এডওয়ার্ড সাঈদের প্রাচ্যভাবনা

এডওয়ার্ড সাঈদ চলে গেলেন। কিছুটা আকস্মিক হলেও তাঁর মৃত্যুর জন্যে অনেকেই প্রস্তুতই ছিলেন। তাঁর দেহে দীর্ঘদিন থেকে কর্কট রোগ বাসা বেঁধেছিল। ১৯৭৮ সালে বেরিয়েছিল তাঁর সেই সাড়া জাগানো, দুনিয়া কাঁপানো গ্রন্থ ওরিয়েন্টালিজম। সেই থেকে ২০০৩ সাল-এই পঁচিশ বছরে আমাদের চিন্তার ভুবনে তিনি মহীরুহের ছায়া বিলিয়ে গেছেন। প্রাচ্যকে তিনি যে অন্তর্দৃষ্টি দিয়ে দেখেছেন, তা-ই যে একেবারে নিরঙ্কুশ, একথা অনেকে হয়তো মানেনইনি; ভিন্নমতের আধিপত্যটা একটা প্রায় দুর্ভেদ্য বলয় সৃষ্টি করেছিলো বলেই তো সাঈদের মধ্যে অমন মননভূমি গড়ে উঠেছিলো। জন্মসূত্রে তিনি প্যালেস্টাইন, লেখাপড়া করেছেন কায়রোতে, আর তারপর ওই বিদ্যাচর্চার অভিপ্রায়ে সেই যে গেলেন পাশ্চাত্যের নতুন দুনিয়া-মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে, সেখানেই অভিবাসন ঘটলো তাঁর। একে স্বেচ্ছা-পরবাস বলেই সংজ্ঞায়িত করা যায়। কিন্ত্ত প্রবাসের মধ্যে যে পেলব অতীতচারিতা বা রোমান্টিকতা থাকে, তার কোনো সংক্রমণ ঘটেনি সাঈদের রচনায়। এবং তা যে তিনি শুধু সৃজনধর্মী লেখক নন বলেই নয়, একথা যে-কোনো যতœবান পাঠক সহজেই অনুধাবন করতে পারেন।     আলাদা অথচ নিজস্ব একটা জন্মভূমির ব্যক্তিক বৃত্তটা তাঁকে আবেগিক শিহরণে কতটা আলোড়িত করতো তার সাক্ষ্য তেমনভাবে প্রবল হয়ে ওঠেনি তাঁর রচনায়। কারণ দৈশিক সীমানা অতিক্রম করার মানসজাত এমন সব রসদ সঞ্চিত হয়েছিলো তাঁর নিরন্তর ভাবনায় যে, জ্ঞঘরে-ফেরারঞ্চ আকাঞ্ঝজা কোনো ব্যাকুল ধ্বনি সৃষ্টি করতে পারেনি। অন্যদিকে গভীর অধ্যবসায় নিয়ে ইতিহাস, নৃ-তত্ত্ব, শিল্পকথা ও সমাজবিজ্ঞানের পাঠ তাঁর মধ্যে গড়ে তুলেছিলো এক অতুলনীয় ও অভূতপূর্ব বিশ্লেষণী ধারা যা ফেলে যাওয়া

ভূগোলের প্রতি ফিরে চাওয়ার চেয়ে ইতিহাসের পথ ধরে পর্যবেক্ষণের তাত্ত্বিক গবেষণায় তাঁকে প্ররোচিত করেছিলো। পাশ্চাত্যের যে নয়া ঔপনিবেশিক কেন্দ্রে তিনি নিজেকে স্থিত করেছিলেন, অধ্যয়নে ও অধ্যাপনায় সেখান থেকেই তিনি স্ব-ভূমির দূরত্বটা অনেক ভালোভাবে পরিমাপ করতে পেরেছেন, বুঝতে পেরেছেন কোন দৃষ্টিতে এরা তাকায় অন্যদের প্রতি। ইউরোপ এবং আমেরিকার উপনিবেশবাদী দৃষ্টিভঙ্গির মধ্যে যে নিজস্ব গরিমাবোধ ত্র্কিয়াশীল, তা থেকেই তাবৎ জ্ঞঅন্যজনরাঞ্চ যে নি¤œবর্গীয় এমন যোগফল-বিয়োগফল অনিবার্য হয়ে ওঠে-এই বোধ এডওয়ার্ড