কী কথা তাহার সনে…

কামরুজ্জামান জাহাঙ্গীর

শান্তা আর সজল মিলে যে ওরা হয়, এই ওরা কি কখনো, কোনো একদিন, একদা বা কোনো এককালে বন্ধু ছিল? কী জানি থাকতেও পারে। শান্তা কখন থেকে তার ফেসবুক ফ্রেন্ড হয় তা সৌভিক সজল অনেক চেষ্টা করেও মনে করতে পারে না। নমিতা রহমানের কথাই তার মনে পড়ে – সে-ই বোধকরি তাকে এমন কিছু সাজেস্ট করেছিল। শান্তাকে ফ্রেন্ডলিস্টে ঢোকানোর গল্প আপাতত এভাবেই না-হয় আমরা মেনে নিই। অনেকে আবার পালটাভাবে ভাবে Ñ কথা তো সেখানেই; এই অচেনা রমণী, creative feeling যার সাধনার বিষয়, সে কী করে সৌভিক সজলের বন্ধু হয়! নাকি শান্তা কর্তৃক লাইক দেওয়ার ধরন দেখেই তাকে ফেসবুক ফ্রেন্ড করল সে? এটা সজলের খুব মজার বিষয় মনে হয়, দেখতে-না-দেখতেই জাতি ফেসবুকে লাইক দেনেঅলা একটা জেনারেশন পাচ্ছে! কথা সেটাও নয়, শান্তার সার্বিক জগতে আলাদা কিছু একটা আছে। তা না হলে এমন বেহুঁশের মতো তার যাবতীয় কাজকর্ম দেখার কারণ কী? ক্রমেই তার সৌন্দর্য, পছন্দ, জীবন দেখার যাবতীয় কলাকৌশল উন্মোচিত হতে থাকে। এ দুজনের মন-দরিয়ার কোনো একটা মিল থাকতেও পারে। এভাবে সজলকে কেন সে খুঁজবে, স্ট্যাটাস দেখবে, নোট পড়বে। সজলের সৃজনকৃত গদ্যপদ্যের যাবতীয় বয়ান পড়ে নেবে! ফেসবুকের মেসেজ অপশনে শান্তার সৃজিত নির্জনতামুখর অবস্থান বারবার ঘুরেফিরে আসে। এতবার সে কীভাবে আসে? মনিটর শুধু নয়, কি-বোর্ডের শরীর ঘেঁষে-ঘেঁষে কী এক তাল যেন শোনা যায়! সজল একসময় ফেসবুক বন্ধ করে, ইন্টারনেট থেকেও বের হয়। একটা সময় সে শুধু মনিটরপানে তাকায়। ডেস্কটপের মাইক্রোসফট ওয়ার্ডের ‘Galpo’ নামের ফাইলটা কপি করে, নিউ ভলিউম নামের সাইটে পেস্ট করে দিই। কম্পিউটারের মতো চরিত্রহীন যন্ত্র কয়টা আছে। এই ভালোর সীমা নেই তো, এই দেখা যায় কিছুই করা যাচ্ছে না। এখন তো মনিটরই ওপেন হচ্ছে না! ঘটনা কী? তবে কি তাই সত্যি Ñ এ নির্জনতা শান্তারও সাধনা। জগতের যতকিছু আছে, যত সচলতা আছে, আছে সহজতা; সবটাতেই নির্জনতার একটা ব্যাপার আছে। এমনকি শান্তা তারে শুধায়, তোমার ভেতরেই আছে নির্জনতার তামাম চাষাবাদ, বাইরে কিছু নাই। ওহে মানব, তোমাকে আমি গ্যারান্টি নিয়ে রাখতে পারি, নির্জনতা নেই তো এ-জগতের কিছুই নেই। তাহলে অতদূর থেকে, অত কায়দা করে সে যৌথ-নির্জনতার জন্যই শান্তা পাগল হয়ে আছে? নির্জনতার ভেতর লাভ-লসের একটা বিষয় থাকতে পারে Ñ সৌভিক সজলের এ-ভাবনাটা থাকেই।
এই যেমন এখন, সজল, আমাদের সৌভিক সজল, অনেক কিছুই বলতে চায়; শান্তার সঙ্গে কী এক যোগাযোগে মত্ত হতে চায়। কিন্তু অত সাধ্য-সাধনার পরও শান্তার নির্জনধ্যান নড়ে না! এখন কোথাও কিছু লিখবে তাও পারে না। তাকে কিছু লিখতে গিয়েও পারছে না, কী একটা মেকানিজম তথায় আছে, আবারও ফেসবুকের মেসেজ অপশন চেক করতে ওর মন চাইছে। ই-মেইল একটু দেখে নিলে কেমন হয়? ওইখানেও তো কোনো মেসেজ থাকতে পারে। না, রাত অনেক হয়ে গেল, এবার ঘুমানো দরকার। শান্তা কি ঘুমাচ্ছে, বাংলা-টাউনের দিন-রাতের নাকি কোনো বেশকম নেই! মনে হয় সারাটা রাস্তা সারাটা সময় তার মোহিনী মায়ায় ভরিয়ে রেখেছে Ñ তা যেন একদা একদিন, অনেক-অনেক প্রতিদিন, একজনাতেই প্রয়োজনীয় হইতে থাকিল!!! লাইট অফ করতেই তীব্র এক অন্ধকার সজলের দিকে যেন ক্ষেপে ক্ষেপে আসে। একটা ভারি গল্পের স্পর্শ সে টের পায়। আকাশে বোশেখের ঘন গর্জন শোনা যায়। বৃষ্টি হবে নাকি? গন্ধের টানই তাকে দরজার দিকে ঠেলে ঠেলে এগিয়ে দেয়। কী যে গন্ধ আসে চারপাশ থেকে Ñ কামিনী, হাসনাহেনা আর বেলিফুলের যৌথ গন্ধ-রাজত্ব চারপাশ ভারি করে তুলছে।
বহুক্ষণ বাইরে বসে থাকতে থাকতে অনেকক্ষণ পার হয়, তারপর সেই অনেকক্ষণ বাদে সজল ওঠে, আন্ধার তার চারপাশ ঘিরে রাখে। তীব্র তীক্ষè যৌথ গন্ধ, যৌথ নির্জনতাসহযোগে তাকে বেডরুমের দিকে ঠেলে পাঠাতে থাকে। তার ভয় বাড়ে। মশারির ভয়, ঘরের ভয়, একটা রমণী কর্তৃক সারাটা বিছানা দখল করে পড়ে থাকার ভয়! তার ঘুম হয় না; পাশের বালিশে একটা মানুষ কিসের বালের কোয়ান্টাম ফাউন্ডেশনের অটো সাজেশনের জোরে নাকের মৃদু ডাকের তালে তালে ঘুমাচ্ছে। সেদিকে তাকাতেই ঘরের পরের ঘর, তারপর মশারির বিশাল হাঙ্গামা পেরোতেই ঘুম আরো দূরে সরতে থাকে। তাকে যে এভাবে ঘর-ফোবিয়া, মশারি-ফোবিয়ার পর ইউটারো-ফোবিয়া মানে ‘যোনিভয়’ পেতে থাকবে, তা কে বুঝবে। আবারও একটা ফটোগ্রাফির কথা সজলের মনে ভাসে-ডুবে। তা আজই শান্তার অ্যাকাউন্টে পেয়েছে। যেন সে তামাম সৌগন্ধময় শরীর দিয়ে সারাটা মনিটর দখল করতে আছে। সেই দখল এখন তাকে দখল করছে। শরীরে কেমন একটা যৌন-জাগরণের ইশারা জাগতে থাকে। এবং তা ক্রমেই সারা শরীরে কামড়ে-কামড়ে ধরে। কিছু সময় তো পার হয়েই। এবং কখন যেন শরীর অবশ হতে থাকে। কখন যে সে ঘুমায়। ঘুম প্রগাঢ় হয় কি? মনে হয় না। আচ্ছা কে একজন কেন স্বপ্নের ভেতর স্বপ্ন হয়ে এভাবে আসে? সজল          সে-রাতের সেই ঘুম ভাঙার পরও তাই ভাবছিল। ফেসবুকের মেসেজ অপশনে গতকাল হঠাৎ এমন আলোকিত কাণ্ড ঘটায়, মানে শান্তা যে স্বপ্নের ভেতর স্বপ্ন হয়ে একদা একটা কাণ্ড ঘটাবে তা-ই জানায়। আর সেই জানানো এত জলজ্যান্ত হয়ে অত তাড়াতাড়ি ফলে যাবে? এ থেকে যে বাঁচা দরকার। গল্পকাররা যাবতীয় নিরীহ প্রাণীর ভেতর নিরীহতম প্রাণী – তাই সে প্রমাণ করার জন্য যেন একটা গল্প লিখতে মনস্থ করল। অনেক ধরনের সম্পর্কের অনেক ধরনের চিহ্ন ভ্রাম্যমাণ থাকে Ñ এটিও হয়তো তাদের এ ম্লান-সম্পর্কের একটা চিহ্ন মাত্র। এ হতে পারে সজলের দারুণ দুঃসময়, সুসময় বললেও ভাবের খুব বেশি হেরফের হয় না। কাল সেই এক বালিকা-স্বভাবের রমণী হঠাৎই তার স্বপ্নসহযোগে তার স্বপ্নে ভর করে। কেমন সে বালিকা-স্বভাবের রমণী – বয়স বলে কি কিছু আছে! সজলের যেখানে তিরিশের কোঠায় বয়স, সেই বয়স্ক-বালিকা, শান্তা মাহজাবিন তালুকদারের বিয়েই হয়েছে তিরিশ বছরেরও আগে। তাতে যে তার বা তাদের ঘনিষ্ঠতার হেরফের মনে হয় না। সেই রমণী, কলাপাতা বর্ণের সচল শাড়ি পরিহিতা সেই রমণী তার সর্বাঙ্গে জড়িয়ে ধরে। প্রতি অঙ্গে প্রতি অঙ্গের ছোঁয়াতে ভরপুর হতে থাকে। ক্রমশ যৌথ নিশ্বাস আরো ঘন হয়। ভালোবাসায়, সহমরণে কিংবা সহযাপনে সজল ঘুমের ভেতরই ভয় পায়। কাঁপতে কাঁপতে আপসেআপ সে ঘুম থেকে সরে আসে। তারপর এমন হয় তার, সে শিল্পের এ-মাধ্যমটির কাছে আশ্রয় নেওয়ার কথা ভাবে। বালিকা-স্বভাবের প্রিয় রমণীর সঙ্গে ফেসবুক মেসেজের আনুকূল্যে একটা গল্প লেখার বাসনা করে সে। সেই গল্পের লেখক যৌথভাবে হতে পারতেন শান্তা ওরফে মন্থরা আর সৌভিক সজল। কিন্তু তা কি আর হতে পারে…
কিন্তু কেন সম্ভব নয়, তাই সে, মানে সৌভিক সজল ক্লিয়ার করার মানসেই বলে, অনেক ইতিহাসের দিকে সে মন লাগায়, নির্জনতাপিপাসু শান্তাকে বারবার নির্জনতার গল্প শোনায়। বলে, আমি একটু ক্লিয়ার করি, তুমি ই-মেইল করলে, তাতে শুধু ‘শা’ লেখা ছিল। এর একদিন পরই লম্বা ই-চিঠিতে জানালে, আমরা কি আগের মতো পরস্পরের লেখা পড়তে পারি না। আমি ধরেই নিলাম তুমি ইচ্ছা করেই সম্পর্কটা সচল রাখতে চাইছ না। আমিও আমার যন্ত্রণার কথা লিখে শেষই করলাম। তুমি তোমার মেইল আর ফেসবুকের মেসেজ মিলিয়ে দেখো। আমি দেখেছি। তোমাকে আমার সবকিছু জানিয়েছিলাম, মানে কখন কথা বলা যাবে             আর-কী। আমি আসলে একজন মেয়েমানুষের মতো সিরিয়াস হয়েছিলাম, আর তুমি কার্যত একজন উদাসী পুরুষের মতোই বিহেভ করছ! আসলে তুমি সিরিয়াসলি কিছুই নাওনি Ñ তাই না?
সজল গল্পসৃজনে মন লাগাতে যেয়েও পারে না; কী যে নড়বড়ে হয়ে যাচ্ছে! আরো সময় পার হয়, একসময় শান্তা কোনো এক নির্জন গুহা থেকেই যেন মেসেজ পাঠায় Ñ যতœ নিও, যতেœ রেখো…
সজল, বলো তো কী বলা যায়; কী বলব বলো!
মানে, কী বলতে চাইছ!
পথ কী আর কম হেঁটেছি। আমার বয়সটা দেখবে? চিনবে না আমায়! বড় ক্লান্ত লাগে, কী যে আচানক লাগে দুনিয়ার নিয়ম! এতটা পথ হেঁটেছি যে, ওভাবে ভাবনার মতো তারুণ্য থাকলে আমিই খুশি হতাম।
জীবন যে সদা অগ্নিময়!
তাই!
তুমি যে আমার প্রতি বিন্দু রক্তকণিকায় কী এক ঘ্রাণ হয়ে ঘুরে বেড়াও!
তাই?
ওহে যুবক, আমি যে তোমার দেড়গুণ বয়েসি-মানব। আসলে তোমার সঙ্গে আলাপচারিতায় ভালোই লাগছিল। এই ভালোলাগা কত দীর্ঘ কে জানে?
কেন হবে না, ভালোলাগা দিয়ে সব হবে না কেন?
আমরা যে আমাদের বয়স দেখি না, বয়স যে আমারে চেনা দেয় না!
তাহলে কী চেনা দেয়!
নিজের ঈশ্বরত্ব নিজে চিনলেই যে সব চেনা হয়ে যায়।
তার মানে কী?
কে তোমার ঈশ্বর হতে যাবে; আপনিই আপনার সবটা চিনে নাও।
(নীরবতা, অনেক নীরবতা; তবু নীরবতা…, যেন পুষ্পকালের মায়া পড়েছে কথায়!)
কিহে কলহাস্যময় রমণী? হারিয়ে কি গেলে?
না না, তা নয়।
তারা আবার কখন তাদের যোগাযোগ করতে পেরেছিল তা হয়তো কারো জানা নাই। কারণ তাদের ভেতর সদা নির্জনতার এক সাধনা পুনঃপুন জারি হয়। হয়তো এভাবে বহু মুহূর্ত বহুকাল পার হয়। তবু সজল বহুভাবে ওর সঙ্গে কানেক্ট করতে চায়। শান্তা কি ফেসবুকে আসে না। নাকি তাকেই ব্লক করে রাখল? তাহলে অন্য নোট বা স্ট্যাটাসে তো থাকবে! আবার শান্তার কোনো খোঁজখবরই নেই Ñ বহুদিন সে নিখোঁজ থাকে। এও নাকি এখনকার বিধি বটে! কতদিন তা বলা মুশকিল। ফেসবুক আর ই-মেইল, এমনকি টুইটারে সন্ধান করে তাতেও তার নাগাল পাই না সজল। একটা ফোন করে দেখবে নাকি? সকাল ৭টা, তার মানে তার ওইখানে রাত ২টা Ñ কে না কে ফোন ধরে তার ঠিক আছে। আর এত রাতের ফোন, তখন কে কার জবাব দেবে?
সজল ভাবতে থাকে, ভাবতে ভাবতে তার ভাবনা দিয়ে স্বপ্ন তৈরি করতে থাকে Ñ তাতে যেন সে নিজেই এক গায়েবি আওয়াজ সৃজন করে Ñ ওগো সহজ-কথনের মানুষ, ওগো কুণ্ঠিতা, সম্মোহিত মানবী আমার, তোমার কি কোনোই সচলতা নাই। কোথায় তুমি! আহারে আমার মন্থরা ম্যাডাম, কোথায় তোমার ধ্যান, কোথায় যে তার জ্ঞান।
অনেক অনেক মেসেজ, ই-মেইল পাঠায় সজল! ডাউনলোড করা শান্তার ছবি দেখে সে। জায়েদুলকে তার সৃজিত একটা কবিতার লিঙ্ক দেয় –
আমি তাই হবো, ছায়া-ছায়া মেঘ হবো আমি,
রক্তের বিন্দুতে ছোঁয় কামিনী-বেলি-হাস্নাহেনার নিপুণ-ঘ্রাণ
একা আরও একা হতে হতে তোমাতে যেন লীন হই
তবু সে আসে না, স্বপ্নের ভিতর স্বপ্ন হয়ে সে আসে না
আসে মৃত্যুচিহ্নিত নিদ্রাবীজ…
এমন একটা কবিতার তেজ তো আছে – নাকি নাই? খুব আছে। সেই তেজের মধ্যে পড়েই সজল তা জায়েদুলকে পাঠায়, মানে লিঙ্ক দেয়। এর রিপ্লাই পেতে দুইটা মিনিট সময়ও লাগে না। মোবাইল ফোনে বুতুর-বুতুর করে এসএমএস আসার চিক্কুর আসে। সজল যা চিন্তা করেছে এখন তা-ই হলো Ñ এটা জায়েদুলের এসএমএস -shala, chat option-ye ja| এই একটা জায়গা সজলের এক আনা পছন্দ হয় না। chat option খোলা পেলেই ৭৮০ জনের ফ্রেন্ডলিস্ট থেকে কেউ না কেউ সেখানে উঁকি মারবেই। তা মারুক Ñ কিন্তু সেখানে যত আজেবাজে খোঁজখবর! দুনিয়ার কথা জানতে চেয়ে আসল কথায় আসে; বউ-বাচ্চার খবর যদি নিতে চায় তো নিক – কিন্তু চোদ্দজনমের ওপার থেকে নানান খবর নিয়ে আসল কথা বলে। তাই সে chat option-টা সদাসর্বদা ডিসকানেক্ট করেই রাখে। কিন্তু এই এক জায়েদুল, chat option-এ পোন্দাপুন্দি না করলে তার পেটের ভাতই হজম হয় না!
কিরে সজল, তোরে আবার কিয়ে পাইলো…
কিয়ে পাইলো মানে?
তোর বেবাক কলকব্জা নষ্ট!
আরে কী বালের কথা কছ?
হ, কইছি। তর শইল্যে পিরিতির গন্ধ পাইরে হালার পুত।
কী যে বালের কথা কছ তুই! আরে ধুর, কিয়ের কী।
আরে ধুর মানে। কী একখান কবিতা পয়দা অইলো, তাই তোরে শেয়ার দিলাম।
কবিতার পিরিতিতে শ্রেণিশত্র“ নিয়া খেলাধুলা তাইলে শেষ।
শেষ অইছে কেডায় কইলো?
নাইলে অত পিরিতি চুদাস ক্যান?
তুই বুঝবি না।
কেন বুঝবো না?
আরে এইগুলাইন অইলো পোস্টমডার্ন কাজ-কারবার, এইখানে শ্রেণি আছে।
হ, আমারে পোস্টমডার্ন শেখাও।
তবু সজলের ভাবনা থেকে কবিতাটি যায় না। মন্থরাকে ফোন দেবে? নাকি সেলফোনে মেসেজ পাঠাবে। এসব ভাবতে ভাবতে কিছুই করা হয় না। শুধু একটা মেসেজ সে পাঠায় Ñ এমন কবিতাই-বা কেন যে আসে, এভাবে নিদ্রাবীজই কেন আসে। ওগো সহবর্ণা, সহমরণা মোর, সুধাও মোরে।
এই করেই সে তাড়াতাড়ি অফিসের জন্য রেডি হতে থাকে। সে মেসেজ পাঠায় Ñ আমার নীরবতা নাই; আমি মূলত, ক্রিয়াত, এবং কার্যত নির্জনতার সংকটে ভুগছি। জীবনকে ভাগ করে দিচ্ছি, বাজারের কেঁচকি ভাগার মতো সব বিলিয়ে দিচ্ছি। আমার সময় নাই, লজ্জা নাই, এমনকি আবরণ নাই। আমি ২৪টা ঘণ্টা তোমারই নাগালের মানুষ। আমার কোনো আড়াল নাই। ওগো মন্থরা, ওগো জীবনঘন খোঁজাখুঁজির মানুষ, তুমি কি এই ইহধামে নাই। আল্লার দরবারে ফেসবুক পৌঁছে, তিনার সেলফোন নম্বর কত? তাকে আমার শুধানো দরকার। সবার নম্বর থাকবে, তিনি কী করে নম্বরহীন থাকেন?
এর জবাব আসে পাক্কা সাতটা দিন পর।

Sorry, the whole day was packed up for Mother’s day stuff. I was in a rush.  Sometimes I wonder and feel as if my ‘mind’ left me in the middle of no where.

তাই! তাইলে ভালো থাইকেন, ভালো রাইখেন…
ভালো থাইকেন ভালো রাইখেন! কী যে মজার কথাগো। I love it. Take care and have a good day. Hope, we talk again.

তারা পরস্পর কথা সৃজন করে, এতে কী যে মমতা জমা হয়। শান্তা Ñ শান্তা মাহজাবিন তালুকদার, তাই জানায়।
কীভাবে আমার প্রতি এত মমতা জমা হয়েছিল।
জানি না তো। জগতের জানার চেয়ে না-জানাই অনেক আরাম!
কী যে বলেন।
কই কী বললাম। বলাবলি ছাইড়া দিছি!
এইসব জানি না, কিছু একটা আছে।
কী জানি, জানি না।
আসলে এ-ব্যাপারগুলো বড়ই মধুর। ভিন্ন ভাষায় বলি?

When it happens it happens Ñ no one can make it happen.

Yes, that’s ok. সে বলে এই কথা, শান্তা, কীভাবে বলে, কীভাবে তার কাছে নাজেল হয়, তাই চিন্তা করে। সজল ভাবে, ভাবতে আবারও কামিনী-হাসনাহেনা-বেলির গন্ধ নেয়। অথবা সেই গন্ধই তার আশপাশ ঘুরঘুর করে। লাটিমের মতোই ঘুরে। তীব্র গন্ধের ভেতর আবারও বৈশাখের বৃষ্টির ফোঁটা জমতে থাকে। তাতে ভিজে যায় সে। বৃষ্টি পড়ছে, এ যেন আকাশের তীব্র কান্না।  সে-কান্না থেকে নিজেকে সরিয়ে রাখার মানসে আবারও সজল ঘরপানে ধায়। কিন্তু শান্তা ওরফে মন্থরার আর খবর নেই। কথার মজা নাই। শুধু আগের মতোই লেখালেখির সার নিয়ে কথা বলতে বলে, একে অন্যকে আপনি আপনি করে বলার রুলনিশি কে যেন জারি করে! জায়েদুল এ নিয়ে তুমুল হাউকাউ করে Ñ এবার ঠেলা বুঝো। স্বাদের করপোরেটের চুদন সামলাও। তা নিয়েও শান্তার তেমন ভাবান্তর নাই। এটাই নাকি এখনকার নমিত বিধি! এতদূর থেকে সেলফোনে কথা বলে। ঘটনা কী। সজল ভাবে, সময় পার হয় তো হয় না; তাই সে ফেসবুকে মেসেজ পাঠায়, Ñ ওগো নির্জনপিপাসু নারী, এ কেমন উদাসীনতা, এ কেমন নিপীড়ন হে, যেন শ্বাসনালিতে টিপে ধরল কেউ? দারুণ বেহিসাবী মানুষটা একজনের কাছে কত যে মেনি বিড়াল হয়ে গেলাম। (জায়েদুল এসব জানতে জানতে খ্যাক-খ্যাক করে হাসে। কয় – শালা তোরে করপোরেটের পুন্দানিয়ে পাইছে Ñ হেই মাগির মনে কী যে আছে! নির্জনতা নিয়া ব্যবসা চুদায়!) জানি না! যেন মন্থরা থেকে মন্থরাকে গায়েব করে আরেক মন্থরার বন্দনা করে পাঠাচ্ছে – এটা তো ঠিক যে তুমি নিজেকে সরিয়ে নিলে, আমার এতবড় স্বপ্ন একেবারে তাসের ঘরের মতোই ভেঙে যাবে। এ বড় আশ্চর্য, জীবন সম্পর্কে যেন সে নতুন ফিলসফি জারি করল Ñ আসলে জীবন অনেকভাবেই আবিষ্কৃত হয়।
কী যে বলেন – উদাসীনতা, গলা টিপে ধরা, আপনি আমার কাছে কেবলই মেনি বিড়াল হতে পছন্দ করা শুরু করলেন! আমি খুবই খুবই অস্থিরতা বোধ করি এসব শব্দে। করছিও। সজল, কী করে থামাই আপনাকে! প্লিজ এসব কথা আর না। বললাম না, অনেক ভয়ে ভয়ে শব্দ বসাই, যদি কিছু করে ফেলি। বলুন হে সজল, আপনার মনের ভাবকে কম মূল্য দিই! এক সময় দেখি, আমি সেখানে, আছি কি? হয়তো আছি বা নেই। একটা ঘোরের ভেতর পড়ি। আমি শান্তা, আমিও অনেক নারীর ভেতর যাই। তাদের সঙ্গে  আমিও নানান কাজ করে চলি। আমরা কতিপয় নানা ঘরানার নানা জীবনের মানুষ, নানান নারীও তো বটেই, একসঙ্গে, এরই পরদেশে কাজ করি। জীবন বানাই, ফের ভাঙি। অন্য কোনো দেশের, অনেক অনেক দেশের কোনো এক মানবসন্তানের জন্য আমি জীবনের সরঞ্জাম সৃজন করছি। বালিকা-স্বভাবের আমরা, কতিপয় মানবী, যারতার কাজে মগ্ন-নিমগ্ন।
আবারো অনেকদিন শান্তার খবর নেই। যেন সে নির্জনতার বিচিত্ররূপী চাষাবাদ করছেন! নতুন নতুন বিধির নিশানা কে যেন ঠিক করে দিচ্ছেন। তারও পরে এক মেসেজ আছে –  Just had a proper shower after… not to worry much. I had been having little pain in my chest. It’s all ok. (Just need to take care of me a bit more 🙂 WILL HAVE ASPIRIN FROM NOW TO HELP MY BLOOD THINNING. WE WILL TALK TOMORROW. Thanks for caring. নিশ্চয়ই ম্যাডাম; আপনার সঙ্গে মতবিনিময় করছি না যেন বিদ্যুতের তলোয়ার ফেইস করছি! (একটা তীব্র-ধারালো খিনখিনে হাসি যেন এপার ওপার বইতে থাকে!)
তারপরের কথার কোনো দিশা পায় না সজল। আসলে তার  ভেতর কী যেন কী কাজ করে। সে যেন আসলে বোকার মতোই শান্তাসনে সিরিয়াস হয়ে যেতে থাকে। সজল জানায় Ñ স্যরি, আমার মনে হচ্ছে আপনার ভাবনায় অন্য কোনো জট পাকিয়ে গেছে। তবে এটাই আমার হাহাকার যে, আপনার সর্ববিষয়ে আমি বোকার মতোই কৌতূহলী হয়ে গেলাম।
তবে শান্তা জানায় Ñ নির্জনতার ভিতরই যেন কথা সৃজন হতে থাকে : I shall treasure your lovely comments on me ever. and hopefully when we meet Ñ we will have an interesting conversation on this… one day. তার বাদে বিশাল লম্বা এক নীরবতা; তাই সজল আবারও জানায় Ñ কী যে হয় আমার, কী করে যে কতকিছু হয়! সবই যেন কেমন নড়বড়ে হয়ে যাচ্ছে! কী যৌথ কম্পনের এক নিশানা টের পাওয়া যায়! আবার মেসেজ আসে Ñ যতœ দিও, যতœ নিও…
সময় অতি থেমে-থেমে, মার্বেলের মতো গড়িয়ে গড়িয়ে পার হয়! আবারও নির্জনতাকে পিষে ফেলার মতোই একটা মেসেজ আসে Ñ আপনার আগামী বছর আরো অনেক সুন্দর হবে Ñ অনেক ভালো লেখা হবে Ñ সৃজনশীলতার কুসুমে সুবাসিত হবেন Ñ এই আমার কামনা। শুভ নববর্ষ।
বাংলা নতুন বছরের শুভেচ্ছা পায় সৌভিক সজল Ñ তা নিয়ে সে অত ভাবতে চাইছে না।  সে আবারও শান্তাকে স্পেশাল মেসেজ পাঠায় Ñ তাও হতে পারে, আমি হয়তো সব ধরতেই পারি না। হয়তো আমি ভুল অঙ্কের ভুল মানুষ। আপনি তো আমাদের কী সব স্বার্থ-টার্থ বিষয় বলে সেই যে গেলেন আর খবর নাই। আমি বলব একেবারেই ঠিক করেননি। তা অবশ্য আপনার ব্যাপার। স্যরি, আমি আপাতত গল্পের হিসাবে থাকতে চাই আর-কী। আমি বেসিক্যালি অনার্য-চাঁছাছোলা টাইপের মানুষ। ফলে সুন্দর, ভালো ইত্যাদি শব্দের প্রতি আলাদা কোনো মোহ নেই। সৃজনশীলতার কুসুম তো আরো চিনি না! তবে এটুকু বুঝতে পারছি, আপনার সঙ্গে মতবিনিময়ের যে পর্যায়ে আমি ছিলাম তা থেকে ব্যাক করা আমার জন্য দারুণ যন্ত্রণার ব্যাপার হয়ে গেছে। আমি আবারো একই কথা বলছি, আমার এ ক্ষতসমূহকে লালন করার বিষয়! আমি আপনাকে শুধু একজন শান্তা হিসেবেই দেখতে চাইছিলাম। আমার মনোপীড়ন আমি একাই বহন করতে আছি। আপনার তাতে কোনো কাজ আছে বলেও মনে হয় না।
আবারো নীরবতা পুনঃপাঠের মতোই শান্তা জানাতে থাকে Ñ আচ্ছা, আমরা আমাদের নীরবতা আবার যাচাই করতে পারি না! প্লিজ, একটু ভাবুন। আসুন না, আমরা পরস্পরের কাজগুলো পড়ি। কী কাজ, এত ঢঙের ভেতর আবার কী কাজ! সজলের এমন বাক্যের পর আবার যেন ওহি নাজেল হয় Ñ যেমন আগেও আমরা পরস্পরের নানাবিধ বিষয় নিয়ে কথা বলতাম, লেখা পড়তাম, আচ্ছা নিজেদের ভেতর নিজেদের জানাশোনা ক্রমাগত বাড়তে থাকলে ক্ষতি কী? আপনার সৃজনশীলতা এমন উদ্ভাসিত যে, আপনাকে অনুরোধ করে ফেলেছিলাম Ñ একেবারে সরাসরি ফোন করেই আপনাকে ইনভাইট করলাম! আসলে আমার দীর্ঘদিনের লেখালেখির বন্ধুদের এখন ততো পাই না। তারা কমই ফেসবুকে আসেন। একে অন্যকে জানার সুযোগ পাই না আমরা। আপনাকে মনন করি আর লেখা পড়ি Ñ কমেন্টস শুনি যেন ক-ত চেনা। আমি অমন করে বলে ঠিক করিনি। আপনিই সঠিক। আমাদের সমসাময়িক গল্প করলে অনেক ভালো হবে। আর আপনার চেয়ে আমার উপকার হতো বেশি বলেই আমার বিশ্বাস। তাহলে ওই কথাই রইল।
তাহলে কী কথা রইল! কথা তো রয়ে যায়।
না, মানে আবার আমরা আমাদের সৃজন করি!
কী সৃজন বলুন তো। আরে বলুন না… কোথায় আপনি? নাই নাকি?
তার বাদে সজলের কথার কোনো ধরনের রেসপন্স আর হয় না। শালার নেটও কত আস্তে চলে, যেন পাহাড়ি রাস্তায় গরুর গাড়ি চালাচ্ছে সে। সময় পার হয় Ñ তাদের ভেতর বহুকালের অনেক অনেক নির্জনতা নামে যেন। জায়েদুল যে আবার শরীর দুলিয়ে হাসে, তার পাঠানো মেসেজের সুবাদে সব জানা হয়ে যেতে থাকে। তাকে সজল বলে, চলো একদিন বসে কথা বলি। এসব কথার এক আনাও পাত্তা দেয় না সে। তবে সে জানায়, হালায় তুমি নির্জনতা চুদাও।
তবে কোনো একদিন, বা, কোনো এক ক্ষণে, সজল সবাক হয় Ñ তাকে মেসেজে জানায়, আপনি অনেক কথাই বললেন, তুমি থেকে আপনিতে প্রমোশন নিলেন Ñ তবে তা গল্পকারদের বেহুদা ভাষণের মতোই অনেক বেশি সাংকেতিক! ফলে, অনেককিছুই আমি বুঝতে পারছি না। কেন এ-ধরনের নীরবতা পালন করছেন, তাও জানি না।
আপনাকে, আমাকে, অমুককে, তমুককে বুঝে নেওয়ার বিষয় আছে না?
ও তাই, বিষয়টা তাহলে বুঝে নেওয়ার।
হ্যাঁ, তাই।
এমন কী কথা ছিল গো দন্ত্যন-রমণী।
দন্ত্যন-রমণী?
হ্যাঁ তাই তো।
হি-হি-হি (মনে করবেন না জান ফাটিয়ে হাসছি, তার কী উপায় আছে, বাসার মানুষটা তো ঘুমের ভেতরও আমার কথা শুনতে পায়?)
তাই!
এত ভালোবাসা?
আবার ফাইজলামি শুরু করলেন?
না হে দন্ত্যন-রমণী?
এর মানে কী?
এরই মধ্যে যে তুমিকে আপনিতে প্রমোশন নিলেন; আর তাতে সমাপিকা ক্রিয়ার পর সমানে দন্ত্যন বসাচ্ছেনই।
হি-হি-হি, ও তাই?
জি ম্যাডাম তাই।
দেখা যাক।
কী দেখা যাবে?
আজ আর নয়, অনেক রাত হলো। বাই।
স্যরি – বাই। যাই হোক, ভালো থাইকেন, ভালো রাইখেন।
ভালো থাইকেন, ভালো রাইখেন Ñ কে কাকে ভালো রাখে। ভালো কীভাবে থাকা হয়! ফেসবুকের অপরপক্ষ থেকে আবারও নির্জনতা নামে। বহুকালের নির্জনতা যেন! এমনকি আরো কিছু আচানক বৃত্তান্ত ঘটতে থাকে। তাদের সৃজিত মেসেজ তাদেরই সামনে ক্রমাগত মুছে যেতে থাকে। আবারো সেলফোনে হঠাৎ  পযধঃ করার তাগাদাজনিত বুতুর-বুতুর মেসেজের শব্দ হয়, অচেনা একটা নাম্বার থেকে ক্রমাগত মেসেজ আসে :  Sorry, did you wake up or, it is a message from ago? Delete it forever.

আবারো নীবরতা নামে। কেন এত নীরবতা! এই নীরবতাও কি আরো কোথাও না কোথাও আনাগোনা করে?

Shouvik Sazal is typing…