বাংলা কবিতা সম্পর্কে আধুনিকতার বিষয়টি উত্থাপিত হলেই আমরা সাধারণভাবে তিরিশোত্তর তথাকথিত রবীন্দ্রপ্রভাবমুক্ত নব্য কবিতার কথা ভাবি। আমরা আরো ভাবতে অভ্যস্ত যে, যেহেতু ঊনবিংশ শতাব্দীতে বাংলা সাহিত্য সামগ্রিকভাবে ইংরেজি ভাষা ও সাহিত্যের সংস্পর্শে এসে নতুন সঞ্জীবনী-শক্তিতে উদ্বুদ্ধ হয়েছিল, অতএব বাংলা কবিতার ক্ষেত্রে আধুনিকতা বলে চিহ্নিত গুণাবলিও আধুনিক ইংরেজি কবিতার লক্ষণসমূহেরই প্রতিভাস মাত্র। অথচ ইতিহাসে দেখতে পাই যে, বাংলা গদ্যসাহিত্য ইংরেজি গদ্যের প্রত্যক্ষ প্রভাবে বিকশিত হলেও বাংলা কবিতার হাজার বছরের চলমান ও জাগ্রত ঐতিহ্য ছিল, আর বলাই বাহুল্য যে, চর্যাপদের মতো আধুনিক কবিতার লক্ষণযুক্ত রচনা যে-কোনো সময়ের যে-কোনো ভাষাতেই বিরল। সাধারণভাবে প্রচলিত ধারণার কারণেই আমরা হয়তো অনুধাবন করি না যে, বর্তমানকালের বাংলা কবিতায় আধুনিকতার যে-লক্ষণসমূহ প্রত্যক্ষ তা বহুলাংশেই তার নিজস্ব এবং তাতে বৈদেশিক প্রভাব যতটা বাহ্যিক ততটা আন্তরিক নয়। আজকের দিনের বাংলা কবিতার অবয়বে ও বক্তব্যে যে-আধুনিকতা পরিলক্ষিত হয় তাতে বহির্বিশ্বের প্রভাব থাকলেও তা দুই বিশ্বযুদ্ধজনিত অবক্ষয়ের সঙ্গে প্রত্যক্ষভাবে সম্পর্কিত নয়, বরং তা প্রকৃতপক্ষে এলিয়টের অব্যবহিত পূর্ববর্তী ও পরবর্তী সময়ের কবিকৃতির প্রভাবে তুলনামূলকভাবে অনেক গভীরভাবে প্রভাবিত। কেননা এই উপমহাদেশের সামাজিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক বিবর্তনে দুই বিশ্বযুদ্ধের প্রতিক্রিয়া ইউরোপীয়-অর্থে প্রাসঙ্গিক নয়। এ-কারণেই প্রথম ও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের অন্তর্বর্তীকালে ইংরেজি কবিতায় আধুনিকতার যে-আন্দোলন তার সঙ্গে বাংলা কবিতার আধুনিকতার সম্পর্ক গৌণ।
ইংরেজি কবিতায় আধুনিকতার যে-আন্দোলন সংঘটিত হয় বিংশ শতাব্দীর প্রারম্ভে, তার পুরোভাগে ছিলেন এলিয়ট, যদিও তাঁর চিন্তা-চেতনা, ব্যক্তিত্ব ও জীবনযাপনে কোনো আন্দোলন পরিচালনা করার মতো সাধারণ অনুষঙ্গসমূহ অনুপস্থিত ছিল। কিন্তু তবু ১৯২২ সালে প্রকাশিত ওয়েস্ট ল্যান্ড থেকে শুরু করে ১৯৪৩ সালে প্রকাশিত ফোর কোয়ার্টেট পর্যন্ত তাঁর বিচিত্র কবিকর্মের ভেতর দিয়ে তিনি ইংরেজি কবিতার ভাষা ও শৈলীতে বৈপ্লবিক পরিবর্তন এনে দিয়েছিলেন এবং এই পরিবর্তনের চিহ্নসমূহই এখনো পর্যন্ত কবিতায় আধুনিকতা বলে পরিচিত, যদিও এলিয়ট কখনোই নিজের পুনরাবৃত্তি করেননি, কেননা তাঁর বিশ্বাস ছিল যে, মহৎ কবি মাত্রেই ঐতিহ্যের অন্তর্গত থেকেই ঐতিহ্যকে অতিক্রম করেন, কিন্তু ঐতিহ্যের অনুসৃতি কখনোই পুনরাবৃত্তি নয় এবং যে-কোনো নতুনত্বই পুনরাবৃত্তির চেয়ে শ্রেয়। ওয়েস্ট ল্যান্ড প্রকাশনার সঙ্গে সঙ্গেই এলিয়ট আন্তর্জাতিকভাবে খ্যাতি অর্জন করলেও ১৯১৭ সালে প্রকাশিত দ্য লাভ সং অব জে আলফ্রেড প্রুফ্রকেই সর্বপ্রথম আধুনিকতার সমস্ত লক্ষণ প্রকৃষ্টরূপে পরিস্ফুটিত হয়ে ওঠে। পরবর্তীকালে বহুল পরিচিত এই কবিতা প্রকাশনার দীর্ঘকাল পূর্বে এলিয়ট এর একটি অনুলিপি তাঁর বন্ধু কনরাড আইকেনকে পড়তে দিয়েছিলেন। আইকেন কবিতাটি এজরা পাউন্ডকে দেখান। পাউন্ড কবিতাটি পড়ে তা পোয়েট্রি পত্রিকার সম্পাদক হ্যারিয়েট মনরোকে অর্পণ করেন। মনরোর কাছে কবিতাটি প্রকাশনার অপেক্ষায় কমপক্ষে একবছর পড়ে ছিল। কেননা মনরো তাঁর প্রচলিত কাব্যনিরিখে নিশ্চিত হতে পারেননি যে, রচনাটিকে কবিতা বলা যাবে কিনা।
