যুদ্ধের আড়ালে আরেক যুদ্ধের গল্প

আদনান সৈয়দ
যুদ্ধের আড়ালে যুদ্ধ : ১৯৭১-এ ‘গঙ্গা’ হাইজ্যাক হয়েছিল – হাসান ফেরদৌস – ইত্যাদি গ্রন্থ প্রকাশ  ঢাকা, ২০১৯  ১৮০ টাকা

২০২১ সালে আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধ অর্ধশত বছরে পা দিতে যাচ্ছে। পঞ্চাশ বছর বয়স সময়ের হিসাবে মোটেও কম সময় নয়; কিন্তু গুরুত্বের দিক থেকে বাঙালি জাতির কাছে একাত্তর সালের প্রতিটি দিন এবং ক্ষণ ঐতিহাসিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ। ১৯৭১-এর দীর্ঘ নয় মাসের যুদ্ধের ফসল আজকের বাংলাদেশ নামের একটি স্বাধীন ভূখণ্ড। এই ভূখণ্ড লাভ করতে যেমন অনেক রক্তক্ষয় হয়েছে, পাশাপাশি এই যুদ্ধের আড়ালেও হয়েছে অন্যরকম আরেক যুদ্ধের ইতিহাস। সে-যুদ্ধ কখনো ছিল কূটনৈতিক, কখনো তা সংঘটিত হয়েছিল বাংলা থেকে বিবর্জিত সম্পূর্ণ ভিন্ন আলো-হাওয়ায় ভিনদেশের কোনো মাটিতে। যুদ্ধ বলতে আমরা আমাদের মানসপটে যে-ধারণাটি লালন করি তা হলো একটি দেশের সঙ্গে আরেকটি দেশের প্রত্যক্ষ যুদ্ধ। বলার অপেক্ষা রাখে না যে, প্রত্যক্ষ যুদ্ধকে আমরা স্পষ্ট করে দেখতে পাই; কিন্তু কূটনৈতিক যুদ্ধকে আমরা দেখতে পাই না। সে-যুদ্ধটি চলে মূল যুদ্ধের সমান্তরালভাবে খুব কৌশলে। সে-যুদ্ধে পৃথিবীর বিভিন্ন বড় বড় পরাশক্তি অংশগ্রহণ করে। সে-যুদ্ধে যোগ দেয় জাতিসংঘ, যোগ দেয় বিশ্বের বড় বড় কূটনীতিক। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধও ঠিক এমনি একটি যুদ্ধ, যে-যুদ্ধে গোটা পৃথিবীর পরাশক্তিগুলো দুটো ভাগে বিভক্ত হয়ে পড়েছিল। একটি পক্ষ ছিল বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে, আরেকটি ছিল পশ্চিম পাকিস্তানের পক্ষে। যুক্তরাষ্ট্র, চীন পশ্চিম পাকিস্তানের পক্ষে, আবার ভারত, সোভিয়েত ইউনিয়ন নিয়েছিল বাংলাদেশের পক্ষে। সেই কূটনৈতিক যুদ্ধেও বাংলাদেশের জিত হয়েছিল। কিন্তু কীভাবে তা সম্ভব হয়েছিল! সে আরেক বিরাট ইতিহাস। সেই ঐতিহাসিক ঘটনাগুলো এই গ্রন্থের মূল নির্যাস। আরেকটি বিষয় হলো, বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে এবং বিপক্ষে বাংলাদেশের বাইরেও পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে অনেক জনমত তৈরি হয়েছিল। অনেক অচেনা-অজানা শান্তিপ্রিয় মানুষ খুব নীরবে আমাদের মুক্তিযুদ্ধে তাদের সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিয়েছিলেন। অথচ যথাযথ প্রচার এবং অজ্ঞতার কারণে তাদের অনেকের নাম-ঠিকানা আমরা তেমন ভালো করে জানিও না। লেখক হাসান ফেরদৌস মুক্তিযুদ্ধের পেছনের সেই ঐতিহাসিক ঘটনার ওপর আলো ফেলেছেন এবং তা সুনিপুণভাবে গ্রন্থের পাতায় চিত্রিত করে বিপুল দক্ষতার সঙ্গে তা ফুটিয়ে তুলেছেন। তাঁর সম্প্রতি প্রকাশিত যুদ্ধের আড়ালে যুদ্ধ : ১৯৭১-এ ‘গঙ্গা’ হাইজ্যাক হয়েছিল গ্রন্থটি এরই উজ্জ্বল স্বাক্ষর বহন করছে।
