উপেক্ষিত সংগীতধারার অনুসন্ধানী বয়ান

‘ভিক্ষুক’ শব্দটি নিয়ে কিছুটা সমস্যা আছে। এই শব্দটি উচ্চারণমাত্রে বাড়ির দরজায় বা উঠোনে (নাগরিক অ্যাপার্টমেন্ট-সংস্কৃতিতে ছবিটা মনে আনা কঠিন, অ্যাপার্টমেন্টের স্থাপত্য-পরিকল্পনায় তাকে ভিক্ষুক-প্রতিরোধক করে নির্মাণ করা হয়েছে) নানা বয়সের নর ও নারী, বালক  ও বালিকার একক ও যৌথ যে ছবি ফুটে ওঠে, কিংবা পথের মোড়ে গাড়ির জানলায়, বাসস্টপে, স্টেশনে ট্রেনের জানলায়, ট্রেনের কামরায় যে সব কাতর মূর্তি প্রার্থনা নিয়ে আমাদের কাছাকাছি এলে আমরা আরামের অভাব বোধ করি, তাদের সাধারণভাবে আমরা আমাদের মধ্যবিত্ত শ্রেণি থেকে কিছুটা অস্বস্তি ও অবজ্ঞা মিশিয়ে পৃথক করে দিই। এটা আমাদের নিজেদের জন্য স্বস্তিক্ষেত্র নির্মাণের একটা প্রয়াস, তা আমরা জানি। ভিক্ষুকেরা এক ধরনের ‘অপর’, আমরা ‘বৈধ’ নাগরিক, আমরা ওদের মতো ভিক্ষুক নই। মাঝে মাঝে সখে বা দায়বোধ থেকে ভিক্ষুকের ভূমিকা নিই নিঃস্বার্থে না হোক পরার্থে। অন্তত প্রকাশ্যভাবে। ‘আমরা-ওরা’ – এই বাইনারি দ্বিভাজনের বাইরে গিয়ে যখন ওই তথাকথিত ‘ভিক্ষুক’ দিকে নজর ফেলি, তখন বুঝি, তাঁরাও তো এক রকম নন (মান্যতার সর্বনাম আর ক্রিয়াপদ লিখতে হাত উঠছিল না, তবু লিখেই ফেললাম)। তাঁদের গোষ্ঠী আর সম্প্রদায়ের বিভাগ আছে, আবার কেউ একক।  আবার তথাকথিত ‘ভদ্রলোক’ ভিক্ষুকও আছেন, যাঁরা দেশ ও সমাজের নানা দুর্গতিতে ট্রাকে চড়ে চাদর পেতে ভিক্ষেয় নামেন, ‘দেশ ভেসে গেছে আজি বন্যায়, কোটি দেশবাসী হল অসহায়’ গান গেয়ে।  তাঁরা চিরভিখারি নন। তাঁরা সমাজের সম্মানিত সদস্য।  আবার আছেন ধর্মের আশ্রয়ে যাঁদের ভিক্ষাবৃত্তির অনুমোদন আছে, তাঁদেরও সমাজ মোটামুটি সমীহ করে।  তাঁরাও সাধারণ ভিক্ষুক নন। বৈদিক যুগের তপোবনবাসী আচার্য আর তাঁর শিষ্য থেকে শুরু করে বৌদ্ধ ভিক্ষু (মিয়ানমারে এখনও বালকদের এক বছর না কত ভিক্ষুজীবন পালন করতে হয়), বৌষ্ণব-বৈষ্ণবী, ইসলামের ফকির ও দরবেশ, বাংলার নানা ধর্মের বাউল, মুর্শিদ প্রভৃতি তাঁদেরও এক ধরনের সামাজিক মর্যাদা আছে। অনেক সময় ধর্মস্থানে তাঁদের সমাবেশও এক ধরনের বাধ্যতা তৈরি করে পুণ্যলোভীর মনে, ওখানে ভিক্ষাবর্ষণ করলে নিশ্চয়ই পুণ্য হবে কিন্তু পথেঘাটে বিচ্ছিন্ন সাধারণ ভিক্ষুকদের, গাড়ির জানলায় নাছোড়বান্দা প্রার্থীদের সেই মর্যাদা নেই। এ থেকেই বোঝা যায় যে, যাঁদের সচরাচর আমরা ভিক্ষুক বলি, তাঁরা ব্যক্তিগত অভাব, পঙ্গুতা বা আরও নানা দুর্গতিতে আক্রান্ত, এবং তাঁদের কেউ কেউ এসব কারণে জন্মভিক্ষুক, কেউ দুর্ঘটনায় বা পারিবারিক নিষ্ঠুরতায় পরে ভিক্ষুকে রূপান্তরিত। সকলের যে মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের ভিখুর মতো বর্ণাঢ্য অতীত থাকে তা নয়। বেশিরভাগই একক, বিচ্ছিন্ন ব্যক্তি। যদিও অন্ধ বা প্রতিবন্ধী ভিক্ষুকেরা কখনো কখনো দল বেঁধে ভিক্ষা করেন। মা বা বাবা (সাজানোও হতে পারে) থাকেন শিশুকে নিয়ে।     

