কিস্সা বলেন শেহ্রজাদে

রবিশংকর বল

\ ১৩ \

এ-শহরের পুরনো মানুষরা বলেন, কফিন-গলি। তবে সেরকম মানুষ আর অবশিষ্ট নেই। যাও-বা দু-একজন আছেন, তাঁরা এক লুপ্তপ্রায় প্রজাতির শেষ প্রতিনিধি।

রাস্তাটার নাম ব্রাইট স্ট্রিট। মধ্য কলকাতার বউবাজার অঞ্চলে। এখানেই কফিন ও কাস্কেট তৈরির কয়েকটি দোকান টিকে আছে। যেমন ব্রাইট কফিন শপ, রাজা কফিন শপ, একশ বছরের স্মৃতির ধুলো গায়ে মেখে। কফিন, কাস্কেট ছাড়াও এই দোকানে মৃতদেহ কবরস্থ করার নিয়ম পালনের নানা জিনিসপত্র পাওয়া যায়। গোলাপজল, আতর, ধূপকাঠি, লোবান, সাবান, চন্দন, খেলাল, কর্পূর, সুরমা, আহাদনামা।

অফিস থেকে বেরিয়ে কফিন-গলি পার হয়েই সেন্ট্রাল অ্যাভিনিউয়ে এসে বাস ধরতে হয় রঘুপতিকে। আগে আগে সে দাঁড়িয়ে পড়ত কফিন তৈরির কোনো দোকানের সামনে, সেখানে হয়তো তখন নতুন কফিন বানানো হচ্ছে। এভাবে দোকানের পুরনো কয়েকজনের সঙ্গে আলাপও হয়ে গিয়েছিল তার।

আজ হঠাৎ, স্বপ্নকমলকে দেখতে পেল সে। মাসছয়েকের বেশি হয়ে গেল স্বপ্নকমলের সঙ্গে দেখা হয়েছিল তার। মাঝে টেলিফোনে দু-একবার কথা। রঘুপতির পুরনো অনেক বন্ধুর মতোই স্বপ্নকমলও ছিটকে দূরে চলে গেছে। কোথায়? তারা সবাই যেন এক মহাকাশে লক্ষ্যভ্রষ্ট হয়ে পাক খাচ্ছে, তারপর একদিন পুড়তে পুড়তে ছাই হয়ে পড়ে যাবে এক বিস্মৃতির সমুদ্রে।

তারপর একদিন পৃথিবীর সব গল্প ফুরিয়ে গেলে, মানুষ যখন থাকবে না, আমরা কি কোনো স্বপ্নের ভেতরে থেকে যাব?

গল্পরা তো ফুরোবেই, ফুরোচ্ছেই।

আন্দামানে পঁয়ষট্টি হাজার বছর বেঁচে ছিল বোয়া উপজাতি। ২০১০-এ তাদের শেষ মানুষটি, পঁচাশি বছরের বৃদ্ধা মারা গেলেন। হারিয়ে গেল একটা ভাষা, কত গল্প-পরিকথা। বৃদ্ধা দিনে দিনে বিষণ্ণ হয়ে পড়ছিলেন। কবেই তাঁর স্বামী-সন্তানেরা মারা গেছেন; পরিচিতজনেরাও সবাই মৃত; তাঁর সঙ্গে কথা বলার মতো কেউ আর বেঁচে ছিল না। জীবন যেন ভূগর্ভের নীরবতায় বন্দি।

কিন্তু স্বপ্নকমল, সিগারেটের ধোঁয়া ওড়াতে ওড়াতে, আকাশের দিকে তাকিয়ে কফিন-গলিতে দাঁড়িয়ে আছে কেন?

– স্বপন -। রঘুপতি তার মুখোমুখি দাঁড়িয়ে ডাকল।

– হ্যাঁ – কে -। স্বপ্নকমল এমনভাবে তাকাল, মনে হলো রঘুপতিকে চেনে না। তারপর স্বাভাবিক হেসে বলল, ‘ও তুই – এদিকে কেন?’

– আমার তো কাছেই অফিস। তুই এখানে কী করছিস?

-একটা গল্প-

– কী?

– একটা গল্প লিখব – তাই খোঁজ করতে – অনেকদিন গল্প লেখা হয়নি।

– গল্পের খোঁজে? রঘুপতি হেসে ফেলল। – রাস্তায় এসে গল্প খুঁজছিস?

