কে নজরুল, কেন নজরুল

কে নজরুল? আর কেনই-বা নজরুল? সচেতন কোনো বাঙালির পক্ষে এ-প্রশ্নের উত্তর দেওয়া খুব কঠিন বলে মনে হয় না। তবু এই প্রশ্ন উত্থাপনের পেছনে আছে নজরুলকে নতুন করে বোঝার আকাঙ্ক্ষা, আছে নজরুলের প্রাসঙ্গিকতা অনুধাবনের বাসনা। কে নজরুল? সহজ উত্তর – হাজার বছরের বাঙালির ঋদ্ধ ইতিহাসের ধারায় অন্যতম শ্রেষ্ঠ এক বাঙালির নাম কাজী নজরুল ইসলাম। একজন স্রষ্টা এবং কর্মযোগী মানুষের নাম কাজী নজরুল ইসলাম। সাহিত্য ও সংগীতের মাধ্যমে একটি জাতিকে জাগিয়ে তোলেন যিনি, তিনিই নজরুল। ঔপনিবেশিক শক্তির বিরুদ্ধে এক প্রবলপ্রাণ বিদ্রোহীর নাম কাজী নজরুল ইসলাম। মানবতার তূর্যবাদক এক সেনানীর নাম নজরুল, অসাম্প্রদায়িক চেতনার এক সংহত রূপের নাম নজরুল। পত্রিকার মাধ্যমে দেশবাসীকে জাগাতে চান যিনি, প্রেমের অধরা মাধুরীর কথা কবিতা ও গানে শোনান যিনি, স্বাধীনতার পক্ষে দাঁড়ান যিনি, শাস্ত্রাচার-লোকাচার আর সাম্প্রদায়িক শক্তির বিপক্ষে কলম ধরেন যিনি তিনিই নজরুল। কতভাবেই তো নজরুলের পরিচয় তুলে ধরা যায়।

কাজী নজরুল ইসলামকে স্রষ্টা এবং কর্মযোগী মানুষ হিসেবে দেখতেই আমি ভালোবাসি। জন্মের পর একশ বিশ বছর অতিক্রান্ত, তাঁর নীরব হওয়ার পর কেটে গেছে সত্তর বছরেরও বেশি সময়, মৃত্যুর পরও আমরা পেরিয়ে এসেছি বিয়ালিস্নশ বছর; তবু বাংলাভাষী মানুষের কাছে নজরুল ইসলামের অব্যাহত প্রভাব দেখে বিস্মিত না হয়ে উপায় নেই। তাঁর সাহিত্যকর্মের পরিমাণ বিপুল, লিখেছেন চার হাজারের বেশি গান, সম্পাদনা করেছেন একাধিক পত্রিকা, সরাসরি সংশিস্নষ্ট ছিলেন রাজনীতিতে, সংযোগ ছিল মানবকল্যাণমূলক অনেক প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে। দ্বিমাত্রিক এই প্রয়াস এবং উদ্যোগের কথা স্মরণ রেখেই আমি দেখতে চাই, ভাবতে ভালোবাসি নজরুলকে।