এবার গ্রন্থের ভেতর প্রবেশ করা যাক। মোট ৯৫ পৃষ্ঠার এ-গ্রন্থে আটটি প্রবন্ধ স্থান পেয়েছে। প্রবন্ধগুলো হলো ১) ১৯৭১-এ ‘গঙ্গা’ হাইজ্যাক হয়েছিল, ২) একাত্তরের সোভিয়েত বন্ধু, ৩) ‘পদ্মা’ অবরোধ, ৪) একাত্তর ও জাতীয় মুক্তি আন্দোলন, ৫) একাত্তরের সহযোদ্ধা, ৬) পাকিস্তানের হাতে রক্তের দাগ, ৭) আর্চার ব্লাড : একটি শ্রদ্ধাঞ্জলি এবং ৮) বিস্মৃতির বিরুদ্ধে লড়াই। গ্রন্থে সন্নিবেশিত সবকটি প্রবন্ধই মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন কিছু ঐতিহাসিক ঘটনার বয়ান। গ্রন্থটির নাম দেখে বুঝতে অসুবিধা হওয়ার কথা নয় যে, লেখক ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ বিষয়কে ধারণ করে এই গ্রন্থের অবতারণা করেছেন। লেখক হাসান ফেরদৌসের ভাষা ঝরঝরে। তিনি মূলত প্রবন্ধ লেখেন এবং তাঁর লেখার একটি অন্যতম দিক হলো অনেক কঠিন এবং জটিল বিষয়কেও তিনি সাবলীলভাবে এবং অনেক সরলভাবে পাঠকের সামনে উপস্থাপন করেন, যে-কারণে হাসান ফেরদৌসের লেখা পাঠকের কাছে সুখপাঠ্য হতে বাধ্য হয়। আমাদের আলোচ্য এ-বইটিও এর ব্যতিক্রম নয়। গ্রন্থটিতে সংযুক্ত প্রতিটি প্রবন্ধের বিষয় বেশ কূটনৈতিক এবং একই সঙ্গে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকে প্রভাবিত করে লেখা। লেখক অনেক মুন্শিয়ানার সঙ্গে এই জটিল বিষয়গুলোকে সহজ-সরল ভাষায় পাঠকের সামনে উপস্থাপন করেছেন। এটি লেখকের যেমন একটি নিজস্ব গুণ, পাশাপাশি পাঠকের জন্যও তা এক পরম পাওয়া।
এবার গ্রন্থের প্রবন্ধগুলোর ওপর চোখ রাখা যাক। বেশ বোঝাই যায়, গ্রন্থের প্রথম প্রবন্ধ ’১৯৭১-এ ‘গঙ্গা’ হাইজ্যাক হয়েছিল’ শিরোনামটি বইটির নামকরণের জন্য উপশিরোনাম হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছে। এ-প্রবন্ধের মূল বিষয়ও বেশ তাৎপর্যপূর্ণ। ১৯৭১ সালে আশরাফ কুরেশি ও তাঁর চাচাতো ভাই হাশিম কুরেশি ‘গঙ্গা’ নামে ভারতীয় এয়ারলাইন্সের একটি ফকার ফ্রেন্ডশিপ বিমান শ্রীনগর থেকে হাইজ্যাক করে লাহোরে নিয়ে যায়। এই বিমান হাইজ্যাককে কেন্দ্র করেই এই প্রবন্ধের সূত্রপাত। কেন এই বিমানটি হাইজ্যাক হয়েছিল? এর পেছনে কী ভারতীয় গোয়েন্দা বিভাগ ‘র’-এর পরোক্ষ কারসাজি ছিল, নাকি কাশ্মিরের স্বাধীনতা-আন্দোলনকে বেগবান করতে এটি করা হয়েছিল? ঘটনা যাই থাকুক না, পরবর্তী সময়ে দেখা যায় এই বিমান হাইজ্যাকের কারণে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ অনেকাংশে উপকৃত হয়েছিল। শুধু তাই নয়, এই হাইজ্যাকের কারণে ভারত এবং পাকিস্তানের মধ্যে কূটনৈতিক সম্পর্কে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ প্রভাব পড়েছিল। ১৯৭১ সালের ৪ ফেব্রুয়ারি ভারত সরকার তাদের আকাশসীমার ওপর দিয়ে পাকিস্তানি বিমান চলাচলের ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করে। এর ফল হিসেবে ’৭১-এর যুদ্ধে পশ্চিম পাকিস্তানের সামরিক বিমানকে ভারতের আকাশসীমা পেরিয়ে পূর্ব পাকিস্তানে চলাচল করতে ব্যাপক সমস্যার সম্মুখীন হয়। হাসান ফেরদৌস লিখছেন,