– গল্প তো রাস্তাতেই পাওয়া যায়। স্বপ্নকমল গম্ভীর হয়ে বলে।

– ড্রইংরুমের গল্প তো কখনো লিখিনি। আর ওইসব ত্রিকোণ প্রেম। আজকাল গল্প পড়িস?

– না।

– পড়বি না। সব বানানো গল্প। কিছুক্ষণ চুপ করে হেসে ওঠে স্বপ্নকমল। – লেখকদের আজকাল ফ্যান ক্লাব আছে। ফেসবুক দেখবি। নিজের লেখাই পোস্ট করছে, মন্তব্য করছে আর হাজার হাজার লাইক, কমেন্টে ভরে যাচ্ছে। চল, চা খাই -। স্বপ্নকমল হাঁটতে শুরু করে, নিজেকেই শুনিয়ে বলে, বুঝলি রঘু, আবার রাস্তায় নাবতে হবে। ভাস্করদার কবিতাটা মনে নেই?

– কোনটা?

স্বপ্নকমল মিটমিট করে হাসল। যেন কোনো গোপন কথা বলছে, এভাবেই ফিসফিস করে বলতে লাগল :

মনে পড়ে সুদূর আয়োডিনের গন্ধ।

মনে পড়ে, চিঠিপত্র আর আসবে না কোনোদিনই।

যখনই চোখে ভর্তি হয়ে আসে জল

টুপিটা আমি সামনের দিকে নামিয়ে নিই।

আর হাঁটতে থাকি

ছিমছাম পা-ফেলে শুধুই হাঁটতে থাকি-

 

রাস্তা থেকে, চুপচাপ, হারিয়ে যাই রাস্তায়।

– রাস্তায় আবার। রঘুপতি বলে।

– হ্যাঁ, আবার রাস্তায় নাবতে হবে।

রাস্তা থেকেই তো আমরা উঠে এসেছিলাম, ভুঁইফোঁড় মাশরুমের মতো, রঘুপতি মনে মনে বলে। এ-শহরে আমরা, যারা বসিত্মতে, ভাঙাচোরা টিনের বাড়িতে হারিয়ে ফেলেছিলাম শৈশব-কৈশোর, আমরা, যারা হই-হল্লা শুনলেই গৃহহীনের মতো ছুটে যেতাম রাস্তায়; আমরা, যারা শেষ পর্যন্ত অনামা স্কুল-কলেজে বানান ভুলেভরা লেখাপড়া শিখেছিলাম; যাদের কোনো কোনো তরুণী ভালোবেসেছিল আর তাদের জন্য আমরা কবিতা লিখতে শুরু করেছিলাম, তৃতীয় ধারার রাজনীতির মিছিলে হাঁটতে শুরু করেছিলাম, কলেজে ক্লাস না-করে ঘণ্টার পর ঘণ্টা কলেজ স্ট্রিট কফি হাউসে বসে থাকতাম ইনফিউশন, সিগারেট ভাগ করে খেয়ে, আমরা, যারা জানালার পাশে নির্মাল্য আচার্যকে সারাদুপুর ক্ষণের প্রম্নফ সংশোধন করতে দেখেছি; আমরা, যারা হাতকাটা প্রদীপের মুখে নকশাল-আন্দোলনের বারুদগন্ধের গল্প শুনেছি; এনকাউন্টারে মরে যাওয়া যুবকদের আবার মরে যেতে দেখেছি, আমাদের জীবনে স্বপ্নকমল এসেছিল পতিত দেবদূতের মতো।

স্বপ্নকমল আমাদের চেয়ে বয়সে সাত-আট বছরের বড়, মোটামুটি পরিচিত গল্পকার আর সে চাকরি করত একটা খেলনা তৈরির কারখানায়। আমরা ওর জন্য অপেক্ষা করতাম। স্বপ্নকমল অফিস থেকে ফিরবে, তাহলেই আমরা খেতে পাব টোস্ট, কোনোদিন সঙ্গে অমলেট আর ইনফিউশন। কফি হাউসের সেই টেবিল যেন ছিল আমাদের ঘেটো; মেসায়া স্বপ্নকমল এসে আমাদের রুটি-মদ উপহার দেবে, তার রক্তমাংস।