সাঈদের মধ্যে দানা বেঁধে ওঠে। স্বদেশের বেদনাগান তাঁর অন্তরে বাজে; তিনি ইতিহাসের আর্বতে অসহায় মানবগোষ্ঠীর আর্তি শুনতে পান। প্রতœতাত্ত্বিকের সকল সুখ ছিলো তাঁর, তাই ইতিহাসের কানাগলি পরিক্রমণে তিনি পারঙ্গম। রাজনৈতিক আধিপত্যবাদী উপনিবেশবাদের বাস্তব সংকোচন যে নয়া বিশ্বব্যবস্থা সৃষ্টি করছে, তার মধ্যেও এশীয় দেশগুলোর প্রতি সেই পুরানো জ্ঞবর্ণবাদীঞ্চ দৃষ্টিভঙ্গি অক্ষুণ্ন থেকে যায়। এই বোধের তাড়নায় সাঈদ তন্নতন্ন করে খুঁজে বের করেন উপনিবেশবাদীদের প্রাচ্যকাহিনী; উপস্থাপন করেন এক অবিস্মরণীয় প্রাচ্যভাবনা।

এইসব প্রাচ্যকাহিনীর রচয়িতাবৃন্দ তাদের সমগোত্রীয় পাঠককুলের জন্যই লিখেছেন উপন্যাস, তাদের অভিজ্ঞতার বিবরণী। প্রাচ্য মানে মায়ার খেলা, তেপান্তরের মাঠ পেরিয়ে কুহক ছায়া-এমন একটা ধারণা বেশ জনপ্রিয় হয়ে উঠেছিলো। এই ধারণার মধ্যে একটা বিস্ময়ের ঘোর আছে, কৌতূহলের হালকা নেশা আছে। কিন্ত্ত এইসব বিবরণীর অন্তর্ভুক্ত হয়ে যায় নিন্দাকথনের প্রচ্ছায়া। মূল যে বার্তাটা পাঠকের কাছে পৌঁছে যায় তা হলো, প্রাচ্যের মানুষেরা দীন-হীন, পশ্চাৎপদ। নানা সংস্কারের জাল বিছানো তাদের সমাজচিত্রে, তারই মধ্যে মানুষ বেড়ে ওঠে। তারা যুক্তির পথ দিয়ে হাঁটে না, ভালোবাসে মোহের আবেশ। এই যে প্রাচ্য, এডওয়ার্ড সাঈদ বলতে চাইছেন, তা হলো ইউরোপীয় বা উপনিবেশবাদীদের নিজস্ব সৃজন বা আবিষ্কার। এ যেন এক আলাদা জগৎ, কল্পকথার জন্মভূমি। এই ধারণার বাইরে প্রাচ্যের যে বাস্তব ও বহতা জীবন আছে, তা দেখে পাশ্চাত্যের অনেক পর্যটক আবার হা-হুতাশ করেন; ঐতিহ্য যেন ধসে পড়ছে, এমন বেদনার সুর ঝরে পড়ে তাদের লেখায়। প্রাচ্য সম্পর্কে এই যে ধারণা, তা গড়ে উঠেছে কাল পরম্পরায়।

এডওয়ার্ড সাঈদ তাঁর প্রাচ্যভাবনায় যে কেন্দ্রীয় সত্যের ওপর জোর দিয়েছেন তা হলো, প্রাচ্যের সীমানা ও সংজ্ঞাও উপনিবেশবাদীরা তাদের নিজস্ব প্রয়োজন ও বিবেচনায় বিনির্মাণ করেছেন। আর এই প্রাচ্য বা ওরিয়েন্ট যেহেতু ভৌগোলিক বিচারে অনতিদূর এবং এই বিস্তীর্ণ ভূ-ভাগের অনেকাংশই ইউরোপীয় উপনিবেশের অন্তর্ভুক্ত ছিল, তাই পাশ্চাত্য মানসে এইসব দেশ নিয়ে আলাদা একটি অভিজ্ঞতার ভুবন গড়ে উঠেছিলো। এসব দেশের ছিলো অনেক সম্পদ, আর সেসব নির্বিচার লুটপাটের মধ্য দিয়েই ইউরোপের আধুনিক অর্থনীতির ভিত মজবুত হয়ে উঠেছিলো। কিন্ত্ত সম্পদ আহরণ করতে এসেই পাশ্চাত্য মানুষেরা নতুন