যাকে বলব বহুমাত্রিক সাহিত্যপ্রতিভা, নজরুল তার উজ্জ্বল উদাহরণ। কবিতা, উপন্যাস, ছোটগল্প, নাটক, প্রবন্ধ, ছড়া, ব্যক্তিগত রচনা, চিঠিপত্র, সংগীত – কোন রূপকল্পে না লিখেছেন নজরুল? রবীন্দ্রনাথের প্রবল পরাক্রমের সময় আবির্ভূত হয়েও বাংলা কবিতায় একটা স্বতন্ত্র পরিচয় নির্মাণে সমর্থ হয়েছেন নজরুল। আমাদের কবিতার ধারায় তিনিই প্রথম শিল্পী, যিনি রাজনীতিকে রূপান্তরিত করেছেন শিল্পে। রবীন্দ্রনাথ এবং তিরিশি কবিদের সমকালে কবিতা লিখেও তিনি মুহূর্তেই চিনিয়ে দিলেন তাঁর প্রাতিস্বিক স্বর। নজরুলের দ্রোহচেতনা সঞ্চারিত হলো ঘুমন্ত এক জাতির মর্মমূলে। কবিতাও যে হতে পারে জাগরণের শক্তি-উৎস, নজরুলের কবিতা পাঠেই তা প্রথম জানল বাঙালি জাতি। ঔপনিবেশিক শক্তির বিরুদ্ধে বিদ্রোহের জয়পতাকা উড়িয়ে বাংলা কবিতায় তিনি আবির্ভূত হলেন বন্ধনমুক্ত প্রমিথিউসের মতো। কবিতায় নজরুল উচ্চারণ করেছেন মানবতার জয়, কামনা করেছেন প্রান্তবাসী নিম্নবর্গের উত্থান। তাঁর কবিতায় পরাক্রমশালী বিদ্রোহীর পাশেই আছে কুলি-মজুর-কৃষক-শ্রমিক আর ধীবরের দল, আছে সাঁওতাল-গারো-ভীল জনগোষ্ঠী। তিরিশের কবি জীবনের প্রতি বীতশ্রদ্ধ হয়ে যেখানে উচ্চারণ করেন ‘সহে না সহে না আর জনতার জঘন্য মিতালি’, নজরুল সেখানে উচ্চারণ করেন, কবিতায়, ‘চাইনে সুর, চাই মানব’। ফ্যাসিবাদের উগ্র আগ্রাসনের মধ্যে বাস করেও রবীন্দ্রনাথ যেমন বলেন ‘মানুষের প্রতি বিশ্বাস হারানো পাপ’, তেমনি অভিন্ন চেতনায় নজরুলের কণ্ঠে উচ্চারিত হয় ‘আমি আজো মানুষের প্রতি আস্থা হারাইনি। মানুষকে আমি শ্রদ্ধা করি, ভালবাসি। স্রষ্টাকে আমি দেখিনি, কিন্তু মানুষকে আমি দেখেছি। এই ধূলিমাখা, অসহায়, দুঃখী মানুষই একদিন বিশ্ব নিয়ন্ত্রণ করবে।’ এই মানবতাবাদী চেতনাই কাজী নজরুল ইসলামের কবিতার কেন্দ্রীয় সুর। সুস্পষ্ট মানববন্দনা সমকালের সাহিত্যধারায় নজরুলকে স্বকীয় মাত্রায় প্রতিষ্ঠা দিয়েছে। কবিতায় নজরুল মানুষকে বিবেচনা করেছেন সাম্যবাদীর দৃষ্টিতে, কোনো ভেদচিন্তা সেখানে শিকড়ায়িত হয়নি। স্মরণ করা যায় তাঁর বহুল উচ্চারিত এই পঙ্ক্তিগুচ্ছ :

গাহি সাম্যের গান –

  মানুষের চেয়ে বড় কিছু নাই, নহে কিছু মহিয়ান্।

  নাই দেশ-কাল-পাত্রের ভেদ, অভেদ ধর্ম জাতি,

  সব দেশে, সব কালে, ঘরে ঘরে তিনি মানুষের জ্ঞাতি।

(‘মানুষ’, সাম্যবাদী)

অসাম্প্রদায়িক চেতনা কাজী নজরুল ইসলামের কবিতার বিশিষ্ট লক্ষণ। তাঁর কালের অন্য কবিদের সাম্প্রদায়িক বলছি না, তবু এ-কথা জোরের সঙ্গেই বলব, কাজী নজরুল ইসলামই বাংলা ভাষার প্রথম অসাম্প্রদায়িক কবি। দ্বিমাত্রিক ঐতিহ্যবোধে ঋদ্ধ ছিল নজরুলের সৃষ্টিশীল-মানস। জন্মসূত্রে ভারতীয় উত্তরাধিকারকে তিনি গ্রহণ করেছেন আপন উত্তরাধিকার হিসেবে; অন্যদিকে, ধর্মবিশ্বাসসূত্রে তিনি অর্জন করেছেন পশ্চিম এশিয়ার ইতিহাস ও ঐতিহ্য। দ্বিমাত্রিক এই ঐতিহ্যচেতনা শিল্পী নজরুলের মানসলোকে উপ্ত করেছে অসাম্প্রদায়িকতার বীজ। নজরুলের সৃষ্টিচৈতন্যে সম্প্রদায়নিরপেক্ষ এই চেতনা সদা সক্রিয় থাকার কারণেই উচ্চারিত হয় এমন প্রত্যয়দীপ্ত চরণগুচ্ছ ‘অসহায় জাতি মরিছে ডুবিয়া, জানে না সন্তরণ,/ কাণ্ডারী! আজ দেখিব তোমার মাতৃমুক্তিপণ।/ ‘‘হিন্দু না ওরা মুসলিম?’’ ওই জিজ্ঞাসে কোন জন?/ কাণ্ডারী! বলো ডুবিছে মানুষ, সন্তান মোর মা’র’ (‘কাণ্ডারী হুঁশিয়ার’, সর্বহারা)। নজরুল প্রচলিত ও সনাতন ধর্ম-চেতনার ঊর্ধ্বে উঠে, কবিতায়, মানবধর্মের  জয়গান গেয়েছেন। প্রচল ধর্মাচরণে তাঁর ছিল না কোনো বিশ্বাস। তাই স্পষ্ট করেই তিনি ঘোষণা করেন এই কথা :