যে যা-ই হোক, সকলে গান শুনিয়ে ভিক্ষে করেন না। অনেকে আর্ত প্রার্থনাতেই আবদ্ধ থাকেন।  বিদেশে কেউ বেহালা বা মাউথ অর্গান বাজান দেখেছি, আমাদের দক্ষিণ এশিয়ায় তা দুর্লভ। তবু গান তো একটা শিল্প।  যাঁরা এই শিল্পের শ্রবণ উপহার দিয়ে বিনিময়ে কিছু চান, তাঁদের তো একটু আলাদা করে দেখতেই হবে। কারণ তখন তাঁরা শিল্প-সংস্কৃতির অংশ হয়ে যান, মানুষের বিনোদন-সৃষ্টি বা অভিকরণ (‘পারফরম্যান্স’) প্রক্রিয়ার অংশ। গ্রামে ও নগরে সর্বত্রই তাঁদের উপস্থিতি, নগরে হয়তো তাঁদের নিয়ে সংগঠিত বাণিজ্যও চলে, জন গে-র বেগার্স অপেরা থেকে ব্রেশ্টের থ্রি পেনি অপেরাতে যেমন দেখানো হয়েছিল, এ সংকলনের একজন লেখকও তাঁর উল্লেখ করেছেন।

দুই

আসল বিস্ময়ের কথা হল, এই বিষয় নিয়ে আস্ত একটি গ্রন্থ প্রস্তুত করেছেন সিরাজ সালেকীন, এই গ্রন্থের সম্পাদক।  এর আগে তাঁর সম্পাদিত উলুখাগড়াতে এর কিছু প্রবন্ধ বেরিয়েছিল, পরে সংকলনে আরও কিছু যোগ করা হয়েছে। এবং বাঙালি পাঠক (ধরে নিচ্ছি তাঁদের অধিকাংশই ভিক্ষাজীবী নন, পাঠকদের মধ্যবিত্ততার নিম্নসীমা আমরা স্বতঃসিদ্ধ ধরে নিই), এক নতুন ধরনের ‘অপর’ বিষয়ে এই গ্রন্থটি পেয়ে চমকিত হবেন। সাহিত্যে অবশ্য পড়ি তাঁদের কথা, ন্যুট হ্যামসুনের ক্ষুধাতে (কহঁঃ ঐধসংঁহ : ঐঁহমবৎ) যেমন, বা মানিকের ‘প্রাগৈতিহাসিক’-এ। তবু যাঁদের আমরা বাস্তব জীবনে খানিকটা এড়িয়ে চলতে চাই, তাঁদের কথা কি আমরা বিদ্যায়তনিক দিক থেকেও জানতে বুঝতে চাই বা না? সম্পাদক আর তাঁর লেখকেরা যেন এই প্রশ্ন নিয়েই তাঁদের লেখাগুলি লিখেছেন, সকলেই অপরিসীম যত্ন আর আন্তরিকতা নিয়ে। 