করে আবিষ্কার করলো যে, এসব দেশের ভাষা, জ্ঞান-বিজ্ঞান, সাহিত্য-সংস্কৃতির বিপুল ও সগৌরব ভা-ার। তাদের মনে হলো সভ্যজীবন ও সংস্কৃতির পরিচর্যায় এই প্রাচ্য ব্যাপক অর্থেই তাদের যোগ্য প্রতিযোগী। যদিও সেকথা স্বীকার করার মানসিকতা তারা হারিয়ে ফেলেছে। ইউরোপ যে এই প্রাচ্য থেকে নিয়েছে অনেক কিছু, তা তো আর বাস্তব অর্থে নাকচ করা যাবে না। আবার, উপনিবেশ বিস্তারের সূত্রে তারা তো প্রাচ্যভুবনের শাসক ও হর্তাকর্তা। এই ক্ষমতাই তাদের উচ্চমার্গীয় স্তরে সংস্থাপিত করেছে। উপনিবেশের বাসিন্দাদের শাসন করার জন্যেই তাদের বুঝিয়ে দেয়া দরকার যে, শাসকশ্রেণি শুধু বন্দুকের ক্ষমতায় ও গাত্রবর্ণেই তাদের চেয়ে উঁচুশ্রেণির মানুষ নয়, সভ্যতা ও সংস্কৃতির মানদ-েও তারা অনেক বড়সড়। এভাবেই উচ্চম্মন্যতার এবং তাত্ত্বিকভাবে জ্ঞভিন্নতারঞ্চ সংস্কৃতি গড়ে ওঠে, আর ওরিয়েন্ট বা প্রাচ্য নামে একটা সুবিশাল বলয় সৃষ্টি হয়। উপনিবেশবাদীদের নিজস্ব ও বাস্তব সুবিধার্থেই স্বীকৃত হয়ে যায় বিবিধ সীমানা, নিকটপ্রাচ্য, পশ্চিম এশিয়া, মধ্যপ্রাচ্য, এশিয়া মাইনর, দূরপ্রাচ্য, ইন্দোচীন, ইন্ডিয়া ইত্যাকার প্রাচ্যবিভাগ। বৈচিত্র্যের সৌন্দর্য ও ঐশ্বর্যকে গণ্য না করে শাসকের দৃষ্টি খুঁজে ফেরে এক অভিন্ন মানদ-, আর তা হলো তথাকথিত আঞ্চলিক পশ্চাৎপদতা। এই দৃষ্টিই যুগ যুগ ধরে প্রাচ্যের স্থাপত্য সৃষ্টি করেছে পাশ্চাত্যবাসীর উপভোগের জন্য। এডওয়ার্ড সাঈদ এই দৃষ্টিভঙ্গিকে শনাক্ত করেছেন তাঁর বিপুল পঠনের শ্রমে ও প্রাচ্যবাসীর আহত গৌরববোধ নিয়ে। তিনি উপনিবেশবাদকেই চিহ্কিত করেছেন প্রাচ্যের এমন পরিকল্পিত ও খ-িত পাঠের প্রধান উপাদান হিসেবে। তাই তিনি যেসব রচনার উল্লেখ করেছেন, তার সিংহভাগই ইংরেজি ও ফরাসিদের লেখা। প্রাচ্যের নিজস্বতা এবং পাশ্চাত্যের দৃষ্টিতে এই বিশাল অঞ্চলের (তাদের ভাষায়) অর্থনৈতিক অনুন্নয়ন ও আবার প্রতীচ্যের একটা ভিন্নতর এবং উন্নততর ভাবমূর্তি সংগঠনে সাহায্য করেছে। এর মাধ্যমে প্রাচ্যতত্ত্বও গড়ে উঠেছে তাদেরই ভাবনার সূত্র ধরে। উপন্যাস লেখা হয়েছে। এইসব উপন্যাসের পাত্রপাত্রীরা প্রাচ্যদেশীয়, তাদের সঙ্গে হয়তো শ্বেতবর্ণী চরিত্রের দেখা হয়, কথা হয়, কিন্ত্ত প্রাচ্যের মানুষেরা শুধু তাদের প্রণেতাদের ভাবনার অগ্রাধিকার বিবেচনায় আচরণ করে। অর্থাৎ তারা কখনোই তাদের নিজেদের প্রতিনিধিত্ব করে না। উপনিবেশবাদীদের চোখে যা