কিন্তু তবুও এই প্রুফ্রকে উপনীত হয়েই যেন ইংরেজি কবিতায় পূর্ববর্তী সময় থেকে একটি নিশ্চিত ছেদ ঘটল এবং তা সম্ভব হয়েছে এলিয়ট ও পাউন্ডের যুগ্ম-প্ররোচনায়। ‘প্রুফ্রক অ্যান্ড আদার অবজারভেশানস্’ এ-নাম কবিতাটি ছাড়াও ‘প্রিলিউড’ ও ‘পোর্ট্রেট অব এ লেডি’র মতো সুচারু, নিপুণ ও পরিণত কবিকর্ম গ্রথিত ছিল। অতএব প্রুফ্রকের প্রকাশনার বছর, ১৯১৭ সালকেই বিংশ শতাব্দীর আধুনিক কাব্যবিপ্লবের যথার্থ লগ্ন বলে চিহ্নিত করা যায়। অষ্টাদশ শতাব্দীর প্রান্তবিন্দুতে (১৭৯৮) কোলরিজ ও ওয়ার্ডসওয়ার্থের প্রবর্তনায় এমনি একটি বিপ্লব সংঘটিত হয়েছিল লিরিক্যাল ব্যালাড্সের প্রকাশনার ভেতর দিয়ে। তাঁদের অষ্টাদশ শতাব্দীর পূর্বসূরিদের মতো এলিয়ট ও পাউন্ড কবিতার ভাষা ও শৈলীকে নতুন করে নির্মাণ করতে উদগ্রীব ছিলেন। ওয়ার্ডসওয়ার্থ ভেবেছিলেন যে, তিনি কবিতাকে মানুষের স্বাভাবিক নিত্যদিনের বাচনের কাছাকাছি নিয়ে যাবেন। অন্যদিকে এলিয়ট বিংশ শতাব্দীর আত্মস্বরূপের নির্যাস নিজের চৈতন্যে ধারণ করে এমন একটি ভাষা উদ্ভাবনের প্রয়াসী ছিলেন, যে-ভাষা একদিকে একজন শিক্ষিত মানুষের স্বাভাবিক বাচন হিসেবে ব্যবহৃত হতে পারে আবার অন্যদিকে উন্নাসিকতা বা গ্রাম্যতাকেও বর্জন করে চলে। ১৯১৯ সালে প্রকাশিত হলো ‘জেরোনশান’ যা পোয়েমস গ্রন্থে গ্রথিত ছিল। ‘জেরোনশান’ অন্তর্লীন সংহত ও শাসিত আবেগের ধ্যানী উচ্চারণ। এ-ধরনের কবিতা ইতিপূর্বে ইংরেজি ভাষায় রচিত হয়নি। ১৯২২-এ প্রকাশিত হলো ওয়েস্ট ল্যান্ড। এই দীর্ঘ কবিতাটি পাঁচটি পর্বে ‘কাব্যিক বিচ্ছিন্নতা’ বা ‘রেটরিক্যাল ডিসকনটিনিউইটি’র ধারণার অনুসরণে রচিত। আধুনিক পাশ্চাত্যের নাগরিক-অভিজ্ঞতার ফলে মানুষের যে-ভগ্ন খণ্ডিত চৈতন্যের উদ্ভব হয়েছে, এলিয়টের মতে, তারই নান্দনিক প্রকাশের উপযুক্ত ভাষা তিনি নির্মাণ করতে প্রয়াসী হয়েছেন বিচ্ছিন্ন কাব্যাংশে ও পরস্পর-বিপরীতধর্মী শৈলীর বিপ্রতীপ উপস্থাপনার মাধ্যমে। এতে কেবলমাত্র মহাকাব্যিক, শৌর্যময় অতীতের সঙ্গে ক্ষয়িষ্ণু, কীটদষ্ট ও ক্ষুদ্রতাক্লিষ্ট বর্তমানের বৈপরীত্যই উপস্থাপিত হয়নি, বরং একই সঙ্গে মানুষের নৈতিক অবনতি ও অবক্ষয়জনিত অনুর্বরতার ভয়াবহ চিত্রও অঙ্কিত হয়েছে অচিন্ত্যপূর্ব চিত্রকল্পের সমন্বয়ে। এলিয়টের বিশ্বাস যা-ই থাকুক না কেন, বিংশ শতাব্দীর নৈর্ব্যক্তিক শিল্পী হিসেবে তাঁর বিপুল সার্থকতার পরিচয় মেলে ১৯৪২ সালে প্রকাশিত ফোর কোয়ার্টেটে। চারটি অংশে বিভক্ত এই দীর্ঘ কবিতাটি বিভিন্ন সময়ে লিখিত হয় এবং ১৯৩৫ থেকে ১৯৪১ সালের মধ্যে এর অংশগুলো প্রকাশিত হতে থাকে। ফোর কোয়ার্টেট পুস্তকাকারে একসঙ্গে প্রকাশিত হয় ১৯৪৩ সালে, যার জন্যে ১৯৪৮ সালে তিনি নোবেল পুরস্কারে ভূষিত হন। পাউন্ডের সঙ্গে এলিয়ট ও ইয়েটসের যোগাযোগের কারণে ইংরেজি আধুনিক-কবিতা নানাভাবে প্রভাবিত হয়েছে, যার একটি হলো বাহুল্য বর্জন। উল্লেখ্য যে, ওয়েস্ট ল্যান্ডের মূল পাণ্ডুলিপি আটশ পঙ্ক্তিতে রচিত হলেও পাউন্ডের বিচার-অনুযায়ী এলিয়ট কবিতাটিকে ছেঁটে ৪৩৩ পঙ্ক্তিতে নিয়ে এসেছিলেন এবং এখন এই ছাঁটা ওয়েস্ট ল্যান্ডই আমাদের পরিচিত। লক্ষণীয় যে, আধুনিকতার প্রধানতম উদ্যোক্তা পাউন্ড কবিতাকে কীভাবে তির্যক, ঋজু ও বাহুল্যবর্জিত, প্রায় গাণিতিক বিশুদ্ধতার দিকে ঠেলে দিচ্ছিলেন।
রোমান্টিক-আন্দোলনের শতাব্দীকাল অতিবাহনের পরে বিংশ শতাব্দীর প্রথম দুই দশকের মধ্যেই ইয়েটস, এলিয়ট ও পাউন্ড – এই ত্রয়ীর প্রবর্তনায় কবিতার অন্তরঙ্গ ও বহিরঙ্গ বিপুলভাবে বদলে গেল। কিন্তু স্বকালের ও স্বদেশের বাস্তবতা থেকে তাঁদের শিল্প বিচ্ছিন্ন ছিল না, বরং তাঁদের কালের মানসভূমিকে বিশ্লেষণ করে তার নির্যাস থেকেই উৎসারিত হয়েছে তাঁদের আধুনিকতার শিল্পকর্ম। কাজেই মূলত তাঁদের জীবনদর্শনের সঙ্গে তাঁদের শিল্প একাত্ম ও সমান্তরালগামী এবং এ-কারণেই এই ত্রয়ীর প্রত্যেকের প্রতিটি উচ্চারণ প্রত্যেকের স্বীয় পরিমণ্ডলের প্রেক্ষাপটে প্রত্যয়ের আলোকে উদ্ভাসিত হয়ে ওঠে। ঊনবিংশ ও বিংশ শতাব্দীর পাশ্চাত্য জগৎ যে-রাজনৈতিক, সামাজিক ও অর্থনেতিক অভিজ্ঞতার ভেতর দিয়ে অগ্রসর হয়েছে সেই অভিজ্ঞতার সংকটময় কেন্দ্রে তাঁদের শিল্পের সমূহ উপস্থিতি। কাজেই তাঁদের শিল্প অভিনব হলেও তাতে কৃত্রিমতা অনুপস্থিত ছিল। বিষ্ণু দে ও অমিয় চক্রবর্তী-সম্পর্কে কি এ-কথা নিশ্চিতভাবে আমরা বলতে পারি?
এক্ষেত্রে আমাদের জন্যে লক্ষণীয় বিষয় এ-ই যে, আমরা যে-ধ্যান-ধারণাকে উদার ও মুক্ত লিবারালিজম বলে জানি এবং যাকে আধুনিকতার প্রধান চিহ্ন বলে ভাবি, এই তিন কবির কাব্যাদর্শ ও জীবনচেতনা তেমন কোনো মানসিকতা দিয়ে উদ্দীপিত হয়নি। ইয়েটসের ধারণা ছিল যে, সামন্ততন্ত্রের ধ্বংসের সঙ্গে-সঙ্গেই বিশুদ্ধ শিল্প বিপর্যস্ত হয়েছে প্রাকৃতজনের অশুভ হস্তক্ষেপে। অতএব নবরূপে শিল্পের সত্যিকার উদ্বোধনের জন্যে সর্বাধিক প্রয়োজন শিক্ষিত শ্রেণিসমূহের স্বৈরশাসন। অন্যদিকে এলিয়ট ছিলেন স্বঘোষিত অ্যাংলো-ক্যাথলিক এবং রাজতন্ত্রের একনিষ্ঠ সমর্থক। তিনি স্পষ্টভাবেই তৎকালীন মার্কিন সমাজকে লিবারালিজমের কীটদষ্ট বলে অভিহিত করেছেন। তিনি একটি আনুপূর্ব সামঞ্জস্যময় একমাত্রিকসমাজ এবং সর্বোপরি ধর্মীয় ঐক্যের আকাক্সক্ষা করেছিলেন, আর সে-ধর্ম হলো খ্রিষ্টীয় ক্যাথলিক ধর্ম। পাউন্ড প্রচার করেছিলেন যে, মার্কিনি বিপ্লবের যে-মর্মার্থ, তার প্রকৃত বাস্তবায়ন হচ্ছিল ফ্যাসিস্ট ইতালিতে, যেখানে তিনি স্থায়ীভাবে বসবাস করছিলেন। উল্লেখ্য যে, ১৯১৩ থেকে ১৯১৫ সাল পর্যন্ত তিনি পঞ্চাশোর্ধ অগ্রজ কবি ইয়েটসের ব্যক্তিগত সহকারী হিসেবে কাজ করেছিলেন এবং সে-সময় অগ্রজ কবির রচনাশৈলী-আধুনিকীকরণে পাউন্ডের গভীর অবদান ছিল। লক্ষণীয় যে, স্ব-স্ব ব্যক্তিত্ব, ঐতিহ্য ও চিন্তা-চেতনায় দুস্তর ব্যবধান থাকা সত্ত্বেও বিংশ শতাব্দীর প্রথমার্ধের ইংরেজি ভাষার এই তিন প্রধান কবিই বিশ্বাস করতেন যে, মানবসমাজের সামগ্রিক অগ্রগতি, নান্দনিক উৎকর্ষ ও সুকুমার শিল্পের বিকাশ ও
পরিপূর্ণতা অর্জনের জন্যে গণতন্ত্রের পরিবর্তে একটি শ্রেণিবিভক্ত, অবিমিশ্র কর্তৃত্বপরায়ণ (অথরিটেরিয়ান) এবং মূলত বিশুদ্ধ রক্তের ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠিত সমাজের গোড়াপত্তন করা প্রয়োজন। ১৯৩৩ সালের পরে এঁদের মধ্যে অন্তত দুজন নিজেদের ধ্যান-ধারণার পরিমার্জনা করলেও এই ত্রয়ীর মানবসমাজের গতি ও পরিণতি-সম্পর্কিত মূল বিশ্বাসের ভিত্তি ছিল একই এবং তা হচ্ছে এই যে, পুরুষার্থের দিক থেকে শিল্প ও গণতন্ত্র দুই পরস্পরবিরোধী মেরুতে অবস্থান করে। পরবর্তীকালে এই ধারণা-প্রকাশে এলিয়ট কেবলমাত্র তাঁর ভাষা সামান্য পরিবর্তন করেছিলেন মাত্র : (I incline to believe that no true democracy can maintain itself unless it contains different levels of culture.) ‘আমি মোটামুটিভাবে এই বিশ্বাস করি যে, বিভিন্নস্তরে ভিন্ন-ভিন্ন সংস্কৃতি ধারণ করতে সমর্থ না হলে কোনো সত্যিকার গণতন্ত্রই টিকে থাকতে পারে না।’
প্রণিধানযোগ্য বিষয় হচ্ছে এই যে, যে-আধুনিকতার অনুষঙ্গে আমরা বাংলাদেশে প্রগতিবাদ, বুদ্ধির মুক্তি ও উদারনৈতিক চিন্তা-চেতনার কথা ভাবি, ইংরেজি কবিতার ক্ষেত্রে সেই আধুনিকতার উদ্গাতাগণ কিন্তু কখনোই উদারতায় অনুপ্রাণিত ছিলেন না। আমাদের কবিতা তথা সাহিত্যের আধুনিকতার কেন্দ্রে যে-উদারনৈতিক মানবিক মূল্যবোধের অবস্থান তার শিকড় এই দেশেরই সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের গভীরে প্রোথিত। এই উদারতা ও আপামর মানুষের হিতৈষণার যে-চিত্তবৃত্তি ও মূল্যবোধ তার ধারা আমাদের প্রাচীনকালের বৌদ্ধকৃষ্টি ও পরবর্তীকালের ইসলামের প্রচার থেকে শুরু করে শ্রীচৈতন্য, রামকৃষ্ণ পরমহংস ও রামমোহনের শিক্ষার ভেতর দিয়ে রবীন্দ্র-নজরুল পর্যন্ত প্রসারিত ছিল এবং এই চেতনার ধারাই আমাদের আধুনিক কবিতার অন্তস্থল দিয়ে ফল্গুর মতো এখনো প্রবাহিত হচ্ছে।
প্রকৃতপক্ষে তিরিশোত্তর বাংলা কবিতার অবয়বে ও অন্তরঙ্গে যে-বিবর্তন ঘটেছে তার ওপরে এক ইয়েটস ছাড়া এই ত্রয়ীর আর কারো তেমন উল্লেখযোগ্য প্রভাব পড়েনি। সবচেয়ে কম প্রভাবিত করেছেন পাউন্ড, যাঁর তির্যকতা, স্বল্পকথন ও গীতলতার অভাব আমাদের স্বাভাবিক প্রবণতার পরিপন্থি। এলিয়টের প্রায়োগিক প্রভাব কেবলমাত্র অমিয় চক্রবর্তী ও বিষ্ণু দে-র ওপরেই পড়েছিল। তিরিশের ও তৎপরবর্তী কবিদের মধ্যে সম্ভবত এই দুজনই প্রকরণের দিক থেকে এলিয়টের নিকটতম শিষ্য, যদিও অনুমান করা যায় যে, বুদ্ধদেব বসু তাঁর সমালোচনার নৈর্ব্যক্তিকতা ও বিশ্লেষণী প্রবণতা হয়তো অনেকাংশে এলিয়টচর্চা থেকেই অর্জন করেছিলেন, কিন্তু তাঁর রচিত কবিতায় এলিয়টের তথা এই আধুনিক ত্রয়ীর কোনো প্রভাবই পড়েনি। লক্ষণীয় যে, অমিয় চক্রবর্তী ও বিষ্ণু দে তাঁদের অন্যান্য সমসাময়িকদের তুলনায় বাংলা কবিতায় এমন কোনো উৎসারণ ঘটাতে পারেননি, যা পরবর্তী-প্রজন্মে সঞ্চারিত হয়েছে। বিদ্বান কবি হিসেবে হয়তো অমিয় ও বিষ্ণু উভয়ের ওপরই এলিয়টের প্রভাব প্রত্যক্ষ ছিল। কিন্তু বিষ্ণু দে বা অমিয় চক্রবর্তীর কবিতায় ভারতীয় শাস্ত্রের ও দর্শনের প্রতিফলনের সঙ্গে এলিয়টের গুটিকয় সংস্কৃত শব্দ ও বাক্যাংশের ব্যবহারের তুলনা চলে না। এলিয়ট ১৯১৪ থেকে ১৯১৯ সাল পর্যন্ত হার্ভার্ডে চার্লস ল্যানম্যানের কাছে সংস্কৃত ভাষা ও ভারতীয় দর্শন অধ্যয়ন করলেও ভারতীয় দর্শনের ঔদার্য তাঁকে স্পর্শ করেনি। বরং স্পষ্টতই দেখা যায় যে, ওয়েস্ট ল্যান্ড বা ফোর কোয়ার্টেটে এলিয়ট এক ধরনের ধ্বনির তরঙ্গ-বিক্ষেপের খাতিরেই সংস্কৃতের রণিত শব্দ ও বাক্যাংশকে ব্যবহার করেছেন। কোনো গভীর বিশ্বাস বা প্রত্যয় থেকে ওগুলো তাঁর কাছে উঠে আসেনি। সেটিই স্বাভাবিক। দ্য আইডিয়া অব এ ক্রিশ্চিয়ান সোসাইটির লেখকের পক্ষে তেমন কোনো উদার ভাবাবেগে অনুপ্রাণিত হওয়া অসম্ভব ছিল। সে যা-ই হোক, ওই একইভাবে তিনি নিপুণ শিল্পীর স্বাভাবিক প্রণোদনায় ফরাসি ও জার্মান গানের কলি এবং বাক্যাংশ অত্যন্ত সার্থকতার সঙ্গে ব্যবহার করেছেন তাঁর কবিতায়।
এলিয়টের কবিকৃতির বিষয়ে তাঁর পারিবারিক কৃষ্টি ও শিক্ষার প্রভাব প্রাসঙ্গিক। পারিবারিক ঐতিহ্যের দিক থেকে তিনি ছিলেন কট্টর নিউ ইংল্যান্ডার। এলিয়টের পিতামহ রেভারেন্ড গ্রিনলি এলিয়ট ১৮৩৪-এ হার্ভার্ড থেকে স্নাতক ডিগ্রি লাভ করার পরপরই সেন্ট লুইয়ে চলে আসেন। তিনি ছিলেন ওয়াশিংটন বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠাতা। এলিয়টের মা শারলোট শাঁ স্টার্নস বেশ পরিচিত কবি-ব্যক্তিত্ব ছিলেন এবং তিনি পঞ্চদশ শতাব্দীর ইতালীয় ধর্মীয় সংস্কারক সাভোনারোলার জীবনী নিয়ে একটি কাব্যনাট্য রচনা করেছিলেন, যার একটি ভূমিকা এলিয়ট ১৯২৬ সালে লিখে দেন। এলিয়টকে রীতি-মতো অভিজাত ও বিস্তৃত শিক্ষা দেওয়া হয়। ১৯০৯ সালে তিনি হার্ভার্ডে স্নাতকপ্রাপ্ত হন এবং সেখানেই তিনি জর্জ সান্টায়ানা ও আয়ারভিন ব্যাবিটের সংস্পর্শে আসেন। ১৯১০-১১ সালে তিনি ফ্রান্সে অবস্থান করেন এবং হেনরি বার্গসোঁর দর্শনের সঙ্গে পরিচিত হন তাঁর বক্তৃতাবলি অনুধাবন করে। তখন তিনি ফরাসি ভাষা ও কবিতার সঙ্গে নিবিড়ভাবে পরিচিত হয়ে ওঠেন, বিশেষ করে সিম্বলিস্টদের কবিতার সঙ্গে। এজরা পাউন্ডের সঙ্গে তাঁর পরিচয় ঘটে ১৯১৪ সালে। এইসব ঘটনা তাঁর মানসভূমি রচনা করেছিল। ১৯২০ সালে তাঁর দ্য সেকরেড উড গ্রন্থে ‘ট্র্যাডিশন অ্যান্ড ইনডিভিজুয়াল ট্যালেন্ট’ নিবন্ধটি প্রকাশিত হয়। ঐতিহাসিকভাবে এই রচনা ওয়ার্ডসওয়ার্থের লিরিক্যাল ব্যালাডসের ভূমিকার মতোই গুরুত্বপূর্ণ। ঐতিহ্যের এক নতুন সংজ্ঞা দিয়ে তিনি তারই প্রেক্ষাপটে কবি-ব্যক্তিত্ব ও কর্মের বিচার সহজ করে দিলেন। একজন কবি যেন তাঁর শিল্পের মধ্যে সমস্ত সাহিত্যের ঐতিহ্যকে ধারণ করে রাখেন। এ-গ্রন্থের ‘হ্যামলেট ও তাঁর সমস্যা’ শীর্ষক নিবন্ধে ‘অবজেকটিভ কররিলেটিভের’ ধারণাকে তিনি প্রাঞ্জলভাবে উপস্থাপন করেন। সান্টায়ানার এই বাক্যাংশকে তিনি এক নতুন মর্মার্থে প্রতিষ্ঠিত করলেন সাহিত্যবিচারের ক্ষেত্রে। এলিয়টকে বুঝতে হলে তাঁর সমালোচনা, কবিতা ও নাটককে সামগ্রিকভাবে বিচার করা দরকার। এ-নিবন্ধে সে-সুযোগ নেই। তবে এটুকু বলা যায় যে, তাঁর সমালোচনাই তাঁর শিল্পের প্রকৃত ব্যাখ্যা এবং এই ব্যাখ্যা কবিকে নিরন্তর নিজেকে ও অন্যকে বুঝতে সাহায্য করে। একেই তিনি ‘প্রোগ্রামেটিক ক্রিটিসিজম’ বলে অভিহিত করেছিলেন।
কিন্তু আর সবকিছু বাদ দিয়েই যদি কেবলমাত্র তাঁর কবিতার প্রসঙ্গে আমরা সীমাবদ্ধ থাকি তাহলে দেখা যাবে যে, প্রকরণে ও বিষয়বস্তুতে আমাদের চিন্তা-চেতনা থেকে তিনি অনেক দূরে অবস্থান করেন। বাস্তব দিক থেকে তাঁর নাগরিকতা বলতে যা বোঝায় তা আমাদের অপরিচিত। আমাদের এখনো পর্যন্ত কৃষিভিত্তিক সমাজে তা অনেকাংশে অপ্রাসঙ্গিকও বটে এবং তাঁর শাশ্বত নগরের অবক্ষয় (ফবপধু ড়ভ ঃযব বঃবৎহধষ পরঃু) আমাদের জন্যে আরো দূরাগত ধ্বনিমাত্র। বরং ইতিহাসচেতনায় ও শিল্পে ইয়েটস আমাদের জন্যে সম্ভবত অনেক বেশি প্রাসঙ্গিক। এ-কারণেই কি জীবনানন্দের কবিকর্মে এলিয়টের নয় ইয়েটসেরই প্রবল উপস্থিতি প্রত্যক্ষ করি? বিশ্বসভ্যতার ইতিহাস ও এ-উপমহাদেশের ঐতিহ্যের প্রেক্ষাপটে জীবনানন্দের গভীর এবং কখনো কখনো আবেগাপ্লুত নির্মাণ ইয়েটসকেই স্মরণ করিয়ে দেয়। কিন্তু জীবনানন্দ ব্যাবিলন, মিশর বা বিদিশার পথে হেঁটে গেলেও সর্বত্র বাংলার মুখই মুখ্যত অবলোকন করেছেন। সে-মুখে কখনো বনলতা সেন বা অরুণিমা সান্যালের মার্জিত নাগরিকতার আদল আভাসিত হলেও তাঁর সুন্দরীরা ধান ভানে, গান গায়, ধানসিঁড়ির ওপরে ওড়ে চিল এবং সুরঞ্জনা-সুচেতনা যখন হারিয়ে যায় তখন আকাশের ওপারে আরেক আকাশ থাকে এবং বাতাসের ওপারে থাকে আরেক বাতাস। এই রোমান্টিকতা জীবনানন্দে যেমন তার পরবর্তী প্রজন্মের মধ্যেও তেমনি সমানভাবে সঞ্চারিত। প্রকৃতপক্ষে আধুনিককালে বাংলা কবিতার ওপরে বিপুল গভীর ও সর্বগ্রাসী ছায়া ফেলেছে রোমান্টিক ভাবানুভূতি, যে-প্রবণতা রবীন্দ্রনাথের ভেতর দিয়ে বাংলা কবিতার সর্বত্র সঞ্চারিত হয়েছে। তিরিশের কবিতায় তারই নব্য উদ্বোধন এবং জীবনানন্দে তার আনুপূর্ব অনুসৃতি ও শমিত পরিণতি। এই মূল প্রবণতার ওপরেই তিরিশোত্তর কালের কবিতায় সঞ্চারিত হয়েছে আধুনিক বলে আখ্যায়িত ভাষাগত ও প্রকরণগত পদ্ধতিসমূহ।
আমাদের পঞ্চাশ, ষাট ও তৎপরবর্তী কবিতাও এই প্রভাব থেকে মুক্ত নয় এবং অনুমান করি তা আমাদের স্বাভাবিক জাতিগত প্রবণতারই যথার্থ প্রতিফলন। তিরিশের প্রধান প্রধান কবি-ব্যক্তিত্বরা তাঁদের ভাষায়, প্রকরণে ও বিষয়বস্তুতে কবিতার একটি নিশ্চিত ও সুস্পষ্ট উত্তরণ ঘটিয়েছিলেন। রবীন্দ্রবলয় থেকে নিষ্ক্রান্ত হওয়ার উদগ্র প্রচেষ্টায় তিরিশের কবিগোষ্ঠী প্রকরণগত নতুনত্ব নিয়ে এলেও রবীন্দ্রনাথই তাঁর একেবারে শেষের রচনাগুলোতে এই ক্রান্তিলগ্নের আভাস দিয়েছিলেন। তিরিশের পরে আমাদের যে-কাব্যভাষার উদ্ভব হলো, তা কিন্তু এলিয়টের মতো তাঁর অব্যবহিত পূর্ববর্তী ভাষা ও সামাজিক-প্রবণতা থেকে আমূল বিচ্ছেদ নয়, বরং তা রবীন্দ্রনাথের ভাষার ও তাঁর মৌলিক প্রকরণের ওপরেই নতুন উপাদান দিয়ে নতুন পদ্ধতিতে নির্মাণ, যা পরবর্তীকালে পশ্চিমবঙ্গে ও বাংলাদেশে তাদের নিজস্ব ভঙ্গিতে ভিন্ন-ভিন্নভাবে বিকশিত হয়েছে। কিন্তু লক্ষণীয় যে, বাংলা আধুনিক কবিতার মূল প্রবণতা রোমান্টিক ও নিওরোমান্টিক চর্চা থেকে পঞ্চাশ দশকের শেষে ও ষাটের প্রথমার্ধে সরাসরি অ্যাংরি ইয়াংম্যান ও বিটনিকদের উচ্চকণ্ঠ-উচ্চারণের কাছে পৌঁছে যায়। এর সামাজিক ও রাজনৈতিক কারণ সুস্পষ্ট। ষাটের দশকের বাংলাদেশে তৎকালীন রাজনৈতিক ও সামাজিক পরিস্থিতিতে আমাদেরকে আমাদের মূল সাংস্কৃতিক উত্তরাধিকার ও যথার্থ আত্মপরিচয়ের সংরক্ষণে নব্য-উপনিবেশবাদের বিরুদ্ধে প্রতিবাদী হতে হয়েছে। পশ্চিম বাংলায় আবার অর্থনৈতিক ও তীব্র সামাজিক সংকট একটি প্রজন্মকে সন্ত্রাসের দিকে ঠেলে দিয়েছে বলে, প্রচলিত বিশ্বাস ও পূর্বসংস্কারের বিরুদ্ধপ্রতিক্রিয়ায় প্রতিবাদী ভাষার দিকেই তাঁদের কবিতা আকৃষ্ট হয়েছে তখন। পরবর্তীকালে শক্তি-সুনীলের ভেতর দিয়ে তা বর্তমান পরিণতির দিকে অগ্রসর হয়েছে এবং যা ক্রমান্বয়ে এখন নিশ্চিত অবক্ষয়ের দিকে অবসিত বলে মনে হয়। অন্যদিকে বাংলাদেশের বর্তমানকালের কবিতাচর্চায় আত্মানুসন্ধানের প্রক্রিয়া এখনো জাগরুক এবং সে-কারণেই তার সম্ভাবনাময় দীর্ঘপথ এখনো সম্মুখে রয়েছে এমন আশা করা যায়। কেননা বাংলাদেশে যে-মধ্যবিত্তের উন্মেষ, তা এখনো একটা নিশ্চিত পরিণতির দিকে ধাবিত হয়নি এবং নানা টানাপোড়েনে তার চেতনায় ও মূল্যবোধে নানান ভাঙা-গড়ার কাজ অনবরত চলছে, সে কলেবরেও বৃদ্ধিপ্রাপ্ত হচ্ছে এবং বিস্তৃততর নান্দনিক কর্মকাণ্ডে উত্তরোত্তর নিয়োজিত হয়ে চলেছে।
বিশ-শতকের আধুনিকতার প্রধান পুরোধা এলিয়টের কবিতার অনুসৃতি বাংলা কবিতায় তেমন গভীর ও ব্যাপকভাবে ঘটেনি নানা কারণে। এর অন্যতম প্রধান কারণ এই যে, এলিয়ট মানুষের নবচৈতন্যের রূপরেখা চিহ্নিত করতে গিয়ে যে-নতুন ভাষা-রচনায় নিজেকে নিয়োজিত করেছিলেন সে-ভাষা, এমনকি, আমাদের শিক্ষিত জনগোষ্ঠীর স্বাভাবিক বাচনের আদর্শ হতে পারেনি। তার অর্থ এই যে, এলিয়টের নব্য মানসিকতার যে-ধারণা তা এদেশের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও অন্যান্য বাস্তবতার প্রেক্ষাপটে সেদিনও অপ্রাসঙ্গিক ছিল এবং আজও রয়েছে। কিন্তু তাঁর সাহিত্যের প্রভাব প্রত্যক্ষভাবে আমাদের কবিতায় নয়, তা অন্যত্র এবং মৌল। এলিয়টের কাব্যভাবনার যে-গাণিতিক প্রকৃতি ও সাহিত্যবিচারের নতুন যে-দক্ষ হাতিয়ারসমূহের ব্যবহার, তা আমাদের অন্তত এটুকু শিখিয়েছে যে, কবি প্রধানত ঘটক। সুধীন দত্তের ভাষায় : ‘এলিয়ট কবিকে ঘটক আখ্যা দিয়েছিলেন, এবং আমি মনে করি যে ব্যক্তিগত মনীষায় জাতীয় মানস ফুটিয়ে তোলাই কবিজীবনের পরম সার্থকতা।’ কবির এই নৈর্ব্যক্তিকতার ধারণা একেবারে অভিনব এবং এই ধারণার আপাত বিস্তারেই যে বিংশ শতাব্দীর তৃতীয় ও চতুর্থ দশকে আমাদের কবিতার স্বাভাবিক উচ্ছ্বাস-প্রবণতায় ও তার আলুলায়িত আদলে সংযমী শাসন আসতে থাকে, তা সহজেই অনুমান করা যায়। রবীন্দ্রনাথ যে কেবল প্রথম এলিয়টের অনুবাদই করেছিলেন তা-ই নয়, তাঁর শেষ লেখায় যে প্রমিতি দার্ঢ্য ও ঋজুতা, তাতেও হয়তো এলিয়টের কাব্যভাবনার ছায়াপাত হয়ে থাকবে। কিন্তু আপন প্রতিবেশের ও ভাষার স্বধর্ম কবি বিস্মৃত হতে পারেন না। তাই আবার পরবর্তী সময়ে আমরা অনেক উচ্ছ্বাসের দিকে বারবার ধাবিত হয়েছি। কিন্তু তবু আমরা আমাদের শ্রেষ্ঠ আধুনিক কবিতা-রচনার ক্ষেত্রে এলিয়টের প্ররোচনায় শিক্ষিত, মার্জিত ও নান্দনিকভাবে গ্রাহ্য কবিতা-নির্মাণ করতে উদ্বুদ্ধ হয়েছি তিরিশ থেকে শুরু করে এ-কাল পর্যন্ত এবং আমাদের সাহিত্যজিজ্ঞাসায় এসেছে পূর্ণবয়স্ক শাসন ও বিশ্লেষণ-প্রবণতা। তাঁর পরে আর কোনো কবি-সমালোচকই যেমন সাহিত্যের নবতর সংজ্ঞা রচনা করতে পারেননি, তেমনি সাহিত্যকে এমন অনায়াসে অন্যান্য শিল্প ও বিদ্যার ক্ষেত্র ক্রমশ অধিকারের স্বাচ্ছন্দ্যও দেননি। আমার ধারণা, একজন বুদ্ধদেব বসুর বা মুনীর চৌধুরীর শিক্ষিত গদ্য ও সাহিত্যজিজ্ঞাসার চরিত্র অনেকখানি এলিয়টের পঠন-পাঠন দিয়ে প্রভাবিত। আর এটি সর্বজনবিদিত যে, তিরিশের দশক থেকে বুদ্ধদেব বসুর কাব্যবিচার, তাঁর বোদলেয়ার-অনুবাদ বাদ দিয়েও, আমাদের মনন ও মানসকে দ্রুত আধুনিক উপলব্ধির দিকে এগিয়ে দিয়ে আধুনিক কবিতা-সৃষ্টির উপযুুক্ত ক্ষেত্র প্রস্তুত করেছে। বিংশ শতাব্দীর প্রথমার্ধ হয়তো সাহিত্যের ইতিহাসে অচিরেই এলিয়টের কাল বলে বিবেচিত হবে, যেমন মধ্য অষ্টাদশ শতাব্দী জনসনের কাল বলে আজকে পরিচিত। কিন্তু স্যামুয়েল জনসন আবির্ভূত হয়েছিলেন নিওক্লাসিক্যাল যুগের প্রান্তবিন্দুতে এবং সে-যুগের যোগ্য উপসংহার রচনা করেছিলেন বুদ্ধির শানিত দীপ্তি দিয়ে, আর এলিয়ট তাঁর স্বকালকে যেন স্বহস্তে নির্মাণ করেছেন নিপুণ স্থপতির মতো একাগ্র নিষ্ঠা, বিপুল শ্রম ও সীমাহীন দক্ষতায়। আমাদের কালের কবিতায় রোমান্টিক ও নিওরোমান্টিক ঝোঁক বর্তমান থাকলেও তা নানাভাবে বিশ-শতককে ধারণ করবার চেষ্টা করেছে তার ভাবে ও ভাষায় এবং সেই আধুনিকতার মানসভূমি-নির্মাণে এলিয়টের কাছে আমাদের তথা বিশ্বসাহিত্যের ঋণ অস্বীকার করা যায় না। কিন্তু বাংলা কবিতার যে-সব চরিত্রলক্ষণ আমাদের প্রধানত আকৃষ্ট করে, যেমন, কূটাভ্যাস, প্রকৃতি ও মানুষের পারস্পরিক সম্পর্কের দ্যোতনা, উদার মানবিকতাসঞ্জাত ধ্যান-ধারণা, সাধারণ মানুষের আটপৌরে জীবনের আশা-আকাক্সক্ষা, নেতি ও অবক্ষয়ের চিত্র – এ-সবই কোনো-না-কোনোভাবে প্রাচীনকাল থেকেই আমাদের কাব্য-সংস্কৃতি ও সমাজ-সংস্কৃতিতে বহমান ছিল, যা চর্যাপদ, বাউলগান বা বামাচারী তন্ত্রসাধনায় সুস্পষ্ট। ত্রিশোত্তর আধুনিক বাংলা কবিতার পরিণতিতে তাই এলিয়টীয় তথা পাশ্চাত্যের প্রভাবের চেয়ে আমাদের মৃত্তিকালগ্ন আবহমান প্রবণতাসমূহের ভূমিকাই প্রধান বলে মনে হয়।


Leave a Reply
You must be logged in to post a comment.