তারপর এ-শহর যত দ্রম্নত বদলাতে লাগল, আমরাও বদলে যেতে শুরু করলাম। স্বপ্নকমলের খেলনার কারখানা বন্ধ হয়ে গেল। জিঙ্কের তৈরি ছোট ছোট মডেল খেলনা শিশু ও তাদের বাবা-মায়েরা ছুড়ে ফেলে দিলো। সবকিছুতেই চাই মজা, খেলনাতেও; আনন্দ নয়, মজা, ‘বীভৎস মজা’। অনেক পরে চীন থেকে খেলনা আমদানি শুরু হয়। আমরা সবাই চাকরি পেলাম, ছোট ভাড়াবাড়িতে বা নিজের কেনা ফ্ল্যাটে ‘ঠান্ডা-ঠান্ডা কুল-কুল’ সংসার জমে উঠল। বোয়া উপজাতির শেষ মানুষটির মতো স্বপ্নকমল একা হয়ে গেল তার লুপ্তপ্রায় ভাষা নিয়ে। একটা চাকরির খুব প্রয়োজন ছিল তার। কিন্তু অচেনা-হয়ে-যাওয়া এক শহরে, যেখানে ভার্চুয়াল টেকনোলজি আর নানারকম দালালিই রোজগারের পথ, কে চাকরি দেবে স্বপ্নকমলকে? সে তো এক অতি বিরল প্রজাতির শেষ প্রতিনিধি। স্বপ্নকমলও একদিন বুঝে গেল, বন্ধুদের জীবনে সে আগন্তুক ছাড়া অন্য কিছু নয়। তাই নিজে থেকেই একদিন সরে গেল; যেভাবে তার অপ্রকাশিত গল্পগুলোকে সে হারিয়ে যেতে দিয়েছে।

– আবার লেখা শুরু করেছিস? চায়ে চুমুক দিতে দিতে জিগ্যেস করল রঘুপতি।

– না। কী হবে?

– তাহলে গল্প খুঁজছিস কেন?

– জানি না। কিন্তু তুই তো জানিস -। স্বপ্নকমল অসহায় চোখে তাকায়।

-কেউ কেউ সারাজীবন গল্পের ভেতরেই বেঁচে থাকে। আমারও একটা গল্প দরকার। বলেই সে হাসে।-না হলে চেতলার ওই বসিত্ম, আদিগঙ্গার পচা গন্ধের ভেতরে বেঁচে থাকতে পারতাম? শুধু খিসিত্ম, রাত হলেই বোমা-পাইপগানের আওয়াজ-

– এখন তো সব শান্ত।

– আপাতত। স্বপ্নকমল রঘুপতির হাত চেপে ধরল। – ভেতরে ভেতরে বারুদ জমছে, ঠিক ফেটে পড়বে। ভুলে যাস না, বিপস্নব ভোজসভা নয়।

স্বপ্নকমল হঠাৎই একসময় উঠে চলে গেল। রঘুপতি অনেক চেষ্টা করেও তাকে বসাতে পারেনি। স্বপ্নকমল চলে যাওয়ার পর সোনা – সূর্য ব্যানার্জির কথা মনে পড়ল তার। অসীম রায়ের অসংলগ্ন কাব্য উপন্যাসের সূর্য। তাদের কলেজ-জীবনে কতবার যে ফিরে ফিরে এসেছে অসংলগ্ন কাব্যের সেই কথাটি… ‘আমাদের কালের মহৎ কবিতা বোধহয় অসংলগ্ন হতে বাধ্য।’ সেই সূর্য, যে এমন এক সৌরজগতের অধিবাসী যেখানে চন্দ্র সূর্য তারার আলো বোধহয় অন্যরকম। অনেকক্ষণ ধরে আমি এক ভবিষ্যতের গান শুনলাম। আমাদের পশ্চিমবঙ্গ, বাংলাদেশ, ভারতবর্ষ, চীন, সোভিয়েত ইউনিয়ন, আমেরিকা সর্বত্র এই বিংশ শতাব্দীর শেষে একটা পতাকাই উড়ছে পতপত করে – ভালোবাসার পতাকা। সত্যিই ভাববাদ ও বস্ত্তবাদের এক আশ্চর্য সমন্বয় ঘটেছে, আর ঘটেছে টেকনোলজি ও প্রকৃতির নিরন্তর দ্বন্দ্বের। সোনা মাথা ঝাঁকিয়ে ঝাঁকিয়ে বলতে থাকে, ‘মানুষ বুঝেছে, তাকে নতুন কিছু করতে হলে নিজেকেই নতুন বানাতে হবে।’

পরদিন সকালে টেলিফোনের শব্দে ঘুম ভেঙে গেল রঘুপতির। সমর মিত্রর কণ্ঠস্বর জেগে উঠল, ‘স্বপ্নকমলের কোনো খবর জানো?’