বর্ণনীয় মনে হয়েছে, তারই প্রকাশ ঘটেছে। ভ্রমণকাহিনী বা আত্মজৈবনিক রচনার নানা প্রকরণেও তা ফুটে উঠেছে। এইসব রচনার বর্ধিত কলেবর ধীরে ধীরে পাশ্চাত্য মানসে এমন এক ধারণাকে দিন দিন সংহত করে তুলেছে যে, ওরিয়েন্টালিজম বলতে যে তত্ত্ব আমরা বুঝি তার অনেকটা কাঁচামালই ব্যবহূত হয়েছে এইসব রচনা থেকে। সাঈদ এই বিষয়টাকে নানা তথ্য সহযোগে উপস্থাপন করেছেন, বোঝাতে

চেয়েছেন কিভাবে বিপুলসংখ্যক ইউরোপবাসীর প্রাচ্য সম্পর্কে কোন প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা ছাড়াই কত ভিন্নতরভাবে তাদের মধ্যে নিরন্তর প্ররোচনামূলক প্রাচ্যভাবনা অনুপ্রবেশ করেছে এবং এইভাবে এই ধারণা তাদের ভিন্নমাত্রিক মনস্তাত্ত্বিক অনুশীলনে সহায়তা করেছে।

উপনিবেশবাদের সঙ্গে যেমন রাজনৈতিক তথা অর্থনৈতিক লাভালাভের প্রশ্ন প্রত্যক্ষভাবে জড়িত, তেমনি এই স্বার্থবোধ সংরক্ষণ ও বিস্তারে সাংস্কৃতিক চিন্তাধারার একটা তত্ত্বগত বৃত্ত রচনাও অনিবার্য হয়ে ওঠে। হীনম্মন্যতার আবহকে যতই দীর্ঘতর করা যাবে শাসনের দৈর্ঘ্যও ততই দক্ষতার সঙ্গে বাড়ানো যাবে। প্রাচ্যে নিজেদের আর্থিক বা বাস্তব স্বার্থরক্ষায় রাজনীতির খেলায় নানা কৌশল গৃহীত হয়েছে। সাঈদ এই পরিপ্রেক্ষিতকে নির্দেশ করেছেন, কিন্ত্ত প্রাচ্যভাবনাকে তিনি সাংস্কৃতিক ধারার সংযোজন-বিয়োজন ও সংঘাত হিসেবে দেখেছেন এবং এর প্রকৃতি বিবেচনায় পাশ্চাত্য দৃষ্টিভঙ্গির বৈশিষ্ট্যকেই তিনি চিহ্কিত করতে চেয়েছেন। রাজনীতি, অর্থনীতি এবং সময়নীতি প্রাচ্যের ধারণায় নানা উপাদানের যোগসাধন করেছে এবং তার মাধ্যমে এই বিশাল ভূখ- নিয়ে ইউরোপীয় ও পরবর্তীকালে আমেরিকানদের মধ্যে বিবিধ ঔৎসুক্যের সৃষ্টি হয়েছে এবং এসবের সম্মিলনে প্রাচ্যভাবনার একটা মূর্ত রূপ গড়ে উঠেছে।

সাঈদের মতে, ওরিয়েন্টালিজম যদিও পাশ্চাত্যবাসীর এক নিজস্ব আবিষ্কার, কিন্ত্ত এর প্রকাশ ঘটেছে বহুমাত্রিক যোজনায়। এই ভাবনা যেমন শুধুই রাজনৈতিক বিষয় নয়, তেমনি তা শুধু বিভিন্নজনের রচনায় প্রতিফলিত প্রাচ্য সম্পর্কিত বিবরণীর সমাহারও নয়। প্রাচ্য সম্পর্কে কৌতূহল জ্ঞান-বিজ্ঞানের শাখা বিস্তারে সহায়তা করেছে, নানা প্রতিষ্ঠানেরও জন্ম হয়েছে এ কারণে। কিন্ত সাঈদ একথা বলার চেষ্টা করেননি যে এসবের মাধ্যমে সর্বদাই সুপরিকল্পিতভাবে প্রাচ্যকে হেয়প্রতিপন্ন করার উদ্যোগ নেয়া হয়েছে।