কাটায়ে উঠেছি ধর্ম-আফিম-নেশা

ধ্বংস করেছি ধর্ম-যাজকী পেশা

ভাঙি’ মন্দির, ভাঙি’ মসজিদ

ভাঙিয়া গির্জা গাহি সঙ্গীত,

এক মানবের একই রক্ত মেশা

কে শুনিবে আর ভজনালয়ের হ্রেষা।

     (‘বিংশ শতাব্দী’, প্রলয়-শিখা)

নজরুল ধর্মের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করেননি, তিনি বিদ্রোহ করেছেন ধর্ম-ব্যবসায়ীর বিরুদ্ধে। একালে যেমন, সেকালেও তেমনি, ধর্মকে শোষণের প্রধান হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছে। তাই ভ- মোল্লা-মৌলভি আর পুরোহিতের বিরুদ্ধে সংগ্রামে তিনি ছিলেন সোচ্চার। রুদ্র-মঙ্গল গ্রন্থে তিনি লিখেছেন, ‘হিন্দুত্ব মুসলমানত্ব দুই সওয়া যায়, কিন্তু তাদের টিকিত্ব দাড়িত্ব অসহ্য, কেননা ঐ দুটোই মারামারি বাঁধায়। টিকিত্ব হিন্দুত্ব নয়, ওটা হয়ত প–ত্ব। তেমনি দাড়িত্ব ইসলামত্ব নয়, ওটা মোল্লাত্ব। এই দুই ‘ত্ব’ মার্কা চুলের গোছা নিয়েই আজ এত চুলোচুলি। আজ যে মারামারিটা বেঁধেছে, সেটাও এই প–ত-মোল্লায় মারামারি, হিন্দু-মুসলমানের মারামারি নয়। … অবতার-পয়গম্বর কেউ বলেননি, আমি হিন্দুর জন্য এসেছি, আমি মুসলমানের জন্য এসেছি, আমি ক্রীশ্চানের জন্য এসেছি। তাঁরা বলেছেন, আমরা মানুষের জন্য এসেছি, আলোর মতো, সকলের জন্য। কিন্তু কৃষ্ণের ভক্তেরা বললে, কৃষ্ণ হিন্দুর; মুহম্মদের ভক্তেরা বললে, মুহম্মদ মুসলমানদের; খ্রীস্টের শিষ্যেরা বললে, খ্রীস্ট ক্রীশ্চানদের। কৃষ্ণ-মুহম্মদ-খ্রীস্ট হয়ে উঠলেন জাতীয় সম্পত্তি। আর এই সম্পত্তি নিয়েই যত বিপত্তি। আলো নিয়ে কখনো ঝগড়া করে না মানুষ, কিন্তু গরু-ছাগল নিয়ে করে।’

বস্ত্তত মানুষকে, মানুষের ধর্মকে নজরুল বড় করে দেখেছেন আজীবন। তিনি চেয়েছেন মানুষের কল্যাণ, সমাজের মঙ্গল, স্বদেশের স্বাধীনতা। তাই হিন্দু বা মুসলমান নয়, বিদ্রোহের জন্য মানুষের প্রতিই ছিল তাঁর উদাত্ত আহবান। তিনি কল্পনা করেছেন এক সাম্যবাদী সমাজের, যেখানে নেই শোষণ, বৈষম্য আর সাম্প্রদায়িক ভেদ, নেই আদি-জনগোষ্ঠীর প্রতি কোনো তুচ্ছতাবোধ :

গাহি সাম্যের গান –

যেখানে আসিয়া এক হয়ে গেছে সব বাধা-ব্যবধান,

যেখানে মিশেছে হিন্দু-বৌদ্ধ-মুসলিম-ক্রীশ্চান।

গাহি সাম্যের গান।

কে তুমি? পার্সী? জৈন? ইহুদী? সাঁওতাল, ভীল, গারো?

