এক কবির কাব্যিক উদ্ভাসন

সৌভিক রেজা

কলহবিদ্যুৎ – আলতাফ শাহনেওয়াজ – কবিতাভবন, চট্টগ্রাম – ঢাকা, ২০১৯ – ১৩৪ টাকা

তিরিশের অন্যতম প্রধান কবি বিষ্ণু দে মনে করতেন, ‘কাব্যের ব্যক্তিগত উচ্ছ্বাসের প্রাবল্যের চেয়ে ব্যক্তি-সমাজের নিহিত ভাষাবিনিময়ের আততিই হচ্ছে আধুনিক কবিতার মৌলিক লক্ষণ।’ বলা যায়, অনেকটা এই সূত্র অনুসরণ করেই আলতাফ শাহনেওয়াজের বইয়ের পাঠ শুরু করেছিলাম। আলতাফের কোনো কবিতার বই এর আগে কখনো পড়িনি। কিন্তু তাঁর কবিতা বিভিন্ন দৈনিকের সাহিত্য-পাতায়, বিভিন্ন সাহিত্য-পত্রিকায়, কখনো-কখনো ফেসবুকেও পাঠ করেছি। কেউ-কেউ বলে থাকেন, কবিতার বই ছাড়া একজন কবিকে সাধারণভাবে বিচার করা কঠিন। কথাটা কখনো-সখনো ঠিকই; তবে সবসময় নয়, সবার বেলায় নয়। সাময়িকপত্রে যিনি নিয়মিত লেখেন এমন কবিকে যদি নিবিড়ভাবে অনুসরণ করা যায়, তবে তাঁর কবিতার মৌলিকতা (যদি থেকে থাকে) শনাক্ত করা খুব কঠিন কিছু নয়। আলতাফের কবিতা সেভাবে শনাক্ত করা গেছে। বলা যায়, আলতাফের কবিতার মেজাজ ও মনোবীজ সেই শনাক্তকরণ প্রক্রিয়ায় পাঠককে উদ্যমী করেছে। আর সেই সাহসে ভর দিয়ে এ-ও বলা যায় : আলতাফের কবিতার বই এই প্রথম হাতে নিয়েও আমরা কেউ-কেউ অন্তত তাঁর কবিতার নতুন পাঠক নই। আলতাফকে নতুন কবি বলে অভিহিত করাটাও শোভন হবে না। কেননা ১৯৮১ সালে জন্ম যে-কবির আর যাঁর প্রথম কবিতার বই ২০১১ সালে প্রকাশিত হয়েছে, তাঁকে তরুণ কবিও কি আমরা বলতে পারি?

