-পরিকল্পনার বাস্তবরূপ দিয়েছেন। কবিতা, নাট্যকলা ও শিল্পের পাতাগুলো রঙের আভিজাত্যে হয়েছে মনোমুগ্ধকর। লেখার প্রয়োজন অনুযায়ী সংযুক্ত হয়েছে প্রাসঙ্গিক ছবি। প্রায়ই সব সংখ্যার প্রচ্ছদ প্রখ্যাত চিত্রশিল্পীর অংকিত চিত্র দিয়ে নির্মিত এবং অধিকাংশ ছবির সংগ্রাহক আবুল খায়ের। হাসনাতভাই কালি ও কলমে লেখার তাগাদা না দিলে আমার লেখা হতো না ‘মুনীর চৌধুরীর নাটক ও উত্তরপ্রজন্ম’, ‘জিয়া হায়দার : আধুনিক নাটকের বিশিষ্ট রূপকার’, ‘আবুবকর সিদ্দিক : বহুমুখী প্রতিভার প্রতিভূ’, ‘আবদুল মান্নান সৈয়দের নাট্যসাহিত্য’, ‘মোবারক হোসেন খান : শিল্পসাহিত্যের বরেণ্যজন’ প্রভৃতি প্রবন্ধ। স্মরণসংখ্যা, স্মারকসংখ্যা, শ্রদ্ধাঞ্জলি ক্রোড়পত্র ছাড়াও বর্ধিত কলেবরে প্রতি বছর ছোটগল্প ও প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী সংখ্যা প্রকাশিত হয়। বিশেষ সংখ্যাগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য – সার্ধশতজন্মবর্ষে রবীন্দ্রনাথ, শামসুর রাহমান, জয়নুল আবেদিন জন্মশতবার্ষিক শ্রদ্ধাঞ্জলি, কাইয়ুম চৌধুরী, চিত্রকলা, স্বাধীনতার চল্লিশ বছর, মোহাম্মদ কিবরিয়া, হুমায়ূন আহমেদ, আমিনুল ইসলাম, মাজহারুল ইসলাম, রবিউল হুসাইন ও নবনীতা দেবসেন, বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবর্ষ শ্রদ্ধাঞ্জলি, আনিসুজ্জামান এবং ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর জন্মদ্বিশতবর্ষ ক্রোড়পত্র। বিদ্যাসাগর সংখ্যাটিই আবুল হাসনাত- সম্পাদিত শেষ কালি ও কলম। প্রতিটি সংখ্যায় তাঁর শ্রমসাধনা, নান্দনিক দৃষ্টি ও নতুনতর সৃষ্টির স্বাক্ষর আছে। যোগ্যতাগুণেই তিনি শিল্প ও শিল্পী পত্রিকার সম্পাদক এবং বেঙ্গল পাবলিকেশন্সের নির্বাহী পরিচালক হয়েছিলেন। আমি খুব সীমিত সময়ের জন্যে দৈনিক বাংলার সম্পাদক আহসান হাবীব ও সাপ্তাহিক বিচিত্রার সম্পাদক শামসুর রাহমানের স্নেহধন্য হতে পেরেছিলাম। কিন্তু সম্পাদক আবুল হাসনাতের সান্নিধ্য ও পৃষ্ঠপোষকতা পেয়েছি দীর্ঘ পঁয়তাল্লিশ বছর। আজ সংবাদ সাময়িকী কিংবা কালি ও কলমে চোখ রাখলেই ভেসে ওঠে এক শান্তস্নিগ্ধ প্রত্যয়দীপ্ত সম্পাদকের মুখশ্রী – তিনি লেখক-পাঠকদের আপনজন, প্রিয় ও শ্রদ্ধাভজন আবুল হাসনাত।