কনফুসিয়াস? চার্বাক-চেলা? বলে’ যাও, বল আরো।

…      …     …  

মিথ্যা শুনিনি ভাই,

এই হৃদয়ের চেয়ে বড়ো কোনো মন্দির কাবা নাই।

     (‘সাম্যবাদী’, সাম্যবাদী)

মানুষের প্রতি অপরিসীম ভালোবাসা আর বিশ্বাস ছিল বলেই চরম সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার মুখেও নজরুল অবলীলায় শ্যামাসংগীত আর বৃন্দাবন-গীত রচনা করেছেন; লিখেছেন গজল, ব্যাখ্যা করেছেন তৌহিদের একেশ্বরতত্ত্ব। তিনি জাতি-ধর্ম-বর্ণ
নির্বিশেষে অসাম্প্রদায়িক চেতনায় সকল মানুষের কল্যাণ কামনা করেছেন। তাই যখন খ–তভাবে তাঁকে উপস্থাপন করা হয়, তখন তাঁকে অপমানিতই করা হয়। তাঁকে গ্রহণ করতে হবে সমগ্র দৃষ্টি দিয়ে। মনে রাখতে হবে, তিনি যেমন হামদ্-না’ত্-গজল লিখেছেন; তেমনি লিখেছেন কীর্তন, শ্যামাসংগীত আর শাক্ত-পদ। কোনো কোনো ক্ষেত্রে কালী-কীর্তন ও না’ত্ রচনায় তিনি প্রায়-সমার্থক চিত্রকল্প নির্মাণ করেছেন। যেমন, তাঁর একটি বিখ্যাত কালী-কীর্তনে আছে :

আমার কালো মেয়ের পায়ের নীচে

দেখে যা আলোর নাচন

মায়ের রূপ দেখে দেয় বুক পেতে শিব

যার হাতে মরণ বাঁচন \

আমার কালো মেয়ের আঁধার কোলে

শিশু রবি শশী দোলে

মায়ের একটুখানি রূপের ঝলক

ঐ স্নিগ্ধ বিরাট নীল গগন \

(‘বনগীতি’)

চাঁদ-সূর্যের এই চিত্রকল্প নজরুলের একটি অতিপরিচিত ‘না’তে একই ব্যঞ্জনায় নির্মিত হয়েছে :

তোরা দেখে যা আমিনা মায়ের কোলে।

মধু পূর্ণিমারই সেথা চাঁদ দোলে।

যেন ঊষার কোলে রাঙ্গা রবি দোলে\

(‘জুলফিকার’)

 কাজী নজরুল ইসলাম বিদ্রোহী কবি হিসেবেই বাঙালির কাছে সমধিক পরিচিত। ঔপনিবেশিক শোষণ, সামন্ত-অত্যাচার এবং ধর্মীয় কুসংস্কারের বিরুদ্ধে সচেতন বিদ্রোহী রূপে বাংলা কবিতায় আত্মপ্রকাশ করেছেন নজরুল। রোমান্টিক অনুভবে মানবতার সপক্ষে তিনি উচ্চারণ করেছেন বিদ্রোহের বাণী, সত্যসুন্দর মঙ্গলের আকাঙ্ক্ষায় তিনি বিদ্রোহ ঘোষণা করেছেন যাবতীয় অপশক্তির বিরুদ্ধে, ধর্মীয় শোষণের বিরুদ্ধে এবং জীর্ণ পুরনো মূল্যবোধের বিরুদ্ধে। পরাধীনতার গস্নানিতে নজরুলচিত্ত দীর্ণ হয়েছে, এবং এই গস্নানি থেকে মুক্তির অভিলাষে তিনি হয়েছেন বিদ্রোহী। তবে, কেবল দেশের স্বাধীনতা-কামনাতেই তাঁর বিদ্রোহীচিত্তের তৃপ্তি ছিল না, তাঁর বিদ্রোহ ছিল একাধারে ভাববাদী ও বস্ত্তবাদী। তাঁর বিদ্রোহ ছিল পরাধীনতার বিরুদ্ধে সোচ্চার, সকল আইনকানুনের বিরুদ্ধে উচ্চকণ্ঠ, ইতিহাসনিন্দিত চেংগিসের মতো নিষ্ঠুরের জয়গানে মুখর, ভৃগুর মতো ভগবানের বুকে পদাঘাত-উদ্যত, মানবধর্ম-প্রতিষ্ঠায় দৃঢ়সংকল্প, ধ্বংসের আবাহনে উচ্ছ্বসিত, সুন্দরের প্রতিষ্ঠায় উদ্বেলিত।