– কালই তো দেখা হলো। কফিন-গলিতে।

সমরদা কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বললেন, শুনলাম, ও নাকি মারা গেছে।

রঘুপতি হেসে ফেলল। – তাহলে কি ওর ভূতের সঙ্গে দেখা হলো?

– তবু একবার স্বপ্নকমলের বাড়িতে খোঁজ নিও।

– আপনাকে এসব কথা কে বলল?

– অতনুদা। ওর বাড়িতে নাকি ফোন করেছিল। তখনই জানতে পেরেছে।

– আশ্চর্য! কাল আমার সঙ্গে বসে চা খেল, কত কথা বলল।

– না হলেই ভালো। তবে অতনুদা তো -। লাইনটা কেটে গেল। সমর মিত্র, অতনু মুখোপাধ্যায় – এঁরা সব স্বপ্নকমলের চেয়ে সিনিয়র লেখক। কতদিন হলো, স্বপ্নকমল আর কিছু লেখে না, কোথাও তার লেখা প্রকাশিত হতে দেখা যায় না, সকলের থেকে নিজেকে সরিয়ে নিচ্ছিল ও – কিন্তু কজন খোঁজ রেখেছে? তারা – বন্ধুরাও কি স্বপ্নকমলকে খুঁজেছে? আর শিল্প-সাহিত্যের মানুষগুলো তো এখনো কফি হাউসে বসে নিজের নিজের দল ভারি করা, রাজনীতি করতেই ব্যস্ত। ‘ভাবো, ভাবা প্র্যাকটিস করো।’ ঋত্বিক ঘটকের কথাগুলো মনে পড়ে রঘুপতির। স্বপ্নকমলের মোবাইলে ফোন করতেই ও-পাশ থেকে তার ভাইয়ের গলা ভেসে এলো, কর্কশ, খটখটে। – কে?

– স্বপ্নকমল নেই।

এবার হাসি। – মেজদা তো ওপরে।

– মানে?

– ওপরে বলতে কী বোঝায়? মারা গেছে।

– সে কী! কবে?

-রঘুদা বলছেন তো? সেই নভেম্বর মাসে। হাঁপানিটা বেড়ে গেছিল, হার্ট অ্যাটাক হলো-

তার মানে সাত-আট মাস পেরিয়ে গেছে! স্বপ্নকমল এ-শহর থেকে হারিয়ে গেছে, অথচ তার পরিচিতজনেরা কেউ জানে না? জাস্ট মুছে গেল স্বপ্নকমল।

– একটা তো খবর দিতে পারতে।

– কী হবে? মেজদার খবর কে নিত? বাড়ির সবার সঙ্গে কথা বন্ধ করে দিয়েছিল। স্বপ্নকমলের ভাই তপন বাঁকা স্বরে বলে, আপনারা কোথায় ছিলেন রঘুদা?

রঘুপতি উত্তর দিতে পারে না। তারপর বলে, আমি যদি একদিন যাই -। তোমাদের আপত্তি আছে?

– না – না। আসবেন। রাখি এখন, বাজারে যাব। স্বপ্নকমলের ভাই ফোন কেটে দেয়।

খবরটা শুনে মৃত্তিকা কাঁদে না, শুধু তার দুই চোখের মণি লাল হয়ে যেতে থাকে। বলে, তোমরা কিছু করবে না?

– কী? রঘুপতি বুঝতে পারে তার ভেতরে এক কাঁপুনি ছড়িয়ে যাচ্ছে।

– স্বপ্নকমলদা এভাবে হারিয়ে যাবে? ওনার লেখাগুলো মুছে যাবে?