সাম্রাজ্যবাদ ও সংস্কৃতিচিন্তার বিষয়টাকে সাঈদ দুই দিক থেকে দেখেছেন। তিনি বলছেন, ঊনবিংশ শতক বা তার আগের লেখকরাও সাম্রাজ্যবাদী বিস্তার সম্পর্কে অবহিত ছিলেন। ঊনিশ শতকের প্রধান কয়েকজন লেখকের নাম তিনি উল্লেখ করেছেন, যেমন-জন স্টুয়ার্ট মিল, আর্নল্ড, টমাস কার্লাইল, নিউম্যান, মেকলে, রাসকিন, জর্জ এলিয়ট এবং ডিকেন্স। এঁদের সকলেরই বর্ণবাদ ও সাম্রাজ্যবাদ বিষয়ে পরিণত ও সুষ্পষ্ট ধারণা ছিল, তাঁদের লেখায় সেসবের প্রতিফলন লক্ষ করা গেছে। জন স্টুয়ার্ট মিল বেশ কিছুকাল ইন্ডিয়া অফিসে কর্মরত ছিলেন। তিনি তাঁর দুটি বই ঙহ খরনবৎঃু এবং জবঢ়ৎবংবহঃধঃরাব এড়াবৎহসবহঃ-এ এমন সতর্কবাণী উচ্চারণ করেছেন যে, বিবৃত বিষয়াবলি ভারতের ক্ষেত্রে ব্যবহার করা যাবে না, কারণ সভ্যতার দিক থেকে এই দেশটি অনেক পিছিয়ে রয়েছে। দ্বিতীয় গুরুত্বপূর্ণ যে বিষয়টি সাঈদ বলতে চেয়েছেন তা হলো- জ্ঞএটা ঠিক যে, সাহিত্য রচনা, বিদ্যাচর্চা ও ইতিহাস প্রণয়নে সাম্রাজ্যবাদী ভাবধারা ব্যাপক প্রভাব বিস্তার করে, কিন্ত্ত তার মানে এই নয় যে, এই প্রভাব অনিবার্যভাবেই সংস্কৃতির অবক্ষয় সাধন করে। বিপরীত দিক থেকে এমন ভাবনাই সঙ্গত যে, উপনিবেশবাদীদের বিরোধিতা এবং একই সঙ্গে শাসিত জাতিসমূহ বিষয়ে তাদের বুদ্ধিবৃত্তিক কৌতূহল অনেক সময়ই স্বদেশী লেখক ও গবেষকদের তাদের স্বরূপ-অন্বেষণে বিশেষভাবে সাহায্য করতে পারে।ঞ্চ সাঈদের এই উদারপন্থী মন্তব্য আমাদের জন্য বিশেষভাবে প্রণিধানযোগ্য। আমরা ঊনবিংশ শতাব্দীর বাংলাদেশের মেট্রোপলিটন বিদ্যাচর্চার কথা উল্লেখ করতে পারি। পাশ্চাত্যের অভিঘাতে আমাদের সমাজে তখন নানা ভাঙন সৃষ্টি হয়েছে। ইংরেজিয়ানার প্রতি আকর্ষণ কোনো কোনো ক্ষেত্রে বিকৃতির জন্ম দিলেও তার মাধ্যমে সমাজে উদার মতবাদের বিস্তার যেমন ঘটেছে, তেমনি স্বদেশকে নতুনভাবে আবিষ্কারের একটি অনুপ্রেরণাও পাওয়া গেছে একই সূত্র থেকে। রামমোহন রায় এবং ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর সমাজ ও সংস্কৃতির ধারায় যে উদারপন্থা সূচনা করার ব্রতে নিজেদের উৎসর্গ করেছিলেন তার পেছনে সাম্রাজ্যবাদীদের প্রাচ্য সম্পর্কে ধারণার প্রভাব ছিল। অবশ্য পাশ্চাত্য শিক্ষার প্রত্যক্ষ অবদানকেও অস্বীকার করা যাবে না। মাইকেল মধুসূদনের সাহিত্যও এদিক থেকে খুবই উল্লেখযোগ্য উদাহরণ। ভিনদেশী হয়েও ডিরোজিও যে ইতিবাচক ভূমিকা পালন করেছিলেন সেখানেও উপনিবেশবাদের উপাদান শনাক্ত করা যায়। কিন্ত্ত উদ্বেগের