নজরুলের সাহিত্য, বিশেষত কবিতা, হয়ে উঠেছে অপশক্তির বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার শাণিত আয়ুধ। নজরুলের সাহিত্যে প্রধানত ত্রিমাত্রিক বিদ্রোহভাব পরিলক্ষেত হয়। এই ভাবত্রয় এরকম :
ক. অসত্য অকল্যাণ অমঙ্গল ও অন্যায়ের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ,
খ. স্বদেশের মুক্তির জন্য ঔপনিবেশিক শক্তির বিরুদ্ধে বিদ্রোহ, এবং গ. শৃঙ্খল-পরা ‘আমিত্ব’কে মুক্তি দেওয়ার জন্য বিদ্রোহ। এই ত্রিমাত্রিক বিদ্রোহকে বাসত্মব রূপ দেওয়ার জন্য নজরুল ভারতীয় পুরাণ এবং পশ্চিম এশীয় ঐতিহ্যকে স্মরণ করেছেন। এক ঐতিহ্য থেকে আরেক ঐতিহ্যে নজরুলের পদচারণার উদ্দেশ্য ছিল সমাজ বিনির্মাণের জন্য বিদ্রোহের সপক্ষে শক্তির সন্ধান করা। ‘রক্তাম্বরধারিণী মা’ কবিতায় তিনি দেবী চ-ীর অসুরনাশিনী শক্তি আহবান করেছেন সামাজিক অসুরশক্তিকে ধ্বংস করার বাসনায়। ধ্বংসের শেষে কবি কামনা করেছেন সৃষ্টির উল্লাস :

দেখা মা আবার দনুজ-দলনী

         অশিব-নাশিনী চ-ী-রূপ;

দেখাও মা ঐ কল্যাণ করই

                    আনিতে পারে কি বিনাশ-সত্মূপ।

শ্বেত-শতদল-বাসিনী নয় আজ

            রক্তাম্বরধারিণী মা,

ধ্বংসের বুকে হাসুক মা তোর

            সৃষ্টির নব পূর্ণিমা।

(‘রক্তাম্বরধারিণী মা’, অগ্নি-বীণা)

বাংলার সামাজিক সত্মরবিন্যাসে কাজী নজরুল ইসলামের অবস্থান ছিল ‘তলের তলে’ (bottom of the bottom)। নিম্নবর্ণের অভিজ্ঞতা অধীত বিদ্যা দিয়ে নয়, বরং বাসত্মবতার নিরিখেই তিনি অর্জন করেছিলেন। লক্ষ করলেই দেখা যাবে, নজরুলসাহিত্যে অধসত্মন বঞ্চিত দলিত ও প্রান্তবাসী জনগোষ্ঠীর কথাই তীব্রভাবে চিত্রিত হয়েছে। নিম্নবর্গ হিসেবে, প্রান্তজন হিসেবে নজরুল কখনো বিস্মৃত হননি নিজের অবস্থান এবং কখনো পরিত্যাগ করেননি সে-জনগোষ্ঠীর প্রতি তাঁর অঙ্গীকার ও দায়বদ্ধতা। তিনি ধীবর, শ্রমিক, কৃষকদের নিয়ে কবিতা লিখেছেন, নিম্নবর্গের মানুষের জীবনসংগ্রাম অবলম্বনে লিখেছেন ছোটগল্প ও উপন্যাসে।
এ-প্রসঙ্গে তাঁর মৃত্যুক্ষুধা উপন্যাসের কথা বিশেষভাবে মনে পড়ে। এ-উপন্যাসে কৃষ্ণনগরের চাঁদ সড়কের নিম্নবর্গের মুসলমান ও রোমান ক্যাথলিক পরিবারের মধ্যে পারস্পরিক সম্পর্ক, দ্বন্দ্ব ও সহযোগ এবং জীবনসংগ্রাম রূপলাভ করেছে। মৃত্যুক্ষুধা উপন্যাস যে শিক্ষিত নগরবাসীর প্রেম-প্যাঁচাল নয়, উপন্যাসের গোড়াতেই নজরুল তা স্পষ্ট করেন এভাবে ‘জাতিধর্ম নির্বিশেষে এদের পুরুষেরা জনমজুর খাটে অর্থাৎ রাজমিস্ত্রি, খানসামা, বাবুর্চিগিরি বা ঐ রকমের কোনো-একটা কিছু করে। আর, মেয়েরা ধান ভানে,
ঘর-গেরস্থালির কাজকর্ম করে, রাঁধে, কাঁদে এবং নানান দুঃখধান্দা করে পুরুষদের দুঃখ লাঘব করবার চেষ্টা করে। বিধাতা যেন দয়া করেই এদের জীবনের দুঃখকে বড় করে দেখবার অবকাশ দেননি। তাহলে হয়ত মসত্ম বড় একটা অঘটন ঘটত।’