কিছু রচনা বিবরণ বা আবিষ্কারধর্মী, বিশেষ স্থানের বিশেষ ব্যক্তি বা সম্প্রদায়বদ্ধ ভিক্ষুকের কথা ও গান। যেমন মাসুদুল হকের ‘দদি মোহনের গান’, নাসির হোসেনের ‘মজমা : প্রতিবন্ধী পথশিল্পীর গান’, শারফিন শাহের ‘গ্রামাঞ্চলে ভিক্ষার গান’, জাবেদ ইকবালের কুষ্টিয়া জেলার, শংকর কুমার মল্লিক ও সদানন্দ মণ্ডলের বৃহত্তর খুলনার বা খুলনা অঞ্চলের, শামসুল আরেফীনের চট্টগ্রামের, মো. আঙ্গুর হোসেনের নেত্রকোনার ভিক্ষুকের গান সম্বন্ধে রচনাগুলো। সন্দীপন ধরের সমীক্ষা একটু ব্যাপক, তিনি ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলের ভিক্ষুকের গানের পর্যালোচনা করেছেন। পটভূমি বিস্তার, গানের নমুনা ছাড়াও কোনোটিতে জীবনদর্শন, মৃত্যুচিন্তা ইত্যাদি নিয়ে আলোচনা আছে। আমরা জানি, এবং এইসব লেখাগুলো থেকেই জানা যাবে যে, ভিক্ষুকদের নিজস্বতায় চিহ্নিত যেসব গান, যেগুলোতে ভিক্ষা বা দান করলে আল্লাহ্/ভগবান দাতাকে পার্থিব-অপার্থিব কত কী দেবেন তার তালিকা থাকে সেগুলো ছাড়াও নজরুলের ইসলামি গান বা রামপ্রসাদের শ্যামাসংগীত ইত্যাদি ভিক্ষুকেরা ব্যবহার করেন।  বাউল-মুরশিদি-মারফতি তো অন্য প্রণালির অন্তর্গত।   

গ্রন্থের পঞ্চম নিবন্ধ সাইম রানার ‘মাধুকরীর গান’ থেকে পরের বেশ কয়েকটি নিবন্ধ­বিদ্যুৎ সরকার (‘ভিক্ষার সুর, গীতসম্ভাবনার উপেক্ষিত বয়ান’), মো হাবিবুর রহমান (‘ভিক্ষার গান ও ভিক্ষাকেন্দ্রিক লোকাচার’), কনক আমিরুল ইসলাম (‘ভিক্ষাবৃত্তি বা মাঙনের গান’), শামসুজ্জামান মিলকী, হুমায়ুন আজম রেওয়াজ, মহিউদ্দীন জাহাঙ্গীর, মো. আব্দুর রশীদ, সাকার মুস্তাফা, হাসান রাকিবের লেখাগুলো তত্ত্ব ও বস্তু মিলিয়ে পূর্ণাঙ্গতর গবেষণার রূপ নিয়েছে, এবং এগুলোতে পাঠকের দিগন্ত ব্যক্তি বা আঞ্চলিকতার বাইরে অনেকখানি বিস্তারিত হয় বলে এই আলোচকের বিশ্বাস। প্রচুর গান, কোথাও কোথাও স্বরলিপি, অজস্র সুমুদ্রিত আলোকচিত্র এই সংকলনটিকে একটি আকরগ্রন্থের মর্যাদা দিয়েছে। সম্পাদকের ভূমিকাটি বিদগ্ধতার সাক্ষ্য বহন করে।  তিনি ভিক্ষাবৃত্তির সাংস্কৃতিক ইতিহাস স্মরণ করেছেন, অর্থনৈতিক ভিত সন্ধান করেছেন, এবং আশা করেছেন যে, ‘সমাজ পাল্টাবে, তৈরি হবে নতুনতর মানবসম্পর্ক।’

আমরাও সেই স্বপ্ন দেখি।  গ্রন্থটির প্রকাশে প্রকাশক যত্ন নিতে ত্রুটি রাখেননি।