বিষয় হলো, সাম্রাজ্যবাদী চিন্তাধারা শুধু এর মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকে না, তা মস্তিষ্কের কিছু অংশ দখল করে নেয় এবং তার মাধ্যমেই স্বদেশের যাবতীয় কীর্তি অবলোকনে প্ররোচিত করে। পক্ষান্তরে উপনিবেশবাদীদের দেশে তাদের সৃজিত ওরিয়েন্ট সম্পর্কে নিজস্ব প্রতিত্র্কিয়া আবর্তিত হতে থাকে।

ওরিয়েন্ট সম্পর্কে এই ভাবনার বিস্তার আবশ্যিকভাবেই ইংরেজি ও ফরাসি উপনিবেশের বিস্তারের সঙ্গে যুক্ত। সাঈদ আমাদের স্মরণ করিয়ে দেন ওরিয়েন্ট নিয়ে কৌতূহল ও নিজস্ব বক্তব্য কিন্ত্ত ইউরোপের চিন্তাজগতে সন্নিবেশিত হয়েছে বহুকাল আগে থেকেই। তাত্ত্বিক দৃষ্টিভঙ্গি গড়ে ওঠার সূত্রপাত ঘটেছে সেখান থেকেই। চসার, শেক্সপিয়ার, ম্যান্ডেভিল, ড্রাইডেন, পোপ এবং বায়রন প্রাচ্যের কথা উল্লেখ করেছেন। সাঈদ তাঁর আলোচনার প্রথমদিকেই হাউজ অফ কমন্সের একটি বিতর্কের প্রতি আমাদের মনোযোগ আকর্ষণ করেছেন। ১৯১০ সালের জুন মাসের ১৩ তারিখ। মিশরের বিষয়ে তখন আলোচনা চলছে। আর্থার জেমস ব্যালফুর নামে এক সদস্য অন্য আরেকজনের মন্তব্যকে আক্রমণ করে প্রশ্ন করছেন, জ্ঞযেসব মানুষজনকে নিজেদের ইচ্ছায় ওরিয়েন্টাল বলা হচ্ছে, তাদের সম্পর্কে মন্তব্য করতে গিয়ে উচ্চম্মন্যতার এই অধিকার আপনি কোথায় পেলেন?ঞ্চ তাঁর বক্তৃতায় ব্যালফুর বলেছিলেন, জ্ঞউচ্চম্মন্য মানসিকতার কোনো অবকাশ নেই। প্রাচ্যের দেশসমূহ সম্পর্কে শুধু ভাসাভাসা জ্ঞান থাকার জন্যই এমন মন্তব্য করা সম্ভব।ঞ্চ ইতিহাস যদি মনোযোগ দিয়ে পড়া যায় তবে দেখা যাবে, এঁরা অনেকেই অতীতে সভ্যতার উচ্চস্তরে পৌঁছেছিলেন। সাঈদ ব্যালফুরের বক্তৃতার বেশ দীর্ঘ অংশ উদ্ধৃত করেছেন এবং তার ভাবসম্প্রসারণ করেছেন।

সাঈদ তাঁর ওরিয়েন্টালিজমের আলোচনায় মিশরের কথা বারবার এনেছেন, আমরা যে অঞ্চলকে মধ্যপ্রাচ্য বলে চিনি তার উল্লেখ আছে। কিন্ত্ত সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, তিনি অনেকটা তার নিজের অভিজ্ঞতার অভিব্যক্তি ঘটানোর প্রচেষ্টায়, ইসলাম সম্পর্কে পাশ্চাত্যের দৃষ্টিভঙ্গির অসম্পূর্ণতা ও একদেশদর্শিতার কথা উল্লেখ করেছেন। প্রাচ্যভাবনার সঙ্গে ইসলাম বিষয়ে প্রতীচ্যের মনোভাব বিশ্লেষণ খুবই যৌক্তিক। কিন্ত্ত প্রাচ্যের বিশাল এলাকা তার ফলে বাইরে পড়ে থাকে। অবশ্য এই সীমাবদ্ধতাকে বড় করে দেখার কিছু নেই। তিনি পাশ্চাত্যের শতাব্দী-অতিক্রান্ত যেসব রচনা উল্লেখ করে তাদের