দুই
আলতাফের কবিতা পাঠ করে এই বই সম্পর্কে প্রথমে যে-কথাটি বলতে ইচ্ছে হয়, সেটি হলো : তাঁর কবিতা জীবনকে নিবিড়ভাবে স্পর্শ করার কবিতা। অন্তত সেই চেষ্টাটাই যেন কবি এই বইয়ের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত করে গেছেন। অমিয় চক্রবর্তী তাঁর একটি কবিতায় যেমনটি করে বলেছিলেন : ‘জীবন,
জীবন-মোহ,/ ভাষাহারা বুকে স্বপ্নের বিদ্রোহ’ -; সেই কথাকটির সারবত্তা অনুসরণ করেও একেবারে নিজেরই ধরনে বলেন :
কেউ আসবে না
বসে থাকা কেন?
গোধূলির দেশে
ছিল আলো-লতা
দিন শেষে গ্রহে
মুছে গেল কথা
কালিমা আমার
লোকালয়ে জাগে … (‘কুহক’)
এটুকু পাঠ করে মনে হয়, অসীম গানে কাঁপন দিয়ে শুধু নিজের সত্তাকেই নয়, পাঠকের অস্তিত্বের ভিতটাকেও নাড়িয়ে দেন আলতাফ। অন্তত সে-সামর্থ্য যে তাঁর আছে সেটি জানান দিতে ভোলেননি। আমাদের তো মনে হয় নিজের-নিজের সামর্থ্যকে কাব্যিকভাবে প্রকাশ করার নামই কবিত্ব। অমিয় চক্রবর্তীর কথা আগেও একবার বলেছি, আরো-একবার বলি : ‘মাটি, ধরণী, বসুন্ধরা যে-নামেই হোক ভূমিস্পর্শ অভিযানই আমার স্বপ্রকাশ’, আলতাফের কবিতার মধ্যেও সে-রকম একটি প্রত্যয়ের প্রকাশ দেখতে পেয়ে ভারি ভালো লাগল। ভালো লাগল তার কারণ শুধুই তাঁর একার নয়, সামনে যে আমাদের কবিতায় নতুন দিন আসছে – এই আশায় অন্তত বুক বাঁধতে পারা যায়। রবীন্দ্রনাথের গানে গলা মিলিয়ে কেউ হয়তো গেয়েও উঠবেন : ‘অসীম ধন তো আছে তোমার … হাসির কলরবে।’ আলতাফ শাহনেওয়াজের কবিতা আমাদের নানাভাবে এক গানের জগতে, সুরের জগতে, সংগীতের ধারার দিকে নিয়ে যায়। স্পষ্ট করে আমরা বলতে পারি – তাঁর কবিতার শব্দে, ভাষায়, ছন্দে রয়েছে এক অন্তর্লীন সংগীতসম্ভার। এটা আলতাফের কবিতার একটি বড় সম্পদ। এই সম্পদের অধিকারী হতে পারাটা যথেষ্ট পরিশ্রম আর অধ্যবসায়শীলতার ফলাফল। সে-কারণে সবার পক্ষে তা আয়ত্ত করা কঠিন। আত্মসচেতন হতে না-পারলে আজকের কবির পক্ষে নতুন কোনো পথে চলতে পারাটা এক অসম্ভব ব্যাপার। এ-বিষয়ে আলতাফ পুরোপুরি সচেতন।

তিন
আলতাফ তাঁর এই সচেতন মনোভাবকে ছড়িয়ে দেন না, বরং প্রচ্ছন্ন রাখেন। কবির কাজই হচ্ছে তাঁর আবেগকে প্রচ্ছন্ন রাখা। আলতাফের ‘বিবর’ কবিতাটি সেই প্রচ্ছন্নতার এক সার্থক উদাহরণ –
আর লিখব না। পুরাতন লেখাজোখা ঘুমিয়ে গেলে
এবার হাঁটা দিতে হবে সীমান্তে, বাঁশঝাড়ের দিকে, খোলা
রামদা হাতে।
আমার অতীত থেকে আমিই বের হয়ে আসি,
বর্তমান আমার চোখের ভেতর আমাকে
রাখে না! ভাঙা দুপুরের সাজে
বিচূর্ণ নিজেকে বাঁচাতে আমাকেই করব খুন –
গভীর মসৃণ কোনো আয়না তেড়ে আসছে বাস্তুভূমিতে;
স্তব্ধ। জাগরিত নিদ্রায় চোখ মেলে
তাই না-লেখাও লিখব না – গল্পের মতো অনিশ্চয়তা
ঘুমিয়ে আছে লাইনের ভেতর
শুধুই যে প্রচ্ছন্নতা তা কিন্তু নয়, সেইসঙ্গে বলতে হয় এই কবিতা তাঁর আত্মপ্রত্যয়েরও এক অনবদ্য নমুনা। কবিতার এই পুরো বইটি দাঁড়িয়ে রয়েছে কবিতার আত্মপ্রত্যয় আর শিল্পকুশলতার ওপর ভর দিয়ে। এরকম কবিতা এই বইতে দেখতে পেয়ে আনন্দিত হই; কেননা, পাঠক হিসেবে আমরাও তো কবির এই আত্মপ্রত্যয়ের অংশীদার।

চার
এই বইয়ের নাম-কবিতাটি সবশেষে স্থান পেয়েছে। দীর্ঘ একটি কবিতা। কবিতাটি শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত বারবার যেন টি এস এলিয়টের দ্য ওয়েস্টল্যান্ডকে মনে করিয়ে দেয়। কিন্তু আলতাফের এই কবিতার নিজস্ব একটি তাৎপর্য ও শক্তি রয়েছে বলেই তাঁর এ-বিষয়ে লজ্জিত হওয়ার কোনো কারণ দেখি না। বিদেশের এডগার অ্যালান পো থেকে আমাদের বাংলা ভাষার কোনো-কোনো কবি দীর্ঘ কবিতাকে ইতিবাচকভাবে দেখতে চাননি। প্রণবেন্দু দাশগুপ্তের মতো কবিও বলেছিলেন, ‘আমারও কখনো কখনো … মনে হয় দীর্ঘ কবিতায় একটি ছোট কবিতাকে ফুলিয়ে-ফাঁপিয়ে বড়ো করে দেওয়া হয়, বা দীর্ঘ কবিতা শুধু কয়েকটি ছোট কবিতার যান্ত্রিক সংযোজন।’ পশ্চিমের রাইনের মারিয়া রিলকে থেকে টি এস এলিয়ট-ইয়েটস কিংবা আমাদের রবীন্দ্রনাথ-জীবনানন্দ-বিষ্ণু দে প্রমুখ কেউই এরকম কথা ঠিক মানতে চাইবেন না। কেননা, দীর্ঘ কবিতা যদি জীবনের গভীর উদ্ভাসন আর উপলব্ধিকে উপমা, চিত্রকল্পে আর কাব্যিক উপকরণে নিজেকে প্রকাশ করতে পারে, তাহলে তাতেও কবির সিদ্ধি অর্জন সম্ভব – এমনকি আজকের দিনেও। বিশিষ্ট সমালোচক অশ্রুকুমার সিকদার তো মনে করতেনই যে, ক্রান্তদর্শী কবি যিনি, তাঁর অন্তত খণ্ড কবিতার সিদ্ধি নিয়ে তুষ্ট থাকা মানায় না। আলতাফের এই কবিতাটির শেষাংশটুকু যেন ঘুরেফিরে প্রথম অংশে নিয়ে যায়, প্রথম অংশ নিয়ে যায় মধ্যভাগে। কবিতাটি যেন পাঠককে চক্রাকারে ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে অস্থির করে তোলে। সুস্থির হওয়ার সামান্যতম অবকাশ দিতে চায় না। বর্তমান সময়টা কি আমাদের একটুও সুস্থিরতা দেয়?
তাহলে কবি ও তাঁর কবিতার কাছ থেকেই কেন শুধু সুস্থিরতা আশা করব আমরা? শেষাংশটিই একটু উদ্ধৃত করি :
যাব,
রোগশয্যার উৎসবে, চিকিৎসাবিজ্ঞানে
দূরে বসে
হাসি নিয়ে মরে যাব।
দেশে দেশে হাসব মরে মরে,
গলাগলি করে সদা কাঁদব একটু পর;
উদ্বেগে, নিদ্রায়
নিঃস্ব
নিরীহ কলহ-বৈদ্যুতিক,
জগতে বাস্তব
স্বপ্নে এসেছিল

         ফিরে গেছে এসে ...

‘আর ঘুমের ভেতর নিঃস্ব স্বপ্ন’। তাতে কবি ভেঙে পড়েন না। কেননা তিনি জানেন : ‘ভাষা ডুবে যাওয়ার পর যা কিছু থাকে/ সেটুকু কান্নার মতো – মারণাস্ত্র।’

পাঁচ
শিল্পের মতো শরীরে কবিতার মতো মারণাস্ত্র যে-কবির হাতে, এই জীবনে তাঁর কীসের ভয়? ভোগান্তির? তা সে যতই আসুক, আলোর গভীরে গিয়ে কবি আত্মস্থ হতে জানেন। যে-কবির জীবনের বাস্তব আর স্বপ্ন যখন দু-হাত ধরাধরি করে এগিয়ে যায়, সেই কবির পক্ষেই সম্ভব বাস্তবের দীর্ঘতম চূড়ায় উঠে তার মুখোমুখি হওয়া। আমাদের এই বিশ্বাস আছে যে, ‘কলহবিদ্যুতে’র কবি হারতে পারেন, কিন্তু কখনো পালাতে জানেন না।