মৃত্যুক্ষুধা উপন্যাসে এই প্রতিপাদ্য শেষ পর্যন্ত অক্ষুণ্ণ ছিল প্যাঁকালের মা আর মেজবউর জীবনসংগ্রাম উপন্যাসে সঞ্চার করেছে নতুন মাত্রা। সমষ্টিগত প্রান্তজন ক্রমে ব্যক্তিতে রূপান্তরিত হয়নি মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের পদ্মা নদীর মাঝি উপন্যাসের কেতুপুর গ্রামের ধীবরগোষ্ঠী কুবের-কপিলার প্রেমখেলায় পথহারা হয়নি, macro-জীবন পতিত হয়নি micro-গহবরে। এখানেই নজরুলের ঔপন্যাসিক প্রতিবেদনের স্বকীয়তা। নজরুল চেয়েছিলেন প্রান্তজন উঠে আসুক কেন্দ্রের ভূগোলেশূদ্ররাই শাসন করুক পৃথিবীকে। প্রসঙ্গত নজরুলের ‘লাঙল’ প্রবন্ধের কথা মনে পড়ছে। ওই প্রবন্ধে নজরুল লিখেছেন :

ব্রাহ্মণ-পাদরির রাজত্ব গিয়াছে। গুরু-পুরোহিত, খলিফা, পোপ নির্বংশ-প্রায়। শত সম্রাট ও সাম্রাজ্য সব ধসে পড়েছে। রাজা আছেন নামে মাত্র। আমেরিকা, ইংল্যান্ড প্রভৃতি দেশে এখন বৈশ্যের রাজত্ব। এবার শূদ্রের পালা। এবার সমাজের প্রয়োজনে শূদ্র নয়শূদ্রের প্রয়োজনে সমাজ চলবে।
হিন্দু-মুসলমান সমস্যা, ব্রাহ্মণ-অব্রাহ্মণ সমস্যা সব লাঙলের ফালের মুখে লোপ পাবে।                      

     (‘লাঙল’)

নারীকে প্রাকৃতিক লৈঙ্গিক পরিচয়ে না দেখে নজরুল দেখেছেন সামাজিক লৈঙ্গিক তথা জেন্ডার দৃষ্টিকোণে। ফলে অতি সহজেই তিনি কবিতা-গান-কথাসাহিত্যে নারীর ব্যক্তিত্বের সন্ধান পেয়েছেন, নারীর চিত্তে দেখেছেন বিপুল শক্তির সমাবেশ। ‘সাম্যবাদী’ কবিতায় তিনি ঘোষণা করেছেন নারীর বিপুল মহিমা, মৃত্যুক্ষুধার মেজবউকে দিয়েছেন সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষমতা, আর ‘রাক্ষুসী’ গল্পের বিন্দিকে তো দিয়েছেন অসামান্য এক ব্যক্তিত্ব-পরশ।