কিন্তু কাল কফিন গলিতে কার সঙ্গে দেখা হলো তাহলে? স্বপ্নকমলই তো। তবু স্বপ্নকমল নয়। সে তো নভেম্বর মাসে ছাই হয়ে হাওয়ায় মিশে গেছে। কেন স্বপ্নকমল তার কাছে এসেছিল? অনেকদিন পর মৃত্যুশয্যায় জ্ঞান হারাতে হারাতে রঘুপতি দেখবে, স্বপ্নকমল তার বিছানায় এসে বসেছে, তার কপালে হাত রেখেছে। সে বুঝতে পারবে, এই একটি মাত্র সম্পর্ক – বন্ধুত্ব – যেখানে কোনো দাবি নেই, শুধু এক অমোঘ টান আছে আর সেই টানের সুতো ছিঁড়েই একদিন আমাদের চলে যেতে হয়। তবু এক অলৌকিক জীবন নিয়ে আমরা ফিরে আসি কখনো কখনো, অপেক্ষা করি শ্মশানে, সমাধিক্ষেত্রে, কফিন-গলিতে; হয়তো বন্ধুর সঙ্গে একবার দেখা হয়ে যাবে। স্বপ্নকমলও নিশ্চয়ই কাল তার জন্যই অপেক্ষা করছিল।

 

স্বপ্নকমলের দুটি গল্পের বই, একটি উপন্যাস – কিছুই আর পাওয়া গেল না বাড়িতে। বছরদুয়েক আগে রঘুপতিকে সে জানিয়েছিল, একটা উপন্যাস শেষ করেছে। সেই পা-ুলিপিও নিরুদ্দেশ। শুধু একটা ডায়েরি সে স্বপ্নকমলের বাড়ি থেকে নিয়ে এলো। ছেঁড়া ছেঁড়া, ধূলিমলিন। সেখানে মাঝে মাঝে, অনিয়মিতভাবে, নানা কথা লিখেছিল স্বপ্নকমল; কোনোটায় তারিখ আছে, বেশিরভাগই তারিখহীন এন্ট্রি।

স্বপ্নকমল এক জায়গায় লিখেছে :

* সাহিত্য এখন আমাকে ক্লান্ত করে। বোবা মানুষের মতো বসে থাকতে ইচ্ছে হয়। তবু এখনো লিখি কেন? মৃত্যুর জন্য অপেক্ষা করতে করতে এর চেয়ে অন্য কোনো কাজ তো আমার জানা নেই।

* সমাধির ওপর সূর্যমুখী…

* গুছিয়ে লেখার কথা আর ভাবতে পারি না। মনে হয়, একটা আর্তনাদ যদি ধরা যেত। কিসের আর্তনাদ? মৃত্যুর? যৌন শীৎকারের? বেঁচে থাকার?

* অমিয়ভূষণের মহিষকুড়ার উপকথা অনেকদিন পর আবার পড়লাম। শেষ প্যারাগ্রাফটার কথা একবার ভাবো : ‘…শহরের রাজারা, যারা রাজ্য চালায়, তারা পোষ না-মানা কোনো মর্দা মোষকে নিজের ইচ্ছামতো বনে চরতে আর কোনোদিনই দেবে না। যদিও হঠাৎ তোমার রক্তের মধ্যে এক বুনো বাইসন অাঁ-অাঁ-ড় করে ডেকে ওঠে।’

বুনো বাইসনের আর্তনাদ কি কোনোদিন মানুষের ভাষায় লেখা যাবে? সেদিন একাকার হয়ে যাবে জীবন ও সাহিত্য।

এক পৃষ্ঠায় মাত্র দুটি লাইন লিখেছে সে :

ফারেনহাইট ৪৫১। এই উষ্ণতায় বইয়ের পাতায় আগুন ধরে যায় এবং বই পুড়ে যায়। সব বই পুড়ে গেলেই বা ক্ষতি কী?

একটি গল্পের খসড়া। তারপর স্বপ্নকমল লিখেছে : এই গল্প আর লেখা হবে না। কোন ভাষায় লিখব, জানি না। মরণোন্মুখ মানুষের স্বগতোক্তির ভাষা কেমন?

আরেক পৃষ্ঠায় লিখেছে :

লোকটা যেন বোবা বা তাকে বোবায় ধরেছে। সেলাই করা দুই ঠোঁট নিয়ে সে হাঁটে। তবু রাস্তার লোকদের দিকে তাকিয়ে সে মাঝে মাঝে তাদের দিকে হাসি ছড়িয়ে দেয়। কিন্তু কেউ তার দিকে তাকিয়ে হাসে না। আসলে কেউ তো তাকে দেখেই না।

তারপর :

ঘুষি মারো। পেটে ঘুষি মারো। এই তো জীবন, কালীদা।

অন্য এক পৃষ্ঠায় স্বপ্নকমল লিখেছে :

স্বপ্নের ভেতরে স্বপ্ন। জীবন তো এভাবেই আসে আমাদের কাছে। দেখলাম আমি একটা প্রেক্ষাগৃহে বসে আছি। মঞ্চের ওপর অভিনেতা-অভিনেত্রীরা ঘোরাফেরা করছে। হঠাৎ একটা দরজা খুলে কিছু লোক এসে ঢুকে পড়ল। মেশিনগান চালিয়ে সবাইকে হত্যা করল তারা। একটা বাচ্চার কান্না শুনতে পেলাম। আর তখনই অভিনেতা-অভিনেত্রীরা উঠে দাঁড়িয়ে বলল, আসলে কিন্তু আমরা মরিনি, অভিনেতা হিসেবে মরতে হয়েছে, এই হত্যা নাটকেরই একটা ঘটনা। কী অদ্ভুত! আমরা আসলে মরি না, কেবল অভিনেতা-অভিনেত্রী হিসেবে মারা যাই।

এক জায়গায় লিখেছে :

রাস্তায় নাবো আবার। রাস্তাতেই খুঁজে পাবে তোমার স্বপ্নের চরিত্রদের। বাস্তব থেকে সবাই স্বপ্ন হয়ে উঠতে চায়।

স্বপ্নকমলের ডায়েরি পড়তে পড়তে রঘুপতির মনে হয়, গল্পের দিন ফুরিয়ে আসছে। অনেক গল্প নিয়ে চলে গেছে স্বপ্নকমল। তারা সকলেই একে একে নিজেদের গল্প নিয়ে চলে যাবে। শেষ পর্যন্ত ভাষাহীন সেই বোয়া রমণী শূন্যদৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকবে আকাশ ও সমুদ্রের নগ্নতার দিকে। আকাশ ও সমুদ্র কি আমাদের নতুন কোনো গল্প শোনাবে?

স্বপ্নকমলের ডায়েরি পড়ে কয়েকটা দিন কেটে গেল। শেষও হয়ে গেল লেখাগুলো। একদিন অফিস থেকে বেরিয়ে এলোমেলো ঘুরতে ঘুরতে এক অন্ধকার রাস্তায় ঢুকে পড়ে প্রবল বমি পেল রঘুপতির। শরীরের ভেতরের সবকিছু যেন বেরিয়ে আসতে চাইছে। এ কি বিপন্ন হতে হতে সেই অন্তিম বিপন্নতার সময়? সে রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে বমি করতে লাগল।

আর দেখল, তার ভেতর থেকে ঝলকে ঝলকে তারামাছের মতো বেরিয়ে আসছে ছোট ছোট নক্ষত্র। সে কি এখনই মরে যাবে? না হলে এত নক্ষত্র আসছে কোথা থেকে। বিভিন্ন রঙের, আলো ঝলমলে সব নক্ষত্র। রাস্তার নর্দমায় তারা ভাসতে থাকল। ছোটবেলায় বর্ষার জলে ভাসানো নৌকার মতো ভেসে যাচ্ছে নক্ষত্ররা।

কেউ তার পিঠে হাত রাখল। রঘুপতি মুখ ঘুরিয়ে দেখল, উনিশ-কুড়ির এক তরুণী, ঠোঁটে গাঢ় লিপস্টিক, মিটিমিটি হাসছে। – অনেক মাল খেয়েছ বুঝি?

– না?

– তা হলে? ওমা, এ কী কা-! এ তো তারা বমি করছ তুমি। তুমি কে গো?

রঘুপতি হাসল।

– আমি সোনিয়া। যাবে নাকি আমার ঘরে?

তখনই এই শহরটা মুছে গিয়ে জেগে উঠছে পুরনো সেন্ট পিটার্সবুর্গ, রঘুপতি দেখতে পেল। সোনিয়া তো সেখানেই থাকত। কলকাতায় আসবে কোথা থেকে?

স্বপ্নকমলের ডায়েরির একটি বাক্য মনে পড়ল তার :

জীবন জীবনকে খায়। r (চলবে)

 

[কৃতজ্ঞতা : ক্ল্যারিস লিসপেক্টর]