প্রাচ্য সম্পর্কে ধারণার বিষয়াবলি বিশ্লেষণ করেছেন তার নিরিখেই উপনিবেশবাদী বা সাম্রাজ্যবাদী মনোভঙ্গির যথেষ্ট স্পষ্ট পরিচয় পাওয়া যায়। তাঁর মূল বক্তব্য হলো, প্রাচ্যভাবনা বলে যা পরিচিতি লাভ করেছে তার গোড়াতেই গলদ ছিল এবং উপনিবেশ বিস্তারের মাধ্যমে তা শুধু আরো ক্ষতিকর শক্তি ও ব্যাপকতা অর্জন করেছে। ওরিয়েন্টালিজম গ্রন্থের সমালোচনা করতে গিয়ে ঘথড়নক্ষৎনক্ষ পত্রিকায় লেখা হয়েছিলো, জ্ঞএ এক দারুণ উত্তেজনাবর্ধক, সুঠাম ও লড়াকু বই, যা আসলে কবুতরদের খোঁয়াড়ে বিড়াল ছেড়ে দেয়ার মতো ঘটনাঞ্চ। আমরা সবাই এই মন্তব্যের ভেতরের কথাটা বুঝতে পারি। সুদীর্ঘকাল ধরে প্রতীচ্যের মনোভাবের যে উচ্চম্মন্যতা প্রাচ্য সম্পর্কে ভাবনাকে সারা পৃথিবীতে (প্রাচ্যের দেশসমূহসহ) বিপণন করছিলো, তার ওপর এক সত্যিকারের বিশাল আকারের পণ্ডিতমন্য আঘাত হেনেছিলেন এডওয়ার্ড সাঈদ। পাশ্চাত্যের প-িতদের কথা যেন সর্বদাই সর্বজনমান্য হয়ে উঠেছিলো। ১৯৭৮-এ তখনো বহু ছোট ছোট উপনিবেশ ভালো করে মুক্ত বাতাসের স্বাদ নিতে যেন দ্বিধাগ্রস্ত, তেমন এক সন্ধিক্ষণে, উত্তর-ঔপনিবেশিক দ্রোহের এক অসামান্য দলিল রচনা করেছিলেন তিনি- যা একদিকে পশ্চিমা তাবড় তাবড় ঐতিহাসিককে লজ্জিত করেছে, অন্যদিকে প্রাচ্য বলে অভিহিত এই বিরাট অবহেলিত ভূ-ভাগের আত্মবিশ্বাস জাগাতে সাহায্য করেছে। সাঈদ পরবর্তীকালে আরো অনেক গ্রন্থ রচনা করেছেন, তাঁর অগ্রন্থিত রচনাসমূহ, বিভিন্ন সম্মেলনে প্রদত্ত ভাষণ ও টেলিভিশনের পর্দায় আলোচনা ইত্যাদি তাঁকে দুনিয়াময় খ্যাতি এনে দিয়েছে। বিশেষত তিনটি গ্রন্থ The Question of Palestive. After the Last এবং Ges Covering Islam বিপুল আলোড়ন সৃষ্টি করেছে। কিন্ত এইসব আলোচনার এক অনিবার্য সূত্র যেন গাঁথা আছে তাঁর ওরিয়েন্টালিজম গ্রন্থের সঙ্গে।

ভাবনা ও চিন্তার রাজ্যে উপনিবেশবাদী আধিপত্য বিষয়ে তাঁর মৌলিক ও যুগান্তকারী দৃষ্টিভঙ্গি আমাদের যুগপৎ বিস্মিত ও তাড়িত করে। তিনি পাশ্চাত্যের কেন্দ্রে বসেই এই বই লিখেছেন। তা কিন্ত্ত দুদিক থেকেই অর্থবহ। জায়নবাদের সবচেয়ে বড় পৃষ্ঠপোষক আমেরিকার কেন্দ্রে থেকে তিনি প্যালেস্টাইন আত্মপরিচয়ের যে শক্তিমত্তা প্রদর্শন করেছেন তা যেমন আমাদের মনোযোগ আকর্ষণ করে, তেমনি এই কেন্দ্রে বসতি তাঁর অন্য ধরনের সমঝোতার প্রতিই ইঙ্গিত করে। আরেকজন বিশ্বখ্যাত ভারতীয় তাত্ত্বিক আইজাজ আহমদ তাঁর আলোচনায় (Orientallsm