কাজী নজরুল ইসলাম নিম্নবর্গ তথা প্রান্তজনের যে নতুন ডিসকোর্স বা সন্দর্ভ নির্মাণ করেছেন, তাদের উত্থানের যে রক্তাক্ত ছবি সৃষ্টি করেছেন, সেখানে প্রায়শই ভাবনাগুলো বেরিয়ে এসেছে নারীর বয়ানে। কেন? উত্তরটা এই নারীরাই হচ্ছে তলেরও তল; কখনো তারা ছিদামের ঘরের চন্দরা, কখনো পাঁচুর বাপের বউ বিন্দি, কখনোবা প্যাঁকালের মা কিংবা মেজবউ। রবীন্দ্রনাথের চন্দরা মেনে নিয়েছে ছিদামের খেলা, কিন্তু একদম মানেনি বিন্দি। তাই পাঁচুর বাপের পরকীয়া বিন্দিকে বুঝিয়ে দেয় পুরুষরাক্ষসের অতল ক্ষুধা এবং একসময় হত্যা করে পাঁচুর বাপকে। বিন্দির এই আচরণ আইনের চোখে কীভাবে বিবেচ্য সে ভিন্ন প্রসঙ্গ, কিন্তু ওই আচরণের মধ্যে নজরুলমানসের যে গোপন আকাঙ্ক্ষা অভিব্যক্ত, সে-কথাই আমাদের অন্বিষ্ট। বিন্দিকে যে রাক্ষুসী হতে হলো, তাকে যে
বিকৃতির পঙ্কে হতে হলো নিমজ্জিত, সেখানে পাই প্রামিত্মক নারীর স্বপ্ন ও সংগ্রাম, ভালোবাসা ও প্রতিহিংসার অবিমিশ্র রূপ। নিম্নবর্গের নারী কীভাবে খুঁজে পায় আপন ঠিকানা, কীভাবে জ্বলে ওঠে তার
স্বাধিকার-প্রমত্ত সত্তা, কীভাবে প্রামিত্মকতার সীমানা পেরিয়ে প্রান্তজন গ্রহণ করে আপন সিদ্ধান্ত, বিন্দির নিম্নোক্ত বয়ান তার অভ্রান্ত উদাহরণ :

আমার সোয়ামী একা ঐ অবাগীদের বাড়ির পেছনের তেঁতুল গাছটার তলায় বসে … চারিদিকে তাকিয়ে দেখলুম কেউ কোথাও নেই। … আমি আঁচলে দা’টা লুকিয়ে দৌড়ে বাঘিনীর মত গিয়ে ওঃ সে কি জোরে তার বুকে চেপে বসলুম। সে হাজার জোর করেও আমায় উলটিয়ে ফেলতে পারলে না। তার ঘাড়ে মসত্ম একটা কোপ বসিয়ে দিতেই আমার হাতটা অবশ হয়ে এল। তখন সে দৌড়ে পাশের পাটক্ষেতটায় গিয়ে চিৎকার করে পড়ল! আমি তখন রক্তমুখো হয়ে উঠছি। আমি আবার গিয়ে দুটো কোপ বসাতেই তার ঘাড় হতেই মাথাটা আলাদা হয়ে গেল! তারপর খালি লাল আর লাল! আমার চারিদিকে শুধু রক্ত নেচে বেড়াতে লাগল।

     (‘রাক্ষুসী’)

বর্তমান সময়ে জ্ঞানচর্চার ধারায় Post-colonial Discourse বা উত্তর-ঔপনিবেশিক তত্ত্ব অত্যন্ত আলোচিত একটি বিষয়। সাহিত্য, শিল্পকলা, রাজনীতি ও সংস্কৃতি ব্যাখ্যায় এই তত্ত্ব বিশেষ প্রভাব বিস্তার করেছে। কাজী নজরুল ইসলামের সাহিত্যকর্ম উত্তর-ঔপনিবেশিক তত্ত্বের আলোকে বিবেচনা করলে ভিন্ন এক সত্যের সন্ধান পাব আমরা। ঔপনিবেশিক শাসনামলে এক জটিল সময়-সংক্রামিত্মতে বাংলা সাহিত্যে কাজী নজরুল ইসলামের দীপ্র আবির্ভাব। উপনিবেশিত বাংলার অধিবাসী হয়েও কাজী নজরুল ইসলাম স্বকালের অনেক লেখকের মতো ঔপনিবেশিক জ্ঞানকাণ্ডের অন্ধ অনুসারী হননি, বরং তিনি নির্মাণ করতে চেয়েছেন ভিন্ন এক জ্ঞানকা-। এই ভিন্নতার সাধনাই বাংলা সাহিত্যের ধারায় তাঁকে এনে দিয়েছে নতুন এক অর্জন, যাকে নিঃসন্দেহে শনাক্ত করা যায়
উত্তর-ঔপনিবেশিক ডিসকোর্সের প্রতিফলন হিসেবে। উত্তর-ঔপনিবেশিক চৈতন্য খুঁজতে চায় নিজেকে, খুঁজতে চায় উপনিবেশিতের ঠিকানাকে, সত্তাকে, অসিত্মত্বকে। নিজের স্বর-সন্ধান তথা আত্ম-আবিষ্কারই এই ডিসকোর্সের প্রধান আহবান। নজরুলের রচনায় নিজেকে খোঁজার প্রয়াস আছে, তিনি জাগতে ও জাগাতে চেয়েছেন আপন শক্তিতে, আবিষ্কার করেছেন নিজেকে, ‘বিদ্রোহী’ কবিতায় ঘোষণা করেছেন, ‘আমি চিনেছি আমারে, আজিকে আমার খুলিয়া গিয়াছে সব বাঁধ।’ নজরুলের রচনায় যেসব যুগান্তকারী বৈশিষ্ট্য রূপলাভ করেছে, উপনিবেশিত সমাজের একজন লেখকের কাছ থেকে তা সচরাচর পাওয়া যায় না। উত্তর-ঔপনিবেশিক নজরুল বাংলা সাহিত্যে যথার্থই এক বিরল, ব্যতিক্রমী, প্রাতিস্বিক, অদ্বিতীয় এবং অনতিক্রান্ত প্রতিভা।

বিষয়ের পাশাপাশি সাহিত্যের প্রকাশরীতি তথা ভাষা ব্যবহারেও নজরুল নিজস্বতার পরিচয় দিয়েছেন। বিষয়ের নতুনত্ব ও কাললগ্নতা প্রধান আকর্ষণ হলেও, নজরুলের কবিতায় প্রকাশশৈলী ও নির্মাণকলাগত স্বাতন্ত্র্য সহজেই লক্ষযোগ্য। শব্দ ব্যবহারে, উপমা-রূপক-উৎপ্রেক্ষাচিত্রকল্প নির্মাণে এবং ছন্দ-সজ্জায় তাঁর স্বাতন্ত্র্য বাংলা কবিতার এক বিরল সম্পদ। নজরুলের কবিতার প্রকাশশৈলীর প্রধান বৈশিষ্ট্য তাঁর স্বতন্ত্র কবিভাষা। শব্দ-ব্যবহারের ক্ষেত্রে নজরুলের স্বাতন্ত্র্য সবিশেষ উল্লেখযোগ্য। বস্ত্তত, রবীন্দ্রনাথের পরে শব্দ-ব্যবহারে ব্যক্তিগত রূপসজ্জার প্রথম প্রকাশ আমরা লক্ষ করি নজরুল ইসলামের কবিতায়। বুদ্ধি ও প্রজ্ঞার প্রেরণায় নয়, বরং আবেগের প্রাবল্যে নির্বাচিত হয়েছে তাঁর শব্দমালা। কোনোরূপ বিচার-বিবেচনার দাসত্ব স্বীকার না করে স্বাধীন স্ফূর্তিতে তিনি চয়ন করেছেন তাঁর প্রিয় শব্দরাজি। শব্দ-ব্যবহারের ক্ষেত্রে ঐতিহ্যসচেতনতা নজরুলের কবিভাষায় নিয়ে এসেছে স্বকীয় মাত্রা। শব্দচেতনায় ‘সেকুলারাইজেশন’ নজরুলের কবিসত্তার বিশিষ্ট লক্ষণ। ভারতীয় পুরাণের নানা শব্দ ও অনুষদ তাঁর কবিতায় যেমন ব্যবহৃত হয়েছে, তেমনি সমগুরুত্বেই ব্যবহৃত হয়েছে পশ্চিম এশীয় ইতিহাস-ঐতিহ্যের নানা বিষয়, তৎসম-তদ্ভব শব্দের পাশেই
শিল্প-সার্থকতায় ব্যবহৃত হয়েছে আরবি-ফারসি শব্দ। হাজার বছরের বাংলা সাহিত্যের ধারায় কাজী নজরুল ইসলাম প্রকৃতপ্রস্তাবেই একজন মৌলিক লেখক। নজরুলের নানামাত্রিক ভাবনা বর্তমান সময়েও, তাঁর কালের মতোই, সমান প্রাসঙ্গিক। অব্যাহত প্রাসঙ্গিকতাই নজরুল-সাহিত্যের কালোত্তীর্ণতার কেন্দ্রীয় উৎস। আমরা আমাদের প্রয়োজনে নজরুল ইসলাম ও তাঁর ভাবনাকে কীভাবে ব্যবহার করতে পারি সেটাই হওয়া উচিত একালে নজরুলচর্চার মৌল বিষয়। আমাদের ব্যক্তিক এবং রাষ্ট্রীয় প্রয়োজনেই নজরুল হয়ে উঠুক প্রতিদিনের চর্চার বিষয় – এটাই আমাদের আত্যমিত্মক আকাঙ্ক্ষা।