পশ্চিম পাকিস্তানের সাথে যদি পূর্ব পাকিস্তানের সরাসরি যোগাযোগ ব্যাহত হয়, তাহলে শেখ মুজিবুর রহমানের হাত আরো শক্ত হয়, একথাও বলা শুরু হয়। (পৃ ২৫)
সুখপাঠ্য এবং চমৎকার এ-প্রবন্ধটি আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধের আড়ালে এক অসাধারণ ঘটনাকে মূলত তুলে ধরা হয়েছে। আমরা জানি, এমন অনেক ঐতিহাসিক ঘটনা রয়েছে যা প্রকৃত চর্চা এবং তথ্যের অভাবে অনেক সময় আমাদের দৃষ্টির আড়ালেই থেকে যায়। সন্দেহ নেই, লেখক হাসান ফেরদৌস আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসের তল থেকে এই দলিলগুলো একজন ঝানু ডুবুরির মতোই আমাদের জন্য তুলে এনেছেন।
‘একাত্তরের সোভিয়েত বন্ধু’ প্রবন্ধটি মেজাজের দিক থেকে একটু ভিন্ন। গোটা প্রবন্ধটিই একটি যুদ্ধের আড়ালে আরেক যুদ্ধের গল্প। সে-যুদ্ধটি কূটনৈতিক যুদ্ধ। ’৭১ সালে যুদ্ধ চলাকালীন যুক্তরাষ্ট্র ও চীন প্রত্যক্ষভাবে পশ্চিম পাকিস্তানের পক্ষ নেয়। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকে ভিন্ন খাতে প্রবাহিত করতে এই দেশদুটো অন্যরকম ষড়যন্ত্রে নিজেদের যুক্ত করে। সে-সময় জাতিসংঘে সোভিয়েত ইউনিয়নের স্থায়ী প্রতিনিধি ছিলেন ইয়াকফ মালিক এবং ভারতের জাতিসংঘের স্থায়ী প্রতিনিধি বাঙালি কূটনীতিক সমর সেন বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে তাঁদের বক্তব্য তুলে ধরেন এবং বাংলাদেশের ন্যায়সংগত দাবির প্রতি অকুণ্ঠ সমর্থন জানান। যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থান, চীনের পশ্চিম পাকিস্তানের পক্ষাবলম্বন এবং একই সঙ্গে ভারত ও সোভিয়েত ইউনিয়নের বাংলাদেশের পক্ষ নেওয়া – সব মিলিয়ে ঘটনাগুলো অসাধারণ প্রাঞ্জল ভাষায় এ-প্রবন্ধের প্রতিটি শব্দে ফুটে উঠেছে। জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে বাংলাদেশের কোনো প্রতিনিধি যাতে বক্তব্য রাখতে না পারেন, সেজন্য যুক্তরাষ্ট্র ও পশ্চিম পাকিস্তান তাদের সর্বশক্তি নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল। বাংলাদেশের প্রতিনিধিকে বিতর্কে অংশগ্রহণের পক্ষে জোরালো যুক্তি দেখিয়ে ভারতের রাষ্ট্রদূত সমর সেন বলেছিলেন,
বাংলাদেশকে বাদ দিয়ে এই প্রশ্নে আলোচনা হবে প্রিন্স অব ডেনমার্ককে বাদ দিয়ে হ্যামলেট নাটকের অভিনয়। (পৃ ৪৪)
গভীরভাবে লক্ষ করলে দেখা যাবে, আলোচিত গ্রন্থে অন্তর্ভুক্ত প্রতিটি প্রবন্ধেরই নিজস্ব একটি স্বাতন্ত্র্য রয়েছে; কিন্তু একই সঙ্গে প্রতিটি প্রবন্ধ যেন গভীরভাবে একে অপরের সঙ্গে যুক্তও। যে-কারণে গ্রন্থের প্রতিটি নিবন্ধ ঐতিহাসিকভাবেই গুরুত্বপূর্ণ। আরেকটি প্রবন্ধ ‘পদ্মা অবরোধে’র দিকে দৃষ্টি দেওয়া যায়। ’৭১-এ বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ তখন তুঙ্গে। পশ্চিম পাকিস্তান তাদের সেনাবাহিনী দিয়ে বাংলাদেশে বর্বর হত্যাকা- ঘটিয়ে যাচ্ছে। অথচ এই হত্যাকা-ের পেছনে অর্থায়ন এবং অস্ত্র দিয়ে সহযোগিতার পেছনের মূল হোতা যুক্তরাষ্ট্র। ২৫ মার্চের পর পাকিস্তান সেনাবাহিনীকে অস্ত্র দিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের সব ধরনের সহযোগিতার খবর পত্রপত্রিকায় ছাপা হচ্ছে। ঠিক এমন একটি ঘটনাকে কেন্দ্র করেই ‘পদ্মা অবরোধ’ নিবন্ধের অবতারণা। জানা যায়, ১৯৭১ সালের ১১ জুলাই ‘পদ্মা’ নামের একটি পশ্চিম পাকিস্তানি জাহাজ যুক্তরাষ্ট্রের বাল্টিমোর বন্দরে নোঙর করার কথা ছিল। উদ্দেশ্য যুক্তরাষ্ট্র থেকে অস্ত্র বোঝাই করে জাহাজটি ফের পাকিস্তানের উদ্দেশে রওনা দেবে। কিন্তু বাল্টিমোরের সাধারণ মানুষ এ-খবর জেনে যায়। ফিলাডেলফিয়ায় আমেরিকান ফ্রেন্ডস সার্ভিস কমিটি রিচার্ড টেইলারের নেতৃত্বে এ-বিষয়ে একটি সিদ্ধান্তে পৌঁছে। তারা পরিকল্পনা আঁটে, ছোট ছোট ডিঙি নৌকা দিয়ে সবাই মিলে ‘পদ্মা’ নামে জাহাজটি অবরোধ করবে এবং বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের প্রতি তাদের নৈতিক সমর্থন জানাবে। তারপর অনেক ঘটনাই ঘটেছে। ডিঙি নৌকা দিয়ে যথারীতি ‘পদ্মা’কে ঘিরে ফেলা হলো। যদিও বিষয়টি অনেকটাই প্রতীকী, তারপরও এ-ঘটনা গোটা যুক্তরাষ্ট্রের সংবাদমাধ্যমে বেশ গুরুত্ব দিয়ে ছাপা হয়েছিল এবং যুক্তরাষ্ট্রের সাধারণ মানুষ এতে উদ্বুদ্ধ হয়ে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের প্রতি একাত্মতা প্রকাশ করেছিল। অন্যায়ের প্রতিবাদ যে-কোনো দেশ থেকেই করা যায়। যুক্তরাষ্ট্রের সাধারণ শান্তিকামী মানুষও পশ্চিম পাকিস্তানের অন্যায় এবং একই সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের ভূমিকা নিয়ে প্রতিবাদ করেছিল, যার ফলে যুক্তরাষ্ট্র কংগ্রেস পশ্চিম পাকিস্তানকে এই অবৈধ অস্ত্র সরবরাহ যেন না করতে পারে সে-আইন পাশ করে।
১৫ জুলাই যুক্তরাষ্ট্রের কংগ্রেসের বৈদেশিক সম্পর্ক কমিটি উদ্বাস্তু ভারত থেকে স্বদেশে প্রত্যাবর্তন করার আগে পাকিস্তানকে সব ধরনের সামরিক ও অর্থনৈতিক সহযোগিতা বন্ধের প্রস্তাব অনুমোদন করে। (পৃ ৫৯)
একইভাবে ‘একাত্তর ও জাতীয় মুক্তি আন্দোলন’ আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ নিবন্ধ। একটি দেশ যখন যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ে, তখন সেই দেশটির জন্য অন্য কোনো দেশের স্বীকৃতি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হিসেবে ধরা হয়। আর সেই দেশটি যদি কোনো বড় পরাশক্তি হয় তাহলে তো কথাই নেই। বাংলাদেশে যখন যুদ্ধ চলছে, সে-সময় এই যুদ্ধ যে একটি জাতীয় মুক্তি আন্দোলন তা সর্বপ্রথম উল্লেখ করে সোভিয়েত ইউনিয়ন। সন্দেহ নেই, ভারত ও সোভিয়েত ইউনিয়নের সমর্থন পাওয়ার কারণে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ অনেক বেগবান হয়েছিল। সোভিয়েত ইউনিয়ন ও ভারত কীভাবে, কেমন করে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধকে জাতীয় মুক্তি আন্দোলন বলে গণ্য করেছিল লেখক হাসান ফেরদৌস এ-গ্রন্থে তা অত্যন্ত নিপুণভাবে তুলে এনেছেন।
১৯৭১ সালের ১২ ডিসেম্বর, বাংলাদেশ যখন স্বাধীনতাপ্রাপ্তির দ্বারপ্রান্তে, মুক্তিযুদ্ধে মরণপণ লড়াইয়ে লিপ্ত এই দেশটির প্রতি তাঁর দেশের সংহতি প্রকাশ করে এ কথা বলেছিলেন জাতিসংঘে সোভিয়েত ইউনিয়নের স্থায়ী প্রতিনিধি ইয়াকফ মালিক। সেই প্রথম কোন আন্তর্জাতিক ফোরামে সোভিয়েত ইউনিয়ন বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ যে একটি জাতীয় মুক্তি আন্দোলন, তার আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি দেয়। (পৃ ৬০)
এভাবে প্রতিটি প্রবন্ধ ধরে ধরে আলোচনা করা যেতে পারে। তবে সবচেয়ে বড় যে বিষয়টি আমার কাছে মনে হয়েছে, গ্রন্থটিতে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট অনেক ঐতিহাসিক ও গুরুত্বপূর্ণ উপাদান অত্যন্ত সুন্দর আর নিখুঁতভাবে বর্ণিত হয়েছে, যে-কারণে গ্রন্থের প্রতিটি প্রবন্ধই সুখপাঠ্য এবং একটি প্রবন্ধ পড়া শুরু করলে তা আর শেষ না করে ওঠার উপায় থাকে না। অনেক সময় মনে হয়েছে, আমি বুঝি বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ওপর সাদা-কালোয় নির্মিত একটি তথ্যচিত্র দেখছি। এখানেই লেখকের কৃতিত্ব।
এ-ধরনের গ্রন্থ বাংলাদেশ থেকে আরো অনেক বেশি প্রকাশিত হওয়া প্রয়োজন। আমাদের স্বাধীনতা অর্জনের দীর্ঘ পঞ্চাশ বছরেও মহান মুক্তিযুদ্ধ এবং সেই যুদ্ধের আড়ালের নানা রকম ঐতিহাসিক ঘটনাকে কেন্দ্র করে অনেক তথ্য এখনো আমাদের অগোচরে রয়ে গেছে। আমাদের পরবর্তী প্রজন্ম যেন মুক্তিযুদ্ধের সঠিক ইতিহাস তাদের আত্মায় লালন করতে পারে এবং মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকেও সমানভাবে ধারণ করতে পারে, তখন যুদ্ধের আড়ালে যুদ্ধ : ১৯৭১-এ ‘গঙ্গা’ হাইজ্যাক হয়েছিল এই ধরনের গ্রন্থগুলো পাঠ খুব জরুরি হয়ে পড়ে।
লেখক এবং প্রাবন্ধিক হাসান ফেরদৌসকে অভিনন্দন এবং সাধুবাদ এমন একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ের ওপর আলো ফেলার জন্য। বাংলাদেশ যখন স্বাধীনতার পঞ্চাশতম জন্মবার্ষিকী উদ্যাপনকে সামনে রেখে বিভিন্নরকম প্রস্তুতি নিচ্ছে, ঠিক সে-সময়ে এ-গ্রন্থটি আমাদের অনেকের মনে নতুন করে কিছু খোরাক জোগাবে।
গ্রন্থের প্রকাশক ইত্যাদি গ্রন্থ প্রকাশকে ধন্যবাদ। এ-ধারা অব্যাহত থাকুক। সুন্দর এবং পরিচ্ছন্ন প্রচ্ছদটি করেছেন মামুন হোসাইন।