and After) সাঈদের তীব্র সমালোচনা করেছেন, প্রধানত এই পাশ্চাত্য কেন্দ্র বেছে নেবার জন্য। আহমদ একথাও উল্লেখ করেছেন যে, তাঁর গ্রন্থে সাঈদ যে ভারতীয় পণ্ডিত রণজিৎ গুহের প্রসঙ্গ (Subaltern Studies) এনেছেন, তিনিও ভারতে ব্রিটিশ রাজ্যের চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের ফলে কৃষককুলের ওপর যে কুপ্রভাব সৃষ্টি হয়েছিলো- সে সম্পর্কে অত্যন্ত মূল্যবান পর্যালোচনা করার পর পাশ্চাত্য কেন্দ্রকেই নিজের পেশা ও বসবাসের জন্য নির্বাচন করেছেন। সাঈদ অবশ্য নিজেই একথা স্বীকার করেছিলেন। বলেছিলেন, জ্ঞপাশ্চাত্যে বিশেষ করে আমেরিকায় যে কোনো আরবীয় অথবা প্যালেস্টাইনের জীবন খুবই দুঃখের অভিজ্ঞতায় ভরপুর। বর্ণবাদ, সাংস্কৃতিক ধারার একমুখীনতা, রাজনৈতিক সাম্রাজ্যবাদ, মানবতাবিরোধী আদর্শবাদ তাদের এক কষ্টকর নিয়তির সঙ্গে জুড়ে দেয়।

সাঈদ তাঁর প্রাচ্যভাবনার সমর্থনে তিনজন বিশ্বখ্যাত চিন্তকের প্রসঙ্গ এনেছেন বারবার। এঁরা হলেন মার্কস (Marx), গ্রামসি (Gramsci) এবং ফুকো (Foucault)। তাঁর ভাবনাকে প্রতিষ্ঠিত করতে যেসব যুক্তির অবতারণা করেছেন, সেক্ষেত্রে এঁদের দর্শন তাঁকে বিশেষভাবে প্রভাবিত করেছে। সাঈদ তাঁর বিশ্লেষণের ধারায় দুই ধরনের বুদ্ধিজীবীদের নির্দেশ করেছেন, একদলকে তিনি বলেছেন উপনিবেশবাদী এবং অন্যদের উত্তর-উপনিবেশবাদী। ত্রিনিদাদের বিখ্যাত কম্যুনিস্ট লেখক ও বহুখ্যাত Black Jacobins গ্রন্থের প্রণেতা C.L.R. James-কে এবং আরেক সাড়া জাগানো বই The Arab Anakaning-এর প্রণেতা ঐতিহাসিক জর্জ এন্টোনিয়াসকে তিনি উপনিবেশবাদী লেখক বলে চিহ্কিত করেছেন, আবার মালয়েশিয়া ও ভারতের দুই বিখ্যাত বুদ্ধিজীবী আলাতাস এবং রণজিৎ গুহকে উত্তর-উপনিবেশবাদী বলে আখ্যায়িত করেছেন। অভিধার এমন বিশ্লেষণ নিয়ে কিছু বিতর্ক থাকতেই পারে, কিন্ত ১৯৭৮ সালে, যখন সারা বিশ্ব রিগ্যান আর থ্যাচারের তত্ত্বাবধানে রক্ষণশীলতার পক্ষে সারা পৃথিবী যুদ্ধংদেহী হয়ে উঠেছিলো, সেই ইতিহাসের সন্ধিক্ষণে, সমাজতন্ত্র-বিরোধিতা ও মার্কসবাদ-উত্তর বিশ্বব্যবস্থায় ঙৎরবহঃধষরংস বা সাঈদের প্রাচ্যভাবনা সত্যিই দুনিয়া কাঁপিয়ে দিয়েছিলো। আর আজ যখন বুশ আর ব্লেয়ারের সহিংস উন্মাদনা সভ্যতাকে প্রশ্নাকীর্ণ করে তুলছে, তখন সাঈদের প্রাচ্যভাবনার মর্মবাণী আমাদের জন্য গভীরভাবে প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠেছে।